অর্থমন্ত্রীর কথিত সাক্ষাৎকার, ভারতের হাতে ব্যবহৃত!


অর্থমন্ত্রীর কথিত সাক্ষাৎকার, ভারতের হাতে ব্যবহৃত!

গৌতম দাস

১৫ আগস্ট ২০২২, ০০:০৬ সোমবার

https://wp.me/p1sCvy-4cM

 

     Chinese loans: Developing countries must ‘think twice’

গ্রামদেশে একটা শব্দ চালু আছে “ভাঙরি” দেয়া; মানে বিয়ে ভাঙরি দেয়া বা বিয়ে ভেঙে দেয়া। এর মানে, গ্রামের কোনো দুই পরিবারে হয়ত বিয়ে ঠিক হয়েছে; প্রস্তুতি চলছে। কিন্তু সব গ্রামে কিছু লোক থাকে যাদের কাজ হল, বিয়ে ভাঙরি দেওয়া। হতে পারে, তাদের বেশির ভাগ নিজের জীবন নিয়ে প্রচণ্ড হতাশ। হতে পারে তারা অবিবাহিত বা চিরকুমার ধরনের যাদের বিয়ের বয়স পার হয়ে যাচ্ছে, তাই জীবনের আশা দুর্বল। এরা ছেলের পরিবারে গিয়ে রটায় মেয়ের চরিত্র খারাপ অথবা মেয়ের পরিবারে গিয়ে বলে, ছেলের আগে একবার বিয়ে হতে গিয়েছিল বা হয়েছিল – এ ধরনের গল্প-গুজব ছড়ানো এদের কাজ!

ভারতের এখনকার অবস্থা এই হতাশ ভাঙরি দেয়া মানুষের মত। উঠেপড়ে লেগেছে ‘চীন কত খারাপ’- সত্য-মিথ্যা যেভাবে পারে, তা দিয়ে বাংলাদেশ সরকারের কান ভারী করতে। আর ভারতীয় মিডিয়া এই প্রপাগান্ডার উপর ভর করেই দেশ এক দেশপ্রেম-জাগরণের জোশ রচনায় অস্থির হয়ে উঠেছে।  আবার আমাদের সরকারও সময়ে প্রলোভনে পড়ে ভারতের প্রপাগান্ডা শুনতে চাওয়ার ভান করতে গেছে – “যদি কিছু লাইগা যায়” ভেবে। মূলত চুরির অর্থ ডলারে পাচার করতে গিয়েই এই ডলার সঙ্কট যা থেকে এক চরম অস্থির-অনিশ্চয়তা আমাদের অর্থনীতিতে দেখা দিয়েছে। আর তাতে অসহায় বোধ করে সরকার কোথায় কী পাওয়া যায় যেন সব উলটা দেখতে চাইছে; অথচ আগেই জানে ওখানে কিছু পাওয়া যাবে না।

ঘটনা হল, আমাদের সরকারের অর্থমন্ত্রী এ এইচ এম মুস্তফা কামাল কথিত এক সাক্ষাৎকার দিয়েছেন লন্ডন থেকে প্রকাশিত ফাইনান্সিয়াল টাইমস [Financial Times, (FT)] পত্রিকাকে। সেখানে তিনি চীনা ঋণ কত খারাপ ও কেন বিপজ্জনক, তা বর্ণনা করেছেন বলে দাবি করেছে পত্রিকাটা। FT বা এফটি-এর গত ৯ আগস্ট প্রকাশিত ওই রিপোর্টের শিরোনাম হল, ‘বাংলাদেশের অর্থমন্ত্রী চীনা বেল্ট ও রোড ঋণ নেয়ার ব্যাপারে সতর্ক করেছেন’ [Bangladesh’s Finance minister warns on Belt and Road loans from China]। এটা মনে করার ‘যথেষ্ট’ কারণ আছে যে, এই কথিত রিপোর্টের সাথে ভারতের ইন্টেলিজেন্সের সংশ্লিষ্টতা আছে। কারণ পরের দু’দিন ধরে ভারত এই কথিত রিপোর্ট-কে দিয়ে দিনরাত তার চীনবিরোধী প্রপাগান্ডা চালিয়েছে। যেটা একটা দেশের পরিচালকদের যারা মানসিকভাবে সুস্থ তাদের পরিচালিত কোন কাজ ও তার নীতি-পলিসি হতে পারে না।

ভারতে অন্তত দশটা পত্রিকায় [ economic Times IndiaAsiaFinancial ,   Swarajyamag , Hindustantimesmarket.businessinsider , Newsonair , Theweek , Wionews SentinelassamNewsBharati , Statecraft , News18 , OWSA , ANI  ……….. আরও আছে] ছেপে মিথ্যা প্রপাগান্ডার মাতম তুলে ফেলেছে।

সবগুলো নিউজই একই Financial Times  এর বরাতে ছাপা হয়েছে যদিও সেসবের ভাষ্য, নতুন আরো শব্দ ঢুকানো বা লেখার ভলিউম ছোটবড় করা অথবা শিরোনাম আলাদা করা বা নয়া শব্দ ঢুকানো ইত্যাদি করা হয়েছে; যার মূলকথা হল, রিপোর্টটা স্পষ্ট করে চীন কত খারাপ, চীন বিভিন্ন দেশকে “ঋণের ফাঁদে” ফেলে আয় করে চলা একটা দেশ যেন এই টাউটারি-ই চীনের প্রধান আয়ের উতস আর এছাড়া , শ্রীলঙ্কার বর্তমান অর্থনৈতিক সঙ্কটে চীন দায়ী – এসব অর্থ করে এভাবে সাজিয়ে লেখা।
এভাবে পরবর্তীতে ভাষ্যগুলোর লিড আসে হিন্দুস্তান টাইমস থেকে [Bangladesh minister warns against China’s BRI lending, cites Sri Lanka’s example]। যেখানে শিরোনামের সাথে এবার বাড়তি শব্দ যোগ করা হয়, ‘শ্রীলঙ্কার উদাহরণের পরিপ্রক্ষিতে’ বা cites Sri Lanka’s example – এ বাড়তি শব্দগুলো। আর দশ তারিখ বিকালে বাংলাদেশের ‘মানবজমিন’ পত্রিকাও হিন্দুস্তান টাইমসের ভাষ্যটার বাংলা অনুবাদ করে ছাপে। মানে যেন ঘর পোড়ায় আলু পোড়া দিয়ে কিছু পয়সা কামানোর সুযোগ কেউ ছাড়ে নাই।

এফটি [FT]-এর রিপোর্ট ছাপা হওয়ার পরে, প্রায় ৪৮ ঘণ্টা পরে অর্থমন্ত্রী ও তার মন্ত্রণালয় এবার এক রিজয়েন্ডার [rejoinder] বা প্রতিবাদলিপি পাঠান; যা এমরা ১১ আগস্ট সন্ধ্যার পরে একমাত্র টের পাই। কিন্তু মন্ত্রীর প্রতিবাদলিপির ঠিক-ভাষ্যটা কী তা তখনও জানা যায় নাই। কেবল বাংলাদেশের ফাইন্যান্সিয়াল একপ্রেস পত্রিকা একটা সংক্ষিপ্ত ভাষ্য পাওয়া গেছিল। ফাইন্যান্সিয়াল একপ্রেস ওই রিপোর্টে জানায়, মন্ত্রী এক প্রতিবাদ দিয়েছেন যা তারা জেনেছে, “এক অফিস-কর্তার (অনুমান করছি অর্থ মন্ত্রণালয়ের কাউকে বুঝিয়েছে) কাছ থেকে যে বিষয়টা সম্পর্কে ওয়াকিবহাল [‘the official aware of the rejoinder told the FE.’]“। অর্থাৎ এর সোর্স তখনও খুবই দুর্বল।

তবে এর পরের দিন ১২ আগস্ট ভোরবেলা বাংলাদেশ সময় ভোর ৫টার একটু আগে, FT এবার অর্থমন্ত্রীর ওই প্রতিবাদলিপির মূল ভাষ্য প্রকাশ করে। অর্থাৎ আরো প্রায় ১২ ঘন্টা পরে, এর আগে পাবলিকলি কেউ জানতে পারে নাই যে প্রতিবাদলিপিতে কী ছিল। ্কিন্তু এতেই ভারতীয় সকল মিডিয়া আন-মুভড থাকে। মানে কেউই তাদের মিথ্যা প্রপাগান্ডা বন্ধ করে নাই। মানে  ১২ আগস্ট সারা দিন ভারতীয় পত্রিকাগুলো যারা এফটি-এর বরাতের নামে খবর ছেপেছিল এই প্রতিবাদলিপির কথা তারা সবাই চেপে গিয়েছে। এমনকি প্রভাবশালী দ্য প্রিন্ট; যার প্রধান সম্পাদক শেখর গুপ্ত যিনি নিজে নিয়মিত কলাম লিখে থাকেন আর সাথে ঐ লেখার এক ভিডিও ক্লিপ-ভাষ্য তিনি নিজে তৈরি করে ইউটিউবে প্রচার করে থাকেন। তিনিও এফটি বরাতে কিন্তু হিন্দুস্তান টাইমসের ভাষ্যটার ওপর ভিত্তি করে তার ভিডিও ক্লিপ প্রকাশ করেছেনসেটা চালিয়ে গেলেন প্রতিবাদ আসার পরেও; যা একটি খাসা চীনবিরোধী “দেশপ্রেমিক” ভারতের প্রপাগান্ডা হয়েছে অবশ্য। অর্থমন্ত্রীর প্রতিবাদলিপিটা ছাপানোর বদলে শেখর গুপ্ত বরং তার প্রপাগান্ডা ক্লিপটাই ১২ আগস্ট সারা দিন প্রচার করে গিয়েছেন, এমনই দেশপ্রেমিক তিনি!!!

কী ছিল মন্ত্রী প্রতিবাদলিপিতেঃ
সার কথায় তিনি লিখেছেন, এরিপোর্টে “মন্ত্রীর প্রকৃত অবস্থানের প্রতিফলন ঘটেনি” [does not properly reflect the minister’s actual position.]। কিন্তু মন্ত্রীর ‘প্রকৃত’ অবস্থানটা কী ছিল তাহলে? পরের প্যারায় মন্ত্রী প্রতিবাদলিপিতে লিখছেন, ‘The report mentioned Sri Lanka’। মানে যেন তিনি না রিপোর্টটা শ্রীলঙ্কার কথা এনেছে!! তাই কী? এমরা নিশ্চিত নই। যদিও এরপর মন্ত্রী শ্রীলঙ্কার অর্থনৈতিক সংকটের মূল কারণ উল্লেখ করেছেন।    উল্লেখ করে বলেছেন – যে (মূলত) “সভরেন লোন নেয়ার কারণে গত মে মাসে শ্রীলঙ্কা ডিফল্টার হয়ে গেছে এবং পরে আইএমএফ এর সাথে চুক্তিতে গিয়েছে”। মন্ত্রীর এই দাবিটা সত্য। আর মন্ত্রী তাই এখন দাবি করেছেন এই রিপোর্ট লিখেছে, বিআরআই (চীনা বেল্ট রোড ইনিশিয়েটিভ লোন) লোনের কারণে শ্রীলঙ্কার অর্থনৈতিক সঙ্কট চরম খারাপ হয়ে গেছে’- এটা তিনি বলেন নাই। অর্থাৎ চীনা লোনের কারণে শ্রীলঙ্কা ডিফল্টার হয়েছে এটা বলেন নাই; বরং আসলে ‘সভরেন ঋণের কারণে সমস্যা হয়েছে’।

পরের প্যারায় মন্ত্রী বলছেন, ‘ চীনা লোন নেওয়ার ব্যাপারে (কাউকে) তিনি সতর্ক করেন নাই”। এ ছাড়া সবশেষে তিনি একটা তথ্যের প্রসঙ্গ তুলে বলেন, ‘২০২১ সালের হিসেবে আমাদের মোট বিদেশী ঋণ ৫১ বিলিয়নের মধ্যে মাত্র ৪ বিলিয়ন হচ্ছে চীনা লোন।’

অর্থাৎ মন্ত্রী বলতে চাইছেন, বাংলাদেশের কোনো অর্থনৈতিক ক্রাইসিস চীনা লোনের কারণে নয়।
তবে বাংলাদেশের টিবিএস পত্রিকা তারাও মনে করে মন্ত্রীর বক্তব্য  বদলানো (ডিস্টোর্ট distort) করা হয়েছে। তারা লিখেছে, “London-based daily Financial Times (FT) published a report recently distorting statements made by Finance Minster তাদের রিপোর্টের প্রথম বাক্য হল এটা। 

মন্ত্রীর এ প্রতিবাদলিপিতে আমাদের প্রাথমিক মন্তব্যঃ
দেখা যাচ্ছে এফটির রিপোর্টার হেরেও হার মানতে রাজি নয়। তিনি প্রতিবাদলিপিটা ছাপবার সময় একটা নয়া শিরোনাম দিয়েছেন, Letter: Why Bangladesh minister is phlegmatic on BRI loans , যেখানে একটা বাঁকা শব্দ তিনি ঢুকিয়েছেন – phlegmatic। অক্সফোর্ড যে শব্দের অর্থ করে আবেগশুন্য unemotional, মানে এক উচ্ছ্বাসশুন্য অবস্থা।  মানে বিআরআই ঋণ নিয়ে মন্ত্রী আবেগশুন্য কেন? এধরণের একটা ভাব বা বক্তব্য এর লেখক বেঞ্জামিন পারকিন দিচ্ছেন। এটা অন্যায় ও অসততা। কারণ প্রথমত একজন মন্ত্রী বলছেন তার কথা বিকৃত বা ডিস্টোর্ট করা হয়েছে। যেটা Financial Times (FT) ও এর রিপোর্টারের জন্য খুবই অসম্মানজনক অভিযোগ। যেটা আসলে বলা হচ্ছে এই পত্রিকা ও এর রিপোর্টার অসৎ ও বিশ্বাস করা যায় না- ইন্টিগ্রিটির অভাব আছে। যেটা একটা মারাত্মক অভিযোগ। অথচ রিপোর্টার সেদিকে মনোযোগ না দিয়ে ফাজলামো করছেন। কেন? এইক রিপোর্ট-টা ইংল্যান্ডের এই অর্থনৈতিক দুর্দিনে কেউ পয়সা দিয়ে করিয়েছে??? তাই মন্ত্রীর এত মারাত্মক অভিযোগ শুনেও এক ইউরোপীয় মন অনড়, প্রতিক্রিয়াশুন্য??? তিনি তো অন্তত বলবেন যে মন্ত্রীর অভিযোগ সত্য না!!! নাকি??? সত্যি এটা এক অদ্ভুত সাংবাদিকতা!!!

কিন্তু মন্ত্রীর এ প্রতিবাদলিপি-ও যেসব প্রশ্নের জন্ম দিয়েছেঃ
১। প্রথমত এ প্রতিবাদলিপিতে এটা এখন সন্দেহতীতভাবে পরিষ্কার যে, মন্ত্রী এফটি-এর সাথে কথা বলেছেন যেটাকে তারা ইন্টারভিউ বলছে।

২. কিন্তু কোন দেশের মন্ত্রী সাক্ষাৎকারে বা সাংবাদিকের সাথে আলাপে কোনো একাডেমিক বা ইন্টেলেকচুয়াল আলাপ কথোপকথনে লিপ্ত হন না, হওয়ার কথা না। এটা তার করণীয় কাজ বা সাবজেক্ট না, এখতিয়ারও না। ফলে শ্রীলঙ্কা কেন সঙ্কটে ডুবেছে এ প্রসঙ্গে তিনি কথা বলবেন কেন? শ্রীলঙ্কা বাংলাদেশের মন্ত্রীর এক্তিয়ারের বাইরে – এটাও কী মন্ত্রী জানা নাই? শ্রীলঙ্কা এনিয়ে কোন আপত্তি বা ব্যাখ্যা চেয়ে বসলে তো আমাদের সরকার কঠিন বিব্রত হবে, মাফ চাইতে হবে??   মন্ত্রী বড়জোর বাংলাদেশের অর্থনৈতিক অবস্থা সম্পর্কে কথা বলবেন। এটাই তার এখতিয়ার। বাংলাদেশে চীনা লোন নিয়েও কথা বলবেন যতটুকু একটা বিদেশি মিডিয়ার সাথে কথা বলার সময় মন্ত্রী হিসেবে তাঁর এখতিয়ার। তবুও সাবধান যে সেটাও – শ্রীলঙ্কা চীনের ঋণ নিয়ে ডুবেছে কিনা – এ বিষয়ে কোনো জবাব না দিয়ে, এড়িয়ে যাওয়া বক্তব্য হতে হবে। শ্রীলঙ্কায় তাদের সমস্যা কার জন্য কী হয়েছে, এর ব্যাখ্যা দেয়ার কাজ আমাদের মন্ত্রীর কোনভাবেই নয়। কোন বিদেশী সাংবাদিক তাকে তবু যদি উস্কানিতে শ্রীলঙ্কা চীনের লোনে ডুবেছে কিনা – এনিয়ে মন্তব্য জানতে চায় তাহলে, অর্থমন্ত্রীর উচিত হবে, ঠাণ্ডা মাথায় ভদ্রভাবে ঐ সাংবাদিককে বিদায় করে দেয়া। আর সাংবাদিককে মনে করিয়ে দেয়া যেতে পারে যে, তিনি অর্থমন্ত্রী –  বাংলাদেশের কোনো পাবলিক ইন্টেলেকচুয়াল না; তাই রিপোর্টার যদি আরও  প্রাসঙ্গিক প্রশ্ন না করতে পারেন বা প্রশ্ন না থাকলে তিনি কথোপকথন শেষ করবেন। কিন্তু জানা যাচ্ছে, মন্ত্রী সেটা করেননি, সাংবাদিকের সাথে মেতেছিলেন। আর রিপোর্টার নির্লজ্জের মত তাঁকে বিক্রি করে দিয়েছে!!

৩। বাংলাদেশের চলতি সরকারের একটি নিয়মিত সমস্যা দেখা গিয়েছে যে, কেন সে চীনের সাথেও সম্পর্ক রাখছে তা ভারতকে ব্যাখ্যা করতে যাওয়া। তবু এই কান্ড যদি সরকার টু সরকার পর্যায়ে হয় যেখানে ফরমাল-ইনফরমাল বহু দিকেই আলাপ হয়ে থাকে যা স্বাভাবিক, সেখানে এমন কিছু হতে পারে। কিন্তু পাবলিকলি বা প্রকাশ্যে মিডিয়া-সাংবাদিকতায় এ্টা একেবারেই কাম্য নয়। কেননা তাহলে এর অর্থ দাঁড়ায়, ভারতকে ট্যাক্স দিয়ে আমাদের যেন চলতে হচ্ছে!!!

ভারতও প্রায়ই এমন দাবি করে থাকে যে, তার পড়শি দেশগুলো যেন ভারতের নিজ বাসার পিছনের বাগানবাড়ি সে দেশগুলো যেখানে ভারত ইচ্ছামতো হাত ঢুকাতে পারে, ফুল তুলে আনতে পারে ইত্যাদি। [এনিয়ে আমার পুরানা কয়েকটা লেখা আছে যার একটা লেখা “এক মফস্বলী জেনারেল” দেখা যেতে পারে।] এই ধারণার আদিগুরু হলেন জওয়াহের লাল নেহরু। তিনি মনে করতেন মানে ভাব করতেন, ১৯৪৭ সালে ব্রিটিশরা ভারত ছেড়ে ফিরে গেলেও ওর বদলে তখন থেকে নেহরু হলেন রানীর নয়া ‘ভাইসরয়’ বা প্রতিনিধি। ফলে ভারতের পড়শি দেশ যারাও ভারতের সাথে বা অংশ হয়ে ব্রিটিশ কলোনির অংশ ছিল, কিন্তু এখন এসব স্বাধীন দেশ হলেও সেই সূত্রে নেহরুর নয়া “কলোনি-অধীনস্থতা” তাদের মানতে হবে।

ভারত এ কথাগুলোই রিপিট করা শুরু করেছিল যখন চলতি শতকে চীনা অর্থনৈতিক সক্ষমতা বেড়ে যাওয়াতে এশিয়া-আফ্রিকা সবখানেই এর চীনা প্রভাব বাড়ছিল। ফলে  ভারতের পড়শি দেশগুলোর উপরও চীনা প্রভাব স্বাভাবিকভাবে বাড়ছিল। কিন্তু ভারত চীনের মতই পালটা নিজ অর্থনৈতিক সক্ষমতা দিয়ে না, যে মুরোদ তার এখনো হয় নাই তাই, বরং নেহরুর সামন্ত-কলোনি স্টাইল দিয়ে কিছু করার খামোখা চেষ্টা করে যাচ্ছে। আর আমাদের সরকারের নিজ দুর্বলতার কারণে বিদেশী সাংবাদিক বা ভারতীয় সাংবাদিক পেলেই তাকে তোষামোদ করতে চেষ্টা করা থেকে এসব সমস্যা তৈরি হয় বলে অনেকে অনুমান করে। খুব সম্ভবত এমন কিছুর ফ্যারে পড়েই মন্ত্রীর এই বিপর্যয়!

৪।  তবে কোন সূত্রে (FT)এফটির প্রতিনিধি অর্থমন্ত্রী পর্যন্ত পৌঁছাতে অ্যাকসেস বা প্রবেশ-অনুমতি পায় ও কথা বলতে পেরেছিল সেটা এক বিরাট কৌতুহল ও রহস্য। অবশ্যই। কারণ মন্ত্রী এই সাংবাদিকের সাথেই চীন কেমন, শ্রীলঙ্কার সঙ্কটে চীনা ঋণের স্বভাব খাসলত কেমন ইত্যাদি যেন এটা তাদের খোশগল্প-আলাপের সাবজেক্ট ছিল, মন্ত্রী সে আলাপ প্রত্যক্ষ-পরোক্ষে করেছেন! আর এমন বিশেষ আগ্রহ বিচার করলে এটা তো ভারতের পলিসি যে চীনকে এক দানব বলে তুলে ধরতে চায়। এছাড়া যেন এই চীন এমন যে, যার বাসার ভাত চড়ে অন্যদেশকে ‘ঋণের ফাঁদে ফেলে – বিভিন্ন দেশ থেকে লুটে আনা পয়সায়’!
কাজেই Financial Times (FT) সাথে অর্থমন্ত্রীর সাক্ষাৎ দেয়ার পেছনের ঘটনার সাথে ভারত আছে, তার ইন্টেলিজেন্স আছে এমন অনুমান প্রবল। বিশেষ করে, বাংলাদেশের অর্থমন্ত্রীর মুখ দিয়ে চীনা ঋণের বিরুদ্ধে বলানো, আর এরপর সেটাকে আরেক দফায় ভারতের আরো দশটা পত্রিকায় আরো কঠোর চীনবিরোধী প্রপাগান্ডা ভাষ্য হিসাবে দ্রুত উপস্থাপন যেখানে আবার সেন্ট্রাল রোলে হিন্দুস্তান টাইমসকে রাখা- এ এক বিরাট খবর ম্যানিপুলেশন, প্রপাগান্ডা-হিন্দুত্বের জাতিবাদী চীনবিরোধী জোশ তৈরি করে ভারতের এক মহা-প্রপাগান্ডা তৎপরতা অবশ্যই!  সেটা ভারত করলে করুক যা ভারত আর চীনের ব্যাপার; কিন্তু ভারত এই প্রপাগান্ডা করেছে আমাদের অর্থমন্ত্রীর কাঁধে বন্ধুক রেখে। যেটা অবশ্যই আমাদের সবার জন্য বদারিং পয়েন্ট! এটা ইনসাল্টিং; বিব্রতকর! তাতে এখন দাঁড়িয়েছে এমন যে, তিনি চীনা ঋণের নিন্দা করেন আর নাই করেন তার চেয়ে বড় ঘটনা হল, তিনি ভারতের হাতে ব্যবহৃত হয়ে গেছেনএবং সেটা জেনে বা না-জেনে!

৫। এফটির রিপোর্টের শিরোনামে একটি শব্দ হল, ‘বিআরআই’ [BRI] লোন মানে বেল্ট-রোড প্রকল্পের লোন। অর্থাৎ এখানে ধরে নেয়া হয়েছে চীনা লোন মানেই যেন তা বিআরআই!  না, তা একেবারেই না। এটা ভারতীয় অনুমান এবং এটা মিথ্যা অনুমান। এর কারণ যখন বেল্ট-রোড প্রকল্প যার শুরুতে ২০১৩ সালে নাম ছিল ওয়ান বেল্ট ওয়ান রোড; আগে কয়েক বছর তা চলার পরে ২০১৭ সালে বিআরআই [Belt road Initiative] নাম দিয়ে সম্মেলন ডাকা হয়েছিল কেবল তখনি ভারত বিআরআই প্রকল্পের প্রকাশ্য বিরোধিতায় নেমেছিল। ভারতকেও দাওয়াত দেয়া হয়েছিল আর তাতে অপারগতা প্রকাশ করতে গিয়ে ভারত প্রথম তার বিরোধিতা প্রকাশ্যে এনেছিল। কাজেই সবকিছুকে  ‘বিআরআই’ বলে হাজির করা নিজের ঘৃণা-বিরোধিতা প্রকাশ এটাই তো ভারতের অবস্থান!
আরেক মজার দিক হল, মোদির ভারতে কি চীনা অবকাঠামো ঋণ নেই? মোদি মূলত ২০১৪ সালের আগে গুজরাতের মুখ্যমন্ত্রী থাকার সময়ই চীনা সখ্যতা, চীনা অবকাঠামো ঋণের পথ খুলেছিলেন। আর সেটাই তিনি প্রধানমন্ত্রী হবার পরে বিস্তার ঘটিয়েছিলেন। কাজেই চীনা অবকাঠামো ঋণ  অবশ্যই আছে; মোদির প্রথম পাঁচ বছরে এ সখ্যতা ছিল ঘোরতর। ভারতের রেলওয়ে আধুনিকায়ন (স্টাফ ট্রেনিংসহ), এছাড়া ভারতের অন্তত পাঁচটা শহর আধুনিক অবকাঠামো নতুন করে গড়ে দেয়াসহ আরো অনেক অবকাঠামো প্রকল্প সেখানে নেয়া ছিল। কিন্তু বিআরআই বিরোধিতার পর থেকে ভারতে চীনা ঋণ বিষয়ে সব পাবলিক ইনফরমেশন সরিয়ে ফেলা হয়েছে। তবে এখানের জন্য সার কথা হল, চীনা ঋণ মানে বিআরআই নয়। যেমন বাংলাদেশের বেশির ভাগ লোন বরং নন-বিআরআই।  যদিও কোনো নন-বিআরআই লোন পরে বিআরআই হিসেবে উভয়পক্ষ মেনে নিয়েছে এমনও হয়েছে। আবার পদ্মা সেতুকে বিআরআই বলে দেখাতে রাজি হননি হাসিনা।
আবার যদি আরেকটু আগাই তবে  চার দেশীয় চীনের কুনমিং-বার্মা-(কক্সবাজার) ঢাকা-কলকাতা [BCIM] যে রেলপথ পরিকল্পনা ছিল সেটা এখন সেভাবে নাই, পরিত্যক্ত। এর বদলে সেটা এখন কুনমিং-বার্মা-(কক্সবাজার) ঢাকা বলে কাজ চলছে। তাতে ভারত সরে গেছে মানে ঢাকা-কলকাতা পদ্মার রেলপথ হলে সেটা দিয়ে কানেক্ট করার কথা ছিল; তা আবার আলাদাভাবে শুধু ঢাকা-কলকাতা হয়ে আছে। ফলে চার দেশীয় ঐ প্রকল্প ছিল সত্যিকার বিআরআই। কারণ কোন প্রকল্পকে BRI বলার প্রধান নির্ণায়ক হল যে মূল বিআরআই এর সাথে তা যুক্ত হবে কীনা!!  যেকোনো অবকাঠামো যা ইউরোপ থেকে সেন্ট্রাল এশিয়া হয়ে চীন হয়ে (সাথে অবশ্য সমুদ্রপথে আফ্রিকা যুক্ত) এরপর এশিয়ায় ছড়িয়ে বিভিন্ন দেশে – এটা হল সেই মূল বিআরআই। এমন মূল বিআরআইয়ে যুক্ত নয় তেমন চীনা প্রকল্পও বাংলাদেশে অনেক আছে। কাজেই সাধারণভাবে চীনা ঋণ না বলে সব ঋণ কে বিআরআই বলার মানে হল যেটা  একমাত্র ভারতই যার সুনির্দিষ্ট করে বিরোধিতা করে!

কেন এসময়ে ভারতের বাংলাদেশবিরোধী প্রপাগান্ডাঃ
আগে যেমনই হোক, গত প্রায় দুই মাস ধরে ভারত বাংলাদেশবিরোধী প্রপাগান্ডা  বাড়িয়েছে। এর প্রধান দুটা কারণ মনে করা হয়। প্রথমটা হল, গত এক দেড় বছর ধরে বাংলাদেশের মাথাপিছু আয় ভারতের চেয়ে বেশি; এটা আইএমএফ-বিশ্বব্যাংকের ডাটা থেকে প্রতিষ্ঠিত। কিন্তু এই ফিগার নিয়ে ভারতে মোদিবিরোধীরা মোদির অর্থনীতি খারাপ চলছে, ফেল করেছে এর প্রমাণ বলে পাবলিক পর্যায়ের সমালোচনা তুলে ধরে এসেছে। সেটা ভোটে প্রভাব ফেলেছে বা আরো ফেলবে বলে মোদির আশঙ্কা। কিন্তু এখন বাংলাদেশ ডলার সঙ্কটে বা আইএমএফের কাছে হাত পেতেছে – এ তথ্য ব্যবহার করে ও ব্যাপক প্রচার করে মোদি তার অভ্যন্তরীণ ভোট-কাটা বিরোধীদের সোজা বা শায়েস্তা করতে চান, এ কারণে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক সঙ্কট নিয়ে ভারত ব্যাপক প্রপাগান্ডা করে তুলে ধরছে।

দ্বিতীয় কারণটাও ভারত এর সাথে যুক্ত করেছে। সেটা হল, বাংলাদেশের অর্থনৈতিক দুর্দশার কারণ হল চীনা ঋণ – এই কথাটা মিথ্যা হলেও ভারতের খায়েস – মিথ্যা প্রপাগান্ডা দিয়ে এটা ছেয়ে ফেলা যাতে ভারত তার চীনবিরোধী প্রচারের সব কাজ সেরে ফেলতে পারে।

                               Chinese naval Hi-tech Tracking Ship Yuan Wang 5 docking at Sri Lanka’s Hambantota Port

এদিকে আমাদের সরকারের এখনকার চাওয়া হল, আমেরিকান অবরোধের চাপের সাথে সে এখন ডলার-অর্থনীতির সঙ্কটে পড়েছে, এখানে ভারত তাকে সহায়তা করুক। চাইছে গত ২০১৩-১৪ সালের মত, বাংলাদেশের ওপর আমেরিকান চাপ ভারত সামলে দিক। কিন্তু কঠিন বাস্তবতাটা হল, ভারত আর আমেরিকা বা বাইডেনের সম্পর্ক আর সেখানেই নাই; ভারত আর সেই প্রিয়পাত্র নাই। আসলে আমেরিকা আর ভারত, এদের উভয়ের স্বার্থ উভয়ের মৌলিক বিরোধী হয়ে দেখা দেয়া শুরু হয়ে গেছে। যদিও তাই বলে এখনই সম্পর্কচ্যুতির ঘোষণা দিলে তা আরো ক্ষতিকর হবে, তাই এটা রুটিন সম্পর্ক করে ফেলে রাখা হয়েছে; যদিও এখনকার পরিস্থিতিটা এমন যেমন,  মূল ফ্যাক্টর ভারত যতই রাশিয়ার সাথে অর্থনৈতিক সম্পর্ক বাড়াতে যাবে তত দ্রুত ভারত-আমেরিকা সম্পর্ক সব ভেঙে পড়বে। যেমন সর্বশেষ উদাহরণটাই দেয়া যাক। গতকাল রয়টার্সের নিউজ হল – ভারত রাশিয়ার অশোধিত তেল গোপনে এনে শোধন করে অন্যদেশকে সরবরাহ করছে – U.S. says India hid Russian origin of fuel shipped to U.S.,] এতে স্বভাবতই বাইডেন ক্ষুব্ধ।
কাজেই এঅবস্থায় আমাদের সরকারের আকাঙ্খা মোতাবেক ২০১৩-১৪ সালের সুখস্মৃতিতে ফিরে যাওয়া অসম্ভব। কিন্তু সব জেনেও এবাস্তবতা মানতে সরকারের মন সায় দেয় না। বিশেষ করে তার ভয়, সে একেবারে একা হয়ে যাচ্ছে। তাই বারবার হাত বাড়ায় আর একটা করে ভারতের ঝাপ্টা খাচ্ছে।
বাংলাদেশ সরকারের এ’আকাঙ্খা ন্যূনতম কোন বাস্তব রূপ দিতে ভারত অক্ষম বটে কিন্তু তাতে কী বাংলাদেশকে লুটে খাওয়া, অপব্যবহার করা এটা এখন ভারতের একটা বড় সুযোগ ও কাজে দাঁড়িয়ে গেছে।

তাহলে অপর কাজটা কী?
পুরানা কাহিনী হল,  চীন-আমেরিকার সম্পর্ক ২০১০ সালের পর থেকে প্রথম তিতা হতে শুরু করেছিল। অন্যভাবে বললে, প্রেসিডেন্ট ওবামা যতই এটা টের পাচ্ছিলেন, ততই বেশি করে চীনকে – বাণিজ্যিক সুবিধায় ছাড় দিতে হবে – ওবামার এদাবিকে জায়গা করে দিয়ে চীন আমেরিকাকে ম্যানেজ করছিল। কিন্তু এটাও অকার্যকর হতে শুরু করে পরে স্পষ্টত ট্রাম্পের দ্বিতীয় বছর থেকে। তবু চীন যেটা মেইন্টেন করে গেছে তা হল – সে দ্বিপাক্ষিক ডায়লগের রাস্তা শক্ত মনোযোগে খোলা রেখে চলতে পেরেছিল। কিন্তু চলতি মাসের প্রথম সপ্তাহে স্পীকার পেলোসির তাইওয়ান উত্তেজনা সব ওলট-পালট করে দিয়েছে। তাতে চীন এখন বাইডেনের ওপর এত ক্ষুব্ধ যে, পাবলিকের ভাষায় বললে, চীন আমেরিকার ফোন ধরছে না। মানে সোভিয়েত ইউনিয়ন-আমেরিকাও, সেকালে কখনো দু’পক্ষ এমন ফোনের নাগালের বাইরে থাকেনি। কারণ এমন বাইরে থাকা মানে তাতে অনিচ্ছাতে বড় সামরিক সঙ্ঘাত যেকোনো সময় টার্ন নিতে পারে, যখন দু’পক্ষের হাতেই কঠিন মারণাস্ত্র মজুদ!

এদিকে এ’পরিস্থিতিতে চীনের একটা হাই-টেক ট্র্যাকিং জাহাজ হাম্বানটোটা বন্দরের দিকে আগাচ্ছিল বন্দর থেকে রিফুয়েলিং ইত্যাদি রুটিন সুবিধা গ্রহণের জন্য। এটা অসামরিক গবেষণা মনিটরিং-এর  এক হাইটেক জাহাজ নাম “ইউয়ান ওয়াং ৫“। রয়টার্স লিখেছে, ” Foreign security analysts describe the Yuan Wang 5 as one of China’s latest generation space-tracking ships, used to monitor satellite, rocket and intercontinental ballistic missile launches.”
কিন্তু চীন নিয়ে মানসিকভাবে ম্যানিয়াক ভারত তবু এটা নিয়ে হাইপ বা হৈচৈ তুলবেই। তাই ভারত ততই আমেরিকার মনোযোগ আকর্ষণে যেন এনিয়ে তীব্র আপত্তি হইচই ভারতের অভ্যন্তরীণ মিডিয়ায় তুলেছিল; যদিও ভারতের শেষ লক্ষ্য এসবের কোন কিছু নয়।  আসলে শ্রীলঙ্কায় অর্থনৈতিক সঙ্কটে ভারত নিজের ক্ষুদ্র সক্ষমতার ব্যবহার করে (নগদ বৈদেশিক মুদ্রায় লোন দেয়া নয়); তবে ভারতের ভেতরের বাজার থেকে যা যা রুপিতে কেনা যায় এমন প্রায় পাঁচ বিলিয়ন ডলার মূল্যের চাল-গম ধরনের খাদ্য আর তেল-গ্যাস জ্বালানি ইত্যাদি লোন হিসেবে শ্রীলঙ্কাকে পাঠিয়েছিল। এখন শ্রীলঙ্কায় আপাতত ভারত বা ভারতের সাথে চীনের কোন প্রতিদ্বন্দ্বিমূলক এন্ট্রি নেই; বরং আমেরিকা একা মাতবরি করছে আর সেই খুশিতে ভারত মেটেরিয়াল লোন-সহায়তা নিয়ে এগিয়েছিল। কিন্তু রনিল বিক্রমাসিং নয়া রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হয়ে গেলে ভারতের ভাগে অন্তত সাহায্য-সমতুল্য কর্তৃত্ব-প্রভাব কোন কিছুই আসেনি। কিন্তু এ্টা ভারত আশা করছে। সেই  মনোযোগ আকর্ষণের জন্য আমেরিকার চেয়েও উচ্চৈঃস্বরে চীনা জাহাজের এসফরের বিরোধিতা ও আপত্তি দায়ের করেছিল শ্রীলঙ্কার কাছে। কিন্তু আমেরিকা ভারতের সাথে মিলে শ্রীলঙ্কার সাথে দেনদরবার কিছু করতে যায় নাই। যা করেছে একাই।  ফলাফলে গতকাল সকালেও ভারতের মিডিয়া ভারত কত শক্তিশালী আর চীন কত দুর্বিনীত তার ঢাক পিটাচ্ছিল যেন, ভারত চীনকে ঠেকিয়ে দিয়েছে আর পারলে সে চীনা জাহাজ আর বন্দরের মাঝে ভারতীয়-নৌবাহিনী দাঁড় করিয়ে চীনকে ভাগিয়ে দেয়।
আসলে এনিয়ে গত তিন দিন ধরে ভারতীয় মিডিয়ায় মোদি সরকারের চীনবিরোধী ‘দেশপ্রেম’ আর দেশের কত স্বার্থসচেতন তারা এরই মহিমা প্রদর্শিত হচ্ছিল। এজন্য এর সাথে মিলিয়ে, বাংলাদেশের মন্ত্রীকে ব্যবহার করে “চীন কত খারাপ” এটা তুলে ধরাটা এক বিরাট প্রপাগান্ডা মিডিয়া উচ্ছাস ঘটিয়েছিল।

কিন্তু হায়! ভারতের এক পত্রিকা WIRE গত ১২ আগষ্ট সন্ধ্যায় ভারতের সব উত্তেজনায় ঠান্ডা পানি ঢেলে লিখেছে, শ্রীলঙ্কা সরকার চীন জাহাজকে বন্দরে ভিড়তে অনুমতি দিয়েছে। কারণ, চীন ও আমেরিকার এ বিরোধিতা কেন তারা করছে এর সপক্ষে  যুক্তিগ্রাহ্য যথেষ্ট কারণ তারা দেখাতে পারেনি। আসলে এই ঘটনায় শ্রীলঙ্কা দেখিয়ে দিল এখনও সে ভাত-আমেরিকার ইচ্ছার বিরুদ্ধে সিদ্ধান্ত নিতে সক্ষম!!!

সাংবাদিক না দেশপ্রেমিক, কেবল একটাই বেছে নিতে হবেঃ
এটা এক তত্বকথার ‘হেদায়েত’ বাণী! কী হতে চান, সাংবাদিক না দেশপ্রেমিক? তার মানে হল যেকোন একটা নিতে হবে। দুটোই এক সাথে হওয়া যাবে না। হ্যাঁ, ঠিক তাই। কিন্তু জাতিরাষ্ট্রবাদী উগ্র দেশপ্রেমিকরা হিন্দুত্ববাদীদের মতই ব্যাপারটা বুঝতে নারাজ। আসুন,  তা নিয়ে আলাপ করি। সাংবাদিকতার প্রথম শর্ত হল, ফ্যাক্টস। এতা ফ্যাক্টস বেসজড হতে হবে! একেবারে অবিকৃত বা এদিক-সেদিক মানে করা নয় বা ইঙ্গিত করে বলিয়েছেন, ফেবার করেছেন ইত্যাদি, এমন করা যাবে না। ফ্যাক্টের ওপর দাঁড়িয়ে কাজ করতে হবে।

এখন এভাবে চললে এর অনেক কিছু আপনার দেশের স্বার্থের বিপক্ষে যেতেও পারে। তবু, বাস্তব-সত্য তো সত্যই তা ময়ানতেই হবে। এখন তাহলে আপনি কী চান? যদি সাংবাদিকতা চান তাহলে দেশপ্রেম প্রদর্শন তা হোক না-হোক তা পাশে ফেলে রেখে আপনাকে সাংবাদিকতা বা সাংবাদিক স্বার্থকে উপরে তুলে ধরতে হবে। জার্নালিজমকে ফাংশন করতে দিতেই হবে।
কিন্তু ভারতীয় বর্ষীয়ান সম্পাদক শেখর গুপ্তা সাংবাদিকের আগে দেশপ্রেমিক হতে চান। তাই বাংলাদেশের এই মন্ত্রী-উপাখ্যান নিয়ে ভারতের  তার নির্মিত ভিডিও ক্লিপে তিনি কড়া দেশপ্রেমিক সেজেছেন। অথচ ভারতের পাঁচজন সিনিয়র সাংবাদিকের নাম নিলে তিনি নিজে একজন হবেন। এই হল, ভারতের সাংবাদিক দুর্দশা! সাংবাদিকতাকে চিপায় ফেলে দেশপ্রেমিকের মিথ্যা প্রপাগান্ডায় নেমেছেন তিনি! দেখুন তার ইউটিউব! 

তিনি শেখর গুপ্তা এখানে দুইটা বড় মিথ্যা বলেছেনঃ
এক। হাম্বানটোটা গভীর সমুদ্র বন্দর নিয়ে, এর নির্মাণ ব্যয় নিয়ে এখন শ্রীলঙ্কা সরকারের উপর এই পয়সাও ঋণের বোঝা নাই। কারণ, চীনা সরকারি ঋণের অর্থে এটা নির্মাণের পরেই শ্রীলঙ্কায় এক প্রো-ইন্ডিয়ান সরকার এসেছিল।  তারা দাবি করতে থাকে যে সরকারের পক্ষে এর ঋণ শোধ করা সম্ভব নয়। এটাই তারা আনুষ্ঠানিকভাবে চীনা সরকারকে জানায়। অর্থাৎ ব্যাপারটা দাড়ায় এমন যেন চীনক্বে এখন শ্রীলঙ্কাকে দেয়া ঋণ ফেরত নিয়ে নিতে হবে। ফলে দুপক্ষের আলাপ-আলোচনায় এটা সাব্যস্ত হয় যে তাহলে চীনা সরকার এক প্রাইভেট চীনা কোম্পানী যোগাড় করে দিবে যে নির্মিত হাম্বানটোটা বন্দর কিনে নিবে আর এই বন্দরের আয় থেকে নিজের এই বিনিয়োগ ধীরে ধীরে তুলে নিবে। এটা সাব্যাস্তের পরে নতুন বিতর্ক উঠে বন্দরের কতভাগের মালিক হবে নয়া ক্রেতা। যেহেতু সব প্রকল্পেই অন্তত প্রকল্পের জায়গা-জমি দেয়া বা যাদেরকে সরিয়ে ঐ জায়গায় বন্দর নির্মাণ হয়েছে তাদের পুণর্বাসন ইত্যাদিতে সরকার খরচ করে বলে যেকোন বড় প্রকল্পের ৩০% এর শেয়ার মালিকানা সরকারের হয়-ই। তাই ঐ চীনা প্রাইভেট কোম্পানির শেয়ার মালিকানা এখন প্রকল্পমূল্যের ৭০%।  আর ঠিক একারণের শ্রীলঙ্কা সরকার  হাম্বানটোটা বন্দরের মালিকও নয়, এনিয়ে কোন চীনা ঋণপরিশোধের দায়ও সরকারের নাই। অর্থাৎ শ্রীলঙ্কা সরকার অর্থনীতি ফেল করার পিছনে হাম্বানটোটা বন্দরের কোন ভুমিকাই নাই। অথচ শেখরগুপ্তা হাম্বানটোটা বন্দর নিয়ে চীনবিরোধী মিথ্যা প্রপাগান্ডা চালিয়েই যাচ্ছে।
দুইঃ অন্যান্য চীনা ঋণ শ্রীলঙ্কাকে গছিয়ে দেওয়ার ভারেই ওদেশের অর্থনীতি ঢুবে গেছে?
এটাও শতভাগ মিথ্যা।  এনিয়ে আমার আগের  ১৬ মে ২০২২ তারিখে লেখা শ্রীলঙ্কার দুঃখের নাম ‘ডলার সভরেন  বন্ড’ এখানে বিস্তারিত আছে। শেখর গুপ্তা দাবি করছেন চীনা ঋণই শ্রীলঙ্কার অর্থনঈতি ফেল করার কারণ। অথচ তিনি ফ্যাক্টস অনুসরণ করতে রাজি না। ্তিনি শ্রীলঙ্কা সরকারের দেয়া কোন দেশ বা প্রতিষ্ঠানের কাছে কত ঋণ এই ফ্যাক্টস শীট অনুসরণ করে কথা বলতে চান না। সেটাই নিচে আবার তুলে এনেছি।

এখানে শ্রীলঙ্কার সরকারের দেয়া তথ্য মতে, দেখা যাচ্ছে তাদের নেয়া মোট বিদেশি ঋণের মাত্র ১০% হল চীনা লোন। এজন্য যদি চীনকে দায়ী করা হয় তাহলে শ্রীলঙ্কায় জাপানের ঋণও ১০%, বিশ্বব্যাংকের আরেকটু কম ৯% এছাড়া এডিবিও আরেকটু বেশি ১৩% – এদের সকলকেও দায়ী করতে হয় সমানে!!!। কিন্তু তা না করে কেবল চীনকে দায়ী করা মিথ্যা ও খারাপ উদ্দেশ্যমূলক অবশ্যই, সেটাই শেখর গুপ্তা ও ভারত করে চলেছে।
আর বাস্তবে শ্রীলঙ্কার দুর্দশা বা ডিফল্ট হবার মূল কারণ, নেয়া মোট ঋণের ৪৭%, এক বিশেষ ঋণ। যেটাকে বলে সভরেন ঋণ [Sovereign loan ] যার মানে হল শ্রীলঙ্কা সরকারের ডলার বন্ড বাজারে ছেড়ে বিদেশ (যারা মূলত ব্যক্তি বিনিয়োগকারি) থেকে ডলার সংগ্রহ করেছিল। [সভরেন লোন মানে সরাসরি রাষ্ট্রকেই বন্ধক রেখে ডলার বন্ড ছেড়ে নেয়া লোন।] আমাদের মত দেশের কিছু অতিচালাক নেতা-মন্ত্রীর কাছে এভাবে ডলার বন্ড ছেড়ে ডলার সংগ্রহকে খুব লোভনীয় খুব আরাম ও মজার মনে হয়। কিন্তু তা সব সময়ই ভীষণ রিস্কি এদিকটা তারা ভুলে থাকতে চায়। কারণ এই ঋণ ফেরত দেওয়ার যে কিস্তি তা প্রায়ই সরকার সময়ে ফেরত দিতে পারে না ফলে ডিফল্টার হয়ে যায়। যা থেকে গ্লোবাল ঋণ-বাজারে বদনাম ছড়ায় ব্যাপকভাবে! আর এটাই হয়েছে শ্রীলঙ্কার বেলায়। আর শ্রীলঙ্কার সভরেন বন্ড ছেড়ে নেয়া ঋণ সবচেয়ে বেশি ৪৭%। আর একারণে শ্রীলঙ্কা ডিফল্টার হয়ে আইএমএফের কাছে সারেন্ডার করে লোন চাইতে গেছে। যা বাংলাদেশের বেলায়, সে এখনও কোন ডিফল্টার নয় তবে আইএমএফের কাছে আগেই সারেন্ডার করে লোন চেয়েছে। মন্ত্রী নিজেও তাঁর প্রতিবাদলিপিতে ঠিক এদিকটায় দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন। এদিকটা  অর্থাৎ শেখর গুপ্তা একজন মিথ্যা প্রপাগান্ডার লোক যিনি নিজেকে কোন সম্পাদকের দাবি দূরে থাকে তিনি নিজেকে কোন সাংবাদিকই দাবি করতে পারেন না।

সবশেষের কথা হল, বাংলাদেশের আইএমএফের কাছে চাওয়া ঋণ পেলেও আমাদের আরো ঋণ লাগবে যার সম্ভাব্য দাতা এক চীন ছাড়া সরকার কারো কথা ভাবতে পারছে না। এমনকি আইএমএফ দেরি করলেও এ ঋণ প্রয়োজনীয় বেশি। কিন্তু এ ঋণ অনুমোদনের ক্ষেত্রে সম্ভবত চীনের শর্ত হতে যাচ্ছে, যেসব চীনা প্রকল্প আগে ভারতের আপত্তিতে বাদ পড়েছে বা ঠেকিয়ে রাখা আছে – সেসব এবার আমাদের সরকারকে অনুমোদন দিতে হবে। ভারত সম্ভবত সে জন্য এমন আগ্রাসী! কিন্তু অক্ষম ডেস্পারেট! তাহলে, অর্থমন্ত্রী কী বুঝে এফটি-কে সাক্ষাৎকার দিয়েছেন? যা তাঁকে আবার ফিরিয়ে নিতে হয়!!!

লেখক : রাজনৈতিক বিশ্লেষক
goutamdas1958@hotmail.com

 

[এই লেখাটা দৈনিক “নয়াদিগন্ত” পত্রিকার ১৩ আগষ্ট ২০২২ ওয়েবে আর পরদিন প্রিন্টে অর্থমন্ত্রীর সাক্ষাৎকার এই শিরোনামে ছাপা হয়েছিল। ঐ ছাপা হওয়া লেখাগুলোকে আমার লেখার ‘ফার্স্ট ড্রাফট’ বলা যায়। আর আমার এই নিজস্ব সাইটের লেখাটাকে সেকেন্ড ভার্সান হিসাবে এবং থিতু ভাষ্য বলে পাঠক গণ্য করতে পারেন। আসলে পরবর্তিতে ‘ফার্স্ট ড্রাফট’ লেখাটাকেই এখানে আরও অনেক নতুন তথ্যসহ বহু আপডেট করা হয়েছে। ফলে সেটা নতুন করে সংযোজিত ও এডিটেড এক সম্পুর্ণ নতুন ভার্সান হিসাবে ও নতুন শিরোনামে এখানে আজ ছাপা হল।]

Leave a Reply

Fill in your details below or click an icon to log in:

WordPress.com Logo

You are commenting using your WordPress.com account. Log Out /  Change )

Facebook photo

You are commenting using your Facebook account. Log Out /  Change )

Connecting to %s