বাংলাদেশে মোদির এজেন্ট নাকি কিছু নিজ-বিকল্প
গৌতম দাস
২৯ আগষ্ট ২০২২
এক কাল্পনিক আড্ডার আলাপঃ বিভিন্ন সামাজিক ঝোঁক বা বাক পরিবর্তন নিয়ে যেখানে কথা উঠেছিল। বক্তা নিজেই প্রশ্নটা জানিয়েছিলেন যে বাংলাদেশের হিন্দুরা কেন ভারতমুখি হয়ে থাকে? মানে তিনি এই প্রশ্নের একটা সাফাই নিজেই দিতে চান তাই নিজেই কথাটা তুলেছেন। আর ভারতমুখি বলতে কেউ বাংলাদেশে থেকে আবার ভারতের স্বার্থকেই নিরন্তর নিজের স্বার্থজ্ঞান করে কথা বলে,এভাবে যে নিজেকে তুলে ধরতে চায় এমন কাল্পনিক একজনকে এখানে ধরে নেয়া হয়েছে।
সব রাষ্ট্রেরই নিজ একান্ত কিছু স্বার্থ থাকে যা অবশ্যই অন্য রাষ্ট্র থেকে আলাদা হবেই আর এনিয়ে প্রশ্ন তোলার কিছু নাই। তবে এটা আবার যখন সীমা ক্রশ করে বাড়তে চায় মানে নাগরিক একদেশের কিন্তু আনুগত্য করে বসে অন্যদেশের এবং ভিন্ন দেশস্বার্থের তখন এটা বারবার বাকি সকলের কাছেই খুবই অস্বস্তিকর মনে হবে; এজন্য যে রাষ্ট্রের সাথে নাগরিক-আনুগত্যের এক অবিচ্ছেদ্য সম্পর্ক আছে। এটা অমান্য করতে চায় বলেই এই সীমাছাড়ানির কথাটা আসে। যেমন, কোন দুই ব্যক্তি একবার স্বামী-স্ত্রী হয়ে যাবার পর স্ত্রীর স্বামীর প্রতি বা স্বামীর স্ত্রীর প্রতি এক লয়াল বা আনুগত্যের সম্পর্কের থাকতে বাধ্য। এই বস্তুগত আনুগত্য কোন কারণে যদি কখনও অনুপস্থিত হয়ে যায়, না থাকতে দেখা যায় তবে বুঝতে হবে ঐ সম্পর্ক কার্যত এরা আর স্বামী-স্ত্রী সম্পর্কিত নয়; বা ভান করছে। আর বাস্তবে এথেকেই পরকিয়ার মত কঠিন অমীমাংসিত জটিলতাগুলো তৈরি হয়।
আবার এই ভারতমুখিতার ধরণের ভিতরেও গত বিশবছরে একটা কোয়ালিটিটিভ মানে গুনগত উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন ঘটে গিয়েছে। যেমন আগে, পাকিস্তান আমলে বা বাংলাদেশের আমলে কিন্তু ১৯৯২ সালের আগে দেখা যেত বাংলাদেশি হিন্দুদের বড় অংশই নিজেদেরকে কমিউনিস্ট না হলেও অন্তত প্রগতিশীল বলে পরিচয় তুলে ধরত। আর এই সাথে সেকালের ভারতের হিন্দু মহাসভা, জনসংঘ বা যাদের একালের নতুন নাম বিজেপি-আরএসএস – এদের থেকে দূরে থাকত। অথচ একালে মোদির আমলে বাংলাদেশের হিন্দুরা বিশেষত তরুণেরা মোদিকে তাদের নেতা ও ত্রাতা মনে করে থাকে। এটা এক তাতপর্যপুর্ণ পরিবর্তন সন্দেহ নাই।
কিন্তু এই পটভুমিতে বক্তা চেষ্টা করছিলেন কেন এমন আনুগত্য সমস্যা তা নিয়ে এর স্বপক্ষে কিছু সাফাই তুলে ধরার। তিনি জানাচ্ছিলেন যে, একটা দেশের কোন কোন জনগোষ্ঠি তো অনেক রকম ভিন্নতায় অনেক কিছু চাইতেই পারে। সেকালের পুর্ববঙ্গ বা পুর্ব-পাকিস্তানের হিন্দুরা তো ‘পাকিস্তান’ চায় নাই। তারা তো পশ্চিমবঙ্গের সাথে এক থাকতে চেয়েছিল। কথা বাস্তব সত্য এবং কথা তাদের মনের কথা সন্দেহ নাই। কিন্তু এই চাওয়া কী সঠিক ছিল? তাদের স্বার্থের পক্ষে ছিল?
এককথায় বললে, আপাত দৃষ্টিতে সঠিক ও নির্দোষ এবং ইনোসেন্ট মনে হলেও এটাই ছিল তার আত্মঘাতি চাওয়া। আজপর্যন্ত বাংলাদেশের হিন্দুদের সমস্ত দুর্দশার মুল ও ভুল এই চাওয়া। সবভুলের উতস এটা। যদিও ১৯৪৭ সালের আশেপাশের প্রেক্ষিতের দিক থেকে বললে, ততদিনে এটা বড় ধরণের ভুল অবস্থান।
কিন্তু কিভাবে এটা বুঝব? তা কী দিয়ে বিচার করব?
সবশেষে এই হলো এই তর্কের মূল প্রসঙ্গ!
একঃ এটা যেকোন রাষ্ট্রগঠনের দিক থেকে এক মৌলিক সমস্যা যে সব নাগরিককে একমত হয়ে চাইতে হয় যে তারা কেমন রাষ্ট্র চায়। মানে কিসের ভিত্তিতে রাষ্ট্র চায় এনিয়ে একমত থাকতে হয় বা হতেই হয়। তবেই এক মৌলিক বিষয়ের সমাধান পাওয়া যেতে পারে। আর সেজন্য কেমন কী ভিত্তিতে রাষ্ট্র গড়তে চাচ্ছি তা প্রস্তাবের সময় খেয়াল রাখতে হয় যেন তা সবার পক্ষে গ্রহণ করা সম্ভব হয় – কেবল এমন কিছুই যেন প্রস্তাব করা হয়। আর এতে ব্যর্থ হলে আগামিতে সব বিরোধে ও ব্যর্থতার শুরু হবে এখান থেকে। ের কিছু সুত্র নির্দেশ করা যেতে পারেঃ –
১। সংখ্যাগরিষ্ঠতার জোরে বা দাবিতে কোন কিছু চাওয়া জায়েজ – এমন মনে করা সবার আগে ত্যাগ করতে হবে।
২। এরই আরেক ভার্সান বা মূলসুত্র হল, সমাজের কেউ অন্যের উপর আধিপত্য প্রতিষ্ঠার ইচ্ছা পোষণ – সেটা গোপনে বা প্রকাশ্যে – এটাই যেকোন রাষ্ট্রের ভেঙ্গে পড়া বা কার্যকর না থাকার মূল কারণ হয়।
৩। তাই এরই উলটা পিঠের মানে ইতিবাচকভাবে বলা কথাটা হল – রাষ্ট্রে হতে হবে বৈষম্যহীন নাগরিক সাম্যের রাষ্ট্র এমন ভিত্তিতে। মানে কেউ সংখ্যাগরিষ্ঠের কারণে বেশি ক্ষমতা ও আধিপত্যের অথবা কেউ সংখ্যালঘিষ্ঠের কারণে কম ক্ষমতা ও আধিপত্যের, কেউ পাহাড়ি বলে বা সাঁওতাল বলে কম ক্ষমতা ও আধিপত্যের আইনি এবং সামাজিক চর্চার মধ্য দিয়ে জীবন যাপন করতেই হবে ইত্যাদি এগুলো বন্ধ করতেই হবে। তাই মুল কথা, নাগরিক অধিকারেরর দিক থেকে নাগরিক সকলেই সমান – এই ভিত্তিতে। এই সাম্য-নীতি সবক্ষেত্রে প্রয়োগ করে সমস্যা সমাধান করতে হবে।
এটাই সংক্ষেপে “নাগরিক অধিকারের সাম্য নীতি” রাষ্ট্র বলা হয়। আরো সংক্ষেপ করতে ‘নাগরিক সাম্য নীতিও’ বলা যেতে পারে।
এখন তাহলে বিচার করা যাক – সেকালের পুর্ববঙ্গ বা পুর্ব-পাকিস্তানের হিন্দুরা তো ‘পাকিস্তান’ চায় নাই – এই বক্তব্যকে যারা বাংলাদেশের হিন্দুদের পক্ষের সাফাই মনে করছিল সেটা কী ঠিক ছিল? বাংলাদেশের হিন্দুরা কী নাগরিক অধিকারের সাম্য নীতি মেনে তাদের প্রস্তাব বা চাওয়া তুলে ধরে ছিল? অবশ্যই না। তাই হিন্দুদের সাফাই সঠিক না, তাদের পক্ষে গেছে বা কাজের হয়েছে তাও না, তাদের কাজে লেগেছে তাও না।
এককথায় বললে, এর মানে, বাংলাদেশের হিন্দুদের পশ্চিমবঙ্গের সাথে এক থাকার দাবি বা যে বাসনা সেটা আসলে মুসলিম লীগের আত্মরক্ষামূলকভাবে “পাকিস্তান” নামে আলাদা রাষ্ট্র কায়েম করার যে দাবি -তারই হিন্দু ভার্সান।
তবে এখানে একটা কথা পরিস্কার থাকা দরকার। অরিজিনালি পাকিস্তান হওয়ার প্রস্তাবটা হিন্দু আর মুসলমান জনসংখ্যার ভিত্তিতে ভাগ হতে হবে – এমন ছিলই না। সেটা আরো অবাস্তবও হত, সেটাও ঠিক। তাই প্রস্তাবটা ছিল মুসলমান সংখ্যাগরিস্ট জেলাগুলোকে নিয়ে পাকিস্তান আলাদা হওয়া। অর্থাৎ দেশভাগের পরে উভয় পক্ষেই সংখ্যালঘু হয়ে পড়া অন্য ধর্মের জনগোষ্ঠি থাকবে এটা অলক্ষ্যে ধরে নেয়াই ছিল। কিন্তু কেবল ছিল না দুই হবু স্বাধীন রাষ্ট্র ভারত ও পাকিস্তান গঠনের জন্য রাষ্ট্রগঠনের ভিত্তি প্রসঙ্গে প্রয়োজনীয় ঐক্যমত।
তবে এখানে একটা কথা পরিস্কার থাকা দরকার। অরিজিনালি পাকিস্তান হওয়ার প্রস্তাবটা হিন্দু আর মুসলমান জনসংখ্যার ভিত্তিতে ভাগ হতে হবে – এমন ছিলই না। সেটা আরো অবাস্তবও হত, সেটাও ঠিক। তাই প্রস্তাবটা ছিল মুসলমান সংখ্যাগরিস্ট জেলাগুলোকে নিয়ে পাকিস্তান আলাদা হওয়া। অর্থাৎ দেশভাগের পরে উভয় পক্ষেই সংখ্যালঘু হয়ে পড়া অন্য ধর্মের জনগোষ্ঠি থাকবে এটা অলক্ষ্যে ধরে নেয়াই ছিল। কিন্তু কেবল ছিল না দুই হবু স্বাধীন রাষ্ট্র ভারত ও পাকিস্তান গঠনের জন্য রাষ্ট্রগঠনের ভিত্তি প্রসঙ্গে যথেষ্ট প্রয়োজনীয় ঐক্যমত।
একথা শুনে হিন্দুদের পক্ষের সাফাই যারা দিতে এসেছিল তারা প্রসঙ্গটা কিছুটা বদলে এবার বলে বসল – এজন্যই তো ধর্মের ভিত্তিতে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার বিরোধিতা বাংলাদেশের (পুর্ববঙ্গের) হিন্দুরা করেছিল। এতে ঐ আসরে তারা ভেবেছিল নিশ্চয় এবার বেশ শক্ত পয়েন্ট তুলতে পেরেছে! তাদের পয়েন্টকে আরো শক্ত-পোক্ত করতে তারা এবার আরো কিছু কথা সাথে জুড়ে দিয়ে বলল, ধর্মের ভিত্তিতে রাষ্ট্রগঠন করার চিন্তা তো খুবই বিভেদমূলক ও পশ্চাতপদ চিন্তা! এই বক্তব্য অবশ্য আমাদের তি্নদেশে কমিউনিস্ট-প্রগতিশীল চিন্তা হিসাবে পরিচিত। কিন্তু তা আসলেই কী??? না বাংলাদেশের হিন্দুদের আসলেই কপালই খারাপ! কেন?
এতদিন মনে করা হত, ধর্মের ভিত্তিতে পাকিস্তান গড়ার কাজটা সব খারাপ কাজের গোড়ার খারাপ কাজটা। এমন ধারণা অনেকেই পোষণ করে থাকেন যে কমিউনিস্ট-প্রগতিশীল চিন্তা এমন এক মোক্ষম কথা তুলে মুসলিম লীগের মুখ বন্ধ করে দিতে পেরেছিল। আর এদের চোখে একাজটা ভারতের কংগ্রেসের চেয়েও ভাল ভাবে করেছিল কমিউনিস্ট পার্টি। কিন্তু ঘটনা আসলে উলটা যা উল্টেপাল্টে বিচার করে দেখাই হয় নাই। কিভাবে?
ধর্মের ভিত্তিতে রাষ্ট্র গড়ার কাজটা যদি ধরে নেই খুবই খারাপ কাজ এমনকি জঘন্য কাজ তবে মুসলিম লীগ বা পাকিস্তান কায়েম করাই এধরণের প্রথম কাজ নয়। ধর্মের ভিত্তিতে রাষ্ট্র গড়ার কাজটা অখন্ড ভারতে সবার আগে করেছে, সবার আগে তুলেছে এবং এই ভিত্তিতে নিজ রাজনীতি ও রাষ্ট্র সাজিয়েছে মুসলিম লীগ নয় – কংগ্রেস – যার পুরা নাম ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস দল। কিভাবে?
১৭৫৭ সালে সিরাজদ্দৌল্লাকে পরাজিত করতে পারলেও নানা সমস্যার কারণে ১৭৬২-৬৪ সাল লেগে যায় ক্লাইভের বৃটিশ ইস্ট -ইন্ডিয়া কোম্পানির ভারতে দেওয়ানি লাভ করতে বা প্রশাসন নিজের হাতে উঠিয়ে নিতে। পরে ঐ কোম্পানি আবার একই সময়ে প্রায় দেউলিয়া হয়ে পড়াতে আর বৃটিশ রাণীর সহায়তায় কিছুটা উঠে দাড়ানোর পরে কোম্পানির প্রধান কাজ হয়েছিল যেভাবেই হোক তাতক্ষণিক রাজস্ব আদায় বা সংগ্রহ। একারণেই বাংলায় ব্যতিক্রমি জমিদার প্রথা (আগাম নগদ রাজস্ব জমা দিয়ে জমিদারি কেনা আর পরে প্রজার কাজ থেকে বছরান্তে খাজনা আদায় করে নেয়া) চালু হয়েছিল। কিন্তু কোম্পানির সেই প্রধান রাজস্ব আয়ের উতস জমিদারি ব্যবস্থাটা থিতু করতেই ১৮০০ সাল লেগে যায়। আর দেখা গেল, ব্যাপক সংখ্যাগরিষ্ঠ জমিদারি কিনেছিল হিন্দু জমিদারেরা। ফলে এরপরেই এই হিন্দু জমিদারদের মাথায় আসে হিন্দু আধিপত্য কায়েম করার।
মনে রাখতে হবে সেকালে প্রধান অর্থনৈতিক কর্মকান্ড বলতে কৃষি তাও আবার সেটা জমিদারি মালিকানায় জমিদার-প্রজা ভিত্তিক সম্পর্কের কৃষি অর্থনীতি। ফলে সবার উপরে বৃটিশ কোম্পানি আর এর নীচে জমিদার হিন্দুর আধিপত্য কায়েমের সমাজ প্রতিষ্ঠা এটাই বাস্তবে কায়েম হয়েছিল। যদিও পুর্ববঙ্গে মুসলমানেরা সংখ্যাগরিষ্ঠ কিন্তু পশ্চিমবঙ্গে হিন্দুরা সংখ্যাগরিষ্ঠ আর কলকাতা সারা ভারতের বৃটিশ রাজধানী বলে অন্তত সারা বঙ্গে জমিদার হিন্দুর ক্ষমতা-আধিপত্য কায়েম সহজ হয়েছিল।
কিন্তু তবু এসবই ছিল অর্থনৈতিক বা মাঠের নয়া শ্রেণীর ক্ষমতা-আধিপত্য কায়েম। কেন এভাবে বলছি?
বলতে চাচ্ছি রাজনৈতিক অংশ এটা নয় তা বুঝাতে। নয়া শ্রেণীর রাজনৈতিক অংশটা তৈরি হয়েছিল আলাদাকরে। তবে অবশ্যই এটা তৈরি হয়েছিল সমকালীন ভাবে। বা বলা যায় অল্প কিছুটা আগে। আর তা ঘটেছিল রাজা রামমোহন রায়ের হাতে তার আত্মীয়সভার আসর থেকে। রামমোহন এর পরিচয় লম্বা না করে এখানে কমিউনিস্ট ইতিহাসে যেভাবে তাঁকে পরিচয় করানো হয়েছে কেবল সেটুকুই তুলে আনছি।
আসলে রামমোহন রায়ের হাতে এক নয়া ধর্মের প্রবর্তন ঘটেছিল ১৮১৫ সালে, এটাই ব্রাহ্ম (ব্রাহ্মণ শব্দ বা ধারণার সাথে এর কোন সম্পর্ক নাই) ধর্ম । ফলে সেই থেকে এখনও যারাই ব্রাহ্ম ধর্ম বা সমাজ এর অনুসারি এরা সকলেই সেসময় থেকেই পারিবারিকভাবে রামমোহন প্রবর্তিত ব্রাহ্ম অনুসারি। সেটা রবীন্দ্রনাথের দাদামশায় (গ্রান্ডফাদার) দ্বারকানাথ ঠাকুর থেকে শুরু করে এখনও পুরা ঠাকুর পরিবার। আবার এদিকে ১৯৩৫ সালে পুনগঠিত প্রথম ভারতীয় কমিউনিস্ট পার্টির মেনিফেস্টো লেখক ও বিশ্ববিদ্যালয়ে ইতিহাসের অধ্যপক সুশোভন সরকার তার সারা পরিবারও ব্রাহ্ম ধর্মের অনুসারি হয়েছিলেন। আর এই সুশোভন সরকারের ইতিহাস বইয়ে রামমোহন রায়কে “বেঙ্গল রেনেসাঁর আদিগুরু” বলে পরিচয় করানো হয়েছে।
কিন্তু তাঁর এভাবে বলার মধ্যে সমস্যা কী হয়েছে তা হয়ত অনেকের কাছেই স্পষ্ট হয় নাই। এছাড়া রামমোহন রায়ের কথা কেন তুললাম তা নিয়ে কৌতুহল থাকা স্বাভাবিক। আর এর সাথে ধর্মের ভিত্তিতে দল গড়ার প্রসঙ্গে কে প্রথম এটা করেছিল সেকথাই এখন স্ইপষ্ট করে বলব।
আমাদের এদিকের ভারত-বাংলাদেশ-পাকিস্তানে (এই তিনদেশে) কমিউনিস্ট প্রগতিশীলদের কাছে রেনেসাঁ বেশ আদরণীয় শব্দ ও ধারণা। রেনেসাঁ অনেকটা বড় মৌল ধারণা বা উতস ধারণার মত বলে ধারণাটাকে মনে করেন তাঁরা। যদিও খোদ কার্ল মার্কস রেনেসাঁ ধারণা দূরে থাক, আধুনিক রাষ্ট্র বা মর্ডার্ন স্টেট (তার ভাষায় ‘বুর্জোয়া রাষ্ট্র’ ) নিয়েও তিনি কোন আগ্রহই দেখান নাই। ভাল-মন্দ বড় কিছুই লেখেন নাই। তাহলে কেন আদরণীয় হল? এর মূল কারণ প্রগতিশীলেরা মনে করেন, রেনেসাঁ ধারণার জপতে থাকলে মানে রেনেসাঁর আড়ালে থাকলে তাতেই অনেক উপকার হবে। তাদের প্রকল্প ধর্ম মানে, ইসলাম কোপানোর স্বপক্ষে খুবই ভাল সাফাই আনা যায় এখান থেকে।
আর এধারণার নগদ খদ্দের হল জমিদার হিন্দু যারা যেন এই ধারণা কিনে নিবার জন্য অপেক্ষা করছিল।
এখন প্রথম প্রশ্নে আসা যাক। শব্দাবলীতে বাক্যটাই লক্ষ্য করা যাক, লিখেছি “সুশোভন সরকারের ইতিহাস বইয়ে রামমোহন রায়কে “বেঙ্গল রেনেসাঁর আদিগুরু” বলে দেখানো হয়েছে। আবার রামমোহন হচ্ছেন ব্রাহ্মধর্মের প্রবর্তক এবং সুশোভনের নিজ ও পরিবার ব্রাহ্ম ধর্মের অনুসারি। তাহলে “রেনেসাঁ আর ব্রাহ্ম” এখানে একসাথে উচ্চারিত হচ্ছে কেমন করে? তাহলে জানা যাচ্ছে একমাত্র কমিউনিস্ট সার্টিফায়েড ধর্ম হচ্ছে তাহলে ব্রাহ্ম। যেটা সত্যিই এক আজীব ব্যতিক্রম বটে!
এনিয়ে সরাসরি কথা বললে, আসলে রামমোহন রায়ই বৃটিশ ভারতে প্রথম জাতিরাষ্ট্র বা মর্ডান রাষ্ট্র ধারণা আনেন। তবে খেয়াল রাখতে হবে এই কল্পনাটা ছিল- ব্রাহ্মধর্ম-ভিত্তিক এক জাতিরাষ্ট্র। অর্থাৎ ভারতের সবাইকে আগে আগে ব্রাহ্ম অনুসারি করে নিয়ে এবার – ব্রাহ্মধর্ম-ভিত্তিক এক জাতিরাষ্ট্র – এমন ভারত ছিল রামমোহনের প্রজেক্ট। সারকথায়, ধর্ম ভিত্তিক রাষ্ট্রের (নেশন স্টেটের) প্রথম ইমাজিনেশনটা আনেন রামমোহন। পরে তার মৃত্যু (১৮৩৩) আর ১৮৭২ সালের মধ্যে ব্রাহ্ম সমাজ গড়ার লড়াইয়ে অনুসারিরা তিনভাগে বিভক্ত হয়ে অচল অথর্ব হয়ে পড়লে এবার সেই প্রকল্পটাকে এবার ব্রাহ্মধর্মের বদলে ‘হিন্দুধর্ম-ভিত্তিক এক জাতিরাষ্ট্র’ – এভাবে বদলে নেয়া হয়। আর এটাই ১৮৮৫ সালে এটাই কংগ্রেস দল নামে আত্মপ্রকাশ করেছিল।
কাজেই দল হিসাবে প্রথম ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দল হল কংগ্রেস। আর এভাবেই প্রকল্প সুনির্দিষ্ট করে হিন্দুরাষ্ট্র হয়ে যাওয়াতে এর বিশবছর পরে ১৯০৬ সালে বাধ্য হয়ে মুসলমান ধর্ম-ভিত্তিক আরেক জাতিরাষ্ট্র’ পাকিস্তান কায়েমের লক্ষ্য নয়া দল হয় মুসলিম লীগ।
কাজেই মুসলিম লীগের পাকিস্তান কায়েমের বিরুদ্ধে কথা বলে বাংলাদেশের হিন্দুদের অবস্থান নেয়া কিন্তু আবার নিজেরা হিন্দু ধর্ম-ভিত্তিক ভারতে যুক্ত হওয়ার বাসনা -এটাই তো আসলে কংগ্রেসি অবস্থান~!!!! ফলে এনিয়ে কোন সাফাই দিতে বা করতে তারা পারে না। এর মানে হয় না।
তাহলে মূল সমস্যা ও সমাধান ছিল, ধর্মভিত্তিক জাতিরাষ্ট্রের ধারণা সমূলে ত্যাগ করা। সকলকে নিয়ে “অধিকারভিত্তিক নাগরিক রাষ্ট্রের” প্রসঙ্গে আলাপ-আলোচনা প্রস্তাব এর কথা বিবেচনা করা এবং সেভাবে আগানো।
স্বভাবতই, নইলে বাংলাদেশের হিন্দুদেরকে সারাজীবন ইসকনের মাধ্যমে ‘মোদির দলের ভাড়াটে বাংলাদেশি’ উইংয়ের সদস্য হয়েই কাটাতে হবে।
গৌতম দাস
রাজনৈতিক বিশ্লেষক
goutamdas1958@hotmail.com