বড় নয়া মেরুকরণ শুরু, উভয় সঙ্কটে ভারত!


বড় নয়া মেরুকরণ শুরু, উভয় সঙ্কটে ভারত!

গৌতম দাস
০৪ অক্টোবর ২০২২;  Published on: Oct 4, 2022 at 00:03

https://wp.me/p1sCvy-4fr

 

  External Affairs Minister S Jaishankar with United States Secretary of State Antony Blinken in Washington DC on Tuesday | ANI

সরাসরি বললে, এতদিন এশিয়ায় এক মুখ্য (পুরানা) মেরুকরণ বিরাজ করছিল যেটার শুরু মোটাদাগে বললে চলতি শতকের শুরু থেকে। কিন্তু চিনব কী করে?  বাংলাদেশের গত ২০০৭ সালের ওয়ান-ইলেভেন থেকে শুরু হওয়া আর পরিণতিতে ভারত-আমেরিকার বসিয়ে দেয়া হাসিনা সরকারকে আমরা অনেকে যেভাবে চিনি আর এটাই হল সেই মেরুকরণের ফলাফল বা ফসল। তাই পুরানা সেই মেরুকরণ বলতে বুঝিয়েছি বাংলাদেশের ওয়ান-ইলেভেন ও সাথের পরবর্তি সরকারকে। অর্থাৎ এই মেরুকরণে মূল বৈশিষ্ট ছিল যে পরিণতিতে এতে ‘আমেরিকা-ভারত-বাংলাদেশ” এরা জায়গা নিয়েছিল একই মেরুতে।  আজ সেই মেরুকরণ এখন ভেঙ্গে পড়ার মুখে; অন্তত আজ ৩ অক্টোবরের সকালের খবর পর্যন্ত; তা খুবই দ্রুত আগিয়ে যাচ্ছে। আর সংশ্লিষ্ট সব পক্ষগুলোরই ভাষা ও ভাষ্যও ক্রমশ বদলে যাচ্ছে!  তবে অবশ্যই এটা তা ভেঙ্গে-গড়া ধরণের। তাই আবার গড়তে বড় আরেক নয়া মেরুকরণ ঘটা শুরু হয়েছে; সেটা ইতোমধ্যে যাত্রা শুরু করে দিয়েছে। যদিও এর বড় ও স্পষ্ট প্রকাশটা ঘটতে আরেকটু সময় নিচ্ছে।

মুখ্য তবে পুরানা মেরুকরণ এর বৈশিষ্ট কী ছিলঃ
ঘটনার পিছনের দিক থেকে তাকিয়ে বললে, এর জন্ম জর্জ ডব্লিউ বুশ [George Walker Bush] বা জুনিয়র বুশের হাতে যার দুই টার্মের প্রেসিডেন্সি হল ২০০১-২০০৯, এই সময়কালে। তাতে আমেরিকার সাথে ভারতের সম্পর্কের নয়া যুগের সুচনা করেছিল। দু-এক বাক্যে বললে, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ-উত্তর পঞ্চাশের দশকের শেষের দিকে রিপাবলিকান প্রেসিডেন্ট আইসেনহাওয়ার (১৯৫৩-৬১) [Dwight D. Eisenhower] এর আমলে (১৯৫৯ সালের ডিসেম্বরে তাঁর প্রথম ভারত সফর), ততদিনে যিনি “সিআইও পাঠিয়ে বিভিন্ন দেশে সরকার ফেলানো” কুখ্যাত অভ্যাস চালুর নায়ক; এভাবে প্রথম “ভারত-আমেরিকার সম্পর্ক” শুরু হয়েছিল সেই ১৯৫৯ সাল থেকে। যদিও ১৯৬২ সালের পর থেকে তা আর ভারতের জন্য সুখকর থাকে নাই। মুল কারণ দুটা।  একদিকে আমেরিকার হয়ে নেহেরুর ভারতের চীনে (তীব্বতের দালাইলামার দেশছেড়ে পলায়ন ও ভারতে আশ্রয় ইস্যুতে) ততপরতা ও আমেরিকার খেদমত করতে গিয়েছিলেন বলে (মনে করা হয় এটাই আইসেনহাওয়ার-নেহেরুর ১৯৫৯ সালের গোপন চুক্তি ); আর তাতে ক্ষুব্ধ চীনের হাতে ১৯৬২ সালে আসাম বেদখল ও মার খাওয়া ছিল ভারতের জন্য খুবই খারাপ অভিজ্ঞতা।
আর এছাড়া অন্যদিকে পারমাণবিক বোমা ইস্যুতে  মূলত, ভারত-পাকিস্তানসহ ছোট দেশগুলো যাতে নিজেরাই পারমাণবিক বোমা সংগ্রহ বা তৈরিতে না আগাতে পারে তাই, আমেরিকা-সোভিয়েত এই ইস্যুতে এক এলায়েন্স করেছিল; আর তাতে যৌথভাবে নানান নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছিল (যা শেষে NPT বা নন প্রিলিফারেশন চুক্তি পর্যন্ত হয়েছিল। এই NPT  চুক্তি ছিল আসলে, UN এর অধীনে এই চুক্তি সদস্যদের স্বাক্ষরের জন্য ওপেন করা হয় ১৯৬৮ সালে আর কার্যকর হয়েছিল ১৯৭০ সাল থেকে।) – আর এদুই ঘটনা থেকে পরবর্তিতে ভারত-আমেরিকার সম্পর্ক একেবারেই ঝুলে যায়, প্রায় ভেঙ্গে পড়ে। যা আর সতেজ থাকে নাই।
তাই এর প্রায় ত্রিশবছর পরে  আর ইতোমধ্যে সোভিয়েত ইউনিয়ন ইতোমধ্যে (১৯৯১ সালে) ভেঙ্গে যাবার সুবিধা নিতে, একমাত্র গত শতকের নব্বইয়ের দশকেরও শেষভাগে এসে ভারত-আমেরিকার সম্পর্ক আবার চালু করতে এবার দুপক্ষ আগ্রহি হয়েছিল। যদিও তা ২০০০ সালের জানুয়ারিতে বিল ক্লিনটনের ভারত সফরে ও তাঁর হাতে তবে ‘সুশীলভাবে’ ঘটেছিল;  আর ক্লিনটনের বিপরীতে তখন ভারতের বিজেপির বাজপেয়ীর প্রথম পুর্ণ প্রধানমন্ত্রী (১৯৯৯-২০০৪) জমানা ছিল সেটা।

তবে ভারত-আমেরিকার সেই সম্পর্কের ভিত্তি ছিল  পরস্পরের পিঠচুলকানোঃ
আর ভারত-আমেরিকার সম্পর্ক ২০০১ সেপ্টেম্বর নাইন-ইলেভেনের পরে তা মূলত উভয়ের  “মুসলমান কোপানো” সুবিধা নিতে তারা ‘জঙ্গী’ বয়ান খাড়া করে এরই মারামারি যুদ্ধের সম্পর্ক হিসাবে। আর তা প্রথম রূপান্তরিত হয়েছিল বুশের হাতে ওয়ার অন টেরর এর পলিসির অধীনে।  অর্থাত নয়া চলতি শতকে ভারত-আমেরিকার সম্পর্ক এর মুখ্য দিক বা ফোকাস ছিল আসলে এক ‘মুসলমান কোপানো্র’ এলায়েন্স। যেটা তাদের উভয়ের জন্য দরকারি ছিল এজন্য যে ১৯৮৯ সালে কাশ্মীরে ভোটে কারচুপি করে এথেকে সৃষ্ঠ ক্ষোভে কাশ্মিরের মুসলমান জনগোষ্ঠিকে প্রথমে কংগ্রেস পরে বিজেপির বাজপেয়ী আরও সুচারুভাবে সেই প্রথম সশস্ত্রতার দিকে ঠেকে দেওয়াতে উদ্ভুত পরিস্থিতি মোকাবিলা। আর ওদিকে আমেরিকার দিক থেকে দরকার তাদের “ওয়ার অন টেররের পলিসির” পক্ষে ভারতের সম্মতি আদায় – এদুই স্বার্থের এলায়েন্স ছিল সেটা। পরবর্তিতে, আরো এগিয়ে ২০০৬ সালে বুশের ভারত সফরের ফলে, তা হয়ে দাঁড়ায় এমন যেটাকে বলা যায়,  ভারত আমেরিকার হয়ে ‘চায়না কনটেনমেন্ট’ বা ‘চীন ঠেকানোর ঠিকা” নেওয়া সম্পর্ক। টাই ভারত-আমেরিকার প্রথম ঘোরতর চীনবিরোধি এক স্ট্রাটেজিক এলায়েন্স ছিলযা এবার সম্পুর্ণ উলটা দিকে টার্ণ নিতে শুরু করেছে আর এবার এই ২০২২ সালের শেষভাগে এসে ভারত-আমেরিকার সম্পর্ক আবার ভাঙ্গাচুড়ে, এক নয়া মেরুকরণ হতে যাচ্ছে। কোন কোন ইস্যু বা ক্ষেত্রে তা ইতোমধ্যেই  প্রবলভাবে শুরু হয়ে গেছে।

ভারতের উপর আমেরিকার এবার প্রথম স্যাংশন জারি শুরু হয়েছেঃ
ভারত-আমেরিকার সম্পর্ক এবারের প্রকাশ্যে  ঢলে পড়ার ঘটনাটা হল, এই প্রথম ভারতের উপর আমেরিকার স্যাংশন জারি। যেমন, ভারতের প্রভাবশালী মিডিয়া দ্যা প্রিন্ট এর এক রিপোর্টের শিরোনাম করেছে – লিখেছে  “জয়শঙ্করের আমেরিকা সফরের পরেই, আমেরিকার প্রথম এক ভারতীয় কোম্পানির উপর, ইরানি তেল আমদানির সম্পর্ক করার জন্য, স্যাংশন আরোপ” [Days after Jaishankar visit, US imposes first-ever sanction on Indian firm for oil trade with Iran]।

অর্থাৎ এর আগে ভারতকে দেয়া আমেরিকার বাণিজ্যিক সুবিধাসহ বিভিন্ন ফেবার পরে ছাটাই হতে হতে ক্রমশ নাই হয়ে যাচ্ছিল সেই ট্রাম্পের আমল (২০১৭) থেকেই। তবু ভারতের কোর কিছু স্ট্রাটেজিক সম্পর্ক  সে আমেরিকার সাথে বজায় রেখে চলছিল। এমনকি ট্রাম্প আমলের (২০১৯) শেষে যখন ইরান-আমেরিকান পারমানবিক চুক্তি সে [Joint Comprehensive Plan of Action (JCPOA)] ভেঙ্গে দিলে এরপরে ইরানের উপর নতুন করে স্যাংশন আরোপ করা হয়েছিল। আর তাতে ট্রাম্প ২০১৯ সালে ভারতকে ইরান থেকে সেবার তেল আমদানি বন্ধ করতে বাধ্যও করতে পেরেছিল। এছাড়াও একালে কোয়াডের ভিতর নানা ইস্যুতে ভারতের অবস্থান নিয়ে বাইডেন প্রকাশ্যেই সমালোচনা করে যাচ্ছিল। ভারতে মোদির “মুসলমান কুপিয়ে নির্বাচনে জিতার” কৌশল নিয়ে বাইডেনের ‘ধর্মীয় স্বাধীনতা কমিশন’ স্যাংশন আরোপের সুপারিশ করে চলছিল লাগাতর। বাইডেন সেটা নিয়ে সাবধান করেছেন এমনকি, কাশ্মীরে মোদির নিপীড়নমূলক পদক্ষেপের সমালোচনা করেছেন। কিন্তু স্যাংশন আরোপ করতে পারেন এমন ধারণা দিলেও বাইডেন এর আগে কখনও তা বাস্তবায়ন করেন নাই। অর্থাৎ প্রকাশ্য মুখে সমালোচনা করলেও বাইডেন প্রশাসন কখনও চরম পদক্ষেপ হিসাবে ভারতের উপর প্রত্যক্ষ-পরোক্ষ কোন স্যংশন আরোপের মত ঘটনা ঘটান নাই।

ইউক্রেন যুদ্ধ শুরুর পরও আমেরিকান স্যাংশন-নিষেধাজ্ঞা খাওয়া রাশিয়া থেকে এতদিন ভারত তেল ও অন্যান্ত পণ্য আমদানি করে চলেছিল। তাদের গরীব অর্থনীতির দোহাই দিয়ে। এসব নিয়ে প্রকাশ্যে আমেরিকা আপত্তি বা অসন্তোষ জানালেও কখনই আমেরিকান পদক্ষেপ স্যাংশন আরোপ পর্যন্ত  গড়ায় নাই। কিন্তু এবার একই কাজ মানে ইরানি তেল আমদানির ক্ষেত্রে এবং তা একটা ভারতীয় বেসরকারি কোম্পানি আমদানি করাতে আমেরিকা এবার সেই কোম্পানির উপর প্রথম আমেরিকা সরাসরি স্যাংশন আরোপ করেছে।

আমেরিকার এই এক্টের মধ্যে দিয়ে একটা নিশ্চিত ম্যাসেজ হল, আমেরিকা তার আপত্তিসহ-ই রাশিয়া থেকে ভারতকে তেল আমদানি এলাও করলেও ইরান থেকে একই কাজ ভারত করতে চাইলে কঠোরভাবে তা দমন করবে তা বুঝিয়ে দিল।

ওদিকে এনিয়ে মিডিয়া রিপোর্ট হল, এত পরেপরেই এবার জয়শঙ্করের আমেরিকা সফরে গত সপ্তাহের ২৭ সেপ্টেম্বরে ব্লিঙ্কের সাথে তাঁর বৈঠকে এসব বিরোধ নিয়ে ঠিক কী আলাপ হয়েছিল এর বিস্তারিত সাংবাদিকেরা জানতে চাইলে, ভারতীয় মুখপাত্র জানান নাই। তাঁর “জানা নাই”, অজুহাতে। অর্থাৎ অনুমান করা হচ্ছে ভারতের মোদি সরকারকে এখন “আমেরিকা-ভারত সম্পর্ক নিয়ে” কিছু তিতা সিদ্ধান্ত আর না নিলেই নয় – এমন অবস্থায় পৌছেছে। আগামি দু-তিন সপ্তাহের মধ্যে এর চিহ্ন-ইঙ্গিত আর অপ্রকাশ্য থাকবে না।  আসলে এবারের জয়শঙ্করের সফরের পরে আমেরিকা-ভারত সম্পর্ক যে আর  অপ্রকাশ্য-বিরোধ হয়ে হাজির না হয়ে থাকবে না, এরই প্রবল অনুমান করা হচ্ছে। কারণ, কোন সম্পর্ক আরো কিছুদিন ইতিবাচক থাকার সম্ভাবনা থাকলে সেটা এতদিন প্রকাশ্যে এসে পড়ত।

সম্পর্কবিরোধটা শুধু তেল আমদানি, অনেক গভীরেরঃ
আসলে সম্পর্কবিরোধটা তো শুধু তেল আমদানি নিয়ে নয়; বরং সর্বত্র ও সব ইস্যুতেই। যার আরেক বড় প্রকাশ হল, আমেরিকান বার্মা দখলের খায়েস-পরিকল্পনা। যেটা নিয়ে আগের সপ্তাহে লিখেছি। বলেছিলাম ভারতের কোরস্বার্থ হল, বঙ্গোপসাগরে আমেরিকান সেভেনথ ফ্লিট নোঙর না করতে দেয়া আর এরই সাথে সর্বোতভাবে ” হবুআমেরিকান বার্মা দখলের” বিরোধিতা করা। মানে কোন ‘বাইডেনের বার্মা’ দেখতে ভারতের না চাওয়া, এমনকি চীনের কোলে উঠে হলেও এর যতটা সম্ভব সরাসরি প্রকাশ্যে বিরোধিতা করা।
আমরা ইতোমধ্যেই জেনেছি, তিন সপ্তাহ আগে গত ১২ সেপ্টেম্বর লাদাখ সিমান্তে চীন-ভারত ২০২০ সাল থেকে উভয় পক্ষ যে সেনা সমাবেশ ঘটিয়ে রেখে ছিল এর অবসান ঘটিয়েছে উভয় পক্ষ। ভোজবাজির মত উভয়ের সেনা প্রত্যাহার করে নিয়েছে।  এমনকি চীন-ভারত কতটা কাছাকাছি চলে গিয়েছে আর তাতে ভারত কত মরিয়া হয়ে ছাড় দিচ্ছে এর এক প্রমাণও হাজির হয়েছে। এরপরেই গত ১৫-১৬ সেপ্টেম্বর ছিল এসসিও (SCO) বার্ষিক সভা; সেখানে চীন এক আলোচনায় বর্ণনা তুলে ধরতে গিয়ে এমন এক ম্যাপ দেখিয়েছে যেখানে ভারতের দাবির খোদ লাদাখ ও অরুনাচল প্রদেশকে চীনের অংশ বলে দেখানো হয়েছে তবু মোদির ভারত কোন আপত্তি তুলে নাই – ভারতে বসে এনিয়ে অভিযোগ তুলেছে কংগ্রেস। এনিয়ে ভারতের এক মিডিয়া রিপোর্টের শিরোনামঃ
“ভারতের মানচিত্র থেকে বাদ অরুণাচল, লাদাখ! এসসিও-তে চিনাকীর্তিঘিরে বিতর্ক তুঙ্গে” [লিঙ্ক পেতে এখানে ক্লিক করেন]

আসলে, এখন যেভাবে আমেরিকার এমন খায়েস-পরিকল্পনা প্রকাশিত হচ্ছে এসবই চলতি শতকের শুরুতেও আগে থেকেই আমেরিকার ছিল। কিন্তু শতকের শুরুতে আমেরিকা-ভারত সম্পর্ক কাজ করতে শুরু করাতে, বিশেষত – ‘চীন ঠেকানোর ঠিকা’ কাজ করছিল বলে আমেরিকার সেইসব খায়েস লুকিয়ে বা তুলে রাখা হয়েছিল তখন।  কিন্তু বর্তমানে  আমেরিকান বার্মা দখলের পরিকল্পনা আমেরিকা আর লুকিয়ে রাখতে চাইছে না। আর ওদিকে এই পরিকল্পনার পালটা পদক্ষেপ হিসাবে রাশিয়া-চীন-ভারত এক অঘোষিত মেরুকরণে রাশিয়াকে সামনে রাখতে ভারত-চীন আগ্রহি বলে আর রাশিয়ার বার্মার শাসকদের সাথে এলায়েন্স গড়াতেই বাংলাদেশে গোলা এসে পড়ছিল।

আসলে কার্যত সবমিলিয়ে এতেই ‘নয়া মেরুকরণ’ আর অপ্রকাশ্যে রাখাতে সবপক্ষই অক্ষম হয়ে পড়ছে। আর এরই প্রথম বলি হয়ে যাওয়ার পথ ধরেছে আমেরিকা-ভারত সম্পর্ক। সে কারণেই এসব আলামত আমরা দেখতে পাচ্ছি। তবে এসব আর আলামত হয়ে থাকবে না। প্রকাশ্য চিহ্ন-ইঙ্গিতেও নয়, বরং প্রকাশ্য নয়া মেরুকরণ, নয়া জোট হিসাবেই তা হাজির হতে যাচ্ছে।
আর তা দেখার জন্য আমাদেরকে খুব বেশিদিন অপেক্ষা করতে হবে না। আসলে ইতোমধ্যেই মূল আমেরিকা-চীন গ্লোবাল নেতৃত্বের পালা বদলের লড়াই – এরই অংশ হিসাবে চীনা পক্ষের সম্ভাব্য মেরুকরণের মহড়াটা হয়ে গেছে এসসিও (SCO) বা সাংহাই কর্পোরেশন অর্গানাইজেশন এর  গত-মাসের বার্ষিক শীর্ষ সম্মেলন থেকেই।

তা সত্বেও এর বিপরীতে বাইডেনের আমেরিকা আর কোন দেশকে নিজের পক্ষে পেতে যাচ্ছে – বিশেষত ইইউ বা ইউরোপ কী বাইডেনের পক্ষে থাকতে পারবে কিনা এবং খোদ আমেরিকার আভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক পরিস্থিতির উপর বাইডেনের কী নিয়ন্ত্রণ থাকছে না বাইডেনের হাত গলে তা বাইরে চলে যাচ্ছে – এসব কিছুই তা আগামি ডিসেম্বরেরই ফয়সালা হয়ে যাবে। খুব সম্ভবত নভেম্বরের দ্বিতীয় সপ্তাহে তা ফুটে উটতে শুরু করবে।  আর তা অবশ্যই প্রকশ্যে; মানে গ্লোবাল মেরুকরণের আর কোন কিছুই অপ্রকাশ্য থাকবে না। যেমন,  ইউক্রেন যুদ্ধ এবার (নভেম্বরের দ্বিতীয় সপ্তাহে) শেষ হবে কিনা এবং তা, কোন মেরুকরণে তাও এবার নির্ধারিত হয়ে যাবে প্রকাশ্যেই, নভেম্বরের দ্বিতীয় সপ্তাহ থেকে।

কিন্তু এতে বাংলাদেশে কীঃ
বাংলাদেশের জন্য সবচেয়ে বড় ঘটনাটা হল, গ্লোবাল রাজনৈতিক এই ঘটনাগুলোর পরিণতি বা ফলাফলে, বিশেষ করে নয়া গ্লোবাল মেরুকরণ তা বাংলাদেশে বড় প্রভাব ফেলবে। যদিও বাংলাদেশের চলতি ক্রমশ উত্তাল হয়ে উঠা রাজনৈতিক মোচড় ও গত পনেরা বছরের শাসন ঘটনাবলির একটা বড় অংশই মূলত লোকাল ঘটনা। তবু এই লোকাল ঘটনা্য়র মধ্যে এতদিন “আমেরিকা-ভারত সম্পর্ক ঘনিষ্ঠতা” ছিল এক বড় নির্ধারক উপাদান। তাই আমেরিকা-ভারত “সম্পর্ক ঘনিষ্ঠতা” একেবারে ভেঙ্গে পড়া ও নয়া মেরুকরণের দিকে রওনা এর নিট ফলাফল হবে বাংলাদেশের রাজনীতিতে ভারতের আলগা মাতবরি ও প্রভাব সর্বনিম্ন পর্যায়ে চলে যাবে। এবং তা ইতোমধ্যেই সেদিকে রওনা দিয়েছে। সেটা সম্ভবত ২০০৭ সালের ১/১১ এর আগের বাংলাদেশ-ভারতের সম্পর্কের জায়গায় ফিরে যাবে। অনেকে তাই দোরাইস্বামীর গতমাসের বিদায় ভাষণ কে স্মরণ করছেন; যেখানে তিনি বলছেন, বাংলাদেশে “ভারত নির্দিষ্ট কোনো ব্যক্তির পাশে নেই” বা সাথে ছিল না। এর গুমোর ‘অর্থ’ বের করার চেষ্টা করছেন অনেকে।  সারকথায় বললে, আমেরিকা-ভারত সম্পর্ক ঘনিষ্ঠতা শুন্য হয়ে গেলে আর বাংলাদেশের উপর ভারতের প্রভাব বা গুরুত্বমূল্য আর কই থাকে?

তবু শেষনিঃশ্বাস পর্যন্ত ভারত চেষ্টা করবে পুরানা কায়দা বজায় রাখতেঃ
কিন্তু সাবধান শেষদিন পর্যন্ত ভারতের চেষ্টা বজায় থাকবে। কিন্তু কি করে বুঝব সেটা বজায় থাকার চেষ্টা করছে? সর্বশেষ সুলতানা কামালের লেখা যা প্রথম আলো ছেপে দিয়েছে – এটাই ঢলে পড়া পুরাতন ভারতের শেষ উঠার চেষ্টা। আমেরিকার স্যাংশন আরোপ আগামি ১০ ডিসেম্বর ২০২২ একবছর হবে। আর আলামত হচ্ছে সম্প্রতিকালে হাসিনার ক্ষমতা বড় চ্যালেঞ্জের মুখে। আর একাজে সম্মুখ সারির মিডিয়ার ভুমিকায় আগের মতই প্রথম আলো। এমনকি এই ততপরতা ইউক্রেন যুদ্ধের আমেরিকান প্রপাগান্ডা পর্যন্ত বিস্তৃত করে রেখেছে; অনেকে এটাকে প্রথম আলোর একেবারে উদাম হয়ে প্রো-আমেরিকান মিডিয়া হয়ে উঠার লক্ষণ হিসাবে দেখছে।
যদিও মিডিয়া হিসাবে নিজের বেছে নেওয়া প্রথম আলোর কোর-ভুমিকা হচ্ছে ইন্ডিয়ান স্বার্থরক্ষা যেটাকে, সে আবার প্রগতিশীলতা, সংখ্যালঘুর স্বার্থরক্ষা বা অসাম্প্রদায়িকতা এসব শব্দের আড়ালে করে থাকে। কিন্তু  এখন সে যেন প্রো-আমেরিকান ভুমিকাটাকে এর উপরে রেখে চলছিল। এসব কথাগুলো গোয়েন্দা-পরিভাষায় বলা হয়, এতবছর সিআইএ র-কে আপারহ্যান্ডে রেখে নিজের কাজ চালাচ্ছিল। গত ১০ ডিসেম্বর ২০২১ স্যাংশন ঘোষণা দিয়ে সিআইএ নিজেই যেন নিজেকে আপারহ্যান্ডে উঠিয়ে নিয়েছিল। আর এখন? fall apart ! অর্থাৎ এক বছর না যেতেই এটা এখন ধর্ম ও স্বার্থ যার যার অবস্থায়!!  “আমেরিকা-ভারত সম্পর্ক ঘনিষ্ঠতা” ভেঙ্গে পড়া যেটা এতক্ষণ উপরে আলচনা করেছি তা যেন সবচেয়ে বেশি প্রকাশিত হয়ে পড়েছে “এখানে”।  আর এর ঢলে পড়া বাংলাদেশে ভারতীয় প্রভাব – এথেকেই পালটা আবার উঠে দারানোরই এক উদ্যোগ প্রচেষ্টা হল সুলতানা কামালের ততপরতা, আর প্রথম আলোর এর পক্ষে দাঁড়িয়ে মরিয়া হয়ে সহায়তা দেয়া।
মূলত ইডেনের “সেক্স  স্লেভারির ঘটনা” হাসিনা ও লীগের মরাল ভিত্তিতে প্রবল আঘাত হেনেছে। যেটা ক্ষমতাচ্যুত হবার আগেই যেন লীগের মরালি-চ্যুত হয়ে পড়া। আর একাজে লীগকে সহায়তা দিয়ে বিনিময়ে ভারত নিজের ঢিলা হয়ে পড়া ক্ষমতা আবার খাড়া করতেই এই সুলতানার প্রচেষ্টা। তিনি প্রবল চেষ্টা করেছেন ঘটনার দায় বিওএনপির উপর যতটা সম্ভব চাপিয়ে দিতে। এমনকি সুলতানার কাছাখোলা  সর্বশেষ প্রচেষ্টাটা এবার আর প্রথম আলোর পক্ষ কাঁধ দেয়া সম্ভব হয় নাই। তাই ভারতের প্রো-মোদি এক মিডিয়া ইন্ডিয়া টুডে সে দায় নিয়েছে। যাতে আমেরিকার কাছে বাংলাদেশে হারানো ভারতের প্রভাবেই অন্তত কিছুটা ভারত ফিরে পায়! কিন্তু এর পরিণতি হল সুলতানাকে এখন থেকে বাকি জীবন পাবলিক লাইফে নেপথ্যে বা বাইরে কাটাতে হবে। আর তিনি হিউম্যান রাইট ইস্যুতে কেউ না, আসলে ছিলেনও না এটাই এখন উদাম হয়ে গেল!! এত দ্রুত, অবিশ্বাস্য!!!
তবে এই পতনের মূল জায়গাটা হল, “আমেরিকা-ভারত সম্পর্ক ঘনিষ্ঠতা” ভেঙ্গে পড়াকে পড়তে ব্যার্থ হওয়া। সুলতানা যে একজন ‘পুর্ণ অরাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব’ ছিলেন তা তাঁর জীবন সায়হ্নে এসে উদাম হয়ে গেল!

মূল সমস্যা “আমেরিকা-ভারত সম্পর্ক ঘনিষ্ঠতা” পড়তে ব্যার্থতাঃ
এমনই আরেক চরম ব্যর্থতার ঘটনা দেশের ভিতরেই ঘটেছে। দেশের ভিতরেই আমরা দেখছি হাসিনার ক্ষমতাকে চ্যালেঞ্জ করতে চায় যারা তারা প্রতিরোধ গড়ে তোলার চেষ্টা করছে। আর সেকথাটাকে প্রথম আলোর রিপোর্টের ভাষায় বললে, “বিএনপিকে থামানোর পথ খুঁজছে আ.লীগ”। এই হল বাস্তবতা। অথচ দেখা যাচ্ছে অনেক তুলনামূলক ছোট রাজনৈতিক দল এই ফেনোমেনাটা পড়তে জানে না।  বলে এখন  এই শেষ জীবনে এসে আবার এদের অনেকে ভারতের সহায়তা পেতে চেষ্টারত; লিঙ্ক যোগাড়ের চেষ্টায় রত। তাদের বোকা আকাঙ্খাটা হল, ভারত যদি তাদের দলীয় রেজিষ্টেশন ইত্যাদি কোন সরকারি ফেবার পেতে সহায়তা করে তাহলে এটাই তাদের নিজদলের স্বার্থ হবে।  আগামি হবু নির্বাচনে এভাবেই তারা নিজ স্বার্থটা  বলে বিশ্বাস করছে। এদেরকে নিয়ে কী বলা যায়??
তার মানে লীগ যেখানে নিজ ক্ষমতা ধরে রাখার অন্তত চ্যালেঞ্জ অনুভব করছে এই দলগুলো সেখানে তা দেখতেই পাচ্ছে না। শুধু তাই না, ভারত-আমেরিকার সম্পর্কের ভাটাতে হওয়া সত্বেও এরা হাসিনার বাংলাদেশের উপর মোদির প্রভাব অটুট দেখতে পাচ্ছে!! তাদের প্রাণপণে ভারত লবি খুঁজার কথা জেনে-দেখে  বুঝা যাচ্ছে তাদের নাদানি কত গভীর!!! তারা শেষে এই ২০২২ সালে এসে প্রাণপণে ভারতের দালালি করার প্রতিযোগিতায় নেমেছে। তারা জানেই না যে কোন সম্পর্কই আর আগের জায়গায় নাই; তা না থাকারই কথা! না গ্লোবাল রাজনীতির মেরুকরণের দিক না এটা একান্তই এর স্থানীয় রাজনীতির দিক। সে কেবল ভাল লবি খুজে ভারতের সেবা করে নিজের স্বার্থ অর্জন করতে নেমেছে!!! অদ্ভুত তাদের বুঝাবুঝির ভিত্তি!!
রাস্তার আন্দোলন বা উদ্যোগ কোথায় পরিণতি বা ফলাফলে পৌচাচ্ছে তা দেখতে একটু অপেক্ষা করতেও তারা রাজি না। আবার ভারতের কাছে যা চাইতে নেমেছে তা মিনিংফুলি ভারতের দেওয়ার ক্ষমতা আছে কিনা তা চেক করতেও তারা রাজি না!! এই হল বাংলাদেশের কিছু রাজনীতিক!

তাহলে এখন শুরুর  কিছু কথা আবার মনে করিয়ে শেষ করব।  বাংলাদেশের ওয়ান-ইলেভেন ও সাথের পরবর্তি সরকার এর অর্থ হল এতে যে গ্লোবাল মেরুকরণের ইঙ্গিতটা ছিল তা হল – ‘আমেরিকা-ভারত-বাংলাদেশ” এরা একই মেরুতে জায়গা নিয়েছিল। এখন বাংলাদেশের রাজনীতিক যারা  “এই মেরুকরণ”কে একেবারে স্থায়ী বলে মনে করবে; তারা রাজনীতি করার অযোগ্য যারা ধরে নিবে যে শুধু তাই না,  যারা মনে করবে ভারতের সাথে লবি করলে তবেই আমাদের সরকারের থেকে কিছু সুবিধা পাবার পথ এবং এই পথ স্থায়ী!!!সবশেষে ভারত-আমেরিকার সম্পর্কটা কত দ্রুত গতিতে ভেঙ্গে পড়ছে তা বুঝতে সহায়ক এই রিপোর্টটা আগ্রহিদের পড়ে দেখতে রেফার করব। এটা ভারতের দ্যা প্রিন্টের নয়নিমা বসুর লেখা। তিন অক্টোবর সকাল আটটায় তা প্রকাশিত, ফলে তা লেটেষ্ট। বাংলাদেশের ভাষায় বললে তিনি ফরেন বিটের সাংবাদিক। তবে আমি নয়নিমাকে গণ্য করি ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের যেন সেই অ-সরকারি মুখপাত্র যার মুখ দিয়ে মন্ত্রণালয় নিজের মনের খায়েসের কথাগুলো বলে থাকে, যা মন্ত্রণালয়ের পক্ষে নিজমুখে প্রকাশ্যে নানা সীমাবদ্ধতায় বলা সম্ভব নয়। তবে, এখানে নয়নীমা যেন ধরে নিয়েছেন ভারত-আমেরিকার পুরান সম্পর্ক ভেঙ্গে গেছে!! এভাবেই লেখা!! আর এলেখা থেকে  পরিস্কার যে ভারত আর দুইনৌকায় পা-দিয়ে চলতে পারছে না। তাকে কোন একদিকে অবস্থান নিতেই হবে; মূলত আমেরিকা তাকে এঅবস্থায় দিকে ঠেলে দিয়েছে। এবং ইঙ্গিতে বলা অবস্থান হল চীন-রাশিয়ার দিকেই ভারতের সম্ভাব্য অবস্থান, যেমন এই রিপোর্ট লিখছে, এরকমঃ

.…..well set the tone for the next meeting of Quad, but India — a neighbour of Beijing
and a strategic partner of Moscow.….. 

আমরা চীনকে ভারতের এই “পড়শি” বলে সম্বোধন এর আগে দেখেছি বলে মনে পরে না। এটাই কী এখন থেকে ভারতের চীন-ঘনিষ্ট হবার ইঙ্গিত!! কারণ, এতদিন তো চীনকে  ভারতের মিডিয়া ভারতের শত্রু বলেই আমাদের কাছে পরিচিত করিয়ে গেছে! যেকারনে, এখনো ভারতের পাবলিক পারসেপশন হচ্ছে চীন তাদের শত্রু দেশ। চীনের যেকোন কিছুই তাই ভারতের পাবলিক মাইন্ডে এখনো ঠাট্টার বস্তুই। তাহলে দাড়াচ্ছে যা তা হল, এটা ভারতের জন্য – কে ফ্রেন্ড আর কে এনিমি – তা রি-ডিফাইন করার জটিল বা উভয় সঙ্কটের সময়!  আর এর সাথে যায় এমন নতুন সেসব কিছু নয়া বয়ান তৈরি সহজ কাজ না হলেও সম্ভব বটে!

গৌতম দাস, রাজনৈতিক বিশ্লেষক
goutamdas1958@hotmail.com

Leave a Reply

Fill in your details below or click an icon to log in:

WordPress.com Logo

You are commenting using your WordPress.com account. Log Out /  Change )

Twitter picture

You are commenting using your Twitter account. Log Out /  Change )

Facebook photo

You are commenting using your Facebook account. Log Out /  Change )

Connecting to %s