পাকিস্তানকে আমেরিকা কাছে টানার পরে, আবার বে-ইজ্জতি করা কেন?


পাকিস্তানকে আমেরিকা কাছে টানার পরে, আবার বে-ইজ্জতি করা কেন?

গৌতম দাস

১৭ অক্টোবর ২০২২  রাত ০১ঃ১৮

https://wp.me/p1sCvy-4gb

 

       Pakistan’s Foreign Minister Bilawal Bhutto-Zardari speaks following his meeting with U.S. Secretary of State…..

 

একটা দৃশ্যমান স্ববিরোধ বা পরস্পরবিরোধী ঘটনা আজকের লেখার বিষয়। কোথায় ঘটেছে এটা? বাইডেনের আমেরিকার বিদেশ নীতি-পলিসিতে বা তাঁর সাম্প্রতিক কিছু ততপরতায়।  কী সেই পরস্পরবিরোধী দুই ঘটনা?
এক. মূল বিরোধের স্থান হল,  গ্লোবাল নেতৃত্বের পালাবদলের যুগে চীন-আমেরিকার লড়াইয়ের পটভুমি। সেখানে ইউক্রেন যুদ্ধের ইস্যুকে কেন্দ্র করে ঘটনা গড়াতে গড়াতে এখন চীন-রাশিয়া-ভারত মিলে আমেরিকাবিরোধী এক মেরুকরণ ঘটিয়ে ফেলেছে। বিশেষত সর্বশেষ গতমাসে ১৫-১৬ সেপ্টেম্বর চীনের সাংহাই কর্পোরেশন অর্গানাইজেশন (এসসিও বা SCO) এর বার্ষিক সভা থেকে এই মেরুকরণ আরো দৃশ্যমান করে দেখানোর সুযোগ হিসাবে চীন-রাশিয়া-ভারত নিয়েছে। মনে রাখতে হবে, ভারত ও পাকিস্তান এর জন্মবিরো্‌ধ – এই প্রাচীনবিরোধকে উস্কে দিয়ে যেন আমেরিকা সেখান থেকে কোন নিজ সুবিধা বের করতে না পারে তাই ২০০১ সালে জন্ম নেয়া চীন-রাশিয়ার জোট এসসিও-তে ভারত-পাকিস্তান এদুইদেশকে একসাথে ২০১৫ সালে এসে একই দিনে SCO এর সদস্য করে নেয়া হয়েছিল। তা সত্বেও, বাইডেন ঐ মেরুকরণের পালটা প্রতিক্রিয়ায় পাকিস্তানের উপর সওয়ার হয়ে ভারত-পাকিস্তানের বিরোধ উস্কে তুলে দিল।
সারকথায় বললে,  আমেরিকাবিরোধী চীন-রাশিয়া-ভারত মিলে তাদের নয়া মেরুকরণ-কে দুর্বল করতে সাম্প্রতিককালে আমেরিকা ভারত-পাকিস্তানের বিভেদ উস্কে তোলার কৌশল নিয়েছে। যেমন এর শুরুটা হল, পাকিস্তানকে এফ-১৬ যুদ্ধবিমানের যন্ত্রাংশসহ অন্যান্য প্রায় আধা বিলিয়ন ডলারের সহায়তার জন্য বাইডেনের হাত বাড়ানো। স্বভাবতই এটা ভারত-পাকিস্তানের রেষারেষি উস্কে তুলতে যথেষ্ট। যদিও জয়শঙ্কর চেষ্টা করেছেন বিরোধটাকে ঠিক পাকিস্তান-ভারত নয় বরং  ভারত-আমেরিকার বিরোধ হিসাবে কেন্দ্রীভুত রাখতে। তিনি ভারতে বসে বা আমেরিকা সফরে গিয়ে এনিয়ে আমেরিকার বিরুদ্ধে  খুবই কড়া মন্তব্য বা অসন্তোষ ব্যক্ত করেছেন। [এখানে বিস্তারিত ] যদিও তাতে পাকিস্তানে ইমরানকে হটিয়ে আমেরিকার বর্তমান ক্ষমতাসীন শাহবাজ সরকারকে ক্ষমতায় আনা-কেন্দ্রিক ততপরতা অথবা তাতে যে আমেরিকা-ঘনিষ্টতা শুরু হয়েছিল তা এখন আপত্তিকর ‘অতি ঘনিষ্ঠতা’ হয়ে গেছে, যা আন-এথিক্যাল। কারণ এটা আর এখন পাকিস্তানের স্বার্থে যতটা নয়, তার চেয়ে আমেরিকার স্বার্থে শাহবাজ সরকারকে জবেহ দেওয়ার সামিল হয়ে গেছে। ভারতের সাথে পাকিস্তানের অমীমাংসিত বিরোধ আছে এটা সত্য। কিন্তু তাই বলে সেটাকে অপব্যবহার ঘটানো আর তাকেই আমেরিকা যেন একমাত্র, মুখ্য ও চোখা করে উঠিয়েছে এবং নিজ বাজে স্বার্থে!

কিন্তু আসলেই কী আমরা বাইডেনের পদক্ষেপ-গুলো বুঝেছিলামঃ
বাইরের আমরাও ভেবেছিলাম আমরা বোধহয় ঘটনা, মেরুকরণ ইত্যাদির গতিপ্রকৃতি বুঝেতেছি। কিন্তু না আবার কিছু নতুন ঘটনা হাজির হয়েছে যাতে আমাদের ঘটনা বুঝতে এখনো অনেক বাকি – এটাই সবার উপরে ভেসে উঠেছে।
কিন্তু কী সেটা? সে ঘটনা আবার দুইটা। এক, শাহবাজের পাকিস্তান তো এখন থেকে বাইডেনকে ভালই সার্ভিস দিতে থাকবে, এটাই ধরে নেয়া হয়েছিল। কিন্তু না। আমরা দেখলাম, বাইডেন হঠাৎ গত পরশু (১৪ অক্টোবর) পাকিস্তান সম্পর্কে খুবই কঠোর, কটু ও অমর্যাদাকর মন্তব্য করেছে। যার ফলে পাকিস্তানে আমেরিকান রাষ্ট্রদুতকে শাহবাজ সরকার ডেকে এনে তাঁর হাতে পাকিস্তানের কড়া আপত্তি ধরিয়ে দিয়েছে। তাহলে কী দাঁড়ালো এটা?  পাকিস্তান সম্পর্কে বাইডেন বলেছেন, “পাকিস্তান হচ্ছে সম্ভবত দুনিয়ার সেসব মারাত্মক ক্ষতিকর বিপদজনক রাষ্ট্রগুলোর একটা যার হাতে পারমানবিক অস্ত্র আছে কিন্তু দায়ীত্ববান নিয়ন্ত্রণ নাই”“may be one of the most dangerous” countries in the world which had “nuclear weapons without any cohesion”. …।।

আমেরিকার-ভারতের সম্পর্ক সম্প্রতি ভেঙ্গে গেছে তাইঃ
আমেরিকার-ভারতের সম্পর্ক সম্প্রতি ভেঙ্গে গেছে – একথার মানে কী বা বলতে কী বুঝব? অথবা কতটুকুর বেশি বুঝলে ভুল হবে?
একালের বিচারে সম্পর্ক ভেঙ্গে যাওয়া বলতে বুঝতে হবে, কোন দুই দেশের দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক ভেঙ্গে গেলেও রুটিন কিছু সম্পর্ক তবুও থেকেও যাওয়া।  অর্থাৎ  ভেঙ্গে যাওয়ার আগে যে  সম্পর্কে ‘বিশেষ ঘনিষ্ঠতার’ জায়গাগুলো ছিল কেবল সেসব ক্ষেত্রগুলোর তাতে পরিসমাপ্তি ঘটা। কিন্তু এরপরেও কূটনৈতিক সম্পর্কসহ রুটিন যেসব সম্পর্কে ঐ দুই দেশের মধ্যে আগেও ছিল যেমন, এসবের মধ্যে পারস্পরিক পণ্য-বিনিময় বাণিজ্যিক সম্পর্ক যেগুলো ছিল সেগুলো সবই তা চলতে থাকবে। এটাকে বলছি ‘একালের বিচারের’ ঘটনা। কেন? কারণ,  এর আগে মানে ১৯৯২ সালের আগে আমেরিকা-সোভিয়েত ইউনিয়নের মধ্যকার সম্পর্ক এর কথাই যদি ধরি – এটাই মুখ্য আন্তর্জাতিক সম্পর্কের একটা ধরণ এবং এতাই স্টান্ডার্ড বলে মনে করা হত। আর এর মূল বৈশিষ্ট ছিল আমেরিকা-সোভিয়েত এ’দুই ব্লক রাষ্ট্রের মধ্যে কোন – পারস্পরিক পণ্য-বিনিময় বাণিজ্যিক সম্পর্ক’ই ছিল না –  এমনকি ভাষা, কালচার বা শিল্পকলার বিনিময় বলতেও তেমন কিছুই ছিল না। যার সারকথাটা হল – ‘নো এক্সচেঞ্জ’। এটাই ছিল সেকালের আন্তঃরাষ্ট্রীয় সম্পর্কের স্টান্ডার্ড রূপ। আর এর ঠিক উলটা হল একালের বিচারে আন্তঃরাষ্ট্রীয় সম্পর্ক যেখানে সম্পর্ক ভেঙ্গে যাওয়া বললেও বুঝতে হবে তবু একধরণের রুটিন সম্পর্ক যেমন সাধারণ বাণিজ্য সম্পর্ক তবু থেকে যাবে। বিস্তারে যাব না কেবল সংক্ষেপে বলব, একালের সম্পর্ক মানে সকলেই একই আইওএমএফের সদস্য তাই বাণিজ্য সম্পর্ক থেকে যাবেই। আর তাছাড়া একবার বাণিজ্যিক সম্পর্ক তৈরি ও শুরু করে ফেললে কিছু কিছু পণ্যে পারাস্পরিক ও আন্তঃনির্ভরতা তৈরি হয়ে যাবেই। এটাই মনে রেখে কোন আন্তঃরাষ্ট্রীয় সম্পর্ক ভেঙ্গে যাওয়া ধারণাকে একালে বুঝতে হবে।
তাহলে একালের বিচারে  আমেরিকার-ভারতের সম্পর্ক সম্প্রতি ভেঙ্গে গেছে বলতে কি বুঝায়, এর অন্তত কিছু বুঝলাম। আর তাতে ভারত যেসব সুবিধা হারিয়েছে সেগুলো হল যেমনঃ ১। আমেরিকার-ভারত একসাথে হয়ে আগে পাকিস্তান কোপাতে পারত। মানে আমেরিকার-ভারতের ইসলাম-বিদ্বেষকে তারা পাকিস্তানেরই দোষ বলে উলটা চাপিয়ে দিতে পারত। তাতে দাবি করত, পাকিস্তান একটা ‘নিচা’ দেশ – এরা পশ্চাদপদ, এরা জঙ্গী, আনকালচার্ড কিংবা এদের ধর্মটাই অপুষ্ট বা দুষ্ট ধরণের ঘৃণামূলক অবুঝ বা না-বুঝের কথাবার্তা  ইত্যাদি; এই ভাষ্যের উপর দাঁড়িয়ে এরা পাকিস্তানকে ডিকটেট করতেও সেকালে চাইতে পারত। বাস্তবত  আমেরিকার-ভারতই যে মূলত স্ব স্ব দেশে মুসলমানদের সাথে সীমাহীন বৈষম্য করে চলেছে, বৈষম্যের জাল ফেলে রেখেছে সেটাকে আড়ালে রেখে তাদের সব যৌথ ততপরতাই হল জঙ্গি, ইসলামি রাডিক্যালিজম নামে চালানো সব ঘটনার আদি উতস!
সেটা যাক হোক,  আমেরিকার-ভারতের সম্পর্ক-জোট এলায়েন্স সম্প্রতি ভেঙ্গে গেছে আর এতেই ভারত আর যে পাকিস্তানের চেয়ে শ্রেষ্ঠ এই ‘বয়ানের জায়গা নাই হয়ে গেছে  পাচ্ছে না, চালু থাকতে পারছে না। এর এক সরাসরি ক্ষতি হয়েছে মোদি সরকারের। তিনি ভারত “পাকিস্তানের চেয়ে শ্রেষ্ঠ” এই  ভুয়া বয়ানের উপর দাড়িয়েই ভারতের মুসলমানেরাই খারাপ বা যেন এজন্যই  এরা নিপীড়িত হবার যোগ্য এই সাফাই তৈরি করেই হিন্দুত্ববাদের জজবা তুলে সেই জোশগুলোকে ভোটের বাক্সে জড়ো করে নিজ ক্ষমতা টিকায় রাখতে ব্যবহার করে চলতে পারত। এটা মোদির এক সরাসরি ক্ষতি।

তেমনই ভারতের আরেক ক্ষতি হল বাংলাদেশেঃ
আমেরিকা আর বাংলাদেশ – এরা সরাসরি নিজেরা দুই দেশের স্বার্থের ভাল-মন্দ বা পছন্দ-অপছন্দ নিয়ে নিজেরাই ডিল করুক – এভাবেই আমেরিকা-বাংলাদেশের সম্পর্ক গড়ে উঠুক?? তাতে ভালবাসা বা শত্রুতা করুক এটা ভারতের কাম্য নয়! না তা নয়। ভারতের ইচ্ছা বাংলাদেশ আমেরিকা-বাংলাদেশ এর সম্পর্কটাকে সরাসরি নিজেরা নয়; বরং ভারতের মাধ্যমে ডিল করুক। মানে আমেরিকা-বাংলাদেশের সম্পর্ক – এর লেনদেন, সম্পর্ক রক্ষা ইত্যাদি সবটা ভারতের মাধ্যমে ঘটুক। আর এভাবে ভারতকে একটা আলগা মাতবরি বা কুতুবি করতে দেক। যেটা আদতে বাংলাদেশের উপর ভারত একটা আলগা দালালি ও খামখা অভিভাবকগিরি হয়ে উঠুক। বিনিময়ে যেটা বাংলাদেশের উপর ভারতের প্রভাব বলে যেন ভারত দাবি ও উপভোগ করতে পারে!! গত ২০০৭ সাল থেকে এটাই কায়েম হয়ে ভারতের রুস্তমি রাজত্বের ভিত্তি হয়ে থাকা শুরু হয়েছিল। হাসিনা নিজ ক্ষমতায় থাকার স্বার্থে এটা মেনে নিয়েছিল বলেই এটা চালু হতে পেরেছিল।

কিন্তু  আমেরিকার ভারতের সম্পর্ক-জোট এলায়েন্স সম্প্রতি ভেঙ্গে যাওয়াতে এসব কিছুই একেবারেই দুর্বল হয়ে গেছে। এতে বাস্তবতা হল খুব সহসাই আবার  আমেরিকার-ভারতের সম্পর্ক নুন্যতম জেগে উঠুক বা উঠবে এর কোন সম্ভাবনাই নাই, বরং আরো শত্রুতামূলক হয়ে উঠার সম্ভাবনা। তাই এই পরিস্থিতিতে ভারত নতুন কিছু করে বাংলাদেশের সরকারের উপর প্রভাব সামান্যও যদি ফেরত পায় এমন সব চেষ্টা জারি রেখেছে। এরই একটা রিপোর্ট হল, “বাংলাদেশের ১৯৭১ সালে ঘটা নৃশংসতাগুলোকে আমেরিকান কংগ্রেসে ‘গণহত্যা’ বলে চিহ্নিত করে প্রস্তাব পাশ”  ‘Resolution in US house to recognise 1971 atrocities in Bangladesh as genocide’

ঘটনা পুরানা একাত্তর সালের কিন্তু এটা এখন শাহবাগী রাজনীতি।  সংক্ষেপে বললে বিষয়টা হল, কোন রাষ্ট্রীয় নৃশংসতার ঘটনাকে জাতিসংঘের সংজ্ঞায় ও সীমানায় জেনোসাইড বা ‘গণহত্যা’ বলে চিহ্নিত করানো ও স্বীকৃতির ইন্টারন্যাশনাল লিগাল মুল্য অনেক। এছারা এতে ঘটনায় দায়ীদের শাস্তি দেওয়ার অনেক কাছে চলে যাওয়াও হয়। কিন্তু নানান টেকনিক্যাল কারণে, বাংলাদেশের ১৯৭১ সালের পাকিস্তান সেনাবাহিনীর নৃশংসতার ঘটনা জাতিসংঘের চোখে গণহত্যা বলে স্বীকৃত নয়। এখন এই আলোকে আমেরিকান কংগ্রেস যদি  এমন গণহত্যা বলে স্বীকৃতি দেয় তবু সেটা অবশ্যই সমতুল্য কোন ঘটনাই নয়। তবুও এর কেবল কিছুটা ক্যাম্পেইন, প্রপাগান্ডা মুল্য মাত্র এতে থাকবে। এছাড়া এটা লিগাল রায় নয়। পক্ষ-বিপক্ষেরের রাজনৈতিক জোটের মতামত মাত্র।

কিন্তু তা হলেও এমন মতামত আমেরিকান সংসদ বা কংগ্রেস থেকে উদিত হতে পারল কেন?  এটা তো সত্তরের দশকেও হয় নাই। তাহলে এখন কেন?

আমেরিকা লবির দেশ, লবি করা বৈধঃ
বহু দেশের নাগরিকই পরবর্তিতে মাইগ্রেটেড হয়ে আমেরিকার নাগরিক হয়। আমেরিকান নাগরিক মানে এটাই। এটাই আমেরিকান নাগরিক হওয়াদের প্রধান ধারা। ফলে কেউ পুর্ণ নাগরিক হয়ে গেলেও তারা স্ব স্ব অরিজিন দেশের স্বার্থের প্রেশার গ্রুপের ভুমিকার ভোটার-নাগরিক হয়ে যেতে পারে। তবে সেটা একমাত্র একই অরিজিন দেশের আমেরিকানেরা সংগঠিত হতে পারলে তবেই এরা সম্মিলিতভাবে ফেলে আসা দেশের পক্ষে বিশাল লবি গ্রুপ হয়ে উঠতে পারে।  বাংলাদেশেরও বহু মানুষ একালে আমেরিকার নাগরিক হয়ে গেছে। কিন্তু তারা এখনো বাংলাদেশ লবি গ্রুপ হবার পরিবর্তে  বরং দেশের মতই দ্বিদলীয় ভাগ হয়ে দলদাস হতেই আগ্রহি।

কিন্তু ভারতের ক্ষেত্রে, তারা অনেক জনসংখ্যার বলে, সরকারের দিক থেকে আমেরিকায় এমবেশি থেকে পরিচালিত এটা সংগঠিত করে নেয়া বলে এটা সবসময় ক্ষমতাসীন দলের হয়ে তবে বিশাল লবি গ্রুপ – এক র‍্যাকেট হয়ে ততপরতা করে থাকে। কংগ্রেস সদস্যও নির্বাচন করে থাকে। কোন সিনেটরের পিছনের সাপোর্ট গ্রুপ হয়েও কাজ করে থাকে সময়ে। তবে কংগ্রেসম্যান বা সিনেটর এসব জনপ্রতিনিধি সবসময় সরাসরি ভারতীয় অরিজিনের এমন ব্যক্তি নাও হতে পারেন। তবে অবশ্যই তাদের কনষ্টিটুয়েন্সি ভারতীয় অরিজিন আমেরিকান ভোটাররাই হয়ে থাকেন। এছাড়া আরেক ধরণের জনপ্রতিনিধিকে দেখা যায় যারা আমেরিকায় ভারতের স্বার্থের পক্ষে কাজ করে থাকেন। এরা হল, আসলে কোন এক বা একদল হোয়াইট আমেরিকান ব্যবসায়ীদের প্রতিনিধি যাদেরকে ভারত তাদের দেশের ব্যবসা পাইয়ে দিয়েছে, সহজ করে দিয়েছে। আর বিনিময়ে তারা ভারতের পক্ষে ও স্বার্থে কাজ করবে এমন এক বা একাধিক জনপ্রতিনিধি জুটিয়ে দিয়েছে হয়ত।

আলোচ্য ক্ষেত্রেও আমেরিকান কংগ্রেসে যে প্রস্তাব পাশ হয়েছে,  দুই কংগ্রেসম্যান এই প্রস্তাবটা তুলে এসে পাশ করিয়েছেন –  স্টিভ শ্যাবট [Steve Chabot ] ও আরও খান্না [Ro Khanna ] নামের দুই আমেরিকান কংগ্রেসম্যান। স্বভাবতই খান্না  এই পাঞ্জাবি টাইটেল এর  মানে তিনি ভারতীয় অরিজিন।

তাহলে বাংলাদেশ সংশ্লিষ্ট “এই প্রস্তাব” তাদের এত আগ্রহ করে আনার কারণ কী? কারণ এটাই মোদি সরকারের আগ্রহ। কিন্তু সরকারের আগ্রহ কেন? কারণ, এই প্রস্তাব মানে হল,  বাংলাদেশ-আমেরিকান সম্পর্ক সরাসরি না হয়ে সেটা ভারতের মাধ্যমে  বাংলাদেশ-আমেরিকান সম্পর্ক করার বা হবার লাইনের প্রস্তাব – এরই আকুতি। আর এটাই এতদিন হাসিনা সরকারের স্বার্থ ছিল। বা স্বার্থের গৃহিত লাইন ছিল। যেটা এখন অকার্যকর। হাসিনা মনে করে ভারত এব্যাপারে এখন মুরোদহীন; যার নিজেরই আমেরিকার কাছে বেইল নাই। আর খোদ আমেরিকাই এখন হাসিনা সরকারের উপর বিলা! কিন্তু তবু ভারত নাছোড়বান্দা। যেন দেখাতে চায় এখনো আমার কিছু আমেরিকান জনপ্রতিনিধির উপর প্রভাব আছে আর সেটা আমরাই বাংলাদেশে বেচতে চাই!!

তাহলে এখন এই লেখার মূল প্রসঙ্গে ফিরে আসি। সেটা হল, বাইডেন কেন চীন-আমেরিকার বিরোধ প্রসঙ্গে এখন ভারতের বিরুদ্ধে পাকিস্তানকে ব্যবহার কাজে লাগানো সম্পন্ন করেও আবার পাকিস্তানের বিরুদ্ধেই পারমানবিক বোমার অধিকারি দেশ প্রশ্নে অযোগ্য [without any cohesion] রাষ্ট্র বললো?

Biden in a speech said Pakistan “may be one of the most dangerous” countries in the world which had “nuclear weapons without any cohesion”.

আসলে এর মূল কারণ, দুটা দুই কনটেকস্ট (context) বা পটভুমিতে। প্রথমটা ভারতের চীন-রাশিয়ার পক্ষে চলে যাওয়ার শাস্তি হিসাবে যেটা আগেই অনেক বলেছি। আর দ্বিতীয়টার হল, আমেরিকায় নির্বাচন আগামি ৮ নভেম্বর ২০২২, সেই প্রসঙ্গে ও পটভুমিতে। নির্বাচন মানে?

বাইডেনের চার বছরের জন্য প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হবার দুইবছর বা অর্ধ-আয়ু পার হবার দিন হল আগামি ৮ নভেম্বর। আর ঐদিনই আবার আমেরিকান সিস্টেম অনুসারে এক-তৃতীয়াংশ সিনেট ও পুরা কংগ্রেসের সদস্যদের আসনে মেয়াদ শেষ ও নয়া-নির্বাচনের দিন। আরেকটু ভেঙ্গে বললে, আমেরিকার কংগ্রেসে (আমাদের ভাষায় সংসদে) সদস্যরা মাত্র দুবছরের জন্য নির্বাচিত হন। তাই প্রতিবার প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের সময় ও ওর সাথে একবার আর আরেকবার নির্বাচিত প্রেসিডেন্টের দুবছর পার হলে পরে (যেটাকে মিড-টার্ম বলে) – এভাবে দুই সময়ে দুবছর পরপর আমেরিকান কংগ্রেস সব সদস্যদের (মোট ৪৩৫+২ ) আসনে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়ে থাকে।

আর আমেরিকান কংগ্রেসের নির্বাচনের সাথে একই সময়ে এভাবে সিনেটরদেরও নির্বাচন হইয়ে থাকে। যদিও এক্ষেত্রে এক জায়গায় শুধু একটু ফারাক আছে।   তা হল, সিনেটরেরা কংগ্রেসের মত দুবছরের মেয়াদে নয়, বরং টানা ছয় বছরের জন্য নির্বাচিত হন। তবে প্রতি দুই বছর পরপর মোট আসনে মাত্র এক-তৃতীয়াংশ আসনে নয়া নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়।

তাহলে সারকথায় মিড টার্ম নির্বাচন মানে কী দাড়ালো? তা হল, একঃ  সব কংগ্রেসের আসনেই (৪৩৫+২) নয়া নির্বাচন এর দিন সেটা। দুইঃ  সিনেটের মাত্র এক-তৃতীয়াংশ আসনে নয়া নির্বাচনের দিন সেটা। আর তিনঃ প্রতি নির্বাচিত প্রেসিডেন্টের মেয়াদের অর্ধ-মেয়াদ বা দুবছর পার করার দিন সেটা। যদিও এই মিড-টার্মের নির্বাচনে প্রেসিডেন্টের (বাইডেনের ডেমক্রাট) দলের জনপ্রতিনিধিরা কংগ্রেস ও সিনেটের যেকোন এক জায়গায় বা দুই জায়গাতেই সংখ্যাগরিষ্ঠতা হারালেও তাতে প্রেসিডেন্টকে ক্ষমতা হারাতে হবে না। মানে ডেমক্রাটেরা আগামি এই মিড টার্মে কংগ্রেস ও সিনেটের সবজায়গায় হেরে গেলেও বাইডেনই প্রেসিডেন্ট থেকে যাবেন। চারবছর পুর্ণ প্রেসিডেন্টই থেকে যাবেন।

এবার আমাদের প্রাসঙ্গিক কথা হল, আসন্ন মিড-টার্মের নির্বাচনে ডেমোক্রাট কংগ্রেসম্যান যারা ভারত-প্রভাবিত তাদেরকে জিতাবার জন্যই বাইডেন পাকিস্তান-বিরোধী অমন কথা বলেছেন। অর্থাৎ এর সাথে ভারতের আমেরিকাকে ছেড়ে চীন-রাশিয়ার সাথে তাদের জোটে চলে যাবার কোন সম্পর্ক নাই।
আমার একথা সবচেয়ে ভাল বুঝা যাবে বাইডেন কোথায় গিয়ে এইকথাগুলো বলছেন সেদিকে যদি খেয়াল করেন। লেখা আছে আসন্ন মিড-টার্ম নির্বাচন উপলক্ষ্যে ডেমোক্রাট কংগ্রেস প্রার্থীদের পক্ষে ক্যাম্পেইন শুরু করা হবে [……Biden made the comments during a reception of the Democratic Congressional Campaign Committee on Thursday ]। ঐ ক্যাম্পেইন শুরুর আগে ক্যাম্পেইন কমিটির সভায় তাদেরকে উতসাহ দিতে  বাইডেন সেখানে গিয়েছিলেন।  ঐ বক্তৃতাতেই তিনি পাকিস্তানকে ক্ষেপিয়ে ঐকথা বলেছেন।
এককথায় বললে, যেমন  ডেমোক্রাট Ro Khanna [ROHIT KHANNA] এর মত ভারতীয় অরিজিন আমেরিকান কংগ্রেসম্যানদেরকে মিডটার্মে আবার জিতাবার জন্য বাইডেন পাকিস্তানকে ঠেস দেয়া বা নিচা দেখানো ঐ বক্তব্য দিয়েছেন। আবার যেমন Ro Khanna কে জিতাবার জন্য বাইডেন কাজ করছেন বলে এর মানে এমন নয় যে বাইডেন আমেরিকা-ভারতের ঘনিষ্ট আগেকার সম্পর্কটাই আবার ফিরিয়ে আনার পক্ষে কাজ করছেন। এমন বুঝা ভুল হবে!

এই হল মূল কথা। আর এখন একটু বাড়তি কথা বলে নেই এই সুযোগে। এই মিড-টার্মে বাইডেনের দল ডেমোক্রাটেরা গোহারা হারবে বলে পুর্বাভাস বলছে। কারণ প্রায় ৯% মুদ্রাস্ফীতি আর এতে মিডল-ক্লাস ও নিম্ন মধ্যবিত্ত এরা প্রচন্ড ক্ষেপে ক্ষুব্ধ। এছারা প্রায় দেড় বছর ধরেই তাদের পছন্দের ও নাগালের মধ্যে মুল্যের চীনের তৈরি গৃহস্থলিতে ব্যবহার হয় এমন ওয়াসিং মেসিন বা এসি ইত্যাদি আমদানি পণ্যের উপর ২৫% বা এর উপরে কোথাও ৬৬% পর্যন্ত অতিরিক্ত ট্যাক্স বসানোতে ক্ষুব্ধ ছিল তারা। যদিও এই বাড়তি ট্যাক্স বসিয়েছিলেন ট্রাম্প তাঁর ক্ষতা ছাড়ার আগে কিন্তু এর এফেক্ট শুরু হয় বাইডেনের আমলে। অর্থাৎ সংখ্যাগরিষ্ট ভোটারেরা বাইদেনের দলের বিরুদ্ধে যাবে বলে অনুমান। এতে যদিও বাইডেন ক্ষমতাচ্যুত হবেন না। তবে, যেগুলো অর্থ-বিল মানে যেখানে প্রেসিডেন্ট কোথাও কোন দেশে অর্থ বরাদ্দ দিতে চান এমন প্রতিশ্রুতি দিতে চান সেগুলো আগে তাকে সংসদ-সিনেটে অনুমোদন নিতে হবে। আর এই অনুমোদন নিতে গিয়েই তিনি বাধার সম্মুখীন হবেন।

গৌতম দাস, রাজনৈতিক বিশ্লেষক
goutamdas1958@hotmail.com

 

 

 

 

 

 

Leave a Reply

Fill in your details below or click an icon to log in:

WordPress.com Logo

You are commenting using your WordPress.com account. Log Out /  Change )

Twitter picture

You are commenting using your Twitter account. Log Out /  Change )

Facebook photo

You are commenting using your Facebook account. Log Out /  Change )

Connecting to %s