‘হেফাজতের মত বিএনপিকে’ দমন!
গৌতম দাস
৩১ অক্টোবর ২০২২
ইস্যুটা হাসিনার ক্ষমতায় টিকে থাকতে পারা না পারা নিয়ে। দুদিন আগে ২৯ অক্টোবর বিএনপির রংপুর বিভাগীয় সমাবেশ হয়ে গেল, এটা ছিল তাদের চলমান আন্দোলনের চতুর্থ এমন সিরিজ সমাবেশ। অনেকের মনে হতে পারে এটা কী হাসিনার ক্ষমতায় টিকে থাকার বিরুদ্ধের বিএনপি কোন শক্তি হয়ে উঠতে যাচ্ছে বা পারবে? এমন অনুমাননির্ভর অনেক প্রশ্নই করা যায়। তা সত্বেও নতুন আরেক ফেনোমেনা অন্যদিকে হাজির হচ্ছে যা আরও বেশি প্রভাবশালী। সেদিকে তাকিয়ে বলা যায়, হাসিনার ক্ষমতায় টিকে থাকার জন্য বিএনপির এই আন্দোলন সরকারের জন্য প্রধান চ্যালেঞ্জ নয়। যদিও ইতোমধ্যে হাসিনা “হেফাজতের মত বিএনপিকে” দমন ধরণের একটা ম্যাসাকার করে ফেলতে পারেন এমন ইঙ্গিত-হুমকি দিয়েছেন। এসব সত্বেও বরং হাসিনার ক্ষমতায় থাকার প্রধান চ্যালেঞ্জ হয়ে হাজির হয়েছে দেশের অর্থনীতি! একেবারে সুনির্দিষ্ট করে বললে সরকারের কোষাগারে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বা ডলার সংকট। উপদেষ্টা তৌফিক এলাহির ভাষায় টাকা নাই বা জ্বালানি “কেনার পয়সা নাই…”। অথবা বিদ্যুৎ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদের ভাষায় – আন্তর্জাতিক স্পট মার্কেটে গ্যাসের দাম বেশি তাই কেনা হয় নাই – এসবই হল, ডলার সংকটের বাইরের চেহারা।
সারকথায় বললে, আসলে হাসিনার ক্ষমতায় থাকার জন্য বিএনপির আন্দোলনের চেয়েও আরো বড় চ্যালেঞ্জ হল রিজার্ভে ডলার না থাকা। বাংলাদেশ ব্যাংকে যথেষ্ট ডলার সঞ্চিত না-হওয়া বা থাকা। এখন সরকার নগদ ডলার যোগাড় করতে না পারলে বিএনপির কোন আন্দোলন হোক আর নাই হোক, সেসব ছাড়াও সরকার ভেঙ্গে পড়তে পারে!
যেমন ধরা যাক, চুয়াত্তরের দুর্ভিক্ষ – এর ঠিক কারণ নয় তবে ঐ দুর্ভিক্ষকে ঠেকাতে না পারার শেষ কারণ ছিল তখনো রিজার্ভে এমন ডলার ছিল না যে দেশজুড়ে খাদ্য সংকটে পড়া দেশের সরকার আন্তর্জাতিক বাজার থেকে খাদ্য কিনে আনবে – এমন সক্ষমতা ছিল না। এর সাথে তুলনা করতে পারি তত্ত্বাবধায়ক আমলে ২০০৭ সালের শেষে আইলা ঘুর্ণিঝড়ের পরের খাদ্য সংকট সামলে ফেলতে সক্ষম হতে পারাকে। তখন কেন সফল হয়েছিল? কারণ, তখন মূল ফ্যাক্টর ছিল সরকারের হাতে যথেষ্টে ডলার মজুদ থাকা। তাই সহজেই সেসময় দেশের যেই-ই চাল আমদানির এলসি খুলতে চেয়েছিল তাকেই তা খুলতে দিতে পেরেছিল সরকার। ফলে ভারতের চাল বেচতে না চেয়ে তৈরি আইনি বাধা সত্বেও আমাদের আমদানিকারকেরা ভারতসহ যেদেশ থেকেই পেরেছে চাল আমদানি করে সংকট সামলে ফেলেছিল। আর তিন-চার মাসের মধ্যে বোরো ধান উঠে যাওয়াতে সব সংকট কেটে গেছিল।
দুনিয়ার যেকোন কথিত কমিউনিজমে থাকা অর্থনীতির কমন লক্ষণ হল সারা বছর আকন্ঠ ডলার সংকটে থাকা – এটা ব্যতিক্রমহীন একটা মারাত্মক ও কমন সংকট। ফলে তাজউদ্দিনের “কমিউনিস্ট ফ্যান্টাসিও” এই অলীক কল্পনাও এথেকে বাইরে ছিল না। সেকারণে, ১৯৭৪ সালে রিজার্ভের মারাত্মক সংকটে ছিলাম আমরা। ফলে তখন দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখা ছাড়া শেখ মুজিবের কিছু করার ছিল না। অপরিনামদর্শী ও কমিউনিস্ট সাজতে চাওয়া ফ্যান্টাসীর তাজউদ্দিন এন্ড গংদের মন্ত্রীসভা ও নানান কমিশন-কমিটি থেকে তিনি বাদ দিয়েছিলেন ঠিকই কিন্তু সেটা অনেক দেরি হয়ে গেছে তাই দেশ বাঁচাতে পারেন না। আর এঘটনারই লেজ ধরে শেষে তিনি নিজেই ক্ষমতাচ্যুত হয়ে গেছিলেন। বাকশাল ইত্যাদি করে সব ক্ষমতা নিজ হাতে কুক্ষিগত করে সব সামলাবেন ভেবেছিলেন। খেয়াল করতে হবে, কিন্তু মূলপ্রশ্নটা তো টাকা নয় ডলার সংকট; যা তাঁকে ক্ষমতা সংহত বা কুক্ষিগত করতে পারা না পারার সাথে একেবারেই সম্পর্কিত নয়। কিন্তু তাতে দলের ভিতরেই এটা একটা অংশকে উতসাহিত করেছিল আর সাথে বিদেশিস্বার্থ প্রভাবকেই পরিস্থিতিকে তাদের নিজ দখলে নিতে সুবিধা করে দিয়েছিল। তাই দেখাই যাচ্ছে বিএনপিকে “হেফাজত দমনের মত” একটা ম্যাসাকার করে ডলার সংকট মিটবে না। তবু সরকার এটা নিয়েই সিরিয়াস বলে মনে হচ্ছে। যেমন আওয়ামি লীগের অন্যান্য নেতা ও হাসিনার পরিবারের সদস্য বাংলাদেশ আওয়ামী যুবলীগের কেন্দ্রীয় নেতা ও সংসদ সদস্য মুজিবর রহমান চৌধুরী নিক্সন বলেছেন, [প্রথম আলো লিখছে] দেশে স্বাধীনতাবিরোধীরা যেভাবে মাথাচাড়া দিয়ে উঠছে, তাতে রাজনৈতিক শক্তি ও সামর্থ্য প্রদর্শন করা এখন অপরিহার্য হয়ে দাঁড়িয়েছে।
আবার খাদ্যমন্ত্রী সাধন চন্দ্র মজুমদার বলেছেন, “বিএনপি স্বাধীনতাবিরোধীদের পৃষ্ঠপোষক দল। তারা এখনো স্বাধীনতাবিরোধী শক্তিকে সঙ্গে নিয়ে রাজনীতি করে। বাংলার মানুষ দেশবিরোধী শক্তিকে আর ক্ষমতায় দেখতে চায় না”।
অর্থাৎ আওয়ামি লীগ এবার স্বাধীনতাবিরোধী বলে শক্তি ও সামর্থ্য প্রদর্শন করে বিরোধীদের দমনে মাঠে নামতে চাইছে? তাই কী???
আইএমএফ, এই আশার বাতি জ্বালানোঃ
সরকার এনিয়ে সব শেষে একটা আশার আলো জ্বালানোর চেষ্টা করছে; সেটা হল দাতা আইএমএফের টিমের বাংলাদেশ সফর। প্রথম আলো লিখেছে, “৩০ ও ৩১ অক্টোবর এবং আগামী ২ ও ৮ নভেম্বর আবারও কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সঙ্গে সভার সূচি রয়েছে। ৪৫০ কোটি ডলার ঋণ চেয়ে গত জুলাইয়ে আইএমএফের কাছে যে চিঠি পাঠিয়েছিল বাংলাদেশ, সে ব্যাপারে আলোচনা করতেই দলটি এখন ঢাকায়। আইএমএফের ১০ সদস্যের প্রতিনিধিদলের নেতৃত্ব দিচ্ছেন সংস্থাটির এশীয় ও প্যাসিফিক বিভাগের প্রধান রাহুল আনন্দ”।
আসলে গত জুলাই মাস থেকেই বাংলাদেশে এটা একেবারে উদাম হয়ে পড়েছিল যে ডলারের অভাব বা একটা রিজার্ভ সংকটে আমরা পড়ে গেছি যেটা আর লুকানো থাকছে না। তখনও অর্থমন্ত্রী ও সরকার অর্থহীনভাবে তা লুকানোর চেষ্টা করে যাচ্ছিল যে না তারা নাকি আইএমএফের কাছে যায়নি। আবার যখন সরকারের আইএমএফ-কে দেয়া চিঠিটাই প্রকাশ হয়ে পড়ল তখন খবরটা স্বীকার করে নিলেও সরকারের আবার লুকোচুরি যে কোন আইএমএফের টিম আসে নাই। যারা তখন এসেছিল তারা অন্য রুটিন ভিজিটে এসেছে। অথচ এরকম বলে আড়াল করার চেষ্টাটাও ছিল একেবারেই অপ্রয়োজনীয়। এছাড়া ঐ টিমর সফর থেকে শেষে অর্থনীতি সংস্কারের প্রশ্ন উঠলে মানে এই প্রস্তাব দিবে আইএমএফ, এটা জানতে পেরে সরকার বলার চেষ্টা করেছিল তারা এখন কোন সংস্কারের পক্ষে নয়। ফলে আইএমএফ ইস্যু চাপা পড়ে যেতে দেখেছিলাম আমরা।
সেই চাপা পড়া ইস্যু দেখা যাচ্ছে এখন আবার বড় আশার আলো হিসাবে সরকার তুলে ধরতে চাইছে। যেমন মিডিয়া লিখছে, “…… জানতে চাইলে বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র জি এম আবুল কালাম আজাদ প্রথম আলোকে বলেন, ‘আইএমএফ অর্থনীতি ও ব্যাংকের বিভিন্ন সূচক নিয়ে তথ্য জানতে চেয়েছে। তারা কিছু বিষয়ে সংস্কারের পরামর্শ দিয়েছে। আশা করছি, আগামী দুই সপ্তাহের মধ্যে ঋণের বিষয়ে ইতিবাচক সিদ্ধান্ত মিলবে। এর মধ্যে বাংলাদেশ ব্যাংকের সঙ্গে সংস্থাটির আরও সভা হবে।’
এতে শেষের দিকের বাক্য,… “আশা করছি, আগামী দুই সপ্তাহের মধ্যে ঋণের বিষয়ে ইতিবাচক সিদ্ধান্ত মিলবে”। এটা বলাই বাহুল্য অতি আশাবাদ।
প্রগতিশীলতা ও আইএমএফ-বিশ্বব্যাংকঃ
আইএমএফ-বিশ্বব্যাংক এর প্রসঙ্গ-কথা উঠলেই আমাদের প্রগতিশীলেরা খুব সরব হয়ে উঠেন। ভাব করেন যেন তারা প্রতিষ্ঠানটা বুঝেন। যদিও কেউ সত্যি সত্যিই আইএমএফ-বিশ্বব্যাংক এর জেনুইন ও কঠোর সমালোচক হতেই পারেন। কিন্তু তিনি যদি প্রতিষ্ঠানটার গ্লোবাল (নেতি বা ইতি) ভুমিকা দূরে থাক ফাংশনারিজ-ই না বুঝেন এর কাজ ও উদ্দেশ্য বুঝেন তো এই সমালোচক আসলে একজন খামোখা। তারা আসলে এক আইডিয়াল (ideal) সমালোচক মাত্র। এরা আসলে বাস্তব বা real নয়। হয়ত এথিক্যাল সমালোচক! সবচেয়ে বড় কথা যেন তারা “গ্লোবাল অর্থনীতি” বুঝেন, এই ভান করেন। একই কারণে এরা কিন্তু ১৯৪৫ সালের পর থেকে দুনিয়াতে যে “গ্লোবাল সিস্টেম” – মানে একটা পলিটিক্যাল ও ইকোনমিক গ্লোবাল সিস্টেম গড়ে উঠেছে তা টেরই পান নাই। আবার অবশ্যই একথা মনে করিয়ে দেয়া মানে গ্লোবাল সিস্টেমটাকে আদর্শ বলা নয় বা মেনে নেয়া নয়। এই সিস্টেমের বিরুদ্ধে এর সীমাবদ্ধতা নিয়ে অসংখ্য প্রশ্ন অবশ্যই তোলা যায় এবং সবগুলোই জেনুইন। মানে আরো বদলে নেয়া দরকার আছে। কিন্তু এই সীমাবদ্ধতা তখনই বলা সম্ভব বা আপনি বলতে পারেন যখন আপনি জানেন এই সিস্টেমটা আসলে কী ও কেন ইত্যাদি!
যদিও সবকিছু ছাড়িয়ে তাদের প্রগতিবাদের যে অজ্ঞতা একেবারেই অগ্রহণযোগ্য তাহল তারা আন্তঃরাষ্ট্রীয় বাণিজ্য জিনিষটাই আজও বুঝতে পারেন নাই। যেন, “দরকার কী” এমন মনে করেন! ফলে গ্লোবাল বাণিজ্য তো আরো দুরের; তাদের বুঝাবুঝির দুরস্ত! তাদের সাবজেক্টই নয় সেটা। কারণ আদৌ বাণিজ্য করাই হারাম না হালাল এই প্রশ্নে তারা এখনো বোবা। কিছুই নিশ্চিত নয়। যদিও তারা শুনেছে ফলে তাদের মন বলতে চায় বা সাহসীরা বলবে – বাণিজ্য করা হারাম। কারণ এরা বলবে এখানে মুনাফা আছে। আর মুনাফা মানেই তো ‘শোষণ’, সারপ্লাস ভ্যালু ইত্যাদি ইত্যাদি……।
এখন কেউ যদি গ্লোবাল বাণিজ্য এর গুরুত্ব এবং অপরিহার্যতা বুঝুক বা না বুঝুক তবু স্বীকার করে নেয় তবে এবার আরেক মুখ্য প্রশ্ন সামনে আসবে যে গ্লোবাল বাণিজ্য চাইলে তো একটা গ্লোবাল অর্থনৈতিক সিস্টেম – একটা গ্লোবাল ব্যবস্থাপনা ও প্রতিষ্ঠান সেটা তো লাগবেই! সেটার কী হবে??? বাস্তবে ১৯৪৫ সালের এই প্রতিষ্ঠানটাই আইএমএফ-বিশ্বব্যাংক। কিন্তু সেকালের কমিউনিস্ট গুরু সোভিয়েত রাষ্ট্রের স্তালিন মূলত এনিয়ে সিদ্ধান্ত-ই নিতে পারেন নাই। আর তা থেকেই আজকের কমিউনিস্ট-প্রগতিবাদের এই দুর্দশা! তারা আন্দাজে কথা বলে চলছেন। আসলে অর্থনীতির দিক থেকে বিচারে বললে “স্তালিনিস্ট কমিউনিজম চিন্তা” এটা এক উগ্র ন্যাশনাল ইকোনমি চিন্তা। কিন্তু কী অর্থে ন্যাশনাল বলছি? এই চিন্তার প্রধান বৈশিষ্ট হল এটা একটা নিজ রাষ্ট্রসীমার মধ্যেই অর্থনীতি ও বিনিময় এই সীমায় সীমাবদ্ধ থাকবে এমন কল্পনা। সোজা করে বললে, এতে আন্তঃরাষ্ট্রীয় বাণিজ্য ব্যাপারটাই দরকার হবে না বা নাই। সেকারণে ও এভাবেই স্তালিনের সোভিয়েত ইউনিয়ন আইএমএফ-বিশ্বব্যাংকের জন্মের ‘ব্রিটনউড সম্মেলনে’ যোগ দিয়েও পরে আইএমএফ-বিশ্বব্যাংকের সদস্যপদ আর নেন নাই। আর স্তালিন সবচেয়ে বড় অন্যায় করেছেন তিনি তার এই সিদ্ধান্তের কারণ কোথাও ব্যাখ্যা করেছেন জানা যায় না। পরিণতিতে ১৯৯১ সালে এসে সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙ্গে গেলে ভাঙ্গা ১৫ রাষ্ট্রের টুকরা (রাশিয়াসহ) সকলেই আই-এমএফ-বিশ্বব্যাংকের সদস্যপদ নিয়ে নিয়েছিল। এবং সেটাও কোন কারণ ব্যাখ্যা করা ছাড়াই। সেই থেকে বুঝি আর নাই বুঝি আইএমএফ-বিশ্বব্যাংক নিপাত যাক – এটাই হয়ে আছে প্রগতিবাদি শ্লোগান।
কিন্তু এসব আলাপ তুলছি কেন?
উপরের প্রসঙ্গ এনিয়ে বিস্তারিত আলাপ করতে হবে। এত ছোট পরিসরে তা অবশ্যই হবে না। কিন্তু এখানে এখন বাংলাদেশের রিজার্ভ বা ডলার সংকটের আলাপের সাথে এসব আলাপের প্রাসঙ্গিকতা কী?
প্রাসঙ্গিকতা হল, হাসিনা সরকারের “আগামী দুই সপ্তাহের মধ্যে ঋণের বিষয়ে ইতিবাচক সিদ্ধান্ত পাবার” যে আশাবাদ রেখেছে তা বাস্তবে দেখতে পাবার সম্ভাবনা খুবই কম। ফলে আওয়ামি ঘরানা থেকে এনিয়ে আইএমএফ-বিশ্বব্যাংক এর ছোট বা বড় সমালোচনা উঠা সম্ভবত আমরা দেখতে যাচ্ছি। কিন্তু এটা যদি হয় তখন এই সুযোগে অবুঝ প্রগতিবাদের একটা আইএমএফ-বিশ্বব্যাংক সমালোচনা ইতোমধ্যেই উঠেছে সেটা আরো বড় হবার সম্ভাবনা। তাই আগাম সাবধান করা। আর সেখান থেকে “বিকল্প দেখাও” এর দিকে আলাপ চলে যাবার সম্ভাবনা, আওয়ামি-প্রগতিবাদি এমন সাফাই দেখব হয়ত। দেখা যাক!
তবু একটু অন্য প্রসঙ্গেঃ এখানে আমরা লক্ষ্য করছি যে আইএমএফ নিয়ে সরকারে যে আশাবাদ তৈরি করা হচ্ছে তাতে বহু ভুল বুঝাবুঝি আছে। যেমন, আসলে আইএমএফ যদি সরকারের সাথে সব ব্যাপারে একমত হয়ও তাহলেও বাংলাদেশ যা পাবে তা হল বছরে মাত্র দেড় বিলিয়ন ডলার, এভাবে তিনবছরে মোট সাড়ে চার বিলিয়ন ডলার। এটা পরিমাণে খুবই কম। আমাদের এক মাসের ঘাটতি পূরণের দিক থেকে যদি বিচার করি তো এটা তারও অর্ধেকও না!
সারকথায় এটা বাংলাদেশের ডলার সংকট মিটানোর পরিমাণের দিক থেকে অপ্রতুল অবশ্যই। কিন্তু আইএমএফ টিমের এই সফরের মুল্য অন্যখানে। সেটা হল আইএমএফের এই সফর প্রক্রিয়াটা হল, গ্লোবালি সারা বিনিয়োগ-পুঁজি বাজারকে আশ্বস্ত করা যে বাংলাদেশে অর্থনৈতিক অবস্থাটা ঠিক কী কেমন তা একটা বিস্বস্ত ও বাজারের আস্থার প্রতিষ্ঠান আইএমএফ পরীক্ষা করেছে। তাই এই প্রতিষ্ঠানের রেকমন্ডেশন থেকে যেন বাজার আস্থার সাথে বুঝে নেয়, নিতে পারে যে নতুন করে বাংলাদেশকে বিনিয়োগ বা ঋণ দেয়ার দিক থেকে বাংলাদেশ কতটা যোগ্য। সেখানে দাতাদের কী কী সতর্কতা লাগবে। তাই আইওএমএফের এই সফর আসলে গ্লোবাল বাজারের পক্ষ থেকে বাংলাদেশকে পরীক্ষা যে সংকটের ধরণ ও গভীরতা পরীক্ষা করে নেয়া আর সে অনুযায়ী নতুন করে যে চায় সে অর্থনৈতিক সম্পর্কে জড়ানোর সুযোগ নেয়া বা নিতে পারে।
চিবিয়ে খাইনিঃ
কালচারাল অর্থে এটা হাসিনার দিক থেকে খুবই আনফেয়ার প্রতিক্রিয়া। জনগণের জানার অধিকার আছে, একথা মনে রাখলে কোন সরকারের এমন প্রতিক্রিয়া অগ্রহণযোগ্য। এখন কালচারাল আর অধিকারের দিক ছেড়ে অন্যদিকে আসি। এখানে প্রসঙ্গ দুইটা।
একঃ রিজার্ভে ডলার কত আছে তা দেখানোর যে ফরমাট আইএমএফ-এর স্টান্ডার্ড ফরমাট – তা আইএমএফের সদস্য যেকোন রাষ্ট্র বা সরকার অনুসরণ করে চলতে বাধ্য। এটা সদস্যপদ লাভের পুর্বশর্ত ছিল। সদস্য হবার আগেই তা বুঝতে পেরেছি বা বুঝে নিয়েছি কিনা তা স্বীকারপত্র দিতে হয়েছিল। কাজেই এখন “আমার স্টাইল আলাদা” বলে কোন অজুহাত তোলা মানে সরকার নিজেকে নাদান ও সাব-স্টান্ডার্ড করে হাজির করা হবে। এটা কাম্য নয়।
দুইঃ “নিজের টাকায় করব”। জাতিবাদি শুরশুরি খুবই ভয়ঙ্কর জিনিষ। তাই নিজের টাকায় ব্রীজ করব – এটা খুবই আত্মঘাতি জাতিবাদি শুরশুরি। আমাদের মত দেশ কেবল এই প্রথম, কোন কোন মাসে বাড়তি কিছু ডলার (টাকা নয়) ইতি ব্যালেন্স জমাতে পারি এমন অবস্থা তৈরি হচ্ছিল। কিন্তু এর মানে এই না যে আমরা একটা পায়রা বন্দর নিজের জমাকরা ডলার দিয়ে বানাতে পারি – এমন অবস্থায় পৌছিয়েছি। এটাই এখন প্রমাণিত। আমরা আমাদের সঞ্চিত রিজার্ভ থেকে ডলার নিয়ে (এটা বাংলাদেশি টাকা না) অবকাঠামো নির্মাণে যাবার মত সমৃদ্ধ অর্থনীতিতে পৌছিয়েছি – এটা সত্য না। অথচ আমাদের সরকার একাজই করেছে। এছাড়া সরকার বারবার এটা ডলার না বলে নিজের টাকায় করেছি বলে একটা জাতিবাদি শুরশুরি তৈরির চেষ্টা করছে। কেন?
প্রশ্ন আরো আছে। পায়রা বন্দর নির্মাণ কেন জরুরি? না নির্মাণ করলে আমাদের কী ক্ষতি হত? আমাদের জানা নাই। সরকার বলতে পারে নাই। এছাড়া আরো বড় প্রশ্ন এর ভায়াবিলিটি বা এই প্রকল্প নেয়া সঠিক হয়েছে কিনা!!! জায়গা ঠিক কিনা? প্রকল্পের বিনিয়োগ আয় থেকে ফিরে আসবে কিনা? ইত্যাদি নানান উত্তর পজিটিভ কিনা।
এই বন্দর নির্মাণ আসলে ছিল অনুচিত। এর ইকনমিক ভায়াবিলিটি ছিল কী? যেখানে এ্টার টেকনিক্যালিই ভায়াবিলিটি নাই। মূল কারণ এর নাব্যতা নাই। মানে স্থান নির্বাচনই সঠিক নয়। কারণ একে চালু রাখতে গেলে সারাবছর পলি সরানো ড্রেজিং ব্যাপকভাবে চালু রাখতে হবে। স্থান নির্বাচনই সঠিক হয় নাই। এসব নিয়ে খোদ ততকালীন অর্থমন্ত্রী মাল মুহিত নিজেই নিজের আপত্তির কথা তুলেছিলেন।
অবস্থা এখন দাড়িয়েছে এই যে আমাদের তেল-গ্যাস আমদানির ডলার নাই অথচ আমরা এই অচল পায়রা বন্দরে টাকা নয় ডলার ঢেলে চলেছি, কেন? আজ কোথায় ভারতীয় বিনিয়োগ? নেদারল্যান্ডের বিনিয়োগ? এটা নাকি সোনাদিয়ার বিকল্প হবে? অথচ পায়রা বন্দরের গভীরতা মানে কত বড় জাহাজ নোঙর করতে পারবে – তা চট্টগ্রাম বা মোংলা বন্দরের নিচে। আমরা জানি না এই নন-ভায়াবল এক প্রকল্প কেন? কেন এটা এসেনশিয়াল অতি জরুরি? সবচেয়ে বড় কথা এই প্রথম কেন আমরা মজুদ থেকে এই প্রকল্প খরচ করব?
গৌতম দাস, রাজনৈতিক বিশ্লেষক
goutamdas1958@hotmail.com