পাকিস্তান সেনাবাহিনী জনগণের মুখোমুখি
গৌতম দাস
০৭ নভেম্বর ২০২২
COAS General Bajwa approached US after taking authorisation from PM Shahbaz Sharif
[সারকথাঃ একটা মনার্কি (monarchy) বা রাজতন্ত্রের বিপরীতে যেকোন রিপাবলিক রাষ্ট্র; এর ক্ষমতার একমাত্র উতস হল জনগণ। জনগণের সম্মিলিত ইচ্ছা-আকাঙ্খাই হল রাষ্ট্রক্ষমতার উতস! তাই, এমন রাষ্ট্র মাত্রই ওর যেকোন রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান আর সাথে এর নির্বাহি ক্ষমতার প্রশাসন বা বিচার বিভাগ বা সেনা প্রতিষ্ঠান সকলেই তাদের সকল নির্বাহী ক্ষমতা অবশ্যই সেই গণক্ষমতার অধীন। এই বিচারে পাকিস্তানের সেনাবাহিনীকেও জনগণের ক্ষমতার অধীনস্ততা মানতেই হবে। জনগণের কাছে, গণক্ষমতার কাছে জবাবদিহিতায় ও অধীনস্ততায় থেকে কাজ করতেই হবে। কিন্তু বর্তমান পাকিস্তান সেনাবাহিনী সেনাকর্তারা যেন মনে করতে চান যে তাদের কোন সদস্য বা জেনারেলের বিরুদ্ধে পাকিস্তানের সিভিল আদালতে মামলা করা যাবে না।
এটা সত্যি যে সেনাসদস্যরা দেশ সুরক্ষা করার কাজে (যেমন কোন বিদেশি মানুষ খুনের মত) কোন অপরাধ করে বসলে যেটা সিভিল আইন আদালতের চোখে ক্রিমিনাল অপরাধ হলেও এর জন্য তাদের কোন সদস্যের বিচার সিভিল আদালতে হবে না। এধরণের পেশাগত অপরাধের ক্ষেত্রে মনে করা হয় এমন বিষয়াদি সেনাদের “নিজস্ব কোর্ট মার্শাল” এই প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামোতে আইন-অপরাধগত দিক পরীক্ষা করে দেখা হবে। কিন্তু সাবধান এর মানে এই নয় যে সেনাসদস্যদের যেকোন অপরাধ দেশের প্রচলিত আইন-আদালতের উর্ধে । কোন সেনাসদস্য যদি কোন সিভিলিয়ান যেমন কোন রাজনীতিবিদকে খুন করে সেক্ষেত্রে কী তাদের বিরুদ্ধে কোন অভিযোগ সিভিল প্রসাশন ও বিচার বিভাগের কাছে চাওয়া যাবে না! তাদের জন্য কী পুলিশ আদালত সব মাফ – এসব সিভিল প্রতিষ্ঠানগুলো সেনা সদস্যদের কোন সিভিল নাগরিকের বিরুদ্ধে করা অপরাধ আমল করতে পারবে না? সেনারা কী সবধরণের আইন-আদালতের উর্ধে???? এটা হতে পারে না।
বর্তমান সেনাপ্রধান ও সেনাগোয়েন্দা (ISI) প্রধান নিজেদেরকে এমন সবকিছুর উর্ধে গণ্য করে ধমকিয়ে চলতে চাইছেন। এটা অগ্রহণযোগ্য; তারা কোন স্বয়ম্ভু ক্ষমতার অধিকারী নন। তারা এক মুহুর্তের জন্যও ভুলে যেতে পারেন না যে রাষ্ট্র এর ক্ষমতার একমাত্র উতস জনগণ। ফলে শেষ বিচারে কোন না কোন জনপ্রতিনিধি বা জনপ্রতিষ্ঠানের জবাবদিহিতায় ও অধীনস্ততায় থেকে কাজ করতেই হবে। জেনারেলদের এমন অনুমান যে তারা গণক্ষমতার উর্ধে, এই অনুমানে আচরণ – আর সেখান থেকেই সব সংকট এবং তা এক গভীর সংকট পাকিস্তানের আকাশে অন্ধকার হয়ে নেমে আসতে দেখা যাচ্ছে। ]
ঘটনা সংক্ষেপ হলঃ
পাকিস্তানের অন্যতম রাজনৈতিক দল ইমরান খানের পিটিআই দলের এক রাজনৈতিক কর্মসুচীতে মিছিলের উপরে আততায়ীর বড় রাইফেলসহ গোলাগুলি চালানোর ঘটনা ঘটেছে। এতে অন্তত একজন কর্মী নিহত হয়েছে সাথে সাতজন আহত। আর মুল লক্ষ্যবস্তু ছিল খোদ ইমরান খান। তাঁর উপর ছোড়া গুলি লক্ষ্যভ্রষ্ট হয়ে তাঁর পায়ে লেগেছে। তাও লক্ষ্যভ্রষ্ট হওয়ার কারণ এক পিটিআই কর্মী সময়মত পিস্তলের উপর থাবা দিয়ে ওর অভিমুখ বদলে দিয়েছিল – এর ভিডিও এখন দেশি-বিদেশি মিডিয়ায় দেখা যাচ্ছে। এদিকে এটা রুটিন যে প্রত্যেক গোলাগুলি ও খুনের ক্রিমিনাল ঘটনা পরবর্তিতে যে মামলা হয় (FIR) তাতে ক্ষতিগ্রস্থ ও ভিকটিমেরা তাদের সন্দেহ যাদের উপর তাদের নাম উল্লেখ করে থাকে। আততায়ীর এই জানের উপর হামলা থেকে বেচে যাওয়া ইমরান খান তিনজনকে মূল সন্দেহভাজন বলে চিহ্নিত করে বক্তব্য দিয়েছেন। তিনি বলেছেন, “এই বন্দুক হামলার পেছনে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী শাহবাজ শরীফ, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী রানা সানাউল্লাহ এবং পাকিস্তানের গোয়েন্দা সংস্থা আইএসআইয়ের কর্মকর্তা মেজর জেনারেল ফয়সাল দায়ী” । এটা যেকোন মামলায় সাধারণ প্রাকটিস যে ভিকটিমদের দেয়া সন্দেহভাজনদের নাম এফআইআরে লেখা হয়। আর এফআইআর মানেই প্রমাণিত অপরাধী নয়। ভিকটিমের সন্দেহ মাত্র। যা পরে ইনভেস্টিগেশনে পরিস্কার হবে ও এনিয়ে পরে বিচার শুরু হবে। অথচ সেনাপ্রধান ও সেনাগোয়েন্দা (ISI) প্রধান প্রকাশ্যে ও অপ্রকাশ্যে নানান ন্যাস্টি চাপ সৃষ্ট করে যাচ্ছেন যেন ঐ এফআইআর গৃহিত না হয়। যেন সেনাবাহিনী সবকিছুর উর্ধে – তারা পাবলিকের জবাবদিহিতায় ও অধীনস্ততাতেও নয়। রাষ্ট্র সরকার প্রশাসন কিছুই তাদের উপরে কার্যকর নয়। এই মনোভাব একেবারেই অগ্রহণযোগ্য।
উলটা করে বললে যেন সেনাসদস্যরা কেবল নিজেরা নিজেদের পরিচালিত কোর্ট মার্শালের অধীনে আর কোর্ট মার্শাল হয়ত সেনা প্রধানের অধীনে হলেও খোদ সেনাপ্রধান যেন নিজে আর কোন জনপ্রতিনিধির অধীনে নয়!!!
প্রতিক্রিয়ায় ইতোমধ্যে এই প্রথম পাকিস্তানের আম-পাবলিক সেনা প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে চলে গেছে। এখানে এই টুইটারে দেখা যাচ্ছে ক্ষুব্ধ পাবলিক কিভাবে এক পাকিস্তানি ট্যাংকের উপরে উঠে তাঁর ক্ষোভপ্রকাশ করছে। বলাই বাহুল্য এতে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর ইমেজ কোথায় নেমেছে সেই খারাপ ইঙ্গিতও ফুটে উঠেছে। অথচ সেনাকর্তাদের মধ্যে এই গণবিচ্ছিন্নতার ব্যাপারে উদ্বিগ্ন এর কোন প্রমাণ দেখা যায় নাই!
ঘটনা বিস্তারেঃ
পাকিস্তানের রাজনীতি আবার চরম উত্তপ্ত হয়ে উঠেছে। কার্যত এটা হয়ে দাঁড়িয়েছে গ্লোবাল চীন-আমেরিকা দ্বন্দ্বের এক লোকাল তবে নোংরা নাট্যমঞ্চ। কিন্তু এর মধ্যে সবচেয়ে কেলেংকারির ঘটনাটা হল, পাকিস্তান আর্মি যেভাবে মরিয়া হয়ে নিজেকে ন্যাংটা করে মেলে ধরেছে। অনেকে বলেন পাকিস্তানের আর্মি হল, উপরে আল্লাহ’র পরেই যার স্থান। পরিণতিতে এবার এই প্রথম দেখা যাচ্ছে ক্ষুব্ধ পাকিস্তানি জনগণ নিজ আর্মির গাড়ি ভাংচুর করেছে, লাথি মেরেছে। যা কোনভাবেই কোন ভাল ঘটনা নয়! অর্থাৎ অন্যভাবে বললে, পাকিস্তানের আর্মির উপর আমেরিকান চাপ ও তাদের রাজনৈতিক ইচ্ছার পক্ষে খেদমতে নামতে গিয়ে জেনারেল বাজওয়া ও অন্য জেনারেলেরা আবার গণবিরোধী অবস্থান নিয়েছেন। গণ-ইচ্ছাকে পায়ে দলে আমেরিকান ইচ্ছার সাথে শাহবাজ ও জেনারেলদের সমন্বয়ে তৈরি হওয়া শাসকদের ইচ্ছা মাখিয়ে নিয়ে এক দাগী-আসামির মত দাগী-ক্ষমতা [despotic power] হয়ে জনগণের উপর চড়াও হয়েছে।
পাকিস্তানে সেনাবাহিনীকে এখন পাকিস্তানের রাজনীতিতে “সেনাবাহিনী” নামে ডাকার রেওয়াজ নাই। খোদ সরকার বা বিরোধীদল একে স্টাবলিসমেন্ট (প্রতিষ্ঠান) বা ইন্সটিটিউশন বলে ডাকে ও এসব শব্দ ব্যবহার করে মিডিয়ায় সেনাবাহিনী শব্দটা বুঝানো ও লেখা হয়। যেন এটা একটা non-person তবে একটা প্রতিষ্ঠান মাত্র। এতদিন এভাবেই সেনাবাহিনী ভয় উতপাদন করে চললেও মানুষজন এনিয়ে আর ঘাটাত না। কিন্তু এবার সেই সীমাটাও খোদ জেনারেল বাজওয়া এন্ড গং বিশেষ করে, তাদের সেনাগোয়েন্দা প্রতিষ্ঠান আইএসআই [ISI] নিজেই ভেঙ্গে দিল।
আমাদের মত দেশে সব সেনাগোয়েন্দা সংস্থা কেন্দ্রিক এক কমন প্রবলেম হল যেখানে প্রতিষ্ঠানটার ঘোষিত কাজ হল রাষ্ট্রকে বাইরের শত্রুদের হাত থেকে রক্ষার পক্ষে কাজ করা আর এজন্য গোয়েন্দা তথ্য সংগ্রহ, তা বিশ্লেষণ ও প্রক্রিয়াজাত করে তা ব্যবহার করা। মূলকথা এর কাজ বাইরের শত্রুদের বিরুদ্ধে ততপরতা। মানে ধরে নেয়া আছে দেশের ভিতরের আপন জনগণ অবশ্যই কোন রাষ্ট্র-শত্রু নয় বরং আভ্যন্তরীণ জনগণ শত্রু হবে কেন? তা হওয়ার কারণ থাকতে পারে না। তবে দেশের ভিতরে অপরাধী থাকতে পারে যাদেরকে সামলানোর জন্য প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের অধীনে নয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অধীনে আভ্যন্তরীণ নানা বাহিনীর পুলিশ প্রশাসন আছেই।
কিন্তু না এই আদর্শ ধারণা বা কেমন হওয়া উচিত ধারণা আমাদের ম৫ত দেশে থাকে না। দেখা যায় সেনাগোয়েন্দা সংস্থা আভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে ঢুকে পরে আর আভ্যন্তরীণ সমাজও তার কাজের ক্ষেত্র; এমন মনে করতে শুরু করে থাকে। আর একাজে সাধারণত এই সমস্যাটা তৈরি করে থাকেন ক্ষমতার প্রধান নির্বাহি হিসাবে প্রধানমন্ত্রী বা প্রেসিডেন্ট যেই থাকেন তিনি। কারণ তিনি দেশে তাঁর সরকারের রাজনৈতিকবিরোধীকে খোদ দেশেরই বিরোধী যেন এভাবে তারা রাষ্ট্রবিরোধী বলে চালিয়ে দিতে চান। এখান থেকেই সব সমস্যার শুরু হয়। সব স্বৈরাচার বা ফ্যাসিবাদের জন্ম হয় এখান থেকে। অথচ প্রধানমন্ত্রীর রাজনৈতিক-বিরোধীতা তা কোনভাবেই রাষ্ট্রবিরোধীতা নয়।
আইএস এর ততপরতার যুগে সেনাগোয়েন্দা সংস্থা বড়জোর আভ্যন্তরীণ সিভিল গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর সাথে নিজ সংগৃহিত তথ্য শেয়ার করতে পারে, ব্রিজ-রিলেশন বা সমন্বয় করতে পারে। কিন্তু সেই তথ্য সিভিল গোয়েন্দারা কিভাবে সিভিল জবাবদিহিতার সাথে ব্যবহার করবে এটা তাদের হাতেই ছেড়ে রাখতে হবে। কিন্তু সেনাগোয়েন্দা সংস্থা এখানে সিভিল নাগরিকদের সমাজেও ততপর থাকতে চায়। আর এখান থেকেই সমস্যা কঠিন ও জটিলতর সমস্যা হয়ে যায় যেটা তো হবেই; এতে প্রশাসনিক কাঠামো আর আইন ও বিধি (বিজনেস রুল) নির্ভর থাকবে না। ব্যক্তিইচ্ছা নির্ভর অপেশাদারিত্বে সব ভরে উঠবে।
এই কমন সমস্যা আমাদের মত দেশগুলোতে কমবেশি সকল দেশেই বর্তমান। মূল সংকটটা হল, সিভিল প্রশাসনের অধীনের পুলিশ বা গোয়েন্দা সংস্থার জবাবদিহিতা আলাদা হলেও আইডিয়ালি বা কি এর হওয়া উচিত এই অর্থে বললে, সিভিল জবাবদিহিতার ভিত্তি হল কনষ্টিটিউশনাল নাগরিক অধিকার রক্ষামুখি হয়ে ততপরতা ও তা মান্য করা এবং এই মান্যতায় এরা চলতে বাধ্য। অথচ সেনাগোয়েন্দা সংস্থার কাঠামো এমন নয়। কারণ তাদের প্রকৃত “ডিল করার সাবজেক্ট” তো আভ্যন্তরীণ জনগণই নয়; বরং দেশের বাইরের শত্রু। তাই উলটা বরং তাদের আভ্যন্তরীণ জনগণকে নিয়ে টানা-হেচড়া করাটাই অপরাধ। এটা তার নো গো [no go] এরিয়া। অথচ এই নো গো এরিয়াতে গিয়েই বারবার সেনাগোয়েন্দা সংস্থা ক্ষমতা অপব্যবহার করে আর হোঁচট খায়।
পুরান তর্ক রাজনীতিতে সেনাবাহিনীঃ
এই প্রসঙ্গটাকে অনেকে সামরিক শাসন অবৈধ আর বেসামরিক হলেই তা বৈধ – এমনই এক সামরিক-বেসামরিক তত্ব দিয়ে ব্যাখ্যা করতে চেষ্টা করত আমরা দেখেছি। যেমন শেখ মুজিবের বাকশাল ঘোষণা – তিনি নিজেই আগে প্রধানমন্ত্রী থেকে পরে আপনাতেই এক প্রেসিডেন্ট হওয়াটাকে বৈধ বলা হয়েছিল; কারণ নাকি তিনি সিভিলিয়ান। আর ওদিকে ১৫ আগষ্টের ১৯৭৫ সালের পর থেকে যত সামরিক শাসন কায়েম সব অবৈধ – এই তত্বের জনক ছিল প্রথম আলোর মিজানুর রহমান খান। তাঁর মৃত্যুর পরে দেখা যাচ্ছে এনিয়ে প্রবক্তাও এখন কম। যদিও রাষ্ট্র নিয়ে সিরিয়াস আলোচনার মুরোদ না থাকাতেই এধরণের নিম্নমানের আলোচনা চালু হয়েছিল। আসলে রাষ্ট্রের ভাল-মন্দ কিভাবে বিচার করতে হয় কেমন করে এই বোধের মারাত্মক অভাব। বলা যায় এক শুন্যতা বিরাজ করে এখানে। যেমন কনষ্টুটিউশনে সংশোধনী এনে বাকশাল ঘোষণা করে দেওয়াতে মূল যে অঙ্গ-হানি যা করা হয়েছিল সেটা হল, আগের কনষ্টিটিউশনে দেয়া থাকা নাগরিকের রিট করার মৌলিক অধিকার কেড়ে নেয়া হয়েছিল বাকশাল সংশোধনী ঘোষণাতে। সাথে আদালতেরও মানে বিচারকদেরও নাগরিকের রিট আবেদন শোনার অধিকার কেড়ে নেয়া হয়েছিল। আর নাগরিকের রিট করার অধিকার না থাকা মানে কার্যত সেটা আর কোন রাষ্ট্রই থাকে না। কারণ তাতে সেক্ষেত্রে রাষ্ট্র নাগরিকের মৌলিক মানবিক অধিকারগুলো রক্ষার যে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল আগে তা আইনতই আর কার্যকর না থাকা। যার সোজা মানে ১৯৭২ সালের রাষ্ট্রগঠন ও কনষ্টিটিউশনের সমাপ্তি টেনে দেওয়া হয়েছিল ঐ বাকশাল সংশোধনী এনে। অথচ বাকশাল –সমর্থকেরা আজও গলাবাজি করে। আর সমস্ত ক্ষোভ গিয়ে উগড়ে দেয় সেনাবাহিনীর উপর। যেন সেনাবাহিনীই বাকশাল কায়েম করেছিল। তবে লক্ষণীয় যে ২০০৭ সালের সেনাশাসনের সুবিধাভোগী বর্তমান সরকার ও তার সাঙ্গপাঙ্গরা এখন সেনাবাহিনী নিয়ে একেবারে চুপ হয়ে গেছে।
তাহলে আমাদের মত দেশে সেনাশাসন ঘটার মূল কর্তা কে?
এককথায় এর উত্তর আমেরিকা; যেটা মূলত আমেরিকান প্রেসিডেন্ট ও তাঁর প্রশাসন। ইউজুয়ালি এবং এখনো আমেরিকা সেনাশাসনের প্রধান পৃষ্টপোষক! গ্লোবাল রাজনীতিতে সেকালে সোভিয়েত ইউনিয়ন আর একালে চীনের বিপরীতে আমাদের মত দেশে প্রভাব-বিস্তারের ক্ষেত্রে আমেরিকার জন্য সহজ পথ এটা। তবে একটা মজার উদাহরণ হল, পাকিস্তানে ১৯৯৯ সালে জেনারেল মোশাররফের ক্ষমতা দখল। সেটাই প্রথম আমেরিকার ইচ্ছার বিরুদ্ধে পাকিস্তানে সেনা ক্ষমতাদখল। যদিও এই পরিস্থিতি তৈরি করার জন্য দায়ী ততকালীন আমেরিকার প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিনটন যার আসকারায় প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরীফের সেনা বিভাজনের নীতি-পদক্ষেপের বিরুদ্ধে ঘটেছিল সেই ক্ষমতা দখল। তবে ২০০১ সালের নাইন ইলেভেনে টুইনটাওয়ার হামলার পরে আমেরিকা আগের মতই সেনাশাসনকে আপন করে নিয়েছিল।
সেনা প্রতিক্রিয়া অপেশাদারি, অগ্রহণযোগ্যঃ
বর্তমানের পরিস্থিতিতে পিটিআই দলের নেতারা সরাসরি জেনারেলদেরকে অভিযুক্ত করছেন দেখা যাচ্ছে। কিন্তু এর মানে কী এখন জবাবে জেনারেলদেরকে রাজনীতিকদের উপর প্রতিহিংসাপরায়ন হয়ে উঠতে হবে? তাদেরকে পালটা নিজহাতে শাস্তি দিতে দন্ড নিজ হাতে নিতে হবে? এটা হতে পারে না। কিন্তু ঠিক এজিনিষটাই ঘটে গেছে। “এই হামলাকে ইমরান খানের ‘তৎপরতার কারণে ভারসাম্যহীন হয়ে পড়া’ পাকিস্তানের রাজনীতি নিয়ন্ত্রণের ‘চেষ্টা’ হিসেবে দেখছেন বিশ্লেষকেরা। বিশেষ করে ইমরানের লং মার্চ ও জনসমাবেশ ক্ষমতাসীনদের মনে ভয় ধরিয়ে দিয়েছে। এরই মধ্যে তাঁর সমর্থকেরা ‘স্টাবলিশমেন্টের’ বিরুদ্ধে ইমরানকে হত্যাচেষ্টার অভিযোগ তুলেছেন। তাঁদের দাবি, এদের ষড়যন্ত্রের কারণেই ইমরান খান ক্ষমতাচ্যুত হয়েছিলেন। ফলে ইমরান খানের ওপর এই হামলায় তার সমর্থকেরা আরও বিক্ষুব্ধ হবেন”।
অথচ আইএসআইয়ের প্রধান নাদিম আনজুম, তিনি ইমরানের বিরুদ্ধে বক্তব্য দিয়ে অপেশাদারি কাজ করেছেন। এমনিতেই অতীত রেকর্ড বলছে এমন বক্তব্য সবসময় আইএসপিআর [ISPR] এর তরফ থেকে দেয়া হয় না। তাহলে এবার আইএসআই-এর প্রধানকে তা দিতে হল কেন? কোন দায়ীত্ববান মানুষের কাজ এটা হলে পারে না যে তিনি টেনশন বাড়ানো জন্য কোন কাজ করেন! তিনি সরকারি কর্তা অন্তত এটুকু তাঁর মনে রাখা উচিত ছিল। তবে সবচেয়ে অন্যায় করেছেন তিনি পাবলিকের বোধবু্দ্বিতে আস্থা রাখেন নাই। তিনি কোন রাজনীতিকের সাথে সরাসরি অহেতুক বাকবিতন্ডায় গিয়েছেন। তিনি কোন অন্যায় অপরা্ধ না করে থাকলে তো নিজের উপর আস্থা রাখা উচিত ছিল।
আইএসআইয়ের প্রধান নাদিম আনজুম; তিনি প্রথা ভেঙে ইমরানের বিরুদ্ধে বক্তব্য দিয়েছেন। ছবি: সংগৃহীত
এই প্রতিহিংসা অগ্রহণযোগ্য ও জেনারেলদের অসদাচরণের প্রমাণঃ
পাকিস্তানের রাজনীতিতে মূল তর্ক মানে এর পিছনে যে গ্লোবাল রাজনৈতিক লড়াই – তাতে তা চীন-আমেরিকার লড়াই হয়ে আছে। যেমন সেটা হল, সাংহাই কর্পোরেশন অর্গানাইজেশন [SCO] এর এবছরের সম্মেলন চীন-রাশিয়া-ভারত এই জোট মেরুকরণ হয়ে যায় যা বলাই বাহুল্য বাইডেনের চলতি ততপরতাগুলোরই প্রতিক্রিয়া। আর এখানেই পাকিস্তান ও ভারত (যারা দুই রাষ্ট্রই SCO এর সদস্য সেই সুত্রে) দুই রাষ্ট্রই একসাথে ঐ মেরুকরণে সামিল হয়ে যায়। ফলে এই মেরুকরণকে দুর্বল করতে বাইডেন প্রশাসন ভারতের বিরুদ্ধে পাকিস্তানকে খাড়া করার উদ্যোগ নিয়েছিল। এতে অন্তত ও আপাতত বাইডেন সফলতা দেখতে পাচ্ছে। কারণ, মুসলিম লীগ (নওয়াজ) আর পিপিপি বা ভূট্টোর দল যারা আবার ইমরানের দলের বিরুদ্ধে জোটবদ্ধ এরা, আগে থেকেই আমেরিকান সমর্থনে ইমরানকে ক্ষমতাচ্যুত করার অপ-ততপরতায় লিপ্ত ছিল। সেই এপিসোডে ইমরান খান সরাসরি দক্ষিণ-পুর্বএশিয়ার আমেরিকান উপ-পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডোনাল্ড ল্যু এর বিরুদ্ধে পাকিস্তানের রাজনীতিতে নাক-গলানোর আনুষ্ঠানিক অভিযোগ তুলেই ক্ষমতা ত্যাগ করেছিলেন। অর্থাৎ (নওয়াজ) আর ভূটোর দল যারা মূলত উভয়েই দুর্নীতির অভিযোগে অভিযুক্ত আর নাহলে পেন্ডিং দুর্নীতির মামলার আসামি – অথচ আমেরিকাকে এই দুনীতিবাজ দুই দলকেই সঙ্গ দিয়ে তাদেরকেই বেছে নিতে হয়েছিল নিজস্বার্থ হাসিলের পথে আগাতে হয়েছিল। সারকথায় আমেরিকাকে অনৈতিকতা সাথে নিয়ে হেটেছে আর সাথে সেনা প্রতিষ্ঠানকেই নিয়েছে নিজের অসৎ উদ্দেশ্যকে চরিতার্থ করতে। অথচ সেটা এমন এক সময়ে যেখানে সারা পাকিস্তানে ইমরান খান জনস্বার্থের প্রতীক হয়ে উঠেছেন। আসলে বাইডেনের আমেরিকার রাজনীতি এতই দেউলিয়া দশা যে তাকে পাকিস্তানকে প্রভাবিত করতে হচ্ছে খারাপ রাজনীতিবিদদের মাধ্যমে যাদের পাবলিক রেটিং সর্বনিম্ন!!! সেকারণে, প্রতি মুহুর্তে ক্ষমতাসীনেরা যত ষড়যন্ত্রমূলক আচরণ বা ততপরতা করছে এর দায়ভার আমেরিকার উপরও বর্তাচ্ছে। এভাবে চলে পাকিস্তানে আমেরিকান স্বার্থ কতদুর কী হাসিল হতে পারে???
ওদিকে সেনা প্রতিষ্ঠান যে অসদাচরণ ও প্রতিহিংসায় জড়িয়েছে এর একটা বড় প্রমাণ হল সিনেটর আজম সোয়াতি [Azam Swati ] এর সাথে জেনারেলদের আচরণ। আজম পিটিআই দলের সিনেটর। বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শাহবাজ ও তার ছেলে অর্থপাচার মামলার আসামি ছিলেন। এর বিচার আদালতের শুরু হবার মুহুর্তে তিনি প্রথম প্রধানমন্ত্রীর শপথ নিয়েছিলেন। এবং বিরোধীদের অনুমান ও অভিযোগ যে, ক্ষমতায় এসেই তিনি আমাদের দুদকের মত তাদের প্রতিষ্ঠান [FIA] কে প্রভাবিত করে নিজেরা বাপ-ছেলে ঐ মামলা থেকে নিজেদের মুক্ত বা জড়িত নয় বলে এফআইএ এর তরফ থেকে সার্টিফিকেট যোগাড় করে নিয়েছেন।
ঘটনার শুরু এরপর থেকে এটা নিয়ে! কারণ, সেনাপ্রধান বাজওয়া শাহবাজ বাপ-বেটার দায়মুক্তিতে তাদের কে অভিনন্দন জানিয়েছিলেন। আর এটা নিয়ে বাকা কথায় টুইটারে স্টাটাস দিয়েছিলেন এই সিনেটর আজম সোয়াতি। আর এর প্রতিক্রিয়ায় সেনাপ্রধান বাজওয়া প্রতিহিংসা পরায়ন হয়ে উঠেন। তিনি আমাদের দেশের মত সাইবার মামলা দায়ের করান আজমের বিরুদ্ধে, শুধু তাই না। তিনি তাকে গ্রেপ্তার করান যেখানে “নিরাপত্তা বাহিনীর হেফাজতে তাকে শারীরিকভাবে নির্যাতন করা হয় বলে অভিযোগও করেছেন সোয়াতি। অথচ মামলা যে তেমন সিরিয়াস কিছু নয় তা বুঝা যায় আদালত আজমকে প্রথমদিনই জামিন দিয়ে দেয়।
কিন্তু প্রতিহিংসার সবচেয়ে বড় উদাহরণ ইতোমধ্যেই হাজির হয়ে গেছেঃ
গত ৫ নভেম্বর এক সাংবাদিক সম্মেলনে এসে সিনেটর আজম সোয়াতি কান্নায় ভেঙ্গে পড়েন। কেন?
তিনি কয়েকদিন আগে অন্য এক শহরে (কোয়েটা) গেছিলেন সস্ত্রীক। সেখানে এক সরকারি গেস্ট হাউজে ছিলেন। আজম সোয়াতি জানাচ্ছেন তার স্ত্রীর কাছে কেউ এক ভিডিও ক্লিপ পাঠিয়েছে। কেন? আর সেই ক্লিপ হল, তাদের স্বামী-স্ত্রীর অন্তরঙ্গ মুহুর্তের এক ভিডিও। আর এটা হল সেই গেষ্ট হাউজে থাকার রাতের ছবি। কোন দম্পতির রাতের সজ্জার অন্তরঙ্গ মুহুর্তের ছবি গোপনে রেকর্ড করা – এটা কোন সভ্যতা? কোন বাহাদুরি?
তাহলে এখন এটা কেমন প্রতিহিংসামূলক আচরণ? এটা কী কোন দায়ীত্ববান ও নুন্যতম সেনসেটিভ ব্যক্তিত্বের সাথে সামঞ্জস্যপুর্ণ? জেনারেলেরা নিজেদেরকে রাষ্ট্রের উর্ধে এক ব্যক্তিত্ব হিসাবে দেখতে চান! তাই সে প্রয়োজনে তারা পাকিস্তানের রাজনীতিকে আর কত নিচে নিবেন! আর সবমিলিয়ে এতে আমেরিকা নিজ দায় ও সংশ্লিষ্ঠতা থেকে কী দূরে থাকতে পারবে!!!
ইতোমধ্যে প্রধানমন্ত্রী জানিয়েছেন তিনি প্রধান বিচারপতিকে লিখবেন এই জুডিশিয়াল এনকোয়ারির জন্য! কিন্তু এটা কী ক্ষমতাবানদের এই অসভ্যতা থেকে পাকিস্তান সমাজকে বের করে আনতে পারবে!!!!
গৌতম দাস, রাজনৈতিক বিশ্লেষক
goutamdas1958@hotmail.com