বিজ্ঞান বা র‍্যাশনালিটির সীমা কোথায়? (২য় ও শেষ পর্ব)


রেনেসাঁ থেকে এনলাইটেনমেন্টঃ
বিজ্ঞান বা র‍্যাশনালিটির সীমা কোথায়?
(২য় ও শেষ পর্ব)

গৌতম দাস
০৮ জানুয়ারি ২০২৩  ০০ঃ২২ রবিবার

https://wp.me/p1sCvy-4lO

 

প্রথম পর্বের লিঙ্ক এখানে https://wp.me/p1sCvy-4l1
দ্বিতীয় ও শেষ পর্ব এখান থেকে শুরু। continued………

যেমন মানুষের সম্পর্কগুলো কোন ধরণের?
মূলকথায় এটা ‘রিলেশনাল’ (relational) মানুষে মানুষের সম্পর্কিয় দিকটা সে লালন করে থাকে। সে কেবল লজিক্যাল সম্পর্ক করে না।  সেটা কেমন?
দোকানদারের সাথে ক্রেতার সম্পর্ক এটা লজিক্যাল। (যদিও এটা মানুষে মানুষেরই এক সম্পর্ক, তবুও)।  এখানে দোকানদারকে দশ টাকা দিলে দোকানদার ঠিক দশটাকার পণ্যই বিনিময়ে তুলে দেয়।  কিন্তু পিতার সাথে সন্তান বা স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্ক অথবা আমাদের যে কারো পিতামাতার সাথে সম্পর্ক এটা রিলেশনাল, মানুষে মানুষের সাথে সম্পর্কিত বোধ করা এক সম্পর্ক। যদি হয় এমন যে কোন পুত্র বা কন্যা  পিতার রাশনাল আকাঙ্খা মানছে না। পড়ালেখা করছে না, ঠিকমত খাওয়া যা নিজ যত্ন নেয়া করছে না, পারিবারিক বা সামাজিক ডিসিপ্লিন অনুসরণ করছে না। এখন ব্যাপারটা রাশন্যালি দেখলে পুত্র-কন্যার পিতার অনুগত হবার কথা। কিন্তু হচ্ছে না। এজন্য পিতা ক্রমশ চাপসৃষ্টি জন্য শাস্তি দেওয়ার দিকে যেতে পারে। বকাঝকা থেকে খাওয়া পরা বন্ধ চাইকি বাসা থেকে বের করে দেয়া বা খোদ সন্তানই বের হয়ে যাওয়াও ঘটতে পারে। রাশনালি এটাই হবার কথা!
কিন্তু তা ঘটছে না। কারণ, পিতা ব্যাপারটাকে দেখছে রিলেশনাল জায়গায় বসে। পিতা একই সাথে ভাবছে সন্তান তো তার নিজেরই, যাকে সে প্রচন্ড ভালবাসে। তাই এমন পথে সমাধান করতে গেলে পিতার নিজেরই তা আরো কষ্ট পাবার কারণ হবে সেটা। তাই, এটা কোন সমাধান নয়। তাই পিতা হয়ে গেলেন হেদায়েতি লাইনে। বা পারসুয়েশিভ (persuasive) মানে  তিনি কোন ভাল ফল পাক আর নাই পাক পিতা হয়ে গেল নিয়মিত ‘বুঝানোর’ লাইনে। কন্যার হয়ত এক দুর্বল জায়গা হল ওর নানী অথবা বড় ভাই অথবা এক বড় বোন। তাই তাদেরকে দিয়ে পিতা নিয়মিত বুঝানোর লাইনে গেলেন। এটাকে আমরা হেদায়েতি লাইনও বলতে পারি। হয়ত দেখা গেল ২৫-৩০ বছর বয়সের আশেপাশের কালে কন্যার ভিতর হঠাত পরিবর্তন দেখা গেল। নিজে নিজেই তার আচরণে পরিবর্তন লক্ষ্য করা গেল এমন হতে পারে। এমন ক্ষেত্রে এই সম্পর্কটা রিলেশনাল; মানে বিয়ন্ড লজিক্যাল – বা যুক্তিবুদ্ধির সম্পর্ক ছাড়িয়ে চলে যাওয়া এক দশা।

আবার আরেকটা উদাহরণ স্বামী-স্ত্রী নিয়ে। দুজনেই চাকরি করে। কিন্তু স্ত্রী দাবি প্রতিদিন অফিস শেষে বাসায় এসে আমাকেই চা বানাতে হয়। কেন? স্ত্রী বলছে তুমি কিছুই না করে আরামে কেবল আমার দেয়া সেসব সেবা উপভোগ কর! এটা তো সাম্যের সম্পর্ক নয়। তাই তারা সমাধান ঠিক করল যে এরপর গুনে গুনে একেকজন পনেরোদিন করে চা বানাবে। কিন্তু তাতে দেখা গেল স্ত্রীর এক (কনজারভেটিভ বা রক্ষণশীল) বান্ধবী ব্যাপারটা শুনে ব্যাপারটাতে বান্ধবিকে একটা র‍্যাশনাল বোকা বলে সাব্যস্ত করল।  স্ত্রী ব্যাপারটা কীভাবে তা বুঝতে চাইলে তার বান্ধবী বলল স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্কটা শুধুই রাশনাল নয়, এটা র‍্যাশনাল এন্ড বিয়ন্ড। এভাবে দেখতে হয়! কিভাবে সেটা?

বান্ধবি ব্যাপারটা ব্যাখ্যা করে বলল, নিজেদের দম্পতি সম্পর্কের বেলায় সে লক্ষ্য করেছে প্রতিদিনই সে নিজেই চা-নাস্তা সব বানায়। আর সে সময়ে সে যখন উপাচার সাজিয়ে স্বামীর সাথে বসে কথা বলে গল্প করে সেসময়ই তার স্বামী সবচেয়ে উতফুল্ল থাকে, সবচেয়ে কেয়ারিং স্বামী হয়ে উঠে যা স্বামীর প্রতিটা কথায় আচরণে প্রকাশ পেতে থাকে। এটা তাকে ভীষণ সুখ দেয়। এথেকে বিচ্ছিন্ন হওয়ার কথা সে ভাবতেই পারে না! আর এটা তাঁর বেচে থাকার জন্য খুবই প্রশান্তিময় এক উপাদান হয়ে আছে জীবনে।  তাই এই সুখের লোভে কোন বোকা চা-নাস্তা বানানোর কাজ ভাগের কথা তুলবে আর এভাবে ‘সাম্য’ খুজতে যাবে? এখানে সাম্য অবশ্যই রেশনাল কিন্তু তুলনায় অকেজো; কাজেই রিলেশনাল পথ ধরাই উত্তম!! এই হল বান্ধবীর সিদ্ধান্ত!

তাহলে দাড়ালো যা – সব জানা বুঝাবুঝিই কী কেবল  বৈজ্ঞানিক চিন্তা পদ্ধতিতে পাওয়া??? মানুষ কী কেবল লজিক, রিজন বা র‍্যাশনালিটি দিয়েই চিন্তা করে? এর জবাব হবে মানুষ শুধুই কেবল লজিক্যাল বা র‍্যাশন্যাল হয় না। সে একই সাথে রিলেশনাল হয়েও চিন্তা করে থাকে।

আরেকটা কথা বলে এই প্রসঙ্গটা এখানে শেষ করব তবে সেটা আবার আসবে পরে।
১৪৫০-১৫৫০ সাল এসময়টা এজ অব সাইন্স [Age of Science] বা বিজ্ঞানের বিকাশের ক্ষেত্রে এক বিরাট অর্জনের যুগ মনে করা হয়। যেটা পরবর্তিতেো ধারাবাহিকতা বজায় রাখে।
আর ঠিক এরপরেই বা পাশাপাশি যে রেনেসাঁ নামে আরেক আন্দোলনের কথা বলেছি তা ইউরোপীয় ইতিহাসে ছড়িয়ে পড়েছিল, ব্যাপক নাড়া দিয়েছিল। সারকথার দিক থেকে বললে এই রেনেসাঁ  ছিল আসলে পরবর্তিতে যাকে এনলাইনটেনমেন্ট বলে বা র‍্যাশনালিটি আবির্ভাবের যুগ বলে এরই প্রাথমিক দিক বা শুরুর রূপ। রেনেসাঁ থেকে  এনলাইনটেনমেন্ট-এ পৌছাতে মোটাদাগে প্রায় চারশ বছর লেগেছিল। তাই রেনেসাঁ বলে ভাল-মন্দে যা শুরু এরই পরিণত রূপ এনলাইটেনমেন্ট। যেখান থেকে আবার মর্ডানিটির ধারণা; রাজনৈতিকভাবে যেখান থেকে মর্ডান স্টেট (আধুনিক রাষ্ট্র) ও ব্যবস্থার ধারণা। তবে এগুলো র‍্যাশনাল বা বিজ্ঞানের যুগ অবশ্যই তবে অচিরেই যা থেকে নেতি অর্থে অতি-বিজ্ঞান বা বিজ্ঞানবাদিতার তা শুরুও বটে।
তাহলে বিজ্ঞান ও থিওলজির লড়াইটা কী রূপ নিয়েছিল ও কেন?
বিজ্ঞান কেন ঐ সময়ে মানে রেনেসাঁ একটু আগে আগে বিকশিত হয়েছিল? এই প্রশ্নটা গুরুত্বপুর্ণ।

এরিস্টোটলের কথা শুনেছি কমবেশি  আমরা, একটা প্রাথমিক ধারণাও আছে। তাঁর সময়কাল ছিল খ্রিষ্টপূর্ব ৩৮৪ – খ্রিষ্টপূর্ব ৩২২)। মানে পুরাটাই যিশুর জন্মের আগেকার ঘটনা। তিনি দার্শনিক না রাজনীতিবিদ নাকি আবার বিজ্ঞানী বা জোর্তিবিদ এককথায় বলা মুশকিল তাই সেকালে এমন গুণীদের বলা হত বহুবিদ্যাগুণী; (polymath) বলা হত। তবে আমাদের জন্য গুরুত্বপুর্ণ লক্ষ্যনীয় হল, তাহলে তখন বিজ্ঞানী ও দার্শনিক বা থিওলজিস্ট  এভাবে সবকিছু আলাদ আলাদা মানুষের কাজ হয়ে যায় নাই।  একই লোক একই সাথে বিজ্ঞানী ও  থিওলজিস্ট  হতে পারত। আর তা অবলীলায়!
কিন্তু পরবর্তিতে রেনেসাঁ আন্দোলনের একটু আগে বা প্রায় সমসাময়িক ঘটনা হয়েছিল বিজ্ঞান বিকাশের শতবর্ষ। কিন্তু এবার  সেই বিজ্ঞান কিন্তু এরিস্টোটল যুগের বিজ্ঞানের চেয়ে অনেক আলাদা। কারণ সে তখন যে মূলত রাশনালিস্ট, রিজন (reason) তার মন্ত্র বা চিন্তা পদ্ধতি্র।
তাহলে এবার এই বিজ্ঞান আসলে কী, কোথায় সে আগের চেয়ে আলাদা হয়ে গেল? এতা খুবই গুরুত্বপুর্ণ প্রশ্ন!

সেকথাগুলো  বুঝাবার জন্য সহজ করে বললে, আগে জোতির্বিদ, দার্শনিক বা থিওলজিস্ট একই চিন্তা পদ্ধতি অনুসরণ করতে চলত ও পারত। অর্থাৎ দুনিয়াটা ফিজিক্যাল বা বস্তুগত এবং একই সঙ্গে স্পিরিচুয়াল; মানে ফেনোমেনা আকারে বললে এটা ফিজিক্যাল ফেনোমেনা এবং একই সাথে তা স্পিরিচুয়াল ফেনোমেনা হিসাবে দেখা হত।  কিন্তু এখনকার মূল আগাম অনুমান (assumption) হল এই ধরে নিয়ে আগানো যে দুনিয়াটা কেবলই সব ফিজিক্যাল ফেনোমেনা।
অর্থাৎ ইউরোপের রেনেসাঁ বা বিজ্ঞানের যুগের বিজ্ঞানচর্চায় মূল আগাম অনুমান বা সেই ভিত্তি হল সব ফেনোমেনাই কেবল ফিজিক্যাল বা বস্তুগত। কোন স্পিরিচুয়াল দিক নাই। এজন্যই এটা র‍্যাশনাল, রিজন-বেজ বা লজিক্যাল হয়ে উঠেছিল।
একারণের তাদের মহা আবিস্কার হিউম্যানিজম (Humanism) – এই ধারণাটা স্পিরিচুয়াল ধারণার ছিটেফো্টাকেও এড়িয়ে তা কেবল এক “বস্তুগত মানুষের” ধারণা। মানে এর মধ্যে  মানুষের রিলেশনাল দিকের বুঝাবুঝি অনুপস্থিত। যা এখন এক হিউম্যান কোয়ালিটির কথা তুলে ধরা যা স্পিরিচুয়াল দিক নাই, রিলেশনাল দিক নাই। কানেকটেড বোধ নাই।  এই  হিউম্যানিজম (Humanism) কথার সোজা মানে হল, কথিত মানবতাবাদী। মানে যে ব্যক্তি – মানুষের সব হিউম্যান কোয়ালিটির কথা বুঝে ও মানে। কিন্তু তার চোখে এই মানুষের মধ্যে কোন স্পিরিচুয়ালিটির বোধ ধারণার বালাই নাই।
সারকথায় এমন এক বৈষয়িক ভোগী মানুষ যার স্পিরিচুয়াল ক্ষুধা বা আকাঙ্খা নাই। তাই, “রিলেশনাল” নয়, বোধ নাই।  তাই যেমন কেউ যদি বলে, নবী মানবতাবাদী ছিলেন? তাহলে কেমন হবে? এটা কথা হল না, মানে হয় না! কারণ এখানে এমন এক নবীর কথা কল্পনা করা হয়েছে যার মধ্যে স্পিরিচুয়ালিটির ক্ষুধা বা আকাঙ্খা অথবা বোধ ইত্যাদি এসবের কোনটাই নাই। মানে যেটা এক উদ্ভট, এব্সার্ড বা অলীক ধারণা। যার কোন নবী ধারণাই নাই!
দুনিয়ার বস্ত-অবস্তু ও গ্রহ-নক্ষত্র সহ সকল কিছুর সাথে আমরা মানুষ কানেকটেড, যুক্ত বা সম্পর্কিত। আর এই সম্পর্ক তৈরি করেছে এমনভাবে যেখানে প্রতি দুই সত্বার (being) মাঝখানে আছে আল্লাহ, গড বা ঈশ্বর ধরণের কিছু ধারণা যে আমাদের যেকোন দুই সত্বাকে কানেক্ট বা সম্পর্কযুক্ত করে তুলে,  সম্পর্কিত করে এক বন্ধনের মধ্যে রেখেছে।  যেকোন থিওলজির কমন ভিত্তিমূলক ধারণা এটাই। এভাবে আমরা সবাই “আল্লাহ ধরণের ধারণা” যার মধ্যে দিয়ে সবাই সবকিছুর সাথে কানেকটেড – যেকোন থিওলজির মূলকথা এটাই। তবে  হয়ত কোন কোনটা থিওলজিতে ব্যাখ্যা বেশি স্পষ্ট করে সাজানো, এভাবে ব্যাখ্যা তুলে ধরতে পারে।
সরাসরি বললে বিজ্ঞান বা রাশনালিটি এই কানেকটেড দিকটা উপেক্ষা করে চলে, আমল করে না। তবে যেমন নিউটনের গতিসুত্র এটার (ফিজিক্যাল ফেনমেনাকে ব্যাখ্যা করার বিজ্ঞান চিন্তা পদ্ধতি) উপর মানুষের স্পিরিচুয়াল দিকের তেমন প্রভাব নাই। কিন্তু সাবধান। যখনও আমাদের যাকে ব্যাখ্যা করছি তার ভিতর যদি “মানুষ” থাকে তবে  বিজ্ঞান চিন্তা পদ্ধতি সেখানে প্রযোজ্য নয়। কারণ মানুষের উপর প্রয়োগ মানেই ধরে নিতে হত ওখানে স্পিরিচুয়াল দিক আছে,  মানুষ কানেকটেড বা সম্পর্কিত বিষয়াবলী আছে। তাই বিজ্ঞান চিন্তা পদ্ধতি বা লজিক্যাল বা রেশনাল দিক যথেষ্ট নয়। কিন্তু তবু বিজ্ঞানবাদিতা বিশ্বাস করে তারা সর্বগামি তারা হিউম্যান ফেনোমেনা (যা কেবলই ফিজিক্যাল নয়) গুলোকেও ব্যাখ্যা করতে সমর্থ; তাদের চিন্তা পদ্ধতি সমর্থ!! অথচ এই অনুমান ও দাবি অসত্য!!

আবার পুরানা কথায় একটু ফিরে যাই।
কথিত “প্রগতিশীলতার” যে মৌলিক বৈশিষ্ট – ইসলামবিদ্বেষ ও ঘৃণা, এর পক্ষে যে সাফাই বা তাদের মূল আড়াল যার পিছনে দাঁড়ায়ে তারা নিজের ডিফেন্স সাধারণত নিয়ে থাকে বলে বুঝি সেটা হল এই রেনেসাঁ (renaissance) ধারণা; যদিও রেনেসাঁ কী জিনিষ এটা জিজ্ঞাসা করা যায় তবে দেখা যাবে খুবই আবছা কিছু না-বুঝা মুখস্ত কথা তারা বলছে।
তবে তাদের এক সুনির্দিষ্ট বৈশিষ্ট আছে, বিশেষ করে যেটা ‘ধর্ম বনাম বিজ্ঞান’ বলে যে তর্ক তারা তুলে থাকে। ধর্ম বনাম বিজ্ঞান’ নামে প্রগতি-চিন্তায় যে পপুলার ধারণা আছে সেটা হল – বিজ্ঞান ধর্মকে নাকচ করে দিয়েছে। অথচ ব্যাপারটা কী তাই? আর এতই সিম্পল?মোটেই তা নয়। তাহলে কী?
প্রথম কথা হল বিজ্ঞান ও থিওলজি (ধর্মতত্ব) এদুইয়ের সাবজেক্ট ম্যাটার বা কথা বলার প্রসঙ্গই এক নয়। এরা একই বিষয় নিয়ে কাজ করে না।

রেনেসাঁ জিনিসটা কীঃ
রেনেসাঁ শব্দের প্রাথমিক ধারণা করতে, যদি এর আক্ষরিক বাংলা করি তবে এর অর্থ পুনঃজন্ম (re-birth) । তবে এটা যতটা না জন্ম এর চেয়ে বেশি আবার ফিরে পাওয়া (re-found) এমন অর্থ করলে তা এর আসল অর্থের বেশি কাছাকাছি হবে।
এটা মূলত এখনকার ইটালির রাজধানী রোম এবং ফ্লোরেন্স শহরে বিকশিত হওয়া এক প্রগাঢ় আবেগ উচ্ছ্বাসের কাল (১৪ শতক থেকে ১৭ শতক জুড়ে মানে ১৩০০-১৬০০ এই সময়কালের ঘটনাবলী। কী নিয়ে? এটা ছিল ইউরোপীয় সংস্কৃতিতে শিল্পকলার নানা ধরণে এবং রাজনীতি ও অর্থনীতিতে। তবে এই বয়ানের মধ্যে যেটা বাদ পরে গেল তা হল সাইন্স বা বিজ্ঞানের বিস্তারে মানে শতবর্ষ জুড়ে (১৪৫০-১৫৫০) নানা বৈজ্ঞানিক আবিস্কারের যুগ। তবে পরে ১৪৯৯ সাল থেকে এই আন্দোলন এবার আর রোম বা ফ্লোরেন্সে আবদ্ধ থাকে নাই; বরং নর্থ ইউরোপ বা ফ্রান্স দিয়ে ঢুকে সারা ইউরোপকে আন্দোলিত করে ফেলেছিল।

একাদেমিসিয়ানদের মধ্যে বলা হয়ে থাকে, প্রায় চারশ বছরের রেনেসাঁ আন্দোলন ধারাবাহিকতায় বিকশিত হলেও এর বিকাশের তিনটা আলাদা পর্ব বা স্তরে বলে চিহ্নিত করা যায় – শুরুর দিক, চরম বিকাশের দিক আর শেষের দিক এভাবে। বিস্তারে দেখতে দেখুন এখানে। তবে আমরা সেই বিস্তারের দিকে এখান থেকে আর এখন যাব না।

The Renaissance was a fervent period of European cultural, artistic, political and economic “rebirth” following the Middle Ages.
Generally described as taking place from the 14th century to the 17th century, the Renaissance promoted the rediscovery of classical philosophy, literature and art.
Although the evolution of Italian Renaissance art was a continuous process, it is traditionally divided into three major phases: Early, High, and Late Renaissance.

বিশেষ করে যেটা ‘ধর্ম বনাম বিজ্ঞান’ নামে প্রগতি-চিন্তায় যে পপুলার ধারণা আছে যে বিজ্ঞান ধর্মকে নাকচ করে দেয় – আমি এমন ধারণ-অনুমানের সমর্থক-খাদক নই। মূল কারণ এরা মূলত মানুষের চিন্তার ইতিহাস বিশেষ করে ‘চিন্তার পদ্ধতি’ সম্পর্কেই বেখবর। তবু তারা কেবল রেনেসাঁ বলতে বুঝেছে বা আগ্রহী যেন এজন্য যে তারা মনে করে রেনেসাঁ পাওয়া মানে ধর্ম বিশেষ করে ইসলাম কোপানোর একটা অস্ত্র পাওয়া গেছে!

রেনেসাঁ মানে পুনঃজন্ম কিন্তু কার পুনঃজন্ম, সেই রহস্য ভেদঃ
রেনেসাঁ মানে  আগে বলেছি পুনঃজন্ম কিন্তু কার পুনঃজন্ম, সেই রহস্য ভেদ করতে হবে সবার আগে। তবেই প্রগতিবাদীদের ইসলাম কোপানোর আকাঙ্খা ও গোমড় ফাঁক হবে।  তাই সেকাজে সবার আগে ‘মধ্যযুগ’ (middle age) এই ধারণাটা নিয়ে কথা শুরু করা যাক। মধ্যযুগ বলতে মোটাদাগে ৫০০ থেকে ১৫০০ সাল; মাঝের এই হাজার বছরটাকে কী বুঝানো হয়ে থাকে। আরো সুনির্দিষ্ট করে বললে, এটা প্রাচীন রোমের (ancient Rome) সাথে সংযুক্ত ঘটনা। বিভ্রান্ত না হওয়ার জন্য রোম নিয়ে স্বল্পে কিছু কথা এখানেই যোগ করে রাখি। প্রাচীন রোম বলতে একেবারে শুরুতে এক ছোট নগর রাষ্ট্র যা পরে রোমান রাজার রাজ্য (৭৫৩-৫০৯ খ্রীষ্ট্রপুর্ব) হয়ে যায়। আর পরে তা এক রোমান রিপাবলিকে পরিণত হয়েছিল (৫০৯-২৭ খ্রীষ্ট্রপুর্ব)। এভাবে সবশেষে তা পরিণত হয়েছিল এক রোমান সাম্রাজ্যে (২৭ খ্রীষ্ট্রপুর্ব থেকে ৪৭৬ খ্রীষ্ট্রাব্দ বা যিশুর জন্মের পরে)। আর এই ৪৭৬ সালে রোম সাম্রাজ্য ধ্বংস হয়ে যায়। একালের ইউরোপের বড় অংশ জুড়েই তা এই রোম সাম্রাজ্যের অংশ ছিল।

কিন্তু পরে ৮০০ সাল থেকে আরেক রোমান সাম্রাজ্য জন্ম নিয়েছিল। যদিও দুই রোমান সাম্রাজের মধ্যে কোন সম্পর্ক নাই, একই সাম্রাজের পুনঃ-আবির্ভাবও নয়। তাই পরের রোমান সাম্রাজ্যের পুরা নাম ছিল হলি রোমান এম্পায়ার যা বাংলায় বললে ‘পবিত্র রোমান সাম্রাজ্য’ হয়। তাই মধ্যযুগ বলতে আসলে রোমান সাম্রাজ্যের পতন (৪৭৬ সাল) বুঝা বা ধরা হয়। আর ওদিকে ১৫০০ সাল বলতে আসলে চোদ্দ শতকে রেনেসাঁর জন্মকে বুঝানো হয়। মধ্যযুগ মানে দাঁড়ালো প্রাচীন রোম সাম্রাজ্যের পতন আর রেনেসাঁর জন্ম এদুই এর মাঝের সময়কে। কিন্তু কেন?

আসলে ফ্লোরেন্স আর রোম নগরীতে রেনেসাঁ আন্দোলন শুরু হওয়ার পিছনে্র কারণ হিশাবে বলা হয় এ’শহর দুটা শিল্পকলা সংশ্লিষ্ট চিত্রকর, আর্কিটেক্ট, ভাস্কর্য-শিল্পী ইত্যাদিতে ও তাদের কাজে সবচেয়ে সমৃদ্ধ ছিল। তারাই এরা টের পেতে শুরু করেছিল যে তখনও রোমের প্রাচীন যেসব শিল্পকলার নিদর্শন তখনও টিকে ছিল সেগুলো তাদের সমসাময়িক সময়ের চেয়ে অগ্রসর ছিল। অর্থাৎ  সেকালে রেনেসাঁ শুরুর জমানা চোদ্দ শতকের চেয়ে প্রাচীন রোম অনেক অগ্রসর ছিল। তাই তাদের উচিত হবে প্রাচীন রোমের  শিল্পকলার নিদর্শনগুলোকে আবার খুঁজে নিয়ে সেগুলোর অনুসারি হয়ে সেসবের পুনজন্ম ও ব্যবহার ঘটিয়ে নিজের সময়কালকে আপডেট করে নেয়া। ক্রমশ একই জিনিষ দেখা যেতে লাগলে রাজনীতি বা অর্থনীতি বিষয়ক ধারনাগুলোতেও। কিন্তু এমন দেখা যাওয়ার পিছনের কারণ কী???
এর কারণ হিসাবে অনেকে ধারণা করতে থাকে যে খ্রীষ্টধর্মের বন্ধন-ই এমন পিছিয়ে যাবার কারণ। এর মানে কী? আর  কী দেখে তাদের কেন এমন মনে হল?

প্রাচীন রোম কী খ্রীশ্চান ধর্ম অনুসারি ছিলঃ
উত্তর টা হ্যা। কিন্তু সাথে আরেক প্রশ্ন হল, প্রাচীন রোমের মোট সময়কাল মানে এর শুরুটা হল যিশুর জন্মেরও ৭৫৩ বছর আগে বা যেটাকে আমরা  খ্রীষ্টপুর্ব বলি, তখন। সে সময় থেকে শুরু করে এই সাম্রাজ্যের পতন হয়ে যায় যিশুর জন্ম পরবর্তি ৪৭৬ সাল পর্যন্ত। মোট কথা যিশুর জন্মের আগেকার ঘটনা হল রোম সাম্রাজ্যের জন্ম। তাহলে? কবে থেকে সেই রোম ক্যাথোলিক খ্রীশ্চান ধর্মকে গ্রহণ ও অনুসারি হয়েছিল?

আসলে ৩১৩ খৃষ্টাব্দ বা সাল থেকে সম্রাট কনষ্টানটিন (Constantine) এর আমলে রোম সাম্রাজ্যের সম্রাট-সহ প্রজারাও খ্রীশ্চান হয়ে যায়। তাই আরো সুনির্দিষ্ট করে মধ্যযুগ বলতে অনেকে বলে থাকেন আসলে ৪৭৬ সালে রোমের পতন থেকে নয় বরং আরও আগে এই ৩১৩ সালে পুরা সাম্রাজ্যের খ্রীশ্চান হবার পর থেকেই – রোমের শিল্পকলা-সহ  জ্ঞানবুদ্ধির সবকিছুতে তারা আগেকার সময় থেকে পিছিয়ে যাওয়ার শুরু মনে করে থাকে। সরাসরি বললে, খ্রীশ্চান হওয়ার কারণেই তাদের এরপরের জীবনে জ্ঞানবুদ্ধি কমতে শুরু করেছিল।  অর্থাৎ রোমের রেনেসাঁ ধর্মবিরোধী এক ধারণা হয়ে উঠার শুরু এখান থেকেই। কিন্তু আসলেই কী তাই?

কেন এমন প্রশ্ন করছিঃ
কারণ ৩১৩ সালে এসে রোমের সবাই খ্রীশ্চান হয়ে যাবার আগে কী তাহলে রোমের সমাজ ধর্মহীন ছিল??? রোমের বাসিন্দারা অন্যকোন ধর্মের অনুসারী  ছিল না?  এর জবাব হল ৩১৩ সালের আগে তারা অবশ্যই অন্যধর্মের অনুসারী ছিল। কোন ধর্মহীন ছিল না! কারণ এথেন্স বা গ্রীক সভ্যতার দেবতা বা বহুঈশ্বরবাদী ধারণা-বৈশিষ্টের গ্রীক থিওলজি-ই ছিল রোমের পুর্বপুরুষ-সকল। তাই গ্রীক থিওলজি ও গ্রীক দেব-দেবীই ছিল  ও রোমের বাসিন্দাদের উপাস্য ও অনুসৃত ধর্ম। অর্থাৎ রোমের রেনেসাঁ সাধারণভাবে সব ধর্মের বিরোধী এক ধারণা ছিল না। বরং ছিল ৩১৩ সাল থেকে প্রচরণ শুরু হওয়া ক্যাথলিক খ্রীষ্ট্রধর্মের বিরোধী। এবং গ্রীক থিওলজি ও গ্রীক দেব-দেবী কেন্দ্রিক ধর্মচর্চার প্রতি সহানুভুতিশীল! একালের কমিউনিস্টদের আকাঙ্খায় যে নাস্তিকতা বা ধর্মহীনতা – তার সাথে রেনেসাঁ আন্দোলনের  গ্রীক ধর্মের প্রতি যে মনোভাব তা কোনভাবেই এক নয়।  এককথায় বললে, অন্তত শিল্পকলার বিচারে  রোমে গ্রীক থিওলজির প্রভাব ও অবদান ৩১৩ সাল থেকে অনুসৃত ক্যাথলিক খ্রীষ্ট্রধর্মের  প্রভাব ও অবদান নেতিবাচক – তাদের ভাষায় পিছিয়ে থাকা।
তবে আমাদের জন্য যেটা গুরুত্বপুর্ণ তা হল,  ফ্লোরেন্স আর রোম নগরীতে শুরু হওয়া রেনেসাঁ আন্দোলনের রেনেসাঁ-বাদীরা তারা ধর্মবিরোধী নয়। একালের কমিউনিস্ট-প্রগতিবাদীরা আকার-ইঙ্গিতে আমাদের যা বুঝিয়ে থাকে, সেটা একেবারেই মিথ্যা। – “ধর্ম মানেই কালো যুগ, অন্ধকারাচ্ছন্ন যুগ” এসব অনুমান একেবারেই ভিত্তিহীন!!
তবুও যে প্রশ্নটা থেকে যায় যে গ্রীক থিওলজি আর ক্যাথলিক খ্রীষ্ট্রধর্মের তুলনা – যে তুলনাতে ক্যাথলিক খ্রীষ্ট্রধর্মের অবদান “পশ্চাদপদতা” সেই অনুমানও কতটা সঠিক? আর সবচেয়ে বড় কথা কেন এমন অনুমানের জন্ম??

দুনিয়ায় মোটাদাগে দুই বৈশিষ্ঠের থিওলজিঃ 
এসব প্রশ্নের জবাব খুজতে আমাদেরকে প্রসঙ্গের আরেকটু গভীরে যেতে হবে। দুনিয়াতে যত ধরণের ধর্মচর্চা (থিওলজি) আছে সেগুলো মোটা দুভাগে ভাগ করা যায়। যেমন আসমানি কিতাব বা কিতাবি ধর্ম – এর একটা ধরণ। যেখানে নাজেল হওয়া কিতাবি ধর্ম সেটা, বলে মনে করা হয়। আবার নন-কিতাবি ধর্মও আছে। যেমন ভারতের হিন্দু সভ্যতা থেকে বিজেপি-আরএসএস পর্যন্ত এসে তা হিন্দু-ধর্ম হয়ে উঠা। অথবা আরেক উদাহরণ হল, গ্রীক দেবদেবী ভিত্তিক অনুসৃত গ্রীকদের ধর্মচর্চা। ফলে এটাই গ্রীকদের রোমের আসার পরে তখনও তাদের অনুসৃত ধর্ম ছিল যাকে নন-কিতাবি থিওলজি বলা যায়।
মোটা দাগে কিতাবি আর নন-কিতাবি ধর্মের বড় ফারাকটা হল, কিতাবি ধারার মধ্যে, স্ব স্ব মূল কিতাব একবারই আসে বা নাজেল হয় আর তাদের নবী-জন্মের পরে তাতে কিছু কালাম যোগ হয় বড়জোর। তুলনায় নন-কিতাবির বেলায় এখানে এক লম্বা সময় ধরে ইভলভিং (evolving) বা ক্রমশ প্রকাশিত এমন ধারায় উদ্ভব বা বিকশিত এভাবে নয়া দেবতা-সহ নয়া বাণী এখানে এসে থাকে। এখানে একাধিক দেব-দেবির ধারণাও দেখা যায়।  অবশ্যই এখানে এদুইয়ের মধ্যে কোনটা ভাল এজাতীয় কথা বলার মানে হয় না। সেটা অন্তত আমার কাজ না। এলেখার উদ্দেশ্যও না।  বরং যে যেটা অনুসরণ করে তার কাছে সেটাই সবচেয়ে ভাল – এমনটাই দেখতে পাওয়া যায়।  তবে আরেক ফারাক-বৈশিষ্ট হল, কিতাবি ধর্ম কম্প্রিহেন্সিভ (comprehensive) হয়ে থাকে। মানে সর্ব-বিষয়ে ব্যাপকভাবে বক্তব্য এড্রেস করা হয়ে থাকে যেন কোন প্রসঙ্গই স্পর্শ করতে বাদ রাখে নাই সাধারণত এমন হয়ে থাকে। এছাড়া কিতাবি ধর্ম যেটা সবচেয়ে পুরানা পরে নাজেল হওয়া সেটা তত বেশি ডিটেল হয়ে থাকতে দেখা যায়।
এসব বিচারে বলা যায়, প্রাচীন রোম আসলে প্রায় হাজার বছর ধরে নন-কিতাবি গ্রীক দেবতাভিত্তিক ধর্ম অনুসরণ করে চলার পরে, ৩১৩ সাল থেকে কিতাবি খ্রীশ্চান ধর্মের অনুসারি হয়ে উঠেছিল। আর কিতাবি খ্রীশ্চান ধর্ম ইনক্লুসিভ ও কম্প্রিহেনসিভ হওয়াতে জ্ঞান-বিজ্ঞানের (মানে ফিজিক্যাল ফেনোমেনা গুলা ব্যাখ্যা করার ক্ষেত্রে) চর্চায় অনেক বেশি নয়া বিধিনিষেধ তখন থেকে তাদের মেনে চলতে হয়েছিল।
এতদুর বলার পরও মৌলিক কথার আরো কিছু অংশ বাকি থেকে গেছে। এখন সেদিকে যাব।

রেনেসাঁ প্রসঙ্গে বলতে গিয়ে এর বিকাশের তিন পর্ব বা স্তরের দিক আছে তা বলেছি। কিন্তু এভাবে সতেরো শতকে (১৬০১-১৭০০) এসে রেনেসাঁ স্তব্দ হয়ে যায় বা থেকে যায়। একাদেমিকভাবে এর সাতটা কারণ বা সাতটা উপাদানের সম্মীলিত প্রভাবের কথা জানা যায়। যেমন পনেরো শতকের দিকে রোমের ভুমি দখলে মেতে উঠেছিল  স্পেন, ফ্রান্স ও জর্মানী। ফলে রোম বা ফ্লোরেন্স অস্থিতিশীল উঠতে শুরু করেছিল। আবার প্রতিযোগিতায় পড়ে যাবার কারণে ফ্লোরেন্স ও রোমে আসা-যাওয়ার নৌবাণিজ্যের রুট বদলে গিয়েছিল । ফলে আয় বিশেষত সমৃদ্ধ ফ্লোরেন্সের সম্পদ-ধারীরা আর আগের মত রেনেসাঁ আন্দোলনের পৃষ্ঠপোষকতা চালিয়ে যেতে পেরে উঠছিল না। ইত্যাদি কারণগুলো ছাড়াও আরেক নির্ধারক কারণও উঠে এসেছিল। এতদিন রেনেসাঁ আন্দোলন ক্রীশ্চানিটিকে কোনঠাসা করে চলে আসছিল। কিন্তু এই রেনেসাঁই এবার পালটা আক্রমণ ও চাপের মুখে পড়ে যায়। কারণ ততদিনে ততকালীন প্রশাসন নয়া আইনি বাধা তৈরি করতে সমর্থ হয়ে যায়। তাই সেকাজে নয়া আইনের নাম রোমান ইনকুইজেশন (Roman Inquisition) বলে  আইন চালু করেছিল তাদের কাউন্সিল অব ট্রেন্ট (Council of Trent) । সহজ ভাষায়, এই ট্রেন্ট মানে হল রোমান ক্যাথলিক অথরিটি যারা “ধর্ম-অবমাননার” শাস্তি আরোপ করার ক্ষমতাধারী কর্তাগোষ্ঠি। আসলে মূলকথাটা হল, রোমের ক্যাথলিক ক্রিশ্চান চার্চ মূলত প্রটেষ্টেন্ট (Protestent) খ্রীশ্চানিটি ধারার হাতে ক্রমান্বয়ে আগে থেকেই  চ্যালেঞ্জ হয়ে আসছিল। যার সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ-কারী হয়ে উঠেছিল প্রটেস্ট্যান্টেরা।  হওয়াতে আর সাথে প্রকারন্তরে রেনেসাঁর অবস্থান প্রটেসটেন্ট দের পক্ষে যাওয়াতে সবমিলিয়ে ক্ষমতাসীন ক্যথলিকেরা “নিজ ধর্মীয় আইন লঙ্ঘন ও নিষিদ্ধ পুস্তক চর্চার বিরুদ্ধে  ও এই অজুহাতে  মৃত্যুদন্ডের শাস্তি চালু করেছিল।

মিলিত ফলাফলে রেনেসাঁ আন্দোলনের পরিসমাপ্তি ঘটে যায় সতেরো শতকেই। আর এখান থেকেই পরের মানে আঠারো শতকে এরই পরিপূরক আরেক আন্দোলন এনলাইটেনমেন্ট (enlightenment) আন্দোলন বিকশিত হয়ে উঠেছিল।  তবে এখানে প্রটেস্টান্ট খ্রীশ্চানিটির ধারা সম্পর্কে কিছু কথা বলে নেয়া যাক।
এনলাইটেনমেন্ট  নিয়ে কথা  কথা আগানোর আগে রেনেসাঁ নিয়ে গুরুত্বপুর্ণ আরো কিছু কথা আগে শেষ করে নেয়া যাক।
তবে বিদ্রোহি প্রটেস্টেন্ট খ্রীশ্চান ধারার সাথে রেনেসাঁবাদীদের সখ্যতা খুবই গুরুত্বপুর্ণ। খুবই সংক্ষেপে বললে,  প্রটেস্টেন্ট ধারার উত্থান তাদের মূল নেতা মার্টিন লুথারের হাতে। জর্মানিতে জন্ম লুথারের জীবনকাল (১৪৮৩-১৫৪৬); যার পরিচয় সম্পর্কে বলা হয় তিনি এক জর্মান থিওলজিষ্ট, প্রফেসর, যাজক ও চার্চ সংস্কারক ইত্যাদি।  আসলে তিনি ছিলেন ধর্মতত্বে একাদেমিক গ্রাজুয়েট। গত ১৫০০ সালের পরে রেনেসাঁ যখন নর্থ ইউরোপে হানা দিয়েছে ঘটনাচক্রে শহরের সিনিয়র পাদ্রীদের সাথে বাইবেলের ব্যাখ্যা নিয়ে গভীর ঝগড়ায় লিপ্ত। রেনেসাঁ আন্দোলনের অন্যতম এক ইতিবাচক অবদান হচ্ছে মানুষকে সবকিছু নিজে দেখেশুনে পড়ে বুঝাবুঝি করে নিতে আগ্রহী করে তোলার যুগের সুচনা করেছিল। যেমন এর আগে বাইবেলে কী আছে তা পাদ্রীরাই ব্যাখ্যা করার এক্তিয়ারধারী। এমন হবার পিছনের টেকনিক্যাল কারণ হল শুকানো চামড়ার উপর বাইবেল হাতে লেখা। ফলে তা জনে জনে বিতরণ বা সহজেই পাওয়া যায় এমন বস্তু ছিল না। বলা হয়ে থাকে রেনেসাঁ উদয় পিছনে তিনটা জিনিষ আর আগে আবিস্কৃত হতে হয়েছিল। তাহল গোলাবারুদ, কম্পাস আর প্রিন্টিং প্রেস বা ছাপাখানা। এর প্রথম দুটা হল বাকি ইউরোপ থেকে নৌপথে ফ্লোরেন্স বা রোম পৌছানো বাস্তব ও সহজেই সম্ভব করে তুলতে ভুমিকা রেখেছিল। এমনিতেই  ফ্লোরেন্স বা রোম থেকে রেনেসাঁ নর্থ ইউরোপ পৌছাতে লেগেছিল প্রায় একশ বছর।  কেবল ছাপাখানা আবিস্কৃত হয়েছিল বলেই এরপরে তা অসংখ্য কপি ছাপা হয়ে  ইউরোপে রেনেসাঁ ছড়িয়ে পড়তে তা সাহায্য করেছিল। বাইবেলও এরপরে জন-নজরে উন্মোচিত হতে সাহায্য করেছিল। যারা বাইবেলের ব্যাখ্যা নিজে কুক্ষিগত করে এতদিন রাখতে পেরেছিল  সেই পাদ্রিগোষ্ঠি  এরাই সেকালের ক্ষমতাসীন এলিট ক্লাসের সহযোগী ছিল। ঝগড়া শুরু হয়েছিল এক আন্ডার কনষ্ট্রাকশনে থাকা চার্চে নোটিশ টাঙানো ছিল যে এই দানবাক্সে অর্থে দিলে সহজেই বেহস্ত মিলব – ধরনের গ্যারান্টি।  লুথার এই বক্তব্য বাইবেল সমর্থিত নয় বলে চ্যালেঞ্জ করেছিলেন। আর তা থেকে বড় রাজ-পাদ্রি পর্যন্ত সকলের সালে তার বিতর্ক – শেষে পালিয়ে থাকা, রাজ নীটিশ ইত্যাদি। আর ততই তিনি লুথার প্রতিদিন এসব সরকারি পাদ্রিদের বিরুদ্ধে তাঁর গরীব মানুষের স্বার্থের পক্ষে বাইবেলের ব্যাখ্যা দান। শেষে রাজ-পাদ্রিদের পশ্চাদ-অপসারণ। আর তা থেকেই প্রটেস্টটানিজম (Protestant Reformation) হাজির হয়েছিল। যেখান থেকে প্রটেস্টটানিজম (Protestantism, Reformation of Catholic) বা বলা যায় প্রটেস্টেন্ট নামে নয়া ফ্যাকড়ার খ্রীশ্চানিটির জন্ম। তবে আমাদের জন্য গুরুত্বপুর্ণ তথ্য হল, রেনেসাঁর আগমন প্রটেস্টান্ট খ্রীশ্চানিটির আগমন ও উদ্ভবকে সাহায্য করেছিল। ফলে আমাদের এদিকের ইসলাম কোপানি খায়েসের কথিত সেকুলার যারা নাকি  রেনেসাঁ পাঠ করে রায় দিয়ে থাকেন যে রেনেসাঁ ধর্মের প্রয়োজনীয়তা শে করেছে তারা আদৌ কোন রেনেসাঁ পাঠ করেছে কিনা তা সন্দেহজনক!

কথা শুরু করেছিলাম মধ্যযুগ (medieval period) নিয়ে। এই শব্দটা উচ্চারণ করাই হয় একটা তুচ্ছতাতুচ্ছ অনুমানের উপর দাঁড়িয়ে যে এটা নাকি ধর্মের যুগ তাই এটা পশ্চাদপদ। যদিও রেনেসাঁর উদ্গাতা প্রভাবশালী সামনের সারির দশজন কর্তার নাম নিলে দেখা যাবে ওর মধ্যে মাত্র একজন মধ্যযুগ-কে অন্ধকার যুগ (Dark Ages) বলে চিহ্নিত করেছেন [Francesco Petrarca (known as Petrarch) was the first person to coin the term ‘Dark Ages’. He was an Italian scholar of the 14th century.] ।

তা ভাল! কিন্তু বিপরীতে তারা কী কামনা করতেন? সেটা এখন আমরা বিচার করে দেখব আর এভাবেই তাদের ‘অন্ধকারের ধারণা’ বুঝব।

হিউম্যানিজম (Humanism) এই শব্দটার বাংলা অনেকে করেন। মানবতাবাদ। ইন্টারেস্টিং ঘটনা হল শব্দটাকে খুবই ইতিবাচক শব্দ বলে আমরা মনে করি। এমনকি কেউ কেউ বলে বসেন যে নবীও খুবই মানবতাবাদী ছিলেন।  কিন্তু দুঃখের কথা হল এই “মানবতাবাদ” হল রেনেসাঁর প্রধান বৈশিষ্ট। আর এটা একটা এন্টি-রিলিজিয়াস শব্দ।   দুনিয়াতে যারা হিউম্যানিস্ট গ্রুপ আছে তারা নিজের সম্পর্ক মনে করে তাদের জীবনের প্রতি দৃষ্টিভঙ্গি হল, তারা হলেন রিজন (reason) যুক্তিবুদ্ধিতে চলা উচ্চমানের ব্যক্তিবর্গ। এছাড়া তারা যেসব মুল্যবোধের উপর দাঁড়িয়ে কথা বলেন যা আল্লাহ-ভগমানের মত কোন অতিপ্রাকৃত (super-natural) ধারণায় আস্থাবিশ্বাস রাখেন না। বরং যা মানুষের প্রকৃতি ও অভিজ্ঞতালব্ধ ধারনায় কেবল এর উপর দাঁড়িয়ে কথা বলেন। [Humanism is an approach to life based on reason and our common humanity, recognizing that moral values are properly founded on human nature and experience alone.]।
কথাগুলোকে আরো সরাসরি বললে তাদের ধারণা হল, আল্লাহ-খোদা বলে কিছু নাই। মানুষই সব। এভাবে বলাতে অনেকের মনে হতে পারে এটা আর এমন কি? এটা তো আল্লাহ বিশ্বাসী আর অবিশ্বাসীর মধ্যকার পুরানা বিবাদ বৈ আর কিছু না!  হা আপাত চোখে তা মনে হতে পারে কিন্তু তা নয়।  কেন?

মানুষ কী কেবল কোন বস্তুগত সত্বা (physical being) মানে ফিজিক্যাল বিয়িং। নাকি এটা একই সাথে এক স্পিরিচুয়াল বিয়িং (spiritual being) -ও; এটাও বটে!  রক্ত-মাংসের মানুষের অসংখ্য বস্তুগত চাহিদা আছে; তাই মানুষ কেবলই এক বস্তুগত সত্বা বা ফিজিক্যাল বিয়িং নয়। তাই এতেই সে শেষ না, মানুষের স্পিরিচুয়াল চাহিদাও সাথে আছে।
হিউম্যানিজম  স্পিরিচুয়াল চাহিদাকে অস্বীকার করে বেড়ে উঠেছে। কিন্তু এই স্পিরিচুয়াল জিনিষটা কী?
সারকথায় মূল প্রশ্ন হল আমরা মানুষ কিভাবে দুনিয়াতে অন্যান্য বস্তু, অবস্তু, অন্যান্য প্রাণী- অপ্রাণী বা উদ্ভিদ এমনকি গ্রহ-নক্ষত্র ইত্যাদি অথবা আরেকটা মানুষ ও অন্যান্য অস্তিত্ব ইত্যাদি সবকিছুর সাথে কানেকটেড বা সংযুক্ত – এই বিষয় নিয়ে যে কথা বলে বা যার সাবজেক্ট ম্যাটার এটাই থিওলজি। কি করে মানুষ বাকি সবকিছু অন্যান্যের সাথে কানেকটেড এটাই  থিওলজি ব্যাখ্যা করে থাকে।  মানুষের কোন বিষয়ে একটা ধারণা যেমন যুগে যুগে বিকশিত হয়ে পরে পোক্ত হয় তেমনই এটাও। যত পরবর্তিকালের থিওলজি ততই আরেকটু স্পষ্ট তার ব্যাখ্যা। তবে ব্যাখ্যা সঠিক কিনা অথবা কোন থিওলজিক্যাল ব্যাখ্যাটা ভাল এটা এখানকার আলোচনার বিষয় না। বরং বুঝাতে চেয়েছি কানেকশন, কি করে আমরা সম্পর্কিত সেদিকটা বুঝাবার চেষ্টা করছি। আর আমরা কী করে সকলে কানেকটেড এটা জানা-বুঝার যে আকুতি – সম্পর্কিত বোধ করার আকুতি এটাই স্পিরিচুয়াল চাহিদা। আমি দুনিয়াতে কেন, এর দরকার কী অথবা এর অর্থ তাতপর্য কী এগুলোকে জানা এটাই মানুষকে তাড়া করে। এছাড়া মানুষ তার পরিবারের সদস্য অথবা কোন কোন ঘনিষ্ঠজন এদের প্রতি একটা “টান” অনুভব করে কেন?
মূল কথাটা হল, এই অনুভবগুলো আর মানুষের কেবল ‘ফিজিক্যাল বিয়িং’ ধারণার মধ্যে আটকে থাকতে দেয় না। মানে হল মানুষ কেবল অন্ন বস্ত্র শিক্ষা চিকিতসা ও বাসস্তানের চাহিদা-ধারী নয়, তার স্পিরিচুয়াল চাহিদা আছে।

এজন্যই আমরা লক্ষ্য করলে দেখল ১৪শতকের রেনেসাঁ থেকে শুরু করে ১৮ শতকের এনলাইটেনমেন্ট এই পুরা সময়কাল জুড়েই কেবল বিজ্ঞানবাদিতা আর সাথে রিজন, লজিক্যাল বা রেশনালিটি ধারণার মধ্যে বুঁদ হয়ে থাকা।

কাজেই রেনেসাঁ অথবা ওর চারশবছরের সফর শেষে এনলাইটমেন্ট পর্যায়ে আসা, এক পড়তে হবে ক্রিটিক্যালি। শুধু সবই ভাল বা সবই খারাপ এমন কোনটার করেও নয়। বিশেষ করে আমাদের এদিকের প্রপাগান্ডা ধারণা –  রেনেসাঁ নাকি এসেছে ধর্মের ইতি টানতে,  এমন ভিত্তিহীন অনুমানও এড়িয়ে চলতে হবে। আসলে মূলত বিজ্ঞান ও রেশনালিটি ধারণাকে এর প্রয়োগ সীমাবদ্ধতা এর নো গো [No Go] এরিয়া সম্পর্কে জেনে তবেই এটা আমল করতে হবে।

সমাপ্ত

 

গৌতম দাস, রাজনৈতিক বিশ্লেষক
goutamdas1958@hotmail.com

 

Leave a Reply

Fill in your details below or click an icon to log in:

WordPress.com Logo

You are commenting using your WordPress.com account. Log Out /  Change )

Facebook photo

You are commenting using your Facebook account. Log Out /  Change )

Connecting to %s