ভারতের হিন্দুত্ববাদ উপড়ে ফেলার নায়ক, আমেরিকা!


ভারতের হিন্দুত্ববাদ উপড়ে ফেলার নায়ক, আমেরিকা!
গৌতম দাস
২০ এপ্রিল ২০২৩
https://wp.me/p1sCvy-4mT

‘The next few months are a crucial test of our democracy’   ‘The next few months are a crucial test of our democracy’ | Photo Credit: AP

রাজনৈতিকভাবে গ্লোবাল ইস্যুতে  এশিয়া উত্তাল হয়ে উঠছে।  বিশেষ করে সাউথ-ইস্ট এশিয়া সামনের দুবছরে আরও বড় করে উত্তাল হবে। লঙ্খণগুলো ফুটে উঠতে শুরু করেছে।   ঘটনার মূল ফেনোমেনাটা হল অর্থনৈতিকভাবে  রাইজিং চীনের দুনিয়া জুড়ে প্রবল  গ্লোবাল প্রভাবের প্ক্ষেটভুমিতে  ব্যাপারটা উঠতি চীন আর নামতি আমেরিকা এরই উত্থান-পতনের ঘটনাবলী ও প্রতিক্রিয়া হয়ে দাঁড়িয়েছে । যেটাকে অনেক সময় আমি “গ্লোবাল নেতৃত্বে পালাবদল” বলে ব্যাখ্যা করেছি। চীন-আমেরিকার প্রতিদ্বন্দ্বিতা, প্রতিযোগিতা আর তা থেকে জেগে উঠা কোন হবু সংঘাত – এই ঘটল বলে, লাগল বলে ধরণের পরিস্থিতিতে যা গত অন্তত দশবছর ধরে ক্রমশ বাড়ছে বা অস্থির হয়ে উঠছে – এটা হল সেই দৃশ্যপট।

এর আগে আমরা দেখেছি ওবামা আমলের সেকেন্ড টার্ম (২০১৩-১৬) থেকে এই পালাবদলের ফেনোমেনা সাধারণ চোখে মোটামুটি  দৃশ্যমান হতে শুরু করেছিল। তাতে তা বড়জোড় শ্রীলঙ্কা, বা মালদ্বীপ বা নেপালের নির্বাচনে ওসব দেশের দলগুলো একেকটা হয় ভারত বা চীনের সমর্থক হয়ে এমন ‘পালাপদলের’ প্রক্সি খেলে  চলছিল – এতটুকুই দেখা যেত। এতটুকুর মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল। যদিও  তখনকার ভারত মানে? সেকালের ভারত ছিল মূলত এশিয়ায় – এঅঞ্চলে আমেরিকান স্বার্থের প্রতিনিধি ফলে ভারতের উপস্থিতি যেন এক বরকন্দাজি “যৌথ” উপস্থিতি। আমেরিকা তখন ব্যাপারটাকে আমাদের বুঝাতে এক বয়ান ভাষ্যে বলত – ভারত হল “এশিয়ায় আমেরিকার চীন ঠেকানো এর দায়িত্বপ্রাপ্ত এজেন্ট”। তাই এশিয়ায় ভারতকে আমেরিকার এই চাঙ্গে তোলা!

কিন্তু এখন এশিয়া উত্তাল হবার কথা যেটা বলছি, তাতে কথিত সেই যৌথ উপস্থিতি জিনিষটাই নাই, উধাও! তা একেবারে বদলে গিয়েছে। এককথায় বললে – যৌথ উপস্থিতি দূরে থাক বরং এশিয়ার ভারত-আমেরিকার অবস্থান এখন যেকোন স্ট্রেটেজিক ইস্যুতে আলাদা; যার যার তার তার। তবে এমন আলাদা অবস্থান যত গভীরে ততই আরো বেশি করে একেবারেই আলাদা হয়ে গেছে; তবে ততদুর তা প্রকাশিত করা হয় না; তবে সেটা দুপক্ষেরই নিজ নিজ স্বার্থের আলাদা কারণে।

যেমন ইউক্রেন ইস্যুতে ভারতের অবস্থান একবারেই আমেরিকার চেয়ে আলাদা। ভারত এখন রাশিয়ান তেল রপ্তানির  প্রধান পার্টনার। কিভাবে  নিষেধাজ্ঞার কারণে রাশিয়া সরাসরি তেল রপ্তানি করতে পারে না। তাই ভারত রাশিয়ান তেল আমদানি করে এরপর, রিফাইন করে পরে আবার বিদেশে বিক্রির সবচেয়ে বড় দেশ। ভারত তার আট-নয়টা রিফাইনারির সবগুলাই এখন কেবল একাজেই ব্যস্ত। আর তাতে রাশিয়ান তেলের সেকেন্ডারি উতস হিশাবে ভারত ঐ তেল আবার বিভিন্ন পশ্চিমা দেশেই  রপ্তানি করছে।
কাজেই সরকথাটা হল ইউক্রেন যুদ্ধে ভারত রাশিয়ার পক্ষে আর বিপরীতে আমেরিকা রাশিয়ার বিপক্ষে তা সবাই জানেন।

আমেরিকার বার্মায় রেজিম চেঞ্জে আগ্রহঃ
তবে ভারত আর আমেরিকা  স্ব স্ব স্ট্রাটেজিক স্বার্থে কত দূরদুরান্তে আলাদা এর মোক্ষম উদাহরণ হল আমেরিকার “বার্মায় রেজিম চেঞ্জ” [Regime Change] বা সরকার বদলের আগ্রহ – এই ইস্যু। এই ইস্যুতে বরং ভারত-চীন-রাশিয়া এই তিন দেশ যৌথভাবে আমেরিকার বিরোধী অবস্থানে।  ভারতে আভ্যন্তরীণ বিভিন্ন মিডিয়া এনালাইসিসে রিক [RIC] বলে একটা শব্দ ব্যবহার শুরু হয়েছে দেখতে পাওয়া যায়। [আগ্রহীরা এই আর্টিকেলটা পড়তে পারেন] যেটা আসলে যথাক্রমে রাশিয়া, ভারত ও চীন এই তিনদেশের ইংরাজি নামে  প্রথম অক্ষর  নিয়ে তৈরি।  তবে আবার সাবধান এজন্য যে  এটা আর ‘কোল্ড ওয়ারের’ যুগ (১৯৫৩-৯২) নয়। দুনিয়াতে কোথাও আর কোল্ড-ওয়ার এর নীতি ও অভ্যাস নাই। মানে হল, কোল্ড-ওয়ারের কালে কোন দুই দেশ স্ট্রাটেজিক বন্ধু হলে তারা এতে বাকি অন্য সব ইস্যুতে আপনাতেই ‘বন্ধু’ হয়ে যেতই। কিন্তু একালে সব উলটা। একালে দুই রাষ্ট্রের যেকোন শত্রুতা বা বন্ধুত্ব হল মূলত ইস্যু ভিত্তিক। তাই একালে দুইটা রাষ্ট্র এক ইস্যুতে চরম শত্রু হলেও অন্য ইস্যুতে কিছুটা ‘বন্ধু’ থাকতে দেখতে পাওয়া সম্ভব। চীন-ভারত এখনও বিভিন্ন স্ট্রাটেজিক স্বার্থের ইস্যুতে যথেষ্ট শত্রুতা বজায় রাখে, আর ভারতের মিডিয়া এখনও এন্টি-চায়না টোনে যেকোন কিছু বয়ান করে থাকে। কিন্তু  আমেরিকার “বার্মায় রেজিম চেঞ্জ” ইস্যুতে  ভারত-চীন একসাথে আমেরিকা বিরোধিতায় ও অবস্থানে;  আর তা রাশিয়াকে সাথে নিয়ে। আর একথাও সত্য যে এই ইস্যু খুবই প্রভাবশালী ইস্যু। আর প্রভাবশাল বলেই অন্য অনেক ইস্যুর উপরে  – তা খুবই নির্ধারক। যেমন “বার্মাতে রেজিম চেঞ্জ” ইস্যু ভারতের কাছে খুবই প্রভাবশালী ইস্যু। আর প্রভাবশালী ইস্যু বলতে বুঝতে হবে এই ইস্যু ভারতের অন্যান্য ইস্যুতেও যা প্রভাব রাখবেই। যেমন, বঙ্গোপসাগরে আমেরিকান সপ্তম নৌবহর স্থায়ী ঘাঁটি গেড়ে নোঙর করে উপস্থিত থাকুক এটা আমেরিকার বহুদিনের খায়েস। আর ঠিক এর উলটা অবস্থানটাই ভারতের। মরে গেলেও আমেরিকান এই খায়েসে একমত হবে না ভারত।
‘বার্মাতে রেজিম চেঞ্জ’ ইস্যু বঙ্গোপসাগরে আমেরিকান নৌ-উপস্থিতির সাথে সম্পর্কিত। যদিও এর চেয়েও বড় কথা বার্মা আর ভারতের বিস্তির্ণ সীমান্ত আছে যা বার্মাতে রেজিম চেঞ্জ ঘটে গেলে এর ব্যাপক প্রভাব ভারতের উপর পড়তে বাধ্য। শুধু তাই নয়, এঘটনা ভারতের আসামসহ পুরা নর্থ-ইস্ট অঞ্চল এর উপরেও প্রভাব ফেলতে বাধ্য। যদিও  এতদিন ভারত ভেবে এসেছে তার আসামসহ নর্থ-ইস্ট অঞ্চল রক্ষার স্বার্থ  এর প্রধান বাধা ও বিরোধি হল নর্থ-ইস্ট সীমান্তেরওপারে চীনের উপস্থিতি বা চীনের তিব্বত সীমান্ত। আর এটাকে বিক্রি করেই ভারত এতদিন বাংলাদেশের উপর দিয়ে করিডোর আদায়, বাংলাদেশে অবাধে প্রবেশ আর ফেনী-অঞ্চলকে যত রকমভাবে সম্ভব কব্জা করে নেয়া ও রাখা তা করে গিয়েছে। কিন্তু এখন টের পাচ্ছে আমেরিকা ভারতের জন্য প্রকৃতপক্ষে কে ও কী???

কিন্তু কাকে ঘিরে এশিয়া উত্তাল হচ্ছেঃ
এলেখায় কথা শুরু করেছিলাম ‘এশিয়া উত্তাল হচ্ছে’ বলে। কিন্তু কাকে ঘিরে তা হবে? মানে এর কেন্দ্র বা ফোকাস হতে যাচ্ছে কোন ভুগোল? সোজা জবাব হল,  সেই মূল ফোকাস হতে যাচ্ছে সম্ভবত বার্মা। তবে এটা সেখানেই একমাত্র বা ঘনীভুত থাকবে তা না। এর সরাসরি ভৌগলিক কেন্দ্র হবে চীনের তিব্বত-কুনমিং সীমান্তের নীচের অংশ থেকে ভারতের নর্থ-ইস্ট ও সংলগ্ন সব অংশ আর বলাই বাহুল্য বাংলাদেশও; ইত্যাদি সব ভূখন্ডই। তবে এসব কথা ভুগোল হিশাবে বলা, রাজনৈতিক প্রভাব বা বলয়ের দিক থেকে নয়, সেটা আরও বড় ও ব্যাপক।

তাই  ‘এশিয়া উত্তাল হচ্ছে’ বলতে এসবের বাইরেও নানান জায়গায় ব্যাপক রাজনৈতিক অর্থে পরিবর্তন আসন্ন হয়ে উঠছে ও উঠবে। যেমন উপরে ভারতের কিছু ভৌগলিক অঞ্চলের কথা বললেও রাজনৈতিক দিক থেকে সারা ভারতের উপরেই ব্যাপক রাজনৈতিক প্রভাব ও পরিবর্তন আসন্ন হয়ে উঠতে পারে। আর ভারতে এসব কিছুই ইতোমধ্যে নড়াচড়া করা শুরু করে দিয়েছে ব্যাপকভাবে। যদিও তা বাইরে থেকে দেখে মনে হচ্ছে তা বোধহয় আগামি “২০২৪ সালের আসন্ন কেন্দ্রিয় নির্বাচনকে” কেন্দ্র করেই।  আসলে, কংগ্রেসের রাহুলের নেতৃত্বে বিরোধী জোট এর কাছে  ২০২৪ সালের নির্বাচনে   মোদি ও বিজেপির ভরাডুবি ঘটানোর লক্ষ্য নিয়ে এই আমেরিকান পরিকল্পনা আগাচ্ছে।
যেমন একটা ঘটনার কথা বলি।
রাহুলের কংগ্রেসের সাথে মমতার তৃণমূলের সম্পর্ক খুবই খারাপ, বিশেষেত মোদিবিরোধি জোটের নেতা হিশাবে কংগ্রেস অথবা রাহুল গান্ধী কোনটাকে মানতে তৃণমূল রাজী নয় বলে। আবার, কলকাতার রাজ্য নির্বাচনে কংগ্রেস  বিজেপিকে শত্রু মনে করে না বরং গোপনে বা প্রকাশ্যে বিজেপির সাথে মমতাবিরোধী এলায়েন্স করে।  একারণে গত ২ মার্চ ২০২৩ মমতা জানিয়ে দেন যে আগামি  “২০২৪ সালের লোকসভা ভোটে বিরোধী জোটে যাচ্ছে না তৃণমূল, লড়বে একলাই, জানিয়ে দিলেন মমতা“। কোন জোটে যাবেন না।  কিনতু বেশি না ঐ মাসের তিন সপ্তাহের মাথায় একেবারে বিরোধি জোটের নেতা হিশাবে রাহুলের পক্ষে নিজে টুইট করলেন খোদ মমতাই। তিনি সব “তিক্ততা ভুলে কার্যত রাহুলের পাশে দাঁড়িয়ে … রাহুলের পক্ষে মমতার টুইট: আমাদের গণতন্ত্র আজ নতুন নীচতায় পৌঁছাল। কেন?
কারণ, ততদিনে মমতা জেনে গেছেন এই বিরোধি জোট নেতা রাহুল আগের জন নন। এটা সর্বাত্মক! তার মানে আমেরিকা ভারতে মোদির বিরোধিদের একাত্ম করতে পেরেছে এই মাঝের সময়ের মধ্যে।

এখন এতে কী হতে পারে? সারা ভারতরাষ্ট্র মূলত এতে শেষে এমন এক যুগে প্রবেশ করতে পারে তাতে তা এই প্রথম হিন্দুত্ববাদ-সহ  মোদির বিজেপি-আরএসএস সমূলে উপড়ে পড়তে পারে। পুরানা গান্ধী-নেহরুর সফট বা লুকানো হিন্দুত্ববাদ ( মানে উগ্র হিন্দু জাতিবাদ) যা একালে (২০১৪) মোদির প্রধানমন্ত্রী হবার আগে ঢলে পড়ে বিলীন হবার যুগে হাজির হবার পরে ২০১৪ সালের নির্বাচনি বিজয় থেকে মোদির বিজেপি-আরএসএস একে আরো উগ্রভাবে  আর নরমের বদলে উগ্র-হিন্দুত্ব হয়ে হাজির হয়েছিল। তাতে ভারত চরম মুসলমানবিদ্বেষ ও  চরম মুসলমান নিপীড়নমূলক এক চরম বৈষম্যমূলক  রাষ্ট্র হয়ে উঠেছিল, এবার এই পর্যায়ের একটা অবসান ঘটতে পারে।

 

ভারতের নির্বাচনের সাথে এশিয়া উত্তাল হবার সম্পর্কঃ
কিন্তু ভারতের নির্বাচনের সাথে এশিয়া উত্তাল হবার কী সম্পর্ক? বিশেষ করে যেখানে গতবার মানে ভারতের ২০১৯ সালের নির্বাচনে তো আমরা তেমন কিছু দেখি নাই!
হা সেকথা সত্যি; তবে সেবার আর এবার এক নয়; আর তেমন থাকছে না। মানে কী?
আমাদের দেশেও আজকাল রাজনীতিক দল ক্ষমতায় বা বাইরে যেখানেই থাকুক এরা বলা শুরু করেছে “আমেরিকা রেজিম চেঞ্জ করতে পারে, করার ক্ষমতা রাখে ইত্যাদি. যেমন এখানে দেখেন,  ….. যুক্তরাষ্ট্র চাইলে যেকোনও দেশের ক্ষমতা উল্টাতে-পাল্টাতে পারে

তবে এটা বলতে তামাসার মত শোনাচ্ছে যদিও তবু কথাটা হল – আমেরিকা রেজিম চেঞ্জ করতে পারে বলতে মনে করা হয় এটা কেবল বাংলাদেশের মত তৃতীয় বিশ্বের দেশের বেলায় সত্যি। তবে, যেখানে ভারত অবশ্যই একালে আর যেন তৃতীয় বিশ্বের দেশ বলে বুঝানো যাবে না। কেন?
কারণ, মোদির প্রপাগান্ডায় ভারতের সারা মিডিয়া এক উগ্র-হিন্দুজাতি-বোধ থেকে সময়য়ে নিজ পত্রিকায় লিখেছে ও বিশ্বাস করা শুরু করেছে যে ভারত তৃতীয় বিশের দেশ থেকে একলাফে কবে যেন পরাশক্তি হয়ে গেছে। দ্যা-হিন্দু পত্রিকার সুহাসিনী হায়দারও একথা বিশ্বাস করেছিলেন। কিন্তু মোহভঙ্গের পরে এনিয়ে এক আর্টিকেল লিখেছিলেন।
মোদির সেই ‘পরাশক্তি ভারতকে’ বাইডেনের আমেরিকা এখন মোদি রেজিম চেঞ্জের জন্য উঠে-পড়ে লেগে গিয়েছে – যদিও পুরা ঘটনাটা দেখে আগামি ২০২৪ সামের মে মাসের ফলাফলে জনগন দেখবে মোদি সেই নির্বাচনেই হেরে গেছে – এমনই মনে হবে হয়ত।
তাই এশিয়া উত্তাল হচ্ছে বলতে যদি ভারতের দিকে তাকিয়ে বলি তবে, বলতে হবে ভারতের কেন্দ্রীয় সরকারের নির্বাচন শেষ হয়ে যাবে আগামি বছর ২০২৪ সালের মে মাসের মধ্যে। সেক্ষেত্রে এই নির্বাচন শুরু হতে এখন থেকে এক বছরেরও কম সময় আর বাকি আছে বুঝতে হবে। কারণ গতবারের (২০১৯ সালের নির্বাচন) কথা মনে রেখে বললে ২০২৪ সালের ১১ এপ্রিলের মধ্যে নির্বাচন শুরু হয়ে যাবার কথা। আর আমেরিকা ও রাহুলের নেতৃত্বের বিরোধী দলের টার্গেট হল ২০২৪ সালের নির্বাচনে মোদি ( ফলে সাথে তার হিন্দুত্ববাদও) উপড়ে উঠিয়ে ফেলে দেওয়া। আর আমেরিকান টার্গেট হল, এভাবে ভারত থেকে প্রো-আমেরিকান স্ট্রাটেজিক নীতি-পলিসির এক ভারতকে পাওয়া।

মোদি-উপড়ানোতে উতসাহিদের বয়ান দাবি করে যে ভারতে ধারাবাহিক একশন শুরু হয়ে গেছে। যেমন, গুজরাত মুসলমান-নিধনের ডকুমেন্টারি বিবিসিতে প্রকাশ, শেয়ার বাজারে মোদির দোস্ত আদানির গুমোড় ফাঁস, কংগ্রেসের রাহুলের ‘ভারত-জোড়ো’ পদযাত্রা, রাহুলের লন্ডন সফর ও সফরে গিয়ে ভারতে ব্যাপক মানবাধিকার লঙ্ঘনে আন্তর্জাতিক গোষ্ঠিগুলোকে সোচ্চার হবার আহবান জানিয়েছেন [defenders of democracy have been “oblivious” to the systematic erosion of democracy in India. ] বলে মোদির অভিযোগ, পালটা হিশাবে মোদির ভারতের বৃটিশ এনজিও অক্সফামের বিরুদ্ধে তাদের অফিস তল্লাসি ও মামলা,  গায়ের জোরে রাহুলের সংসদ সদস্যপদ বাতিল, সর্বশেষ কাশ্মীরে পুলওয়ালে জওয়ান হামলায় ৪০জনের মৃত্য ও এতে মিথ্যা করে পাকিস্তানের সংশ্লিষ্টতার দাবি ও ভারতের বিমান বাহিনীর পাকিস্তানে হামলার মিথ্যা খবর ছড়ানো ইত্যাদি নিয়ে মোদি নিজেই দায়ি বলে গুমোড় ফাঁস করেছেন। পুলওয়ামা হামলা: সরকারের ভুল চেপে যেতে বলেছিলেন মোদি; বলছেন, সেকালে মোদির নিয়োজিত কাশ্মীরের রাজ্যপাল  সত্যপাল মালিক – এসব ঘটনাই এক সুত্রে যুক্ত।

আমেরিকান স্টেট ডিপার্ট্মেন্টঃ
আমেরিকান স্টেট ডিপার্ট্মেন্ট মানে হল আমাদের ভাষায় আমেরিকার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। সম্প্রতি লক্ষ্য করা যায় এর মুখপাত্র ছাড়াও আরেকজন উপ-মুখপাত্র আছেন যার নাম বেদান্ত প্যাটেল। তাকে আগে আমরা খুব একটা দেখেছি বলে মনে পড়ে না। কিন্তু তিনি এখন খুব এক্টিভ। ভারতের কেন্দ্রিয় সংসদের স্পিকার কংগ্রেসের রাহুল গান্ধির সংসদ সদস্যপদ খারিজ করে দিয়েছেন।  আর এর অজুহাত হল গুজরাতের এক মেজিষ্টেট কোর্টে দুবছর আগের মামলা যে রাহুল মোদির মানহানি করেছেন, তার তাকে দুবছরের সাজা দিয়েছেন। তবে কোর্ট নিজেই তাকে আগাম জামিন দিয়েছেন উচ্চ আদালতে যাবার জন্য, এর আগে সাজা বলবত স্থগিত রেখেছেন ইত্যাদি। এমনিতেই বহু আইনি ত্রুটিতে ভরা এক সাজা আদেশ আর এছাড়া ঐ আইনেই বলা আছে চলতি সংসদ সদস্যের বেলায় আপিলের আগে এই সাজা বলবত করা যাবে না তবু স্পিকার  রাহুল গান্ধির সংসদ সদস্যপদ খারিজ করেছেন। এরপর ঐ বেদান্ত প্যাটেল এক বিবৃতিতে জানিয়েছেন আমেরিকা রাহুলকে নিয়ে আদালতের ঘটনাবলীর দিকে নজর রাখছেন। ‘Importance of freedom of expression’: US says it’s watching Rahul Gandhi’s case – এই শিরোনাম দেখুন।
অর্থাৎ এখানে দেখা যাচ্ছে এখানে এসে ভারত আর বাংলাদেশ যেন একাকার – এক তৃতীয় বিশ্বের দেশ নিয়ে আমেরিকান বিবৃতি যেমন হয়ে থাকে।

হিউম্যান রাইট নিয়ে আমেরিকাঃ
আমাদের মত দেশে হিউম্যান রাইট লঙ্ঘণ নিয়ে আমেরিকার আগ্রহ কী কাম্য? স্বাগত জানানোর মত? নাকি আমাদের আভ্যন্তরীণ ইস্যুতে হস্তক্ষেপের উসিলা?
এককথায় বলা যায়, কমিউনিস্টেরা মনে করে এটা হস্তক্ষেপ। কোন দেশ উত্তর কোরিয়া হয়ে গেলেও ভিন্ন কোনদেশের তা একেবারেই আমল করা উচিত না। কারণ, এটা তাদের আভ্যন্তরীণ বিষয়।

এ সম্পর্কে একটা কথা বলাই যথেষ্ট যে কমিউনিস্ট রাষ্ট্র ধারণায় নাগরিক বলে কোন ধারণা নাই, অনুপস্থিত। অতএব সে অবস্থায় আবার নাগরিক অধিকার বা অধিকার [Citizen’s right] বলে কোন ধারণা সেরখানে থাকার আশা করা অর্থহীন। তবে রাষ্ট্রে শ্রেণী [Class] বলে ধারণার প্রাবল্য আছে। কোন রিপাবলিক রাষ্ট্রে বাসিন্দারা সকলে নাগরিক এবং শ্রেণী নির্বিশেষে সকলে সমান নাগরিক অধিকারের নাগরিক। কমিউনিজমের রাষ্ট্র চিন্তায় নাগরিক বলে ধারণাটাই নাই, তাই সমান অসমানের বালাই নাই। তবে বুর্জোয়া ও প্রলেতারিয়েট বলে অন্তত দুটা আলাদা শ্রেণী ধারণা আছে।  আর তাদের ওই রাষ্ট্র কেবল প্রলেতারিয়েটের পক্ষের রাষ্ট্র, এর পক্ষে সগর্ব ঘোষণা আছে। সুতরাই এখানে সমান নাগরিক, সমান অধিকারের মানুষ বা নাগরিক বলে কিছু নাই। বরং মারাত্মক অসম ক্ষমতার বুর্জোয়া ও প্রলেতারিয়েট বলে অন্তত দুটা আলাদা ও অসম শ্রেণী ধারণা আছে।
অতএব কমিউনিস্টেরা রাষ্ট্রের সার্বভৌমত্বের কথা বলে, আভ্যন্তরীণ ইস্যুর কথা তুলে নিজের এই দুর্বলতা ঢাকবে বা লুকাবে স্বাভাবিক!

কিন্তু তাই বলে কী  হিউম্যান রাইট লঙ্ঘণ নিয়ে কথা তুলে আমরা আমেরিকাকে ডেকে আনবো? হস্তক্ষেপের উসিলা করে দিব?
সেটাও অবশ্যই না।  এককথায় সার্বভৌমত্ব লঙ্ঘণ বা হস্তক্ষেপ না করতে দিয়েও অধিকার দিয়ে কথা বলতে দেয়া সম্ভব ও তা যায়।  এছাড়া মনে রাখতে হবে হিউম্যান রাইট তো জাতিসংঘের ঘোষিত ম্যান্ডেট এবং ইস্যু তাই এনিয়ে জাতিসংঘের ফোরামে তো কথা উঠবেই।  আর এখানেও কোন কথা না তোলার মানে হবে সংশ্লিষ্ট দেশের ভিতরে  সরকারবিরোধী সবাইকে গুম-খুন অপহরণ বা পিটায়ে মেরে ফেললেও তা নিয়ে বাইরের কাউকে কথা বলতে না দেয়া হবে।
আসলে মূল তর্কটা অন্যখানে, সেখানে সরাসরি যাওয়া যাক।
আমেরিকান সরকারি ফরেন পলিসিতে, আমেরিকান সরকার যদি কোন দেশ ও সরকারের হিউম্যান রাইট ভায়োলেশন এর বিরুদ্ধে কথা বললে আমেরিকারর নিজের স্বার্থ আছে বলে না দেখে তবে আমেরিকা সেক্ষেত্রে নিঃশ্চুপ থাকবে। অর্থাৎ ভায়োলেশন হলেই তা নিয়ে আমেরিকা মুখ খুলবে না। যদি তাতে আমেরিকান স্বার্থও না থাকে বা আমেরিকান সরকার না দেখে।

তাহলে কনক্লুশন কীঃ
ওয়ান-এলেভেনের হস্তক্ষেপ এর সুবিধা  যাদের পক্ষে গেছিল স্বভাবতই তারা এই হস্তক্ষেপকে ভাল বলবে। অন্যেরা সমালোচক হবে। বর্তমানে বা আগামিতেও এই নিয়মে সব হিসাব মিলবে দেখা যাবে। এর বাইরে আপাতত কোন কমন সুত্র বা সমাধান দেখছি না।

সবশেষে ভারত প্রসঙ্গে আরেকটা তথ্যা দেই। সোনিয়া গান্ধী কংগ্রেসের প্রাক্তন সভাপতি ও রাহুলের মা। দলের এক শীর্ষ বা প্রধান ব্যক্তিত্ব। তিনি মোদির দুটার্মের প্রায় দশ বছরে রাজনৈতিক অপরাধ ও অন্যায়গুলোর একটা তালিকা করেছেন। অন্যভাবে বলা যায় মোদির নাগরিক অধিকার লঙ্ঘণ-গুলোর এক গ্রহ্নিত তালিকা এটা।  সিরিয়াস ও ভাল তালিকা সন্দেহ নাই। শিরোনাম করেছেন,  “An enforced silence cannot solve India’s problems.” জবরদস্তিতে চুপ করিয়ে দেয়া ভারতের সমস্যার কোন সমাধান নয়।  কিন্তু একটা অসুবিধা হল তিনি এটা কেবল দ্যা হিন্দু পত্রিকাকে দিয়েছেন আর তারা পাঠক এটা পুরাটা পড়তে চাইলে পয়সা চাচ্ছেন। যা খুবই অন্যায়। কংগ্রেসের দিক থেকেও বড় অন্যায়।  তবে অর্ধেকটা বিনা পয়সাতে পড়া যায়।
একটা ভিন্ন বিকল্প আছে। আরো কয়েকটা পত্রিকা এনিয়ে পর্যালোচনার ছলে প্রায় অনেকটাই ছাপিয়ে দিয়েছে, যাদের একটা হল ইন্ডিয়া টুডে – সেটা এখানে দেখা যেতে পারে।  এমন করে দ্যা প্রিন্ট পত্রিকা এর টা এখানে।


গৌতম দাস
রাজনৈতিক বিশ্লেষক

 

 

Leave a Reply

Fill in your details below or click an icon to log in:

WordPress.com Logo

You are commenting using your WordPress.com account. Log Out /  Change )

Facebook photo

You are commenting using your Facebook account. Log Out /  Change )

Connecting to %s