ডলার-স্যাংশনের সীমাবদ্ধতা প্রসঙ্গে জেনেট ইয়েলেন 


ডলার-স্যাংশনের সীমাবদ্ধতা প্রসঙ্গে জেনেট ইয়েলেন
গৌতম দাস

২৮ এপ্রিল ২০২৩      ০০ঃ ০১
https://wp.me/p1sCvy-4nV

 

      What Janet Yellen Can Do……..

ঠিক দুদিন আগে গ্লোবাল নেতৃত্ব ও বিদেশি পুঁজি প্রসঙ্গে – এই শিরোনামে  একটা লেখা দিয়েছিলাম। অর্থাৎ এর ঠিক আগের লেখা ছিল সেটা।  আজকের প্রসঙ্গ সেই লেখাটার উপর দাঁড়িয়ে লিখবো। সেখানে আগের “গ্লোবাল নেতা” ধারণাটা আরো অনেক বেশি বিস্তারে ব্যবহার করব। একটা দেশে সবচেয়ে বড় রাজনীতি ও ক্ষমতা-কাঠামোর প্রতিষ্ঠান হল ঐ দেশের রাষ্ট্র মানে ওর রাষ্ট্র ব্যবস্থা। যেটাকে আমরা ওর State System বা Political Order & System বলে বুঝি। এখন এটাকে যদি লোকাল বা স্থাণীয় পর্যায়ের ঘটনা বলে বুঝি তবে ঠিক তেমনি দুনিয়াজুড়ে ইন্টারন্যাশনাল পলিটিক্যাল অর্ডার ও সিস্টেম  বলে কিছু একটা আছে; যার মুখ্য পলিটিক্যাল প্রতিষ্ঠানটা হল জাতিসংঘ।  এটাই লোকাল রাষ্ট্রগুলোর বিপরীতে গ্লোবাল ইন্সটিটিউশন। আর যে রাষ্ট্র এমন গ্লোবাল ইন্সটিটিউশন-গুলোর উপর এর সকল সিদ্ধান্ত-ততপরতার উপর সবচেয়ে বেশি প্রভাব ও আধিপত্য রাখে সেটাই গ্লোবাল নেতা-রাষ্ট্র বলতে পারি।
এই সুযোগে এটাও বলে রাখি গ্লোবাল নেতা ধারণাটা সবচেয়ে বেশি বিস্তার লাভ করে ছড়িয়ে পড়েছে ১৯৪৫ সালের পরে। রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক এই দুই অর্থেই গ্লোবাল নেতা ধারণাটা বিস্তার ঘটিয়ে দুনিয়ায় ছেয়ে বসেছিল আমেরিকাকে কেন্দ্র করে। মানে দুনিয়ায় গ্লোবাল নেতা বলে ধারণাটা ১৯৪৫ সালের আগে তেমন বিস্তারিত কিছু ছিল না। যদিও ইউরোপের কলোনিদখলদার হিশাবে টপ পাঁচটা দেশ (বৃটিশ, ফ্রেঞ্চ, ডাচ, পর্তুগীজ ও স্পানিজ) এর মধ্যে বৃটিশেরা ছিল সবচেয়ে প্রভাবশালী, যাদের প্রধান অর্থনীতি বা ব্যবসা ছিল অন্যদেশকে কলোনিদখল করা – ইস্ট-ইন্ডিয়া কোম্পানির মত কোম্পানি খুলে বা বিনিয়োগ করে কলোনিদখলে বেরিয়ে পড়া।  সেকালের ভাষায় এমন দখলদার শক্তিগুলোকে  ‘সাম্রাজ্য’ বলার চল ছিল। যেমন গর্ব করে সেকালে বলা হত – “বৃটিশ সাম্রাজ্যের সুর্য কোনদিন অস্ত যাবে না, ঢুববে না”। এমন গর্বে ফেটে পড়া বাক্য থেকে অনেক কিছু বুঝা যায়। যদিও কোম্পানি-সাম্রাজ্যের এই দুনিয়া টিকে থাকতে পারে নাই, ১৯৪৫ সালের মধ্যে সব শেষ হয়ে যায়।

সংক্ষেপে বললে বিশ্বযুদ্ধে ১৯৪০ সালের জুনে হিটলারের জর্মানির হাতে ফ্রান্স, বেলজিয়াম, নেদারল্যান্ড ও লুক্সেমবার্গ দখল হয়ে যায়, পজর্মান সেনাবাহিনী নিজ প্রশাসন বসিয়ে এসব দখলি ভুখন্ডে শাসন শুরু করেছিল। এটা খুবই গুরুত্বপুর্ণ ঘটনা এজন্য যে সামরিক ও অর্থনৈতিক দখলদার শক্তি হিশাবে  ইউরোপের বৃটিশের পরেই ছিল ফ্রান্সের অবস্থান। সেই ফ্রান্সই হিটলারের জর্মানির দখলে চলে যাওয়া ছিল তাই তাতপর্যপুর্ণ ও ইঙ্গিতময়। আর তা দেখে বৃটিশ প্রধানমন্ত্রী চার্চিল নিজেদেরও একই ভবিষ্যত এঘটনার মধ্যে  দেখতে পেয়ে যায়। কারণ সাউদার্ণ ইংল্যান্ড আর নর্দার্ণ ফ্রান্স এদের মাঝে মানে এই দুই ভুখন্ড মাত্র এক ইংলিশ চ্যানেল দুরত্বে। কাজেই হিটলারের ইংল্যান্ডে আসতে আর কতক্ষণ – এই ছিল চার্চিলের মুখ্য ও চরম উদ্বিগ্নতা। এই চিন্তা করে চার্চিল সব ধরণের সাহায্য লাভে আশায় আমেরিকার প্রেসিডেন্ট রুজভেল্টের দারস্থ হওয়া ছাড়া বাঁচবার উপায় দেখেন নাই। আর ১৯৩৯ সালে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হয়ে গেলেও রুজভেল্ট তখনও যুদ্ধে কোন পক্ষ না নিয়ে নিজেকে বাঁচিয়েই চলেছিলেন।  আর অপেক্ষা করছিলেন ইউরোপের মাথা গ্লোবাল নেতারা কবে সাহায্যের জন্য তার পায়ে পড়েন। সেবার চার্চিল কার্যত নিজ কলোনিসাম্রাজ্যের মালিক গর্ব বা সমস্ত ভ্যানিটি ভুলে নিজেকে লুটিয়ে সারেন্ডার করেছিলেন। আর তা থেকে সাহায্যদাতা আমেরিকা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের মূল নেতা আর যুদ্ধে সকলের (নিজ মিত্রশক্তির)খরচদাতা হয়ে উঠেছিল। এটা ১৯৪১ সালের আগষ্টের সিদ্ধান্ত। চার্চিল প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন এরপর যুদ্ধে হিটলারকে হারাবার পরের নতুন দুনিয়াটা হবে কলোনিদখল-মুক্ত এক দুনিয়া।  এটাই হয়েছিল রুজভেল্টের আমেরিকা ও এর ওয়াল স্ট্রিট বিনিয়োগ ব্যবসায়ী প্রধান চাওয়া ও তা অর্জনের সাফল্য। স্বভাবতই এই সুফল আমরাও পরে নিয়েছিলাম। বৃটিশ-মুক্ত স্বাধীন হয়েছিলাম।  কিন্তু এর আগে রুজভেল্ট-চার্চিল চুক্তির পরে এর চারমাসের মাথায় ১৯৪২ জানুয়ারি এক জানুয়ারিতে, স্তালিনের সোভিয়েত ইউনিয়নও একই পথ অনুসরণ করে মানে, আমেরিকান নেতৃত্ব মেনে চুক্তিস্বাক্ষর করেছিল। কমিউনিস্টেরা এই ইতিহাস স্মরণ করতে চায় না; বরং না জেনে থাকতে চায়। তারা হিটলারের হাত থেকে সোভিয়েত দেশ বাঁচানো এক বীর হিশাবে স্তালিনের জয়গান দিয়ে বিশ্বযুদ্ধের ইতিহাসের বয়ান সাজায়। অথচ আমেরিকার নেতৃত্বে মিত্রশক্তিতে স্তালিন যোগ দেওয়ার সুযোগ পেয়েছিল বলেই আর এতে, যুদ্ধের খরচ হিশাবে আমেরিকান অর্থসাহায্য  না পেলে বীর স্তালিনের সোভিয়েত দেশ বাঁচানো কি করে সম্ভব হত – সেদিকটা ভুলে চুপ থাকতে চায়।
তবে  মোটামুটি ১৯৫০ সালের পর আর ১৯৫৩ সালের পরে পরিস্থিতি ভিন্ন হয়ে যায়। সুনির্দিষ্ট করে স্তালিনের সোভিয়েত ইউনিয়ন আমেরিকাকে সাম্রাজ্যবাদী শক্তি বলা শুরু করেছিল; যেখান থেকে আমেরিকা-সোভিয়েত কোল্ডওয়ার [Cold War] এরও যাত্রা  শুরু মানা হয়। কারণও ছিল এই যে আমেরিকান রাজনীতিতে টানা ২০ বছর পরে ১৯৫৩ সালে এসে প্রথম কোন রিপাবলিকান আমেরিকায় প্রেসিডেন্ট পদে উঠেছিলেন; তিনি হলেন আইসেনহাওয়ার, তাঁর বিজয় ঘটেছিল। আর তাতে এতদিনের আমেরিকার সে গ্লোবাল ইমেজ যে আমেরিকা  বিশ্বযুদ্ধে জিতিয়ে দুনিয়াকে গড়া নতুন রূপ দেয়া, জাতিসংঘ এর জন্ম দেয়া, আইওএমএফ-বিশ্বব্যাংকের মত গ্লোবাল প্রতিষ্ঠান গড়া যে ইতিবাচক উজ্জ্বল আমেরিকান ভুমিকা ছিল এর পরিসমাপ্তি ঘটেছিল। কারণ আইসেনহাওয়ার আমেরিকা তখন এক নয়া আমেরিকা যে এক নয়া ফেনোমেনা চালু করেছিল – সিআইএ দল পাঠিয়ে রেজিম চেঞ্জ, দেশ দখল বা তেলের খনির মত সম্পদের দখল নেয়া ইত্যাদি বহু কিছু শুরু হয়েছিল, সে আরেক প্রসঙ্গ।

কিন্তু এত পরিবর্তনের মাঝেও পরবর্তিতে কমিউনিস্ট চিন্তা ও ভুমিকা ততই  সব মিলিয়ে আরো পিছিয়ে পড়তে শুরু করেছিল। যেমন “গ্লোবাল নেতা” বা একটা নয়া “গ্লোবাল অর্ডার”  বলে দুনিয়ায় এতবড় পরিবর্তন নয়া গ্লোবাল পলিটিক্যাল সিস্টেম চালু হওয়াকে কমিউনিস্ট সোভিয়েত ইউনিয়ন আমল না করার পথে চলে যায়। অথচ নয়া দুনিয়ায় নয়া বিশ্বব্যাবস্থা যেটা তখন হাজির হয়েছিল যার ভিত্তি হল, কাউকে কলোনিদখল হারাম এটা মানতে আমেরিকার সারা ইউরোপকে লিখিতভাবে বাধ্য করা থেকে ইত্যাদি এসব দিক গ্লোবাল কমিউনিস্ট রাজনীতিতেই আর কখনও আমল হয় নাই। অথচ স্তালিনের নয়া ভাষ্যটা হল সেটা নাকি নয়া-উপনিবেশবাদি দুনিয়া। তাহলে ১৯৪২ সালের পয়লা জানুয়ারিতে স্তালিন কোন দলিলে স্বাক্ষর করেছিলেন??  যেটা জাতিসংঘের জন্ম ঘোষণা ১৯৪২ এর দলিল?

এই প্রসঙ্গটা নানাভাবে বহুবার আমার লেখায় যুক্ত করেছি। কিন্তু খুব একটা প্রভাব পরেছে টের পাইনি। আগে খাড়া রেফারেন্স দিয়েছিলাম ইংরাজি ডকুমেন্ট থেকে। সম্প্রতি একটা বাংলায় করা পিডিএফ পেয়েছি। সেখান থেকে ওর সপ্তম পাতা থেকে নিচার অংশ তুলে এনেছি। আগ্রহিরা পুরা পিডিএফ ডকুমেন্ট এখানে পেতে পারেন। এটা সম্ভবত স্কুলের বাচ্চাদের জন্য বাংলায় করা।

অথচ কমিউনিস্টেরা জানতেও পারে নাই বা জানতে চায় নাই যে কলোনিদখল ব্যবস্থার উতখাত ও নিষিদ্ধ এই ঘোষণা দিয়েই জাতিসংঘের জন্ম ঘোষণা, যার মধ্যে স্তালিনও একজন স্বাক্ষরকারি।
এভাবে কমিউনিস্টেরা কখনই জানতেই পারে নাই, চায় নাই যে  গ্লোবাল নেতা বা গ্লোবাল পলিটিক্যাল সিস্টেম চালু ফেনোমেনাগুলো আসলে কী? অথচ আজ দুনিয়া ১৯৪৫ সালের পরে আমেরিকান নেতৃত্বে ৭৮ বছর পার করছে আর সবচেয়ে বড় কথা এটা এখন সেই গ্লোবাল নেতৃত্বে পালাবদল আসন্ন এর সময়। কমিউনিস্টেরা এখানে এনিয়ে এখনও বেখবর। খাড়া বলতে গেলে, কমিউনিস্টেরা আসলে  এরপর থেকে বিশেষত চলতি শতকের দুনিয়ার ঘটনা-ফেনোমেনা গুলোকে ব্যাখ্যা করতে পারছে না। পিছিয়ে অযোগ্য হয়ে গেছে। যার মূল কারণ, ১৯১৬ সালের পরে কমিউনিস্ট চিন্তায় আর কোন আপডেট বা কোন ব্যবহারিক ভাষ্য আর নাই, আসে নাই।

তবে এখানে আরেকটা কথা বলে রাখি, ১৯৪৫ সালের আগের যতটুকু গ্লোবাল নেতার ধারণা ছিল সে ধারণা মতে গ্লোবাল নেতা সেটা মূলত সামরিক শক্তি গত ধারণা বলেই বুঝা হত। বিপরীতে  ১৯৪৫ সালের পরে একালের গ্লোবাল নেতা বলতে আরও অনেক দিকে ধারণাটা ছড়িয়েছে। যেমন এর একটা বড় অনুষঙ্গ অংশ বা দিক হল গ্লোবাল কমিউনিটিতে দান বা লিল্লাহ। জাতিসংঘের দিক থেকেই যদি বলি মূল জাতিসংঘের অধীনে আরেক এজেন্সি প্রতিষ্ঠান হল ওয়ার্ল্ড ফুড প্রোগ্রাম [WFP] বা বাংলায়, বিশ্ব খাদ্য  কর্মসুচি। এটাই হল দুনিয়ার ভুখা মানুষকে দানের খাদ্য পৌছে দেওয়া। আমাদের যুদ্ধের পরে ১৯৭২-৭৩ সালে আমরা এই WFP এর ভরসাতেই বেচে গেছিলাম। ১৯৭৪ সালে আর পারি নাই, সে আরেক কাহিনী, তা পরে কখনও।  গুলশান ধরণের জায়গা বাদে ঢাকার বাকি এলাকায় কমিউনিটি বা মহল্লা সেন্স কাজ করে প্রবল্ভাবে। দেখা যাবে মহল্লার কোন মুরুব্বি প্রায়ই ডেকচি বসিয়েছেন – খিচুরি-বিরিয়ানি কিছু একটা রান্না করে গরীব বস্তিতে বিলাচ্ছেন। WFP এই অর্থে লিল্লাহ সংগঠন যেন। এখন WFP এর সাথে গ্লোবাল নেতার কী সম্পর্ক? WFP-কে বড় চাঁদাটা দেয় কে? কেউ গ্লোবাল নেতা হতে চাইলে সবচেয়ে বড় চাঁদাদাতা হতেই হয়। এমনকি সরকারি অর্থের ঘাটতি থাকলে রাষ্ট্রীয় ঋণ করে হলেও গ্লোবাল নেতাকে WFP-কে দেয়া প্রতিশ্রুতি পূরণ করতে পারতে হয়। গতবছর আফগানিস্তানে খাদ্য সংকট হয়েছিল চরমে। জাতিসংঘ নয়া সরকারকে এখনও স্বীকৃতি না দিলেও খাদ্য সাহায্য যোগাড় করে দেওয়ার ক্ষেত্রে কার্পণ্য করে নাই। সারকথায় মানবিক সাহায্যের এক সেফটি নেট এক নয়া প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবস্থা ১৯৪৫ সালের এই দুনিয়া হাজির এবং তা খুবই সুসংগঠিত এক ম্যানেজমেন্ট সিস্টেম হিশাবে তা স্বীকৃত।

 

সরাসরি ব্যবহারিক বাস্তবতায়, বাইডেনের আমেরিকাঃ
বাইডেন ২০২১ সালে ক্ষমতায় এসেছিলেন মূলত একথা বলে যে গ্লোবাল নেতা হিশাবে আমেরিকার এখনও কতসব হাতিয়ার বা টুলস আছে যা অন্য বিশেষ করে রিপাবলিকান প্রেসিডেন্টেরা কখনও এক্সপ্লোর বা হাতড়ে খুজে দেখেনই নাই।  এগুলো ব্যবহার করে আমেরিকা এখনও চীনকে ছাড়িয়ে গ্লোবাল শীর্ষনেতা থেকে যেতে পারে। তাই তাঁর ক্ষমতামলের বৈশিষ্টই হবে আমেরিকার সেসব পড়ে থাকা মারাত্মক হাতিয়ার প্রয়োগে আনতে হবে।  যেমন, তিনি এমন দুটা হাতিয়ার এর কথা বললেন – শত্রু বা বেয়াড়া দেশের বিরুদ্ধ্বে মানবাধিকার লঙ্ঘণের অভিযোগ এনে তাকে পর্যদুস্ত করে ফেলা। এমনি আরেকটা অস্ত্র হল অবরোধ বা স্যাংশন [Sanction] আরোপ করা।

চলতি প্রেসিডেন্ট বাইডেন ২০২১ সালের ২০ জানুয়ারি প্রেসিডেন্টের শপথ নিয়ে যাত্রা শুরু করেছিলেন। তিনি তাই তাঁর পুর্বসুরি ডোনাল্ড ট্রাম্প রিপাবলিকান আর তিনি ডেমোক্রাট, আর নিজে ডেমোক্রাটে বলে তারা আতেঁল ও বুদ্ধিমান, বুদ্ধির চর্চা করে চলে থাকেন এটা রিপাবলিকানদের উপর ডেমোক্রাটদের চিরাচরিত উচা ও গর্বের ধারণা! তাই ‘বোকা’ ট্রাম্পের উপর তাদের বুদ্ধির ছটা দেখাতেই যেন তিনি যে নীতি-পলিসি নিয়ে সামনে এসেছিলেন তা হল এরকম যে, আমেরিকা কেন চীনের কাছে হারবে যেখানে আমেরিকার এখনও অঢেল বাড়তি সুবিধার হোল্ডার! বাইডেন যেন বলতে চান যে বোকা ট্রাম্পের মত লোকেরা ঝটাপট প্রেসিডেন্ট হয়ে গেছে – তাই চীনের উপর আমেরিকার হাতে থাকা বাড়তি সুবিধাগুলো কী কী তা এদের ‘জানাই নাই’! আর এসব বাড়তি সুবিধার দুটা বাইডেন বের করে দাবি করলেন যে তিনি এমন দুইটা কে তাঁর নীতি-পলিসি করে হাজির করছেন। যা অন্যদের বা শত্রুদেশকে বিপদে ফেলতে সক্ষম আর তা থেকে তাদেরকে আমেরিকার হাতে একধরণের নিয়ন্ত্রণে আনা সম্ভব। তেমনই এক মোক্ষম অস্ত্র হল তাদের ‘হিউম্যান রাইট’ ভায়োলেশনের প্রশ্ন তুলে তাদেরকে বেকায়দায় ফেলা। অন্যভাষায় বললে, এজন্যই বাইডেন-ব্লিঙ্কেন ঘোষণা দিয়েছিলেন যে ‘হিউম্যান রাইট’ কমপ্লায়েন্সের প্রশ্ন তোলা তাঁদের বৈদেশিক নীতির অবিচ্ছেদ্য অংশ।

বিগত ভারত-আমেরিকার স্ট্রাটেজিক জোটঃ
বিগত বাইশ বছর ধরে মানে চলতি শতকের শুরু থেকে  ভারত-আমেরিকার স্ট্রাটেজিক জোট বা ঐক্য যা আমরা এতদিন কাজ করতে দেখেছিলাম সেই প্রেসিডেন্ট বুশের আমলের শুরু থেকে, মনে হচ্ছে তা এই ২০২৩ সালে এসে এবার ক্ষান্ত দিতে চাইছে বা থেমেছে; যে স্ট্রাটেজিক ঐক্যজোটের অকার্যকারিতা বা স্তব্দ হয়ে যাওয়া এখন প্রকাশ্যে ঘোষণা দিয়ে না বললেও প্রায় সবটাই এখন কার্যত প্রকাশ্য হয়ে পড়েছে। আগামি নির্বাচনে মোদি সরকার যেন জিতে আসতে না পারে সেকাজে বাইডেন কমবেশি প্রকাশ্যে উঠেপড়ে লেগে পড়েছে। অথচ গত বাইশ বছর ধরে এই চীন-ঠেকানোর ঐক্য বা চায়না কনটেইনমেন্ট [China Containment] এর ঐক্য যেন চিরকালের তাই অনেকের মনে হচ্ছিল। মোদি এখন ক্রমশ বাইডেনের ‘হিউম্যান রাইট’ অস্ত্রে ক্ষতবিক্ষত হয়ে পড়ছেন। বার্মায় রেজিম চেঞ্জ প্রশ্নে আলাদা স্বার্থ বা আলাদা রাস্তার দুই দেশ হয়ে উঠছে।

বাইডেনের ব্যবহৃত আরেক অস্ত্রের নাম ‘ডলার অবরোধ’ অনেকে যেটাকে অনেক সময় “ইকোনমিক স্যাংশন”[Economic Sanction] আরোপ বলছেন.  এর সোজা মানে হল ডলারে কোন বাণিজ্য বা বেচাকেনা করা যাবে না অথবা আমেরিকান কোন ব্যাংকের সুইফট কোড ব্যবহার করা যাবে না আমেরিকান সরকারের নিষেধাজ্ঞা আরোপের কারণে। আন্তর্জাতিক দুনিয়াজুড়ে যত বাণিজ্য বা পণ্য কেনাবেচা হয় এর সত্তরভাগের বেশি বাণিজ্য-লেনদেন হয় আমেরিকান ডলারে। অর্থাৎ পণ্যমুল্য ডলার এই মুদ্রায় লিখে ইনভয়েস তৈরি করা হয়। আর সেকারণে এই লেনদেন সম্পন্ন হতে হলে প্রক্রিয়ার মাঝে কোথাও কোন আমেরিকান ব্যাংকের সংশ্লিষ্টতা বা সাহায্য লাগবেই। আর এখানেই আমেরিকান স্যাংশন মানে আপনি (যেমন তেল-বিক্রেতা রাশিয়া হলে) আমেরিকার ব্যাংকের সুবিধা ব্যবহারে অযোগ্য।

এখন এটা হল দুইধারী তলোয়ারের মত। কারণ, এটা ঠিক যে কোনদেশের উপর আমেরিকান ব্যাংক ব্যবহারের বিরুদ্ধে নিষধাজ্ঞা যেটা স্যাংশন নামে পরিচিত এবং তা আমেরিকান সরকারের পক্ষে বাস্তবায়নও সহজ। কারণ আমেরিকান বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোকে এই নির্দেশ পাঠিয়ে তা বাস্তবায়ন করানো সম্ভব। আর নির্দেশ অমান্য করলে ব্যাংকগুলো দুই বিলিয়ন ডলার ফাইন করারও উদাহরণ আছে। ইরানের উপর নিষধাজ্ঞার বেলায় হংকং ব্যাংকের উপর এমন দু বিলিয়ন ডলার ফাইন করা হয়েছিল। কিন্তু দিনকে দিন এই ইচ্ছামত ডলার অবরোধ অপব্যবহার আমেরিকার বিরুদ্ধে যাবার সম্ভাবনা তৈরি হচ্ছে। যেমঞ্চীনের সাথে বিভিন্ন দেশের বাণিজ্যও এখন উঠতি ট্রেন্ড। মানে আসলে বলতে চাচ্ছি ডলারের পাশাপাশি চীনা ইউয়ানেও বাণিজ্য বাড়ছে। অর্থাৎ যত বেশি ডলার ব্যবহারে কড়াকড়ি আরোপ করা হবে ততই এথেকে ছুটকারা পেতে প্রচেষ্টাও প্রবল হবে। আর এতে এখন গ্লোবাল মোট বাণিজ্যিক লেনদেন তা ডলারে লেনদেন এর ৭০-৯০% ডলারে  হয়ে থাকে। তা একবার ৭০% এর কাছাকাছি হতে শুরু করলে এই ঝোঁক স্থায়ী হতে চাইবে। মানে অবরোধের অতিরিক্ত বাড়াবাড়ি বিপুরীতে কাজ করবে।
একথাটা যেকোন ভাবেই হোক মিডিয়ার সামনে এসে গেছে। আমেরিকান অর্থ-ট্রেজারি মন্ত্রী হলেন জেনেট ইয়েলেন [Janet Yellen]। সিএনএন এর ফরিদ জাকারিয়ার সাথে এক আলাপ তিনি মন্তব্য করে বসেন যে অপর দিকটা হল,  “আমরা যখন কোন দেশের বিরুদ্ধে স্যাংশন ব্যবহার করি যা ডলারের ভুমিকার সাথে সম্পর্কিত – এতে এমন রিস্কও থেকে যায় যাতে তা ক্রমশ ডলারের আধিপত্য ক্ষুন্ন করে ফেলতে পারে”।  তিনি আরও বলেন, “এভাবে ডলার অবরোধের যথেচ্ছ ব্যবহার  এটা অবশ্যই চীন, রাশিয়া বা ধরেন ইরাণকে ডলারের বিকল্প খাড়া করার জন্য প্রবল আকাঙ্খার জন্ম দেয়”।  অর্থাৎ আমেরিকাও রিস্কের পথে হাটছে তা জেনেট স্বীকার করে নিয়ে বলেই ফেলেছেন ।

“There is a risk when we use financial sanctions that are linked to the role of the dollar that over time it could undermine the hegemony of the dollar,” “Of course, it does create a desire on the part of China, of Russia, of Iran to find an alternative,” 

আরো কিছু প্রতিক্রিয়াঃ
এদিকে এখনকার পাকিস্তান খুব ভাল উদাহরণ হয়ে উঠেছে। আগের ইমরান সরকারকে ক্ষমতাচ্যুত করার ব্যাপারে ডোনাল্ড লু এর ভুমিকা নিয়ে অনেক কথা উঠেছিল। সেটা যাই হোক, তাতে ইমরানের ক্ষমতাচ্যুতি এড়ানো যায় নাই। পরিবর্তে শাহবাজ শরীফ ক্ষমতায় আসেন। কিন্তু ক্ষমতা পেলেও  সরকার চালাতে গেলে খারাপ অর্থনৈতিক দুর্দশায় পড়া পাকিস্তানের প্রয়োজনীয় ডলারের ব্যবস্থা যদি আমেরিকা না করে দিতে পারে; নিদেনপক্ষে বিশ্বব্যাংককে দিয়েও যদি আমেরিকা ব্যবস্থা এরেঞ্জমেন্ট না করে দিতে পারে তবে আমেরিকান গ্লোবাল নেতৃত্ব ক্রমশ প্রশ্নের সম্মুখীন হয়ে যাবে। পাকিস্তানের নিয়মিত অর্থসংকট এমন ইঙ্গিত দেয়। আবার এই পরিস্থিতিতে পাকিস্তানকে যদি চীনের কাছ থেকে নিয়মিত লোন দেরিতে পরিশোধে ছাড় রোল আউট[Roll Out] বা নয়া ঋণ চাইতে হয় তবে এটা তা আমেরিকার গ্লোবাল নেতৃত্বের জন্য ভাল সংবাদ নয়।  মানে ইমরানও তার আমলে ক্ষমতা ছাড়ার দুমাস আগে এমন রোল আউট নিয়েছিলেন।

আবার রয়টার্সের এক নিউজ যা প্রথম আলো অনুবাদ করে ছেপেছে ওর শিরোনাম হল, রাশিয়ার তেলে পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞায় ক্ষতিতে ইউরোপ, লাভ তুলছে এশিয়া। মানে হল ডলার অবরোধ কাজ করছে না। আর শুধু আমেরিকা না বলে পশ্চিমা অবরোধ মানে হল এখানে আমেরিকার মত করেই ইইউ জোটেরও আলাদা অবরোধ দেয়া আছে। এমনকি এশিয়ার জাপান বা অষ্ট্রেলিয়া ইত্যাদি দেশেরও একই অবরোধ দেয়া ছিল।

অন্যদিকে, জ্বালানি তেল প্রসঙ্গে আরো দুর্দশার ইঙ্গিত দেখা যাচ্ছে। যেমন, আমেরিকা রাশিয়ার উপর তার তেল বিক্রির লেনদেনে ডলারে করার উপর নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে।  এতে ভারত হয়ে উঠেছে রাশিয়ান ক্রুড ওয়েল আমদানি করে পরে নিজে রিফাইন করে তা পুণ-রফতানীর প্রধান দেশ বা  রাশিয়ান তেল রপ্তানির সেকেন্ডারি উৎস দেশ।  অথচ আমেরিকা এতে বাধা দিতে পারছে না। বা অন্তত দিচ্ছে না তাই আমরা দেখছি যার অন্তত একটা বড় কারণ হল অর্থনৈতিক লেনদেন ডলারে হচ্ছে না। এতে ফলাফলে রাশিয়ার উপর অবরোধ কার্যত এখানে অকার্যকর হয়ে পড়ছে। সর্বশেষ অবস্থা হল এতে বিপদ ক্রমশ আরো বাড়ছে। কারণ পাকিস্তানের কথাই যদি ধরি,  ইতোমধ্যে এবার পাকিস্তানও দুই চালান এমন রাশিয়ান অশোধিত তেল যা ভারত শোধন করে রপ্তানি করছে তা ভারত থেকেই আমদানি করে ফেলেছে পাকিস্তান।  শুধু তাই না, এবার সরাসরি রাশিয়া থেকেই (তবে অশোধিত) রাশিয়ান তেল আমদানি করে ফেলেছে পাকিস্তান, পরে নিজ রিফাইনারিতে শোধন করে ব্যবহার করবে বলে। আর এতে কোন মুদ্রায় তা আমদানি করেছে তা মিডিয়ায় পাকিস্তানের মন্ত্রী অপ্রকাশ্য রেখেছেন। অর্থাৎ ধরে নিতে পারি তা ডলারে অবশ্যই নয় এবং সম্ভবত তা ইউয়ানে।
এতে নিট ফলাফলে, রাশিয়ার উপর আমেরিকান অবরোধের পরিণতি যা দেখা গেল তা নিঃসন্দেহে বিব্রতকর!  মানে হল একদিকে, আমেরিকা নিজ সমর্থনের শাহবাজ সরকার যে অর্থনৈতিকভাবে দুর্বল বিদেশি মুদ্রার অভাবে মারাত্মক ভুগছে – এই বাস্তাতবতায় আমেরিকা শাহবাজ সরকার রাশিয়ান তেল যেন না কিনে তা করতে চাপ দিতে পারছে না। অপরদিকে চাপ দিতে না পারায় রাশিয়ার উপর আমেরিকান অবরোধ অকার্যকর হয়ে থাকছে। এভাবে আমেরিকার যদি সকল দেশকেই নানান অজুহাতে ছাড় দিতেই হয় তাহলে অবরোধ-শ্যাংশন কথাটা অর্থহীন!!  এসবই কী আমেরিকার গ্লোবাল নেতৃত্বের সক্ষমতার বিরুদ্ধে ইঙ্গিত হয়ে উঠবে!!!  মানে হল শুধু রেজিম চেঞ্জ নয় সাথে নয়া সরকার চালানোতে বৈদেশিক মুদ্রার ব্যবস্থা করে দেওয়ার আমেরিকান সক্ষমতাতেও সে যেন শর্টেজে না থাকে তা,  একালে আমেরিকার গ্লোবাল ভুমিকার জন্য সমান গুরুত্বপুর্ণ  এসেনশিয়াল বলে হাজির হচ্ছে!!


গৌতম দাস
রাজনৈতিক বিশ্লেষক

3 thoughts on “ডলার-স্যাংশনের সীমাবদ্ধতা প্রসঙ্গে জেনেট ইয়েলেন 

Leave a Reply

Fill in your details below or click an icon to log in:

WordPress.com Logo

You are commenting using your WordPress.com account. Log Out /  Change )

Facebook photo

You are commenting using your Facebook account. Log Out /  Change )

Connecting to %s