হালকা, আবছার উপর ঝাপসায় মারা কমিউনিস্ট বিবৃতি


হালকা, আবছার উপর ঝাপসায় মারা কমিউনিস্ট বিবৃতি
গৌতম দাস

০২ মে ২০২৩  মধ্যরাত ০০ঃ০১
https://wp.me/p1sCvy-4oK

 

United Communist League of Bangla Desh

দেশে না জেনে আন্দাজের উপর কথা বলা লোকের সংখ্যা বাড়তেছে। গত ২৫ এপ্রিল প্রধানমন্ত্রী হাসিনা ত্রিদেশীয় জাপান-আমেরিকা-যুক্তরাজ্য সফর শুরু করেছিলেন। আর এরপরেই ২৭ এপ্রিল সন্ধ্যায় সিপিবি-র এক জ্ঞানী বিবৃতি প্রকাশিত হয়েছিল। এমনকি পরের দিনও তাদেরই “বাম গণতান্ত্রিক জোট” একই ইস্যুতে বিবৃতি দিয়েছিল। সরকারকে অভিযুক্ত করার ভাবে তেমনই টোনে এসব বিবৃতি। যেমন সিপিবির বিবৃতির শিরোনাম – ‘প্রধানমন্ত্রীর জাপান সফরে যেন জাতীয় নিরাপত্তা বিকিয়ে দেওয়া না হয়: সিপিবি’। আর জোটের বিবৃতির শিরোনাম – ‘তেল-গ্যাস অনুসন্ধান ও উত্তোলনের চুক্তি প্রকাশ করার দাবি’
যারা এতদিন মানে, কম করে ধরলে গত পনেরো বছর ধরে ‘সরকারের বিকল্প দেখে নাই’ তারা আজ হঠাত এত কড়া অভিযোগে ‘সাম্রাজ্যবাদ’ বলে গালি দিয়ে হুঙ্কার দিচ্ছে – এটা কেন?  তার মানে, বামেরা কী মনে করে সরকারের কী তবে আয়ু শেষ? তাই বিপ্লবীপনায় ফিরে যেতেই…!  সম্ভবত একারণেই, সবার আগে বামেরা তাই হাসিনার দায়দায়িত্ব আর এতদিনের সমর্থন ও ঘষাঘষি সম্পর্ক এখন থেকে  মুখে অস্বীকার করে ডিস্ট্যান্স তৈরি করে দূরে দাড়ানোর জন্য উঠে পড়ে লেগেছে মনে হচ্ছে!

তাই দেশে এখন একটা “হালকা, আবছার উপর ঝাপসা মারা বিবৃতি” ও তা নিয়ে পত্রিকা রিপোর্ট করা শুরু হয়েছে; যে ঘটনার  শুরু প্রধানমন্ত্রীর এবারের জাপান সফর থেকে, সফর শুরুর দিন থেকে। সেদিন আবার দৈনিক যুগান্তরেও একটা খবর ছাপা হয়েছিল যার শিরোনাম, “গভীর সমুদ্রে তেল-গ্যাস অনুসন্ধান মার্কিন কোম্পানি এক্সন মবিল কাজ পাচ্ছে”। একইদিনে মাদারবাড়িতে জাপানের গভীর বন্দর নির্মাণ আর ভারতকে চট্টগ্রামের পরে এবার মোংলা বন্দর ব্যবহার করতে দেয়ার রাজস্ব বিভাগের খুটিনাটির নির্দেশ জারি এবং বাংলাদেশেরও আগে ভারত প্রায়োরিটিতে যেন বন্দর ব্যবহার করতে পারে ইত্যাদি এসব বিষয়ে খবর প্রকাশিত হয়েছিল। আর তা থেকে বাম-বিপ্লবীপনার জোয়ার ছড়িয়ে পরা শুরু হয়েছে। যা অন্যান্যদের রাজনীতিকেও বিভ্রান্ত-প্রভাবিত করেছে স্বাভাবিকভাবেই। কারণ, মনিষীরা বলে গেছেন – বিভ্রান্তিই ছোঁয়াচে রোগের মত যা সহজেই ছড়িয়ে পরে; তুলনায় যা ‘জ্ঞানবুদ্ধির’ কথা তা সুস্বাস্থের মত। মানে যা ছোঁয়াচে নয় বলে মানুষের মধ্যে সহজে ছড়ানো যায় না। আর তাতে বর্তমান রাজনৈতিক জ্ঞানগম্যি-তথ্য-পরিস্থিতি বুঝতে সবাই ছুটছে “তেল-গ্যাসের মধ্যে’।

মানুষ মানে কী কেবল অন্ন-বস্ত্র-শিক্ষা-চিকিতসা-বাসস্থান? তাহলে রাজনৈতিকতা কীঃ
কমিউনিস্টেরা আজও – রাজনীতি- এই শব্দের অর্থ আমল করতে চাইলো / পারলো না। মানুষের বৈষয়িক স্বার্থ আর রাজনৈতিক স্বার্থ যে দুটা আলাদা জিনিষ ও আলাদা চাহিদা তা তারা হদিশ জানলো না। মানুষের কেবল তাঁর তনু বা দেহ বাঁচায় রাখলেই, কেবল এতেই সতুষ্ট থাকলেই চলে না। প্রাণ শুধু জৈবিক না – এর স্পিরিচুয়ালিটি বা রাজনৈতিক দিকের মত বহু আরও দিকে এর উন্মেষ দরকার হয়। অথচ এরা মানুষকে কেবল বৈষয়িকতায় সীমাবদ্ধ [reduced] করে রাখতে চায়, এভাবে কল্পনা করতে চায়। অথচ আমাদের শুধু অন্ন-বস্ত্র-শিক্ষা-চিকিতসা-বাসস্থান এসব বৈষয়িক চাহিদার দিক পূরণ হলেও মানুষের একেবারেই চলে না। কারণ, এসব ছাড়াও মানুষ তো অন্তত রাজনৈতিক মানুষ!  বৈষয়িকতা ছাড়িয়েও যে মানুষ আছে তাঁর  আরও যেসব চাহিদা আছে তা কমিউনিস্টেরা কখনও বুঝতে চাইলো না। আর এরই পরিণতি হল একালে; যেমন, তাঁর রাষ্ট্র কী তাকে গুম-খুন-অপহরণ ইত্যাদি করতে পারবে? রাষ্ট্রে জায়েজ আছে, থাকবে? কথিত শ্রেণী শাসনের একনায়কতন্ত্রের রাষ্ট্রে সব কী জায়েজ, এর নামে?  এসব প্রশ্ন, মানুষের ‘রাজনৈতিকতার’ প্রশ্ন – যা কমিউনিস্টেরা আমল করতে জানে না। অধিকার কী, নাগরিক কী – এসব ধারণা তাদের ভোকাবুলারিতেই নাই।  অথচ এদের জবাব  জানা না থাকা, এসব নাগরিক মানুষের ধারণা ও প্রশ্ন সম্ভবত একালে ভাতের প্রশ্নের চেয়েও বেশি জরুরি!

কিন্তু তবু এরা “সরকারের বিকল্প দেখে” না। খুঁজে পায় না। আর  না পেয়ে সেজন্যই কী এরা “তেল-গ্যাসের বৈষয়িকতার মধ্যেই’ কেবল মানুষকে দেখতে চায়। এভাবে খুঁজতেই যেন মানুষকে আবার ঠেলতে শুরু করেছে কিছু বামেরা।
তেল-গ্যাস বা মাটির নিচের সম্পদ নিয়ে কথা উঠলেই দেশের বামপন্থিরা মনে করে এটা তাদের একচেটিয়া এক সাবজেক্ট  আর তাঁরা নিজেকে এর বিষয়ের চ্যাম্পিয়ান মনে করে। আর তাতে তারা ইস্যু্টার অলিগলি বা রাজনীতি জিনিষটা বুঝুক আর নাই বুঝুক। তারা মনে করে তেলের খনির ইস্যু উঠলেই তারা একে এক মুখস্ত শব্দ ‘সাম্রাজ্যবাদ’ বলে গালি দিয়ে দিলেই বা ‘সাম্রাজ্যবাদের ষড়যন্ত্র’ বলে এক অর্থহীন ফতোয়া বিবৃতি দিয়ে দিলেই তারা এই ইস্যুতে চ্যাম্পিয়ান হয়ে যাবে। সব রাজনৈতিক দায় অবস্থান হাজির করে ফেলতে পারবে, আর এতেই তাদের কথিত “রাজনীতি-বোধ”  প্রকাশের কাজ হাসিল হবে? তাই কী?

সরকার আমেরিকান ব্কেযক্তি কোম্পানিকে তেল অনুসন্ধানের কাজ দিয়ে দিলেই কী আপোষঃ
সরকার আমেরিকান কোন কোম্পানিকে  তেল অনুসন্ধানের কাজ দিয়ে দিলেই কী আপোষ, মানে সরকার টিকে যাবে? কথিত কোন ডিল হয়ে যাবে?  দৈনিক যুগান্তরে তেল-গ্যাস অনুসন্ধান মার্কিন কোম্পানি এক্সন মবিল কাজ পাচ্ছে  ধরণের রিপোর্ট ছাপা হবার পর থেকেই বামপন্থিরা এমন অনুমান ও গুজব ছড়িয়েছে। যার মূল কারণ সম্ভবত, তারা মনে করে আমেরিকা রাষ্ট্রের রাজনীতিক স্বার্থ মানে কেবল বৈষয়িক স্বার্থ – কয়েকটা তেলের খনি হস্তান্তর।
প্রথমত, এটা গত পনেরো বছরে লটকে থাকা একটা তেল অনুসন্ধানের কাজ বিতরণের ঘটনা যার কিছুই অন্ত নাই, দেখা যাচ্ছে না। কারণ, এটা “তেল আছেই” এমন জানা কোন ভুখন্ডের কোন অনুসন্ধান নয়। খুব সম্ভবত এর প্রাপ্তির সম্ভাবনা কম বা অনিশ্চিত মানে একটা এমন ঘটনার নুন্যতম নিশ্চয়তা্র প্রাইমারি থ্রেসহোল্ড [Primary Threshold] যদি না থাকে তাতে ঐ কাজে অর্থ ঢালার আগ্রহ কম হবেই, সক্রিয় প্রতিযোগিতায় উতসাহ কমে যায় এটা তেমন।  তাই ব্লক বিতরণ পনেরো বছরে লটকে আছে।  এতে নয়া উতসাহ পেতে এবার কোম্পানি প্রস্তাব করছে যে ১৫টা ব্লক-ই তাকে দিতে হবে। অথবা নয়া উতসাহ দেখা যেতে পারে হয়ত আগামিতে কোন কারণে গ্লোবালি তেল-গ্যাসের দাম আকাশ্চুম্বি হলে, উতসাহ বাড়তে পারে। কিন্তু সেসব যাই হোক না কেন বেশিরভাগ ব্লকে এক্সপ্লোরশনে কিছু পাওয়া না গেলেও গড়ে তা লাভজনক হয়ে যায়। অর্থাৎ উতসাহের অভাব দূর না করতে পারলে কেউ আসতে চাইবে না।
তবে সেসব যাই হোক ঘটনার মূল পয়েন্ট সেটা না। বরং ধরা যাক, এখানে তেল-গ্যাস পাওয়া একেবারে নিশ্চিত সেক্ষেত্রে কে “লাভবান” হবে? আমেরিকা রাষ্ট্রের রাজনৈতিক স্বার্থ নাকি এক্সন মবিল? যদি ধরে নেই ‘লাভবান” বলতে রাজনৈতিক স্বার্থ  বলে কিছু নাই সবটাই বৈষয়িক স্বার্থ তাহলে আমেরিকান রাষ্ট্রস্বার্থ এখানে কোন খাতক নয়। মূল সম্ভাব্য খাতক এক্সন মবিল [Exxon Mobil Corporation] কোম্পানি একা আর এর উচ্ছিষ্ট কুড়াবে বাইডেন প্রশাসনের কেউ কেউ বড় জোর। সোজা কথা আমেরিকান রাষ্ট্রস্বার্থ এতে কোন  লাভালাভ পাবে না।
এর মানে হল – আমেরিকান রাষ্ট্রস্বার্থ কী – এটা যারা বুঝতেই পারে না, এটা হল সেই কমিউনিস্টদের বয়ান! অর্থাৎ ঐ ১৫টা ব্লকে যদি তেল উপচিয়ে পড়া নিশ্চিত ব্লকও হয় তবু আমেরিকা-হাসিনা সরকারের এখন এথেকে  সমঝোতার সংকট তা কাটার কোন সম্ভাবনা নাই।  অথচ এই শতকের শুরু থেকেই আমেরিকার প্রধান সংকট গ্লোবাল পালাবদলে চীনের সাথে প্রতিযোগিতার নিজের আগের গ্লোবাল নেতৃত্ব ও প্রভাব আগের মতই পক্ষে ধরে রাখা। আরো সুনির্দিষ্ট করে বললে, ২০১৫ সালে ওবামা আমল থেকে এশিয়ায় চীনকে হারানো ও প্রভাব বাড়াতে না দেওয়া ইত্যাদি করতে যতগুলো কর্মসুচি আমেরিকা নিয়েছে তার কোনটাই ফলাফল আনে নাই। সাউথ চায়না সি – কে কেন্দ্র করে মালাক্কা প্রণালি বাধা তৈরির সম্ভাবনা থেকে শুরু করে কোয়াড আর সর্বশেষ ইন্দোপ্যাসিফিক স্ট্রাটেজি ইত্যাদি  কোনটাই আমেরিকাকে জুতমত চীনের উপরে কোন মাইলেজ দেয় নাই। সব উদ্যোগই ফেল করেছে বা করছে ক্রমশ। মূলত আশিয়ান দেশগুলোর [ASEAN] অনাগ্রহের জন্যই, তা বিশাল ফ্যাক্টর হয়ে থাকছে! আমেরিকান নীতিনির্ধারক ও থিঙ্কট্যাংকগুলো আশিয়ান দেশগুলোর স্বার্থ বা আগ্রহকে ছুতেই পারে নাই। তারা কেবল নিজ-রাষ্ট্রস্বার্থের দিক থেকে লাভালাভ আশিয়ান সদস্যেদের উপর চাপিয়ে দিতে চেয়েছে। তাই  কোনভাবেই আমেরিকা তাদের হিলাতে পা্ররে নাই, পারার সম্ভাবনাও নাই।  ওতএব নয়া উদ্যোগে আমেরিকার জন্য নয়া কর্মসুচি হল বার্মা দখল বা রেজিম চেঞ্জ; আর এতে এবার যদি আমেরিকার কোন ভাগ্য খুলে…! এগুলোই হল আমেরিকা রাষ্ট্রের রাজনৈতিক স্বার্থ বা রাষ্ট্রস্বার্থ।  এখন কমিউনিস্টেরা যদি  দশ-পনেরোটা তেল-গ্যাসের উপচে পড়া খনি পাবার স্বার্থ দিয়ে আমাদেরকে ইস্যুটা ব্যাখ্যা করতে চায় বা বুঝতে বলে তাহলে আমরা কী বুঝব? এরা কী কোন রাজনৈতিক দল, কমিউনিস্ট ? এসব পেটি মধ্যবিত্ত, এরা কারা?
যারা গ্লোবাল নেতৃত্বে –  প্রতিযোগিতা ও স্বার্থ-সংঘাত দিকটা আমল করার যোগ্যই নয় – বড় জোর তেলের খনি আর সবকিছুকেই বস্তুস্বার্থ দিয়ে বুঝে তাই সবকিছু তেলগ্যাসের বুঝ দিয়েই বুঁদ হয়ে থাকে তবে এদের লইয়া আমরা কী করিব!!

সিপিবির এক ফাঁকা বিবৃতিঃ
সিপিবির বিবৃতির এক উল্লেখযোগ্য প্যারাগ্রাফ হল –

বিবৃতিতে বলা হয়, ‘মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের’ এশিয়াভিত্তিক সামরিক অভিলাষ বাস্তবায়নের অংশ হিসেবে ইন্দো–প্যাসিফিক কৌশলগত প্রকল্প বাস্তবায়নের জন্য চট্টগ্রামের মাতারবাড়ীতে জাপান যে গভীর সমুদ্রবন্দর তৈরি করেছিল, সেটি ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্যের সঙ্গে সংযুক্ত করা এবং এর সহায়ক হিসেবে যুক্তরাষ্ট্রের দীর্ঘদিনের ইচ্ছানুযায়ী বাংলাদেশে একটি মার্কিন নৌঘাঁটি স্থাপন ইত্যাদি বিষয় জাপান সফরকালে আলোচিত হবে বলে বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে। এটি হলে তা হবে বাংলাদেশের জাতীয় নিরাপত্তা ও সার্বভৌমত্বের জন্য বিরাট হুমকিস্বরূপ। এ ধরনের চুক্তি বা সমঝোতা হবে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার পরিপন্থী।

প্রথমত এটা আমেরিকার নেহায়েতই কোন “সামরিক অভিলাষ” -মাত্র নয়।  ঠিক যেমনটা আমরা কোল্ড-ওয়ারের (১৯৫৩-৯১) আমলে সোভিয়েত-আমেরিকান ঝগড়ায় আমরা সবকিছুকেই ‘সামরিক’  বলে বয়ান করতে সোভিয়েত  বয়ানের মধ্যে দেখতাম। এছাড়া এমনকি সত্তর-আশির দশকের বয়ান দিয়েও বিশেষত,  কোল্ড-ওয়ারের চিন্তা ফ্রেমে একালে কিছুই ব্যাখ্যা বর্ণনা করা যাবে না। নিজেকে বোকা প্রমাণ করা ছাড়া ওতে আর কোন লাভ হবে না।
দুই. ইন্দো-প্যাসিফিক স্ট্রাটেজি এটা কোন আমেরিকান প্রকল্পই নয়। বড়জোর একটা কনসেপ্ট মাত্র। আর তা হল,  চীন নাকি কোন আন্তর্জাতিক রুল, নিয়ম-কনভেনশন মানে না, রুল বেজড নয়। বিশেষ করে আড়ালে বলতে চায় চীন নাকি  জাতিসংঘের [UNCLOS – The United Nations Convention on the Law of the Sea] মানে, সমুদ্রসীমা নিয়ে রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে আরবিট্রেশন (যা ঠিক বিচার নয় তবে সালিশীর মত জাতিসংঘের অধীনে এক  মিটমাট ব্যবস্হা) মানে না। এই অজুহাতে চীনকে একঘরে করে আমেরিকা – ভায়েরা আসেন একটা কনসেপ্ট তৈরি করি যার যার কনসেপ্ট অবস্থান বলি বললে যেমনটা হত – এটাই আমেরিকার ইন্দো-প্যাসিফিক স্ট্রাটেজি বাতচিত।  এই লক্ষ্যে, সবদেশের একেকটা স্ট্রাটেজি প্রকাশিত হোক এটাই আমেরিকার ইচ্ছা। আর এর বিরুদ্ধে চীনা রাষ্ট্রদুতের অভিযোগ ওরা সুনিদির্ষ্ট করে একটা দেশকে (মানে চীন)  বাদ দিয়ে একটা কোন ইন্টারন্যাশনাল জোট কনভেনশন করতে পারেন না। তবে মূলকথাটা বা বটম অব দা ফ্যাক্টস হল, চীন কখনও এপর্যন্ত সে – জাতিসংঘ মানে না বা UNCLOS মানে না বা আইনের শাসন মানবে না ইত্যাদি বলে কোন বিবৃতি বা ধারণা দেয় নাই। ফলে এমন অভিযোগ গ্লোবাল নেতৃত্ব নিয়ে অ্যামেরিকান একটা চীনবিরোধী ক্যাম্পেইন মাত্র। যদিও একথা ঠিক, সাউথ চায়না সি (যেটা চীন থেকে সমুদ্র পথে বের হলেই যে নৌ-অঞ্চল)  -তে চীন তার প্রায় সকল পড়শির সাথেই সমুদ্রসীমা বিতর্কে আছে।
তিন. মাতারবাড়ি জাপান যে গভীর সমুদ্রবন্দর এর সাথে “ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্যের সঙ্গে সংযুক্ত” -এসবকথা কোথায় পেল সিপিবি? হঠাত এনিয়ে মাঠে উদিত হল কোথা থেকে – এই কমিউনিস্টেরা ভারতের উত্তর পুর্বাঞ্চল রক্ষার দায়ীত্ব কাধে নিল কেন?  মাতারবাড়ি মূলত কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ প্রকল্পের (যা মাতারবাড়ি প্রকল্পের আরেক অংশ) জন্য বড় বাল্ক জাহাজে করে কয়লা (ছোট লাইটার জাহাজ না) সরাসরি বিদ্যুৎ প্রকল্প পর্যন্ত প্রবেশ সহজ করতে পারার এমন উপযোগী করে নির্মিতব্য এক গভীর সমুদ্রবন্দর। আর এতে আমেরিকার নৌঘাঁটি করার খায়েস এর পথে তা সাহায্য হতে পারে তাই এটা জাপানকে সামনে রেখে ২০১০ সালে বাংলাদেশ সরকার তা করার অনুমতি দেয়া হয়েছিল। আর এসবের বিপরীতে বাংলাদেশের জন্য মূল বা বাণিজ্যিক গভীর সমুদ্রবন্দর করার স্টাডি-পরিকল্পনা করা হয়েছিল পাশে মহেশখালির সোনাদিয়াতে। যেটা চীন (কুনমিং), বাংলাদেশ ও বার্মায় পণ্য আনা-নেওয়া জন্য ব্যবহার করা যায় – সাথে আর চাইলে ভারতও তা ব্যবহার করতে পারবে;  এতে তাহলে এর নির্মাণ খরচ সহজেই বাণিজ্যিকভাবে পরিচালনা করে উঠে আসবে।  কিন্তু ভারতের আপত্তি ও ফুসলানিতে এই প্রকল্পই ২০১৫ সাল থেকেই বাগড়া, শেষে সরকার বাদ দিয়ে দেয়। আর আজকে পট উলটে যাওয়ায় সিপিবি  ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্য রক্ষার গল্প ও কান্নাকাটি নিয়ে এসেছে! এটাই ভাগ্যের পরিহাস! কিন্তু এখন কেন?  ভারতের পিঠে আমেরিকার হাত থাকাতেই এতদিন ভারত-আমেরিকান স্ট্রাটেজিক বন্ধু  এই গর্বে মাটিতে পা না পড়া ভারত এতেই কী বাংলাদেশকে করদ রাজ্যের মত ব্যবহার করে আসে নাই???  তখন সিপিবি ও বামেরা কারদিকে কোথায় ছিল??? কোন সাম্রাজ্যবাদের পক্ষে ছিল???
চার. বাংলাদেশ সরকার শেষ পর্যন্ত তার “ইন্দো-প্যাসিফিক স্ট্রাটেজি” পাবলিক করেছে। এনিয়ে বিবিসির রিপোর্টের শিরোনাম হল – “ইন্দো-প্যাসিফিক রূপরেখা: চীন-মার্কিন দ্বন্দ্বে ভারসাম্যের নীতি নিয়েছে বাংলাদেশ”। মানে হাসিনার বাংলাদেশ চীন-মার্কিন দ্বন্দ্বে কোন পক্ষ নিবে না, বরং ভারসাম্যের নীতি বজায় রাখবে – যেকোন কারণেই হোক এটা সঠিক পদক্ষেপ। এটা ২০২০ সালে বা তারও আগে থেকেই হাসিনার একই অবস্থান – মানে এটাই হাসিনার নিজেকে ক্ষমতায় রাখার দিক থেকেও বরং উপযুক্ত বলে তাঁর নিজস্বার্থ ও  বিবেচিত। আর তা তিনি বজায় রেখেছেন। তাহলে হাসিনার এই চলতি ত্রিদেশীয় সফরে আমেরিকান সাথে আতাঁত আপোষ হয়ে যাচ্ছে বলে ভয় দেখানোর সুযোগ কই???
অতএব,  হাসিনার এই ত্রিদেশীয় সফর নিয়ে আমরা বড়জোর বলতে পারি এটা হাসিনার শেষ চেষ্টা কোন “ওয়ার্কেবল রিলেশন” বের করার তবে সেটাও যদি লাইগা যায় ধরণের, তবে তুকতাকে বিশ্বাসের। তুকতাক বললাম এজন্য যে মানুষ সব হারালে তুকতাকে বিশ্বাস করতে চায়। মানে, মনে হয় না হাসিনা লজিক্যালি এমন কোন সম্ভাবনা দ্যাখেন।
সারকথায় তাহলে, সিপিবির তরুণ নেতাদের নতুন করে পড়াশুনা করতে হবে। পুরানা সত্তর-আশির দশকের ভাবনা একেবারেই অচল, মুখস্থ কথা অচল হয়ে গেছে। কমিউনিস্ট চিন্তা একালে ঢেলে সাজাতেই হবে – মার্কস যাকে নিরন্তর পর্যালোচনা বা নিজেকেই ক্রিটিক [Critique] করতে বলতেন। রিভিউ [Review] বা ঢেলে সাজানো এটাই। এই মুরোদ ছাড়া সব পন্ডশ্রম, সময় নষ্ট – এই পথেই যাচ্ছে কমিউনিজম, যাবেই!

 

কমিউনিস্টদের সাম্রাজ্যবাদঃ
সিপিবি’র বিবৃতির একটা বাক্য হল এরকম, “সিপিবি মনে করে, শুধু ক্ষমতায় টিকে থাকতে ‘সাম্রাজ্যবাদী শক্তির’ কাছে দেশের সার্বভৌমত্ব ও নিরাপত্তা বিকিয়ে দেওয়ার চেষ্টা কখনো শুভ হবে না” ।
এখন একথার মানে কী?  তাহলে বাংলাদেশে গত পনেরো বছরে কী হয়েছে? এসময়ে “ক্ষমতায় টিকে থাকতে ‘সাম্রাজ্যবাদী শক্তির’ কাছে দেশের সার্বভৌমত্ব ও নিরাপত্তা বিকিয়ে দেয়া” – বলতে কিছুই ঘটে নাই? এটাই কী সিপিবি মনে করছে? তাহলে এতদিনে হাসিনার বিকল্প নাই কথা এখন ফেলে ত্যাগ করে সরকারের সমালোচনায় আসার ভাব দেখানোর দরকার কী?
‘সাম্রাজ্যবাদ’ শব্দটা কমিউনিস্ট ভোকাবুলারিতে গুরুত্বপুর্ণ হয়ে চালু হয়েছিল কমিউনিস্টদের এক গুরু-নেতা লেনিন এর ১৯১৬ সালে লেখা বা প্রকাশিত ‘সাম্রাজ্যবাদ’ নামের বই থেকে। আর ওর পরের বছরই ১৯১৭ সালে রাশিয়ায় রুশবিপ্লব বা দুনিয়ায় প্রথম এক কমিউনিস্ট বিপ্লব সংঘঠিত হয়েছিল। যেটা পরে  ১৯২২ সালের পর থেকে – সোভিয়েত ইউনিয়নএই নয়া নামে ১৫টা আলাদা মোটা জাত-ভুখন্ডের এক সমাহার রাষ্ট্র হিশাবে তা পুণর্গঠিত হয়েছিল। এভাবে সোভিয়েত ইউনিয়ন গড়তে গিয়ে তা ১৯৫০ এর দশক পর্যন্ত তাতে নয়া দেশ যুক্ত করা তখনও চালু ছিল। সবচেয়ে বড় কথা কবে থেকে কমিউনিস্টেরা আমেরিকাকে ‘সাম্রাজ্যবাদ’ বলে ট্যাগিং বা নাম দেওয়া বা নিচা দেখানি শুরু হয়েছিল এর হদিস খুব কম কমিউনিস্ট দিতে পারবে। তাদের বেশির ভাগেরই এনিয়ে ধারণাটা আবছা, তবে তারা সারকথায় বলবে হয়ত কমিউনিজমের জন্ম থেকে আমেরিকাকে “সাম্রাজ্যবা্দী” বলে কমিউনিস্টেরা ডাকে, যা একেবারেই ভুল। ফ্যাক্টস হল লেনিন সাম্রাজ্যবাদ নামে নয়া ধারণা আনতে বই লিখলেও ঐ বইয়ের ভিতরে অন্তত আমেরিকাকে সাম্রাজ্যবাদ বলা হয় নাই। বরং ওখানে প্রসঙ্গ ছিল সেকালের জর্মানি। লেনিন ১৯১৭ অক্টোবরের রুশবিপ্লবের পরে বেঁচেছিলেন মাত্র আরো প্রায় ছয় বছর, ১৯২৪ সালের জানুয়ারি পর্যন্ত। আর ওদিকে আমেরিকা ১৯৪৫ সালে মানে বিশ্বযুদ্ধের সমাপ্তির আগে গোনায় ধরার মত কেউ কিছু ছিল না, মানে গ্লোবাল নেতা বলেও কিছু ছিল না। যখন সারা দুনিয়া ছিল কেবল ইউরোপ-কেন্দ্রিক কলোনি দখলদারদের হাতে বা নেতৃত্বে। কাজেই সোভিয়েত ইউনিয়ন আর আমেরিকার মধ্যে কোন বিশেষ বিরোধ-সংঘাত বা শত্রুতা কিছুই ছিল না।

তাহলে সোভিয়েত ইউনিয়ন আমেরিকাকে সাম্রাজ্যবাদি দেশ বলা শুরু করেছিল কবে থেকে? স্বভাবতই সেটা ১৯৪৫ সালের পরের পঞ্চাশের দশকে। আরো সুনির্দিষ্ট করে বললে, ১৯৫৩ সাল থেকে জব্বর ভাবে। ওদিকে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের কালে স্তালিন তো প্রেসিডেন্ট রুজভেন্টের ঘনিষ্ট বন্ধু, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের অ্যামেরিকান নেতা রুজভেল্টের ডানে-বায়ে থাকা আরো দুই ঘনিষ্ট দেশবন্ধুর একজন ছিলেন খোদ স্তালিন, আর তাতে অপরজন ছিলেন  বৃটিশ প্রধানমন্ত্রী চার্চিল। এই তিন নেতা ১৯৪২ সালের পর থেকে একসাথেই বিভিন্ন দেশ নানান ইস্যুতে নেতৃত্ব দিতে ভ্রমণ করতেন। পরে ১৯৪৫ সালে রুজভেল্ট এর হঠাত স্বাভাবিক মৃত্যু হলে পরে প্রেসিডেন্ট হ্যারি ট্রুম্যান যিনি রুজভেল্টের ভাইস-প্রেসিডেন্ট ছিলেন ও একই নীতি অনুসরণ করতেন। ফলে তাঁর সাথে স্তালিনের সম্পর্কও প্রায় একই ছিল – সো নো সাম্রাজ্যবাদ ট্যাগিং!
পরের রিপাবলিকান আমেরিকার প্রেসিডেন্ট আইসেনহাওয়ার ১৯৫৩ সালের জানুয়ারিতে শপথ নিলে সোভিয়েতের সাথে আমেরিকান সম্পর্ক একেবারেই বদলে এনিমি হয়ে যায় যা যাওয়াই স্বাভাবিক ছিল। যেমন, সিআইএ দল পাঠিয়ে আইসেনহাওয়ার এর ইরানের সরকার বা রেজিম চেঞ্জ, যেটা ইরানে মোসাদ্দেক সরকারকে  উপড়ে ফেলা ও তেলের খনির দখল নেয়া এমনকি আবার ওদিকে, চীনের তিব্বতে নেহেরুর ভারতের সাহায্যে ভারতে সিআইএ ঘাটি করে একই কাজ করা এর আরেক উদাহরণ। এখান থেকেই দালাইলামাদের তিব্বত ত্যাগ, ভারতে আশ্রয় আর পরিণতিতে শাস্তি হিশাবে চীন কয়েকদিনের জন্য সারা আসাম দখলে রেখে দেয়া ঘটিয়েছিল যা ১৯৬২ সালের চীন-ভারত যুদ্ধ বলে বাইরে থেকে বিবেচিত।  ভারত-চীনের সম্পর্ক তিতা সেই থেকে আর যা এনিমি হয়ে যায়।

অন্যদিকে মনে রাখতে হবে লেনিনের সাম্রাজ্যবাদ ধারণা ও প্রসঙ্গ এর সাথে ১৯৫৩ সালের সোভিয়েত ইউনিয়নের আমেরিকাকে ট্যাগ লাগানো সাম্রাজ্যবাদ ধারণা – এদুটো ঠিক একই নয়।  মনে রাখতে হবে,  এমনিতেই রাষ্ট্র মাত্রই তা এক একান্ত স্বার্থ। এবং যা বাকি সব রাষ্ট্রের স্বার্থের চেয়ে আলাদা ও অপর [Other] গণ্য করা; এবং সবকিছুর উর্ধের নিজস্বার্থ – এক স্বার্থপর স্বার্থ। এবং এমন এক একান্ত স্বার্থ এটা যে অন্য কোন অপর রাষ্ট্রকে নিজ স্বার্থে অবলীলায় ব্যবহার করে ফেলতে পারে।  তাহলে সোভিয়েত ইউনিয়ন যতই কমিউনিস্ট রাষ্ট্র হোক না কেন অন্যান্য কমিউনিস্ট রাষ্ট্র বা বিভিন্ন দেশের কমিউনিস্ট পার্টি  যতই সোভিয়েত ইউনিয়নের সাথে নিজেদের আদর্শগত মিল আর হরিহরাত্মা এক দেহ-বোধ দেখাক না কেন, সোভিয়েত ইউনিয়নের নিজ একান্ত রাষ্ট্রস্বার্থের প্রশ্নে সে সবকিছুর উর্ধে এক নিরঙ্কুশ আত্মস্বার্থ দিয়েই পরিচালিত স্বার্থ। কাজেই আইসেনহাওয়ারের আমল থেকে আমেরিকা-সোভিয়েতের যে বৈরিতা তাতে সোভিয়েত ইউনিয়ন নিজের সেই একান্ত চোখেই দুনিয়ার সকল কমিউনিস্ট দেশ ও পার্টি আমেরিকাকে দেখুক সেটাই হবে সোভিয়েত ইউনিয়নের পররাষ্ট্রনীতি। আর এই পররাষ্ট্রনীতি,  আবার এর ভিতরে যদি আরেক কমিউনিষ্ট রাষ্ট্র তার নিজস্বার্থের বেলায় তারও একান্ত স্বার্থ বের করে তাহলে?? তাতে অন্তত আমারও একান্ত স্বার্থ বইলা সেটা সোভিয়েত ইউনিয়ন থেকে একটু আলাদা তো হতেই পারে। কিন্তু সেই ভিন্নতা কী সোভিয়েত ইউনিয়নের পররাষ্ট্রনীতি এলাও করবে বা শ্বাস নিতে দিবে???  তাই একই কমিউনিস্ট আদর্শের হওয়া সত্বেও দুই কমিউনিস্ট রাষ্ট্রস্বার্থের ভিন্নতার বিরোধ কমিউনিজমে কখনও রিসলভড বা সমাধা করা হয় নাই বা যায় নাই। মূল কারণ, দুই রাষ্ট্রের আদর্শ একই – এর মানে তাদের রাষ্টস্বার্থও এক  – এই অনুমান ভিত্তিহীন। মূলত দুই রাষ্ট্রস্বার্থ কখনও এক হতেই পারে না। এমন হওয়া মানে তারা তো এক-রাষ্ট্র হয়ে যেত!!!  তাই সাম্রাজ্যবাদ ট্যাগ কতটা কমিউনিস্ট  আদর্শগত ধারণা আর কতটা সোভিয়েত রাষ্ট্রস্বার্থের একান্ত পররাষ্ট্র নীতি তা ভেদজ্ঞানে আলাদা করতে জানতে হবে। একারণে ১৯৫৮ সালের মাওয়ের  চীনা সাংস্কৃতিক বিপ্লব এই নয়া ধারা  ডাকার কারণে পরে চীনও সোভিয়েত হামলার ভয়ে উলটা সোভিয়েত ইউনিয়নকে  সামাজিক সাম্রাজ্যবাদ বলে ট্যাগ দিয়েছিল; যেটা পরে ১৯৯২ সালে  সোভিয়েত ইউনিয়ন রাষ্ট্র ভেঙ্গে যায় বলে এই ট্যাগিংয়ের সমাপ্তি ঘটে আর দরকার থাকে নাই।

তাহলে একালে কে সাম্রাজ্যবাদ?
কাকে কে, কেন সাম্রাজ্যবাদ বলবে সে ব্যাপারটা  নতুন করে পরিস্কার ঝালাই করে নিবার সময় এটা। যেমন ধরেন আজকের গ্লোবাল নেতা হয়ে উঠতে শুরু করা চীন-কে সিপিবি বা কোন কমিউনিস্ট পার্টি কী আমেরিকাকে সাম্রাজ্যবাদ ট্যাগে ডাকার মত চীনকেও সাম্রাজ্যবাদ বলে ডাকবে? কেন ডাকবে আর কেন ডাকবে না এর ব্যাখ্যা-বুঝ একালের বাংলাদেশের কমিউনিস্টদের লাগবে। নয়া পক্ষে বা বিপক্ষে যে যেদিকেই থাক সে সাফাই লাগবে। কোল্ডওয়ার আমলের বুঝ ব্যাখ্যা ও বাস্তবতার রিভিউ ঢেলের সাজানো আগে করে নিতে হবে। এই বুঝাবুঝির আবার যোগ্য হতে হবে।  সত্তর-আশির দশকের মুখস্ত ধারণা দিয়ে চলবে না। সোভিয়েত ভেঙ্গে গড়া ১৫ দেশই এখন আইএমএফের সদস্য, বলা ভাল যে দুনিয়ায় কে এখন আর আইএমএফের সদস্য নয় তাই এখন খুঁজে পাওয়া যাবে না। আবার আনরিয়েলিস্টিক [অবাস্তব] ও আইডিয়েল [আদর্শগত] ধারণা আঁকড়ে কথা বলার মানে হবে না। তাহলে আইএমএফ প্রতিষ্ঠানটা বুঝতে হবে আগে, বুঝাবুঝিতে ভুল কী ছিল  এর জানাবুঝা শুরু করতে হবে সেখান থেকে।   ১৯৪৪ সালে আইএমএফ-বিশ্বব্যাংক প্রতিষ্ঠানটা জন্ম নেওয়ার সম্মেলনে তখন জীবিত স্তালিন; তিনি সেই জন্মসভায় সোভিয়েত প্রতিনিধিও পাঠিয়েছিলেন। যদিও পরে যখন চাঁদা পরিশোধ করে আইএমএফের সদস্যপদ নিবার কথা তখন যোগাযোগ ত্যাগ করে সোভিয়েত ইউনিয়ন। কিন্তু ঠিক কী কারণে? স্তালিনের বুঝ কী ছিল তা নিয়ে কোথাও তিনি কিছুই লেখেন নাই।  আজকের আধা-বুঝের কমিউনিস্টেরা অবশ্য মনে করেন তারা এই প্রতিষ্ঠানটা বুঝেন? যেন তারা স্টাডি করেছেন? অথচ তারা বলতেই পারবেন না যে কী ধরণের প্রতিষ্ঠান এটা, ম্যান্ডেট কী? যেমন তারা কী বলতে পারবেন – বাংলাদেশ যদি আইএমএফ-বিশ্বব্যাংক এর সদস্যপদ ত্যাগ করে তাহলে বাংলাদেশের  লাভ বা ক্ষতি কী কী হবে? বাংলাদেশ বা যেকোন দেশ আইএমএফ এর সদস্য না হয়ে অর্থনীতিতে টিকে থাকতে পারবে কিনা, এনিয়ে কমিউনিস্টদের বক্তব্য কী??
ক্যাপিটালিজমকে কমিউনিস্টরা যদি পাপ মনে করে সেক্ষেত্রে এটা তো এক এথিক্যাল বিবেচনা মাত্র – সে বোধ কী  কমিউনিস্টদের আছে – যদিও তাদের এই বিচারে বাংলাদেশের বা সেই অর্থে দুনিয়ার সব মানুষই পাপী। এমনকি যেসব অর্থনীতির শিক্ষক ও কমিউনিস্ট  বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকেরা তারাও সমান পাপী। কারণ তারাও ক্যাপিটালিজমের বাংলাদেশ সরকার ও সমাজের থেকে বেতন নিচ্ছেন – তাদের  ভাত গলার নিচে যাওয়া এমন প্রতিটা ভাত – এর সবই ক্যাপিটালিজম পাপের ভাত। তাহলে পাপের বাইরে কে?

“জনগণের শতভাগ মালিকানা নিশ্চিত করলেই” এসব পাপের মুক্তি ঘটবে – এই অনুমানও এক স্বপ্ন-কল্পনা। কারণ এগুলাও আর বাস্তবে রিয়েলিজমে নাই।

 

আরেক বিপদ কমিউনিস্টদের সার্বভৌমত্ব ধারণাঃ
সবশেষের এক প্রসঙ্গ; বাংলাদেশে আরেক  বয়ান তৈরি করছেন  সিপিডি [CPD] এই প্রতিষ্ঠানের ডিস্টিঙ্গুইশুড ফেলো ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্যযা খুবই বিপদজনক ও এথিক্সের ভয় সৃষ্টিমূলক।
সার্বভৌমত্ব বা সভরেনিটি [Sovereignty] নিয়ে এথিক্যাল বুঝকে রাজনীতি বানিয়েছে কমিউনিস্টেরা। আমাদের মত রাষ্ট্রগুলো কলোনিদখল মুক্ত স্বাধীন ফলে সার্বভৌম হয়ে গেল কেমনে আর তা থেকে একটা গ্লোবাল পলিটিক্যাল অর্ডার বা জাতিসংঘ দুনিয়াতে কোথা থেকে হাজির হল যারা এর কিছুই জানে না – এরাই আবার কিছু হলেই দেশের সার্বভৌমত্বের বুঝ হাজির করবে। যেমন দাবি করবে বাংলাদেশে সার্বভৌম তাই বাংলাদেশ নিজ ইচ্ছায় এটা সেটা কত কী করতে পারে। মনে মনে ভাব নিবে প্রবোদ দিবে যে এসব প্রশ্ন তোলা বুদ্ধিমানেরা যেন আমেরিকাকে কত্তবড়ই না বিপদে ফেলতে পারছে!
না ভাই সরি, আপনারা পারেন নাই। আসলে বাংলাদেশের মত দেশগুলো কী করে কী অর্থে সভরেন তা আপনি আজও জানেন না। মানে কী? মানে হল, এটা আমেরিকারই অবদান যে সে দুনিয়ার কোন রাষ্ট্রের অন্যদেশকে কলোনিদখল করে রাখা এই কাজটা অন্যায়, অবৈধ বলে – এই ভিত্তিতে এক জাতিসংঘ বানিয়েছিল – এটা অ্যামেরিকান আইডিয়া ও তাদের একক অবদান। এতে আমাদের মত দেশগুলো তাই ১৯৪৫ সালের পর থেকে কলোনিদখল মুক্ত স্বাধীন ও জাতিসংঘের সদস্যদেশ হয়েছে; তাই এই অর্থে সে সভরেনও। কলোনিদখল হারাম কাজ –  এটাই দুনিয়াতে প্রথম এক গ্লোবাল অর্ডার তৈরি করেছিল, আর তারই রায় এটা। যদিও এর আর অনেক কিছুই এখনও পূরণ হয় নাই, খামতিতে আছে অনেক; কথা সত্য কিন্তু দয়া করে এই অর্জন টুকুকে তুচ্ছজ্ঞান করেন না।  কারণ, সার্বভৌমত্ব এটা আসলে কী ও কতটুকু হয়েছে তা নিয়ে কমিউনিস্টেরা এখনও বেখবর।

এখন আরো একটা কথা মনোযোগে শুনেন।
এরপরেও যে  সার্বভৌমত্ব বা সভরেনিটির ধারণা যা তবুও আপনি শুনে ফেলেছেন তা কোথা থেকে  এলো বাংলাদেশ সভরেন দেশ বলে বিবেচিত হল তা না জানা সত্বেও –  একথা সত্য যে এই সার্বভৌম ধারণাটা আসলে এক আইডিয়াল [IDEAL] ধারণা। মানে তা রিয়েল [REAL] বা বাস্তবে দেখানো যাবে, এমন সত্য করে দেখানো যাবে – এমন ধারণা নয়।এটাই আইডিয়েল ধারণা। আর আইডিয়েল বলতে বুঝতে হবে – হওয়া উচিত – ধরণের ধারণা যেটা কাগজে বা খাতায় থাকা ধারণা মাত্র। সেকালে জন্ম নেয়া গ্লোবাল পলিটিক্যাল অর্ডারটা অতটুকুই আপনাকে দিতে পেরেছে। এখন আপনি কতটুকু বাস্তবে সভরেন সেটা তো আপনার রাষ্ট্রকে  -হয়ে উঠে  মানে, মুরোদ অর্জন করে দেখিয়ে দিতে হবে।  অর্থাৎ আপনার রাষ্ট্রকে রিয়েলি [really] -ই সত্য করে দেখাতে হবে যে এটা সার্বভৌম। চীন বা ভারত যেমন আজকাল – রাশিয়াল তেল বুক ফুলিয়ে আমদানি করে দেখাচ্ছে, আমেরিকাকে অবজ্ঞা করছে। আমরা অবশ্যই তা পারি না। এমনকি  রুপপুরের রাশিয়ান প্রকল্পের পেমেন্ট রাশিয়াকে বাংলাদেশ ইউয়ানে শোধ করতে পারব কিনা তা নিয়েও আমেরিকারআপত্তি শোনা যাচ্ছে। এসব শুনতে বা আমাদের রাষ্ট্রকে আমল করতে হচ্ছেই। মানে হল রিয়েল সার্বভৌমত্ব বা মুরোদ দেখানোর মত সভরেনিটি হতে পারি নাই। কারণ, এটাও না-বুঝার কারণ নাই যে এসব জায়গায় – আমরা সভরেন দেশ – বলে বোকার মত বীরত্ব দেখাতে যাওয়ার মানে হয় না, অবশ্যই!

কিন্তু দেবব্রত ভট্টাচার্য বিজ্ঞের মত বলেছেন,  “আইএমএফ ঋণ নেওয়ার মাধ্যমে আমরা অন্তত কিছু নীতি সার্বভৌমত্বের ক্ষেত্রে আত্মসমর্পণ করেছি। আমরা তাদের শর্তাবলি মেনে নিয়েছি”। আচ্ছা কারও ঋণ শর্ত মেনে নিয়ে ঋণ নিলেই তাহলে আমাদের সার্বভৌত্ব চলে যাবে, ঢিলা হয়ে যায়। তাহলে মানুষের ব্যক্তি বা ব্যবসার জন্য ব্যাংক ঋণ নিলেই ইজ্জতের মত আমাদের সার্বভৌমত্ব চলে যাবে! কেন?  আইএমএফ এর ঋণ নিলে সার্বভৌমত্ব চলে যাবে কেন?   আইএমএফ কী তাহলে কোন পাপী সংগঠন।  দেবব্রত কী জানেন খোদ আমেরিকান রাষ্ট্র মানে যেটাকে আমেরিকা রাষ্ট্রের নেয়া  সভরেন লোন বলে, সেটা ৩১.৪ ট্রিলিয়ন ডলার ছাড়িয়েছে [দেখুন, On December 16, 2021, lawmakers raised the debt limit by $2.5 trillion to a total of $31.4 trillion.1 ] ; এবছর আরো ঋণসীমা বাড়ায়ে  নিতে হবে? আবার ওদিকে জাপান নিজ রাষ্ট্রের সভরেণ লোন (দেশি-বিদেশি বাজার থেকে খোদ রাষ্ট্রের  নেয়া ঋণ এটাই সভরেন ঋণ)  হল তা ইতোমধ্যেই ঐদেশের বাৎসরিক জিডিপির ২০০% এর বেশি?  তাহলে এদুই দেশের সভরেনিটিও কী নাই ধরতে হবে?? আর যারা ঋণ দিয়েছে তারা আমেরিকা বা জাপানকে কী বিনাশর্তে এসব লোন দিয়েছে? তাই কী? দেবব্রত ভট্টাচার্য কী বলেন!!

আবার,  আচ্ছা দেখেন; আইএমএফ কী  হাসিনার বাংলাদেশকে বাধ্য করেছিল যথেচ্ছারে রিজার্ভ খরচ করতে, ইচ্ছাকৃত খেলাপি ঋণ এর দেশ হতে, ডলারে সম্পদ পাচার করতে – রিজার্ভ ভেঙ্গে সঙ্কটে পড়তে? এমনকি শেষে আইএমএফের কাছে ঋণ চাইতেও কী আইএমএফ আমাদের সরকারকে বাধ্য করেছিল? এমন তো কোন সরকারি বা খাতক ভাষ্য জানা যায় না। তাহলে রিজার্ভ খুইয়ে আইএমএফের কাছে ঋণ চাইতে গেলে সেটা আইএমএফেরই দায় ও দোষ জ্ঞান করে কমিউনিস্টেরা কেন?  নিজেই দেশকে বিপদে ফেলে এরপরে নিজেই আইএমএফের কাছে আমাদের শাসকেরা যায় কেন, এমন তো কোন বাধ্যবাধকতা নাই! কিন্তু কমিউনিস্টেরা এমন প্রপাগান্ডায় বিশাল জ্ঞানী সাজতে চায় কেন???
সাধারণ ফেনোমেনা হল, যেখান থেকেই কোন লোন নেন না কেন, তা আপন ভাই হলেও – সেই ভাইয়েরও কিছু সুবিধা-অসুবিধা বা স্বার্থ থাকবে এটাই স্বাভাবিক। যেমন কবের মধ্যে ভাইয়ের থেকে নেয়া ঋণের অর্থ ফেরত দিতে হবে অন্তত এমন কথা তো থাকবেই। এখন এমন শর্ত দিলে কী সেটা নিজ ভাইয়ের কাছে আমার সারর্ভৌমত্ব চলে যাবে? কেন এই আজিব ভাবনা?
তাহলে “শর্তাবলি মেনে নিয়েছি” একারণে, “আইএমএফ এর কাছে কিছু নীতি সার্বভৌমত্বের ক্ষেত্রে আত্মসমর্পণ” – মনে করছেন কেন দেবব্রত?? এত পাপবোধের অতিশুদ্ধতা কেন? অতিভক্তি কেন? রাজনীতিতে পাপপুণ্যের ধারণা মানে এই এথিক্স রাজনীতিতে নাই। তবে ধর্মতত্বে আছে। দেশীয়  কমিউনিস্ট কাছে ক্যাপিটালিজম বা সেই সুত্রে আইএমএফ এর ধারণা একেবারেই এমন ভুতুড়ে ধারণা! এর চেয়েও তা পাপ আর ছুয়াছুয়িতে শুদ্ধ-অশুদ্ধতার ধারণায় ভরপুর। এজন্যই তাদের কাছে  আইএমএফ ঋণ   মানে যেন শুদ্ধতা খুইয়ে আত্মসমর্পণ করা!  কমিউনিস্ট  মস্কোর পিএইচডি হলে কী এমন ভেট দেয়া বয়ান দিতেই হয়?  মা কালীর ভোগ চড়ানোর মত!!!

আচ্ছা গত ওয়ান ইলেভেনের সময় ভারতের নর্থ-ইস্টকে সব ধরণের করিভোর দিয়ে দেওয়ার পক্ষে সিপিডি আদাজল খেয়ে লাগা ততপরতা দেখেছিলাম আমরা; সেটা কী বাংলাদেশের সার্বভৌমত্ব রক্ষার জন্য করা হয়েছিল??  এমনকি যারা সিপিডির বিরোধিতা করবে তারা মুর্খ অশিক্ষিত বলতেও সিপিডির মালিক মহাজনদের সেসময় মুখে আটকায় নাই। আর ভারতকে করিডোর দিলে এর আয়ে নাকি আমরা সিঙ্গাপুর হয়ে যাবার কথা কারা বলেছিল?  এসব গুলো কী ছিল? ভারত-স্বার্থের পক্ষে ওপেন  দালালি নাকি সার্বভৌমত্ব ক্ষার উদাহরণ?   এগুলো কী আমাদের “অন্তত কিছু নীতি সার্বভৌমত্বের ধরে রাখার” কাজ? কোন ধরণের “আত্মসমর্পণ না করার” উদাহরণ এগুলো?? বাহরে নন্দলাল…!! মারহাবা!

সর্বশেষ এডিটঃ সকাল ০৯ঃ৫৭, ৩মে ২০২৩
____
গৌতম দাস

রাজনৈতিক বিশ্লেষক

 

Leave a Reply

Fill in your details below or click an icon to log in:

WordPress.com Logo

You are commenting using your WordPress.com account. Log Out /  Change )

Facebook photo

You are commenting using your Facebook account. Log Out /  Change )

Connecting to %s