এশিয়ায় বাইডেনের আমেরিকার ঢুকে পড়ার পথ দুইটা
কিন্তু জাপান-ভারত-বাংলাদেশের কথিত বিগ-বি তে আমেরিকাকে দেখা যাচ্ছে না, ফলাফল?
০৯ মে ২০২৩
https://wp.me/p1sCvy-4qz
The Big-B Initiative: Alive or Dead?
এশিয়ায় বাইডেনের আমেরিকার ঢুকে পড়ার এপর্যন্ত দুইটা পথ দেখা যাচ্ছে। কিন্তু এশিয়ায় আমেরিকাকে প্রবেশের বিশেষ পথ খুঁজতে শুরু করতে হল কেন ও তা কবে থেকে?
যদিও গত শতক পর্যন্ত এশিয়া তো গতানুপতিকতা ভাবেই অ্যামেরিকান নেতৃত্বে বয়ে গেছিল। চীনা উত্থান ঘটনার উল্লেখ করার মত কিছু ঘটে নাই, কোন চিহ্নও ছিল না। কেবল, ডাবল ডিজিটে চীনা জিডিপি বাড়ছিল যেটা বিগত ১৯৯০ সাল থেকে সেটা ছাড়া উল্লেখযোগ্য কোন লক্ষণ ছিল না। এমনকি ২০০৮ সালের যে গ্লোবাল মহামন্দা [বাড়তি পড়তে আগ্রহিরা দেখতে পারেন The Great Recession and Its Aftermath] ; এটাকে আমেরিকা সরকারি ভার্সানের এক বয়ান মনে করা যেতে পারে। তারাও জেনেছিল যে এই মহামন্দার কেন্দ্রভুমি মূলত পশ্চিমা জগতেই; মানে এশিয়ায় এর প্রভাব তেমন দৃশ্যমান নয়। একমাত্র চীনের অর্থনৈতিক উত্থান সেটা ১৯৯০ সাল থেকে এক নাগাড়ে ১৭-১৮ বছর চলার পরে সেই প্রথম ৮-৯% এভাবে ক্রমশ সিঙ্গেল ডিজিটের দিকে নামতে শুরু হয়েছিল। অর্থাৎ গ্লোবাল ইকনমি (যেটা গ্লোবাল ক্যাপিটালিজম) বলতে যেটা আমরা বুঝি সেটাও মাত্রার দিক থেকে তখনও তত গ্লোবাল হয়ে উঠে নাই – পশ্চিমা দেশগুলোর বাজার আর এশিয়ার বাজারগুলো ততটা পরস্পরের উপর নির্ভরশীল হয়ে উঠে নাই – গভীর বাণিজ্য লেনদেনের সম্পর্কই এই পারস্পরিক নির্ভরশীল এক গ্লোবাল অর্থনীতি হয়ে উঠে, তা তখনও ছিল না। কিন্তু এখন সেটা অনেক ইন্টিগ্রেটেড বা পরস্পর সম্পর্কিত। বিশেষ করে সারা এশিয়া দেশগুলোর বাজারে চীনা উপস্থিতি ও চীনের যায়গা করে নিয়েছে অনেকখানিই।
প্রধানমন্ত্রী হাসিনার এবারের ত্রিদেশীয় সফর ছিল মূলত ইমেজ তৈরির সফর, দেশের অর্থনৈতিক সংকট বিশেষত বৈদেশিক রিজার্ভের দৃষ্টিকটু ঘাটতি যা সাধারণ মানুষ পর্যায়ে তাদের জীবনেও অনুভুত হয়ে গেছে ভালভাবেই। অথচ আসন্ন নির্বাচন যেমনই হোক বা না হোক – সরকারের ইমেজের প্রশ্ন খুবই গুরুত্বপুর্ণ। তাই তিনি রাজনৈতিক নুন্যতম অধিকার দিতে পারেন আর নাই পারেন সরকার “উন্নয়নের চ্যাম্পিয়ান” এই ইমেজ তৈরিই মূলত এসফরের লক্ষ্য ছিল। সরকারের প্রায় ১৫ বছরের আয়ুতে কেবল ২০১৬ সালের পরেই (চীনা প্রেসিডেন্ট শি এর সফর) সরকার উন্নয়ন করছে বলে মনোযোগ টানা শুরু করতে পেরেছিল। এর একদম খাড়া কারণটা হল অবকাঠামো ঋণ [ যেটা ইংরাজিতে – Infrastructure Development Loan বা ইনফ্রাস্ট্রাকচার ডেভেলবমেন্ট লোন- এথেকেই বাংলায় উন্নয়ন শব্দটা এসেছে] এর দাতা ছিল একচেটিয়া বিশ্বব্যাংক। এটা বলাই বাহুল্য বিশ্বব্যাংকের লোন নিয়ে কোন দেশ “উন্নয়নের চ্যাম্পিয়ান” দাবি করে নাই, করা যায় না। এর মূল কারণ, আমাদের মত দেশ যাদের সকলেরই এমন বিশাল ঋণ চাহিদায় ভুগছে যেটার খুবই অল্প অংশই কেবল বিশ্বব্যাংক (এর নিজস্ব ফান্ড ক্যাপাসিটি) পূরণ করতে সক্ষম। তাই ২০১৬ সালের আগে আমরা ছিলাম উন্নয়নের ঋণ পাবার দিক থেকে সাপ্রেসড বা চাপিয়ে রাখা দেশ। আর আরেক সবচেয়ে বড় অ্যামেরিকান বোকামির খেসারত দিয়েছে আমেরিকা। তারা ২০১২ সালে বিশ্বব্যাংককে দিয়ে আমাদের সরকারের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ দায়ের করেছিল। এই অভিযোগ কতটা সঠিক বা বেঠিক আমরা জানতেই পারি নাই। তবে আমেরিকা যে অবিবেচক আনপ্রফেশনাল এটা একেবারেই প্রমাণিত। তারা দুর্নীতির অভিযোগ দায়ের করেছে ভাল কথা কিন্তু বছর দুই ঘুরতেই নিজেরাই সে অভিযোগ প্রত্যাহার করে নিয়েছিল। তাহলে প্রধান প্রশ্ন অভিযোগ দায়ের কেন করেছিল? যথেষ্ট চিন্তাভাবনা না করেই? যারা এত কম চিন্তা করে কাজ করে তারা কী প্রফেশনাল?? এরপরে আরও বড় প্রশ্ন আছে। চীন যে এই শতকে বিশেষ করে ২০১০ সালের পর থেকে অবকাঠামো ঋণ দানের সুযোগ নিয়ে বিশ্বব্যাংকের প্রতিদ্বন্দ্বি হয়ে উঠে আসছে – সেটা কী সারা অ্যামেরিকান প্রশাসন বা বিশ্বব্যাংকের পরিচালকেরা কেউ খেয়াল করে নাই?? বাংলাদেশের সাথে বিশ্বব্যাংকের সম্পর্ক ঝুলে গেলে এটাই যে চীনের বাংলাদেশে ঢুকে পড়ার সুযোগ হিশাবে হাতে এসে যাবে – এটা যে আমেরিকা বুঝেই নাই সেই আমেরিকা তো ডুবে মরবেই…। নাকি!!!
তাই এটা একটা ক্লাসিক উদাহরণ যে এশিয়ার বিভিন্ন দেশে চীনা উত্থানের সক্ষমতায় সে আমেরিকাকে ছাড়িয়ে যাবেই এবং ছাড়িয়ে গেছিল এর হাতে নাতে প্রমাণ। তাই এভাবে বলা যায় পুরানা নেতা আমেরিকার সাথে প্রতিযোগিতায় চীন সক্ষমতায় এগিয়ে যাওয়া চীন আমেরিকাকে পরাজিত করে নিজ প্রভাব বাড়িয়ে নিয়েছিল; আর আগিয়ে যাওয়ার সেটাই ছিল শুরু। বিপরীতে আমেরিকা পিছনে পিছনে দৌড়াচ্ছে।
আমেরিকা এশিয়ায় কতটুকু আগিয়েছেঃ
বহু পরীক্ষা-নিরিক্ষার পর একালে এশিয়ায় বাইডেনের আমেরিকার ইন্টারভেনশন বা হস্তক্ষেপ বা পদক্ষেপ নিয়ে ঢুকে পড়তে এখন শেষ পর্যন্ত দুটা পথ বা পাটাতন নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। যদিও মনে রাখতে হবে এটা চীন-আমেরিকার মধ্যে এশিয়ায় কোন অবকাঠামো ঋণ দান করে নিজ প্রভাব-প্রতিপত্তি বাড়ানোর প্রতিযোগিতা নয়। চীন সেটাতেই নিজেকে আকড়ে ধরে থেকেছে বটে কিন্এতু আমেরিকা বহু আগেই এটাকে সামরিক ও স্ট্রাটেজিক দিক দিয়ে আগানোই তার পথ চুনেছে। যার সোজা মানে সে চীনের কাছে অবকাঠামো ঋণদানের প্রতিযোগিতার পথ ছেড়ে দিয়েছে – হার স্বীকার করে কেটে পড়েছে। তবে আমেরিকার অনুসৃত সেই পথই এখন ফাইনালি ইন্দো-প্যাসেফিক স্ট্রাটেজি এই মুখ্য নামে আপাত থিতু হয়েছে। যদিও এটা শুরু হয়েছিল ২০১৫ সালে ওবামা্র এশিয়া পিভোট নামে। সেটা অনেক আগেই ব্যর্থ হলে পরে ট্রাম্পের আমলে পুরানা কোয়াড নামে আবার তা চালু করা হয়েছিল। পরে তা অ্যামেরিকান বন্ধুদের মধ্যে কে কার কাছে সাবমেরিন বেচবে এসব তর্কাতর্কিতে পরে আর ওদিকে মাঝখান থেকে ভারতের কার্যত কোয়াড থেকে নিস্ক্রিয় হয়ে পড়েছিল। মূল কারণ ভারত কোন সামরিক জোটে যেতে চায় না; কেবল চীনবিরোধী পলিটিক্যাল জোটে থাকাতেই তার স্বার্থ বলে মনে করে। আরও পরে বাইডেন এসে সব ঝিমিয়ে পড়া দশাকে আবার চাঙ্গা করতে চায় তবে এবার এরই নাম হল ইন্দো-প্যাসেফিক স্ট্রাটেজি। যার খাস অর্থ হল কে কে চীনকে একঘরে করতে চাও (ব্যবসা-বাণিজ্য এবং জাতিসংঘের ফোরামেও), বলো। এটাই লেটেস্ট হয়ে খাড়িয়ে আছে। এই গেল বাইডেনের একটা প্রথম পথ বা এশিয়ায় পা রাখার পাটাতন বা সম্পভাব্থয উপায়।
তাহলে অপর পথ বা পাটাতনটা কী?
শিরোনা্মে আমরা সেটাকে বলতে পারি আমেরিকার বার্মা দখল বা রেজিম চেঞ্জ। যার সবচেয়ে বড় সাফাই-অজুহাত হল এক মিলিয়ন এরও বেশি রাখাইন রোহিঙ্গা খেদিয়ে বাংলাদেশে তাদের মানবেতর জীবনে ফেলে দিয়েছে বার্মার জেনারেলেরা। কথা সত্য। নিঃসন্দেহে যা এক চরম মুসলমানবিদ্বেষী জাত-ঘৃণার প্রকাশ; এক হিটলারি এথনিক উদগ্র ঘৃণা ছড়ানির বেপরোয়া কাজ। আর এত নিচা পর্যায়ের কাজের নয়া-উস্কানি বার্মার জেনারেলেরা ভারত থেকে পেয়েছিল – সেকালে ২০০৭ সালের আগের একঘরে হয়ে থাকা বার্মাকে পশ্চিমের দুনিয়ার সাথে মুলাকাত – পশ্চিমের অবরোধ তুলে দেওয়া – একাজে পশ্চিমের এক এজেন্ট হিশাবে ভুমিকা রাখার সুযোগ নিয়ে ভারত এই পরামর্শ দিয়েছিল। ভারত আশ্বাস ও পরামর্শ দিয়েছিল জেনারেলদের যে এটাই ভাল সময়। ভারতের ক্যালকুলেশন সঠিক তবে তা বার্মার জন্য আত্মঘাতি ছিল। কারণ পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞা উঠিয়ে নেওয়াতে এক নয়া বার্মা যেভাবে ২০০৮-১০ সাল থেকে উন্মেচিত হয়েছিল ফলে বার্মার সাথে ব্যবসা-বাণিজ্য আর মাটির নিচের সম্পদ লুটে খাওয়ার এক নয়া বার্মা যেভাবে ২০০৮-১০ সাল থেকে উন্মেচিত হয়েছিল তা চীন, ভারত আর আমেরিকাসহ পশ্চিমের কাছে তাতে কোনপক্ষই নিজের লোভ সামলাতে পারে নাই। তাই রোহিঙ্গা খেদানি কাজকে চীন, ভারত আর আমেরিকা সকলেই সমর্থন করেছিল। আর এর পক্ষে বার্মা বা আমেরিকাসহ সকলেরই সাজানো বয়ান ছিল কথিত এক আরসা (ARSA) নাকি বার্মিজ সামরিক বাহিনীর উপরেই হামলা করেছিল আর তার পালটা হামলাতেই নাকি রোহিঙ্গাদের নির্মুল শুরু হয়েছিল। চীন, ভারত আর আমেরিকা এই সাফাই বয়ান সমর্থন করেছিল।
এখন আমেরিকা গত কয়েক বছর হলো, সে অবস্থান বদলিয়েছে। এখন সে রোহিঙ্গা খেদানোকেই প্রধান কারণ বানিয়ে এর প্রতিকার হিশাবে বার্মা দখল বা রেজিম চেঞ্জ এর পরিকল্পনা করেছে।
এমুহুর্তে আমেরিকার মধ্যে কেউ কেউ দ্বিধাদ্বন্দ্ব দেখছে কেনঃ
এতক্ষণ পশ্চাত পটভুমি বর্ণনা করলাম। আর এতে আমরা দেখলাম আমেরিকার হাতে এখন দুটা খাতা বা পথ খুলা আছে। তবে এদুইয়ের কোনটা নিয়ে আমেরিকা আগামিতে এশিয়ায় নিজ প্রভাব বিস্তারে আগাবে এহলো প্রশ্ন! যদিও এনিয়ে আমেরিকার মধ্যে কেউ কেউ দোনোমনো দেখছে কেন? যদিও এই পথের দ্বন্দ্ব বলতে এমন না যে বাইডেন দুই খাতার কোন একটাকে নিয়ে আগাবে! বরং আগানোর পথ হিসাবে সে পথ দুটাকেই একসাথে ব্যবহার করতে পারে অবশ্যই। কিন্তু কোনটা ডমিনেটিং বা ফোকাসে আর কোনটা সেকান্ডারি হয়ে সহায়তার ভুমিকা নিবে – এনিয়ে বাইডেনের পরামর্শদাতাদের মধ্যে সাময়িক ভিন্নতা থাকতে পারে। তবে এটাকে দ্বিধাদ্বন্দ্ব বলে মনে করা ভুল হবে। আর এসব নিয়ে বাংলাদেশে যারা নিজেকে হাসিনাবিরোধি মনে করে তাদের মধ্যে গত কয়েকদিন ধরে একধরণের সাময়িক – ঢাকার বাজার অন্তত কিছুটা হতাশা ও কৌতুহলে দেখছেন বলে দাবি করেছেন! জাপান সফর থেকে জাপান-বাংলাদেশের দুই প্রধানমন্ত্রীর এক যৌথ ঘোষণা প্রকাশিত হয়েছে আর পরে স্টেট ডিপার্টমেন্টের মুখপাত্র বেদান্ত প্যাটেলের কিছু বক্তব্যকে ভোয়া যেভাবে কায়দা করে হতাশব্যঞ্জকভাবে হাজির করেছে – তাতে এথেকে এসব তৈরি হতে পারে হয়ত।
জাপানে দুই প্রধানমন্ত্রীর এক যৌথ ঘোষণার মূলকথা কীঃ
যৌথ ঘোষণার মূলকথা কী – তা নিয়ে আমার বুঝ কী সেটাই সবার আগে বলে দিয়েই শুরু করা যাক। জাপান, (হাসিনার) বাংলাদেশ আর (মোদির) ভারত – এই তিনদেশ মিলে যদি একটা পথচলার জোট খাড়া করতে পারত তাহলে হয়ত সেই আলোকে এই যৌথ ঘোষণা কে একটা পারফেক্ট যৌথ ঘোষণা বলে মানা যেত। কিন্তু অসুবিধা হল যে এমন তিন নেতার তিনদেশীয় আকাঙ্খার সবচেয়ে বড় খামতিটা হল এদের এওই পরিকল্পনার আমেরিকাকে কোথাও দেখা যায় নাই। এশিয়ায় এমন যেকোন জোটের-কৌশল পরিকল্পনায় যদি আমেরিকা অনুপস্থিত থাকে তবে বুঝতে হবে এমন পর৮ইকল্পনার কোন ভবিষ্যতই নাই। তাতে যদি আমেরিকাকেও ভিতরে না রাখা যায় তবে অন্তত এনিমি হিশাবে বিপরীতে দেখাতেই হবে। তবু আমেরিকাকে অনুপস্থিত বা উহ্য রেখে যেকোন পরিকল্পনা মাত্রই তা এক অলীক আকাশ-কুসুম বলেই আমাদের মানতে হবে। হতে বাধ্য।
তাহলে জাপান ও বাংলাদেশের সাথে বিগ-ব [BIG-B] বলে প্ল্যান যেটা মোদি সাজাচ্ছে দেখেন এখানে [JAPAN AND THE BIG-B PLAN FOR BANGLADESH: AN ASSESSMENT] , এখানে বিগ-বি নিয়ে জাপানের জাইকার উদ্যোগ [The Initiative of BIG-B, JICA], অথবা এখানে চীন এবং আমেরিকাকেও বাদ দিয়ে ভারতের এক “নয়া ওয়ার্ল্ড অর্ডার” এর স্বপ্ন-কল্পনা [“THE NEW WORLD ORDER” ]; অথবা এমনকি মোদির হিন্দুত্বের স্বরাজ্য ম্যাগাজিন যেভাবে এতে মোদির বিজয় দেখছে –A Quiet Diplomatic Victory for India, Japan Against China in Bangladesh – এরকম যত কথা এখন উঠেছে এর সবই যেন নিশ্চিত বৃথা যাবার জন্যই অপেক্ষা করছে। বলা হচ্ছে BIG-B উদ্যোগটা নাকি ২০১৪ সালে শুরু হয়েছিল। তাহলে এতদিনেও এর কোন অগ্রগতি নাই কেন? কারণ, আমেরিকারকে উদ্যোক্তারা কী কোথায় রাখবে এর ভিতরে না বাইরে তা ঠিক করতে পারে নাই তাই??? আর আমেরিকা এতে রাজি হবে কেন এসব প্রসঙ্গ-গুলো নিয়ে কথা আগাতে ভারত ও জাপান উভয়েরই দ্বিধা অস্বস্তি আছে তা তো বলাই বাহুল্য! মোদি এখন একালে একেবারেই চাইবে না এতে আমেরিকা কোনভাবেই যুক্ত হোক বা তার ছায়া কোথাও থাকুক। আবার বিপরীতে বাইডেন এর অবস্থাও তাই!
এছাড়া এখন এটা কে না জানে যে, বাইডেনের বার্মা দখল প্রকল্পে সে সরাসরি মোদির ভারত এবং চীনেরও বিরোধী। আর এমনিতেই আগামি ২০২৪ সালের ভারতের আগামি নির্বাচনে বাইডেনের বাজি হল সে মোদিকে উতখাত আর রাহুলকে ক্ষমতাসীন দেখতে চায়। তাই আইন বাঁচিয়ে যতটুকু যা করা যায় এর সবটুকুই করতে শুরু করেছেন বাইডেন। তাহলে মোদির ভারত আর বাংলাদেশ-কে সাথে নিয়ে জাপানের ত্রিদেশীয় খায়েশ এর তো কোন ভবিষ্যতই নাই!!!! আসলে এককথায়, যেখানে আমেরিকা নাই অথচ জাপান-মোদির ভারত আর হাসিনার বাংলাদেশ – এমন ত্রিদেশীয় কোন পরিকল্পনা আছে এখন তাতে মাতারবাড়ী গভীর সমুদ্র বন্দরে জাপানি বিনিয়োগ হানতেন ইত্যাদি যাই দেখানো হোক না কেন এসবকিছুর ভবিষ্যত শুণ্য!! এসব অবাস্তব ও অলীক সব কল্পনা হয়েই থাকবে – যেভাবে ২০১৪ সাল থেকে এই উদ্যোগটা কেবল টিকেই আছে!
এছাড়া আমরা যদি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে মিত্রশক্তির এনিমি ও হেরে যাওয়া জাপানের কথা মনে রাখি তবে কিছু কথা আমরা হাতে গুনে মনে রাখতে পারি যে যুদ্ধের পর থেকে জাপানি পররাষ্ট্রনীতি অ্যামেরিকান পররাষ্ট্রনীতিরই অনুগত হয়ে থাকতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। আর এই প্রতিশ্রুতির কারণ হল – বিশ্বযুদ্ধে হিটলারের পক্ষ নেয়া ও হেরে যাওয়া সত্বেও জাপানের পুণর্বাসনে ও পুনর্গঠনে সমস্ত বিনিয়োগ আমেরিকাই দিয়েছিল। কাজেই Initiative of BIG-B এটা যতই উচ্চে তুলে সম্ভাবনাময় হিশাবে দেখানো হোক না কেন অ্যামেরিকান স্বার্থ ও পররাষ্ট্রনীতির বিপরীতে বা বাইরে জাপান যেতে পারবে না; কিছুই করতে পারবে না।
কেন Initiative of BIG-B এর ভবিষত নাই এর দ্বিতীয় আরেক কারণঃ
এই উদ্যোগটা আসলে মূলত গভীরভাবে নিজেদের চীনবিরোধী মনে করে তাদের আগ্রহে তৈরি হওয়া উদ্যোগ। সে হিশাবে এটাক ভারত ও জাপানের উদ্যোগ; কিন্তু তাহলে এর ভিতর বাংলাদেশ কেন? কিন্তু এর চেয়েও বড় কথা এটা প্রথমে চীনা নেতৃত্ব আরেক উদ্যোগ আগে তৈরি হয়ে যাবার পরে এরই নকল এক উদ্যোগ মাত্র। চীনা সেই উদ্যোগের নাম RCEP [Regional Comprehensive Economic Partnership] । এটা আশিয়ান [ASEAN] জোটের গর্ভ থেকে প্রথম প্রস্তাবিত হয়েছিল ২০১১ সালে। মজার কথা হল চীনা নেতৃত্বের RCEP তৈরি হলেও এখানে জাপানও সদস্য হয়ে আছে। মূলত আশিয়ান দশটা দেশই ভারি এরা দশটা দেশ আর এদের সাথে জাপান, অষ্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ড দক্ষিণ কোরিয়া ও চীন – এভাবে এরা সবাই মিলে এটা একটা Free trade agreement (FTA) এর বাণিজ্য চুক্তির আওতায় যুক্ত। এটা গত বছর ২০২২ সালের পয়লা জানুয়ারি থেকে সক্রিয় ততপরতায় চলে গেছে; জার্কাতা এর হেড কোয়ার্টার। কিন্তু এর চেয়েও বেশি ইম্পর্টেন্ট তথ্যটা হল এটা মূলত শেয়ার্ড ভ্যালু চেন [shared value Chain] – ভিত্তিতে এক উতপাদন ব্যবস্থায় সদস্যরা সকলে যুক্ত হবে – যেখানে যেকোন একটা পণ্য নির্মাণে সদস্য সকল দেশের শ্রম যুক্ত করে [শ্রম যোগ করা মানে ভ্যালু এড করা] নির্মিত হবে আর সদস্য সকলেই ঐ পণ্যের ক্রেতা ব্যবহারকারি-ভোক্তা হবে। এটাই দুনিয়ার লেটেস্ট অর্থনৈতিক জোটবদ্ধতার এক নয়া ধারা যা গ্লোবাল ক্যাপিটালিজমের মধ্যে অবশ্যই । আর এর সদস্য হতে গেলে প্রধান শর্ত হল আপনার নিজ দেশে বিদেশি পণ্য আমদানিতে যে শুল্ক ব্যবস্থা বজায় আছে তাতে গড়ে শুল্ক হার ৮-১০% এরও নিচে হতেই হবে। এটা আশিয়ান জোটের সদস্যপদ পাবার ক্ষেত্রেও শর্ত।
কিন্তু তাতে কী?
তাতেই এটা ভারতের পক্ষে এসব শর্তপূরণ একেবারেই অসম্ভব। কেন?
আসলে কোন উগ্র জাতিবাদি বিশেষ করে যাদের জাতিবাদ এক অর্থনৈতিক জাতিবাদ পর্যন্ত বিস্তৃত তেমন ধারায় বিরাজ করে ভারত। এমনিতেই ভারত জন্ম থেকেই এক উগ্র-জাতিবাদি অর্থনৈতিক দেশ। আর একালে মোদির উগ্রজাতি-বোধের হাতে পড়েছে এটা আরও মারাত্মক দিক। ঠিক এই অর্থনৈতিক উগ্র-জাতিবাদ অবশ্য ব্যবহারিক কমিউনিস্ট বা স্তালিনিস্টদের মধ্যেও গেথে থাকা একই ধারণা। এরা মনে করে দেশের মানুষ যা কিছুর ভোক্তা বা সেবা নিবে এমন সকল পণ্যই দেশে তৈরি হতে হবে। একারণের জাতিবাদি ও কমিউনিস্টেরা কার্যত বাণিজ্য-বিরোধী। এমনিতেই নেহেরুর হাতে গড়ে উঠা ভারত অন্যের পণ্য তো কিনবেই না – এমন কঠোর নীতিতে বিশ্বাসী; আর এর উপর আবার এক কলোনিদখল মানসিকতাও তারা ক্রেডিট হিশাবে দেখে থাকে। সেটা এমন যে পারলে ছলেবলে অন্য দেশের বাজার দখল করবে আর এজন্য চাপ দিয়ে বা বেকায়দায় ফেলে হলেও এটা তারা জায়েজ মনে করে। একারণেই নেহেরুর সেই নীতি একালে এখনও ধরে রেখে চলছে মোদি।
আরেকটা তথ্য দেই তাহলে অনেক কিছু পরিস্কার হবে।
RCEPএর জন্মের প্রস্তাব যখন তুঙ্গে তখন কথা উঠেছিল মোদির ভারত কেন তাতে যোগ দিবে না? স্বভাবতই মোদি ও তার পররাষ্ট্র নেতা জয়শঙ্কর জানিয়েছিলেন এসব উদ্যোগ ভারতের জন্য নয়। আসলে ভারতকে ত অন্যের পণ্য ঠেকাতে ট্যাক্স বেশি ধরতে হবে বা ডাম্পিং করতে হবে। যেমন আমাদের পাটের উপর এখন এমন ট্যাক্স আরোপ করে, আমাদের রপ্তানি বন্ধ করে রেখেছে। তাহলে আমরা ভারতের পণ্য আমদানি করব কেন? এই প্রশ্নের জবাব তারা দিবে না বুঝাতে চাইবে তারা বড় ভাই। এনিয়ে আমার পুরানা লেখা একটু পরে খোজ করে দিচ্ছি।
এমন পুরানা লেখার শিরোনাম ও লিঙ্ক এখানেঃ
১। আরসিইপিঃ দুনিয়ায় নতুন সম্পর্ক আনার সম্ভাবনা
২। যারে দেখতে পারি না অথচ, তাঁর আরো ঘনিষ্ঠ হই, কেন?
আর ঠিক একই প্রস্তাব বাংলাদেশকেও দেয়া হয়েছিল। কিছুদিন পরে বাংলাদেশ আশিয়ান সদস্য হবার জন্য আবেদনও করে রেখেছে।
তাহলে এখন এটা সবার কাছেই পরিস্কার হয়ে যাবার কথা যে ভারত দুনিয়ার কোন দেশের সাথেই অর্থনৈতিক জোট গড়বার যোগ্য নয়। তাতে সেটা সার্ক বা যেকোন অর্থনীতিই হোক না কেন!
অতএব, এত ঘটা করে তাহলে RCEP এর বিকল্প হিশাবে Initiative of BIG-B নিয়ে এত গল্প আর এই জাপান-বাংলাদেশ যৌথ ঘোষণার কী আর কোন অর্থ আছে? এক নিজ নিজ দেশের পাবলিককে বোকা বানানোর প্রপাগান্ডা ছাড়া…।।
গৌতম দাস
রাজনৈতিক বিশ্লেষক