ভারতীয় সুবীর ভৌমিক এর লেখাটা


ভারতীয় সুবীর ভৌমিক এর লেখাটা
গৌতম দাস

২২ মে, ২০২৩   ০০ঃ০৩
https://wp.me/p1sCvy-4ul

       Wary Delhi watching Dhaka 

ভারতীয় সুবীর ভৌমিক আবার একটা লেখা ছাপিয়েছেন – ‘দ্যা ফেডারল’ [The Federal], এই নামের দক্ষিণ-ভারতীয় পত্রিকায়। বাংলাদেশের পাঠককুল সাধারণত  সুবীরকে ধরে নেন যে তিনি ভারত সরকারের (গোয়েন্দাবিভাগ) এক অঘোষিত মুখপাত্র। বা উলটা করে বললে শুরুর দিকে সুবীরও যেন এটাই চেয়েছিলেন যার নতিজা এটা। তবে যেকোন সরকারের নানান মুখপাত্র থাকে; আর মুখপাত্র ব্যাপারটা হল,  কোন ঘটনায় সরকারের মানে সরকারি ভাষ্যটা কী তা জানাতেই এই পদের সৃষ্টি হয়েছে। অনেকগুলো সরকারি প্রতিনিধি বা কর্মচারির মধ্যে  কার কথাটা সরকারের অবস্থান বলে সরকার মনে করে সেটার নির্ধারক হল কাকে মুখপাত্র বলে সরকার আগেই পরিচয় করিয়েছে।  যেমন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়েরও এক মুখপাত্র থাকে; সম্প্রতি বাংলাদেশেও এই প্রথম এমন পদে একজন মুখপাত্র নিয়োগ দিয়েছে। কিন্তু এর বাইরেও এমন কিছু মুখপাত্র দরকার হয় যারা সরকারের অফিসিয়াল বা ঘোষিত মুখপাত্র নয় বা থাকেন না; অথচ তাদের মুখ দিয়ে সরকার নিজ অবস্থানও জানায় রাখতে চান। অর্থাৎ অফিসিয়ালি তাঁকে মুখপাত্র বলে স্বীকার না করেও সরকার বিভিন্ন ইস্যুতে নিজ অবস্থান জানানোর এক ব্যবস্থা করে থাকে, যেখানে পাঠক আর সরকার – এরা উভয় পক্ষই এই অঘোষিত ব্যবস্থা সম্পর্কে ওয়াকিবহাল থাকেন। অর্থাৎ ইনফরমালি এক ফরমাল ব্যবস্থা যেন! সুবীরকে তেমনই এক মুখপাত্র মনে করা হয়!
আবার এমন ব্যবস্থা চীনেরও আছে, যদিও তা আরেকটু গোছানো। চীনের বেশিরভাগ খবর প্রকাশিত হয় জিনহুয়া  [Xinhua] নিউজ এজেন্সি থেকে তবে তা চীনে সারা দেশের নানান নামের পত্রিকায়। কিন্তু চীনা গ্লোবাল টাইমস [Global Times] হল সরকারি অবস্থান প্রকাশ করার আলাদা এক পত্রিকা তবে সে কথাটাও অঘোষিতই থাকে। মানে কোথাও তা উল্লেখ নাই; তবুও পাঠক অনুমান করে নেয় বা ধরে নেয় যে এটাই চীনের অফিসিয়াল ভার্সান।

সুবীরদের এই লেখার শিরোনামটাই অদ্ভুত – “নির্বাচনের আগে হাসিনা যেমন ঢাকার উত্তাপ টের পাচ্ছে দিল্লিও এক কোনায় পড়ে নিজেও তা টের পাচ্ছে” [As Hasina faces heat in Dhaka ahead of polls, Delhi finds itself in a corner too]। মানে সারকথায় সুবীর যেন বলতে চাইছেন,  বাংলাদেশের হাসিনা যেমন  আমেরিকান চাপ থেকে বের হবার পথ না পেয়ে মোদির সহায় হয়েছিলেন; মোদিও তাতে ব্যর্থতা অসহায়ত্ব দেখিয়ে ফেলে পালাতে বা কেটে পড়তে চাইছেন!

এতদিনের ভারত-বাংলাদেশের সম্পর্ক বা মোদি-হাসিনার সম্পর্কের কথা পাশে সরিয়ে রেখে যদি কেবল এবারেরটা মানে গত মাসে ২৫ এপ্রিল হাসিনা সরকারের জাপান সফর থেকেই আমলনামা শুরু করি – তাহলে বলতে হয় জাপান সফরটা মূলত ছিল মোদির ভারতের জন্য কিছু করে দিবার সফর। যাতে আমাদের সরকার মোদির জন্য কিছু করে দিলে  মোদি সরকারও আমাদের সরকারের জন্য গুরুত্বপুর্ণ কিছু করে দিবেন!  যেমন এক, বাংলাদেশ জাপানি লোনের ভার নিজ কাঁধে নিয়ে ভারতের নর্থ-ইস্টকে শুধু সমুদ্র বন্দর না একেবারে একটা (মাতারবাড়িতে) গভীর সমুদ্র বন্দরের ব্যবস্থা পাইয়ে দিতে জাপান সফরে গেছেন।  আর দুইঃ যদিও  মোদির ভারত ক্রমান্বয়ে নিজেকে এক পরাশক্তি বলে এক শতভাগ মিথ্যা দাবি বা আচরণ করে চলে –  যেন কোন মানুষ যখন অলীক সব স্বপ্ন-কল্পনাকে বাস্তবে তা আছে বলে মনে করে বিশ্বাস করা শুরু করে আর সেসবকে তাঁর স্মৃতি বলে চালিয়ে দিতে চায়, এটা সেরকম। যা বাস্তবে নাই ঘটেই নাই তা কারো স্মৃতি হয় কেমনে?  যেখানে বাস্তবের ভারত হল এমন এক অর্থনীতির নাম যার প্রচুর অবকাঠামো ঋণ আর এফডিআই- এদুই ধরণের বিনিয়োগ ঋণের ঘাটতিতে আছে বা থাকছে; মানে একটা বিদেশি ঋণচাহিদায় থাকা দেশ। উদ্বৃত্বের অর্থনৈতিক দেশ ভারত নয়। ফলে তার ঋণ প্রয়োজন যেটা সে সবাইকে জানিয়ে চীনের (যে এখন ঋণদাতা হিশাবে শীর্ষে) কাছ থেকে সংগ্রহ করতে পারে না। তার অহঙ্কার-ভ্যানিটিতে লাগবেই যদি সে নিজ পুর্ণ ক্ষমতায় বিকশিত হয়ে উঠতে চায়। কিন্তু মোদির ভারতের আবার চীন-এলার্জি আছে বলে – মানে হলে হুদাই মোদি হল এক কঠোর জাতিবাদি স্বরাজ্য-জ্ঞানসম্পন্ন শক্তি হিশাবে দেখিয়ে পাবলিকের কাছে ভোট চেয়ে ফেলেছে; ফলে যেখান থেকে সে আর এখন বের হতে পারবে না –  অতএব চীন তার বিনিয়োগ চাহিদা মিটাতে পারলেও মোদিকে এখন চীনের একটা বিকল্প খুঁজতে নেমে পড়তে হয়েছে। ভারত সেই বিকল্প হিশাবে সে পেতে চায় জাপানকে। যদিও ভারত জানে এটা তেমন জুতের না; কারণ এটা আবার পায়ে জুতার কাটার মত খচখচ করে লাগে। কারণ জাপানি ঋণের খরচ তুলনায় বেশি; এছাড়া জাপানি শিল্প ভারতকে সাব-অর্ডিনেট বা অধীনস্ত করার ঝোঁক প্রবল বেশি। তবে মাঙনা যদি কিছু জাপান থেকে আসে তো খারাপ কী! এটাও ঠিক! হাসিনার সফরকে আমরা এখান থেকে দেখতে পারি!

সমস্যা হল মোদির ভারতের অর্থনীতিবিষয়ক স্বপ্ন আসলে এক অলীক স্বপ্ন। কারণ, মোদি বা আরএসএস এর রাজনীতি এক উগ্র জাতিবাদী ধারণা বলে, তাদের অর্থনীতি জ্ঞান ও ধারনাও উগ্র জাতিবাদ প্রসুত! কিন্তু এর মানে কী? মানে হল এই চিন্তা্র শাসকেরা বাস্তবে কখনও আরেক দেশের সাথে শেষবিচারে লেনদেন বা বাণিজ্য-অর্থনীতিতে লিপ্ত হয়ে পারে না, পারবে না। কেননা এমন উগ্র জাতিবাদ মনে করে আমার দেশের মানুষ যাকিছু উতপণ্য ভোগ-ব্যবহার করব তা কেবল নিজ-দেশের উতপাদনই হতে হবে। আমিও রপ্তানি করব অন্যদেশেও আমার দেশে রপ্তানি করবে – না এমন নীতিতে উগ্র জাতিবাদ বিশ্বাস করে না। এটা কার্যত ওয়ানওয়ে  মানে কেবল একদিকে আমিই কেবল রপ্তানি করব এমন হতে হবে। এমনকি তা যদি তা সোজা আঙ্গুলে না হয় (বাস্তবে তা না হওয়ারই কথা) তবে শঠতা, প্রতারণা করে হয়েও আগাতে হবে। ভুয়াভাবে এমন বিশ্বাস আছে তা দেখাতে হবে আর এই দেখানোটা জায়েজ মনে করতে হবে। যেটা অনেকটা ছলনাময় ও চতুর কলোনিদখলদার ব্যবসায়ী বৃটিশদের মত, তাদের পররাষ্ট্রনীতির মত;  আর এটাই উগ্র জাতিবাদিদের অর্থনৈতিক মডেল।  একারণে গত একদশকেরও বেশি এই জাপান-ভারতের সম্পর্ক এক স্বপ্ন-কল্পনাই হয়ে চলছে যার তেমন কোন বাস্তবায়ন অগ্রগতি নাই। যদিও তাতে উচ্ছ্বাসে কমতি নাই। যেকারণে,  যাকিছুর নামে সাথে স্বরাজ অথবা জাগরণ ধরণের শব্দ আছে বুঝতে হবে সেসবগুলো আসলে আরএসএস এর প্রকল্প। তাই স্বরাজ্য-মাগ ম্যাগাজিনে জাপানকে নিয়ে উচ্ছাস দেখা যাবে যারা বলতে চাইবে এই তো চীনের বিকল্প এক বিড়াল হিশাবে জাপানকে পেয়ে গেছি আর চিন্তা নাই। কিন্তু এটা যে মাঙনায় পাওয়া হাসিনা সরকারের দেয়া জাপান থেকে হবু সুবিধা তা উগ্র জাতিবাদিরা পরিস্কার করে বলবে না।

কিন্তু হাসিনা সরকার তাহলে এর বিনিময়ে নিজে কী পাবে ভেবেছিল? সেটা অনেকটা –  “দেখেন তো ভাইজান কিছু করতে পারেন কিনা – আমেরিকার ঘেরাও এর ভিতর থেকে আমাকে উদ্ধারে কিছু করতে পারেন কিনা” – ধরণের কিছু।
এমনকি গত সপ্তাহে বাংলাদেশের হোস্ট করা (১২-১৩ মে) ভারত মহাসাগর কনফারেন্স নামে যেটা হল সেটাও ছিল আরেক রাজভেট – ভারতকে দেয়া আমাদের উপহার। সেটা আবার কী? এছাড়া এই সম্মেলনের তাতপর্যই বা কী?

সেটা বুঝাতে একটু পিছন থেকে বলি। আগেও  অনেকবার বলেছি যে গ্লোবাল নেতৃত্বের পালাবদলের একালের সকল প্রতিযোগিতার  ফোকাস-ভুখন্ড হবে (আসলে হয়ে গেছে) এশিয়া; আর যা  নুন্যতম আগামি তিনদশকের জন্য। অর্থাৎ একথাটাই আবার ভুখন্ডের দিক থেকে না বলে এর বদলে, মহাসাগর এর দিক থেকে বললে তা হল, ভারত মহাসাগর ও প্রশান্ত মহাসাগর জুড়ে সমুদ্র-অঞ্চল হল এর ফোকাস এরিয়া ।  আমেরিকা নিজের সেই সমুদ্র-কেন্দ্রিক ততপরতার ফোকাস করেছে  – সমুদ্রপথে চীনের প্রবেশমুখ যেটা – সাউথ চায়না সি বলে ইতোমধ্যেই পরিচিত; তাকে কেন্দ্র করে তবে তা, অবশ্যই দুই মহাসাগর জুড়ে হৈ চৈ করে শুরু করে দিয়েছে।  চীনও কমবেশি তা করেছে তবে প্রোফাইল লো রেখে এবং সেও অবশ্যই দুই মহাসাগর জুড়েই সেটা শুরু করেছে। যেমন, আমাদের কক্সবাজর কেন্দ্রিক চীনের উপস্থিতি ও সব ততপরতা হল সেগুলোই।

কিন্তু ‘পরাশক্তি’ নামের ভাঁড় ভারত, তার খায়েসের কী হবে? তারও একটা কিছু দেখানো যে লাগবেই! যাতে মনে হয় নকল হলেও সেও একটা পরাশক্তি! তাই এ যেন -পোলাও মনে করে গরীবের চালভাজা- খাওয়ার সুখ! আর সেটাই হাসিনার কান্ধে চড়ে এবারের ভারত মহাসাগর কনফারেন্স এর হোস্ট ভারত করে নিয়েছে বাংলাদেশকে। এটা করে, ভারত দেখাতে চাইলো সেও কম যায় না। এদিকে,  কূটনৈতিক রেওয়াজ হল কোন কনফারেন্সের গুরুত্বের মাত্রা বুঝার একটা তরিকা হল তাতে আগত বিভিন্ন দেশের কারা প্রতিনিধিত্ব করতে এসেছে তা দিয়ে। মানে এরই একটা মাপকাঠি মানা হয় হল  – রাষ্ট্র বা সরকার প্রধান কতজন সেখানে এসেছেন। তাতে ভারতকে দেখা গেল তবু একজন রাষ্ট্রপতিকে আনতে পেরেছেন। কিন্তু কে তিনি? তিনি হচ্ছেন মরিশাসের রাষ্ট্রপতি! মহাদেশ-হিসাবে যা আফ্রিকায়; মানে আফ্রিকার পাদদেশে যে মাদাগাস্কার দ্বীপ আছে তারও আরও পুবে খুবই  ছোট্ট একদ্বীপ। মোট জনসংখ্যা যার মাত্র ১২ লাখ, মানে আমাদের মাঝারি মানের একটা উপজেলার জনসংখ্যা যেমন। আর মরিশাসের ৬৭% জনসংখ্যা আবার ভারতীয় অরিজিন। কেন এমন? কারণ,  যাদেরকে সস্তা শ্রমিক হিশাবে বৃটিশ কলোনিদখলদারেরা সেকালের বৃটিশ-ইন্ডিয়া থেকে মাইগ্রেট করে নিয়ে গেছিল, তারাই। যেমন অনেকেই লক্ষ্য করেছেন বাংলাদেশে এসে এই মরিশাস প্রেসিডেন্ট – নাম পৃথ্বীরাজসিং রূপম – তিনি  সস্ত্রীক আমাদের ঢাকেশ্বরী মন্দির দর্শন করতে গেছিলেন। সারকথায়, এজন্য এটা এক ভারত-নির্ভরশীল দ্বীপ-রাষ্ট্র। এই হল সেই একমাত্র প্রেসিডেন্টের নমুনা! দাবি করা হয়েছে পঁচিশটা দেশের প্রতিনিধি এতে উপস্থিত ছিল যার প্রায় সবই ভারতের আমন্ত্রণে বা ভারতের কূটনৈতিক জোরে।  আর বাংলাদেশ কেবল হোস্ট মাত্র যার মাধ্যমে ভারত বাংলাদেশকে সদ-ব্যবহার করে দেখাতে পারে সে বাংলাদেশে অনেক প্রভাবশালী! ভারতের এরিয়া অফ ইনফ্লুয়েন্সেই’,  “আমার তালুকেই”যেন বাংলাদেশ অবস্থিত!

বিনিময়ে বাংলাদেশ সরকার কী পেলঃ
কিন্তু এসব করার বিনিময়ে বাংলাদেশ সরকার কী পেল? হা; সেকথাটাই যেন আমাদেরকে জানাতে মোদি সরকার সুবীর ভৌমিকের আর্টিকেল্টা প্রকাশিত কররার ব্ছেযবস্থা করেছে। যেমন শিরোনাম থেকেই শুরু হয়েছে এটা বলে যে “বাংলাদেশ সরকার (অ্যামেরিকান) “চাপের” তাপ বুঝতেছে আর তাতে দিল্লিও কোণার চিপায় পড়ে গিয়েছে”। কিন্তু এতে তো ভারতকেও বিপদে পড়া দেখানো হয়ে গেল, তা কেন? কারণ এখন ভারতের খাই-দাই শেষ; মানে আমাদের সরকার ভারতের জন্য যা যোগাড় করে দিয়েছিল! ফলে এখন ভারতও নিজেকে অসহায় কোণার চিপায় পড়া দেখালেই তো দায়িত্ব শেষ – যেন বলতে চাচ্ছে, “অনেক চেষ্টা করলাম, আর পারি নাই ভাই!”  এমন বলে হলেও তো খালাস পেতে হবে!!!

সাথে আবার সুবীরের আরও অজুহাতও আছে। এমনকি এতে খোদ ভারতই বিপদে আছে বলে সে আড়াল নিতেও চেয়েছে। একাজে, ভারতকে অসহায় দেখানোটাও জরুরি মনে করেছেন সুবীর! যেমন সাব-হেডিং দিয়েছেন, “খোদ ভারতই এক শক্ত-ঠেলার মধ্যে” [India in a tight spot] পড়েছে। এরপর বলছেন, এবারের পরিস্থতিতে দুইটা জিনিষ নাকি ভারতের বিপক্ষে, নাহলে ভারত হাসিনার জন্য কতকিছু করে দেখায় দিত!
সে দুটা অসুবিধা কী? সুবীর বলছেন এক হল, জাতিসংঘে ভারতের হাতে চীনের মত ভেটোক্ষমতা নাই যে যেকোন অ্যামেরিকান প্রস্তাবে বিরুদ্ধে সে ভেটো মেরে দিতে পারত। আচ্ছা সুবীর সাব, আমেরিকা কী হাসিনার বিরুদ্ধে জাতিসংঘে কোন প্রস্তাব এনে হাসিনাকে চাপে রেখেছে? তা তো বাস্তবতা নয়! তাহলে এসব অপ্রাসঙ্গিক কথা কেন বলেন? বাস্তবতা হল,  আমেরিকা  নিজ-রাষ্ট্র-ক্ষমতাবলেই নানান স্যাংশন দিয়ে রেখেছে? শুধু তাই না। এখনও জাতিসংঘের যেকোন ফোরামে অ্যামেরিকান প্রভাব সবার চেয়ে বেশি। এই প্রভাবের অর্থ হল অন্যান্য ভেটো হোল্ডার সদস্যদের (চীন বা রাশিয়ার) এতে তেমন কিছুই করার নাই।  আজ জাতিসংঘ গঠন প্রায় আশি বছর হয়ে গেল তবুও গ্লোবাল নেতা আমেরিকা ঢলে পড়ার যুগে  আজ প্রবেশ করলেও  আমেরিয়ান প্রভাব এখনও একক; আমেরিকা চাইলেই কেবল জাতিসংঘের হিউম্যান রাইট [OHCHR] এজেন্সি সংগঠনে যেকোন প্রস্তাব সহজে নড়েচড়ে উঠতে পারে।  ফলে ভারতের অযোগ্যতা, অসহায়ত্ব তো নতুন নয়। এমনকি আজ ভারত ভেটো ক্ষমতা পেলেও তাতে কিছুই হবে না। কারণ, এখনই আমেরিকা ছাড়াও আরও চার ভেটোক্ষমতা-ওয়ালা দেশ আছে। যার মধ্যে দুজন হল বৃটিশ ও ফরাসিরা। কই জাতিসংঘে তাদের উদ্যোগে বা চাপ কী হাসিনার বিরুদ্ধে কিছু আছে??? কাজেই ভারতের আলগা মাতবরি দেখানোর ত এখানের কিছু নাই!!! সোজা কথাটা হল, ভারতের হাতে ভেটোক্ষমতা থাকলেও সেটা হাসিনা সরকারের উপর আমেরিকান চাপের  বিরুদ্ধে কিছুই করতে পারত না। কাজেই ভারতের আলগা ভাব নিবার কী আছে এখানে???
সুবীর ভৌমিক দ্বিতীয় আরেক ওজুহাত সুনিয়েছেন হাসিনা-কে। তিনি বলছেন ২০১৪ সালের নির্বাচনের কথা। সেসময় নির্বাচনের আগের ডিসেম্বরে (২০১৩) ভারতের পররাষ্ট্র সচিব সুজাতা সিংকে ভারত পাঠিয়েছিল। প্রকাশ্যেই তিনি বলে গেছিলেন, বিএনপি ছাড়াই (কারচুপির) নির্বাচন হবে কোন সমস্যা হবে না কারণ এরশাদ না চাইলেও জাতীয় পার্টিকেই গৃহপালিত বিরোধী দল করে নেয়া হবে – যেটা সুজাতার সঙ্গে এরশাদ মিটিং শেষে বেড়িয়েই মিডিয়ার সামনে সব উদাম করে দিয়েছিলেন এরশাদ। মজাটা হল,  সে ঘটনাটা সুবীর ভৌমিক এখন স্মরণ করছেন আমেরিকার বিরুদ্ধে ভারতের বিরাট কৃতিত্ব বলে দাবি করে।
অথচ ফ্যাক্টস হল, দুনিয়ায় গ্লোবাল নেতা ও এর মধ্যে সবচেয়ে প্রভাবশালী দেশের ক্ষমতা সবই তখনও এককভাবে সবই আমেরিকার দখলে ছিল। আর আজকের চেয়ে তা আরও ভাল ভাবে। যার কাছে ভারত তুচ্ছাতিতুচ্ছই ছিল। কিন্তু ঐ ভারতকে আমেরিকা এশিয়ায় চীন ঠেকানোর ঠিকাদারি বরকন্দাজ বানিয়ে রেখেছিল বলে তাতে ভারতের কিছু “ভয়েস অর্থে ক্ষমতা” তৈরি হয়েছিল যা আমেরিকা সদয় হলে ভারতকে সময়ে আমল করত। [মনে রাখতে হবে সেই ক্ষমতাটুকুও এখন ভারতের নাই]  কারণ আমেরিকা বাংলাদেশকে ভারতের হাতেই তুলে দিয়েছিল বলেই সুজাতা সিং অ্যামেরিকান ক্ষমতার উপর ভর করেই ওসব মাতব্বরি কথা সেকালে বলে যেতে পেরেছিল।  সুবীরের ধারণা এগুলো কেউ জানে না,  বা তার চাপাবাজি কেউ ধরতে বা বুঝতে পারবে না। পুওর সুবীর!! সুবীর তাই এবার লিখছে সুজাতার এই খেল এসবই নাকি ভানুমতির খেল  আর সেই আসলে ভানুমতি ছিলেন প্রণব মুখার্জি। যিনি এখন মারা গেছেন বলেই নাকি এবার আর হাসিনাকে অ্যামেরিকান চাপ থেকে উদ্ধারে মোদি কিছু করতে পারল না।!!!!
মিঃ সুবীর, মিথ্যা কথা বলতে গেলেও তো কিছু নিয়ম মানতে হয়, নাকি?? সুবীর সেটাও বুঝে না। অথচ এবারের লেখাতেই সুবীর স্বীকার করে নিয়েছেন যে সুজাতার সেসময়ের ক্ষমতার অপ-ব্যবহারের ও অবৈধ হস্তক্ষেপের ক্ষমতাটাই ছিল আমেরিকারর ক্ষমতাই। সুবীর সেসব কথা স্বীকার করছে এভাবে আর লিখেছে,    its (India’s) strategic alliance with the US to take on China মানে  চীন ঠেকানোর বরকন্দাজি সুত্রে আমেরিকার সাথে ভারতের যে স্ট্রাটেজিক এলায়্যেন্স ছিল সেটাই সেসময়ের ভারতের সুজাতার ক্ষমতার উৎস। মানে এটা ব্যক্তি প্রণব মুখার্জির কোন ক্যারিসমা বলতে কিছু ছিল না। কিন্তু তবুও সুবীর এই লেখায় দাবি করেছে [India now also lacks someone like Pranab Mukherjee……… ] – আজ প্রণব বেঁচে থাকলে ভারত আমেরিকাকে দেখায় দিতে পারত, হাসিনার বিরুদ্ধে অ্যামেরিকান চাপ থেকে হাসিনাকে উদ্ধার করে দিতে পারত!
সুবীর এরপর আর নিজেকে ধরে রাখতে পারেন নাই। প্রণব মুখার্জির ক্ষমতা সম্পর্কে আরো লিখে দাবি করে বসেছেন যে ….. [প্রণব].who battled it out with the US to ask the military-backed caretaker to stand down.  মানে প্রণব এতই ক্ষমতাবান যে তিনি খোদ আমেরিকার সাথে লড়ে বাংলাদেশের  সেনাবাহিনীকে সরে দাঁড়িয়ে হাসিনাকে ক্ষমতা দিবার ব্যবস্থা করে দিতে আমেরিকাকে বাধ্য করতে পেরেছিলেন।  আর এটাই এখন মোদি সরকার হাসিনার জন্য কিছু করতে পারছেন না; কারণ প্রণব মুখার্জি এই একটাই রত্ন ছিল ভারতের, তিনি তো মরে গেছেন!!

তার মানে দাড়ালো যে প্রণব মরার পর ভারত আর হাসিনার সরকারের জন্য কিছুই করতে পারবে না। তাহলে তো ভারতের সবকথা এখানেই শেষ হয়ে যাবার কথা, নাকি?
না, সুবীর মিথ্যা বলতেছেন।  তাই এসব বলার পরেই তিনি এবার ভারতের এখনকার মনের শঙ্কা হাজির করছেন। সেই আশঙ্কা নিচে ছবি আকারে দিয়েছি।  কথাগুলো সুবীরের লেখা থেকে নেয়া। যা বাংলা করলে হয় যে, কী হবে যদি খালেদা জিয়া ক্ষমতায় এসে এতদিন যাকিছু হাসিনা সরকারকে দিয়ে চুক্তি করে ভারত পেয়ে নিয়েছে তার সবকিছু পুণর্মুল্যায়ন করে খালেদা যদি ওসব চুক্তি বাতিল করে দেন – এই হুমকির কী হবে???

কিন্তু এই আশঙ্কা কেন? হাসিনা সরকার আর ভারতের মধ্যে কী কোন আন্ডারহ্যান্ড অসম বা আনফেয়ার ডিল করা হয়েছে? সুবীর সেতাই কী পরোক্ষে স্বীকার করে নিচ্ছেন না!  এই বাক্যটা লিখে সুবীর ভৌমিক সেই আশঙ্কা তার বাংলাদেশি পাঠকের মনে নিজেই স্বগোক্তিতে প্রবেশ করিয়ে দিলেন!  যখন বাংলাদেশের বিগ মেজরিটি মানুষ বিশেষ করে তরুণদের মনে “ভারত অগ্রহণযোগ্যতা” এখন সর্বোচ্চ!  বাংলাদেশে “ভারত অগ্রহণযোগ্যতা” ও নেতি লুটেরা ধারণা এর আগে কখনও এমন তুঙ্গে উঠে নাই! এই বাস্তবতায় এটাই কী তাহলে প্রণব মুখার্জির বাংলাদেশ ডিলিং এর নতিজা নয় কী?  – প্রণবের এসব শঠতা এটা কী আসলেই ভারতের জন্য খুবই ভাল কিছু হয়েছে? ইতোমধ্যেই যা কিছু প্রকাশিত হয়ে গেছে তা আসলেই ভারতের বিপক্ষে চলে যায় নাই, যাবার কারণ নয়? মানে আমরা যেটাকে – লাভের গুড় পিপড়াতে খেয়ে গেছে অবস্থার কথা বলি ! এটা কী তাই নয়?   সুবীর ভৌমিক সহ ভারতের নীতি নির্ধারকদের জন্য ব্যাপারটা তাদের জন্য রিভিউয়ের খোরাক হতে পারে- যদি সতভাবে চিন্তা করতে পারে তবে এই ভিউ পয়েন্ট তাদেরকে আগ্রহি করতেও পারে!

কিন্তু এর পরেও ইতোমধ্যে আরো কিছু খারাপ ডেভেলবমেন্ট তৈরি হয়ে গেছে। আগামিতে কী হতে পারে তা নিয়ে সুবীর এক সার্ভে রিপোর্টের বরাতে অনেক কিছুই বলেছেন। আর এর সাথে  সুবীর ভৌমিকের মুখ দিয়ে আরও কিছু ভারতের নয়া খায়েস-ফরমায়েস হাজির হয়ে গেছে। সুবীর  হাসিনা সরকারের কাজে নয়া আরও চাহিদা হাজির করতে দ্বিধা করেন নাই। একাজে সুবীরের  নয়া উপশিরোনাম হল, হাসিনাকে যা করতে হবে [What Hasina needs to do]মানে হল, ভারত যা করল তাতে হাসিনা এখন শেষ হয়ে যাচ্ছেন; অথচ সেদিকে সুবীরের কোন দৃষ্টি নাই। বরং ভারত এখনও আছে কেবল নিজ সংকীর্ণস্বার্থ নিয়ে। তাই বলতে চেয়েছেন,  নিজ স্বার্থ ভুলে হাসিনা সরকারকে এখনও এরপরেও যা করতে হবে তার  এক তালিকা দিয়েছেন সুবীর।

এটা বেশ ইন্টারেস্টিং যে সুবিরের বরাতে আমরা জানছি যে ভারতের অবস্থান হল, বটম লাইনটা হল, “হাসিনাকে চীনের সংস্পর্শ ত্যাগ করতে হবে। কিন্তু এর সাথে যেটা বলা নাই তা হল, কেন হাসিনাকে তা করতে হবে? হাসিনার স্বার্থ বা লাভ কী এতে? এর কোন হদিস রাখেন নাই। যেন এটা ভারতের একক স্বার্থের নির্দেশ!!! ভারতের প্রেজেন্টেশন এমন সবসময় সবকিছুতে ভীষণ স্বার্থপর ও সংকীর্ণ – যেখানে সেটা হল ও মডেলটা হল কলোনিদখলদারের মডেল। যেটাপ্রথম কপি ও চালু করেছিলেন জওয়াহরলাল নেহেরু, আর তা এখনও চর্চায় ভারতের প্রধান ধারা। ব্যাপারটা সত্যিই দুঃখজনক এবং করুণার… কেন?

কারণ, সুবীর এক আজিব ও অবিশ্বাস্য কথা বলেছেন, যেন ভুতের মুখে রামনামঃ

Delhi wants to see the Awami League return to power but through a fair election
that can shut up the Western nitpickers and prevent Bangladesh’s slide
into a one-party rule that will augment Chinese influence.

সোজা ভাষায় বলছেন,  ভারত দেখতে চায় হাসিনা আবার ক্ষমতায় ফিরুক কিন্তু একটা ফেয়ার নির্বাচনের মাধ্যমে। যদিও এই ফেয়ার নির্বাচনের মানে কী  সেটা সুবীর পরিস্কেকার করেন নাই। আবার গত কোন নির্বাচন ফেয়ার হয়েছে কিনা সেটা নিয়ে ভারত কখনও কিছুই বলতে চায় নাই, পাশ কাটিয়ে গেছে, তাই এনিয়ে ভারতের কোন উদ্বেগ ছিল না। একমাত্র উদ্বেগ ছিল নিজ স্বার্থ হাসিল, তা যেভাবেই হোক। তাহলে আজ  ফেয়ার নির্বাচনের কথা কেন?  আগে (সুজাতা সিংয়ের কেসের আমলে) ফেয়ার নির্বাচন না করার ফর্মুলা দিয়ে যাওয়া –  মানে সেটা কী তাহলে ভুল হয়েছিল? বলে এখন স্বীকার করছে? যদি তাই হয় তো  ভারত কী এর দায় নিবে?
ঐ সার্ভে রেজাল্টের বরাতে সুবীর অনেক চেষ্টা করেও হাসিনার দলকে জিতবে বা সে সুযোগ আসবে তা দেখাতে পারে নাই। শুরু করেছিলেন যে হাসিনার লীগ দল 32 to 47 seats পাবে বলে।  পরে নানান শর্তে সেটা  83–117 seats হতে পারে বলেছেন। আর সবশেষে ১৪০ আসনের উপরে আর তুলতে পারেন নাই।  
কিন্তু তবু, যে ফর্মুলা দিয়েছে এর সোজা মানে, আ লীগের ভিতরে যুদ্ধ শুরু করতে হবে। অপর গ্রুপকে চীনাপন্থি নামে লেভেল লাগিয়ে তাদেরকে দলছাড়া করতে হবে। এমনকি বেচারা মোমেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী হয়ে ভারতকে স্বামী মেনেও নিজে আজ চীনাপন্থি তকমা পেয়েছেন। ভারত তার উতখাত চায়। এমন মন্ত্রণালয়ের নামও দিয়ে দিয়েছেন সুবীর এরা হল -” home, finance, foreign, information, industry, commerce, and water resources” ইত্যাদি।
এই ব্যাপারটা বা ভারতের কামনার পার্জিং [purging]; বাংলায় বললে তা দলে বিভক্তি আনতে সুপারিশ করা। অর্থাৎ ভারত এখন লীগকেই চীনাপন্থি নামে লেভেল  আরেক ভাগ করতে চায়। মানে ভারতীয় হস্তক্ষেপ কত গভীরে চলে গেছে এর চিহ্ন।  সম্ভবত এর আরো বড় চিহ্ন হল, কালবেলা পত্রিকায় আরেক প্রপাগান্ডা লেখা; যার শিরোনাম আরও মার্কিন নিষেধাজ্ঞা আসছে, প্রস্তুত সরকার এই মিথ্যা জল্পনা-কল্পনা ওয়ালা রিপোর্ট ছাপা হয়েছে।  সেই রিপোটটা আওয়ামি লীগ দলে বিভক্তি আনার আরও বিস্তারিত ভারতীয় উদ্যোগ বলে মনে করছেন অনেকে।  কারণ, আমেরিকার আরও স্যাংশন দেওয়ার আর কোন কারণই নাই। কারণ সেক্ষেত্রে স্যাংশন খেয়ে হলেও হাসিনা সরকারের জন্য তো ভালই। আর সেটা এই অর্থে যে এটা হাসিনা সরকার থেকে যেতে পারে, সে সম্ভাবনা বাড়াবে!

এখন ফিরে আবার সুবীর ভৌমিকের লেখার শিরোনাম টা মনে করা যাক  – নির্বাচনের আগে হাসিনা যেমন উত্তাপ টের পাচ্ছে দিল্লিও এক কোনায় পড়ে নিজেও তা টের পাচ্ছে।
হাসিনা সরকার একা নয়, বাংলাদেশ ইস্যুতে সাথে ভারতও চরম বিপদে পড়েছে।  সুবীর সেই দুর্দশার একাউন্টগুলো আমাদের সামনে খুলে ফেলেছেন!

+++++
গৌতম দাস
রাজনৈতিক বিশ্লেষক

Leave a Reply

Fill in your details below or click an icon to log in:

WordPress.com Logo

You are commenting using your WordPress.com account. Log Out /  Change )

Facebook photo

You are commenting using your Facebook account. Log Out /  Change )

Connecting to %s