‘ইন্দো-প্যাসেফিক স্ট্রাটেজি’ জিনিষটা কী; বাংলাদেশ কোথায়?
গৌতম দাস
২৭ মে ২০২৩
https://wp.me/p1sCvy-4vF
ইন্দো-প্যাসিফিক স্ট্র্যাটিজি: যুক্তরাষ্ট্র যেভাবে চীনকে মোকাবেলা করবে
বাংলাদেশে এখন পড়াশুনা করার চেয়ে আঁতলামো বেশি গুরুত্বপুর্ণ হয়ে গেছে। এতে আমাদের সাংবাদিক বন্ধুটাও ‘কূটনৈতিক রিপোর্টার’ বলে নিজ পরিচয়টা বোল্ড করে লিখতে যতটা আগ্রহী এর চেয়ে ঠিক এর উলটা – ততোধিক যেন তাঁর অনাগ্রহ তৈরি হয়েছে কোন দেশি বা আন্তর্জাতিক ইস্যুকে বুঝার ব্যাপারে। যেমন, ইন্দো-প্যাসেফিক স্ট্রাটেজি জিনিষটা কী অথবা কবে কোথা থেকে এলো তা আমাদের মিডিয়া নিজে বুঝেছে ও পাবলিককে কিছু স্পষ্ট ধারণা দিয়েছে, এমন জানা যায় না। কেবল ভাষাভাষা আর এমনিতেই যতটুকু যা আন্দাজে ঢিল মেরে যেটুকু যা মিলে সেটুকুতে তারা বুঝে যে, আমেরিকা কিছু একটা আমাদের সরকার থেকে চাচ্ছে! কিন্তু কী সেটা? সাংবাদিকেরা তা জানে, এমন মনে হয় না।
এর উপর আবার লেটেস্ট খবর হল, হাসিনা সরকার নাকি তার ‘ইন্দো-প্যাসেফিক স্ট্রাটেজি’ কী তা লিখে আমেরিকার হাতে দিয়েছে, জানিয়েছে। তা খারাপ না ভাল আমরা তেমন জানি না। কিন্তু, কি লিখা আছে সেখানে? অন্তত কয়েকটা বাক্যে সরকারের জবাবের সারকথাটা কীঃ অথবা ধরাযাক এছাড়া লিখতে গিয়ে সরকার কী কী অসুবিধা ও কী বাধা ঠেকছিল ইত্যাদি নিয়ে আমাদের পাঠককে সেটা আমাদের মিডিয়া জানাতে পারে নাই। এনিয়ে একমাত্র রিপোর্ট যা পাওয়া যায় তা হল বাংলা বিবিসির – সেটাই কোন কোন মিডিয়া তুলে এনে ছাপিয়ে দায় শেষ করেছে। ছাপিয়েছে। আবার কেউ কেউ আবার এনিয়ে কলাম লিখেছেন যা এতই অখাদ্য যে সেগুলো আবার বিরাট গেম বা খেলা হবে টাইপের…। তবে সকলের মধ্যেই একটা ভাব আছে যেন সরকারের ডিএসএ [ডিজিটাল সিকিউরিটি এক্ট] আইনের ভয়েই যেন তারা কিছু লিখে নাই। যা শতভাগ এক মিথ্যা কথা। কারণ সরকার প্রধান নিজেই বক্তৃতায় এনিয়ে তাঁর নিজের কথা তুলে ধরেছেন। তাই পাবলিকলি হাসিনার বলা সেসব কথাগুলোই রিপোর্ট আকারে অবশ্যই ছাপিয়ে দেয়া যেত, কোন সমস্যা ছিল না।
ঘটনা আরও আছে এনিয়ে ঢাকায় জাপানের রাষ্ট্রদুত আবার বলেছেন, ঢাকার প্রকাশিত ইন্দো-প্যাসেফিক স্ট্রাটেজি – এটা নাকি তাদের ফেবারে!!! বলেছেন “জাপানের উদ্যোগ ইন্দো-প্যাসিফিক স্ট্র্যাটেজি (আইপিএস) নিয়ে সঠিক পথেই হাঁটছে ঢাকা”। ] আবার অনেকে বলছেন, আমেরিকাও অনেকটা তেমনই ইঙ্গিত দিয়েছে বলে ধরে নেয়া যায়! বলেছে, ঢাকা সম্প্রতি তার ইন্দো-প্যাসিফিক আউটলুক (আইপিও) প্রকাশ করেছে, যার অনেক কিছুর সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের ইন্দো-প্যাসিফিক স্ট্র্যাটেজির (আইপিএস) মিল রয়েছে। পরের এই খবরটার আবার এটা যেখানেই ছাপা হোক এর মূল সোর্স হল সরকারি বাসস। এর মানে সরকার নিজেই মনে করে, এই ভাষ্যটা সঠিক! এমনকি অ্যামেরিকান বা কুগেলম্যানের ফরেন পলিসিও এমন এক রিপোর্ট ছেপেছিল।
আচ্ছা তাই যদি শেষমেশ দশা-পরিস্থিতি হয়, তাহলে ভারি মজার কথা তো!!
মানে তাহলে তো আমেরিকা হাসিনা সরকারকে ক্ষমতায় রেখেই দিবে বা দিচ্ছে নাকি – আর ঝামেলা নাই কী বলেন!!! এমন কী বলা যায় না, রিপোর্ট করে দেয়া যায় না? না আ আ … এবার আর এমন “রিপোর্টার” কাউকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না; সবাই নাকি “গোপন সব খবর” মানে স্কুপ নিউজ খুজাতেই খুবই ব্যস্ত হয়ে আছে!
আচ্ছা তাহলে আমাদের – আই আর [IR] – মানে আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর ‘ইন্টারন্যাশনাল রিলেশনস’ ডিপার্টমেন্টগুলো নিশ্চয় অনেক কিছু না হলেও কিছু জানে ও বলতে পারত! না, তাও মনে হচ্ছে না। কারণ তাদেরকে রেফার করে কোন মিডিয়ায় ত কোন নিউজ নাই! তাহলে?? আমাদের কী হবে? এই হলো আমাদের মিডিয়া!!
‘ইন্দো-প্যাসেফিক স্ট্রাটেজি’ এই জিনিষটা কীঃ
এর আদ্যোপান্ত নিয়ে খুঁটিনাটি সব নিয়ে এখানে কথা বলতে গেলে পাঠক অতি-তথ্যের ভারে হারিয়ে যাবেন। তাই এখন অল্পকথায় মুল বিষয়টা বলার চেষ্টা করব। যদিও এনিয়ে কয়েকবছর আগে আমার অন্তত একটা ছিল যেটা খুজতে এখন একটু টাইম লাগবে। তবে ইতোমধ্যে পেয়ে গেলে সেই রেফারেন্সও দিব।
‘ইন্দো-প্যাসেফিক স্ট্রাটেজি’ ইস্যুটা বুঝার জন্য সবচেয়ে ভাল মানে সহজ এপ্রোচ বা উপায় হতে পারে এই যে, খেয়াল করলে দেখব এই ইস্যুটা একটা আগাম অনুমানের উপর দাড়ায়ে আছে; সেই ধরে নেয়া অনুমানটা কী, তা যদি আগেভাগে বুঝে নেই। সে অনুমানটা হল যে, “চীন আন্তর্জাতিক রুল মানে না”। এখানে আন্তর্জাতিক রুল বলতে বুঝতে হবে জাতিসংঘের হেফাজতে থাকা নানান আন্তর্জাতিক আইন-কানুন, আন্তরাষ্ট্রীয় স্বার্থবিরোধ মিটাবার জন্য অতীতে নানান সময়ে ডাকা রাষ্ট্রগুলোর সভায় নেয়া সিদ্ধান্ত ও কনভেনশন ইত্যাদি।
এখন ‘চীন আন্তর্জাতিক রুল মানে না’ এই আগাম অনুমান যদি সত্যি ধরে নেই তবে এর ভিত্তিতে পালটা আমেরিকার নেতৃত্বে ও চীনবিরোধী হয়ে যে জোট তৈরি করতে হবে – সে দাবিই হবে ‘ইন্দো-প্যাসেফিক স্ট্রাটেজি’ ইস্যুটার মূলকথা। কারণ তাহলেই এতে সহজেই আমেরিকা চীনকে কোনঠাসা করে ফেলবে বা পারলে একঘরে করে রাখার পথে হাঁটবে – এই হল আমেরিকার মূল স্ট্রাটেজি। কিন্তু এটা আমেরিকার মূল স্ট্রাটেজি হলেও আমেরিকা ও তার বন্ধুরা “চীন আন্তর্জাতিক রুল মানে না” – এভাবে কথাটা বলতে চায় না। কথাটা তারা ভিন্ন ভাষায় বলতে চায়। তাই অনেক ঘষাঘষি ড্রাফট মুসাবিদা করার শেষে যে ভাষ্য-রূপটা দেখা যায় সেটা হল – “…advancing the common vision of a free, open, inclusive, peaceful, and secure Indo-Pacific region“ ; যার বাংলা করে বললে – একটা অবাধ ফ্রি, খোলামেলা, সবাইকে নিয়ে, শান্তিপুর্ণ ও নিরাপদ এমন কমন দৃষ্টিভঙ্গিতে – ইন্দো-প্যাসেফিক রিজিয়ন গড়ে আগানো।
এখন সবার আগে একটা কথা বলে নেই। এই যে – “advancing the common vision of a free, open, inclusive, peaceful, and secure Indo-Pacific region” – এই যে ভাষ্যটা এনেছি এটা আসলে ২০২০ সালের; এখণকার নয়। মানে বাইডেনের আগের ট্রাম্প আমলের; আর সে আমলে ট্রাম্পের শেষ বছর ২০২০ সালে তিনিও অ্যামেরিকান কংগ্রেসের সিদ্ধান্তের কারণে বাধ্য হয়েছিলেন এই ভাষ্যের অ্যামেরিকান কৌশল নিয়ে এশিয়ায়, তার স্টেট ডিপার্টমেন্টের ডেপুটি সেক্রেটারি স্টেফান বিগান [Stephen Biegun] কে পাঠিয়েছিলেন। তিনি বাংলাদেশে এসেছিলেন ১৪ অক্টোবর ২০২০; উদ্দেশ্য এশিয়ায় আমেরিকার এই স্ট্রাটেজি প্রচার করে এরপক্ষে এশিয়ার রাষ্ট্রগুলোকে দলে ভিড়ানো। এখানে লক্ষ্যণীয় যে তখন এই স্ট্রাটেজিকে ডাকা হত ইন্দো-প্যাসেফিক রিজিয়ন এর স্ট্রাটেজি বলে। যেটা এখন বাইডেন আমল থেকে সরাসরি, ” ইন্দো-প্যাসেফিক স্ট্রাটেজি” বলে ডাকা হচ্ছে। আর এছাড়া বড় ফারাক হল তখন ছিল সবাইকে আমেরিকার নিজ-স্ট্রাটেজিতে সামিল হতে ডাকার; যেজন্য ডেপুটি সেক্রেটারি স্টেফান বিগান এসেছিলেন। আর এখন বাইডেন ডাইরেক্ট একশন করতে চান; তাই এবার এটা সহকারি পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডোনাল্ড লু এর আমলে সেটা এখন হয়েছে ‘ইন্দো-প্যাসেফিক স্ট্রাটেজি’- যার মানে আর করণীয় হল এশিয়ার বিশেষ করে দক্ষিণ এশিয়ার প্রত্যেক দেশকে তার ‘ইন্দো-প্যাসেফিক স্ট্রাটেজি’ কী তা লিখে আমেরিকার কাছে জানাতে হবে। মানে হল, ঐদেশ কী “চীনকে আন্তর্জাতিক রুল মানে না” – বলে মনে করে কিনা সেটাই বলতে হবে। তবে কথাটা ঘুরায় বলতে হবে অর্থাৎ বলতে হবে ঐদেশ ইন্দো-প্যাসেফিক অঞ্চলে অবাধ ফ্রি, খোলামেলা, সবাইকে নিয়ে, শান্তিপুর্ণ ও নিরাপদ এমন দেখতে চায় কিনা।!! এদিক থেকে!
যদিও সব ততপরতার সারকথাটা হল, যেন আপনাকে আগেকার দিনের সোভিয়েত-আমেরিকা বলে কোল্ডওয়ারে বিভক্ত দুই ব্লক বা জোটের ঝগড়ার মত; তবে একালের চীনকে রুল মানে না – অথবা চীন খারাপ দেশ – এসব ট্যাগ দিয়ে যেন আপনি চীনের বদলে অ্যামেরিকান ব্লকে আপনি আসছেন কিনা – এরই ভাগাভাগির তুলে দেখানোটাই হল একালের ‘ইন্দো-প্যাসেফিক স্ট্রাটেজি’। যদিও মনে রাখতে হবে একালের ধারণাটা আরো অনেক সুনির্দিষ্ট। যেমন, আপনার দেশ নিজ অবকাঠামো এবং ডাইরেক্ট ঋণ- বিনিয়োগ সেটা চীনের থেকে নিবেন আর চীনের সাথে ব্যবসা-বাণিজ্যের রমরমা অবস্থা গড়বেন সেটা হবে না। কারণ একালে দেখাতে হবে যে চীন তো আন্তর্জাতিক সমাজে চলার দেশ না, [UNRULY] দেশ যে কোন নিয়ম মানে না, আর ঘামন্ডি বেয়ারা দেশ – একথা যদি মানেন তবে আপনি চীনের সাথে ঋণ-বিনিয়োগের সম্পর্ক, মাঙনা টিকার চালান নেয়া কিংবা ব্যবসা-বাণিজ্য এমন কোন কিছুই করতে পারেন না – এই হল ইন্দো-প্যাসেফিক স্ট্রাটেজির মূল আর্গুমেন্ট, এমন হতে হবে।
তবে বলাই বাহুল্য এসব কথাগুলো নিজ রাষ্ট্রের ‘ইন্দো-প্যাসেফিক স্ট্রাটেজি’ লেখার সময় সরাসরি চীনের নাম নিয়ে বললে অনেক কূটনীতিক বিপত্তি, ঝামেলা দেখা দিবেই। তাই চীনের নাম না ধরে বলতে হবে আর সেই স্টান্ডার্ড ভাষ্যটা হল, ইন্দো-প্যাসেফিক মহাসাগরের সাউথ চায়না সি- অঞ্চলে আকাশপথ বা সমুদ্রপথকে অবাধ ফ্রি, খোলামেলা, সবাইকে নিয়ে, শান্তিপুর্ণ ও নিরাপদ চলাচল দেখতে চায় আমার দেশ। আর এই কথাটা বিভিন্ন দেশকে বলায় নেয়াটাই হচ্ছে আমেরিকার ‘ইন্দো-প্যাসেফিক স্ট্রাটেজি’- এর সারকথা। তবে যতদিন যাচ্ছে আমেরিকা এই মূল ভাষ্যটা আরও আপডেট ও বিস্তারিত করে সাজাচ্ছে। যেমন ইউ.এস.এইড [USAID] – এটা আমেরিকার বিদেশি সাহায্যদাতা মূল প্রতিষ্ঠান। এর ওয়েবসাইটে ইন্দো-প্যাসেফিক স্ট্রাটেজি’র অনেক বিস্তারি ব্যাখ্যা পাওয়া যাবে। উপরের লাইনে আমার লালকালিতে লেখা প্রতিটা শব্দের আরো বিস্তারি ব্যাখ্যা সেখানে পাওয়া যাবে। আর সেখানে দেখবেন মূল লালকালির কথাগুলো আর ছোট করে বলা হয়েছে। যেমন লেখা হয়েছে, “Strategic Approach to the U.S. Vision for a Free, Open, and Resilient Indo-Pacific”। যদিও ব্যাখ্যা দিবার সময় তা আরো বিস্তার করা হয়েছে। পাঠকদের কেবল একটাই অনুরোধ করব যে দয়া করে এসব পাঠ করার সময় এগুলোকে – দেশের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র অথবা অ্যামেরিকান ষড়যন্ত্র বা সাম্রাজ্যবাদের ষড়যন্ত্র ইত্যাদি ট্যাগ লাগিয়ে দেখবেন না। এটা বরং গ্লোবাল নেতৃত্বের পালাবদলের যুগে চীনের বিপরীতে চীনের স্বার্থের স্ট্রাটেজির বিপরীতে আমেরিকার স্বার্থ-উদ্ধারের স্ট্রাটেজি – এজায়গা থেকে দেখা ও বুঝার চেষ্টা করলে ভাল হবে। সেখান থেকে তাহলে বাংলাদেশ কী অবস্থান নিবে, নেওয়ার সুযোগ আছে তা বুঝার লক্ষ্য নিয়ে পাঠ করতে বসতে হবে।
ট্রাম্পের আমলের ‘ইন্দো-প্যাসেফিক রিজিয়ন এর অ্যামেরিকান স্ট্রাটেজি’ হাসিনা কিভাবে ফিরিয়ে দিয়েছিলঃ
উপরে বলেছি একালে বাইডেনের আমলের ইন্দো-প্যাসেফিক স্ট্রাটেজি – সেটাকে ট্রাম্পের আমলের বলা হত ইন্দো-প্যাসেফিক রিজিয়নে অ্যামেরিকান স্ট্রাটেজি। আর সেই কাজে ডেপুটি পররাষ্ট্রমন্ত্রী স্টেফান বিগান বাংলাদেশে এসেছিলেন ২০২০ সালের ১৪ অক্টোবরে। আমি সেদিনের বাংলাদেশের ফাইনান্সিয়াল এক্সপ্রেস পত্রিকার খবরের রেফারেন্স দিয়েছে এখানে। আপনারা চাইলে এখানে অথবা এখানে আরো ওদিনের পত্রিকা দেখতে পারেন। সেদিনের রিপোর্টেই প্রথম অবশ্য, “দিল্লির চোখে বাংলাদেশকে দেখে না ওয়াশিংটন” প্রসঙ্গ উঠেছিল। স্টেফানের সফরে তিনি মূল যে প্রস্তাব নিয়ে এসেছিলেন তা হল, বাংলাদেশ যেন ইন্দো-প্যাসেফিক রিজিয়নে অ্যামেরিকান স্ট্রাটেজির সাথে এলাইন [align] হয়।
কিন্তু এই প্রস্তাবের ভিতরের আসল কথাটা কী? তা হল, বাংলাদেশ যেন চীনের সাথে ঋণ-বিনিয়োগ নেয়া বা ব্যবসা-বাণিজ্যে যুক্ত না হয় কারণ চীন যেহেতু আনরুলি [unruly] নিয়ম বা আইনের শাসন মানে না, তাই। এখন এই অ্যামেরিকান প্রস্তাব নিয়ে হাসিনা সরকারের সমস্যা হল, সে ২০১৬ সাল থেকে চীনের অবকাঠামো ঋণ, বিনিয়োগ আর ব্যবসার উপর নিজ অর্থনীতি দাঁড়িয়ে আছে। তার মুখ দিয়ে অনবরত উন্নয়নের বুলি বের হচ্ছে। কারণ, বিপুল অবকাঠামোর নির্মাণের জন্য বাংলাদেশে ঋণ যোগাড় করতে হবে – সে বিপুল খামতিতে আছে আর তা দেওয়ার ক্ষেত্রে বিশ্বব্যাংক অপ্রতুল, এছাড়া আমেরিকা সে একক দাতা বলে ভারসাম্য তার দিকে তার ইচ্ছাই সব ইচ্ছা – এভাবে জন্ম থেকে পরের সত্তর বছর এভাবেই চলেছে। কাজেই চীনকেই হাসিনার দরকার; বিশেষ করে আবার হাসিনার নিজদলের কর্মীদের আনুগত্য-লোভ ঠিক রাখতে গেলে এমন বিপুল ঋণ-বিনিয়োগের কিছু অংশ তাদের পিছনে ঠিকাদারি বা সরাসরিভাবে ব্যয় সম্ভব। আবার চীনা ঋণের প্রকল্পের টেন্ডার হয় না। কাজেই এই ইলাহি-রাজ-রাজারার কারবার ব্যবস্থা চীনের সাথে বিশেষ সম্পর্কের জন্যই সরকারের পক্ষে সম্ভব হয়েছে। উল্টাদিকে যদি তা চীনের হাত ছেড়ে দেয় তবে আমেরিকা নিজে বা বিশ্বব্যাংক এর মাধ্যমে কী চীন যেভাবে ঋণ-বিনিয়োগ ও বাণিজ্য দিচ্ছে এর নামমাত্র কিছু অংশ দিতে পারবে – আমেরিকা কী এক্ষেত্রে চীনের তুল্য না হোক নুন্যতম বিকল্প? এককথায় এর জবাব হল, না। আমেরিকার সেসক্ষমতা শুকিয়ে গেছে।
আর সবচেয়ে বড় কথা আমেরিকার স্ট্রাটেজিই তো ছিল ভুল। কারণ ২০১২ সালে এি কৌশল শুরু হবার পর থেকে এটা বহুবার আমেরিকা ঢেলে সাজিয়েছে নতুন নামে। কিন্তু সবসময় এই কথিত ইন্দো-প্যাসেফিক রিজিয়নে অ্যামেরিকান স্ট্রাটেজি সামরিকতা নির্ভর করে সাজানো হয়েছে। সেখানেও বাস্তবতাহীনভাবে ধরে নেয়া হয়েছে যে পুর্ব থেকে দক্ষিণ এশিয়া (যার কল্পিত কেন্দ্র হল সাউথ চায়না সি) এই সারা অঞ্চলের দেশগুলোর চীনের সাথে অমীমাংসিত সমুদ্রসীমা আছে তাই এই ইস্যুতে নিরাপত্তার অভাব আছে। কাজেই আমেরিকা সহজেই এসব দেশকে চীনের বিরুদ্ধে নিজেকে প্রটেকশন দাতা করে নিয়ে দাড়াতে পারবে বলে অনুমান করেছে। তাই দেশগুলো সহজেই আমেরিকার নিরাপত্তা নৌকায় উঠে পড়বে, এই ছিল আমেরিকার অনুমান। এই ছিল আমেরিকার গভীর অনুমান; কিন্তু একেবারেই অকেজো অনুমান!!! এজন্যই ওবামার ২০১২ সালের স্ট্রাটেজির নাম ছিল এশিয়া পিভট [PIVOT]. পিভট মানে দাড়িপাল্লায় দুই পাল্লা যে দন্ডের দুই মাথায় ঝুলে থাকে সেই দন্ডের ঠিক মাঝখানের বিন্দু হচ্ছে পিভট। পাল্লার একদিকে চীন আর অন্যদিকে চীনের থেকে নিরাপত্তার অভাব বোধ করবেই ধরে নেয়া এমন দেশগুলো – এভাবে দুইপাল্লার মাঝখানে পিভট হয়ে বসবে আমেরিকা আর সে বানরের পিঠাভাগ করার ভুমিকায় নেমে যাবে।
কিন্তু কেন অ্যামেরিকান এমন কল্পনাঃ
কারণ চীনের ভৌগলিক অবস্থান; – চীন মূলত তার সাড়ে তিনদিক পাহাড় বা ভুমিতে ঘেরা এক ভুখন্ড। ওর কেবল উত্তরপুবদিক দিয়েই সমুদ্রপথে চীনে প্রবেশ বা বের হওয়া সম্ভব। আবার মূল ডাঙ্গা ভুখন্ড থেকে বের হলেই সামনে ক্রমশ কোন এক মহাসাগর তা নাই। যেমন বাংলাদেশ থেকে সমুদ্রপথে বের হলে বঙ্গোপসাগর ছেড়ে সামনে আগালে তা ক্রমশ গভীর মহাসাগরের নাগাল পাবে। কিন্তু চীনের ক্ষেত্রে তেমন নয় বরং চীন থেকে বের হলে সামনে চীন সাগরের চার পাশে অনেক দ্বীপ-ভুখন্ড যেগুলো নানান রাষ্ট্র যারা চীনের পড়শি দেশ। ফলে প্রায় সবার সাথেই সমুদ্রসীমা এনিয়ে বিতর্ক আছে এবং এতা খুবই স্বাভাবিক। আমাদের সামনে মানে আমাদের সমুদ্রপথের ডাইনে বামে না সামনে আর কোন দেশ-ভুখন্ড নাই। আমাদের ডাঙ্গা থেকে সমুদ্রে যাবার পথে ডাইনে ভারত বামে বার্মা আছে তাতেই আমাদেরকে জাতিসংঘের [UNCLOS – United Nations Convention on the Law of the Sea] এই সালিশি প্রতিষ্ঠানের কাছে যেতে হয়েছিল – বিতর্ক-মারামারি না করে দুই পড়শিদের সাথে আপোষে মাপামাপির সমাধান পেতে। কাজেই চীন যার সমুদ্র-অঞ্চলের চারদিকে ভিনদেশের-ভুখন্ড তার কী অবস্থা তা অনুমেয়।
আমেরিকা অনুমান করে নিয়েছিল চীনের এই ভৌগলিক অবস্থানের কারণে চীনের সাথে পড়শিদের সংঘাত তো আসন্ন হবেই! কিন্তু না, বাস্তবতা সেপথে হাটে নাই, ঘটনা হয়ে যায় ভিন্ন। তার আগে চীনের পড়শি কারা কেমন রাষ্ট্র তারা? এর এক বড় অংশই হল আসিয়ান (ইস্ট-তিমুর যোগদান ছাড়া একে বাদ রাখলে আসিয়ান এটা দশ রাষ্ট্রীয় মূলত এক অর্থনৈতিক জোট) জোটের সদস্য। আর অর্থনীতিক দিক থেকে যারা মধ্যম আয়ের, তবে বাংলাদেশের চেয়ে উপরে অবস্থান। সম্ভবত অর্থনৈতিক জোট হবার কারণে তাদের কমন অবস্থান চীনবিরোধী অ্যামেরিকান ইচ্ছা অনুসারের এক আসিয়ান এমন হয় নাই। বরং জোটের দেশগুলো তাদের অর্থনৈতিক স্বার্থকে সবার উপরে রেখেছে। তাই তাদের চীনের সাথে সমুদ্রসীমা বিতর্ক থাকলেও তা মিটানোর জন্য তারা আমেরিকার সাহায্য-সহায়তার জন্য দারস্থ হয় জোট তা চায় নাই।
এর কারণ এক. তারা চায় নাই যে চীন-আমেরিকার সামরিক টেনশন বা স্বার্থঝগড়ার সমাধান তা আসিয়ান কোন দেশের কাঁধে বন্ধুক রেখে সম্পন্ন হোক। দুই. এটা ছিল প্রথমটার চেয়ে অনেক বেশি নির্ধারক। অনেকের হয়ত জানেন যে বিশ্বব্যাংক আপার [upper] মধ্যম আয়ের সদস্য দেশের (যে দেশের গড় মাথাপিছু হিশাবে আয় ৪০৪৫ ডলারের বেশি এই ক্যাটাগরি্তের দেশের) জন্য ঋণ পেতে কাজে লাগে না। কারণ, বিশ্বব্যাংক মূলত জোর দেয় এমন সদস্য রাষ্ট্রগুলোর দিকে যাদের মাথাপিছু গড় আয় একহাজার ডলারের নিচের। তাই যেকোন অবস্থায় এমন দেশগুলোকে বিশ্বব্যাংক নিজের আইডিএ (IDA) স্লট বলে, এই ক্যাটাগরিতে ঋণ দেয় যেটাদের সুদের হার মাত্র ০.৭৫%, আর যেটাতে ঋণশোধের জন্য ৪০ বছরের মত লম্বা সময় দেয়। যাতে খাতক দেশের ঋণশোধের কিস্তির চাপ কম হয়। বিশ্বব্যাংকেই এই IDA ক্যাটাগরি ছাড়াও এর উপরে আরেকটা ক্যাটাগরিতে ঋণ দেয় যাদের আয় লোয়ার [lower] মধ্যম আয়ের শুরু্তের দিকের; মানে যারা গড় মাথাপিছু ১০৩৬ ডলারের উপরে চলে গেছে কিন্তু তা এর আপার লিমিট ৪০৪৫ ডলার এই প্রান্ত দিকে যায় নাই। তাদেরকেও বিশ্বব্যাংক লোন দেয় কিন্তু এবার সুদের হার ২% এর উপরে। তাই এর উপরের মাথাপিছু আয়ের দেশগুলার কাছে ঋণ পাবার ক্ষেত্রে বিশ্বব্যাংক কোন কাজে লাগে এমন প্রতিষ্ঠান নয় হয়ে আছে। একারণেই ২০১৩ সালে যখন চীনা সিঙ্ঘভাগ মালিকানার চীনা হাতে থাকা – ও বিশ্বব্যাংক সমতুল্য প্রতিষ্ষ্ঠানের [AIIB] জন্ম দেয় তখন চীন AIIB ব্যাংককে আপার [upper] মধ্যম আয়ের খাতক দেশগুলোকে টার্গেট করে সাজিয়ে নিয়েছিল। অর্থাৎ এদুই কারণে আসিয়ান দেশগুলোর কাছে অর্থনৈতিক বিচারে চীনের আলাদা বিশেষ মূল্য আছে। তাতে চীনের সাথে তাদের সমুদ্রসীমা নিয়ে অমীমাংসেয় ইস্যু আছে – সেটা সত্বেও। কিন্তু অর্থনৈতিক ইস্যুতে চীন তাদের কাছে সাহায্যকারি দেশ তাই, চীনের সাথে অর্থনৈতিক সম্পর্ক তাদের কাছে প্রায়রিটি ইস্যু হয়ে থাকে যায়। তবে এটা তাদের সমুদ্রসীমা নিয়ে দাবি্কে কোনই ছাড় দেয়াও নয়।
সবমিলিয়ে তাই ওবামা আমলেই ২০১৫ সালে এটা পরিস্কার হয়ে যায় যে আমেরিকার পিভোট স্ট্রাটেজি অকার্যকর। কিন্তু ইতোমধ্যেই আমেরিকা যেখানে যা বিনিয়োগ করেছিল তাও পানিতে চলে যায়। যেমন আমেরিকা অষ্টেলিয়াতে একটা নিজ সামরিক ঘাটি বানিয়েছিল যেটা নির্মাণের পরে ২০১৬ সালে চালু করা হয়, তাও তেমন কাজ আসে নাই। পরবর্তিতে ২০১৭ সালের আগে ইন্দো-প্যাসেফিক অঞ্চলে অ্যামেরিকান নতুন করে কোন নয়া স্ট্রাটেজি চালু হতে পারে নাই। কোয়াড [QUAD] নামে চারদেশীয় নয়া উদ্যোগ সেবারই নিজ জন্মের দশ বছর পরে চালু করা হয়েছিল। কিন্তু ঐ ২০১৭ সালেই তা চারদেশ এক সাথে একই ভাষায় কোন বিবৃতিও দিতে পারে নাই। কারণ ঐ চারদেশের প্রত্যকেই চীনের দেয়া বিশেষ ব্যবসায়িক সুবিধা ভোগ করে বসে ছিল বলে কারও কলম উঠে নাই। ট্রাম্পের মিড-টার্মের (২০১৮) পরে বিশেষত শেষ বছর ২০২০ সালে নতুন করে “ইন্দো-প্যাসেফিক রিজিয়নে” অ্যামেরিকান স্ট্রাটেজি চালু হয়েছিল। আর এরই পরের রূপ হয় ২০২১ সাল থেকে বাইডেনের ইন্দো-প্যাসেফিক স্ট্রাটেজি -এই নামে।
আর হাসিনা ২০২০ সালে স্টেফান বিগিন-কে খাড়া ভাষায় বলেছিল, আমরা কোন যুদ্ধজোটে বা এর কোন পক্ষে যাবো না। বরং আপনাদের যদি ঋণদান প্রকল্প থাকে যেমন চীনের বেল্ট-রোড ধরণের তবে পরে আইসেন। ফলে স্টেফান বিগিন হাসিনার উপর কোন চাপ বা ছাপ ফেলতে পারে না। সম্ভবত এখান থেকেই ইন্দো-প্যাসেফিক স্ট্রাটেজি নিজের অধীনে IPEF [Indo-Pacific Economic Framework] নামে অবকাঠামো ঋণদানেরও এক প্রতিষ্ঠান চালুর চেষ্টা করেছিল যেটা এখনও অসমাপ্ত, প্রস্তুতির ভিতরেই আছে। চালু হতে পারে নাই। কিন্তু বাইডেন প্রশাসনইন্দো-প্যাসেফিক স্ট্রাটেজি নামে প্রচন্ড চাপ সৃষ্টি করা ও সবাইকে নিজ নিজ স্ট্রাটেজি দেখাতে বলাতে এবারই প্রথম হাসিনা সরকার তা করতে বাধ্য হয়েছিল।
তাহলে আমাদের সরকার নিজের ইন্দো-প্যাসেফিক স্ট্রাটেজি বলে যা প্রকাশ করেছে (যার নাম দিয়েছে ইন্দো-প্যাসেফিক আউটলুক) সেখানে কী আমাদের সরকার চীনের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছে, নিন্দা করেছে??? নাহলে, জাপান কেন বলল সঠিক পথেই হাঁটছে ঢাকা আর ওদিকে আমেরিকা বলল, তারা নাকি আমাদের কৌশলপত্রের সাথে যুক্তরাষ্ট্রের ইন্দো-প্যাসিফিক স্ট্র্যাটেজির (আইপিএস) অনেক মিল পাইলো! কেন?
এমাসেই ইন্ডিয়ান ওশেন কনফারেন্সে ভারতকে উপরে তুলে ধরতে এটাতে বাংলাদেশ হোস্ট হয়েছিল। কিন্তু এটা এতই অগোছাল ছিল যে অংশগ্রহণকারি দেশ মানে বক্তৃতার বক্তারা সবাই একই প্রসঙ্গে কথা বলতে পারে নাই। যে যেটা পেরেছে সে প্রসঙ্গে কথা বলেছে। যেমন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী বাংলাদেশের ইন্দো-প্যাসেফিক আউটলুক এখানে কী অবস্থান নিয়েছেন তা নিয়ে নিজেই বক্তৃতায় বলেছেন। তো সরকার প্রধান ঐ বক্তৃতায় বলেছেন, “……ভারত মহাসাগরে সামুদ্রিক নিরাপত্তা এবং নিরাপত্তার বিষয়ে বিদ্যমান ব্যবস্থা জোরদার করার প্রয়োজনীয়তার ওপর জোর দেন এবং আন্তর্জাতিক আইন অনুসারে নৌচলাচল ও ওভারফ্লাইটের স্বাধীনতার অনুশীলনকে সমুন্নত রাখার আহ্বান” জানান।
এছাড়া আরেক স্থানে বলেছেন, এ অঞ্চলে শান্তিপূর্ণ, ন্যায়সঙ্গত ও অন্তর্ভুক্তিমূলক সমাজ গঠনের জন্য …ইত্যাদি। এখন এর মানে কী এর মাধ্যমে মানে আন্তর্জাতিক আইন অনুসারে নৌচলাচল ও ওভারফ্লাইটের স্বাধীনতারঅনুশীলনকে সমুন্নত রাখার” কথা বলে হাসিনা চীনের প্রতি কী নিন্দা জানিয়ে ফেললেন?? অবশ্যই নয়। তাহলে আন্তর্জাতিক আইন অনুসারে নৌচলাচল ও ওভারফ্লাইটের স্বাধীনতার… পক্ষে কথা বললেন যে? তবুও তাতেও এটা চীনের নিন্দা আর আমেরিকার পক্ষে দাঁড়ানো নয়; হয় নাই। কেন?
আন্তর্জাতিক আইন অনুসারে নৌচলাচল ও ওভারফ্লাইটের প্রসঙ্গের মধ্যে এখানে আন্তর্জাতিক আইনবলতে বুঝতে হবে জাতিসিংঘের হেফাজতখানার দলিলে যা আছে। তো সেকথা উচ্চারণ করাতে জাতিসংঘের কোন সদস্য দেশের এতে কোনই অসুবিধা নাই। এমনকি এই কথাগুলো চীনও যদি তাদের কোন বিবৃতিতে উল্লেখ করে তবু সেটা চীনের বিপক্ষের বক্তব্য বলে মনে করা যাবে না। কারণ এই বক্তব্যে লেখা নাই যে “আন্তর্জাতিক আইন অনুসারে নৌচলাচল ও ওভারফ্লাইটের স্বাধীনতার কথা যা বলা আছে তা চীন বা অন্য কোন দেশ লঙ্ঘন বা ভায়োলেট করেছে। তাই এটা চীনের বিরুদ্ধের বলা কোন বক্তব্যই নয়।
কিন্তু একালে স্টেফান বিগিন-কে বাংলাদেশের হাসিনা কখনও “নৌচলাচল ও ওভারফ্লাইটের স্বাধীনতা” নিয়েই কিছু বলেন নাই। তিনি স্টেফান-কে বলেছিলেন, এসব যুদ্ধের অস্ত্র বেচা বা পক্ষ-বিপক্ষে অবস্থান নিবার কথা তিনি যা বলছেন যা নিয়ে বাংলাদেশ আগ্রহি নয়। বরং অবকাঠামো ঋণ নিয়ে আমেরিকা যদি বিতরণ করা শুরু করে, তখন তারা নক দিতে পারে সেটা দিয়েন কিন্তু এখন যান……। কিন্তু এবার বাইডেন-লু এর আমলে তিনি আরেকটু আগিয়ে বলেছেন আন্তর্জাতিক আইন অনুসারে নৌচলাচল ও ওভারফ্লাইটের স্বাধীনতা থাকার কথা আছে। তবে এর সাথে আবার এমন কোন কথা বলা হয় নাই যে চীন এটা অবমাননা করেছেন – তাতে আমেরিকা মনে করতে পারে যে তার উপস্থাপিত ইস্যু হাসিনা গ্রহণ করেছে অবশ্যই। কিন্তু এর সাথে চীনকে কোনই নিন্দাবাক্য জানায় নাই। ফলে এই মূল জায়গায় হাসিনা সরকার আগের ভুমিকাতেই আছে। মাএ হাসিনা সরকারের ইন্দো-প্যাসেফিক আউটলুকে চীন প্রসঙ্গে অবস্থান আগের মতই আছে। এটাই ফাইনাল অবস্থান!
তাহলে সারকথাটা হল, হাসিনা সরকারের আমেরিকার বিরুদ্ধে সোজা খাড়ায় যাওয়া না হোক – অন্তত আমেরিকার পক্ষে দাঁড়িয়ে চীনকে দেখা বা চীনকে আমেরিকার স্টাইলে নিন্দা করা -এগুলো কিছুই না করেও টিকে ছিল। যার সোজা মানে হল আমেরিকার কথা না শুনে চীনের সাথে অবকাঠামো ঋণ বা চীনা বিদেশি বিনিয়োগ নেয়া এবং অবাধে চীনের সাথে ঘোরতর ব্যবসা-বাণিজ্যের সম্পর্ক গড়ার কাজ চালিয়ে যাওয়া সবই করেছিল বা এখনও করছে। কিন্তু এই অর্জন পাবলিকের অর্জন হতে পারল না। পাবলিকের অর্জন বলে হাসিনা পাবলিকের অনুমোদন প্রশংসা লাভ সেটা করতে পারছে না কেন? এক অ্যামেরিকান “ভিসা দেয়া হবেনা” – উলটা চোর আর নাগরিকের মৌলিক অধিকার ভঙ্গকারিদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক পদক্ষেপ নিবে আমেরিকা একথাটা সদর্পে বলেই বরং খোদ আমেরিকাই বাংলাদেশের পাবলিকের কাছে হিরো হয়ে গেছে। এমনটা আজ কেন হল? মূল কারণ, হাসিনার বিরুদ্ধে অভিযোগ তো সঠিক! এটা পাবলিক মনে করে। আর এরই প্রকাশ তো আমেরিকার পক্ষে হাততালি! দেখেন ২০১৪ আর ২০১৮ সালে দুইদুবার নির্বাচনে হাসিনার চরম অস্বচ্ছতায় নিজেকে জবরদস্তিতে বিজয়ী ঘোষণা করে আনার সুখ – এটা দশবছরের জন্য ক্ষমতা পেয়ে যাবার সুখ নিঃসন্দেহে সীমাহীন! আবার ওদিকে চীনের সাথে বিলিয়ন বিলিয়ন ডলারের প্রকল্প পাস যার কোন ওপেন টেন্ডার হয় না, জি-টু-জি বা সরকার-সরকারে চুক্তির নামে ওপেন কোন টেন্ডার না করেই প্রকল্পমুল্য ইচ্ছামত লেখা গেছে সেখানে, অর্থ লুট আর ভাগবাটোয়ারা করা যায় – এমন কাজের সুখ সীমাহীন, তা বলাই বাহুল্য!
কিন্তু সেসবেরই কাফফারা দিতে হচ্ছে এখন। অ্যামেরিকান পক্ষে বাংলাদেশে পাবলিক ইমেজ বাংলাদেশে কখনই তেমন উজ্জ্বল নয়, ছিল না। তা সত্বেও এখন অ্যামেরিকান ভিসা দেয়া হবেনা বলাতে কমন মানুষ হাততালি দিচ্ছে মানে ঐ আমেরিকাকেই অন্তত এখনকার জন্য ত্রাতা ভাবছে – মানে কে দেশী আর কে বিদেশি এদিক দিয়ে আর দেখছে না এটা মারাত্মক ডেনজারাস হয়ত – কিন্তু হাসিনার চরম পরাজয় এখানেই! কারণ সে জনবিচ্ছিন্ন! আর কতটা জনবিচ্ছিন্ন তা – ভিসা দেয়া হবেনা – বলাতে জনউল্লাস দেখে সকলেরই বুঝতে পারা সম্ভব!
এককথায় বললে কূটনীতিতে হাসিনা আমেরিকার বিরুদ্ধে সফল ফাইট দিতে দাঁড়াতে পারলেও চীনের সাথে “চুরির সম্পর্কে অস্বচ্ছ সম্পর্কে” জড়িয়ে যাওয়াতেই – হাসিনার এসব অর্জনকে পাবলিক এনডোর্স [endorse] বা অনুমোদন করছে না, পাচ্ছে না। পাবলিক এসবকে নিজের অর্জন মনে করতে চাচ্ছে না। গুম-খুনের অভিযোগ-দাগের এই হল কাফফারা! আবার নিন্দনীয় কমিউনিস্ট কায়দায় সিপিবি এই অন্যায় টাকে বিবৃতি দিয়ে সাফাই গাইতে গেছে। এটা নাকি ” অ্যামেরিকান হস্তক্ষেপ” – এই বলে চালিয়ে দিবার চেষ্টা করেছে। তাহলে তো হিটলারের বিরুদ্ধেও আমরা তো বাইরের লোক তাই আমাদের কিছু বলার সুযোগ নাই। কারণ সেটা সার্বভৌম জর্মান সরকারের বিরুদ্ধে “বাইরের হস্তক্ষেপ” হয়ে যাবে, তাই কী!!!! কোনটা দালালি আর কোনটা রাজনীতি তা ফারাকের বোধশক্তিহীন এরা!
আবার বাংলাদেশে যারা আমেরিকা আমাদেরকে আগের মত ফেলে চলে যাবে অথবা হাসিনা-আমেরিকা আপোষ হয়ে যাবে, হাসিনাকে ক্ষমতায় রেখে দিবে ইত্যাদি বল ও অবস্থান নিয়েছিল – তারা এখন থেকে ভুল বলে আপাতত প্রমাণিত হয়ে গেল। হাসিনা-আমেরিকা আপোষের জায়গা নাই হয়ে গেল বা কোন ঘনিষ্ট সম্পর্কে থাকার সম্ভাবনা শেষ হয়ে গেল! অ্যামেরিকান ভিসা দেয়া হবেনা একথার সার অর্থ এটাই!
সবশেষে, আমার কথ আনা বিবিসির; বিবিসি লিখেছে, “ভারত এবং প্রশান্ত মহাসাগর অঞ্চলে যুক্তরাষ্ট্রের যত মিত্র দেশ আছে, এই ইন্দো-প্যাসিফিক স্ট্রাটেজিতে তাদেরকে একটি চীন-বিরোধী জোটে জড়ো করতে চায়। এই জোটের অনেক ধরণের লক্ষ্য আছে- সামরিক, অর্থনৈতিক, প্রযুক্তিগত এবং কূটনৈতিক”।
আর এজন্যই চীনের অবস্থান নিয়ে বলছে – সুনির্দিষ্ট কোন একটা দেশকে টার্গেট-বিরোধিতা করে বা তাকে বাইরে রেখে দুনিয়াতে কোন একটা জোট গঠন করা কী জায়েজ, এটা কেমন ততপরতা?
“ভারত এবং প্রশান্ত মহাসাগর অঞ্চলে যুক্তরাষ্ট্রের যত মিত্র দেশ আছে,
এই ইন্দো-প্যাসিফিক স্ট্রাটেজিতে তাদেরকে একটি চীন-বিরোধী জোটে জড়ো করতে চায়।
এই জোটের অনেক ধরণের লক্ষ্য আছে- সামরিক, অর্থনৈতিক, প্রযুক্তিগত এবং কূটনৈতিক। “– – – – – –
হা, এই প্রশ্ন আমাদের নাগালের মধ্যে থেকে বেশি তুলেছেন বাংলাদেশে চীনের রাষ্ট্রদুতেরা। এই জায়গায় আমেরিকা বেশ গুটিয়ে আছে জবাবহীন হয়ে!
শেষ করার আগে জানিয়ে দেই আমি ঐ প্রশ্নের জবাব নিয়ে আর লিখি নাই। সেটা হল, যে এজাম্পশন [assumption] এর উপর আমেরিকা দাড়িয়েছে যে সে অনুমানটা হল যে, “চীন আন্তর্জাতিক রুল মানে না”। – এই অনুমান টা আমেরিকার কেন হল? প্লাস এটা কতদুর সত্য-মিথ্যার চেয়ে কেন আমেরিকা এই অবস্থান নিল সেটা বুঝা বেশি জরুরি – এভাবে নেওয়াই উপযুক্ত হবে। সেজন্য এনিয়ে একেবারেই এখানে আগাই নাই, টাচ করি নাই। সেটা শুরু করলে এওলেখার আয়তন দ্বিগুণ হয়ে যেত। তাই এই প্রসঙ্গ নিয়ে আলাদা করে লিখতে হবে। পরে হয়ত সবগুলো জুড়ে একটা বই করা যেতে পারে। তবে ব্যাপারটা গুরুত্বপুর্ণ আর এই ইস্যুতে চীন-আমেরিকার রেষারেষির শুরু কম করে হলেও ২০০৮ সাল থেকে। সেসব দলিল দস্তাবেজ যার কিছু আমার সংগ্রহে আছে তা পাবলিকের সামনে আনতে হবে। পরবর্তিতে তা করতে হবে। আপাতত এখানেই শেষ!
আপডেটেডঃ ২৭ মে ২০২৩ সকাল ১১ঃ ২৯
+++++
গৌতম দাস
রাজনৈতিক বিশ্লেষক
পিনাকী ভট্টাচার্য তো দেখি অনেক সময় আপনার লেখা থেকে রসদ নিয়ে ভিডিও বানায়।
LikeLike