গ্লোবাল অর্থনৈতিক ব্যবস্থাটা প্রাতিষ্ঠানিক নিয়ন্ত্রণে আসে কবে থেকে


গ্লোবাল অর্থনৈতিক ব্যবস্থাটা প্রাতিষ্ঠানিক নিয়ন্ত্রণে আসে কবে থেকে

গৌতম দাস

  আগস্ট ৩১, ২০১৮, 00:0২

https://wp.me/p1sCvy-2tv

 

 

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের (১৯৩৯-৪৫) মূল তাত্পর্য কী?  এই প্রশ্নের জবাবে দক্ষিণ এশিয়ায় মানুষজনের মধ্যে এক অদ্ভুত মনোভাব লক্ষ্য করা যায়। এই যুদ্ধে হিটলার-মুসোলিনির ‘অ্যাক্সিস পাওয়ার’ বা ‘অক্ষশক্তির’ কথা সবাই ঠিক ঠিকই জানে। কিন্তু এই শক্তির বিপরীতে কথিত মিত্রবাহিনীতে প্রভাবশালী রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে প্রধান ভূমিকায় কে ছিল— আমেরিকা না ব্রিটেন? এ প্রসঙ্গে ভারতীয় উপমহাদেশীয় ধারণা হলো, এটা ব্রিটেন। অথবা একই কথা আরেক প্রশ্ন করে যদি জিজ্ঞাসা করা হয় যে, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে আমেরিকার ভূমিকা কী? মানে কেমন ছিল? সেটা কি গুরুত্বের দিক থেকে ব্রিটেনের ভূমিকার চেয়ে খাটো বা নিচে? এরও একই জবাব হবে — আমেরিকান ভুমিকা ছিল ব্রিটেনের চেয়ে নিচে। এছাড়া এ কথাগুলো বলার সঙ্গে সঙ্গে তারা তখনকার ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী উইন্সটন চার্চিলের নেতৃত্ব ও নানা গুণের কথা তুলে প্রশংসাও শুরু করবে।

কিন্তু এগুলো একেবারেই ডাহা অসত্য তথ্য। ফ্যাক্টস হল, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধকে কেউ যদি নিজেদের পরিকল্পনামাফিক গ্লোবাল মেরুকরণ (অক্ষশক্তি বনাম মিত্র) করে একে পরিণতি ও পরিসমাপ্তির দিকে নিয়ে গিয়ে সফল হয়ে থাকে, তবে সেটা আমেরিকা ও এর সে সময়ের প্রেসিডেন্ট রুজভেল্ট করেছেন। এর সমস্ত ক্রেডিট তাঁর ও তাঁর সহযোগীদের। আসলে আমাদের ভারতীয় উপমহাদেশে কলোনি প্রভু ব্রিটিশদের বাইরে “পশ্চিম” বলতে আর কেউ আছে বলে আমরা সে সময়ে খুব কমই জানতাম। আর কাউকে আমরা চিনতামই না। বৃটেন মানে যদি বড়জোড় ইউরোপের ধরি তবে এর বাইরে আমেরিকা কী, কোথায়, কী তার বৈশিষ্ট, কেমন রাষ্ট্র সেটা ইত্যাদি এত সব নিয়ে আমাদের শিক্ষিতজনদেরও কোন আগ্রহ ছিল না।

শিরোনাম যেভাবে দেয়া হয়েছে, তাতে যা বলতে চেয়েছি, এক. দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের আগে “গ্লোবাল অর্থনীতিক ব্যবস্থা” বলে কোন কিছুর অস্তিস্ত ছিল না বললেই চলে। অন্য ভাষায় গ্লোবাল অর্থনীতিতে “গ্লোবাল পণ্য  বিনিময় ব্যবস্থা” বলতে কিছু ছিল না বললেই চলে।  দুই. গ্লোবাল মুদ্রা ব্যবস্থা ছাড়া গ্লোবাল পণ্য বিনিময় অসম্ভব। সেকালে কোন গ্লোবাল বা বহুরাষ্ট্রীয় পরিচালিত আইএমএফ এর মত কোন প্রতিষ্ঠান ছিল না, ফলে গ্লোবাল কোন মুদ্রা ব্যবস্থা ছিল না। ফলে স্বভাবতই বাস্তবে একটা “গ্লোবাল পণ্য বিনিময় ব্যবস্থা” অসম্ভব ছিল। তিন. পণ্য বিনিময়ও ছিল খুবই সীমিত এবং তা কেবল কলোনি প্রভু (যেমন বৃটেন) দেশের সাথে তার কলোনি দেশের (বৃটিশ-ইণ্ডিয়া) মধ্যে। তাও সেটা মূলত একপক্ষীয় কেবল কলোনি দেশ থেকে প্রভুর দেশে লুটের আয় যাওয়া।   ফলে আইএমএফের মাধ্যমে (ভাল অথবা খারাপ তা যেটাই হোক) – প্রথম প্রাতিষ্ঠানিক নিয়ন্ত্রণে আসে গ্লোবাল অর্থনৈতিক ব্যবস্থা। একটা গ্লোবাল অর্থনৈতিক ব্যবস্থা কায়েম হয় অর্থাৎ একট গ্লোবাল পণ্য বিনিময় ব্যবস্থা বিকশিত ও তা বাস্তবায়িত হয়। আরও স্পষ্ট করে বললে, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের আগে মানে কলোনি যুগে, ফাংশনাল যে অর্থনৈতিক ব্যবস্থা ছিল এর উপর কোন রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণই ছিল না। রাষ্ট্রীয় মালিকানার কোন ব্যংকের ধারণাই ছিল না। ফলে সেন্ট্রাল ব্যাংক (বাংলাদেশ ব্যাংক যেমন) বলে কোন ধারণাও ছিল না।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের তাত্পর্য এক: কলোনি যুগের অবসান
কলোনিয়ালিজম বা উপনিবেশবাদের ছুটির ঘণ্টা বাজে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ থেকে। এই বিচারে, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের আগ পর্যন্ত সময়কালকে কলোনি যুগ বলা যায়। আর ১৯৪৫ সালে বিশ্বযুদ্ধের পরিসমাপ্তি পর থেকে উপনিবেশ-উত্তর স্বাধীন রাষ্ট্রের যুগ শুরু হয়েছিল। ফ্যাক্টস দেখে অনেকে তর্ক তুলতে চেষ্টা করতে পারেন, এশিয়ায় কলোনিমুক্ত স্বাধীন রাষ্ট্রের অভ্যুদ্বয় – তা হতে শুরু হওয়া  মোটাদাগে পঞ্চাশের দশকে ঘটনা ফেনোমেনা। যদিও ১৯৭৫ সালে ভিয়েতনাম, লাওস, কম্বোডিয়া সম্ভবত এমন অভ্যুদ্বয়ে সব শেষের দিকের ঘটনা। ওদিকে আফ্রিকায় একইভাবে বেশির ভাগ কলোনি-রাষ্ট্র স্বাধীন হয় ষাটের দশকের শেষের দিকে, অল্প কিছু সত্তরের দশকে আর সর্বশেষ সম্ভবত দক্ষিণ আফ্রিকা, ১৯৯৪ সালে। লাতিন আমেরিকা এরকমই ষাট-সত্তরের দশকের মধ্যে বেশির ভাগ স্বাধীন হয়েছিল। তাহলে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের আগে পর্যন্ত উপনিবেশ যুগ আর পরে সমাপ্তিতে মুক্ত স্বাধীন যুগ— এমন এক ‘বিভক্তি লাইন’ টানা যায়। কিন্তু ঠিক কীসের ভিত্তিতে এই লাইন টানা হবে, সে ভিত্তি কী?

আসলে সুনির্দিষ্ট করে বললে বিভক্তি লাইন নয় বরং আরও স্পষ্ট করে বিভক্তির দিনক্ষণই বলে দেয়া যায়। মানে কলোনি শাসন সমাপ্তি টানার ঘণ্টা বাজার দিনটা হবে ১৯৪১ সালের ১৪ আগস্ট। কেন?

কারণ ওইদিন বৃটিশ প্রধানমন্ত্রী চার্চিল আমেরিকার প্রেসিডেন্ট রুজভেল্টের সঙ্গে “আটলান্টিক চার্টার” নামে এক চুক্তিতে স্বাক্ষর করেছিলেন। আর আট দফা এ চুক্তিতে স্বীকার করে নিয়েছিলেন, তারা উভয়ই মানুষের নিজ ভূমিতে বসবাস করা এবং সেই ভূমিতে কী ধরনের শাসনের অধীনে কারা তার শাসক হবে তা নিজেই বেছে নেবে— এ অধিকারকে সম্মান করে। এছাড়া তারা উভয়ে যেকোন ভুখন্ডের জনগোষ্ঠি মানুষের নিজ দেশে সার্বভৌমত্বের অধিকার ও আত্মনিয়ন্ত্রিত সরকার পুনরুদ্ধার করা গেছে এটাই দেখতে চায়, যা থেকে ওসব জনগোষ্ঠিকে বলপ্রয়োগে বঞ্চিত করে রাখা হয়েছে বলে তাঁরা উভয়ে মনে করে।

অর্থাৎ চার্চিল এই চুক্তিতে রুজভেল্টের চাপের মুখে স্বীকার করে নিচ্ছেন যে অবিভক্ত ভারতবাসীকে নিজ ভূমির ওপর শাসনের আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার ফিরিয়ে দিতে হবে। কিন্তু তাহলে তো চার্চিলের আর নিজের উপনিবেশগিরি থাকে না। এটা জানা সত্ত্বেও কলোনি শাসন ত্যাগের এ নীতিগত অবস্থানপত্রের আট দফায় চার্চিল স্বাক্ষর করেছিলেন। মানে নীতিগতভাবে কলোনি শাসন আর বজায় রাখবেন না — এ প্রতিশ্রুতি তিনি অন্তত আমেরিকাকে দিয়েছিলেন ওই চুক্তিতে বাধ্য হয়ে। কেন? কারণ হিটলারের আক্রমণে  এরই মধ্যে ফ্রান্স হিটলারের দখলে চলে গেছে এবং এরপরে ব্রিটেনও দখল হয়ে যাওয়ার অপেক্ষায়। তাই এই ভয়ে আমেরিকার সহায়তা পেতে চাইছেন তিনি। তাই “কলোনি শাসন ত্যাগের এ নীতিগত অবস্থানপত্রের” এই শর্তেই চার্চিল রুজভেল্টের মন পেয়েছিলেন। আর এথেকেই রুজভেল্ট চার্চিলের সঙ্গে মিলে হিটলারবিরোধী “মিত্রশক্তি” গড়তে রাজি হয়েছিলেন। ফলে বিশ্বযুদ্ধে হিটলার ও সহযোগীদের পতন নিশ্চিত করেছিল।

রুজভেল্ট ‘মিত্রশক্তির’ ইউরোপকে শুধু সামরিক সহায়তাই করেননি; যুদ্ধে প্রয়োজনীয় খাদ্য, পানীয় বা পোশাক থেকে শুরু করে যুদ্ধজাহাজসহ যেকোন সামরিক সহায়তা ইত্যাদি না কোন জাহাজ রিপেয়ার, নতুন সরবরাহ অথবা নগদ সাহায্য করেছিলেন। আর তা করেছিলেন সোভিয়েত ইউনিয়নসহ মিত্রশক্তির সব রাষ্ট্রকে। যুদ্ধ শেষে মার্কিন ট্রেজারি বিভাগের এক হিসাবে দেখা যায় মিত্রশক্তির রাষ্ট্রগুলোর সবাইকে দেয়া সাহায্য, এর মোট পরিমাণ ছিল ২৭০ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের। এখনকার মুদ্রামানে যা হবে এর আরো ৩৫ গুণ। কারণ সেকালে স্বর্ণের আউন্স ছিল ৩৫ ডলার, যা আজকের সোনা ১ হাজার ২৩০ ডলারের আউন্স ধরলে সেটা এখন ৩৫ গুণ হয়। অর্থাৎ সেকালের ২৭০ বিলিয়ন ডলার হবে একালে ১০ ট্রিলিয়ন ডলার। এখানেই শেষ নয়।

ওদিকে আবার যুদ্ধ শেষে সারা ইউরোপের (সঙ্গে পুরা জাপান ও চীনেও কিছু) অবকাঠামো পুনর্গঠনের “মার্শাল প্ল্যানে” আবার নতুন করে অবকাঠামো গড়ে দিতে নতুন বিনিয়োগ করতে হয়েছিল আমেরিকাকে। নতুন এ বিনিয়োগ প্রায় বিশ্বযুদ্ধের ব্যয়ের সমান।

সেই থেকে আমেরিকা হয়ে যায় দুনিয়ার নতুন নেতা। আমেরিকান নেতৃত্বের দুনিয়া অথবা আমেরিকান নেতৃত্বের এক গ্লোবাল অর্থনৈতিক ব্যবস্থা কায়েম হয়েছিল। আজ প্রায় সত্তর বছর পরে এবার আমেরিকাকে পেছনে ফেলে সে জায়গা নিতে যাচ্ছে গ্লোবাল অর্থনীতির নতুন নেতা চীন। সেকালে আজকের রাইজিং অর্থনীতির চীনের মতোই উদ্বৃত্ত সঞ্চয় ছিল আমেরিকার হাতে। বিশ্বযুদ্ধের আগের সেকালে দুনিয়াকে কলোনি করে রাখাই ছিল রীতি; আর এর ভেতর নতুন উত্থিত অর্থনৈতিক শক্তি হচ্ছিল আমেরিকা, ১৮৮০ সালের পর থেকেই। বলা যায়, এরই পূর্ণতা তারা পাওয়া শুরু করেছিল প্রথম বিশ্বযুদ্ধের (১৯১৪-১৮) পর থেকে। চলতি নতুন শতকে এসে চীন গ্লোবাল অর্থনীতির নতুন নেতার ভুমিকায় উঠে আসছে।

তাত্পর্য দুই: অর্থনীতিক ব্যবস্থার প্রাতিষ্ঠানিকতা, গ্লোবাল প্রাতিষ্ঠানিকতা
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের আরেক তাত্পর্য হলো, এ যুদ্ধ শেষের নতুন দুনিয়ায় এক গ্লোবাল অর্থনৈতিক ব্যবস্থা প্রথম প্রাতিষ্ঠানিকতা পায়। অর্থাৎ কোনো প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে নিয়ন্ত্রিত হওয়া শুরু হয়।

এর মানে কী? প্রথমত. এর আগে দুনিয়ায় ক্যাপিটালিজমের অর্থনৈতিক ব্যবস্থা চলত ঠিকই, কিন্তু তা নিয়ন্ত্রণের একটা রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান যেমন — কেন্দ্রীয় ব্যাংক ধরনের কোনো প্রতিষ্ঠান সেখানে ছিল না। ফলে এ রকম কোনো নিয়ন্ত্রণও ছিল না। বিচ্ছিন্নভাবে নানা ধরনের ক্যাপিটাল মালিকদের প্রতিষ্ঠান, সেটা কোনো ব্যাংক বা কারখানা বা বাণিজ্যিক মালিকানা প্রতিষ্ঠান যা-ই হোক, তা নিজ নিজ মালিকানার পুঁজিকেই কেবল নিয়ন্ত্রণ করত, যেটা সব পুঁজি মালিকই নিজের স্বার্থে করে।

প্রথম কথা হলো, কলোনি যুগের অর্থনীতিতে কোনো ইনস্টিটিউশন— যা সামগ্রিক অর্থনীতিকে মোটাদাগে নিয়ন্ত্রণ করে — এমন প্রাতিষ্ঠানিক কিছু ছিল না; তেমন গ্লোবাল প্রতিষ্ঠান দূরে থাকে, স্থানীয় প্রতিষ্ঠান মানে যেকোনো রাষ্ট্রের অধীনে ও ভেতরে নিজস্ব রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণ আরোপ করে এমন কোনো প্রতিষ্ঠান ছিল না। আজ সব রাষ্ট্রেরই একটা ‘সেন্ট্রাল ব্যাংক’ থাকে, যা দিয়ে সে নিজ অর্থনীতিকে মোটাদাগে নিয়ন্ত্রণ করে। এছাড়া ‘সেন্ট্রাল ব্যাংক’ যেমন সময়ে সময়ে ফিসক্যাল ও মনিটারি পলিসি ঘোষণা করে। বৈদেশিক মুদ্রা নিয়ন্ত্রণ করে। সরকারি বা বেসরকারি ব্যাংকগুলোর একক নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষ হিসেবে কাজ করে, বাজারে অর্থের সরবরাহ নিয়ন্ত্রণ করে। কিন্তু এটা কত আগে থেকে, কবে থেকে শুরু হয়েছিল?

এটা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর থেকে। এর আগে কেন্দ্রীয় ব্যাংক বলে কোনো ফেনোমেনা ছিল না। ‘ব্যাংক অব ইংল্যান্ড’ ১৬৯৪ সালে জন্মের পর থেকে এটা প্রাইভেট ব্যাংক ছিল এবং ফাংশন করত। আর ১৯৪৬ সালে এসে এটা ন্যাশনালাইজড বা সরকারি মালিকানায় নেয়া হয়, সেই থেকে এটাই ইংল্যান্ডের “সেন্ট্রাল ব্যাংক” হিসাবে কাজ করছে। ১৯৪৬ সালের আগে আসলে ‘সরকারি ব্যাংক’ বলে কোনো ধারণাও ছিল না। রাষ্ট্র, সরকার, এমনকি রানীর অফিস — এসব প্রতিষ্ঠানের সব অ্যাকাউন্টের হিসাব-কিতাব ব্যাংক অব ইংল্যান্ডই দেখাশোনা করত। ব্যক্তি ক্লায়েন্টের মতোই। তবে ব্যাংক অব ইংল্যান্ড মুদ্রা ছাপানোর অনুমতি পেয়েছিল, সরকারের থেকে তা নিতে হতো সমতুল্য পরিমাণ স্বর্ণ জমা রেখে।

তবে এ প্রসঙ্গে একটু ব্যতিক্রম আমেরিকার ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাংক, যার জন্ম ১৯১৩ সালে। এটা আমেরিকার ৫০ স্টেটের মধ্যকার মুদ্রা ও অর্থনীতির সমন্বয়ের জন্য তৈরি করা হয়েছিল। কারণ ১৭৭৬ সালে আমেরিকার স্বাধীনতা লাভের পর থেকে প্রতিটি স্টেট আলাদা আলাদা নোট ছাপত। শুধু তাই নয়, প্রত্যেক স্টেটের প্রত্যেক ব্যাংক আলাদা নোট ছাপত। এছাড়া এক স্টেট অন্য স্টেটে বিনিয়োগ করতে পারত না। পরবর্তীতে প্রত্যেক স্টেটের পুঁজি সঞ্চয় এর পরিমাণ বেড়ে গেলে এ বাধা উ্ঠিয়ে দেয়া হয়, আর পরস্পরের  পুঁজি ও সঞ্চয়  বিনিয়োগ ইত্যাদির সমন্বয়ের দরকার দেখা দেয়। সেখান থেকেই ১৯১৩ সালে ফেড রিজার্ভের জন্ম। আরো পরে এটা আর পাঁচটা কেন্দ্রীয় ব্যাংকের মতো ভূমিকায়ও নামে।

কিন্তু বিশ্বযুদ্ধের পরেই কেন কেন্দ্রীয় ব্যাংক ধারণার জন্ম? বিশ্বযুদ্ধের আগে নয় কেন?

এতক্ষণ সাধারণভাবে প্রাতিষ্ঠানিকতার কথা বলেছি, তবে তা রাষ্ট্রীয় সীমানার ভেতরেই কেবল এখতিয়ার— এমন প্রতিষ্ঠানের কথা।
কিন্তু দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের আরেক তাত্পর্য হিসেবে যে প্রাতিষ্ঠানকতার কথা বলছি, তা আসলে গ্লোবাল অর্থনীতির প্রাতিষ্ঠানিকতা; রাষ্ট্রীয় সীমানার বাইরে সর্বত্র যার এখতিয়ার।

মূলত ১৯৪৪ সালে আইএমএফ (তবে সঙ্গে বিশ্বব্যাংক) গ্লোবাল অর্থনীতিকে ঢেলে সাজানোর কাজ শুরু করে। আর আইএমএফের গ্লোবাল তত্পরতা সক্রিয় করার জন্য এরই নানা ডানার মতো সদস্য দেশগুলোয় ‘কেন্দ্রীয় ব্যাংক’ গড়ে তোলা হয়। আইএমএফের সদস্য হতে হলে কোনো রাষ্ট্রে আগে না থেকে থাকলে এবার এক কেন্দ্রীয় ব্যাংক খুলে নিতে হয়। আর কীভাবে কী কী অর্থনৈতিক তথ্য আইএমএফকে দিতে হবে সেই ফরম্যাট ও এর ট্রেনিং আইএমএফ দিয়ে দেয়। কেন্দ্রীয় ব্যাংক সাধারণত কনস্টিটিউশনাল স্টাটুটরি প্রতিষ্ঠান হয়, তবে স্বায়ত্তশাসিত।

তাহলে দেখা যাচ্ছে, আগের কলোনি ক্যাপিটালিজম যা নিয়ন্ত্রণবিহীন চলত তা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরে শুধু কেন্দ্রীয় ব্যাংক ধরনের রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানের নিয়ন্ত্রণেই নয়, বরং ক্যাপিটালিজমের অর্থনীতি এবার সারা দুনিয়ার একক গ্লোবাল প্রতিষ্ঠান আইএমএফের নিয়ন্ত্রণে পরিচালিত হতে থাকল।

এই প্রথম দুনিয়া একটা নতুন শব্দের সঙ্গে পরিচিত হলো— গ্লোবাল অর্থনীতি। তাহলে গ্লোবাল অর্থনীতি মানে কী দাঁড়াল, যুদ্ধের আগের কলোনি যুগে গ্লোবাল অর্থনীতি বলে কিছু ছিল না? হ্যাঁ, ঠিক তা-ই। কিছু ছিল না। তাহলে কী ছিল?

আসলে বিশ্বযুদ্ধের পরের প্রাতিষ্ঠানিক অর্থনীতি শুরু হওয়া মানেই হলো তা গ্লোবাল অর্থনীতি। যেমন — একটা রাষ্ট্র সীমানার ভেতরে বাণিজ্যিক লেনদেন হলে তা একই নিজস্ব মুদ্রায় করা যায়। ওই মুদ্রার মান কত, মানে অন্য মুদ্রার সঙ্গে এর বিনিময় হার কত, তা সেখানে অবান্তর, অপ্রয়োজনীয় প্রশ্ন। কিন্তু যেকোনো দুই রাষ্ট্রের মধ্যে বাণিজ্যিক পণ্য বিনিময় লেনদেনের বেলায় মুদ্রা বিনিময় হার কত তা নিশ্চিত হওয়া গুরুত্বপূর্ণ। তাদের নিজ নিজ মুদ্রার মান মানে, বিনিময় হার সেখানে জানতেই হবে। কিন্তু তা নিশ্চিত জানার উপায় কী? কথাটা আরেকভাবেও বলা যায়। বাণিজ্যিক বিনিময় যদি রাষ্ট্রসীমার বাইরে হয়, মানে আন্তর্জাতিক বাণিজ্যিক বিনিময় লেনদেন হয়, সেই বাণিজ্যের ক্ষেত্রে একটা আন্তর্জাতিক মুদ্রাও তো লাগবে। এই প্রয়োজন মেটাতে যে আন্তর্জাতিক অর্থনৈতিক প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবস্থাপনা, এরই প্রতিষ্ঠান হলো আইএমএফ। এক ম্যান্ডেট অনুযায়ী এর কাজ দুটো। এক. আন্তর্জাতিক মুদ্রা বিনিময় হার ঠিক করা, যাতে প্রতিটি সদস্য রাষ্ট্র তা থেকে নিজের মুদ্রার সরকারি হার জেনে বুঝে নিতে পারে। দুই. কোনো রাষ্ট্রের আন্তর্জাতিক লেনদেনের অ্যাকাউন্টে ব্যালান্সের ঘাটতি দেখা দিলে তা পূরণে লোন দেয় আইএমএফ। তবে ওই ঘাটতি আর যাতে দেখা না দেয়, সেজন্য যা কিছু পরামর্শ ও করণীয় আইএমএফ দেবে, তা পালন করতে রাজি থাকা সাপেক্ষে ঐ ঋণ অনুমোদিত হবে। তবে ্মনে রাখতে হবে আইএমএফ অন্য কোন ঋণ দেওয়ার প্রতিষ্ঠান নয়। সেকাজ সহযোগী প্রতিষ্ঠান বিশ্বব্যাংকের, যা মূলত অবকাঠামো ঋণ বিতরণ করে থাকে।

গ্লোবাল অর্থনীতি কথাটা সেই থেকে অর্থপূর্ণ হতে শুরু করেছিল। যদিও এর ভেতর আবার চড়াই-উতরাই ক্রাইসিস সবই ছিল এবং এখনো আছে। এটা আরো অর্থপূর্ণ হয়ে উঠে আশির দশক থেকে অর্থনৈতিক গ্লোবালাইজেশন শুরু হলে। আর সবচেয়ে ইতিবাচক অর্থে গ্লোবালাইজেশন মানে হল, প্রত্যেক রাষ্ট্র যেসব পণ্য উৎপাদনে সবার চেয়ে দক্ষ, কেবল সেগুলোই সেসহ যারা তার মতনই দক্ষ, তারা মিলে সেসব পণ্য দুনিয়ার সবার জন্য উৎপাদন ও রফতানি করবে। বিনিময়ে অন্যান্য পণ্যের বেলায় সেগুলোরও দক্ষ উৎপাদকের থেকে তা আমদানি করবে।

এক অব=জারভেশন হিসাবে বলা যায়, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধসহ এ পর্যন্ত সব গ্লোবাল পরিবর্তনে দেখা  গেছে, কেবল সেগুলোই বাস্তবায়ন হয়েছে যেগুলোয় ‘ওয়াল স্ট্রিট’ প্রতিষ্ঠানগুলোরও সম্মতি ছিল। যেমন— কলোনি যুগের সমাপ্তি টানতে হবে রুজভেল্টের এ সিদ্ধান্তের মূল প্রভাবক ওয়াল স্ট্রিট প্রতিষ্ঠানগুলো। ওয়াল স্ট্রিট প্রতিষ্ঠানগুলো মানে হলো, যেকোনো ব্যাংক বা করপোরেট মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানি অথবা কোনো বড় ম্যানুফ্যাকচারার ইত্যাদিসহ যেখানেই বড় বিনিয়োগ লাগে সেখানে বাণিজ্যিক ঋণ দেয় এমন প্রতিষ্ঠান। এসব প্রতিষ্ঠানের বেশির ভাগ আমাদের মতিঝিলের শেয়ারবাজার পাড়ার মতো আমেরিকার নিউইয়র্কের ম্যানহাটন সিটিতে ওয়াল স্ট্রিট নামের পাড়ায় অবস্থিত বলে সেখান থেকে এমন নাম। সেখানকার সবচেয়ে এক বড় প্রভাবশালী প্রতিষ্ঠান হল, গোল্ডম্যান স্যাকস। এরই এক গবেষক হলেন জিম ও’নিল। তিনি সাবেক ব্রিটিশ অর্থমন্ত্রী ও পলিসি গবেষণা প্রতিষ্ঠান রাজকীয় চেথাম হাউজের চেয়ারম্যান। তার গবেষণার সবচেয়ে প্রভাব ফেলা কাজ হল, চীন যে ব্রিকস উদ্যোগ বা ব্যাংক বানিয়েছে, সেটা তিনি ও তাঁর দলের পরামর্শ থেকে।

সম্প্রতি তিনি খুবই ভোকাল হয়ে উঠেছেন। তার প্রসঙ্গ হলো গ্লোবাল অর্থনীতি, চাইলে যেটাকে আমরা গ্লোবাল ক্যাপিটালিজমও বলতে পারি। তার আর্গুমেন্ট হলো বিশ্বযুদ্ধের পর যে গ্লোবাল ইকোনমিক অর্ডারটা তৈরি হল, এর ওপরও একটা গ্লোবাল পলিটিক্যাল নিয়ন্ত্রণ ও সমন্বয়ের প্রয়োজন, বিশেষ করে ক্রাইসিসের সময়গুলোয়। এ কাজে বড় অর্থনীতির সাত রাষ্ট্রের যে জি৭ গ্রুপ তৈরি হয়েছিল, সেটা গ্লোবাল ক্রাইসিসের সময় যথাযথ ভূমিকা রাখতে ব্যর্থ হয়েছে। তার ভাষায়, জি৭ এখন জিরো, মানে অথর্ব অকেজো। এছাড়া ট্রাম্পের আমেরিকার এখন যে অবস্থান, সেটা অ্যান্টি-গ্লোবালাইজেশনের। ফলে এখন আরও যারা রাইজিং অর্থনীতির সম্ভাবনাময় রাষ্ট্র— এমন টপ ২০টিকে নিয়ে জি২০ গ্রুপ গড়তে হবে।

সারকথা, গ্লোবাল অর্থনীতি কথাটা এখনো কাজে পরিপূর্ণতা পায়নি। সে লক্ষ্যে অনেক কাজ বাকি, যেখানে আমাদের মনোযোগী হতে হবে।

লেখক: রাজনৈতিক অর্থনীতি বিশ্লেষক

goutamdas1958@hotmail.com

 

[এই লেখাটা এর আগে গত ২৯ আগস্ট ২০১৮ দৈনিক বণিকবার্তা পত্রিকায় বৈশ্বিক অর্থনীতির প্রাতিষ্ঠানিক নিয়ন্ত্রণ কবে থেকে  – এই শিরোনামে ছাপা হয়েছিল। পরবর্তিতে সে লেখাটাই এখানে  আরও নতুন তথ্যসহ বহু আপডেট করা হয়েছে।  ফলে  সেটা নতুন করে সংযোজিত ও এডিটেড এক সম্পুর্ণ নতুন ভার্সান হিসাবে এখানে ছাপা হল। ]

Leave a comment