মোদির আনা শর্ত ও পরিণতিতে বাংলাদেশ ব্রিকসে নাই


মোদির আনা শর্ত ও পরিণতিতে বাংলাদেশ ব্রিকসে নাই
গৌতম দাস
২৫ আগষ্ট ২০২৩      মধ্যরাত ০০ঃ ০৪
https://wp.me/p1sCvy-4Ro

 

আজ বাংলাদেশের বিকেল পাঁচ টার দিকে বিবিসি জানায় ব্রিকসে যোগ দিতে ছয় দেশকে আমন্ত্রণ, ডাক পায়নি বাংলাদেশ। অথচ যারা ভারতের অর্থে নিজ মিডিয়া বাঁচিয়ে রেখেছে তারা নিঃশ্চুপ। তারা এনিয়ে সরাসরি নিউজ করে নাই। তবে ডেইলি স্টার এনিয়ে তবে  UNB বরাতে এনিয়ে আড়ালের নিউজটা ছেপেছে। এমনিতেই UNB প্রো-গভর্মেন্ট এজেন্সি অবস্থান নিয়ে চলেছে।  যেটা ছেপেছে চীন বাংলাদেশের সদস্যপদ চাওয়া সমর্থন করবে, [“China to support Bangladesh in joining BRICS, XI tells Hasina।] কিন্তু এটা এখন হাফ ট্রুথ। মানে কথা অসত্য না, কিন্তু অর্ধসত্য বলে অকার্যকর। চীনের এই সমর্থন তখনই এর মানে হবে যখন বাংলাদেশ সদস্যপদ পাবার শর্ত পূরণ করবে। আর বাংলাদেশ মোদির আপত্তিতে তা পূরণ করতে পারবে না – মানে সাতমণ তেল ঢালাও হবে না, রাধাও নাচবে না – এমন দশা হবে। এনিয়ে বিস্তারিত আরো পরে এনেছি।

দক্ষিণ আফ্রিকার ১৫তম ব্রিকস শীর্ষ সম্মেলন চলছে ২২-২৪ আগষ্ট। এছাড়া এই সম্মেলন থেকেই ব্রিকসে নয়া সদস্যরাষ্ট্র যুক্ত হবার কথা ছিল। মানে জন্মের সময় থেকেই এর উদ্যোক্তা সদস্য পাঁচ রাষ্ট্র ছিল, তা এবারই প্রথম বাড়ানোর কথা ছিল। কিন্তু বড় ধরণের বিতর্ক দেখা দেওয়াতে তা এবার আর হচ্ছে না। এছাড়া আর ব্রিকসের সিদ্ধান্ত নিবার পদ্ধতি হল কেবল – সদস্যরা সবাই এক হলে তবেই সেটা সিদ্ধান্ত – এই নীতিতে চলে বলে এব্যাপারে একমত হতে তাদের আরো সময় লাগবে। অর্থাৎ এবারের সম্মেলন থেকেই নয়া সদস্য নেয়া হচ্ছে না। এটা ইতোমধ্যেই ব্রিকসের মূল অফিসিয়াল ভার্সান কেউ না দিলেও  “ভিতরের খবর” হিশাবে গত ১৭ আগষ্ট এই আভ্যন্তরীণ সমস্যার দিকটা মিডিয়ায় এসে পড়েছিল। হংকংয়ের সাউথ চায়না মর্ণিং পোস্টের বরাতে প্রথম আলো খবরটা দিয়েছিল। শিরোনাম ছিল, ব্রিকসে নতুন সদস্য চায় চীন, তবে সতর্ক অবস্থানে ভারত ব্রাজিল।  আর গত ২৩ আগষ্ট নিউ ডেভেলবমেন্ট ব্যাংক যেটা বিশ্বব্যাংক সমতুল্য ব্যাংক হিশাবে ব্রিকসের বিশ্বব্যাংক হিসাবেও পরিচিত; এই ব্যাংকের প্রধান ফাইন্যান্স অফিসার [CFO, Chief Financial Officer Leslie Maasdorp] তাঁর বরাতে রয়টার্স জানিয়েছেএই ছিল ২৩ আগষ্ট পর্যন্ত ঢাকায় পাওয়া ও জানতে পারা ঘটনাবলী।

কিন্তু  এবারের ব্রিকস সম্মেলন ঘটনাবহুল। যতটা লিখতে পারা যায় তার চেয়েও দ্রুত ঘটনা বদলাচ্ছে। এর উপর আজ ২৪ আগষ্ট পর্যন্ত সম্মেলন কার্যকর আছে তাই নয়া ঘটনা সিদ্ধান্তঅও আসছে। সেসব ত্নফরমেশন ও সাথে ব্যাখ্যা করতে কয়েক পর্বে লিখতে হবে।  তাই আজ এখানে কেবল সংক্ষিপ্ত একটা ভাষ্য লিখব।

এক.
যেমন প্রধান এক ঘটনা হল, ২২ আগষ্ট সাউথ আফ্রিকার দৈনিক ম্যাভেরিক [maverick] পত্রিকা জানাচ্ছে সেই খবরের শিরোনাম হল, “ত্রিভুজ প্রে্মের কঠিন ক্যাচালঃ সাউথ আফ্রিকা প্রেসিডেন্ট রামফোসা চীনা প্রেসিডেন্ট শি এর দিকে ফোকাস দেওয়াতে মোদির হাত-পা ছুড়ে ক্ষোভ প্রকাশ, ‘আমি কী ভাইসা আইছি’ বলে রাগ, তিনি প্লেন থেকে নামবেনই না” [Tough Love Triangle: While Ramaphosa focused on Xi, Modi threw a tantrum and refused to get off his plane]। শেষে অবশ্য মোদি আউথ আফ্রিকার ভাইস প্রেসিডেন্টের সাথে প্লেন থেকে নেমে গার্ড অফ অনার নিয়েছেন। অন্তত ছবি দেখে যা বলা যায়।
তবে এর পিছনের মূল কারণ ঐ পত্রিকা ব্যাখ্যা করেছে। সেটা হল, প্রেসিডেন্ট শি ব্রিকস সম্মেলন শুরুর আগেই সাউথ আফ্রিকা এসেছেন আগের দিন। কারণ তার সফর ছিল  সাউথ আফ্রিকার সাথে প্রথমত দ্বিপাক্ষিক। সেটা শেষ হলে পরের দিন তিনি যোগ দিয়েছিলেন ব্রিকস  বৈঠকে। তাই তাকে রিসিভ করেছিলেন প্রেসিডেন্ট রামফোসা। যদিও পত্রিকা জানাচ্ছে তার মনে ইচ্ছা ছিল মোদির বেলায়ও তিনিওই আসবেন কিন্তু শিডিউল মিলাতে পারেন নাই। এছাড়া ঐ দ্বিপাক্ষিক বৈঠক ছিল সাউথ আফ্রিকার জন্য খুব গুরুত্বপুর্ণ বাণিজ্যিক বৈঠক। এজন্য যে চীনে সাউথ আফ্রিকার সোনাসহ অন্যান্য মূল্যবান ধাতু রপ্তানি এবং আরো গিউরুত্বউর্ণ  মাংস রপ্তানি যেটা এতদিন বন্ধ ছিল এসব বাজার খুলবার চুক্তি সই ছিল এই সফরের বড় গিরুত্বপুর্ণ অংশ। এসব মিলিয়ে প্রেসিডেন্ট শি এর গুরুত্ব অন্য যেকোন কিছুর চেয়ে হয়ে উঠেছিল বেশী মুল্যবান অতিথির আগমন। আর এটার সাথে অপ্রয়োজনীয়ভাবে নিজ তুলনা করতে গিয়ে ভারতের মোদি হাত-পা ছুড়েছিলেন কিন্তু লাভ হয় নাই।
এবারের সফরের আগে-পড়ে ভারত প্রতিটা পদে পদে অপ্রয়োজনীয়ভাবে নিজেকে চীনের সাথে তুলনীয় করে হাজির করতে গিয়েছে আর পিছু হটেছে বা আরো মলিন্মুখের  ইমেজ নিতে বাধ্য হয়েছে।

দুই. মূলত মোদির ভারতের কারণে বাংলাদেশের ব্রিকস সদস্যপদ আটকে যাচ্ছেঃ
ঘটনা উপস্থাপনটা বাংলাদেশের দিক থেকেই করা যাক!  ইতোমধ্যেই প্রথম আলো সুর বদলে লিখেছে আসলে আবেদন ছাড়া কিছুই করেনি বাংলাদেশ। ওর রিপোর্টের প্রথম প্যারাটা এরকমঃ

আসলে আবেদন ছাড়া কিছুই করেনি বাংলাদেশ। যদিও বাংলাদেশের
নীতিনির্ধারকেরা ব্রিকসের নতুন সদস্যপদ পাওয়া নিয়ে বিশেষভাবে
উৎসাহী ছিলেন। আসন্ন জাতীয় নির্বাচনের পূর্বে ভিন্ন এক ভূরাজনৈতিক
পরিস্থিতিতে ব্রিকসের সদস্যপদ পেলে তা বাংলাদেশের জন্য নতুন
এক মাত্রা যোগ করত বলেই ধারণা করা হচ্ছিল।

দ্রুত মূল কথাটায় চলে যাই। সবাই জেনেছিলেন যে নয়া সদস্য করতে গিয়ে নয়া ক্রাইটেরিয়া মানে শর্তাবলী কী হবে একথা বলে ব্রিকসের ভিতরে বিতর্ক শুরু হয়েছিল গত শেষ দশদিন ধরে। রয়টার্সের ভাষায় সবই ঠিক চলছিল কিন্তু শেষ সময়ে এসে মোদি সদস্যপদ দিবার ক্ষেত্রে কিছু নয়া শর্তের কথা তুলে ধরেন।

An agreement had been meant to be adopted following a
plenary session
earlier on Wednesday, but the source said
it had been
delayed after Indian Prime Minister Narendra Modi introduced new admission criteria.

যেমন তিনি বলেন,  যেসব দেশের উপর অ্যামেরিকান স্যাংশন নাই – এটাই একটা শর্তাবলী হতে হবেrequiring members not be the target of international sanctions।।  এটা রয়টার্সের ২৩ আগষ্ট ২০২৩ এর প্রকাশিত রিপোর্ট। আর  বাংলাদেশের ২৫ আগষ্ট তারিখ গননা শুরুর রাত বারোটা থেকে  পিছনের প্রায় ১৮ ঘন্টা আগে ছাপানো রিপোর্ট।

“The BRICS country official said that admission criteria India’s Modi proposed
included requiring members not be the target of international sanctions,
ruling out potential candidates Iran and Venezuela.”

“Modi was also pushing for a minimum per capital GDP requirement”.

এখানে,  রয়টার্স যদিও সদস্যপদ পাবে না এমন রাষ্ট্র বলতে উদাহরণ হিশাবে ইরান ও ভেনিজুয়েলা বাদ পড়ার কথা তুলেছে। কিন্তু  মজার কথা হল তাহলে তো খোদ রাশিয়াও বাদ পড়ে যাবার কথা। কারণ, সবচেয়ে বড় অ্যামেরিকান অর্থনৈতিক স্যাংশন খাওয়া দেশ হল রাশিয়া। এছাড়া বাংলাদেশও শ্যাংশন খাওয়া দেশ বটে – এই বিচারে তো বাংলাদেশও ব্রিকসের সদস্য পাওয়ার ক্ষেত্রে বাদ পড়ে যায় ও যাবে।
যদিও এসব ইজ্জতের কথা ঢেলে ফেলার জন্য আমাদের পররাষ্ট্রমন্ত্রী মোমেন এক সাংবাদিক সম্মেলন করেছেন। এর রিপোর্ট UNB এর বরাতে ডেইলি স্টার ছেপেছে। যার শিরোনাম হল, China to support Bangladesh in joining BRICS, XI tells Hasina। এটা দেখে মনে হতে এই তো চীন আমাদের সদস্যপদ পাওয়া সমর্থন করে দিবে বলেছে। কিন্তু ব্যাপারটা ঠিক সেরকম নয়। তবে এটাই ব্রিকসে গিয়েও ভারতের চীন ঠেকানোর ততপরতা বলা যায়।
প্রথমত, সদস্যপদ দেওয়ার শর্তাবলী কী হবে এনিয়েই ব্রিকস আটকে গেছে যা এবার আর ছুটছে না।  সময় লাগবে। সম্ভবত এমনটাই যে পরিণতি হবে সেটা অনুমান করে প্রেসিডেন্ট শি এই সাউথ আফ্রিকা সফরে পৌছানোর শুরু থকেই সরব। তিনি বারবার বলছেন, “যত ধরণের বাধাই আসুক ব্রিকস বেড়ে চলবেই [Xi said BRICS would continue to grow “whatever resistance there may be.]”  এছাড়া ব্রিকসে তার আনুষ্ঠনিক মূল বক্তব্যে তিনি বলেছেন ব্রিকস গ্রুপের সদস্যপদ বাড়াতে আহবান জানিয়ে কথা বলেছেন, [ Xi Jinping called for the acceleration of the expansion of the BRICS group…]।  তাই সারকথা হল, আপাতত বাংলাদেশের সদস্যপদ আটকে গেলো মোদির ভারতের কারণে।

তিন. এটা কেমন ভারত যে হাসিনার সদস্যপদ আটকে দেয়ঃ
গত চারদিন ধরে আমরা মথ্যা প্রপাগান্ডার তোলপাড় দেখেছি যে ভারত নাকি হাসিনাকে ফিরে ক্ষমতায় রেখে দেওয়ার জন্য আমেরিকাকে কূটনীতিক বার্তা পাঠিয়েছে – এই ভুয়া খবরের।  তাহলে সেই ভারত এখন হাসিনা সরকারের ব্রিকস সদস্যপদ আটকাচ্ছে কেন?
প্রথম আলোই কিন্তু ডয়েচ ভেলের ভুয়া মিথ্যা প্রপাগান্ডাটা ছাপীয়েছিল বীরদর্পে। আমরা ভুলি নাই। তাহলে এখন ব্রিকসে বাংলাদেশের সদস্যপদ পাওয়া নিয়ে প্রথম আলোর  আসলে আবেদন ছাড়া কিছুই করেনি বাংলাদেশ। এই বিরাট জ্ঞানী মন্তব্যটা কেন? ভাতার ভারতেরও মন রক্ষা করতে হবে? এজন্য? যাতে দেনা-পাওনা চালু থাকে?
এর মানে ভারত বাংলাদেশকে যে অবস্থায় ফেলে দেয় সেটাই ভাল মনে করে, সেটার পক্ষে দাড়ায় প্রথম আলো!!! সব দোষ বাংলাদেশের, তাই না? তবে মোদির এই হাসিনাবিরোধি অবস্থান এটাও প্রমাণ করে যে ভারতের কথিত কূটনীতিক বার্তার খবরটাই ডাহা মিথ্যা কথা ছিল!

চার. মোদির ভারত কেন ব্রিকসে এই অবস্থান নিলঃ
নিঃসন্দেহে মোদির ভারতের ব্রিকসে এই অবস্থান নেয়া এটা শুধু চীনবিরোধি বা ব্রিকসের সম্প্রসারণ-বিরোধীই শুধু না এটা খোদ ব্রিকসেরই বিরোধী। মানে যা ব্রিকসের ভারতের জন্য আত্মঘাতি। কেন?

হংকংয়ের সাউথ চায়না মর্ণিং পোস্টের একটা লেখা মন্তব্য প্রতিবেদন এরকম যে,  ভারত সম্ভবত শিগগিড়িই – হয় ব্রিকস না হয় পশ্চিম (আমেরিকা) একটা বেছে নিতে হবে এমন অবস্থায় পড়তে যাচ্ছে [India may soon be forced to choose between Brics and the West]।  প্রথম কথা হল, ভারত নিজে এখন ব্রিকসের উদ্যোক্তা সদস্য। এমন সদস্য থাকা অবস্থায় মোদির ভারত যখন বলেন, অ্যামেরিকান স্যাংশন খাওয়া দেশ সদস্যপদ পাবে না  – এর অর্থ ভারত  ব্রিকসে আছে আর এভাবে থাকা অবস্থাটাকেই সে আমেরিকার কাছে বিক্রি করতে চায়, সুবিধা চায়। এজন্যই চীন বলছে ব্রিকসের সম্প্রসারণ করতে হবে আর ভারত বলছে আমেরিকা আপত্তি দেওয়া দেশকে ব্রিকসে নেয়া হবে না।
এর আরো ভয়াবহ অর্থ আছে।
যেমন ধরেন ইরানঃ এই ইরান জন্মের সময় থেকে ১৯৭৯ সাল থেকেই আমেরিকান বাধা সয়েই লড়াই করে নিজ অর্থনীতি টিকে রাখার চেষ্টা করে যাচ্ছে। বাইডেনের সময়ে এবার এটা আরেক চরমে উঠেছে।  স্যাংশন মানে হল ডলারে বাণিজ্য করা যাবে না, তেল বিক্রিতে ডলারে ইনভয়েজ [invoice] লেখা যাবে না, ডলারে পেমেন্ট নেয়া যাবে না। সোজা কথায় বিক্রি যগ্য পণ্য থাকা সত্বেও না খেয়ে বিনা চিকিতসায় মরতে হবে  – এমনই এক আন্তঃরাষ্ট্রিয় বাণিজ্য ব্যবস্থায় ইরানকে ঠেলে দেয়া হইয়েছে। এখন ব্রিকস হলে এর সদস্যপদ পেলে ডলারের সমান্তরাল গ্লোবাল বাণিজ্যের আরেক কারেন্সি ব্যবহারের সুবিধা ঐ ইরানের কাছ থেকে কেড়ে নেয়ার পক্ষে – এমন আমেরিকান দালালির পক্ষে মোদি দাঁড়িয়ে গেলেন।

কিন্তু একটা কথা পরিস্কার করে দেই।  সবার আগে। ব্রিকস নিয়ে নানাবিধ ভুল অনুমান আছে আর তা বেশির ভাগ একাদেমিক, অধ্যাপক, প্রাক্তন আমলা-সচিব আর সাথে আমেরিকান চাপে থাকা হাসিনা সরকারের মত লোকজনও আছেন।
কথাগুলো হলঃ
১।  ব্রিকস চল্লিশ বা এরও বেশি নয়া সদস্য নিয়ে কার্যকর হলেও এসব নয়া দেশগুলো আর ডলারে বাণিজ্য করবে বা এমনকি আমেরিকার সাথেও আন্তঃরাষ্ট্রীয় বাণিজ্য সম্পর্ক সব বন্ধ হয়ে যাবে এমন অনুমান অবাস্তব, মিথ্যা।  এখন অল্পকথায় বললে, ডলার আন্ত্রররজাতিক কারেন্সি বলে আইএমএফ চালু হয়েছিল ১৯৪৫ সাল থেকে। কিন্তু এর আগের বৃটিশ সাম্রাজ্য (যাদের সাম্রাজ্যে নাকি কোনদিন অস্তে যায় না যাবে না – এমন গর্বের) – সেই বৃটিশ পাউন্ডে  আন্তঃরাষ্ট্রিয় বাণিজ্য কী এরপর থেকে বন্ধ হয়ে গেছিল??? বাস্তব চন্তা করতে সক্ষম হতে হবে। আমাদের সংকট এখানেই।
২। আমি বারবার বলেছি, ব্রিকস কোন অর্থনৈতিক জোট একেবারেই নয়। যেমন আইএমএফ কে আমরা কোন অর্থনৈতিক জোট বলি না। আসলে  এসব শির ভাগ একাদেমিক, অধ্যাপক, প্রাক্তন আমলা-সচিব এরা কী বলতেন তাই তারা জানেন না। আসলে এরা কখনওই খেয়াল করেন নাই যে আইএমএফ জিনিষটা কী?  আর তাই বলে খোদ ব্রিকস আবার নয়। তবে আইএমএফ-বিশ্বব্যাংক এর বিকল্প গড়ার উদ্যোক্তা পাঁচ দেশের জোট
৩।  প্রায় আশি বছর হয়ে গেল এক নয়া গ্লোবাল অর্ডার (দুনিয়া পরিচালনের গ্লোবাল-রাষ্ট্র ব্যবস্থা যেন) চালু হয়েছে, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক  উভয় অথেই আমেরিকাকে কেন্দ্রে রেখে। এখনও Global Order  জিনিষটা কী আমাদের বেশির ভাগ একাদেমিকেরা জানলেন না।  আমলে নাই। তারা এখন হঠাত করে একটা শব্দ শিখেছেন ভুরাজনীতি (Geo-politics).। আজকাল গুগল নেটের যুগে নিজে নিজেই তো কতকিছু জেনে নেওয়া যায়। তারা খেয়ালই করেন না যে Global আর Geo এদুটা একই শব্দ তো নয়ই, একই অর্থ তো নয়ই! 
৪। এখন তাই দিতে হচ্ছে কাফফারা। কারণ, এইকালটা পালাবদলের – অন্তত অর্থনৈতিকভাবে আমেরিকার বদলে চীনের নেতৃত্ব আসন্নের। কাজেই আমেরিকার নেতৃত্বে উত্থানের সময়টাকে যারা কহ্নও আমল করেন নাই অথচ একাদেমিক তারা এই পালাবদলকে বুঝবে ব্যাখ্যা করবে কীভাবে???   অথচ এবার ব্রিকসের সম্মেলনের আগে বাংলাদেশে কোথাও কোথায় একাদেমিক আলোচনা হতে দেখা গেল ঠিকই কিন্ত্য সেসব এতই পুওর যে হতাশা ছাড়া আর কিছু জন্মায় নাই।
৫। বাংলাদেশ ব্রিকসের সদস্য হয়ে গেলেই হাসিনার বাংলাদেশ আমেরিকাকে বুড়া আঙুল দেখাতে পারবে এই অনুমান একেবারেই ভিত্তিহীন।  এসবই রাশিয়ার মতই অস্থিরআর “এখনই বিকল্প চাই” এমন বোকা কথা বার্তা।  প্রথম কথা ইউয়ান-কে ডলারের বিকল্প প্রধান কারেন্সি বলে হাজির করা – এটা কোন ব্যক্তি বা রাষ্ট্রের ইচ্ছার উপর নির্ভর করে না – এই বিচারে এটা অবজেকটিভ ঘটনা। অন্যভাষায় বললে, এটা বাস্তবে করে দেখাতে হবে, বা হয়ে দেখাতে হবে। যা সিদ্ধান্ত নিলেই হয়ে যাবে না। কাজেই চিন বা প্রেসিডেন শি অথবা পুতিনের আর আমেরিকান স্যাংশন সহ্য হচ্ছে না ভাবলেও হবে না।
৬। এই ব্যাপারগুলো পরিস্কার বুঝতে গেলে আইএমএফের জন্মের ইতিহাস জানতে হবে। পারলে আমেরিকার ১৯১৪-১৯৪৫ সাল পর্যন্ত কংগ্রেস-সিনেটে যেসব আইন পাশ হয়েছে সেগুলোকে স্টাডিতে নিতে হবে। সবচেয়ে ভাল হয়, আমেরিকান ইতিহাস এর এই (১৮৮০-১৯৫৮) কালপর্বটা পাঠক পড়ে নিতে পারেন। history.com ধরণের যেকোন ওয়েব থেকে শুরু করতে পারেন। পরে নিজের নয়া ফারদার কৌতুহলের বিষয়গুলোকে ফলো করে আগাতে পারেন। খুব কঠিন কাজ নয়। নেটেই সব পাওয়া যাবে। কিন্তু ঠিক কী জানতে হবে এনিয়ে গাইড লাগবে, তাবেই অল্প কষ্টে আর বাস্তবে এসব জানা হতে পারে।
৭।  ভারতের আজকের এই দশা হবে সেটার মূল কারণ ভারত কেন ব্রিকসে গিয়েছে সেতা কখনই তাদের কাছেই ইমাজিনেশনে নাই। মূল কারণ, ভারতের একেদেমিকেরাও ব্যাপারটাকে মোটাদাগে মোদির মতই উগ্র অর্থনৈতিক জাতিবাদ এর চোখে দেখে থাকে।  ঘটনা হল যারা উগ্র অর্থনৈতিক জাতিবাদী মানে যারা আন্তঃরাষ্ট্রীয় বাণিজ্য অপ্রয়োজনীয় গণ্য করে, যার তার দেশের মানুষ যাকিছুই ভোগ-উপভোগ করবে তা সবই নিজ দেশে উতপাদন করতে হবে এই অকেজো অনুমানের উপর দাঁড়ানো। অথচ এরা  আন্তঃরাষ্ট্রীয় বাণিজ্যের প্রথম আন্তঃরাষ্ট্রীয় মুদ্রা ব্যবস্থা  কায়েম ও নিয়ন্ত্রণের প্রতিষ্ঠান আইএমএফের সদস্য তো হয়েছেই এরপর এখন আবার ব্রিকসেরও উদ্য্যোক্তা রাষ্ট্র হবার সুযোগ পেয়েছে, নিয়েও নিয়েছে।  অথচ উগ্র অর্থনৈতিক জাতিবাদীদের  জন্য তো কোন আন্তঃরাষ্ট্রীয় বাণিজ্য বা মুদ্রা ব্যবস্থাই দরকার থাকার কথা নয়।  এই স্ববিরোধটাই প্রমাণ যে তারা আইএমএফ বা ব্রিকস কী তা বুঝে নিয়ে আসে নাই। তবে তাদের আছে দুনিয়ায় এক শ্রেষ্ট দেশ-রাষ্ট্র হতে হবে এই বাসনা। কিন্তু কিভাবে আর কী সেটা সেটা আবছা।
৮। কিন্তু তা সত্বেও তারা এটুকু বুঝেছিল যে তাদেরকে চীন আর আমেরিকার মাঝে কখনও এটাকে কখনও এটাকে ব্যবহার করেই তারা নাকি ২০৫০ সালের মধ্যে আমেরিকাকে ছাড়িয়ে দ্বিতীয় বড় জিডিপির অর্থনীতি হয়ে যাবে, এই হল তাদের অনুমান। এসব বোকা বোকা একেবারেই আবছা ধারণাটা মোটামুটি বাইরে এসে পড়েছিল ২০১৩ সালে। গত ২০০৯ সালে ব্রিকসের জন্ম হলেও ২০১৩ সালে চীনের বেল্ট এন্ড রোড (গ্লোবাল অবকাঠামো প্রকল্প) এর প্রথম সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়েছিল। এই সম্মেলনের আমন্ত্রণ ভারত কেন গ্রহণ করবে না সেই সিদ্ধান্ত এর পিছনের বাইরে এসে গেলে ভারতের এমন ভাবনা প্রথম বাইরে এসে পড়েছিল।  ভারত আন্তঃরাষ্ট্রীয় সম্পর্ক কে চালাকির সম্পর্ক মনে করে এটাই মূল সমস্যা।
৯। ভারতের অনুমান চীনের সাথে হাসিনা সরকারের বিশেষ পরিকল্পনা হয়ে আছে যা যদি হাসিনা সরকার আগের মত এবারও যদি নিজেকে বিজয়ী দেখাতে পারে তবে তা কার্যকর হতে চাইবে। ভারত এই সম্পর্ক ও পরিকল্পনার ঘোরতর বিরোধী। অনুমান করা হয়, তাই এর বিরুদ্ধে যতটা সম্ভব তা ভন্ডুল করা যায় সেই পদক্ষেপই হল বাংলাদেশ বাদে অন্য ছয় রাষ্ট্রের ব্রিকস সদস্যপদ লাভের পক্ষে সর্বসম্মত অনুমোদন লাভের ডিলে যোগদান।
১০। তবে এই অবস্থা বদলে যাবে, সামনে এটা থিতু হতে থাকবে। এবার আগষ্ট মাসে ১৫ তম ব্রিকস সম্মেলন হল। অর্থাৎ আগামি ১৬তম ব্রিকস সম্মেলনে সম্ভবত দেখা যাবে বদল শুরু হয়েছে। আর আগামি বছর মানে ২০২৪ নভেম্বরের মধ্যে অনেকটাই এমন বদলে যাবে যে ওর আগামির অভিমুখ দেখতে পাওয়া যাবে বা অনেকটাই স্পষ্ট আন্দাজ করা যাবে। ভারতের মোদি অবস্থান থাকতে পারবে না।
১১। আমাদের একাদেমিক সমাজ এরা ব্রিকস ফেনোমেনা বুঝতে অক্ষম হবার পিছনে আছে আমাদের অবুঝ কমিউনিস্ট ভায়েরা।  তাদের ধারণা সারপ্লাস চুরি হল দুনিয়া একমাত্র ইস্যু।  আর  এই ঘ্যাঘের ওষুধ একটাই এর সমাধান হল রাষ্ট্রীয় মালিকানার সমাজতন্ত্র। কাজেই সব মানুষেরই একই রোগ তাই ওষুধ এক – সবাইকেই প্যারাসিটামল…।।  এরা নিজে জানবে না আর এমনই প্রভাব তৈরি করে রেখেছে যা অন্যকেও জানতে দেয় নাই!  তাই ব্রিকসও নিশ্চয় তাদের চোখে সারপ্লাস চুরির ঘটনা…। তাই কী?

 

সর্বশেষ আপডেটেডঃ  ২৫ আগষ্ট  ২০২৩; রাত ০১ঃ ২৬
আপডেটেডঃ  আগষ্ট ২০২৩;  সকাল 

>
গৌতম দাস
রাজনৈতিক বিশ্লেষক
goutamdas1958@hotmail.com

 

Leave a comment