জাতিসংঘ কী কেন এমন, সেই বোধ-বুঝের অভাবে থাকা ভারতের জয়শঙ্কর


 

জাতিসংঘ কী কেন এমন, সেই বোধ-বুঝের অভাবে থাকা ভারতের জয়শঙ্কর
গৌতম দাস
২৫ দিসেম্বর ২০২৩   ১৯ঃ ৫৮
https://wp.me/p1sCvy-5cJ

এস জয়শঙ্কর [S. Jaishankar] ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী, মানে সরকারি হিন্দিভাষায় বললে “বিদেশমন্ত্রী”। তিনি স্থানীয়ভাবে মানে ভারতের ব্যাঙ্গালুরু রাজ্যের এক সামাজিক সভায় বক্তৃতা করছিলেন গত ১৭ ডিসেম্বর ২০২৩।  ্সেখানে তিনি জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদ বা সিকিউরিটি কাউন্সিল [UNSC] ও এর পাঁচ ভেটো সদস্যদের বিরুদ্ধে ভারতের সব রাগ ক্ষোভ উগড়ে দিয়ে কথা বলেছেন। জয়শঙ্করের ভারতের প্রধান ক্ষোভ হল, বর্তমানের পাঁচ ভেটো সদস্যকে গালি দেয়া এই বলে যে এরা কেন ভারতকেও নিরাপত্তা কাউন্সিলের স্থায়ী সদস্য বা ভেটো সদস্য করে নেয় না?

তবে এবারই প্রথম ভারতের লাগাম-ছাড়া ক্ষোভ দেখছি আমরা। এতদিন যে ভেটো সদস্যপদ পাওয়া ছিল ভারতের আকাঙ্খা!  মানে  এতদিন ভারত তার আকাঙ্খার কথা তুলত আর নিজেকেই সান্ত্বনা দিয়ে বলত যে,  এই তো ভেটো সদস্যপদ পেয়েই গেল বলে!! কিন্তু এবার ব্যতিক্রম হয়ে অনেকভাবেই ক্ষোভ ঝেড়েছে। যেমন, পাঁচ ভেটো সদস্য “ওরা বুড়া তাই” যারা তরুণ তাদের জন্য জায়গা ছাড়ে না; অথবা এরা ক্লাবের বুড়া সদস্য যারা নতুন সদস্য নিতে চায় না জায়গা ছাড়তে চায় না; অথবা  এরা যাত্রীবাহী বাসের এমন প্যাসেঞ্জার যারা অন্যদের জন্য সিট ছাড়তেই চায় না ইত্যাদি – এরকম। এমন ভঙ্গিতে  আগের কোন ভারত সরকার এমন করে কথা বলে নাই। তাহলে কেন এখন বলছে???

আচ্ছা, ভারত সরকার কী সবসময়ই এমন ভেটো সদস্য হতে চেয়ে কথা বলত বা বলেছে?? এসম্পর্কে ফ্যাক্টস বা জবাব হল – না, একেবারেই না। বরং ভেটো সদস্যপদের আকাঙ্খী কোন এক ভারত – আমরা দেখছি কেবল এই চলতি শতকে; তাও সেটা বুশের আমলে (২০০১-৮) গোপনে আর ওবামার আমলে (২০০৯-২০১৬) প্রকাশ্যে। আরো সুনির্দিষ্ট করে বললে, ২০০৭ সালের সেকেন্ড হাফে যখন এশিয়ায় চীন ঠেকাও [china Containment] বলে  আমেরিকা খামোখা ও বাস্তবায়ন-অযোগ্য এক শখে পড়ে এই এসাইনমেন্ট বা ঠিকা সে ভারতকে দিয়েছিল; তা থেকেই সবকিছুর উতপত্তি!! তবে এতে মজুরি হিসাবে বাংলাদেশকে ভারতের হাতে তুলে দেয়া হয়ে গেছিল!। যদিও আগে আমেরিকা বুঝে নাই যে তার চীন ঠেকানোর খায়েস – এটা খামোখা ও বাস্তবায়ন-অযোগ্য এক শখ মাত্র। আর এটা ২০১৯ সালের পর থেকে আমেরিকা নিশ্চিত হয়ে যায়; ফলে বাদ রেখে দিয়েছে। যার বাইরের প্রকাশ আমরা একটাই দেখেছিলাম যে মার্কিন স্টেট ডিপার্টমেন্টে [পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে] বাংলাদেশকে আলাদা করা হয়েছিল; মানে ভারতের সাথে একই ডেস্ক বা বিভাগ থেকে আর পরিচালনা করা হয় না। আর বাংলাদেশকে ভারতের হাতে তুলে দেয়ার বাতচিত-পরিকল্পনা ২০০৭ সালের শেষের দিকে খতম হয়ে গেলেও  – সেটা পেকে উঠেছিল ২০০৯ সালের জানুয়ারিতে যখন ওবামা নয়া প্রেসিডেন্টের শপথ নিয়েছিলেন এর পরে। ততদিনে হাসিনা সরকারও বাংলাদেশে আসীন হয়ে গেছিল। আর সেসব দিনগুলোতে আমার প্রতিটা লেখায় ব্যাপারটা ব্যাখ্যা করতে আমি লিখতাম, মুরুব্ববি আমেরিকা ভারতের পিঠে একটু হাত রেখেছে তাতেই ভারতের আচার-আচরণে একটা পরাশক্তি ভাব যেন, সে পরাশক্তি হয়েই গেছে তা ফুটিয়ে তোলা শুরু করে দিয়েছিল ভারত! তখন প্রণব মুখার্জিরা বলে বেড়াত ওবামা নাকি তাদেরকে আশ্বস্ত করেছে যে ভেটোসদস্যপদ এবার তারা পাচ্ছেই!!  আর এর কয়েকমাসের মধ্যে ভারতেও কংগ্রেস পার্টি টানা দ্বিতীয়বারও ক্ষমতা এসেছিল। আর প্রণব মুখার্জি সেবার পররাষ্ট্রমন্ত্রী ছেড়ে অর্থমন্ত্রী হয়েছিলেন। সেসময় তিনি ধরেই নিয়েছিলেন আর সেভাবেই কথা বলতেন যেন ভারত তো ভেটো সদস্য হয়েই গেছে বা যাচ্ছে!!!  যদিও এটা ঠিক যে বুশের আমলে ২০০৫ সালে বুশের দিল্লি সফরে ভারত-মার্কিন অসামরিক পরমাণু চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়ে গেছিল। আর এরপরের ২০০৯ সালে  চীন ঠেকাও এর ঠিকা পাওয়াতে ভারত তখন  ফ্ল্যাইয়িং হাই [flying high] বা আকাশে উড়ছে!! প্রেসিডেন্ট ওবামা নাকি তাঁকে বলেছিল, তাই প্রণব মুখার্জি বিশ্বাস করতেন যে ভারতের ভেটো-পদ পাওয়ার আকাঙ্খা ওবামা সমর্থন করবেন। এমনকি ২০১০ সালের জানুয়ারিতে হাসিনা প্রথম ভারত সফরে গেলে উতসাহের ঠেলায় প্রণব মুখার্জি ভারত-বাংলাদেশ যৌথ ঘোষণায় লেখায় নেন যে বাংলাদেশও সেটা সমর্থন করছে।  অথচ বোকাদের এমন কান্ড  এর মানে হল, প্রণব মুখার্জির জাতিসংঘ সম্পর্কে বুঝটা হল যে, প্রেসিডেন্ট ওবামা বা হাসিনা সমর্থন করলেই ভারতের ভেটো সদস্যপদ পাওয়া আর ঠেকায় কে???

জাতিসংঘ সম্পর্কে ভারতের বুঝের অভাব নিজ জন্মসময় থেকেইঃ
প্রনব মুখার্জিই প্রথম নেতা নন যার জাতিসংঘ সম্পর্কে বুঝে ঘাটতি আছে। এবং শুনতে খারাপ লাগলেও কথাটা সত্য যে,  জাতিসংঘ জিনিষটা কী সে সম্পর্কে সম্ভবত সবচেয়ে বেশি গোঁয়াড় ও  অ-বুঝের ধারণা ছিল জওহরলাল নেহেরুর! আর একালে এটা জয়শঙ্কর পর্যন্ত আমরা দেখতে পাচ্ছি, অবস্থা একই আছে। মানে কোন জিনিষ সম্পর্কে বুঝাবুঝি না থাকলে আর গোয়াড় হলে অবলীলায় গর্বের মুডে ডাটের সাথে বোকা বোকা প্রশ্ন তো করাই যায়!! তাই না?

প্রথম কথা হল জাতিসংঘ কী? মানে কী ধরণের সংগঠন এটা?  যদিও অনেকরই অদ্ভুত সব অযাচিত ধারণা  আছে জাতিসংঘ নিয়ে; এর মধ্যে আবার যারা কমিউনিস্ট-প্রগতিশীল তারা আরেক কাঠি সরেস! যেমন এদেরকে এমন জ্ঞানের ভান্ডার খুলে বসতে দেখা যায় যে  – জাতিসংঘ একটা সাম্যের (ইউনিফর্ম রাইট বা সমান অধিকার) সংগঠন। মানে হল জাতিসংঘ যেন এমন একটা সংগঠন যার সদস্যদের সবারই সমান অধিকারের।  কিন্তু জাতিসংঘ এমন তা একেবারেই নয়। জাতিসংঘের সব সদস্য-রাষ্ট্রের সমান বা একই অধিকারের অধিকারী তা নয়।  বরং জন্ম থেকেই জাতিসংঘ-কে অসাম্য করে রেখেই, অসাম্যের ভিত্তিতেই  গড়ে তোলা হয়েছে।  সিকিউরিটি কাউন্সিল বলে জাতিসংঘের ভিতরেই একটা আলাদা কমিটি বানানো আছে যা মোট ১৫ সদস্যের (১০ সদস্য অস্থায়ী বিভিন্ন মহাদেশ থেকে দুবছরের জন্য একেক্টা রাষ্ট্রকে এর সদস্য করা হয় ) আর (৫টা স্থায়ী এবং ভেটো সদস্য) এভাবে। এই সিকিউরিটি কাউন্সিল আর ভেটো-পদ দেখলেই তো পরিস্কার বুঝা যায় যে জাতিসংঘের গঠন-প্রণালি সাম্য-নীতির ভিত্তিতে নয়। তা ইচ্ছা করেই করা হয়েছে। কিন্তু কেন, সেটাই আমরা এখানে বুঝার চেষ্টা করব।

প্রশ্ন হল, কেন ভেটো-পদ ওয়ালা এক জাতিসংঘ-ই বানানো হয়েছিল?। আর সেটা জানা হলে আর এই প্রশ্ন বোকামির হয়ে যাবে যে কেন জাতিসংঘ সাম্য-নীতির প্রতিষ্ঠান হল না নয়। বরং বুদ্ধিমানের হবে প্রশ্ন করা যে ভেটো-পদ ওয়ালা এক জাতিসংঘ-ই কেন বানানো হয়েছিল?  আর কমিউনিস্ট-প্রগতিশীলদের একছত্র নেতা জোসেফ স্টালিন; তিনি কেনইবা এই অসাম্য-নীতির মানে “ভেটো-পদওয়ালা এক জাতিসংঘ-ই” মেনে নিয়েছিলেন? মনে রাখতে হবে কমিউনিস্ট-প্রগতিশীলদের চোখে স্টালিন তো নাকি “দুনিয়ার সব শোষণের বিরুদ্ধে আপোষহীন” এক কঠিন লড়াকু!!!

জাতিসংঘ তৈরির প্রস্তাব কে করেছিল ও কেনঃ
সবচেয়ে গুরুত্বপুর্ণ প্রশ্ন হল এটা। আর এর জবাব ঠিকমত বুঝলে বা ঠিকঠাক জেনে নিলেই একমাত্র সব পরিস্কার হবে।
কবে থেকে জাতিসংঘ কার্যকর হয়েছে সে হিসাবে এটা ১৯৪৫ সালের ঘটনা। কিন্তু এরও আগে জাতিসংঘের আনুষ্ঠানিক জন্ম-ঘোষণা [DECLARATION DAY] ধরা হয় ১৯৪২ সালের ১ জানুয়ারি।  এদিনটা একই সাথে আমেরিকার জন্য দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে প্রথম অংশ নেওয়ার দিন ছিল। মানে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের বিস্তার (১৯৩৯-৪৫) এই সময়কাল হলেও শুরুতে আমেরিকা এথেকে দূরে ছিল, কোন পক্ষের হয়েই এই যুদ্ধে  অংশ নেয় নাই। সেই ১ জানুয়ারি ১৯৪২ সালে আমেরিকা হিটলারবিরোধী মিত্রপক্ষ [allied force] গড়ে নিয়ে প্রথম যুদ্ধে অংশ নিয়েছিল। সাথে সোভিয়েত ইউনিয়নও সেদিন থেকে এই যুদ্ধ-জোটে আনুষ্ঠানিকভাবে যুক্ত হয়েছিল। আসলে হিটলারবিরোধী মিত্রপক্ষ জোট গড়া আর জাতিসংঘ প্রতিষ্ঠান গড়ার ধারণা একই আলাপের দুইটা অংশ। আর এই জাতিসংঘ গড়ার ধারণাটা এনে প্রস্তাব করেছিলেন ততকালীন আমেরিকান প্রেসিডেন্ট রুজভেল্ট।   কথাটা আমেরিকান প্রস্তাব না বলে রুজভেল্টের প্রস্তাব বলেছি এর পিছনের কারণ আছে।
কারণটা হল, আমেরিকা ১৯৪২ সালেই প্রথম জাতিসংঘের প্রস্তাব করেছিল তা নয়। এর আগে যে টাকে প্রথম বিশ্বযুদ্ধ (১৯১৪-১৮) বলি আমরা সে সময়ও যুদ্ধের শেষের দিকে আমেরিকা জাতিসংঘের মতই আরেকটা প্রতিষ্ঠান গড়ার প্রস্তাব করেছিল। ওর নাম ছিল “লীগ অব নেশন” League of Nations] এর  জন্ম ও চালু হয়েছিল ১৯২০ সালে। মূলত প্রথম বিশ্বযুদ্ধে হেরে যাওয়া জর্মানির কাছ থেকে বৃটিশ-ফরাসীদের ক্ষতিপূরণ আদায় করতে ফ্রান্সের ভার্সাই নগরিতে আলোচনা বসেছিল; যার আউটকাম বা চুক্তি,  সেটাকেই ভার্সাই চুক্তি বলে। তখনকার আমেরিকান প্রেসিডেন্ট ছিলেন উড্রো উইলসন। তাঁর প্রস্তাব ছিল সাথে একটা  লীগ অব নেশন প্রতিষ্ঠানও গড়ে নিবার। তাই কার্যত যেটা হয়েছিল, ক্ষতিপূরণ দেয়া বা আদায় ছিল ইউরোপীয় স্বার্থ বা ইস্যু। বিপরীতে আমেরিকা চেয়েছিল এই সুযোগে জাতিসংঘের সমতুল্য একটা “লীগ অব নেশন” গড়ে নিতে। তাই, শেষ পর্যন্ত একটা আপোষ হয়েছিল যে দুটাই করা হবে যাতে এই দুই স্বার্থই জায়গা পাবে। মানে, পরস্পর পরস্পরের স্বার্থকে স্বীকৃতি দিবে। তাই ফরমাল বাক্যটা দাড়ায় এভাবে  ক্ষতিপুরণ আদায়ের ইন্সটিটিউশন হিসাবে লীগ অব নেশন গড়ে নেয়া হবে।
এখানে একটু সংক্ষেপে বলে নেই যে লীগ অব নেশন এর পরিণতি কী হয়েছিল। প্রথমত এটা টিকে নাই। ১৯২৯-৩০ সালের গ্লোবাল মহামন্দার  [Great Recession] বাস্তবতা সব উলটে যায়। এতে  জর্মনীর জনমত ঐ ক্ষতিপূরণ না দিবার পক্ষে শুরু থেকেই ছিল। ১৯৩২ সালে হিটলার নির্বাচিত হয়ে কোয়ালিশন সরকার গড়েছিলেন। তিনি ক্ষতিপূরণ দেয়ার দায় না মানার পক্ষে জনমত সাজিয়ে নেন। আর দ্বিতীয়ত, লীগ অব নেশন এর সবচেয়ে বড় অসঙ্গতি ছিল এর সদস্যরা ছিল বিভিন্ন ধরণের যে কোন রাষ্ট্র। মানে যেমন কলোনি-দখলদার রাষ্ট্রও ছিল  আবার যে পরে কলোনি দখলে চলে যেতে পারে এমন রাষ্ট্রও ছিল। যেমন রাজতন্ত্রী ইথিওপিয়া লীগ অব নেশন এর সদস্য হয়েছিল। কিন্তু পরবর্তিতে ইথিওপিয়া (হিটলারের সাগরেদ) ইতালির মুসোলিনির হাতে কলোনিদখল হয়ে যায়। অথচ এনিয়ে লীগ অব নেশন-এ  ইথিওপিয়া নালিশ দিলেও (যেখানে বৃটেন, ইতালি সবাই সদস্য) লীগ অব নেশন এর কোন বিচার করতে পারে নাই, চুপ ছিল। মূল কারণ, কে বচার করবে? কারণ প্রভাবশালী সব রাষ্ট্রই ছিল কলোনিদখলদার। তাই কে কাকে কী বলবে। যেমন বৃটেনের উপায় ছিল না যে বলে ইতালির ইথিওপিয়াকে কলোনিদখল নেয়াটা অন্যায় হয়েছে। মূলত এসব কারণেই লীগ অব নেশন কার্যত ঠুঠো-অকার্যকর হয়ে গেছিল। পরে ১৯৪৫ সালে জাতিসংঘ জন্ম হলে লীগ অব নেশন তাতে বিলীন হয়ে গেছে ধরে নেয়া হয়েছিল।

এখন প্রশ্ন হল আমেরিকা জাতিসংঘ বা লীগ অব নেশন ধরণের প্রতিষ্ঠান গড়তে চায় কেন?
জবাবে এককথায় বললে, আমেরিকাই প্রথম রাষ্ট্র যে বুঝেছিল যে যুদ্ধ ভাল জিনিষ নয়। কারণ, যুদ্ধ রাষ্ট্র-জনগণের জমানো সম্পদ নষ্ট করে দেয়। অথচ যেকোন দুই রাষ্ট্রের স্বার্থের সংঘাত নিরসনে যুদ্ধকেই একটা উপায় মানা হয়। বিশেষত যে রাষ্ট্রের সা্মরিক শক্তি ভাল বলে নিজ ধারণা থাকে। তা সত্বেও বাস্তবতা হল, যুদ্ধে জড়ানো মানেই জমানো সম্পদ নষ্ট বা পুঁজি নষ্ট এতে হবেই। আমেরিকায় এই জনমত প্রবল হয়ে উঠেছিল। এমন হবার পিছনের কারণ হল, ১৭৭৬ সালে যে আমেরিকা স্বাধীন হল, এই স্বাধীনতা মানে ইউরোপের বিভিন্ন দেশ থেকে আমেরিকায় যাদের আনা হয়েছিল তারাও সাদা-ককেশীয় হলেও তাদের ইউরোপের বড়লোক যারা কলোনিদখল ব্যবসায়ীর, তারাই এই গরীর ককেশীয়দেরকে আমেরিকা নিয়ে এসে ছেড়ে দিয়েছিল। আর তাদের আয় যা হত এর সিংহভাগ তারা লুটে নিত, এই ছিল কলোনিদখলদারদের ব্যবসা। আর এই কলোনিয়াল লুটের বিরুদ্ধেই ছিল তাদের ১৭৭৬ সালের স্বাধীনতা যুদ্ধ; এতে জড়ানো ও বিজয় আনা। কিন্তু এর অন্য দিকটা হল তাদেরকেও এই যুদ্ধ করতে গিয়ে তাদের সঞ্চিত সম্পদ ও পুঁজি হারাতে হয়েছিল। তা সত্বেও তাদের এই যুদ্ধ কলোনিদখলদার বিরোধী বলে স্বাধীন আমেরিকার জনমত হয়ে গেছিল প্রবল এন্টি-কলোনিয়াল। মানে, সেকালের ল্যাটিন (দক্ষিণ) আমেরিকার কোন কোন দেশকে স্বাধীন আমেরিক দখল করলেই নিজ জনমত এর কাজের বিরুদ্ধে চলে যেত। তাই স্বাধীন আমেরিকা স্বাধীন হবার পরে নিজে ফিরে কাউকেই কলোনি করে রাখতে পারে নাই।
এর উপর আবার এর মাত্র ৮৪ বছরের মধ্যেই ১৮৬০ সালে স্বাধীন আমেরিকা আবার আরেক যুদ্ধে জড়িয়ে যায় – তবে এটা গৃহযুদ্ধ। সাদা-কালোর লড়াই বা  সাদা-কালোর সমান অধিকারের জন্য লড়াই! কেন এমন হয়েছিল?
কারণ, আফ্রিকা থেকে আমেরিকায় ধরে আনা কালো দাসেরা ১৭৭৬ সালের স্বাধীনতা যুদ্ধের সময়ে এই যুদ্ধে বিরুদ্ধ্বপক্ষ মানে ককেশীয় বড়লোক কলোনিমাস্টারের পক্ষে অস্ত্র হাতে লড়াই করেছিল। একারণে, স্বাধীন আমেরিকায় কালো মানুষদের জন্য সমান অধিকার রাখা বা দেয়া হয় নাই। আর সেটা নিয়েই ১৮৬০-৬৫ এই পাঁচ বছর কালো-সাদার গৃহযুদ্ধ চলেছিল। ১৮৬৫ সালে অন্তুত আমেরিকান কনষ্টিটিউশনে সংশোধনী এনে কালো-সাদা নির্বিশেষে সবার নাগরিক সমান অধিকার, সবাই সমান অধিকারের নাগরিক – এটা মেনে নিয়ে সেবারের বিরোধ মিটানো হয়েছিল। কিন্তু সেবারও আবার প্রমাণ হয়েছিল যে যুদ্ধ মানে সঞ্চিত সম্পদ নষ্ট করা।

তাই সেই থেকে সমাজের সমষ্টিস্বার্থ নিয়ে যারা চিন্তা করতে পারে সমাজের এমন চিন্তকদের অবস্থান হয়ে দাঁড়ায় যে, যতটা সম্ভব যুদ্ধ এড়িয়ে চলাটাই সবচেয়ে ভাল। যদিও তারা বাস্তবতা বুঝত যে দুনিয়া থেকে যুদ্ধ একেবারে বিলীন করা যাবে না। আর সেখান থেকে প্রথমত সব রাষ্ট্রকে নিয়ে একটা জাতিসংঘ গড়া – একটা  গ্লোবাল প্রতিষ্ঠান তৈরি করা; যাতে পরে নানান ইস্যুতে সকল সদস্যদেরকে নিয়ে নানা ইস্যুতে আন্তর্জাতিক কনভেনশন, আইন তৈরি করে নেয়া যায়। যার মূল লক্ষ্য হল, ওসব আইন-কনভেনশন কে ভিত্তি মেনে সেই ভিত্তিতে যেকোন দুই রাষ্ট্রের স্বার্থবিরোধ সংঘাতের আপোষ মীমাংসা [arbitration] ও বিচার [ Legal judgement] করে নেয়া।
তাহলে জাতিসংঘের মূল কাজ হল,  আন্তর্জাতিক কনভেনশন, আইন তৈরি করা; আর যেকোন দুই রাষ্ট্রের (বা কতগুলো রাষ্ট্রস্বার্থের) স্বার্থবিরোধ সংঘাত দেখা দিলে ওসব আন্তর্জাতিক কনভেনশন, আইন এর ভিত্তিতে তা নিয়ে যতদুর সম্ভব যুদ্ধ এড়িয়ে একটা আপোষ মীমাংসা [arbitration] ও বিচারে পৌছানো। এককথায় যথা সম্ভব যুদ্ধ এড়ানো।
একটা দেশ-সমাজে যেমন বিচার ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করে সমাজে শান্তি-শৃঙ্খলা বজায় রাখার উপায় খুজা হয় ও সম্ভব; ঠিক সেরকম আন্তরাষ্ট্রীয় সমাজেও জাতিসংঘের অধীনে আগে থেকেই তৈরি আন্তর্জাতিক নানা আইন-কনভেনশন কে ভিত্তি মেনে একটা আপোষ মীমাংসা  ও বিচারে পৌছানোর চেষ্টা করা যাতে রাষ্ট্রস্বার্থের বিবাদগুলোতে যুদ্ধ না করেই মীমাংসা করে দেয়া যায়।

তবে মনে রাখতে হবে জাতিসংঘের জন্ম ভিত্তি হল কোন ভুখন্ডের বাসিন্দাদেরকে অন্য কোন রাষ্ট্রই কলোনি করে রাখতে পারে না। কলোনি দখল হারাম। আর কোন ভুখন্ডের বাসিন্দারাই একমাত্র এক্তিয়ার রাখে যে তারা কার দ্বারা, কিভাবে শাসিত হতে চায়। অর্থাৎ কলোনি দখলদারদের (যেমন বৃটেন) এব্যাপারে কিছুই বলার কোন এক্তিয়ার নাই।  এটাই জাতিসংঘের জন্ম ভিত্তির নীতি

আবার এর ভিতর দিয়ে পড়ে পাওয়া গেছে আরেকটা দিক! কেমন সেটা?
যেহেতু কোন ভুখন্ড বা দেশের ভাগ্য কী হবে তা নির্ধারণের একমাত্র এক্তিয়ার ও ভিত্তি হল ঐ ভুখন্ডের বাসিন্দারা আর এই নীতি ও ভিত্তি মানা হয়েছে কলোনি শাসন নিষিদ্ধ করতে; কিন্তু এতে এই ফাঁকে যেকোন রাজা-বাদশা-আমীর-মোনার্কি সকলের শাসনই জাতিসংঘের চোখে অবৈধ হয়ে গেছে। যেমন বাংলাদেশের বেলায়,  কেবলমাত্র বাংলাদেশের বাসিন্দারা যদি  রাজা-বাদশা-আমীর-মোনার্কি শাসন চায় তবেই কেবল এসব শাসন থাকতে পারে। জাতিসংঘও তা মানবে। কিন্তু না হলে???  না হলে বাংলাদেশের মত সকল বাসিন্দা রাজা-বাদশা-আমীর-মোনার্কি সকলের শাসনই জাতিসংঘের চোখেও অবৈধ হয়ে যাবে।   ঠিক যে জিনিষটা এখনকার আফগানিস্তানে হয়ে আছে!!!

নেহেরুর জাতিসংঘ বুঝঃ
নেহেরুও জাতিসংঘের এই জন্মগত ভিত্তি নিয়ে কোন ধারণা নাই। এর সবচেয়ে ভাল উদাহরণ হল কাশ্মীর ইস্যু! নেহেরুর ধারণা কাশ্মীরের শেষ রাজা যেহেতু অখন্ড কাশ্মীরকে (-ইন্সট্রুমেন্ট অব একশেশন) চুক্তি করে ভারতের সাথে যুক্ত করে দিয়ে গেছে তাহলে তো সারা কাশ্মীরই ভারতের অংশ হয়ে গেছে। এইবার ভাল মানুষ সেজে এসব কাগুজে দলিলের কপি জাতিসংঘের কাছে পাঠিয়েছিলেন নেহেরু। এই ভরসায় যে তাহলে এই বার নিশ্চয় জাতিসংঘ অখন্ড সারা কাশ্মীরকে ভারতের অংশ বলে রায় দিবে!!! কিন্তু হায়! নেহেরু জানেনই না যে জাতিসংঘের জন্ম ভিত্তি কী? জাতিসংঘ যে রাজার এক্তিয়ার মানে না; বরং ভুখন্ডের বাসিন্দাদের মতামত মানে গণভোট বা রেফারেন্ডামকেই একমাত্র ভিত্তি মানে তা নেহেরুর জানা ছিল না। তাই জবাবে জাতিসিঘ নেহেরুকে জানায় যে কাশ্মীরে কেবলমাত্র একটা গণভোটই এই প্রশ্নের মীমাংসা করতে পারে। কাজেই রাজার ইচ্ছা নয়, বাসিন্দাদের গণভোট – একমাত্র এর ভিত্তিতেই একমাত্র ঠিক হয়ে পারে কাশ্মীর কার সাথে যুক্ত হবে নাকি নিজে স্বাধীন থাকবে। এর পরবর্তিতে নেহেরু সহ কেউই সেই গণভোট অনুষ্ঠান আর আয়োজন করেন নাই। অথচ সবাই দাবি করে চলেছেন সারা কাশ্মীর নাকি ভারতের?????

তাহলে এখন আমরা জানতে পারলাম যে কেন আমেরিকা জাতিসংঘ ধরণের প্রতিষ্ঠান গড়তে চেয়ে এসেছে সব সময়। এমনকি প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পরে ১৯২০ সালে ততকালীন আমেরিকান প্রেসিডেন্ট উড্রো উইলসনও এক “লীগ অব নেশন” গড়তে চেয়েছিলেন একই কারণে। আর তাতে আমেরিকা বুঝে গিয়েছিল যে কলোনি শাসন দুনিয়া থেকে উচ্ছেদ না করলে  “লীগ অব নেশন” এর মত সংগঠন টিকবে না। একারণেই জাতিসংঘ গড়ার বেলায় প্রথম শর্ত বা ভিত্তি করেছিলেন যে কলোনিদখল অবৈধ – এটাই হবে মূলভিত্তি।
র একারণেই দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় জাতিসংঘ ধরণের প্রতিষ্ঠান গড়তে প্রস্তাব রাখেন ততপকালীন প্রেসিডেন্ট রুজভেল্ট!

 

স্তালিন রুজভেল্টের জাতিসংঘ গড়ার প্রস্তাব প্রত্যাখান করেনঃ
সোভিয়েত প্রেসিডেন্ট স্তালিন রুজভেল্টের জাতিসংঘ গড়ার প্রস্তাব সবার আগে প্রত্যাখান করেন। কেন?
স্তালিনের আপত্তি বা প্রত্যাখান ছিল জেনুইন। তাই-ই হবার কথা! কেন?
রুজভেল্ট জাতিসংঘ চাচ্ছেন আন্তঃরাষ্ট্রীয় স্বার্থবিরোধ গুলোকে অনেকখানি বা যতদুর সম্ভব কমিয়ে আনার জন্য – বিচার সালিশীর মাধ্যমে মীমাংসার পথ খুলবার জন্য জাতিসংঘ ধরণের প্রতিষ্ঠান গড়তে চান। সেটা ঠিকই আছে। কিন্তু স্তালিনের আপত্তিটা সেখানে ছিল না। স্তালিনের আপত্তিটা ব্যবহারিক! কারণ, বাস্তব দুনিয়ায় জাতিসংঘ বাস্তবায়নের সমস্যাগুলো অন্য কোথাও। সেটা কোথায়?
স্তালিনের সঠিক এক যুক্তি ছিল যে জাতিসংঘের কোন সিদ্ধান্ত গ্রহণের ভিত্তি বা নিয়ম কী হবে?  মানে কী ধরণের সাধারণ সংখ্যাগরিষ্ঠতায় মানে তা কী ৫০% এর বেশি সদস্যদেশ একটা অবস্থানের পক্ষে থাকলেই সেটাই জাতিসংঘের সিদ্ধান্ত হয়ে যাব? স্তালিন এমন জাতিসংঘ গড়ার বিরোধী ছিলেন! এমনকি যদি বলি এটা ৫১% না; একেবারে ৬৬% সদস্য একদিকে থাকতে হবে কিংবা ৭৫% সদস্য একদিকে থাকতে হবে – এভাবে ভিত্তি ঠিক করতে হবে? তাতেই কিছু এসে যাবে না। তবু স্তালিনের আপত্তি সঠিক! কেন?

কারণ, যেটাকে আমরা পরাশক্তি বলে বুঝি এর সারকথা হল ইনফ্লুয়েন্স বা প্রভাব! অন্য রাষ্ট্রের উপর প্রভাব ছড়ানো। এমন পরিস্থতিতে যেকোন পারসেন্টেজের ভিত্তিতেই এমন সিদ্ধান্ত হোক না কেন তা আপত্তিকর হবে। কারণ, আমেরিকা এই প্রভাব বিস্তার করতে পারার সক্ষমতা রাখে। আমেরিকা শুধু অবকাঠামো ঋণ বিতরণ করেই ৭৫% এর বেশি গরীব-দেশকে প্রভাবিত করার ক্ষমতা রাখে। যেটা এখন পালাবদলে চীনের হাতে ও দখলে ক্রমশ তা চলে যাচ্ছে!  অর্থাৎ ফলাফলে এভাবে জাতিসংঘের সব সিদ্ধান্তই রাশিয়া বা সোভিয়েত ইউনিয়নের বিরুদ্ধে আমেরিকার পক্ষে একচেটিয়া ভাবে  নিয়ে নেয়া সম্ভব হবে। তাই স্তালিনের আপত্তি জেনুইন! আর ওদিকে রুজভেল্টের কাছে ব্যাপারটা হল, সোভিয়েত ইউনিয়নকেও রুজভেল্টের প্রস্তাবের পক্ষে “অনবোর্ড” বা তুলে নিতে না পারলে জাতিসংঘ ধরণের কোন গ্লোবাল প্রতিষ্ঠান জন্মাবার কোন চান্স নাই! তাহলে?
সারকথায়, কাজেই স্তালিনের আপত্তির জবাব বা একটা সন্তোষজনক জবাব বা আরো ভাল করে সংশোধিত প্রস্তাব আনা – সেটা রুজভেল্টকে করতে হবেই!

আসলে রুজভেল্টের দিক থেকে সেই মোক্ষম সংশোধিত প্রস্তাবটাই ছিল ‘ভেটো পদ্ধতি’। আসলে ভেটো মানে ঠিক কী বুঝায়?  জাতিসংঘের মত প্রতিষ্ঠানে যেসব সদস্যের ভেটো ক্ষমতা থাকবে এর মানে হল সেসব রাষ্ট্রেরও ভোট একটাই অবশ্যই। কিন্তু সে দেশ একা আপত্তি দিলেই ঐ প্রস্তাব আর পাশ করার অযোগ্য হয়ে যাবে। এই হল ভেটোসদস্য কথাটার অর্থ! অর্থাৎ জাতিসংঘের কোন প্রস্তাব পাশ ঠেকাতে গেলে এক ভেটোসদস্য ওয়ালা দেশের ভোটই যথেষ্ট! এই হল ভেটোর খাস অর্থ!

তাহলে পাঁচ ভেটো সদস্য করার মানে কীঃ
এটা ব্যাখ্যা বুঝলে জাতিসংঘ প্রতিষ্ঠানকে আরও ভাল ভাবে জানা যাবে।
একথাটা সেই সময়ের প্রেক্ষিতে, কোন কোন দেশ তাদের একক সামরিক সক্ষমতাই এত বেশী যে সেই একক দেশ দুনিয়াতে গ্লোবাল সামরিক যুদ্ধ লাগিয়ে দেয়া সম্ভব? এমন প্রভাব বিস্তারি সক্ষমতার চারটা দেশকে চিহ্নিত করা হয়েছিল প্রথমে। এরা হল,  সেকালের সোভিয়েত ইউনিয়ন, আমেরিকা, ইউকে আর ফ্রান্স। কিন্তু তাতে এবার চিন্তা করে দেখা যায় যে এর সবগুলোই পশ্চিমাদেশ! কিন্তু এতে এশিয়ায় কোন দেশ নাই কেন? এই প্রশ্ন উঠবে। তাই উপস্থিত সময়ের হিসাবে সামরিকভাবে সেসময় একমাত্র জাপান-ই ছিল কলোনিয়াল পাওয়ার হিসাবে এশিয়ায় অন্য যেকোন দেশের চেয়ে সামরিক দিকে সবার চেয়ে এগিয়ে। কিন্তু জাপান আবার ছিল হিটলার-মুসোলিনির ক্যাম্পের ও তাদের সঙ্গি! অতএব জাপান বাদ হয়ে যায়। এর বদলে জাপানের হাতে সবচেয়ে নিগৃহিত চীনের কথা মাথায় আসে। এছাড়া চীনের প্রতি আমেরিকার এক প্রবল আগ্রহও ছিল। তাই এশিয়া থেকে চীনকে যে আগামিতে শক্তি হয়ে উঠবে বা আমেরিকা একে গড়ে নিবে এই ধারণা থেকেই আমেরিকা চীনের নাম প্রস্তাব করেছিল। এছাড়া আসলে আমেরিকা ছাড়া বাকি তিনদেশ (সোভিয়েত ইউনিয়ন, ইউকে আর ফ্রান্স) এরা নিজে ভেটো ক্ষমতা পাবে এটা শুনেই তারা আমেরিকার উপর এতই সন্তুষ্ট ছিল যে তারা আর আমেরিকার চীনের নেয়ার ব্যাপারে (ভেটো সদস্যপদ দেয়াতে) আপত্তি করে নাই। যদিও মনে রাখতে হবে সেসময়ের চীন সেটা মাওয়ের চীন নয়। মাওয়ের উত্থান বা কমিউনিস্ট বিপ্লব হয়েছিল আরো চার বছর পরে ১৯৪৯ সালে। তাই কোন দেশ আর চীন নিয়ে আপত্তির কিছু দেখে নাই!

তাহলে সারকথাটা এখন কী হল?
হল যে, সে সময়ের প্রেক্ষিতে সামরিক শক্তিতে যেসব দেশ একাই একটা যুদ্ধ পরিস্থিতি তৈরি বা বাড়িয়ে নিবার ক্ষেত্রে সক্ষম তাদেরকেই ভেটো ক্ষমতা পাবার যোগ্য বিবেচনায় ভেটো-সদস্যপদ দেখা হয়েছিল। যারা একক দেশ ভেটো প্রয়োগ করে দিলে মানে তাদের যে কারো একটা ভোটই জাতিসংঘের যে কোন সিদ্ধান্ত হতে বাধা দিবার জন্য যথেষ্ট ছিল!  তার মানে সাথে আরেকটা কথাও পরিস্কার হয়ে যায় যে কোন সিদ্ধান্ত হতে গেলে ভেটোওয়ালা এই পাঁচ রাষ্ট্র একদিকে বা একমতে থাকলেই জাতিসংঘের আসরে সেতা সিদ্ধান্ত হয়ে যাবে।
কাজেই যারা সাম্যের ভিত্তিতে জাতিসংঘকে ক্লাব হিসাবে বুঝতে বা বানাতে চায় বা এমন ক্লাব কেন হয় নাই এমন আবদার করে তাদের থেকে আমরা অনেক দুরে। আর এতে আমরা এইবার অনেক জটিল সমস্যা সমাধান করে ফেলেছি তাই দেখছি!

সারকথায়, জাতিসংঘ এর সদস্যেরা এরা সকলের সমান অধিকার ভিত্তিক পাড়ার কোন ক্লাব নয়ঃ
এককথায় জাতিসংঘ এর সদস্যরা সবাই সম-অধিকারের এমন সদস্য না। এবং এটা বলে কয়ে। কারণ, জাতিসংঘ গড়ার ক্ষেত্রে এর সবচেয়ে বড় অসুবিধা হল, জাতিসংঘ এর যে কোন বিশেষ একটা দেশকে একেবারেই নিয়ন্ত্রণ করতে পারে না। বিশেষত, যে দেশের সামরিক সক্ষমতা এমনই যে সে জাতিসংঘ সদস্যপদ ত্যাগ করে চলে যেতে পারে আর পরে একাই দুনিয়ায় হাঙ্গামা-অস্থিরতা তৈ্রি করতে সক্ষম! তাই বাস্তবের এই দুনিয়ায় সাম্য-অধিকারের ভিত্তিক কোন জাতিসংঘ গড়া অসম্ভব! জাতিসংঘ তা নয়ও!
তাই জাতিসংঘকে বুঝতে হলে এর জন্মের প্রয়োজন কী ছিল সেদিক থেকে একে বুঝতে হবে। জাতিসংঘের জন্মের মূল প্রয়োজনটা হল যে দুনিয়াতে যুদ্ধ ছাড়াই যত বেশি আন্তঃরাষ্ট্রীয়-বিরোধ মীমাংসা করে দেয়া যায়। আর এটাই হবে জাতিসংঘ জন্এমামোর মাপকাঠি বা সাফাই! আর এতে এর সদস্য সকলের সমান অধিকারেরই হতে হবে এমন বায়না ধরা হয় নাই।

অথচ এখন ভারতের জয়শঙ্কর-কে দেখেন! জাতিসংঘ কী ও কেন তা নাবুঝার সুবিধা নিয়ে তিনি যা মনে চায় বলে গেছেন! যাকে বলে অজ্ঞতার সুবিধা, তা তিনি পুরাটাই ভোগ করেছেন! যেমন তিনি কথা বলেছেন একটা পুর্ব-অনুমান বা এজাম্পশনের উপর দাঁড়িয়ে যে সবচেয়ে ভাল বা আদর্শ হবে যদি জাতিসংঘ কে সবাই সমান অধিকারের সদস্যদের এক ক্লাব বলে গড়ে নেয়া যায়।  তাই তিনি অবলীলায় বলে যাচ্ছেন, কেন প্যাসেঞ্জার বাসের বুড়া যাত্রীরা যেমন ছোকরাদের জন্য বা নিউ-কামারদের জন্য সিট ছেড়ে দেয় না? জয়শঙ্করের এমন উদ্ভট বক্তব্য দিতে পেরেছেন জাতিসংঘ কেন জন্ম দেয়া হয়েছিল তা না বুঝলে যে সুবিধা নেওয়া যায় তা নিয়ে এমন যা খুশি তো বলাই যায়! তাই না!

আর বাস্তবতা হল, উপরে আমরা দেখিয়েছি কোন দেশ যদি একাই এমন সামরিক শক্তির না হয় যে সে একাই দুনিয়াতে নিয়ন্ত্রণ অযোগ্য পরিস্থিতি তৈরি করতে পারে তাহলে সে দেশের ভেট ক্ষমতার সদস্যপদ পাবার সম্ভাবনা নাই।  আগে সেই সামরিক শক্তি অর্জিত হয়ে থাকতে হবে।   অথচ ভারত নিজ সক্ষমতার খবর না নিয়েই চীনা সীমান্তে এগিয়ে মার খেয়ে এসেছে!

আবার দেখেন জয়শঙ্করের ভারত মনে করে পাঁচ ভেটো সদস্যদের চারটাই নাকি ভারতের অন্তর্ভুক্তি কামনা করে বা সমর্থন করবে! এই কথা শুনে মনে হয় এটা যেহেতু একটার বিরোধীতার বদলে চারটা ভেটো সদস্যের সমর্থন অতএব ভারতের ভেটোপদ পাওয়া উচিত! অবশ্যই এটা যথেষ্ট না। কারণ এখনকার নিরাপত্তা পরিষদের নিয়ম হল জাতিসংঘের যেকোন সিদ্ধান্ত  গৃহীত হতে হলে পাঁচ ভেটো সদস্যের পাঁচটাকেই ভারতের পক্ষে ভোট দিতে হবে। এটা ৪ঃ১ এমন না!

তার মানে মূল সমস্যা হল, জাতিসংঘ কেন জন্ম হয়েছে কী এর লক্ষ্য ইত্যাদি এসবের কোন খবর নাই, খবর না রেখেই জয়শঙ্কর ভাবছেন তার অজ্ঞতা মানুষ বুঝবে না!

জাতিসংঘের কথিত সংস্কার!
গ্লোবাল নেতৃত্বের পালাবদল ঘটা শেষ না হল জাতিসংঘের কোন সংস্কার হবার সম্ভাবনা একেবারেই কম! জাতিসংঘের যখন প্রথম জন্ম হয়েছিল তখন বাস্তবে বিপুল বিনিয়োগ করতে যোগ্য বা একাই যুদ্ধে বিপুল ব্যায়বহন সক্ষম এক আমেরিকা আগেই হাজির হয়ে ছিল। তাই সেই ওজনের উপর ভর করে প্রতিদ্বন্দ্বীদের পক্ষে নেয়া সহজ হয়েছিল। এই বিচারে পালা এবার চীনের এবং চীনের লক্ষ থেকে সেটা হতেই হবে বলেই অনুমান! জয়শঙ্করের উচিত হবে সেই ১৯৪২-৪৫ সময়কালকে স্টাডি করা। সেসময়কালের আমেরিকান ইতিহাস ঘাটতে হবে। এটা ভারত বলে নয়।  গ্লোবাল নেতৃত্বের পালাবদল ঘটা শেষ হলে তবেই জাতিসংঘের কোন সংস্কার হবার সম্ভাবনা। তাতে এটা ভারত বলে নয় অন্য যেকোন রাষ্ট্রের বেলাতেও একই কথা!

আশা করি সেপথে যেতে সবার আগে না জেনে ফটাফট কথা বলে বসা আমাদের বন্ধ করতে হবে!

 

 

 

 


সর্বশেষ আপডেটঃ   ২৫ ডিসেম্বর ২০২৩,  রাত ০৮ঃ ১০

গৌতম দাস
রাজনৈতিক বিশ্লেষক
goutamdas1958@hotmail.com

Leave a comment