বন্যার পানি বা পানি পাবার সমস্যা ভারতকে তোষামোদ-চাটুকারিতা করে মিটবে না


বন্যার পানি বা পানি পাবার সমস্যা ভারতকে তোষামোদ-চাটুকারিতা করে মিটবে না
গৌতম দাস
২৩ আগষ্ট ২০২৪
https://wp.me/p1sCvy-5H2

                          বন্যা মোকাবিলায় বাংলাদেশ–ভারতের নতুন ব্যবস্থার প্রস্তাব প্রধান উপদেষ্টার

 

সবার আগে এখন সারকথাটা বলিঃ
আন্তর্জাতিক নদী আইন এর শুরু বহু পুরানা ১৮৮৭ সাল থেকে। আর একালে জাতিসংঘের জন্মের পরে ২০১৪ সাল।
জাতিসংঘের কনভেনশন (২০১৪) অনুসারে অভিন্ন নদীর ক্ষেত্রে ভাটির দেশেরও সমান অধিকার আছে। তাই কমন বা অভিন্ন নদীতে উজানের দেশ এককভাবে নদীর প্রবাহে কোন বাধা সৃষ্টি (বাধ দিয়ে বাধা দেয়া আর যখন ইচ্ছা সেই বাধের পানি ছেড়ে দেওয়া; কখনো পানি প্রবাহের স্বাভাবিক গতিপথ ঘুরিয়ে দেয়া বা পানি অন্যদিকে টেনে নেয়া ইত্যাদি) করতে পারে না।  অথচ ভারত আমাদের  (৫৪ অভিন্ন নদীর প্রায় সব ) অভিন্ন নদীতে এমন নানান স্থাপনা নির্মাণ করেছে। আমাদের ভাটির দেশের অনুমতি না নিয়ে এবং একচেটিয়া যা খুশি করে।
[অভিন্ন নদীঃ মানে ভারত-বাংলাদেশ হয়ে শেষে বঙ্গোপসাগরে মিলেছে যে নদী; আবার হতেও পারে তা প্রথমে ভারতে প্রবেশের আগে হয়ত চীনে উতপত্তি। কিন্তু যেটাই হোক, ভারত-বাংলাদেশ হয়ে শেষে বঙ্গোপসাগরে মিলেছে যে নদী সেটাই এখানে অভিন্ন নদী বলতে বুঝানো হয়েছে। আর ভাটির দেশ [RIPARIAN country] বলতে এখানে মানে হল যে নদী ভারত-বাংলাদেশের অভিন্ন নদী এবং এই কমন নদীর ভাটির দেশ হল বাংলাদেশ, উজানের দেশ হল ভারত। ]

তাহলে এখন বাংলাদেশ সরকারকে  কী করতে হবেঃ 
বাংলাদেশ সরকার আনুষ্ঠানিকভাবে ভারতের কাছে জানতে চাইবে – ভাটির দেশ বাংলাদেশের অভিন্ন নদীতে কোন অধিকার আছে বলে কী ভারত মনে করে তাদের মনোভাব কী?
স্বভাবতই ভারত বলবে (অনুমান করি) আমরা জাতিসংঘেরসহ এমন কোন কনভেনশনে স্বাক্ষর করি নাই। তাই বাংলাদেশের অধিকার নিয়ে আমাদের আন্তর্জাতিক বা অন্যকোন বাধ্যবাধকতা নাই।

এখন আমাদের সরকারের করণীয় কী?
আমরা তখন ভারতকে জানিয়ে দিতে পারি যে, যে ভারত ভাটির দেশ বাংলাদেশের অভিন্ন নদীতে কোন অধিকার স্বীকার করে না সেই বাংলাদেশ ভারতের সাথে কোন সম্পর্ক রাখবে না, সব ধরণের “বিনিময় সম্পর্ক” ছিন্ন করছে।
এখানে এই বিনিময় বলতে বুঝতে হবেঃ ব্যক্তি সম্পর্ক থেকে পণ্য বিনিময়, বাণিজ্য ভাব ভালবাসাসহ সবকিছু। তবে বাংলাদেশের যারা ব্যক্তি ভাব ভালবাসা করতে চাইবে তারা তৃতীয় দেশে গিয়ে করতে পারে।
আর সীমান্ত সিল করা থাকবে, পাঁচ কিমির মধ্যে বিডিআর-সেনারা ছাড়া কোন নাগরিক যাবে না। ইত্যাদি
এমন এসব কিছু ভিন্ন আমাদের কী করার আছে অন্তত আমি দেখছি না।

 এখন ইউনুস সাহেব কী করছেনঃ
গতকাল ভারতের রাষ্টদুত প্রণয় ভার্মার সাথে তাঁর যে বৈঠক তাদেখে বলা যায় তিনি ভেবেছেন এটা ভারতের পিঠে হাত বুলিয়ে তিনি পার পাবেন। অথচ প্রথম কথাটা হল তিনি সমস্যার গোড়াটাই এখনও জানেন না। কোন হোমওয়ার্ক করা নাই।
তাই উনি চাচ্ছেন ভারত বাধ সহ যত রকমের বাধা অভিন্ন নদীতে দেয়া দিতেই থাকবে; বাংলাদেশের ভাটির দেশের পানিতে অধিকার ভারত পায়ে দলতেই থাকবে। কেবল বাধ খুলে দেয়ার (অটোমেটিক খুলে দেয়া সিস্টেমের বেলায় অটোমেটিক খুলে যাবে আর ভারত বলবে আমি বাধ খুলি নাই) আগে আমাদেরকে একবার জানিয়ে দায় খালাস করবে এই ব্যবস্থা চালু হোক।  আর আমরা পানিতে আমাদের অধিকার পাব না এটা চলতেই থাকবে। মোদি-মমতাও বলতে থাকবে আগে ভারতের লোক সব পানি তারাই কেবল করবে এরপর যদি বাচে তাহলে বাংলাদেশকে দেয়া যায় কিনা দেখা যাবে। আর বাধ দিয়ে তা ভেঙ্গে পড়লে বা আটকাতে নাপারলে ইচ্ছামত তা ছেড়ে দিয়ে আমাদের ভাসিয়ে দিবে। আর আমাদের ভারত-প্রেমি সেকুলার, কমিউনিস্ট, প্রগতিশীলেরা সাক্ষ্য দিয়ে বলতে থাকবে (এবারও অনেকে বলেছে) যে ভারতের কোন দোষ নাই!
কিন্তু অভিন্ন নদীতে বাধ দেয়া হল কেন? বাংলাদেশের পানিতে অধিকার কোথায় গেল ইত্যাদি এসব নিয়ে ইউনুস সাহেব কথা তুলতে চান না। আর এখাবেই তাই অন্তর্বর্তীকাল উনি ভারতের দালালি করেই কাটিতে চাইতেছেন!

আরও কিছু বাস্তবতাঃ
কিছু ভারত-প্রেমী মানুষ, কিছু কথিত পানি বিশেষজ্ঞ, কিছু পানি ও নদী সম্পর্কিত কথিত পরিবেশবাদী এনজিও কর্তা থেকে শুরু করে প্রধান উপদেষ্টা ইউনুস সাব পর্যন্ত সকলেই গতকাল খুব ব্যস্ত দিন কাটিয়েছেন। জেনে বা না জেনে কিভাবে ভারতকে বেকসুর দায় খালাস দিবেন, এই মহা দুশ্চিন্তায়!  তবু দুই তরুণ মন্ত্রী সাহস করে পাবলিক সেন্টিমেন্ট আঁচ করে বলেছেন “বিনা নোটিশে” ভারতের পানি ছেড়ে দেওয়ার বিরুদ্ধে; একে  “অমানবিক” বলেছেন। যদিও একথাটাও পুর্ণাঙ্গ না। উপরের কথাগুলো যদি বুঝে থাকেন তাহলে জানবেন! কেন তা বলছি।

একটা দুঃখের কথা দিয়ে শুরু করিঃ 
আজকে মানে এই ২০২৪ সালে, তো তবু ভারতের বিরুদ্ধে পানি বা সীমান্ত নিয়ে কিছু বলা যাচ্ছে। সাধারণ মানুষ নিজের তাগিদে বিক্ষুব্ধ হচ্ছে, ফুঁসে উঠেছে কিন্তু যারা সত্তর-আশির দশক দেখেছেন তারা মনে করে দেখতে পারেন সেকালে এমন কথা মুখে আনলে টিএসসি এর মোড় থেকে জীবন নিয়ে ফিরে আসা অসম্ভব ছিল। কমিউনিস্ট-প্রগতিশীলেরা (তারাও মনে করে দেখতে পারেন) এরা আপনার উপর ঝাপায় পড়ত সেকালে  ‘আপনি সাম্প্রদায়িক” একথা বলে! অর্থাৎ বাংলাদেশের নিজ স্বার্থে বাংলাদেশের কেউ ভারতের বিরুদ্ধে আপত্তি তুললেই আপনাকে বলা হত আপনি “সাম্প্রদায়িক”! এমনই ভারত-পুজারি ছিল এসব কমিউনিস্ট-প্রগতিশীলেরা!
এই পরিস্থিতির প্রথম বদল এসেছে ২০১৩ সালে ৫ মে এর পরে – শাহবাগীদের শাহবাগ আন্দোলন যখন প্রথমবারের মত পরাস্ত হয়েছিল; ধাক্কা খেয়ে চ্যালেঞ্জড হয়েছিল।
সেই থেকে আজকের অবস্থার তুলনা করেন। আসেন আপনাদেরকে একটু সাহায্য করি।

আজ (২৩ আগষ্ট) প্রথম আলোতে ছাপা হওয়া একটা বিবৃতির শিরোনামঃ

ভারত আন্তর্জাতিক আইন লঙ্ঘন করে বাঁধ খুলে দিয়েছে: বাম গণতান্ত্রিক জোট

 কারা এই বাম জোট?
আসেন পরিচয় করায় দেই। ঐ বিবৃতির শেষ প্যারাটা হল এরকমঃ “বাম গণতান্ত্রিক জোটের কেন্দ্রীয় পরিচালনা পরিষদের সমন্বয়ক ও বাসদের সাধারণ সম্পাদক বজলুর রশীদ, সিপিবির সভাপতি শাহ আলম, সাধারণ সম্পাদক রুহিন হোসেন (প্রিন্স), বিপ্লবী কমিউনিস্ট লীগের সাধারণ সম্পাদক ইকবাল কবির, গণতান্ত্রিক বিপ্লবী পার্টির সাধারণ সম্পাদক মোশরেফা মিশু, বাসদের (মার্ক্সবাদী) সমন্বয়ক মাসুদ রানা ও বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক পার্টির নির্বাহী সভাপতি আবদুল আলী গণমাধ্যমে এ বিবৃতি পাঠিয়েছেন”।

এরা সবাই কমবেশি আমার পরিচিত; সেকালের সেকেন্ড বা তার নিচের ক্যাডার ছাত্র সংগঠন লিডারশীপ; কথাগুলো ১৯৮৫ সালের ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের প্রেক্ষিতে যদি চিন্তা করি। ১৯৮৫ বললাম এজন্য যে সেটা ছিল আমাদের গোপন জীবন, গোপনে কেন্দ্রীয় সংগ্রাম পরিষদের মিটিং করে বেড়াতে হত সেকালে এরশাদের শাসনে অত্যাচারে। এরশাদের পুলিশ আর জাতীয় পার্টি বা জাতীয় ছাত্র সমাজের অত্যাচার এমন তীব্র ছিল তখন!  আর সাথে ছিল এরশাদের পক্ষে আওয়ামি লীগের কামাল হোসেনের দালালি; আর এরপক্ষে ছাত্র ইউনিয়নের সেক্রেটারি  আনোয়ারুল হকের দালালি! এতটুকু বললাম যাতে তারা স্মৃতি হাতড়ে দেখে সেই আয়নায় নিজেকে দেখে “সাম্প্রদায়িকতার অভিযোগ” তুলে ভারতের দালালিতে তারা কিভাবে সেসব দিন কাটিয়েছিল তা মনে করতে পারেন!

আর এবার তুলনা করে দেখতে পারে তাহলে এখন ২০২৪ সালেএই বিবৃতি দিতে বাধ্য হচ্ছেন কেন?
বিবৃতিতে লিখেছেন, ……”জোটের নেতারা বলেছেন, আন্তর্জাতিক আইন অনুযায়ী উজানের কোনো দেশ নদীর ওপর দেওয়া বাঁধের গেট খুলে দেওয়ার ৭২ ঘণ্টা আগে ভাটির দেশকে জানানোর কথা। কিন্তু এবার পূর্বসতর্কতা ছাড়াই ডুম্বুর ও কলসি বাঁধ খুলে দেওয়া হয়েছে”।
এথেকে একটা জিনিষ পরিস্কার যে সেকালে সাম্প্রদায়িকতার অভিযোগ তুলে ভারতের পক্ষে দাঁড়ানো সেটা তাদের দালালিই ছিল! এটাই এখন পরোক্ষে হলেও তারা স্বীকার করছেন। নাকি ভুল বললাম?
কিন্তু সরি কমিউনিস্ট-প্রগতিশীল ভায়েরা আপনারা এখনও কী করতে হবে বা বলতে হবে তা জানতে অক্ষম হয়েই আছেন।

আপনারা আর ইউনুস সাহেব একই কাতারেঃ
আপনারা এখনও ভারতের পিঠে হাত বুলিয়ে সময় পার করতে চান। অভিন্ন নদীতে ভাটির দেশের যে অধিকার আছে তা বুঝেন নাই! যদি ভারত-মাতার বিরুদ্ধে কথা বলার হেদায়েত আপনাদের হয়ে থাকে অথবা মুলকথাটা – জমিদার হিন্দুর স্বার্থের বিরুদ্ধে তাদের আধিপত্যের বয়ান এখনও যদি ছিড়ে বের হয়ে বাংলাদেশ রাষ্ট্রের স্বার্থের পক্ষে না দাড়াতে পারেন তবে আমরা এখনও বাংলাদেশের নাগরিকই না! এমন হয়ে আছেন বুঝবেন!

যে মানুষ অভিন্ন নদীতে ভাটির দেশ বাংলাদেশের যে অধিকার আছে তা বুঝেন নাই তারা বুঝে বা না-বুঝে ভারতের দালাল বা ভারতের স্বার্থের ধ্বজাধারী হয়েই থেকে যাবেন।

যদি আগ্রহ থাকে তবে কিছু পড়াশুনা করতে পারেনঃ
সেক্ষেত্রে বাংলায় আপাতত একটাই পেলামঃ এখানে খুব পরিস্কার না হলেও স্কুপ হিসাবে অনেক তথ্য পাবেন। “ফারাক্কা লংমার্চ এবং অভিন্ন নদীতে ভাটির দেশের অধিকার” ; আজাদ খান ভাসানী প্রকাশ: ১৫ মে ২০২১ | ১০:৫৪ | আপডেট: ১৫ মে ২০২১ | ১০:৫৬

 

একইরকম পাকিস্তানের ডন পত্রিকার এক রিপোর্ট দেখতে পারেন কারণ সিন্ধু নদ নিয়ে তাদের ভারত-অভিজ্ঞতাও আমাদের মতনই।

আর ২০১৪ সালের জাতিসংঘের কনভেনশন টা সম্পর্কে একটাই রেফারেন্স আছে এখানে।  যার আবার ফারদার মানে বিস্তারিত ওর সাথে নাই।

কিন্তু আমার অবস্থান একেবারে সোজা ভারত কোন অভিন্ন নদীতে ভাটির দেশ বাংলাদেশের যে অধিকার আছে  এমন কনভেনশনে সই না করে থাকলে আম সেই ভারতের সাথে বাংলাদেশের কোন সম্পর্ক বজায় রাখার সুযোগ দেখি না।
আর কনভেনশনের কথা বাইরে রাখেন, ভারত যদি অভিন্ন নদীতে ভাটির দেশ বাংলাদেশের অধিকার না দিতে চায় এমন ভারত আমাদের কেউ না, এটা যত তাড়াতাড়ি আমরা বুঝতে পারব ততই ভাল ……।

লেখকঃ
গৌতম দাস, রাজনৈতিক বিশ্লেষক
goutamdas1958@hotmail.com

আপডেটঃ      ২০২৪  রাত
শেষ আপডেটঃ    ২০২৪, সকাল 

 

 

 

Leave a comment