ভারতীয় আধিপত্যের হাতিয়ার ইসকন ও আমাদের রাষ্ট্রস্বার্থবোধ


ভারতীয় আধিপত্যের হাতিয়ার ইসকন ও আমাদের রাষ্ট্রস্বার্থবোধ
গৌতম দাস
১৫ নভেম্বর ২০২৪
https://wp.me/p1sCvy-5NP

 

 

ইসকন একটা আন্তর্জাতিক সংগঠন,  অরিজিনালি যা মূলত এক ধর্মীয় সংগঠন আর যার প্রধান অফিস আমেরিকায় নিউইয়র্কে। ভারতের মায়াপুরিতেও (নদিয়া, পশ্চিমবঙ্গ) এর অফিস আছে।
আবার বাংলাদেশেও ইসকন একালে হাজির ও ততপর। বিশেষ করে ২০১৪ সালে মোদি প্রথম ভারতের প্রধানমন্ত্রী হবার পর থেকে প্রবল ভাবে।

‘ইসকন’ [ISKCON] ১৯৬৬ সালে আমেরিকায় রেজিস্টার্ড এক হিন্দুধর্মীয় প্রতিষ্ঠান, যা ‘কৃষ্ণনাম চর্চার এক বিশেষ ব্যাখ্যা’ বলে দাবী করে সেসবেরই এক প্রচারের সংগঠন হিসেবে যাত্রা শুরু করেছিল। কিন্তু তা সত্বেও চলতি শতকে (২০০০+) এসে আমেরিকান সংসদে ও সিনেটে ভারত সরকারের পক্ষে আমেরিকান নীতি পলিসিকে প্রভাবিত করা বা লবি [lobby] করতে ভারত আমেরিকায় যেসব প্রতিষ্ঠান ও ব্যক্তির মিলিত এক নেটওয়ার্ক গড়ে তুলেছিল, ক্রমেই ইসকনই হয়ে উঠে এর এক প্রধান অংশ ও প্রধান ভুমিকায়। এর নিট ফলাফল হল ইসকন। ফলে এটা আর নেহায়েতই ধর্মপ্রচারের সংগঠন থাকেনি। এর ফোকাস বদলে রাজনৈতিক সংগঠন হয়ে যায়। শুধু তাই না, এটা ভারতের ‘র’-এর অন্তর্ঘাতমূলক কাজের কুখ্যাতির সংগঠন – এর মত গোয়েন্দা সংস্থাও এতে সামিল হয়ে যায়।

বাংলাদেশে এর ততপরতার মুখ্য লক্ষ্য হল, এককথায় বললে –  বাংলাদেশের হিন্দু নাগরিকদের  সাথে সরাসরি মোদির সম্পর্ক করার মধ্যস্থতাকারী সংগঠন যেন হয়ে উঠে ইসকন! যেকোন রাষ্ট্রের নাগরিকেরা সুরক্ষা চায় ও তা পেতে পারে কেবল নিজ রাষ্ট্রের কাছ থেকে; এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু মোদির (বিজেপি-আরএসএস) লক্ষ্য হল – বাংলাদেশের হিন্দু নাগরিকদের ক্ষেত্রে তাঁরা হিন্দু বলে তাঁদের সুরক্ষাদাতা এক বিদেশি প্রধানমন্ত্রী হিসাবে নিজেকে প্রতিষ্ঠা ও হাজির করতে চান মোদি! যাতে এসব (ইসকন ততপরতার ভিতর দিয়ে) প্রভাবিত হিন্দুদের মাধ্যমে বাংলাদেশের শাসন-ক্ষমতা ও আভ্যন্তরীণ রাজনীতির উপর হস্তক্ষেপ করে বাংলাদেশে ভারতের স্বার্থ ও প্রভাব প্রতিষ্ঠা করা যায়।
অথচ ঘটনা হল কোন নাগরিক নিজ রাষ্ট্রীয় সুরক্ষা কোন ভিনদেশি প্রধানমন্ত্রীর থেকে আশা করতে পারে না বা গ্রহণও করতে পারে না। কারণ, এটা নিজ দেশের সার্বভৌমত্ব লঙ্ঘণ করা হবে। ভিনদেশি প্রধানমন্ত্রীর কাছে সুরক্ষা চাওয়া হবে – যা প্রকৃত অর্থেই এই প্রকৃতই রাষ্ট্রদ্রোহিতা মূলক অপরাধ!

একারণে বাংলাদেশ রাষ্ট্র মূলত – কোন ইসকন সংগঠনের ততপরতা থাকতে পারে না, চলতে দিতেই পারে না। অথচ বাস্তবতা উলটা। বিশেষ করে গত ১৬ বছর এটা কোন অনুমতিতে ততপরতা চালাচ্ছে খোলামেলাভাবে এর সদুত্তর বাংলাদেশ সরকার বা এর কোন প্রতিষ্ঠান দিচ্ছে না। এমনকি ইউনুস সরকার নাকি হিন্দু-জনগোষ্ঠির উপর নির্যাতন চালাচ্ছে বলে এরা মিথ্যা প্রপাগান্ডা চালাচ্ছে। বিবিসি নিজেই এনিয়ে এক রিপোর্টে দেখিয়েছে এগুলো ভুয়া অভিযোগ।

বাংলাদেশের স্বেচ্ছাসেবী বা দাতব্য (এনজিও) সংগঠনের ততপরতা অনুমোদনঃ
বাংলাদেশের আইন অনুযায়ী বাংলাদেশে কোন স্বেচ্ছাসেবী বিশেষত বিদেশী সংগঠন ততপরতা চালানোর পুর্বে আমাদের সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয় এর অনুমোদন পাওয়া এর পুর্বশর্ত। এছাড়া এমন এই পুর্ব নিবন্ধন পাওয়া পরে এই সাপেক্ষেই কেবল কোন বিদেশী সংগঠন ততপরতা শুরু্র প্রাথমিক যোগ্যতা লাভ করতে পারে। আর এর চেয়েও বড় কথা এর বাইরে আরো আছে —- এরপরে বিদেশ থেকে ফান্ড আনার অনুমতি বা অনুমোদন পাওয়া যেটা আমাদের দেশে “এনজিও ব্যুরো” – প্রধানমন্ত্রীর অফিসের অধীনের এই প্রতিষ্ঠান অনুমোদন দিয়ে থাকে। একটু ভেঙ্গে বললে, এখানে “এনজিও ব্যুরো”  আসলে রাষ্ট্রের প্রায় ছয়-সাতটা সামরিক-অসামরিক গোয়েন্দা সংস্থাকে সংশ্লিষ্ট করে তদন্ত-অনুসন্ধান করতে আর শেষে এদের সবার রিপোর্ট ইতিবাচক পেলে তবেই অনুমোদন মিলতে পারে।

 

যেমন নিচের লিঙ্ক দেখেনঃ
https://dss.gov.bd/site/page/a7389e64-bfd2-4bf1-96ec-f2569bee2b06/%E0%A6%B8%E0%A7%8D%E0%A6%AC%E0%A7%87%E0%A6%9A%E0%A7%8D%E0%A6%9B%E0%A6%BE%E0%A6%B8%E0%A7%87%E0%A6%AC%E0%A7%80-%E0%A6%B8%E0%A6%82%E0%A6%B8%E0%A7%8D%E0%A6%A5%E0%A6%BE-%E0%A6%A8%E0%A6%BF%E0%A6%AC%E0%A6%A8%E0%A7%8D%E0%A6%A7%E0%A6%A8

এটা সবচেয়ে প্রাথমিক অনুমোদন সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয় থেকে।

এরপরের ধাপ হল বিদেশী স্বেচ্ছাসেবি প্রতিষ্ঠান এর বেলায় বিদেশি ফান্ড আনার ক্ষেত্রে এই পুর্ব অনুমোদন অপরিহার্য; আর এটাই দেখেশুনা করে “এনজিও ব্যুরো”।

প্রেসিডেন্ট জিয়ার আমলে, বাংলাদেশের ফরেন ডোনেশন এক্ট ১৯৭৮ চালু হয়েছিল। তবে বর্তমানে হাসিনা আমলে এর সর্বশেষ সংশোধিত আইনটা হল ২০১৬ সালের। যা অনুসারে কোন বিদেশী সংগঠন কাজ-ততপরতা শুরুর আগে এই আইন অনুসারে অনুমোদন নেয়া বাধ্যতামূলক।

এছাড়াও তৃতীয় আরেকটা অনুমোদনের ধাপ আছে। আর সেটা যে কোন দাতব্য তবে ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের বেলায় প্রযোজ্য। এদেরকে বাংলাদেশের ফরেন ডোনেশন এক্ট -২ এর অনুমোদন নিতে হয়। কারণ, ধর্মিয় প্রতিষ্ঠান ততপরতার বেলায় লোভ দেখায়ে ধর্মান্তকরণ ঘটতে পারে। তাই বিস্তারিত ভাবে তাদেরকে সেদিক থেকে পরীক্ষা করে দেখতে হয়।

 

ইসকন শুধু একটা বিদেশী স্বেচ্ছাসেবি প্রতিষ্ঠানই নয় এটা ধর্মীয় সংগঠনও বটে। তাই আইনত,
বাংলাদেশের ফরেন ডোনেশন এক্ট দুই অনুসারে ধর্মীয় সংগঠনের ইসকনের বেলায় এই আইন অনুসরণ করে আগাম অনুমোদন ছাড়া কোন ততপরতা বাংলাদেশে নিষিদ্ধ। কাজেই ইসকনের এমন অনুমোদন লাভের ডকুমেন্ট প্রদর্শন করতে বাধ্য।

গত হাসিনার আমলের ১৬ বছর এমন ডকুমেন্ট “এনজিও ব্যুরো” থেকে কেউ যোগাড় করে দিতে পারে নাই।

আমরা যদি ইসকনের ব্যাপারে সিরিয়াস হতে চাই তবে আমাদেরকে

এক) ইসকনকে শো-কজ পাঠিয়ে এমন অনুমোদন প্রদর্শন করতে বাধ্য করতে হবে। চেক করতে হবে কোন প্রতিষ্ঠান কিসের ভিত্তিতে এমন অনুমোদন দিয়েছে বা আদৌও দিয়েছে কিনা? এতে  ব্যর্থ হলে আইনানুগ ব্যবস্থা সব সিলগালা করে এদের সংশ্লিষ্ট দেশি-বিদেশি সকলকে জেলে নিতে হবে।

যেমন ধরেন বাংলাদেশের কোন এমন এক দাতব্য প্রতিষ্ঠান যদি ভারতের মুসলমানদেরকে নিয়ে কাজ-ততপরতা করতে চায় সেক্ষেত্রে কী হবে?

প্রথমত বাংলাদেশের ভারতীয় হাইকমিশনার এটা জানা-শোনা মাত্র আপনাকে নিরুতসাহিত করবে, এমন সব বাক্য বলতেথাকবে।
এরপরেও যদি আপনি নাছোরবান্দা হন তাহলে তখন বলবে আপনি আপনারভ সংগঠনের উদ্দেশ্য-লক্ষ্য সম্বলিত সব কাগজপত্র সবার আগে ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে পাঠাতে বলবে।
এই মন্ত্রণালয় ভারতের ঘোষিত পররাষ্ট্র নীতির সাথে কোন বিরোধ সংঘাত বৈপরিত্য আছে কিনা তা চেক করবে।
অর্থাৎ ভারতীয় রাষ্ট্রস্বার্থের সাথে ম্যাচ করতে হবে। এরপরে আমাদের মতই বাকি তিন প্রতিষ্ঠানের অনুমোদন লাগবে।

সারকথাটা হল, বিদেশি দাতব্য সংগঠনের কাজ-ততপরতা মানেই যেকোন রাষ্ট্র এভাবেই সব পরীক্ষানিরীক্ষা করবে। কাজেই বাংলাদেশ কোন বাড়তি কিছু করছে না বা করবে না – রাষ্ট্রস্বার্থ – সার্বভৌমত্ব সবার আছে বিবেচ্য!

অথচ ইসকনের গত দুসপ্তাহের ততপরতা ও হুমকি দেখে যদিও তামনে হয় না।
এব্যাপারে ইউনুস সরকার কী ঘুমায়েই থাকবে!!! সাথে আমরাও?
মনে রাখতে হবে কোন বাংলাদেশি হিন্দু নাগরিক নিজে ইসকন নামের দোকান খুলে বসতে পারে না!

আমরা বাংলাদেশের হিন্দু-মুসলমান কাউকেই – ভারতীয় আধিপত্যের হাতিয়ার ইসকন – এর দোকান খুলতে দিতে পারি না!

লেখকঃ
গৌতম দাস, রাজনৈতিক বিশ্লেষক
goutamdas1958@hotmail.com

আপডেটঃ   নভেম্বর  ২০২৪
শেষ আপডেটঃ      ২০২৪

 

Leave a comment