সেক্যুলারিজম নাকি জাতিরাষ্ট্রঃ দোলাচলের পরিণতি
গৌতম দাস
অক্টোবর ২০২০
https://wp.me/p1sCvy-5MC

[এই লেখাটা গত ২০২০ সালের পুনর্পাঠ নামে একটা সাময়িকী তে ছাপা হয়েছিল। এখানে সেটারই কপি তুলে আনা হয়েছে। আর কোন এডিট করা হয় নাই]
সেক্যুলারিজম নাকি জাতিরাষ্ট্রঃ দোলাচলের পরিণতি
আমাকে ‘পুনর্পাঠ’ থেকে কিছু প্রশ্ন দিয়ে বলা হলো—এগুলো নিয়ে আমি কী মনে করি তা যেন লিখি। প্রশ্নগুলো ছিল এরকম:
ক) বাংলাদেশের সেক্যুলারিজম কেন ইসলামবিদ্বেষী?
খ) ভারতের সেক্যুলারিজম কেন ভারতের দাঙ্গা বন্ধে ভূমিকা রাখতে পারছে না?
গ) ভারতে ধর্মীয় সম্প্রতি ছিল একসময়। সে ভারতে এখন এত সাম্প্রদায়িকতার কারণ কী?
বলাই বাহুল্য, খুবই কমন সব প্রশ্ন যা সম্ভবত সাধারণ মানুষের মনে ঘোরাফেরা করে। আর প্রশ্নগুলোর একটা কমন দিক হলো, ‘সেক্যুলারিজম’ বলে একটা ধারণা, যা মানুষের মনে প্রপাগান্ডা করে একটা বিরাট আশার আলো হিসেবে হাজির করানো হয়েছিল। সাথে এটা যেন সব রোগ-হরণ বা রোগ তাড়ানোর ওষুধ—এমনই এক ‘ধনন্তরী’ ধারণা বলে তৈরি করা হয়েছিল। কিন্তু বাস্তবে এর কোনও সত্যতা নাই বা কোনও প্রভাব মানুষ দেখছে না, আরও বিশেষত, একালে মোদীর জমানায় এসে সেক্যুলারিজমের সব গোমর ফাঁস আর দাবি বেকার হয়ে গেছে। মজার কথা হলো এই হেরে যাওয়া অথবা এএক বিপরীত বাস্তবতা সত্ত্বেও অবশ্য এখনও অনেককে পাওয়া যাবে যারা অসহায় হলেও বুঝে না বুঝে সেক্যুলারিজম আগলে বসে থাকতে চাইছে। সম্ভবত এর চেয়ে ভালো উপায়/বিকল্প জানা নাই বলে।
এককথায় বললে, আসলে মূল সমস্যাটা রাষ্ট্র-ধারণা সম্পর্কে ‘কনসেপচুয়াল’ মানে বোঝাবুঝির মৌলিক গলদ থেকে হাজির হওয়া সমস্যাজাত। রাষ্ট্র বলতে ‘জাতি’ বুঝেছে। রাষ্ট্র মানে জাতি না। কিন্তু তবু রাষ্ট্রকে জাতি বলেই বুঝেছি। এমনটা আবার হতে পেরেছে ‘জাতি’ (বা ইংরাজিতে নেশন) ধারণার কারণে।
যদিও সেই সাথে এটাও সত্য যে আপনি কোন কনসেপ্টকে সেভাবে বুঝতেই পছন্দ ও আপন মনে করে থাকতে পারেন, মানে সেভাবে বুঝে বসতে পারেন যেভাবে বুঝলে আপনার স্বার্থ ভালোভাবে রক্ষা পাবে বলে একটা অনুমান আপনার মধ্যে কাজ করে। যার মানে দাঁড়াল একটা কনসেপ্টের বোঝাবুঝির শুরু থেকে ওর মধ্যে হাজির কিছু মারাত্মক ভুল থেকে গেছে। আবার সেই সাথে ঐ ভুলটাই আপনি পছন্দ করেছেন।—এই হল সমস্যার গোড়া।
আমাদের অনেকের মনে করে রাষ্ট্র মানে ইংরাজিতে ‘স্টেট’ ধারণাটা বোধহয় দুনিয়ার সবকালেই ছিল। এটাও ভুল। আসলে এখানে ‘শাসন’ আর ‘রাষ্ট্র’—এ-দুই ধারণাকে মাখিয়ে ফেলার কারণে এটা হয়েছে। শাসন (বা ইংরাজিতে রুল) তো সবসময় অবশ্যই ছিল। কিন্তু সেটা রাষ্ট্র ধারণা তো না। তাই, শাসন থাকা মানেই রাষ্ট্র থাকা নয়। একইভাবে খেয়াল করলে দেখবেন, আমাদের পূর্ব-পাকিস্তানের আমলে পুরো ষাটের দশকের রাজনৈতিক আন্দোলনে এবং স্বাধীনের পরের সত্তর দশক জুড়েও আমরা বহুল ব্যবহার করতাম ‘জাতি’ শব্দটা। যদিও সেই ভাব-আলাপগুলো আসলে বোঝাতে চেয়েছি রাষ্ট্র শব্দ দিয়ে। এছাড়াও ‘জাতি’ শব্দে ‘আমার জাতি’ বলে আবেগটাকে ছুঁয়ে রাখতে সময়ে সময়ে আমরা ‘দেশ’ শব্দ ব্যবহার করেছি। যেমন— ‘দেশের জন্য লড়ছি’, ‘দেশের জন্য প্রাণ দেওয়া’, ‘দেশ গড়ার’, ‘দেশপ্রেম’ ইত্যাদি। কিন্তু রাষ্ট্র নয়—অন্তত এই শব্দের ব্যবহার তেমন বা ততটা তো নয়ই।
রাষ্ট্র ধারণার শুরু মনে করা হয় ইউরোপ-আমেরিকাসহ পশ্চিমা দেশ, আর আধুনিক রাষ্ট্র কায়েম করার শুরু থেকে। অর্থাৎ, রিপাবলিক রাষ্ট্র ধারণার বাস্তবায়নের শুরু থেকে। মোটাদাগে ১৬৫০ সালের পর বা ইংলিশ রেভেলিউশন বা ক্রমওয়েলের বিপ্লব বলা হয় যেটা—এর শুরু থেকে। কথাটার মানে দাঁড়াল, তাই ১৬৫০ সালেরও আগের যত মনার্কি বা রাজতন্ত্র কায়েম ছিল সেগুলোকে রাষ্ট্র গণ্য করব না। কোনও রাজতন্ত্রও রিপাবলিক বা প্রজাতন্ত্রী রাষ্ট্র নয়। বরং বিপরীত। আর তা রাষ্ট্রই নয়। কেন?
কারণ রাষ্ট্র-ক্ষমতার প্রশ্ন। কোন শাসক শাসন ক্ষমতা কোথা থেকে পেয়েছে? কে তাঁকে দিয়েছে—এটা রাষ্ট্র ক্ষমতার ফান্ডামেন্টাল প্রশ্ন। কোনও রাজা বা সম্রাট মানে মনার্কির কাছে এই প্রশ্নের সদুত্তর নাই, দিতে পারে নাই। পরোক্ষে স্বীকার করেছেন তার বংশের কেউ অথবা তিনি নিজে জোর করে ক্ষমতা নিয়েছেন। কেউ কেউ যেটাকে ‘আল্লাহ দিয়েছেন’ ধরনের ব্যর্থ সাফাই গেয়েছেন।
কিন্তু রাজতন্ত্রের বিপরীতে রিপাবলিক রাষ্ট্রে, এখানে ক্ষমতার ধারণাটা হলো রাষ্ট্রে ক্ষমতার উৎস জনগণ, নাগরিক জনগণ। এটাই রিপাবলিক বা বাংলায় গণ-প্রজাতন্ত্রী রাষ্ট্র-ধারণা। আর এখান থেকেই রাষ্ট্র ধারণার শুরু।
এখানে মূলত স্বীকার করে নেওয়াও শুরু হয় যে, রাষ্ট্রক্ষমতা মূলত জনগণের, নাগরিক জনগণের। ক্ষমতার উৎস নাগরিকেরা। বলাবাহুল্য, এটা বহুবচন। নাগরিকেরা তাদের সেই ক্ষমতা তাদের “প্রতিনিধি”“নির্বাচনের” মাধ্যমে (রিপ্রেজেন্টেশনের মাধ্যমে) সেই নির্বাচিত প্রতিনিধিকে সাময়িকভাবে নিজের ক্ষমতা দান (ডেলিগেট) করে। আর সে-কারণে ‘নির্বাচিত প্রতিনিধিরা’ রাষ্ট্র ক্ষমতা প্রয়োগ ও পরিচালনার যোগ্য হয়।
রাষ্ট্রচিন্তায় বিপথগামিতার উৎস ‘জাতি’ ধারণা
করার কথা ছিল নাগরিক অধিকার ভিত্তিক রাষ্ট্র ; যেখানে কোনও জাতি পরিচয় (যেমন হিন্দু জাতি, মুসলমান জাতি, বাঙালি জাতি অথবা জুম্মু জাতি ইত্যাদি) নয় বরং হতে হবে সুনির্দিষ্ট কোনও জাতি-পরিচয়হীন, এক অবস্থায় সকলেরই একই পরিচয় যে, তারা রাষ্ট্রের নাগরিক। এবং সকলে সমান অধিকারের নাগরিক আর তাতে নাগরিক বৈষম্য থাকতে পারবে না। অর্থাৎ, সকলেই নাগরিক এবং সমান নাগরিক—এমন এক রাষ্ট্রগঠন করার কথা ছিল। কিন্তু তা তো করা হয় না; বরং রাষ্ট্র কথাটাকে ‘জাতি’ বলে বোঝা হয়েছে। আর তাতে রাষ্ট্র গঠন বা নির্মাণকে জাতিগঠন বলে বোঝা হয়েছে। এখানেই শেষ নয়। শুরুতে সারা ইউরোপ জুড়ে এই ধারণার পথ ধরে কথিত জাতিভিত্তিক রাষ্ট্র মানে ‘নেশনস্টেটই’ গড়ে তোলা হয়েছিল। আর মনে করা হয়েছিল এটাই একমাত্র রিপাবলিক রাষ্ট্রের বাস্তব রূপ।
আমাদের উপমহাদেশে সমস্যাটার শুরু হয়েছিল ব্রিটিশদের মানে ইউরোপের নেশনস্টেট ধারণার কপি থেকেই। রেনেসাঁর অনুষঙ্গ ছিল নেশনস্টেট ধারণা। কলোনি ব্রিটিশ-ভারতের অংশ হিসেবে পরে তা আমাদের মধ্যেও এসে উপস্থিত হয়েছিল। আধুনিক রিপাবলিক রাষ্ট্র বলতে একটা ‘জাতিরাষ্ট্র’ ধারণা আমাদের ভিতরে প্রবল ও একমাত্র হয়ে উঠেছিল।
খুবই কম কথায় বললে, আমরা সকলেই যার যার মতো একটা ‘মহান’ জাতি, ‘হাজার বছরের’ পুরানা জাতি, আমাদের এই-সেই বিখ্যাত দিক আছে এমন জাতি, লড়াকু জাতি, বিজয়ী জাতি ইত্যাদি এমন ফুলিয়ে বলা কথাগুলো যার যার জাতিরাষ্ট্রের মধ্যে, মূলত জাতি ধারণার মধ্যে পুষে রেখেছি। কাজেই সেভাবে এখন সবাই একেকটা ‘মহান’ জাতি। তবে খুঁজে দেখতে হবে, ইউরোপে শুরুটা এভাবে ‘জাতির’ বয়ান খাড়া করেই হয়েছিল কেন?
মোটাদাগে ১৬৫০ সালের আশেপাশের যখন রিপাবলিক বলে জাতিরাষ্ট্র জন্ম নেওয়া শুরু হচ্ছিল সে-সময়টা আসলে একই সাথে ইউরোপ কলোনি দখলে বের হয়ে পড়ারও শুরু—এমনই একটা সময় ছিল। মানে যখন কলোনি দখল একটা ব্যবসা তাই যুদ্ধজাহাজে বিনিয়োগ করতে সক্ষমরা ঝাঁপিয়ে পড়েছিল আর সেই জাহাজ নিয়ে দেশ দখল ও লুট করতে এশিয়া-আফ্রিকা বা ল্যাটিন আমেরিকার দিকে বের হয়ে পড়া ছিল প্রধান ব্যবসা—সবচেয়ে আকর্ষণীয় ব্যবসা। ব্যবসায় যেমন প্রতিযোগিতা থাকে আর সেটাই বড় অনুষঙ্গ হয়ে ওঠে, তেমনি কে বেশি দেশ দখল-লুট করতে পারে এটা হয়ে উঠেছিল প্রধান ফোকাস ও অভিমুখ। তাই দরকারও পড়েছিল এমন ফোকাসের পক্ষে সামঞ্জস্যপূর্ণ এক সাফাই বয়ান তৈরি করার। একাজে সবচেয়ে উপযুক্ত পাওয়া গেছিল ‘জাতি’ ধারণাটাকে। অন্যের দেশ দখল ও লুট করা অন্যায় অন্যায্য কি না, তা নয়—বরং আমরা ‘মহান’ জাতি বা শ্রেষ্ঠ জাতি, এমন বয়ানের কদর বেশি হয়ে উঠেছিল। যেমন, ব্রিটিশেরা ফরাসিদের চেয়ে শ্রেষ্ঠ এমন ধারণা সারা হবু ব্রিটিশ রিপাবলিক রাষ্ট্র ধারণার মধ্যে মুখ্য বিষয় হয়ে উঠেছিল। অর্থাৎ, কলোনি দখল ব্যবসায়ীরা যারা আসলে ছিল সমাজের একটা এলিট অংশমাত্র, অথচ তাদের স্বার্থটাই সমাজের সব অংশের স্বার্থ বলে, কথিত এক “ব্রিটিশ জাতির” স্বার্থ বলে হাজির করা হয়েছিল। আবার একই কাজ ফরাসিরাও করেছিল হয়ত ব্রিটিশ বা অন্য কলোনি-দখলদারদের বিরুদ্ধে তাদের বয়ান হিসেবে।
এ-থেকে সেকালে রাষ্ট্রগঠন বলতে, মানে রাজতন্ত্র ধারণার বিপরীতে রিপাবলিক রাষ্ট্র ধারণা বলতে একমাত্র জাতিরাষ্ট্র বুঝাবুঝি শুরু হয়েছিল। হওয়ার কথা ছিল প্রতিটা ব্রিটিশ নাগরিকের ‘নাগরিক অধিকার’ কীভাবে নিশ্চিত করা যায় এমন রিপাবলিক রাষ্ট্র গঠন। অথচ সেটা বিপথগামী হয়ে সকলেই কথিত এক ‘ব্রিটিশজাতির’ স্বার্থে প্রতিদ্বন্দ্বী আরেক কথিত ফরাসিজাতির (বা অন্য কথিত জাতি) বিরুদ্ধে ব্রিটিশ জাতিরাষ্ট্র গঠন বা খাড়া করার তৎপরতায় পর্যবসিত হয়ে যায়। এভাবেই প্রতিটা নাগরিকের অধিকার নিশ্চির করার হবু রাষ্ট্রগঠনটা পা পিছলায়ে হয়ে যায় এক জাতিরাষ্ট্র ধারণা। এমনকি ১৭৮৯ সালের ফরাসি বিপ্লব, যা নিয়ে এত সুনাম বা গর্বের ধারণা ইতিহাসপাঠে অনেককে মনে করতে দেখা যায়, সেটারও কালোদিক হলো এমন বয়ান যে, ফরাসি জাতিরা ‘মহান’ তাই তাদের জাতিরাষ্ট্র। আর এতে যতই সাম্য-মৈত্রীর কথার মহিমা বলা থাক, অর্থাৎ, যতই নাগরিক সাম্যের কথা বলা থাক অথবা বলা হয়েছে বলে গর্ব থাকুক সবকিছুই আসলে পর্যবসিত হয়ে গেছিল এক গারবেজে—একটা নেশন মানে ‘জাতি’ ধারণার কারবারে, কথিত অন্যান্য জাতির বিরুদ্ধে এক জাতিরাষ্ট্র কায়েমের লড়াইয়ে।
এ-কারণে, ইউরোপের রেনেসাঁ ধারণা যেটা আমরা আমাদের কলোনি দখলদার মালিক ব্রিটিশদের কাছ থেকে বয়ান হিসেবে পাচ্ছি, সেটা আসলে ততদিনে একটা রিপাবলিক রাষ্ট্র বলতে এক জাতিরাষ্ট্র ধারণাই। ভারতের শিরোমনি রেঁনেসা চিন্তার আদিগুরু বলে প্রচার ও অনুমান করা রাজা রামমোহন রায়, তিনিও শাসক ব্রিটিশদের একটা ‘জাতি’ কল্পনা করে তার আদলে ভারতকেও ‘হিন্দুজাতির’ ভারত গঠন করতে হবে বলে বুঝেছিলেন।
অর্থাৎ, এখানে তাঁর বুঝাবুঝিতে মূল কথা ছিল রিপাবলিক রাষ্ট্র মানে এক ‘জাতি’ ভিত্তিক জাতিরাষ্ট্র (নেশনস্টেট) গড়ে তোলা। আরও গুরুত্বপুর্ণ সেই সাথে এই অনুমান যে, কোনও জাতি মানেই সেটা একই ধর্মপরিচয় ভিত্তিতে এক জাতি। যেমন—ব্রিটিশ আধুনিক রিপাবলিক রাষ্ট্র বলে ব্রিটিশ কলোনিপ্রভুর রাষ্ট্রটাকে তিনি দেখেছিলেন ও বুঝেছিলেন এভাবে যে, এটা একটা ব্রিটিশ জাতিরাষ্ট্র। আর এই জাতি গড়ে উঠেছে তাদের একই ধর্ম—সকলেই মূলত এঙ্গলো-ক্যাথলিক ক্রিশ্চান—ভিত্তিক জাতির কারণে। এখানে এঙ্গলো ক্যাথলিক মানে এটাও ক্যাথলিসিজমই, তবে যারা এঙ্গলো বা ইংলিশ রাজবংশ মানে ও চর্চা করে থাকে। অর্থাৎ, এঙ্গলো-ক্যাথলিক ক্রিশ্চান—এই ধর্মের ভিত্তিতে গড়া হয়েছে এক ব্রিটিশ জাতি। আর এই ব্রিটিশ জাতিই গড়ে তুলেছে এক ব্রিটিশ-জাতিরাষ্ট্র। এঙ্গলো-ইংলিশ-ইংল্যান্ড রাষ্ট্র।
তবে ভারতের ক্ষেত্রে রামমোহন এতে একটু বদল করতে চেয়েছিলেন। ইংল্যান্ডের অনুকরণে এরই আদলে হিন্দুধর্মের একক ভিত্তিতে হিন্দু জাতির ভারতরাষ্ট্র হবে—এমনটা চাওয়ার বদলে তিনি আগে সারা ভারতকে একই ব্রাহ্মধর্মের ভিত্তিতে এক জাতি করা এবং তা থেকে রাষ্ট্র গড়ার পরিকল্পনা করেছিলেন। কারণ, হিন্দুধর্ম অসংখ্য কাস্ট অর্থে জাতপাতে বিভক্ত এবং আবার হিন্দু ছাড়াও অন্যান্য ধর্মে ভারতে আছে বলে রামমোহন আগে সকল ভারতীয়কে একটা ব্রাহ্মধর্মে দীক্ষিত করে নিতে চেয়েছিলেন। এরপর হবু সেই কমন ব্রাহ্মধর্মের ভিত্তিতে একটা হবু একক ভারতীয় জাতি গড়ে নিয়ে এর ভিত্তিতে এক ভারত-জাতিরাষ্ট্র গড়ার কল্পনা করে মাঠে নেমেছিলেন। রামমোহন ব্রাহ্মধর্ম চালু করেন ১৮১৫ সালে। কিন্তু তিনি ১৮৩৩ সালে মারা যাবার পরে ১৮৬৬ সালের মধ্যে এটা নিজেই মতভেদে বিভক্ত হয়ে যায়। এরপর থেকে দুই অংশই ক্রমশ প্রভাব হারিয়ে আর কোনও আশা-ভরসার আলো হয়ে থাকতে পারে নাই।
কিন্তু তাতে হিন্দু জাতিবাদীরা দমে নাই। তারা এবার সরাসরি হিন্দুধর্মের ভিত্তিতেই হিন্দুজাতির ভারতরাষ্ট্র গড়তে হবে বলে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল। এরপর থেকে খোলাখুলি যারা হিন্দুজাতির ভিত্তিতে ভারত জাতিরাষ্ট্র গড়তে আগিয়ে গিয়েছেন, নানান তত্ত্ব খাড়া করেছেন, এদের মধ্যে অন্যতম হলেন বঙ্কিমচন্দ্র চট্টপাধ্যায় (১৮৩৮-১৮৯৪), স্বামী বিবেকানন্দ [নরেন্দ্র দত্ত] (১৮৬৩-১৯০২), শ্রী অরবিন্দ [ঘোষ] (১৮৭২-১৯৫০) প্রমুখ। এদের বয়ানটাই ক্রমে ১৮৮৫ সালে ভারতের প্রথম রাজনৈতিক হিসেবে কংগ্রেসের (পুরা নাম ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস দল) বয়ান হয়ে দাঁড়ায়। স্বভাবতই হিন্দু-জাতিবাদিতার বিরুদ্ধে কংগ্রেসের মুসলমান সদস্যরা আপত্তি তুলতে থাকে। কিন্তু তাতে কংগ্রেসের মধ্যে কোনও বিকার না হওয়ায় পরিণতিতে ২০ বছর পরে ১৯০৬ সালে মুসলিম লীগ গঠিত হয়েছিল। গান্ধী সাউথ আফ্রিকা থেকে ফিরে কংগ্রেসে সক্রিয় হন ১৯১৫ সালের দিকে। শুরুর দিকে নেহেরুর বাবা মতিলাল আর পরবর্তী সময়ে জওয়াহরলাল নিজে গান্ধীর সঙ্গে মিলে এই হিন্দু-জাতিবাদভিত্তিক ভারত জাতিরাষ্ট্র গড়ার জন্য কংগ্রেসের রাজনীতি করে গেছেন। আর এর বিরুদ্ধে সর্বশেষ বিরোধিতা করে গেছেন জিন্নাহ ১৯২৮ সাল পর্যন্ত, তাঁর বিখ্যাত ১৪ দফা দাবিনামা তুলে ধরে। যেখানে তিনি হবু স্বাধীন ভারতকে এর প্রদেশগুলোর সমন্বয়ে এক ফেডারেল ভারত রাষ্ট্র হিসেবে গঠনের প্রস্তাব করেছিলেন, যেখানে প্রদেশগুলো সর্বোচ্চ স্বায়ত্বশাসিত হবে। এই শর্তে তিনি মুসলিম লীগের পক্ষ থেকে মুসলমান সংখ্যাগরিষ্ঠ অঞ্চলগুলোকে নিয়ে ভারত থেকে আলাদা পাকিস্তান রাষ্ট্র গঠনের দাবি থেকে সরে আসতে পারেন বলে ধারণা দিয়েছিলেন। মনে রাখার বিষয় হবু পাকিস্তানের প্রস্তাবিত রাষ্ট্রও ছিল কংগ্রেসের হিন্দুজাতির নেশনস্টেটের বদলে মুসলমান-জাতিভিত্তিক এক নেশনস্টেটের প্রস্তাব। এর বিপরীতে নেহেরু বা গান্ধী জিন্নাহর প্রস্তাবের কোনও কিছুই আমল করতে রাজি ছিল না। তাই এরপর থেকে জিন্নাহ চূড়ান্তভাবে কংগ্রেস ত্যাগ করে সরে যান।
অতএব সময়টা আসলে ছিল রিপাবলিক ক্ষমতার রাষ্ট্র বলতে জাতিরাষ্ট্র বুঝবার কাল। এখানে ঐ সময় বলতে বুঝতে হবে প্রায় তিনশ (মোটাদাগে ১৬৫০-১৯৫০ সাল) বছরের কাল। এই সময়ে সারা ইউরোপই ব্যতিক্রমহীনভাবে রিপাবলিক রাষ্ট্র বলতে জাতিরাষ্ট্রই বুঝতে চাইত ও বুঝেছিল। এতে প্রতিটা নাগরিক তার নিজের নাগরিক-স্বার্থ ও নাগরিক অধিকার নিশ্চিত করতে নতুন রাষ্ট্র পারল কি না, সে যোগ্য কিনা, সব নাগরিককে বৈষম্যহীনভাবে সমান বিবেচনা করা রাষ্ট্র নিশ্চিত করল কিনা—সেটা আর বিচার্য থাকে নাই। এর বদলে আমার কথিত ‘জাতি’ অন্য কোনও জাতির সাপেক্ষে শ্রেষ্ঠ হয়েছে বলে মানা হচ্ছে কি না এই খুশিতে আমাকে বরং এখন হাততালি দিতে হবে। জাতশ্রেষ্ঠত্বের উন্মাদনায় উৎফুল্ল হয়ে উঠতে হবে—এই ছিল সেকালের সাজেশন।
এখন যেমন হিন্দু জাতশ্রেষ্ঠত্বের উন্মাদনা সারা ভারত জুড়ে জাগানো এখন বিজেপির লক্ষ্য। মুসলমান মাত্রই তাকে হত্যা বা নির্যাতন করা জায়েজ, হিন্দুজাতিই শ্রেষ্ঠ, তার অসংখ্য (একেকটা হাজার বছরের) ঐতিহ্য আছে, এক গরুপুজাকে কেন্দ্র করে তার কত কত ঐতিহ্য আছে। অতএব, মুসলমানবিদ্বেষও খুবই জায়েজ কাজ। এমনকি অপ্রয়োজনে প্রতিদ্বন্দ্বী পাকিস্তান-জাতির বিরোধিতার সুরসুরি তুলে ভোট চাওয়া ইত্যাদি সবই আসলে সেই জাতিরাষ্ট্র ধারণারই জয়জয়কার—এমন প্রকাশ।
জাতিবাদী রাষ্ট্র ধারণায় তাই রাজনীতিতে তিনটা শব্দ পাওয়া যায়—স্বাধীনতা, দেশপ্রেম ও জাত (জাতশ্রেষ্ঠত্ববোধ)। অর্থাৎ, ঠিক এসব ধারণার বিপরীতে প্রতিটি মানুষকে নাগরিক গণ্য করা, নাগরিক অধিকার নিশ্চিত করা, নাগরিকদের মধ্যে কোনও নাগরিক-বৈষম্য না করা ইত্যাদি নিশ্চিত করা এদের কোনও এজেন্ডাই হয়ে উঠতে পারে না, না হয়েই থেকে যায়। বরং উল্টা মুসলমানকে জয় শ্রীরাম বলানোর জন্য সে চাইলে মুসলমানকে নির্যাতন করে মেরেও ফেলতে পারে।—এটাই হিন্দু-জাতশ্রেষ্ঠত্ববোধ। আর এটার পক্ষে থাকাটাই দেশপ্রেম, নইলে গাদ্দার।
সম্প্রতি দিল্লি ম্যাসাকারের সময় দেওয়া শ্লোগানের কথাগুলো মনে করে দেখেন : মুসলমান“ওরা গাদ্দার, তাই গোলি মারো”। আবার লক্ষ্য করেন, ঢাকার শাহবাগে যেটা বসেছিল ওটাও একই আরেক জাতশ্রেষ্ঠত্বের ধারণা ও বৈশিষ্ট্যের প্রকাশ। কথিত ‘বাঙালি জাতির’ জাতশ্রেষ্ঠত্ব। একাত্তর সালের পাকিস্তান জাতিরাষ্ট্র বাংলাদেশের বিরুদ্ধে গণহত্যা নির্যাতন করেছিল একথা সঠিক। কিন্তু সেকারণে একইভাবে আমাদের এখন বা কখনোই পাকিস্তানি শব্দের বিরুদ্ধে, পাকিস্তানি নাগরিকের বিরুদ্ধে ঘৃণা ছড়ানো জায়েজ হতে পারে না। কারণ এটা এক জাতিধারণার বিরুদ্ধে আরেক জাতশ্রেষ্ঠত্বের ধারণা। মূল কারণের দিকটা হলো যে, কারও যে-কোনও জাতশ্রেষ্ঠত্বের ধারণাটাই ত্রুটিপুর্ণ, অগ্রহণযোগ্য। কারণ এই ঘৃণা জাগানোটা শেষ হবে এক গণহত্যায়, নতুন নতুন হিটলারি চরিত্রের উত্থানে। যুদ্ধাপরাধের বিচার ও শাস্তির নামে আমি বিনা বিচারে বা সাধারণ বিচারপ্রক্রিয়া ফলো না করে, ত্রুটিপুর্ণ বিচারপ্রক্রিয়ায় যেনতেনভাবে কাউকে ফাঁসি দিতে পারি না। কারণ সুষ্ঠু বিচারপ্রক্রিয়া অনুসরণ না করা আর এই খারাপ কাজকে সামাজিক ঘৃণা ছড়িয়ে উন্মাদনা তুলে আড়াল করা—এটাও আমার নিজেরই গায়ে এক কালোদাগ হয়ে আজীবন থেকে যাবে। ওদিকে এতে প্রকৃতই যারা যুদ্ধাপরাধ করেছে তারা শাহবাগে বিচারের নামে অবিচার হয়েছে এই অজুহাতে নিজের অপরাধকে লঘু করে দেখানোর সুযোগ নেবে। কাজেই, নিজেই এক জাতশ্রেষ্ঠত্বের ধারণার ওপর দাঁড়িয়ে অন্য জাতের বিরুদ্ধে ঘৃণা বিদ্বেষ ছড়ানো—এটা জায়েজ হতে পারে না। আরেক জাতির বিরুদ্ধে (পাকিস্তানি বলে) ঘৃণা বিদ্বেষ ছড়ানো মানেই নিজের মধ্যে (বাঙালি জাতিবাদী) বলে এক জাতশ্রেষ্ঠত্ব জাগানো। এটাই রেসিজম, বর্ণবাদ বা হিটলারিজমের ঘৃণার চাষাবাদ। বলাই বাহুল্য, এটা ন্যায়-ইনসাফবিরোধী, ফলে অগ্রহণযোগ্য। পাকিস্তান গণহত্যা ঘটিয়েছে এর জবাব এখন আমাদেরও আরেক গণহত্যা করতে বা এনিয়ে উন্মাদনার ঘৃণা ছড়াতে হবে—এটা হতেই পারে না। খেয়াল রাখতে হবে : ন্যায়, ন্যায্যতা আর ইনসাফের ভিত্তি ছাড়া দুনিয়ার কোনও সমাজ টিকবে না, টিকতেই পারে না। কাজেই মুসলমানবিদ্বেষ বা ইসলামবিদ্বেষ যেমন নিন্দনীয়, একেবারেই অগ্রহণযোগ্য ঠিক তেমনি যে-কোনও জাতশ্রেষ্ঠত্ব বা জাতবিদ্বেষ জাগানোও নিন্দনীয়। এমনকি ইসলামের নামের আড়ালে করা যে-কোনও শ্রেষ্ঠত্ববোধ, ঘৃণাবিদ্বেষ ছড়ানো বা জাগানো—সেটাও অগ্রহণযোগ্য। যে-কারও বিরুদ্ধে ঘৃণা-বিদ্বেষ ছড়ানো, জাতিবিদ্বেষ চালানো অথবা জাতশ্রেষ্ঠত্বের ধারণা খাড়া করা—এর সবকিছুই বেইনসাফি, ফলে অগ্রহণযোগ্য এবং তা কোনও সমাধান নয়। এমনকি কেউ সেটা করে থাকলে সেটার পালটা জাতিরাষ্ট্র ধারণা আনা বা অন্যের জাতিবোধের (তা খারাপ হলেও) প্রতি বিদ্বেষ চালানো অথবা পালটা জাতশ্রেষ্ঠত্ব দেখানোও গ্রহনযোগ্য নয়। এতে অন্যকে আর দোষী বলে আঙুল তোলার নৈতিকশক্তি আপনার হারিয়ে যাবে। আপনি যা পালটা করতে পারেন, তা হলো হেদায়েত। একটা ইতিবাচক অবস্থান গ্রহণ। অন্যায়-অন্যায্যকে অঙ্গুলিনির্দেশ করে ইনসাফের ওপর দাঁড়ানো। এভাবেই একমাত্র সমাধান আসতে পারে।
তাহলে ইউরোপ কি এখনও ‘জাতিরাষ্ট্র’ ধারণায় আটকে আছে? না, অবশ্যই না। তারা একযোগে সকলে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরে ১৯৫৩ সালে তাদের জাতিরাষ্ট্রগুলো পুনর্গঠন করেছে। যদিও জাতি, জাতিবিদ্বেষ, জাতশ্রেষ্ঠত্ব ইত্যাদি ধারণা তাদের সমাজ থেকে চলে না যাবারই কথা। কারণ এটা সাড়ে তিন শ বছরে ধরে (আমাদে মত দেশে এখনও) চর্চা করা হয়েছে। তবে অবশ্যই প্রভাব কমেছে। তাদের রাষ্ট্রগুলো জাতিবিদ্বেষবিরোধী অবস্থান ব্যক্ত করছে।
কিন্তু আমরা আমাদের রাষ্ট্রচিন্তা থেকে জাতিরাষ্ট্র ভাবনা এখনও ত্যাগ করি নাই। এটাই জাতিচিন্তার মূল উৎস। এ ছাড়াও, এই জাতিচিন্তা (জাতিরাষ্ট্র, জাতিবিদ্বেষ, জাতশ্রেষ্ঠত্ব ইত্যাদি) আমাদের কখনও যাবে না যদি সচেতনে নিজের বিরুদ্ধে ক্রিটিক্যাল না হই, প্রতিদিন নিজেকে পরীক্ষা না করি। আর রাষ্ট্র বলতেই জাতিরাষ্ট্র বোঝা, যা আমরা এখনও করে যাচ্ছি, এটাও দ্রুত ত্যাগ করতে হবে।
যদিও ইউরোপ এটা সাড়ে তিনশ বছর ধরে চর্চা করে এরপর এখন বাদ দিয়েছে, কিন্তু দিয়েছে বাধ্য হয়ে এক চরম শিক্ষা পাওয়ার পরে। এজন্যই ‘দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরে’ কথাটা সাথে জুড়ে দিয়ে কথা বলছি। কারণ জাতিচিন্তা মানে জাতিরাষ্ট্র, জাতিবিদ্বেষ, জাতশ্রেষ্ঠত্ব ইত্যাদি চিন্তা ইউরোপে চরমে উঠেছিল হিটলারের হাত ধরে জর্মান জাতিরাষ্ট্রে। নিজেদের তারা নীলচোখের জর্মান জাতি, আর্য জাতি—এসব ব্যাখ্যার ‘জাতশ্রেষ্ঠত্ব’ ধারণা তারা কায়েম করেছিল। ইহুদি নির্মূল করতে যাওয়ার সাফাই বয়ান এখান থেকেই এসেছিল। কেবল জর্মানিতে নয় বরং সারা ইউরোপের বহু দেশেই আপন ‘জাতশ্রেষ্ঠত্ব’র ধারণায় অপর জাতনির্মূল ক্লিনজিং চলেছিল, আর এর ভয়াবহ পরিণতি দেখে নিজেদের জাতিরাষ্ট্র চিন্তার পরিণতি তারা বুঝে গিয়েছিল। তাই ১৯৫৩ সালে ইউরোপের ৪৭ রাষ্ট্র সবাই মিলে এক ‘কাউন্সিল অব ইউরোপ’ (Council of Europe) গঠন করার মধ্য দিয়ে প্রত্যেক রাষ্ট্রই নাগরিক মানবিক অধিকার ভিত্তিক রাষ্ট্রে নিজেদের বদলে নিয়েছিল। কোনও সদস্য রাষ্ট্রে নাগরিকদের মানবিক অধিকার লঙ্ঘন হলে এর প্রতিকার চাওয়া যাবে এমন একটা কমন আদালত ‘কাউন্সিল অব ইউরোপ’র অধীনে গঠন করে নেওয়া হয়। এই আদালতের রায় সব সদস্য রাষ্ট্রের ওপর প্রযোজ্য করা হয়।
তবে সাবধান হতে হবে, রাষ্ট্রগুলো জাতিরাষ্ট্র ভিত্তির বদলে অধিকারভিত্তিক রাষ্ট্রে বদলে যাওয়া মানে এই নয় যে, এরপর থেকে ইউরোপের সমাজ থেকে জাতিচিন্তা বা জাতিবিদ্বেষ ধারণা চলে গেছে। বরং এটা আবার ভিন্ন নামে জাগানোর চেষ্টা চলছে। এ-কারণেই একালে আমরা ‘হোয়াইট-সুপ্রিমিস্ট’ বা সাদা-শ্রেষ্ঠত্ববাদীদের উত্থান দেখছি। নিউজিল্যান্ডের মসজিদে হামলা করে ৫০জনের বেশি হত্যা করা তাদেরই কাজ ছিল। ট্রাম্পেরও এই চিন্তাধারীদের প্রতি সমর্থন থাকা বা ট্রাম্পের ঘাড়ে চড়ে থাকা তাঁর এক প্রাক্তন উপদেষ্টা স্টিভ বেনন (Steve Bannon) জাতশ্রেষ্ঠত্ববাদীদের উত্থানের উদাহরণ। আবার ফ্রান্সের মুসলমানদের সেখানে বসবাস করতে হলে ফরাসী কালচারকে প্রধান মেনে তার আধিপত্যে উলটা তার মতো করে চলতে হবে, মাল্টিকালচার বা অন্যের কালচারকে পাশাপাশি থেকে যাওয়ার কোনও ছাড় বরদাস্ত করা হবে না। এটাও আরেক ধরনের জাতিবিদ্বেষ বা জাতশ্রেষ্ঠত্বের আরেক নমুনা।
ব্রিটিশের হাত ধরে আমাদের সেই রেনেসাঁর বুঝ নেওয়া, যেটা তাদের আদলে ছিল একটা জাতিরাষ্ট্র চিন্তা, আমাদের তিন রাষ্ট্র ভারত-পাকিস্তান-বাংলাদেশে জাতিচিন্তার সমস্ত আবর্জনা এখান থেকেই উৎপত্তি। কখনও হিন্দুজাতি, মুসলমান-জাতি বা কখনও বাঙালি-জাতি হিসেবে। বলাই বাহুল্য নাগরিক অধিকার ভিত্তিক রাষ্ট্রগঠন এগুলো নয়।
সেক্যুলারিজমের ধারণা এলো কোত্থেকে
আগেই বলেছি, রেনেসাঁ বুঝ থেকে আমরা “রাষ্ট্র মাত্রই জাতিরাষ্ট্র” এই বোধ আর ধারণায় আপ্লুত হয়েছিলাম। একালের বিজেপি (মানে সেকালের হিন্দুমহাসভা) বা আরএসএস এই ধারণা থেকেই পুষ্টি সংগ্রহ করেছে। আর মহাসভার বিরুদ্ধে গান্ধী-নেহেরুরাও কম যায় নাই। তারা ভেবেছে হিন্দুজাতিরাষ্ট্রই তারাও গড়বেন; তবে একটু সফটলি (sofly), মানে গরম না, নরমভাবে। আর তাঁদের এর সপক্ষে সাফাইটা ছিল এরকম যে, ‘হিন্দুজাতির’ ভারতে হিন্দুজাতিরাষ্ট্রই তো স্বাভাবিক! রামমোহনের এক ব্রাহ্মজাতি গড়ে এরপর ব্রাহ্মজাতিরাষ্ট্র ভারত গড়ার প্রকল্প ফেল করলে বঙ্কিম-বিবেকানন্দ-অরবিন্দের উৎসাহে ‘হিন্দুজাতিরাষ্ট্র’ গড়াটাই একমাত্র বিকল্প হিসেবে উঠে আসে, আর এটাই নেহেরু-গান্ধীর জন্য সাফাই-যোগানদাতা হয়ে উঠেছিল। কিন্তু বুদ্ধিমান গান্ধী সম্ভবত বুঝতেন এটা জবরদস্তি ; তাই তিনি কখনও স্বীকার করেন নাই যে, সাতচল্লিশের স্বাধীন ভারতকে আসলে একটা হিন্দু-জাতিরাষ্ট্রই গড়া হয়েছে। কিন্তু তাঁর মনের কথার প্রমাণ হলো, একজন রাজনীতিবিদ হয়েও তিনি হিন্দু ধর্ম শ্রেষ্ঠ বলে বক্তৃতা দিয়ে গেছেন (অন্তত ৪২ টা)। আর এটা করতে তাঁর মনে বাধে নাই। সারাজীবন গীতার একখণ্ড পকেটে নিয়ে ঘুরেছেন আর গীতার ‘সত্য ধারণা’ নিজে আহাজারি করে গেছেন খামোখা। আবার এমনকি নিজ দলেরই নিচুজাতের নেতা ভীম অম্বেদকারকে তিরস্কার করেছেন, তাঁর বিরুদ্ধে বর্ণহিন্দুর পক্ষে জাতের পক্ষে সাফাই দিয়েছেন, বক্তৃতা দিয়েছেন, নিজের বর্ণ-হিন্দুত্ব দেখিয়ে হিন্দুধর্মের শ্রেষ্ঠত্বের জন্য লড়াই লড়েছেন। এভাবে সাতচল্ললিশ সালে ‘হিন্দু জাতিরাষ্ট্র’ ভারত বানানোর পর মাত্র শোয়া বছরের মধ্যে হিন্দু মহাসভার কর্মীর গুলি খেয়ে মরে তিনি মহান ‘মহাত্মা’ গান্ধী হয়ে বেঁচে গিয়েছেন। অথচ এই সোয়া বছরে স্বাধীন ভারতের অসংখ্য দাঙ্গার কোনওটাই তিনি রোধ করতে পারেন নাই। পারার কথাও না। কারণ তিনিই তো এই ‘হিন্দু জাতিরাষ্ট্র’ ভারতের জন্ম দিয়েছেন। দাঙ্গা সামলাতে না পেরে একসময় হয়রান হয়ে বোকার সাজেশন দিয়েছেন—হিন্দুকে মুসলমানের শ্লোগান দিতে, আর মুসলমানকে হিন্দুর শ্লোগান দিতে। যেটা এবসার্ড মানে যেটা কোনও কল্পনার ফ্যান্টাসিও না, এতই অবাস্তব। কারণ এটা যেন হিন্দুকে মুসলমান হয়ে যেতে বলা আর মুসলমানকে হিন্দু হতে বলারই নামান্তর। যেন সমস্যাটা হিন্দু-মুসলমানের বা তাদের ধর্মীয় ভিন্নতার। কে না জানে হিন্দু আর মুসলমান দুইটা ভিন্ন ভিন্ন ধর্ম। অথচ যেন তাঁরা দুই ধর্মের লোক মিলে একটা রাষ্ট্র গড়তে চাইলে বা একটা রাষ্ট্রে থাকতে গেলে আপনাদের সবাইকে একই ধর্মের হতেই হবে। এসব চিন্তাকে নাদান বললেও কমই বলা হয়।
এই নাদানি চিন্তা ঢেকে চলতে বা চিন্তার ঘটতি পূরণ করতেই এদের অকর্মণ্য মনের নতুন এক শব্দ হলো সেক্যুলারিজম। শব্দটা আসলে অসহায়ত্বের প্রকাশ চিহ্ন। তবে গান্ধী বেঁচে থাকতেই এই শব্দ নিজেদের মধ্যে চালু হয়েছিল। কারণ, নিজেদের কানে “হিন্দুজাতির এক জাতিরাষ্ট্র ভারত” এমন সত্য কথা শুনতে ভালো লাগে না। তাই এর গায়ে সেক্যুলারিজম নামের জামা চড়িয়ে একে আড়াল দেওয়া শুরু হয়েছিল। ফ্যাক্টস হলো, ১৯৪৯ সালে গৃহীত ভারতের মূল কনস্টিটিউশনে সেক্যুলারিজমকে রাষ্ট্রের কোনও ‘নীতি’ হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করা হয় নাই। কেবল মুখবন্ধ লেখাতে নেহায়তই একটা শব্দ হিসেবে জায়গা পেয়েছিল। আর তা দিয়েই ভারতকে একটা সেক্যুলার রাষ্ট্র বলে প্রপাগান্ডা চালিয়ে ‘হিন্দু জাতিরাষ্ট্র’ হওয়ার সত্যকে আড়ালে ফেলা হতো।
যা হোক, সবকিছুর আগে একটা বাক্যে সব বলে নেই। কোনও কনস্টিটিউশনে যদি দেখা যায় সেক্যুলারিজম তার নীতি, তাহলে বুঝতে হরে রাষ্ট্র ধারণা তাদের খুব দুর্বল। এক নাবুঝ-অবুঝ অবস্থা। অধিকারভিত্তিক রিপাবলিক রাষ্ট্র সম্পর্কে এর প্রণেতাদের কোনও ধারনাই নাই। মূল কথাটা হলো, কনস্টিটিউশনের কোথাও ‘সেক্যুলারিজম’ (অনেকে এটাকে বাংলায় ‘ধর্মনিরপেক্ষ’ লিখে থাকে) লেখা আছে বলেই যারা রাষ্ট্রটাকে সেক্যুলার বলে দাবি করছে, তারা রাষ্ট্রই বুঝে না, এটা বুঝে নেওয়া যেতে পারে। এককথায় সেক্যুলার লিখে রেখে কোনও রাষ্ট্রকে সেক্যুলার করা যাবে না, যায় না। করার জিনিসই না। তাহলে?
প্রথমত: রাষ্ট্রে কোনও জাতিবাদী নাগরিক পরিচয় রাখা যাবে না, বরং পরিচয়বিহীন সকলেই ‘নাগরিক’—এমন হতে হয়।
দ্বিতীয়ত: রাষ্ট্রকে জাতিবাদী নয়, নাগরিক অধিকারভিত্তিক রাষ্ট্র হতে হয়।
তৃতীয়ত: সকলেই সমান অধিকারের নাগরিক—এমন নাগরিক-বৈষম্যহীন নাগরিক-রাষ্ট্র হতে হয়। কেউ হিন্দু বা মুসলমান অথবা পুরুষ-নারী বা পাহাড়ি-সমতলী ইত্যাদি যাই হোক, নির্বিশেষে এদের মধ্যে কোনও বৈষম্য করা যাবে না। ‘নাগরিক সাম্য’ প্রতিষ্ঠা, সমান সুযোগ সুবিধা, নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে।
এতো গেল কনস্টিটিউশনে লিখে রাখার প্রসঙ্গ। এরপর প্রয়োগ-চর্চার মাধ্যমে রাষ্ট্রকে এই নীতি বাস্তব করে তোলার প্রক্রিয়ায় লিপ্ত হতে হয়, শুধু লিখে রেখে কিছু হবে না তাই। উপরের তিনটা নীতি—বিশেষ করে তৃতীয়টা—আসলে সাম্যের নীতি। নাগরিক-সাম্যের নীতি। যে রাষ্ট্র এটা কঠোরভাবে মেনে চলে এবং বাস্তবায়ন করে দেখায়, সেই রাষ্ট্রকেই আমরা সেক্যুলার রাষ্ট্র বলে বুঝতে পারি। এজন্যই বলা হয় সেক্যুলারিজম—আমার রাষ্ট্র সেক্যুলার বলে কনস্টিটিউশনে লিখে রেখে দাবি করার বিষয়ই এটা নয়। সাম্যের নীতি অনুসরণ ও বাস্তবায়ন করা হয়েছে কি না তা দেখেই বুঝা যায় সেটা সেক্যুলার কি না। সমান নাগরিক বিবেচনা কার্যকর কি না। নাগরিক-বৈষম্যহীনতার চর্চাই সেক্যুলারিজম। জাতিরাষ্ট্র করবেন বা মুসলমানবিদ্বেষ চর্চা করবেন আর দাবি করবেন রাষ্ট্র সেক্যুলার—এটা হাস্যকর।
অথচ আমাদের এখানে বাস্তবে এই উল্টোটাই হয়েছে। ইন্দিরা গান্ধী নিজের ভারত রাষ্ট্রটা এক হিন্দুজাতিরাষ্ট্র করে গড়ে রেখে নিজের হিন্দুমনকে সান্ত্বনা দিতে এবার ৭১ সালে আমাদের হবু রাষ্ট্রকে কাগজে সেক্যুলার রাষ্ট্র লিখতে বাধ্য করেছেন। আর এরপর নিজে এক আত্মশ্লাঘায় ভুগেছেন যে কাজটা ঠিক করেন নাই। কেন? ভারতের কনস্টিটিউশনে তো এমন তথাকথিত সেক্যুলারিজম ‘নীতি হিসেবে’ লেখা নাই। (যদিও লেখা না-লেখায় কিছুই যায় আসে না। এটা যে অর্থহীন তা ১৯৮৪ সালে মারা যারার আগে পর্যন্ত ইন্দিরা গান্ধী জানাবুঝা করে যেতে পারেন নাই।) তবে নিজের মনের অপরাধবোধ তাড়াতে ১৯৭৬ সালে ভারতের কনস্টিটিউশন সংশোধনের সুযোগ যখন পেয়েছিলেন তখন নিজ অবুঝ চিন্তার ‘সেক্যুলারিজমকে নীতি’ ঢুকিয়ে নিয়েছিলেন। অথচ এই সেক্যুলারিজম শব্দের আড়ালে সেই থেকে ভারত-রাষ্ট্র নির্বিচারে এখনও এই মোদীর আমল পর্যন্ত ইসলামবিদ্বেষের চর্চা করে যাচ্ছে।
প্রশ্নগুলো সম্পর্কে ফাইনাল কথা হলো—
ক) বাংলাদেশের সেক্যুলারিজম কেন ইসলামবিদ্বেষী?
কারণ, ১। বাংলাদেশও একটি ‘বাঙালি জাতিবাদী’ জাতিরাষ্ট্র।
২। এই বাঙালি জাতিবাদীদের মধ্যে অনেকে এক ভিত্তিহীন ধারণা পোষণ করেন যে, তারা একাত্তরে ইসলামের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছিল বা ইসলাম তাদের অপনেন্ট ছিল। মানে যেন ‘ইসলামকে তারা পরাজিত’ করেছিলেন। অর্থাৎ, যেন পাকিস্তান রাষ্ট্র ও সেই সময়ের পাকিস্তান সরকার ও তাদের নীতি এর জন্য দায়ী বা আমাদের এনিমি নয় ; বরং শেখ মুজিব ও আওয়ামীলীগ যেন ইসলাম বা মুসলমানের বিরুদ্ধে লড়াই করার জন্যই নেমেছিল। মূলত এই ব্যাখ্যাদাতাদের প্রধান পরিচয় তারা ইসলামবিদ্বেষী। আসলে এরা বুঝা-না-বুঝা জমিদারী-হারানো বর্ণহিন্দুর অনুসারী। জমিদারীহারানোর দুঃখে দুখী সমব্যথী কিছু নাদান।
৩। খোদ ইন্দিরা গান্ধী নিজেই ছিলেন নিজের মুরুব্বি-স্থানীয় নেহেরু-গান্ধীদের মতো রাষ্ট্র প্রসঙ্গে একজন বিভ্রান্ত ব্যক্তি। ফলে তিনিও রাষ্ট্র বলতে জাতিরাষ্ট্রই বুঝতেন এবং বৈষম্যহীন নাগরিক অধিকারের রাষ্ট্র গড়ার কথা বলা বা ‘সাম্যনীতির রাষ্ট্’ কথার অর্থ-তাৎপর্যের ব্যাপারে বোধশূন্য ছিলেন।
এর সবচেয়ে ভালো প্রমাণ হলো : সে-কারণের একাত্তরের আগষ্ট মাসের মধ্যেই আন্তর্জাতিক এলায়েন্সে কারা কারা হবু বাংলাদেশের পক্ষে সামরিকভাবে থাকছে তা নির্ধারিত হয়ে যাবার পরও ইন্দিরার মাথায় খেয়াল আসে না যে, তিনি কোন হবু বাংলাদেশকে সহযোগিতা করতে যাচ্ছেন?—কারণ সেটা ছিল সামরিকসহ সব অর্থেই ভারতের সহযোগিতা—যেই হবু বাংলাদেশের নব্বইভাগ মানুষ মুসলমান, অর্থাৎ, এক মুসলমানে ভরা বাংলাদেশকে! যারা দুদিন আগেও ভারতের জাতশত্রু পাকিস্তানই ছিল! তাই তাঁর মাথার অনিরসিত প্রশ্ন এমনই মারাত্মক ছিল যে, তিনি যেন পারলে প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিনকে বলেন আপনারা অ-মুসলমান হয়ে যান ; নিজেদের এমন ঘোষণা দেন। কিন্তু ইন্দিরা আবার এটাও পরিস্কার বুঝতে পারলেন যে, এটা সম্ভব না—অবাস্তব। কেননা, সেটা তাঁর জন্যও কম বিব্রতকর নয়। তাই তিনি চতুর্থবার বাংলাদেশেকে স্বীকৃতি দেওয়ার তাজউদ্দিনের লিখিত অনুরোধ সত্ত্বেও নিরুত্তর থেকে বিষয়টা উপেক্ষা করার পর এক নিগোশিয়েশনে তাজউদ্দিন-গান্ধী একমত হন যে, হবু বাংলাদেশকে সেক্যুলার বলে ঘোষণা দিতে হবে। অর্থাৎ, এতে ইন্দিরা গান্ধীর কাছে তাজউদ্দিন প্রকারন্তরে কবুল করছেন যে, আমি মুসলমান নই—সেক্যুলার!
৪। এখান থেকেই বাংলাদেশ সেক্যুলার রাষ্ট্র বলে ঢোল বাজানো শুরু হয়। আসলে হিন্দু-জাতিরাষ্ট্রের ভারত আর বিশেষ করে এই উপমহাদেশের কমিউনিস্ট—যারা বাই ডিফল্ট ইসলামবিদ্বেষী—তারা হাততালি দিয়ে উঠে যে, বাংলাদেশ এক সেক্যুলার রাষ্ট্র। অথচ ফ্যাক্টস হলো এক. কমিউনিস্টরা অধিকারভিত্তিক রাষ্ট্রই বোঝে না এবং মানেও না। দুই. বরং তারাও জাতিরাষ্ট্র ধারণার সমর্থক। তিন. উপমহাদেশের হিন্দু কমিউনিস্টেরা হিন্দু-জাতিরাষ্ট্র ধারণার মধ্যেই স্বস্তিবোধ করে। অথচ তাদের রাষ্ট্রচিন্তা যে এক হিন্দুজাতি ধারণা তাতেও তাঁরা কোনও অস্বস্তি অনুভব করে না। চার. কোনও রাষ্ট্র সেক্যুলার কি না তা বুঝবার যোগ্যতা অথবা কী ক্রাইটেরিয়া দেখে এটা বুঝতে হয় সে-ব্যাপারে এই কমিউনিস্ট-প্রগতিবাদীরা পুরা অন্ধকারে ও অজ্ঞ। পাঁচ. ইতিবাচকভাবে তাঁদের ভুল ধরিয়ে দিলেও ব্যাপারটি দাঁড়ায় এমন : অধিকারভিত্তিক রাষ্ট্র ধারণায় যে ‘সাম্য’ প্রতিষ্ঠার কথা বলা হয়, এর স্পষ্ট অর্থ নাগরিক-বৈষম্যহীনতা অর্থে সমান বা সাম্য ধারণা। যেমন কোনও নাগরিক হিন্দু হলে তাঁকে কম বা বেশি খাতির বা বিশেষ সুযোগ দেওয়া অথবা কোথাও নাগরিক মুসলমান বলে সেখানে অসাম্য করা—এর কোনটাই না করা—এটাই মূলত ‘সাম্য’ প্রতিষ্ঠার নীতি। এই নীতি অনুসারে কোনও রাষ্ট্র ‘নাগরিক সাম্য’ প্রতিষ্ঠায় সফল হলে সে আর সেক্যুলার কি না সেটা বলার অপেক্ষা রাখে না। আর তাতে এরপর ঐ রাষ্ট্রের কনস্টিটিউশনেও ‘সেক্যুলার নীতি’ আছে কি না তা লিখে রাখারও বালাই থাকে না। ছয়. কিন্তু আপনি যদি ইসলামবিদ্বেষী হন, তাহলেই কেবল রাষ্ট্রের কনস্টিটিউশনে সেক্যুলার লেখা আছে কি না সেই তর্ক তুলবেন। কারণ আপনার ইসলামবিদ্বেষ লুকিয়ে রাখার কাভারই হলো এই আজাইরা ‘সেক্যুলার’ লিখে রাখা। তখন রাষ্ট্র বলতে জাতি-রাষ্ট্র বুঝবেন আর সেটা হিন্দুজাতিরাষ্ট্র হলেও আপনার কোনও অস্বস্তিবোধ হবে না। সাত. এই কমিউনিস্ট-প্রগতিবাদীরা আমেরিকান রাষ্ট্রের সেক্যুলার বা ধর্মের ধারণা কেন ইউরোপের মতো নয় তাও খেয়াল করে না। অথচ আমেরিকাই সবার আগে নাগরিক ‘সাম্য’ ধারণা দিয়ে এসব সমাধান করেছে। আর তাই আমেরিকা-রাষ্ট্র উলটা মনে করে যে, নাগরিকের ‘ধর্মপালনের স্বাধীনতা’ এটাই নাগরিক মৌলিক অধিকার। রাষ্ট্রের দায় ও প্রতিশ্রুতি হচ্ছে নাগরিকের সেই অধিকার সুরক্ষা করা।
খ) ভারতের সেক্যুলারিজম কেন ভারতের দাঙ্গা বন্ধে ভূমিকা রাখতে পারছে না?
১। ভারত একটি হিন্দু-জাতিরাষ্ট্র। মানে ‘রাষ্ট্র মানেই তা জাতিরাষ্ট্র’ এই ধারণার ওপর প্রতিষ্ঠিত।
২। অথচ জাতিরাষ্ট্র ধারণার সাথে সেক্যুলারিজম ধারণা আনফিট। আপনি যখন অবলীলায় ভারতে হিন্দুজাতিরাষ্ট্রই কায়েম করে ফেলছেন তখন এর মধ্যে আবার সেক্যুলারিজম খুঁজবেন কোথায়? খুঁজবেনই কেন?
৩। জন্ম থেকেই বরং একটা ভাগ ছিল যে, আপনি হিন্দু-মহাসভা বা আর.এস.এস.’র মতো প্রকাশ্যে মুসলমান-কোপানো হিন্দুত্ববাদের ও হিন্দু-জাতিরাষ্ট্রের চর্চা করবেন, নাকি গান্ধী-নেহেরুর কংগ্রেসের মতো ছুপানো বা সফট হিন্ধুত্বের মানে সেক্যুলার জামা গায়ে চড়িয়ে আড়াল করে সেই একই হিন্দুজাতিরাষ্ট্রের চর্চা করবেন?
৪। একটা অবজারভেশন হলো, ১৯৮৫ সাল পর্যন্ত সত্যমিথ্যার লুকোচুরি দিয়ে ভারত কংগ্রেসের-রূপবৈশিষ্ট্যের হিন্দুজাতিরাষ্ট্র হিসেবে চলতে পেরেছিল। এরপর থেকে তা ভাঙতে শুরু করে। যত ভাঙ্গে ততই বিজেপি-আরএসএসের হিন্দুজাতিরাষ্ট্র ধারণা প্রভাব বাড়িয়ে চলে। শেষে একালে মোদী দ্বিতীয়বার এসে এবার পূর্ণভাবে হিন্দুজাতিরাষ্ট্র কায়েম ও চর্চা শুরু করেছেন। কাজেই যে-দাঙ্গা খোদ মহাত্মা গান্ধীই রুখতে পারেন নাই, নিজেই শিকার হয়েছেন সেখানে এক সেক্যুলারিজমের ফাঁকাবুলি দিয়ে কিছুই ঠেকানোর কোনও সম্ভাবনাই নাই। ঠেকাবার কোনও কারণও নাই। সেক্যুলারিজম সব সময়ই ফাঁকাবুলি। বড়জোর এটা হিন্দুত্ব আড়ালে রাখার জামা। নাগরিক সাম্য প্রতিষ্ঠা থেকে ভারতের সকল হিন্দুমন অনেক অনেক দূরে।
গ) ভারতে ধর্মীয় সম্প্রতি ছিল এক সময়। এখন এত সাম্প্রদায়িকতার কারণ কী?
আসলে ধর্মীয় সম্প্রীতি ভারতে কখনওই ছিল না। স্থানীয় নানান পকেটে, স্থানীয় মানুষের উদ্যোগে বিচ্ছিন্নভা যতটুকু যা কিছু দেখা গেছে, তা-ই সার। এছাড়া সবসময় আমরা দেখেছি একটা ভয়াবহ দাঙ্গা ঘটে যাবার পর কমিউনিস্ট-প্রগতিবাদীরা, মানে কিছু সামাজিক বিচ্ছিন্ন এলিটেরা হাত ধরাধরির মিছিল বের করে চলেছে, যারা আসলে পুরা সমাজ থেকেই বিচ্ছিন্ন। তাই এটা কোনও ইমপ্যাক্ট ফেলা ঘটনা না। ভারতে খোদ রাষ্ট্রগঠনটাই হলো একটা জাতিরাষ্ট্র এবং হিন্দুজাতিভিত্তিক চিন্তার নির্মাণ। সেখানে কোনও ‘সম্প্রীতি’ আশা করার সুযোগ কই? এটাতো আম গাছের কাছে জাম আশা করা মতো।
এককথায়, আগে ইমান ঠিক করতে হবে যে, ঠিক কী চাইতেছি। এরপর, রাষ্ট্র বলতে কী বুঝেছি বা বুঝতে চাইছি? আর জাতি ধারণা বা জাতিরাষ্ট্র ধারণা ত্যাগ করতে হবে সবার আগে। জাতি-পরিচয়বিহীন সবাই নাগরিক, সমান অধিকারের নাগরিক—এমন রাষ্ট্রের বুঝ লাগবে। ‘নাগরিক সাম্য’ প্রতিষ্ঠা যার অন্যতম লক্ষ্য হতে হবে। কোনও ধর্মবিদ্বেষ বা ইসলামবিদ্বেষ বাইরে ফেলে রেখে আসতে হবে। তাতে সবার আগে সেক্যুলারিজম শব্দটাই অপ্রয়োজনীয় হয়ে যাবে। ফলে এর শয়তানি থেকে আমরা আপনাতেই রক্ষা পাব।
গৌতম দাস
রাজনৈতিক বিশ্লেষক
২৩ মার্চ ২০২০
https://punorpath.com/journal/65364f4c4f469e8971bc6afd
I

