‘মুসলিম জাতিবাদি’ প্রসঙ্গঃ
ফেসবুকে আমার পাঠকের একটা ভাল প্রশ্ন থেকে
গৌতম দাস
২৪ সেপ্টেম্বর ২০২৫
https://wp.me/p1sCvy-6xH
আজ আমার এক পাঠক প্রশ্ন করেছেঃ
দাদা,
জামাত যদি ৪০% লিবারেল হয় তাহলে কি “মুসলিম জাতিবাদি” হতে পারবে না??
এ নিয়ে আমার লেখা বুঝিয়ে বলা জবাবটা নিচে দেখুনঃ
প্রশ্নটা % এর নয় যে কত পার্সেন্ট! “রিপাবলিক” ধারণাটা বুঝতে হবে। এই ধারণাটা থেকেই রাষ্ট্র, জনগণ, গণস্বার্থ, পাবলিক, নাগরিক, অধিকার, পিপলস, জন-প্রতিনিধিত্ব, ভোট, ইত্যাদির ধারণার এমনকি খোদ ‘রাজনীতি’; এসব ধারণার উতস বা ভিত্তি হল রিপাবলিক বা প্রজাতন্ত্র ধারণা।
রিপাবলিক হল রাজতন্ত্রের বিপরীত, বা সম্রাটতন্ত্র মানে সাম্রাজ্য আর সেই সুত্র বাদশা, আমীরতন্ত্র বা আমিরাত শাসন ধারণা; এগুলোর একেবারে উতখাতের পর এর বিপরীত জনগণের শাসনের ধারণাই হল রিপাবলিক রাষ্ট্র!
এছাড়া পরিস্কার করে মনে রাখেন আমি রিপাবলিক এর কথা বলছি। এটা গণতন্ত্র ধারণা নয়। রিপাবলিক মানে ঠিক গণতন্ত্র একেবারেই নয়! তবে একটা রিপাবলিক রাষ্ট্র এর মধ্যে নাগরিকদের মৌলিক অধিকার যা রাষ্ট্র গঠনের পরও সরকার তাতে হস্তক্ষেপ করতে পারবে না – এমন অলঙ্ঘনীয় কিছু অধিকারের যে তালিকা এটাকে শুধু এটাকে আমেরিকানেরা “গণতন্ত্র” বলে আলাদা গুরুত্ব দিয়ে প্রকাশ করেছিল। তাও আবার এর আসল কারণ হল, মূল কনষ্টিটিউশন ১৭৭৬ সালের লেখার পরেও তাতে এই অংশটা ভুলে বাদ পরে গিয়েছিল বলে এর পনের বছর পরে ১৭৯১ সালে ফাষ্ট এমেন্ডমেন্ড বা প্রথম সংশোধনী হিসাবে তাদের কনষ্টিটিউশনে অনুর্ভুক্ত করে নেয়া বা ভুল সংশোধন করে নিয়েছিল আমেরিকান (ফেডারল) রিপাবলিক রাষ্ট্র। আর সেই থেকে রিপাবলিক আর গণতন্ত্র আলাদা ধারণা বলে একটা ভুয়া হলেও ভিত্তি পেয়ে যায়।
ওদিকে রাজনীতিবিদ বিশেষ করে বোকা কমিউনিস্টেরা রিপাবলিক (যা তাদের মানে খোদ মার্কসের ভোকাবুলারি বা ডিকশনারীর শব্দ / ধারণা নয় বলে) শব্দের বদলে গুণতন্ত্র শব্দের ব্যবহারে প্রাব্যল্য নিয়ে আসে। সেই সাথে গণতন্ত্র নামে মৌলিক অধিকার নয়, গণতন্ত্র মানে কেবল ভোট এই অর্থ করা শুরু করেছিল যা এখন গাধা মির্জার প্রিয় ভাষ্য!
এখন কেউ খেলাফতের রাজনীতি করতে চায় মানে যেমন ধরেন, এরদোয়ানকে (এক ভিনদেশি প্রেসিডেন্টকে নিজের নেতা মনে করা) আপনার খলিফা মনে করে কালো কলেমা তৈয়বার পতাকা উড়াতেই পারেন! বা আরেকজন সৌদি বাদশা বা নবগঠিত তালেবান আমিরি শাসনের ভক্ত বলে নিজের দাবি করতে পারেন। কিন্তু তাতে আপনি রিপাবলিক ধারণার অনুসারি হয়ে যাবেন না আর থাকবেন না বরং আরো একেবারেই দূরে উলটা দিকে চলে যাবেন। কারণ, সেটা হল সোনার-পাথরের বাটি। যা সোনার বাটি তা কেবল সোনার তাই, সেটা একই সাথে আবার পাথরেরও বাটি হয়ে যাবে না। সম্ভাবনাই নাই। কিন্তু তবু আপনি গো-ধরে বসে থাকলে যা হয় তাই এটা!
কিন্তু আপনি যবরদস্তিতে সেটা নাবুঝে দাবি করতে থাকলেন যে নবীর আমলেও “রাজনীতির” ধারণা ছিল, সৌদিতে “জনগণ” বা “নাগরিক” ধারণা আছে ইত্যাদি এই আর কী – এসব বোকা বোকা কথা আপনি অহেতুক বলতেই পারেন!
সার কথায় জামায়াত রাজনীতিতে রিপাবলিক ধারণা, বোধ এগুলার কিছুই নাই। কেবল ভোট ধারণাটা অন্য ঘরাণা থেকে আমদানি করে চালাচ্ছে। কারণ বাদশা বা খলিফাগিরি অবশ্যই রিপাবলিক বা জনগণ বা অধিকার ধারণার সাথে এর কোন সম্পর্কই নাই।
আসলে রিপাবলিক ধারণাটা পচায় দিয়েছে খোদ কার্ল মার্কসঃ
তাঁর শ্রেণীবোধ এই শ্রেণী ধারণাটাই তাঁর সব পটেনশিয়াল শেষ হয়ে যাবার পিছনের মূল কারণ! তবুও শ্রেণী ধারণাটা তিনি যদি সমাজ ব্যাখ্যার (সোশাল ক্লাস বা গ্রুপ হিসাবে) করার একটা টুলস হিসাবে রেখে দিতেন তাহলেও হয়ত চলত। কিন্তু তিনি এটা দিয়ে একেবারে রাষ্ট্র (রিপাবলিক রাষ্ট্র) ধারণাটাকে আঘাত করে বসেন। কারণযখন বলে শ্রেণীর রাষ্ট্র! আবার এক শ্রেণির অপর শ্রেণীকে উতখাত এর ধারণা পর্যন্ত হয়ত চলে! কিন্তু তিনি যোগ করলেন এই উতখাত করতে গিয়ে একে অপরকে গুম, খুন, হত্যা অপহরণ থেকে আয়নাঘর, বুডিগঙ্গায় নিয়ে গুলি করে মাথার তরতাজা গরম ঘেলু হাতের উপর দিয়ে প্রবাহিত হওয়ার উত্তাপের অনুভব ইত্যাদি মানসিক জিঘাংসা সব জায়েজ – শুধু তাই না লেনিন এর উপর বাড়তি যোগ করে দিলেন এটা একনায়কতন্ত্র এবং এটা জায়েজ?????
এতে সব শেষ হয়ে গেল, বিশেষ করে আমাদের মত দেশে যারা কেবল কলোনি্মুক্ত থেকে স্বাধীন হয়ে কেমন রাষ্ট্র গড়ব কোন পথে যাব ভাবছি তারা চরমতম বিভ্রান্ত হয়ে গেলাম।
এত প্রধান ক্ষতি হল নাগরিক ধারণাটা আর বুঝলাম না, আমল করলাম না। দেশের সকল নাগরিককে ‘মৌলিক অধিকার’ দিতে হবে স্বীকার করতে হবে রাষ্ট্র ও শাসককে – এসব চিন্তা কর্তব্য সব উবে গেল। সব নাগরিক কিন্তু মানে, বিশেষ শ্রেণীবোধের শ্রেণী না সকল নাগরিকের নাগরিক অধিকার রক্ষার দায় প্রতিশ্রুতিবদ্ধ থাকবে রাষ্ট্র ও শাসক এই ধারণাটা আর বিকশিত হল না।
যারা বিদ্যুৎ গতিতে কওমি থেকে কথিত মর্ডান বা সেকুলার হয়ে গেছেন বলে সুখবোধ করতেছেন তারা কী এসব বুঝবেন? জীবনে কোনদিন শুনেছেন? শ্রেণীর রাষ্ট্র আসলে এক সাইকোপ্যাথ ধারণা – মানে মানুষকে কষ্ট দিয়ে যারা সুখবোধ করে।
ওকে এখন ফাইনাল ব্যাক্যটা সবাই শুনে রাখেনঃ
কার্ল মার্কসের চিন্তায় – ন্যায়বিচার [justice] বা ইনসাফ ধারণাটাই নাই । কারণ শ্রেণীর ধারণা মানে শ্রেণীর একনায়কতন্ত্র ধারণা এটা ত জিঘাংসা এক সাইকোপ্যাথ ধারনা! এর নিচে চাপা পরে গেছে ইনসাফের ধারণা! প্রত্যেকটা ধর্মতত্বে ন্যায়, ন্যায়বিচার বা ইনসাফের ধারণা একেবারে সেন্ট্রাল ধারণা। ইনসাফ যেকোন সমাজের ফাউন্ডেশনাল ধারণা। কোরান শরীফে কতবার আল্লাহর ‘রহম’, ‘রহমানুর রহিম’ ধারণা আছে কাউন্ট করে দেখেন। হিংসার বিপরীতে, ইনসাফের পক্ষে এই ধারণা যা মানুষেরও মৌলিক বৈশিষ্টের ইঙ্গিত – আল্লাহর গুণ, সম্ভবত সিফাত বা সাফায়াত বলেন; আপনারা ভাল জানেন!
গৌতম দাস
রাজনৈতিক বিশ্লেষক
goutamdas1958@hotmail.com
আপডেটঃ ২৪ সেপ্টেম্বর ২০২৫

