“জঙ্গীবাদের মূল হোতা সামরিক শাসক জিয়াউর রহমান ও এরশাদ”
গৌতম দাস
০৫ নভেম্বর, ২০১৫
পশ্চিমা বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন প্রফেসর, একাডেমিক চর্চায় নিয়োজিত গবেষক এবং নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞ বলে দাবিকারি ব্যক্তি, তাঁর পক্ষে কি – মিথ্যা প্রপাগান্ডা করা সাজে, না এটা তাঁর কাজ হতে পারে? কিন্তু তাই ঘটেছে। এখানে,এই লেখার মূল প্রসঙ্গ এবং উদ্দেশ্য, বাংলাদেশে নিশ্চিতভাবে আইএস এসে গেছে বা অথবা আছে কি নাই মোটেই তা নয়। তবে আছে এবং নাই বলাকে কেন্দ্র করে বাংলাদেশে যার যার স্বার্থে নিজের মাছ ভেজে নেবার মত বহু পক্ষ তৎপর হয়েছে তাই দেখা যাচ্ছে – এটাই এখানে বলবার, দেখাবার চেষ্টা করব।
প্রথম আলোর মিজানুর রহমান খান গত ২৮ অক্টোবর ২০১৫, দুজন নিরাপত্তা বিশ্লেষকের দুটো সাক্ষাতকার নিয়ে ছেপেছেন। বাংলাদেশে আইএস এসেছে আর আসে নাই – এই দুইয়ের তর্কের মধ্যে এই সাক্ষাতকার গ্রহণ বেশ তাৎপর্যপুর্ণ। দুই দেশের দুই নিরাপত্তা বিশ্লেষক – ঢাকার মেজর জেনারেল (অব.) মুনিরুজ্জামান এবং জার্মান হাইডেলবার্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের দক্ষিণ এশিয়ার নিরাপত্তা বিষয়ক গবেষক ড.সিগফ্রিড ও.উলফ, এমন দুইজনের দেয়া এই দুই সাক্ষাৎকার। তবে এটা আবার প্রথম আলোর দ্বিতীয় উদ্যোগ। কারণ প্রথমবার একই ভাবে এই দুই সাক্ষাৎকারদাতার প্রথম জোড়া সাক্ষাৎকার এর আগে প্রথম আলো ছেপেছিল এক মাস আগে, গত ০১ অক্টোবর ২০১৫। কিন্তু প্রথম আলো কেন বারবার সিগফ্রিড উলফকে পছন্দ করেছেন তা তারাই ভাল বলতে পারবে। এখানে লেখার প্রসঙ্গ কথিত জর্মন নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞ সিগফ্রিড ও.উলফ ( Dr. Siegfried O. Wolf) কে নিয়ে।
ঠিক একমাস আগে তার প্রথম সাক্ষাতকার ছাপা হয়। সেই সময় থেকেই দ্বিতীয় সাক্ষাতকার পর্যন্ত তিনি একের পর এক মারাত্মক সব আপত্তিকর মন্তব্য করে গিয়েছেন।
যেমন, প্রথমবারে তিনি বলেছিলেন, “বাংলাদেশের এই জঙ্গিবাদের মূল হোতা হলেন সামরিক শাসক জিয়াউর রহমান ও জেনারেল এইচ এম এরশাদ”। দ্বিতীয় প্রশ্নের জবাবে বলা প্রথম বাক্য দেখুন। বলা বাহুল্য গত সাত বছরের হাসিনা-ইনুর বাংলাদেশে “জঙ্গীবাদ” শব্দটার বিশেষ অর্থ হয়েছে, আছে। যদিও দুনিয়াতে আলকায়েদা ফেনোমেনা উত্থানের সাথে পশ্চিমা রাষ্ট্রগুলো এই ফেনোমেনাকে চিনাতে টেররিজম শব্দের চল শুরু হয়। আর বাংলাদেশের রাজনীতিতে ২০০১ সালের আগে কেউ জঙ্গীবাদ শব্দটা আজকের মত নেতি অর্থে ব্যবহার করেনি বা ব্যবহৃত হতে দেখেনি। ফলে জিয়া অথবা এরশাদের শাসন আমলেও তাদের স্ব স্ব ক্ষমতার বিরোধীদের বিরুদ্ধে অনেক অভিযোগকারি ছিল স্বাভাবিকভাবেই। কিন্তু এদের চরম বিরোধী কেউ সেকালে এদের বিরুদ্ধে “জঙ্গীবাদ” বা “এরা জঙ্গী” এমন অভিযোগ তুলে নাই। এমনকি সেকালের কমিউনিষ্টরাও তুলে নাই। কারণ আগেই বলেছি ২০০০ সালের আগে বাংলাদেশের রাজনীতিতে য়াজকের মত নেতি ও বিশেষ অর্থে জঙ্গীবাদ শব্দটা কেউ ব্যবহার করে নাই বা হতে দেখে নাই। জাসদের “জঙ্গী মিছিলের” কথা শুনেছি, তারা নিজেরাই নিজেদের অগ্রসর লড়াকু ও নির্ধারক মনোবল বুঝাতে ইতিবাচক অর্থে শব্দটা ব্যবহার করত।
তাই এককথায় বললে, জিয়া এবং এরশাদ “জঙ্গীবাদের হোতা” একালে এমন কথা বললে বিশেষত যখন পশ্চিমের চোখে “জঙ্গীবাদ” শব্দের বিশেষ অর্থ সর্বত্র আছে – তখন তা অ-ঐতিহাসিক। এটা ইতিহাসে জবরদস্তিতে আরোপ করে বলা কথা ও চাপিয়ে দেয়া একটা দাবি। ২০০১ সালে প্রচলিত একটা শব্দ কোন ভাবেই আগের ইতিহাসে জিয়ার আমলে (১৯৭৫-৮১) ব্যবহৃত হতে পারে না, সম্ভব নয়।
আলকায়েদা ফেনোমেনাকে বুঝাতে ও নেতিবাচক চিহ্নে চিহ্নিত করতে ২০০১ সালে আমেরিকার নেতৃত্বে পশ্চিমের রাষ্ট্রগুলোর চালু নতুন শব্দ হল টেরর বা টেররিজম। এরই বাংলা করা হয়েছে জঙ্গীবাদ। কিন্তু এর আগে এমনিতে কমিউনিষ্ট লিটারেচারে, বা রাশিয়া থেকে প্রকাশিত প্রচার পুস্তকে টেরর শব্দটা ইতিবাচক ও কাম্য অর্থে ব্যবহৃত হত। ফলে তা একই ভাবে প্রগতিশীল মহলেও পছন্দের ছিল। সুর্যসেনদের মত সন্ত্রাসবাদী গ্রুপ “অনুশীলন” ও “যুগান্তর” – এর যোদ্ধাদের ততপরতাকে সমাজ ইতিবাচক ভাবেই দেখত, দেখান হত। ফলে সে সময় থেকেই ত্রাস, সন্ত্রাস বা সন্ত্রাসবাদ ইত্যাদি শব্দগুলো আমাদের সমাজে ইতিবাচক অর্থেই ব্যবহৃত হত। আর সর্বশেষ গত সাত বছরে হাসিনা-ইনুর আমলে “জঙ্গীবাদ” শব্দটা একটা ঘৃণিত অর্থ বুঝাতে ব্যবহার করা হয়েছে, বিশেষত যারা হাসিনার রাজনীতির ঘোর বিরোধী তাদের গায়ে কালিমা আরোপের জন্য। অর্থাৎ বলতে চাচ্ছি – এটাও ২০০৮ সালের আগে এমন ছিল না। অতএব জিয়া ও এরশাদের বিরুদ্ধে অনেকের অনেক জেনুইন অভিযোগ থাকতে পারে কিন্তু তাঁরা “বাংলাদেশের জঙ্গিবাদের মূল হোতা” – এটা মিথ্যা, অবাস্তব কথা। এমনকি জিয়ার আমলের জিয়ার বিরুদ্ধে আওয়ামী-প্রগতিশীলদের অনেক অভিযোগ থাকলেও কোন কমিউনিষ্ট দল বা খোদ আওয়ামি লীগের জিয়ার বিরুদ্ধে “জঙ্গীবাদের হোতা” বলে অভিযোগ তুলেন নাই।
২। ঐ একই সাক্ষাতকারে জর্মন সিগফ্রিড ঢাকায় ইতালির এনজিও কর্মী সিজার তাবেলার হত্যাকাণ্ড বিষয়ে মন্তব্য করে বলেছেন, “প্রতীয়মান হচ্ছে যে এই হত্যাকাণ্ডের মাধ্যমে আইএস বাংলাদেশে প্রথম আক্রমণের সূচনা ঘটাল”। কিন্তু “এই হত্যাকাণ্ড আইএস করেছে” কোথা থেকে এই তথ্য তিনি নিশ্চিত হলেন সে সম্পর্কে কোথাও কোন রেফারেন্স তিনি দেন নাই। ইতালীয় নাগরিক খুন হন ২৮ সেপ্টেম্বর আর সিগফ্রিডের ঐ সাক্ষাতকার ছাপা হয়েছিল ১ অক্টোবর – অর্থাৎ সাক্ষাতকার দিয়েছেন ধরে দিচ্ছি আগের দিন মানে ৩০ সেপ্টেম্বর। অর্থাৎ তাবেলা হত্যার মাত্র একদিন পরেই এটা সিগফ্রিডের রেফারেন্স ছাড়া এক মনগড়া দাবি। বুঝা যাচ্ছে তিনি বিরাট গুণীন লোক! গুণে বলে দিতে পারেন! আজ এক মাস পরেও যেখানে নিশ্চিত করে দেশি-বিদেশি সরকার কেউই বলতে পারছে না কে খুন করেছে সেখানে সিগফ্রিড খুনের একদিনে পরের তাৎক্ষণিক সাক্ষাতকারে তা আমাদের জানিয়ে দিয়েছেন যে এটা আইএস। আমরা দেখছি, একজন গবেষক বিশেষত বিশ্ববিদ্যালয়ের একাডেমিক লোক, এধরণের ফালতু প্রপাগান্ডায় সামিল হয়ে পড়েছেন।
৩। আঁতেল সিগফ্রিড এরপর বলছেন, “সালাফি মতবাদে বিশ্বাসী আইএস কিন্তু গভীরভাবে জামায়াতে ইসলামীর প্রতিষ্ঠাতা আবুল আলা মওদুদীর আদর্শের প্রতি আকৃষ্ট”। কিন্তু তিনি “সালাফি মতবাদ” বলতে ঠিক কী বুঝিয়েছেন তা আমাদের জানার উপায় রাখেন নাই। কারণ সুন্নি ধারার যে কোন রাজনৈতিক দল তা সে গণ আন্দোলনের দল হোক কিংবা সশস্ত্র দল – সব ধারার মধ্যেই সালাফি চিন্তার ছাপ কম-বেশি থাকতে দেখা যায়। এর উপর আবার মওদুদীর আদর্শও তিনি যেন বুঝেন এমন ধারণা দিয়েছেন আমাদের। এর মানে এই বাক্য বলার আগে তাঁকে সালাফি মতবাদ, আইএসের রাজনীতি এবং মওদুদীর আদর্শ সম্পর্কে জানা থাকতে হবে। কিন্তু এ সম্পর্কে তাঁর নুন্যতম জানা আছে এমন কোন প্রমাণ তার সাক্ষাতকার থেকে জানা যায় না। একথা ঠিক যে “মওদুদী আদর্শ” সম্পর্কে সুন্নী রাজনৈতিক জগতেই বিভিন্ন ধারারই অনেক ধরণের আপত্তি বা বিরোধীতা আছে। এবং এটা অস্বাভাবিক নয়। কিন্তু “মওদুদী আদর্শ” এর ঠিক কোন বা কোন কোন অংশের প্রতি আইএস “আকৃষ্ট” এমন কোন ধারণা তিনি রাখেন নাই। যেন তিনি কেবল আমাদের বুঝাতে চান যে সালাফি বা মওদুদী এসব শব্দগুলো তিনি জানেন তাতে এর অর্থ তাতপর্য ফারাক তাঁর জানা থাক আর নাই থাক। কারণ প্রথম কথা হল, মওদুদীর রাজনৈতিক চিন্তা “সশস্ত্র বলপ্রয়োগে ক্ষমতা দখল” ধরণের নয়। ফলে কথিত “মওদুদীর আদর্শ” অন্তত আর যাই হোক “জঙ্গীবাদ বা টেররিজম” ক্যাটাগরির রাজনীতি একেবারেই নয়।
রাজনীতির দুই ধারাঃ লিবারেল সংসদীয় রাজনৈতিক দল আর সশস্ত্রভাবে রাষ্ট্র ক্ষমতা দখলের দল
মোটা দাগে রাজনৈতিক চিন্তা বা রাজনৈতিক দলের ধরণ অর্থে আমরা দুটো ধরণে এর ভাগ দেখাতে পারি। এক, গণ-আন্দোলনের (মাস-পার্টি) দল। এরা দেশের প্রচলিত কনষ্টিটিউশন মেনে ওর আইনের অধীনে রেজিষ্টার্ড দল হিসাবে সংসদ নির্বাচনে অংশ নেয়, জনগনকে সাথে নিয়ে রাস্তায় প্রকাশ্যে মিছিল মিটিং আন্দোলন করে কিন্তু নিরস্ত্র ভাবে তা করে। নিরস্ত্র মানে কোন ফায়ার আর্মস তারা ব্যবহার করবে না। এভাবেই ক্ষমতায় যাবার পথ চর্চা করে। এদের আর এক সাধারণ নামে ডাকা হয় কনষ্টিটিউশনাল লিবারেল দল বলে। আর এক অর্থে বলা যায়, এরা সংসদীয় রাজনৈতিক দল। যেমন, জামাত একটা সংসদীয় রাজনৈতিক দল। বাংলাদেশের রাজনৈতিক কালচারে আওয়ামি লীগ বা বিএনপির ছাত্র সংগঠন যে অর্থে বিশ্ববিদ্যালয়ে চাপাতি ও পিস্তল ব্যবহারের পরও লিবারেল সংসদীয় রাজনৈতিক দল ঠিক একই অর্থে জামাতে ইসলামিও লিবারেল সংসদীয় রাজনৈতিক দল। আর এসবের বিপরীতে আর এক ধরণের দল হল, সশস্ত্র বলপ্রয়োগে ক্ষমতা দখলের দল। প্রচলিত আইন ও কনষ্টিটিউশনের চোখে এরা ব্যাতিক্রমহীনভাবে বেআইনী দল হয়। ফলে কোন নির্বাচনে অংশগ্রহণের সুযোগ, কোন প্রকাশ্য দলীয় তৎপরতার সু্যোগ এদের থাকে না। জঙ্গী দল, টেররিষ্ট রাজনীতি বলতে এধরণের রাজনৈতিক দলকে বুঝায়। এই বিচারে মওদুদীর আদর্শ বা তাঁর চিন্তা –প্রথম টাইপের – অর্থাৎ গণআন্দোলন টাইপের। তাঁর চিন্তা কোন ভাবেই সশস্ত্র বলপ্রয়োগে ক্ষমতা দখল ধরণের নয়, ফলে পশ্চিমের চোখে যা টেররিজম তা মওদুদীর রাজনৈতিক চিন্তা বা লক্ষ্য নয়। তবু অনেকে উসখুস করতে পারেন। তাদের জন্য বলছি, আমরা মওদুদীর চিন্তা ভুল মনে করতে পারি, বিপদজনক ক্ষতিকর বা আমার বিরোধী, অপছন্দনীয় মনে করতে পারি। অবশ্যই করতে পারি। কিন্তু তবু মওদুদীর চিন্তাকে পশ্চিমের চোখে দেখেও টেররিষ্ট চিন্তা বা রাজনীতি বলতে পারি না। অনেকের মুখে বা স্মরণে পাকিস্তান আমলের কাদিয়ানি বিরোধী দাঙ্গাহাঙ্গামার উদাহরণ আসতে পারে। কিন্তু মনে রাখতে হবে ওটা তাঁর বল প্রয়োগে অস্ত্রের জোরে রাষ্ট্র ক্ষমতা দখলের কৌশল – এর উদাহরণ ছিল না। কাদিয়ানিদের অমুসলমান বলে আলাদা করে অবশিষ্টদের এক সেকটোরিয়ান বা সাম্প্রদায়িক প্রচেষ্টা্র রাজনীতি করা বলতে পারি। কিন্তু এটা তবুও গণআন্দোলন ধরণের ততপরতা গোপন সশস্ত্র ততপরতার নয়, বড় জোর আমরা একে গণআন্দোলন ধারার মধ্যেই আর এক খারাপ প্রচেষ্টার ধরণ বলতে পারি। কারণ সেটা সশস্ত্রতায় রাষ্ট্র ক্ষমতা দখলের কোন উদ্যোগ বা ততপরতা ছিল না। ফলে “টেররিষ্ট” রাজনীতি এটা নয়।
এছাড়া, অনেকের ৭১ এর উদাহরণ মনে আসতে পারে। কিন্তু মনে রাখতে হবে সেটাও ঠিক রাষ্ট্র ক্ষমতা দখলের উদাহরণ নয়, কারণ সেটা পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানকে ক্ষমতা থেকে উৎখাতের লক্ষ্যে জামাতের কোন সশস্ত্র রাজনীতি ছিল নয়। বরং ইয়াহিয়াকে সমর্থন করার রাজনীতি। তবে অবশ্যই বাঙালী মুক্তিযোদ্ধাদের বিরুদ্ধে সশস্ত্রতায়।
মওদুদীর চিন্তাঃ ‘সৎ’ ও ‘আল্লাভীরু’ ক্যাডারের লিবারেল দল
আবার মওদুদীর চোখে তাঁর আকাঙ্খিত রাজনৈতিক দল -এটা রাজনৈতিক চিন্তা ওরিয়েন্টেশনে প্রশিক্ষিত ক্যাডারদের দল হতে হবে– এটাই তার ইমাজিনেশনে ইসলামি রাজনীতির অগ্রগামি পথ দেখানোর সৈনিক অর্থে ক্যাডারের কথা তিনি ভেবেছিলেন, প্রস্তাব করেছিলেন। ক্যাডার বলতে কিন্তু এটা সশস্ত্র ক্যাডার নয়। কারণ তিনি ইমাজিন করতেন ইসলামি নৈতিকতায় এক দঙ্গল “সৎ”, “আল্লা ভীরু” লোকের কথা। একথাগুলো বলে আমি বলছি না মওদুদীর রাজনীতি ঠিক কি বেঠিক ছিল, তিনি যা ভেবেছেন তাই করতে পেরেছিলেন কী না,’সৎ’ ও ‘আল্লাভীরু’ ক্যাডারের দল কথাগুলো অকেজো অর্থহীন কী না অথবা সেটাই সঠিক ইসলামি রাজনীতি ছিল কী না – এগুলো এমন অর্থ করা এমন কিছু আমার বলবার বিষয় নয় বা বুঝানোর ইচ্ছা নয়। আমি কেবল বলছি মওদুদীর আদর্শ বা রাজনীতি – গণ-আন্দোলনের (মাস-পার্টি) দল ধরণের। এটা কোন ভাবেই টেররিষ্ট ক্যাটাগরির চিন্তা আদর্শ বা রাজনীতি নয়। অতএব “মওদুদীর আদর্শের ভিতর আইএসের আকৃষ্ট” বোধ করার কোন সুযোগই নাই। যদিও মওদুদীর আদর্শ আর আইএস এর রাজনীতি এদুটোই ইসলামের ভিতরকার যে সকল রাজনৈতিক প্রবণতা আছে,তার মধ্যে সালাফ অর্থে পূর্বসরী বা একটা বিশেষ প্রজন্মকে ইসলামের ব্যখ্যা বা চর্চার জন্য অথরিটেভি মান্য করা,সে অর্থে সালাফি রাজনীতির দ্বারা প্রভাবিত হতে পারে।
তাহলে জর্মান একাডেমিক সিগফ্রিড যেটা করছেন বলছেন এটা স্পষ্ট এক প্রপাগান্ডা। যা কোন একাডেমিকের কাজ নয়, হতে পারে না। জার্মানির হাইডেলবার্গ বিশ্ববিদ্যালয়ে বসে দক্ষিণ এশীয় ইনস্টিটিউট খুলে করার মত সামঞ্জস্যপুর্ণ কাজও এটা নয়।
জামাতের নাম বললে নিজের ইসলাম বিদ্বেষ, ঘৃণা ছড়ানো বক্তব্য আড়াল করা যায়
প্রথম আলোর প্রথম সাক্ষাতকারে এই প্রচারকের ব্যকগ্রাউন্ড হিসাবে কিছু পরিচয় তুলে ধরেছিল। সেখান থেকে জানা যাচ্ছে, “ডারহাম বিশ্ববিদ্যালয়ের পাকিস্তান সিকিউরিটি রিসার্চ ইউনিট এবং দিল্লির Centre de Sciences Humaines (New Delhi, India) সাবেক রিসার্চ ফেলো। বর্তমানে তিনি জার্মান পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের আফগানিস্তান-পাকিস্তান টাস্কফোর্সের বহিস্থ বিশেষজ্ঞ গ্রুপের অন্যতম সদস্য”। অর্থাৎ এই উপমহাদেশ বিষয়ে তাঁর অভিজ্ঞতা বা এক্সপোজার হল ভারতের এক একাডেমিক ইন্সটিটিউট। ফলে একারণে মনে করার কারণ আছে যে মওদুদীর নাম ও কাজ সম্পর্কে পরিচয় হয়েছে বড় জোর, সালাফি চিন্তা সম্পর্কে পরিচিতি এগুলো তিনি কেবল নাম জানেন, জানাশুনা ষ্টাডি বলতে যা বুঝায় তা তার কিছুই নাই। এছাড়া খুব সম্ভবত বাংলাদেশ সম্পর্কে ভারতীয় চিন্তায় কোনটা তারা প্রপাগান্ডার জন্য বলে থাকে আর কোনটা ফ্যাক্টস এর কোন ফারাক রেখে বলে না বলে তিনিও ভারতীয় গোয়েন্দা প্রপাগান্ডাগুলোকেই ফ্যাক্টস মনে করে বসে আছেন দেখা যাচ্ছে। যেমন ভারতীয় গোয়েন্দাসহ ইনটেলিজেন্সিয়া কেন যে কোন ইসলামি তৎপরতার বিপক্ষে বলার দরকার বোধ করলেই সেটা জামাতে ইসলামির তৎপরতা বলে দাবি ও দোষারোপ করবে। সেটার সঙ্গে জামাতের নুন্যতম সম্পর্ক নাই এটা নিশ্চিত জানলেও তা করবে। কারণ সেটা জামাতের কাজ বললে একটা বাড়তি সুবিধা পাওয়া যায়। জামাত উচ্চারণ করে ওরা বুঝাতে চায় যারা ৭১ সালে বাংলাদেশের বিপক্ষে ছিল – অর্থাৎ এরা নৈতিকভাবে দাগ লাগা গোষ্ঠি – ফলে অর্থ দাড়াল ইসলামের নামে যে কোন তৎপরতাই অনৈতিক, কালিমালিপ্ত। নিজের ধর্মের জায়গায় বসে এতে সহজেই আর একটা ধর্মকে খারাপ বলে ফেলা যায়, ঘৃণা ছড়ানো যায়, নিজেরা ভাল মহান বলে ইঙ্গিত রাখা যায় ইত্যাদি। ঠিক যেমন শাহরিয়ার কবির যে কোন ফ্যাকড়ার ইসলামি রাজনৈতিক বা সাংস্কৃতিক তৎপরতা মাত্র তা জামাতের বলে চিহ্নিত করবেই। না বুঝা চিন্তার দৌড়ে জর্মান সিগফ্রিড এমন ভারতীয় বা শাহরিয়ার কবিরের প্রপাগান্ডার পথটাকেই অনুসরণ করেছেন।
মজার কথা হল, দ্বিতীয় বা ২৮ অক্টোবরের সাক্ষাতকারে সিগফ্রিড এবার আর জামাত এবং আইএসকেও আর আলাদা রাখেন নাই। বলছেন, “আইএসের মতো আন্তর্জাতিকভাবে সক্রিয় জিহাদি গোষ্ঠীর সঙ্গে তার নতুন স্থানীয় সহযোগী জামায়াতের যোগসাজশকে অবশ্যই মনোযোগের কেন্দ্রে আনতে হবে”। জামাত নাকি আইএসের স্থানীয় সহযোগী। দায়দায়িত্বহীন সুইপিং মন্তব্য করা – এটা একজন একাডেমিকের জন্য সবচেয়ে নিন্দিত কাজ। এই যে দাবি তিনি করলেন এর স্বপক্ষে কোন প্রমাণ তার কাছে কী আছে? তার এই মন্তব্য শুনে মনে হচ্ছে, তিনি একজন একাডেমিক নন, হাসিনার মত পল্টনে বা সোহরওয়ার্দি উদ্যানে রাজনৈতিক বক্তৃতা দিচ্ছেন যেখানে আমাদের রাজনৈতিক কালচারে এমন গণ বক্তৃতায় প্রমাণ হীন যা মনে চায় এমন দায়বিহীন উড়া মন্তব্য দেয়া যায়। অথচ এমপ্ন যুতসই প্রমাণ থাকলে হাসিনা সকলের আগে এমন ঠোস প্রমাণের ভিত্তিতে বহু আগেই জামাতকে নিষিদ্ধ করে দিতেন। আর আমরাও এন্টি-জামাত বিষয়ক প্রপাগান্ডার নামে ধর্মবিদ্বেষী প্রপাগান্ডার রাজনীতির হাত থেকে বেচে যেতাম। সিগফ্রিড এর একথা থেকে এটা পরিস্কার যে তাঁর না জামাত না আইএসের রাজনীতি সম্পর্কে কোন ধারণা আছে। বলা বাহুল্য আমেরিকার এমন বেকুবি উদ্ভট চিন্তা নাই। এমনকি ভারতের র ও মনে করে যে বাংলাদেশে বিদেশীদের হত্যা এটা আইএসের কাজ নয়, তবে জামাত হতে পারে। প্রথম আলো ৭ অক্টোবর টাইমস অব ইন্ডিয়ার বরাতে জানাচ্ছে – এই কাজে আইএসের যোগসুত্র নাই। এই খবরের ফলে এক মজার তামশার পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। ভারত বলছে, এই কাজে আইএসের যোগসুত্র নাই, তবে জামাত হতে পারে। তার মানে কী দাঁড়াল? দাঁড়াল এই যে ভারতের র মনে করে জামাত অন্তত আইএস এর স্থানীয় সহযোগী নয়।
সিগফ্রিডের এসব বেকুবি কথাবার্তা এমনই উদ্ভট এবং স্ববিরোধী যে শেষে সাক্ষাতকার গ্রহিতা প্রথম আলোর মিজানেরও আর তা হজম হয় নাই। চরম অসহ্য ঠেকেছিল। তিনি সাক্ষাতকার গ্রহিতা হওয়া সত্ত্বেও বলেই ফেলেছেন যে, এখানে কি আপনার বক্তব্য স্ববিরোধী মনে হচ্ছে না? এরপরেও সিগফ্রিড এতই নাদান যে তিনি বুঝতেও পারেন নাই মিজান তাকে সতর্ক করছে, সুযোগ দিচ্ছে।
এই জায়গায় এসে সিগফ্রিডের অবস্থান হাসিনা সরকারের মত স্ববিরোধী এবং ইসলামফোবিক বিদ্বেষী। এছাড়া যে প্রশ্নটা মাথায় তাড়া করে বেড়াচ্ছে তা হল, প্রথম আলো সিগফ্রিডের মত এই নিম্ন যোগ্যতার লোককে ধরে আনল কেন? এভাবে কাকে সার্ভ করল? তা বিস্ময়কর হয়ে থাকল!
[লেখাটা প্রথম ছাপা হয়েছিল দৈনিক নয়া দিগন্ত ০১ নভেম্বর ২০১৫ সংখ্যায়। এখানে তা আবার আরও সংযোজন ও সম্পাদনার পর ছাপা হল।]
ভাল লাগলো।
LikeLike
পুরোটাই পড়লাম।নিরপেক্ষ,তথ্য,যুক্তি ও বিশ্লেষণধর্মী লেখা। খুব ভাল লাগল।
LikeLike