সভ্যতা মানে কী


সভ্যতা মানে কী
সিন্ধু সভ্যতাঃ এই প্রেক্ষিতে

গৌতম দাস
১২ মে, ২০২২  ১৪ঃ৫২ বৃহস্পতিবার

https://wp.me/p1sCvy-44A

দ্বিতীয় পর্ব পেতে এখানে https://wp.me/p1sCvy-47s

 

Machu Picchu is an ancient city from the Inca civilization.

Ancient ruins of Karnak temple in Luxor. Egypt. Image credit: Zbigniew Guzowski/Shutterstock.com

দুনিয়াতে একেকজন মানুষ বিচ্ছিন্ন কেউ নয়, বিচ্ছিন্নভাবে একা একা তারা আসেনি বা দুনিয়াতে বসবাস শুরু করে নাই। দল বা গোষ্ঠিবদ্ধ ভাবে এসেছিল। জৈবপ্রাণ প্রজাতির টিকে থাকার অপরিহার্য শর্ত হিসাবে শুরুতেই এক পর্যায়ে তাদের হাজিরা হয়ে ইঠেছিল দলবদ্ধ, একথা বলা যায়। কারণ জৈবপ্রাণ প্রজাতিগুলো দুনিয়াতে টিকে যাওয়ার পিছনে এটা একটা গুরুত্বপুর্ণ শর্ত কাজ করেছে বলে অনুমান করা যায়। এছাড়া দুনিয়ায় সবকালেই  মানুষের উপস্থিতির যতগুলো রূপ-ধরণ আমরা এখন পর্যন্ত দেখি তাতে সবকালেই মানুষ মাত্রই তারা যৌথ মানে, তাকে দল বা গোষ্ঠিবদ্ধ ভাবেই দেখি। অর্থাৎ মানুষ একা জন্মায় হয়ত ঠিকই কিন্তু জন্মানোর পর থেকে বসবাস তার গোষ্ঠিবদ্ধতায় অথবা সেই থেকে গোষ্ঠির ভিতরেই তার সব প্রজন্ম ও তাদের বড় হওয়া ঘটেছে দেখি আমরা। তবে কথাটা এভাবে বলায় অন্য এক  লক্ষ্যণীয় দিক হল এখানে ব্যাপারটাকে পেশ করবার চেষ্টাটা হল দুনিয়াতে একেবারে শুরুর দিক থেকে মানুষ প্রজাতির কবে কখন এসেছে বা যুক্ত হয়েছে সেদিক থেকে কথা বলবার চেষ্টা করা হল।

তা সত্বেও এভাবে “শুরু” থেকে বলার অসুবিধা হল, এক্ষেত্রে বেশিরভাগ তথ্যই কোন প্রমাণিত উৎস থেকে সংগ্রহ করা সহজ নয়। যদিও ইন্টারনেটের যুগে অনেক কিছুই আমাদের কাছে এখন লেখাপড়া বা স্টাডির জন্য সহজ লভ্য হয়ে উঠেছে। তবু অনেক উৎস আমাদের এখনও নাগালে নাই।

এছাড়া এক্ষেত্রে আর সবচেয়ে বড় অসুবিধা হল এরপরেও মানুষের ইতিহাসের সব মানুষের জানা হয়ে গেছে, খুঁড়ে দেখা ও খোঁজাখুজি করা হয়ে গেছে আবার পাওয়াও গেছে ব্যাপারটা তা তো নয়। ফলে  বহু প্রসঙ্গই একেবারেই অজানা বা জানার মাঝেও অনেক অজানা পকেট বা ফাঁকা থেকে গেছে হয়ত।  এমনটাই স্বাভাবিক।

লিখিত ইতিহাসঃ
মূল কারণ হিসাবে বলা যায়, আমরা যে আদি মানব রূপ নিয়ে কথা তুলেছি এসব ঘটনা প্রসঙ্গগুলো হল কমপক্ষে কয়েক মিলিয়ন (এক মিলিয়ন মানে দশ লাখ) বছর আগের ঘটনা [One of the earliest known humans is Homo habilis, or “handy man,” who lived about 2.4 million to 1.4 million years ago in Eastern and Southern Africa.]। আবার অন্যদিকে,  যেমন দুনিয়ায় মানুষ-সহ অনেক জৈবপ্রাণ প্রজাতি আছে। এর মধ্য মানুষ এই প্রজাতির বয়স ধরা হয় (গুগলের বিচারে)  যতগুলো তত্বগত ধারণা আছে এর কোনটাই দুই লাখ বছরের কম না। কাজেই এমন প্রসঙ্গের সব তথ্য সহজ লভ্য হবার কোনই কারণ নাই। এটাই স্বাভাবিক। ফলে কথাটা এভাবে বলা যায় একালে আমাদের জানা আছে ততটুকুই যখন থেকে কিছু  লিখিত ইতিহাস আছে। তাহলে লিখিত ইতিহাস কথাটা গুরুত্বপুর্ণ।

তবে তাহলে আবার আরেকটা কথা এসে গেল যে  যদি লিখিত ইতিহাসের কথা ধরে বলি, লিখিত ইতিহাস? এর মানে কী বুঝব? যখন থেকে ইতিহাস লিপিবদ্ধ হয়েছে? তা বলতে পারি হয়ত তবে তাও একেবারেই এত সহজ কথা নয়। কেন?
যেমন শুধু ‘লিখিত’ শব্দটার অর্থ প্রচলিত বা চালু হওয়ার আগেই অন্তত কয়েক হাজার হাজার বছরের মনুষ্য-জীবন এবং তা দলবদ্ধ  ধরণের বিশেষ জীবন পার হয়ে যেতে হয়েছে। মানেই এর আগে বহু বহু কিছু ঘটে যেতে হয়েছে এবং তা অবশ্যই আবার কয়েক হাজার বছরের ফেকড়া। কেমন সেটা?

সভ্যতা বা সিভিলাইজেশনঃ
বড় হেড লাইনে বললে, একটা নতুন শব্দ এই আসরে আনব – শব্দটা হল সভ্যতা।  সভ্যতা বা সিভিলাইজেশন (civilization) যখন থেকে শুরু। অর্থাৎ দুনিয়াতে অন্য অনেক জৈবপ্রাণ প্রজাতির মত মনুষ্য-প্রজাতির আগমন – এটা একটা কয়েক লক্ষ বছরের পুরানা ঘটনা। কিন্তু তা সত্বেও অপর আর একটা  রেফারেন্সের দিক থেকে আমরা কথা বলতে অভ্যস্ত – সেটাই “সভ্যতার” রেফারেন্সে কথা বলা। এই সভ্যতা মানে কী? শারারণভাবে বললে,  তখন কথাটা এভাবে বলা যায় যে যেখানে  মানুষের খোঁজ পাওয়া যায় এমন পুরানা সভ্যতাগুলোও মোটামুটি প্রায় ছয়হাজার বছরের পুরানা। এছাড়াও কথাটা এভাবে সম্ভবত বলা যায় যে সব মানুষের জনগোষ্ঠিই কোন না কোন এক সভ্যতার অংশ; যেমন এই বিচারে আমরা সিন্ধু সভ্যতার অংশ।
আর সবচেয়ে প্রাসঙ্গিক কথাটা হল, উপরে যে লিখিত ইতিহাসের কথা বলছি সেটা ঘটেছিল কেবল ‘মানুষের সভ্যতা’ শুরুর পরেই। এটাই এর অপরিহার্য শর্ত, তা বলা যেতে পারে। তাহলে আবার ফিরে প্রশ্ন থেকে গেল যে সভ্যতা তাহলে কী?
এর খুবই সংক্ষিপ্ত সংজ্ঞাটা হল, মানুষ আদি মানব রূপ [homo sapiens] – এভাবে  কয়েক লাখ বছর আগে দুনিয়াতে হাজির হলেও মানুষের কৃষিকাজের জীবন যাপন শুরু বড়জোর ছয় হাজার বছরের বছরের পুরানা। মানুষের কৃষিকাজ শুরু খুবই গুরুত্বপুর্ণ হদিস। কারণ কৃষিকাজ মানে আর যাযাবর জীবন নয়। থিতু হয়ে যেখানে তাঁর চাষের জমি তারই সংলগ্ন হয়ে বসবাস করতে সে বাধ্য হয়েছে। মানুষের এই জোবনের শুরু মাত্র কয়েক হাজার বছরের পুরানা। তুলনায় মানুষের দুনিয়ায় আদি মানব রূপে আগমন হিশাব করতে হয় লাখে।   অর্থাৎ লাখ নয় কয়েক হাজার বছরের আগে যে মানুষের কৃষিকাজ-ভিত্তিক জীবন-যাপন শুরু হয়েছিল এটাকে আমি একেকটা মানুষের সভ্যতার জীবন বলি। এর আরো বিস্তারিত পরে আসবে।

“লিখিত ইতিহাস” এর আবশ্যিক পুর্বশর্তঃ
এমনিতে লিখিত ইতিহাস বলতে সেটা আসলে একালে বসে পুরানা ইতিহাসের তথ্য সংগ্রহ। যদিও আবার ইতিহাস মানে ‘শ্রেফ অতীত প্রসঙ্গে তথ্য সংগ্রহ ও এর সমাহার নয়’। কারণ ইতিহাসের জন্য আরেক বড় অধ্যায় হল মানুষের বুদ্ধিবৃত্তিক বিকাশ ঘটাই শুধু না, এর শেষে মূলত আত্মসচেতনতার [self-consciousness] জগতে প্রবেশ করা এবং আরো এগিয়ে যাওয়া। চিন্তা যে চিন্তা করে তা জেনে বুঝে যাওয়া। চিন্তারও বিভিন্ন পর্যায়, বিশেষত চিন্তারও যে পদ্ধতি আছে তা সম্যক জানাশুনা করে নেওয়া। এরই প্রথম পর্যায়টা হল  র‍্যাশনালিটি [rationality] মানে যুক্তি-তর্ক করতে শিখে ফেলা – এই অর্জনটা লিখিত ইতিহাসের আগে থাকা জরুরি [essential pre-condition]। মানুষের চিন্তার এই নুন্যতম পর্যায়টা পার হলে তবেই “লিখিত ইতিহাস” সম্ভব হয়। অর্থাৎ কত লাখ বছর আগে মানুষ হোমো সেপিয়ান যুগে তার আদিরূপ ছেড়ে এসেছে সেটা যথেষ্ট নয়; পরবর্তিতে সে তাঁর লম্বা যাযাবর [nomad বা  Pastoral] জীবন ছেড়ে কৃষিকাজের লোভে বা এই নয়া জীবনকে তুলনায় সহজ মনে হওয়াতে কোন মাটিতে থিতু হয়েছিল – সে ঘটনা এই তো মাত্র তিন-ছয় হাজার বছর আগে। এই স্থির হয়ে কোন নিদির্ষ্ট ভুমিতে বসে পড়া আর কৃষিকাজ যেখানে তার পেশা এখান থেকে সভ্যতার শুরু। দুনিয়ায় মানুষের সব সভ্যতাগুলো কমবেশি শুরু হয়েছিল এরপর থেকে এবং তারা পরস্পর পরস্পরকে জানাশুনা না রেখেই বিভিন্ন সময়কালে শুরু হয়েছিল।  এই সভ্যতার জীবনেরই আবার শেষের দিকে মোটামুটি হাজার বছরের অগ্রগতি হল – তবেই মানুষের এই লিখিত ইতিহাসের যুগ প্রবেশ ও পেরোনো। এভাবে শেষে আজকের জায়গায় আসা।
এসবের পিছনের মূল কারণ, এটা মানুষের চিন্তাজগতের এক বড় অর্জন এবং তার নুন্যতম চিন্তায় পরিপক্ক হওয়া বা ম্যাচিউরিটি [maturity]। এমন ঘটবার পরেই মানুষ পুরানা সেসব সময়কালের কী কী ডকুমেন্ট সংগ্রহ করবে বা রাখবে, সাংস্কৃতিক কী কী চিহ্ন-বৈশিষ্ঠ খুঁজবার ও বুঝবার দিকে নজর-মনোযোগ নিবদ্ধ করবে আর এছাড়া মুখে মুখে মানে, মুখ আর কানে বয়ে চলা প্রজাতি পরম্পরায় ধরে রাখা তথ্যকেও যতটা সম্ভব  “ডকুমেন্ট” করে রাখার কথা ভাববে ইত্যাদি  – কেন গুরুত্বপুর্ণ তা বুঝেছে। অর্থাৎ মানুষের পক্ষে এই গুরুত্ব অনুভব করার যোগ্য হতে হতেই হয়ত আরো হাজার বছর কেটে গেছে। আর পরিস্কার মনে রাখতে হবে মানুষের লিখিত ইতিহাস কেবল অন্তত কোন একটা জনগোষ্ঠির এক সভ্যতার যাত্রা শুরু করতে পেরেছিল কিছু অপরিহার্য শর্ত পূরণের পরেই তা সম্ভব হয়েছিল। অন্যভাবে বললে, নিজের একটা সভ্যতা বা সিভিলাইজেশনের কোলে কোন জনগোষ্ঠি থিতু হয়ে বসতে পারলে এরও বহু্বছর পরে একটা লিখিত ইতিহাস শুরু হওয়া সম্ভব হয়েছিল।

সুমেরীয় সভ্যতাঃ
আগে বলেছি দুনিয়াতে সব সভ্যতা একই সময়ে যাত্রা শুরু করে নাই। অর্থাৎ সভ্যতাগুলো বিভিন্ন সময়কালে যাত্রা শুরু করেছিল এছাড়া সেকালের দুর্গম যোগাযোগ ব্যবস্থার মধ্যে তারা পরস্পরের কাছে অজানাই ছিল। তবুও দুনিয়া ছড়িয়ে ছিটিয়ে  সভ্যতাগুলোর কোনটাই মোটামুটি ছয় হাজার বছরের বেশি বয়সী নয়। এছাড়া আগে বলেছি আমরা বৃহত্তর বাঙালি অর্থে এই এথনিক জনগোষ্ঠি আমরা সিন্ধু সভ্যতার অংশ।  আমাদের কাছাকাছি ভুগোলে আরো অনেক সভ্যতার কথা জানা যায়। এদের মধ্যে কাছাকাছি ভুগোলে প্রভাবশালী সভ্যতা হল সুমের সভ্যতা।
সুমের (Sumer)বা সুমেরীয় সভ্যতা  এর ভৌগলিক অবস্থান হল আজকের ইরাক, কুয়েত ও  অংশত সিরিয়া যেখানে। অন্যভাবে বললে টাইগ্রিস ও ইউফ্রেটিস নদীর মাঝের ভুমিতে এই অববাহিকায় গড়ে উঠে সভ্যতা। আর সুমের হল আসলে মেসোপটমীয়া এই সভ্যতা-ভুমির প্রধান নগরের নাম। ফলে অনেক সময় সুমেরীয় সভ্যতাকে মেসোপটমীয় [Mesopotamia] সভ্যতাও বলা হয়।

এই সভ্যতার বিশেষ এক বৈশিষ্ঠ হল এর লিখিত ইতিহাস বা ইতিহাসের উপাদান এখানে পাওয়া গিয়েছে। ফলে এই সভ্যতার অনেক কিছুই ডকুমেন্টেড।  এর সেই লিখিত ধারার নাম আবার কিউনিওফর্ম (Cuneiform)। এই শব্দের অর্থ বাংলায় গোঁজ বা খুটা (গরু বাধা দড়ির যার প্রান্তে আটকানো থাকে)। ইংরাজিতে (wedge)বা গোঁজ দিয়ে নরম কাঁদামাটির স্লেটের উপর চিহ্ন এঁকে লেখা,যা পরে শুকিয়ে-পুড়িয়ে স্থায়ী করে নেয়া – এই হল এর লেখা ও সংরক্ষণের পদ্ধতি। সেখান থেকে এটা ‘সুমেরীয় কিউনিওফর্ম স্ক্রীপ্ট’ এই নামের এক প্রাচীন লিখিত ইতিহাস রাখার পদ্ধতি বলে পরিচিত আছে।

আবার মেসোপটমীয়াকে সব সভ্যতার সুতিকাগার বা দোলনাঘর (cradle of civilization) বলা হয়। অর্থাৎ এটা সবচেয়ে প্রাচীন সভ্যতা। এছাড়াও, কোথাও সভ্যতা গড়ে উঠতে গেলে যেসব উপাদান সেখানে থাকলে তা গড়ে উঠার জন্য সবচেয়ে সহায়ক বলে মনে করা হয় সে বিচারে  মেসোপটমীয়া সভ্যতা সবার চেয়ে  আগিয়ে মানে তাতে সহায়ক উপাদান সবচেয়ে বেশি ও আদর্শভাবে উপস্থিতি পর্যাপ্ত বা বেশি।

সেসব উপাদানকে সহায়ক শর্ত ধরা হয় সেপ্রসঙ্গে যাবার আগে কিছু সাধারণ কথা। যেমন সভ্যতা বিষয়ে আমরা কয়েকটা কথা একেবারে মুখস্ত রাখতে পারি। সভ্যতা শব্দটার প্রায় সমান্তরাল আরেকটা শব্দ হল ডমেস্টিক (domestic) বা গৃহপালিত। এটা প্রচলিতভাবে ডোমেস্টিক শব্দটা আমরা ব্যবহারে যেভাবে অভ্যস্ত তার চেয়ে একটু ভিন্ন। কেন?

মিলিয়ন বছরের মানুষ এই প্রজাতি (spacies) ছয়হাজার বছরের সভ্যতার যুগে প্রবেশেরও আগে অবশ্যই অনেক কিছুর বিপরীত স্রোতের ভিতর দিয়ে যেতে হয়েছে তা বলাই বাহুল্য। এছাড়া যেখানে মাঝের এই সময়গুলোর মানে, মিলিয়ন থেকে হাজার বছরে নেমে আসার বড় একটা অংশই কেটেছে – প্রকৃতির সাথে ভাল “খাপ খাইয়ে নেয়া” প্রজাতি হয়ে উঠতে। অর্থাৎ মানুষের স্বভাব ও শরীরের যেসব বৈশিষ্ঠ বাস্তবের প্রকৃতিতে টিকে থাকার উপযোগী ছিল না এটা বলা অতুক্তি হবে না যে হয় তা মানুষ তার নিজের বাইরের প্রকৃতির সাথে প্রকৃতির উপযোগী হতে বা খাপে খাপ খাইয়ে নিতে গিয়ে নিজেকে নিজের শারীরিক গঠন সহ বহু কিছুতে ব্যপক ভাবে বদলে নিতেই হয়েছে, বদলে গিয়েছে। আর নয়ত টিকতে না পেরে ঐ বিশেষ মানুষ-প্রজাতিটা বিলুপ্ত হয়ে গেছে। যেমন মানুষ কী খেয়ে বাঁচবে এর জবাব সোজা বলে দেয়া যায় যে যা তার পরিচিত ও গমনযোগ্য [accessable] ভূমিতে ঐকালে প্রচুর পাওয়া যেত তারই কোন একটাই তার খাদ্য হয়েছিল; তবে অবশ্যই যা তার খাদ্য হবার উপযুক্ত কেবল সেগুলোই। আর একটা দীর্ঘ সময় মানুষের গড়ন-বৈশিষ্ঠের এই ভাঙ্গা গড়ার ভিতর দিয়েই কেটেছে তা আমরা নিশ্চিত ধরে নিতে পারি।

তবে একটা কথা পরিস্কার মনে রাখতে বলা যায় যে দুনিয়ার ভুগোলের কোন ভুমিতে সভ্যতা গড়তে বসা শুরু হবে তা শুরুর আগের মানুষের যে রূপ ও জীবন – সেটাই ছিল এক ব্যাপক যাযাবর (nomads) জীবন। অর্থাৎ মিলিয়ন বছর থেকে মানুষের বয়স যখন কয়েক হাজারে নেমে এসেছিল এই মাঝের দীর্ঘ সময়কাল এটাই মানূষের যাযাবর জীবনকাল। যাযাবর মানে হল খাবার টোকায় খেয়ে বা গাছ থেকে পেড়ে খেয়ে এক লম্বা শিকার ও সংগ্রহের জীবন মানুষকে পাড়ি দিতে হয়েছিল। মানে, হান্টিং এন্ড গ্যাদারিং [hanting & gathering]  জীবন ছিল সেটা!

এখানে যাযাবর বা নোমাড জীবন আর পশুপালক (pastoral)এদুইয়ের জীবনের মধ্যে মধ্যে একটা ফারাক মনে রাখা যেতে পারে। পশুপালকেরা সাধারণত যাযাবর হয় কিন্তু যাযাবরেরা পশুপালক নাও হতে পারে। কারণ হয়ত খাদ্যের প্রাপ্যতা [availability] জন্য, যে ভুমিতে সে ছিল তাতে কিছুদিন পর পর খাদ্য ফুরিয়ে যায়। মনে রাখতে হবে তখনকার মানুষ কৃষিকাজ কী তা জানত না। অর্তঝাত প্রকৃতি নিজের খেয়ালে যা কিছু ফল-ফলারি গাছে জন্মাত তা পেড়ে সংগ্রহ করেই পাওয়া এমন খাদ্য দিয়েই কেবল ঐ ভুমির মানুষদেরকে চলতে হত। তাই খাদ্যাভাব মানে চাষাবাদ জ্ঞানহীন জীবনের মানুষ গাছের ফল-মূল সংগ্রহ করে খেয়ে চলতে। তাই কোন ভুগোলের ভুমিতে খাদ্যের প্রাচুর্য আছে সেই খোজ রেখে তাকে যাযাবরের জীবন যাপন করতে সে বাধ্য ছিল। এমন অস্থিরতার জন্যও মানুষ যাযাবর হতে হত। যদিও যাযাবর এর সাধারণ সংজ্ঞা হল যে এক দেশ-ভুগোলের ভূমিতে বেশিদিন বসবাস করে না। কারণ খাদ্য প্রাপ্যতার অভাবেও (একই ভুমিতে খাদ্য ফুরায়ে গেলে) তার  যাযাবর হওয়া প্রয়োজন হয়েছে।

তবে আবার এই একটা কথায় অনেক কথা বলা হয়ে গেছে। যেমন এর মানে হল সে সময়ের মানুষ বা নোমাড মানুষ মানে এরা ১। তখনও এমন মানুষ যারা কৃষিকাজ জানে না বা তা করতে শুরু করে নাই। ২।  তখনও অর্থাৎ এটাকে বলে সংগ্রহ বা গেদারিং সমাজ (gathering society)- এমন সমাজ হয়েই তারা ছিল কেবল। যেমন কোন কোন গাছের ফল পাওয়া যায়, তা পেড়ে আনা বা সংগ্রহ করা যায়, কোথাও তা প্রচুর পাওয়া যায় ইত্যাদি সবকিছু সভ্যতা-পুর্ব কালের মানুষের ভাল জানা ছিল। এটা সভ্যতা শুরুর পুর্ব সমাজ কেন বললাম?

সভ্যতা শুরুর পুর্ব সমাজঃ
কারণ, সভ্যতা শুরু হতে গেলে এক অপরিহার্য শর্ত হল, মানুষকে সেক্ষেত্রে থিতু হয়ে কোন ভুগোল-ভুমিতে এর আগেই বসবাস শুরু করতে হবে। আর স্বভাবতই এর আগে পর্যন্ত মানুষ যে যাযাবর ছিল  সেই যাযাবর জীবনযাত্রায় তার আগে ইতি টানতে হয়েছিল। সোজা কথায় যাযাবর জীবনের মানে সভ্যতা শুরুর হয়েছিল যেখান থেকে এমন  জীবন সেটা। 

কারণ যাযাবর জীবন কালও অনেক লম্বা ছিল যা লাখে হিসাব করতে হবে। সাধারণত এর শেষের কালটা হল পশুপালক-যাযাবর (pastoral) জীবন। অর্থাৎ যখন পশু চড়িয়ে বেড়ানো তাঁর পেশা। তবে সাবধান এটা আমাদের এখনকার কল্পনায় দেখা বা বইয়ে পড়া কোন রাখাল বালকের গরু চড়ানো মত কোন গল্প নয়, এমন সরলও নয়। কারণ তখনও সে নোমাড বা যাযাবর। ফলে তারা “গৃহস্থ” হয়ে উঠে নাই তখনও। অর্থাৎ ‘বাসা’ বা আবাসস্থল বলে কোন ধারণা তখনও তাদের নাই। অর্থাৎ যেখানে সে রাত কাটায় সবটাই অস্থায়ী। তাই বাড়ি বা বাসা ধারণাটা তখনও মানুষের মধ্যে আসে নাই। এমন পশুপালক ((pastoral)) জীবন এখনও দেখতে পাওয়া  যেতে পারে আফ্রিকার কোথাও কোথাও।  যেমন কেনিয়ায় মাসাইমারা ট্রাইবে [Maasai mara Tribe & culture], ইথিওপিয়ার পশ্চিমাঞ্চলে [Gambella Region] [In Ethiopia, about 10 million pastoralists rely on animal husbandry as a key source of wealth and subsistence.] বা  ইথিওপিয়ারই সোমালি অঞ্চলে। এদের কমন ফিচার হচ্ছে তারা ট্রাইব (Tribe) গোত্রবাদি সমাজে বসবাস করে। অর্থাৎ এরা একটা বৃহত অঞ্চলে একালের রাজনৈতিক ভুগোলে বসবাস করলেও  এরা গোত্র সমাজের লোক – মানে ঠিক হান্টিং-গেদারিং সমাজের যাযাবর বলতে যা বুঝায় তা নয়। আবার মনে রাখতে হবে কোন ভুমিতে থিতু হয়ে বসা মানুষের জীবন-সমাজেরও আবার দুটা পর্যায় দেখা যায় কোথাও কোথাও। যেমন এর প্রথম রূপ হল গোত্র-সমাজ। যেটার আরেক রূপ  ব্যক্তিভিত্তিক সমাজ।  আর অবশ্যই “ব্যক্তিভিত্তিক সমাজের” আগের রূপ হল গোত্রভিত্তিক সমাজ।

এই সুযোগে গোত্র সমাজ নিয়ে কিছু কথাঃ
মূলকথা, গোত্রসমাজ আর ব্যক্তি সমাজ দুটাই সমাজ মনে হলেও দুটা একেবারেই এক নয়।  আবার “সমাজ” বলছি যখন তখন এটা অবশ্যই আগের মানুষের নিরন্তর যাযাবর জীবনের পরিসমাপ্তিতেই তা এসেছে আমরা ধরে নিতে পারি।  তবে হান্টিং এন্ড গেদারিংয়ের যাযাবর জীবন ধারা শেষে  সরাসরি কোন ভুমিতে থিতু হয়ে যারা কৃষিকাজের জীবন সমাজ শুরু করে নাই – ফিরে আবার পশুপালক (pastoral) জীবন যারা শুরু করেছিল এদের মধ্যেই গোত্রসমাজ সবচেয়ে দীর্ঘসময় টিকে যেতে দেখা যায়। সাধারণভাবে বলা যায় এশিয়ার সমতল-ভুমি অঞ্চলে গোত্রসমাজ সবার আগে উঠে গেছে মানে ক্ষণস্থায়ী ছিল। এর বাইরে যত হাইল্যান্ডার বা মরুভুমি অঞ্চল বা সংলগ্ন অঞ্চল – সেখানে গোত্রসমাজ দীর্ঘকাল টিকে থাকতে দেখা যায়।

গোত্রসমাজে ব্যক্তিবোধ নাই বা তখনও আসে নাই। ফলে ব্যক্তি সম্পত্তি নাই, গোত্র সম্পত্তি আছে। গোত্রসমাজে গোত্র-প্রধানই সব। তিনিই গোত্রের হয়ে সব সিদ্ধান্ত নেন বা দেন। আর এটাক ভেঙ্গে পড়লেই ব্যক্তি-সমাজ গড়ে উঠে। আমাদের পাহাড়ি জনগোষ্ঠি তাদের এখনও গোত্রপ্রধান বলে পদ আছে। যদিও তার কর্তৃত্ব নাই। এদিকে তারা এখন বাংলাদেশ রাষ্ট্রের আইনত নাগরিক। আর যে কোন রিপাবলিক রাষ্ট্র মানেই তা ব্যক্তিভিত্তিক। এছাড়া পাহাড়িদের পাশের বড় ও প্রভাবশালী বাঙালিরা ব্যক্তিসমাজ এর পর্যায়ে উঠে গেছে। সব মিলিয়ে তাই তাদের গোত্র সমাজ মূলত ভেঙ্গে গেছে, ব্যক্তি সমাজের দিকে রওয়ানা দিয়ে দিয়েছে। কিন্তু সাংস্কৃতিক ভাবে পুরানা গোত্রসমাজের সংস্কৃতির চর্চা-অভ্যাসগুলো রয়ে গেছে – যা বার বার উঠে আসছে আর সেগুলো তাদের “নিজস্ব কালচার” এই যুক্তিতে; যদিও সেগুলো আসলে তাদের পুরানা গোত্র (ব্যক্তিবোধ না জাগার কালের) কালচার।
গোত্রসমাজের বৈশিষ্ট বা কালচারাল ধরণ দেখে সহজেই চেনা সম্ভব। যেমন, পাকিস্তানের উত্তর সীমান্তের ভিতর থেকেই আরো উপরে দিকে যতই আফগানিস্তানের দিকে যাওয়া যাবে ততই ঐ অঞ্চলটাই গোত্রসমাজের প্রভাব ও সংশ্লিষ্ট গোত্র কালচারের আধিপত্য দেখতে পাওয়া যায়। যেমন শহুরে জীবনের চোখে তাদের সম্পর্কের আমরা দেখি মিডিয়ায় লেখা হয়েছে – “অনার কিলিং” (honour killing) এর কথা।  এটা কী জিনিষ?
শহুরে চোখে তা খুব আজিব লাগে, আধা বুঝ বা না-বুঝা লাগে হয়ত। ঘটনা বর্ণনা হয়ত শুনব এভাবে যে ওমুক গোষ্ঠির এক টিন-এজ মেয়ে নিজের পছন্দের কোন ছেলেকে বিয়ে করতে গেছে বলে ঐ মেয়ের ভাই নিজ বোনকে খুন করেছে। বর্ণনা শুনে এটাকে আমাদের মতই কোন ব্যক্তিসমাজের ঘটনা বলে ভেবে সে বিচারে  ব্যাপারটা”একটু উগ্র” মনে হবে হয়ত।  কিন্লেতু কেন তাদের সমাজ ওরকম? আর এই খন করার মধ্যে “অনার” মানে সম্মান রক্ষা করার ঘটনা কোনটা? কারই বা সম্মান??
আসলে এখানে এটা পুরাটাই এক গোত্রবাদী কালচারের চর্চা ও এর প্রভাব বা ওরই প্রাকটিস ওখানে করা হয়েছে। কেন ও কীভাবে?

গোত্র সমাজে ব্যক্তিবোধ নাই, থাকে না বা কাজ করে না। গোত্র সমাজে গোত্রপ্রধান থাকে আর তার হুকুমেই চলে। সেখানে তাই গোত্রপ্রধানের সিদ্ধান্তই সবার পালনীয়।  গোত্র পরিবারের কে কার সাথে বিয়েতে বসবে সেটাও গোত্রপ্রধানের বা তাঁর মিটিংয়ের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। অর্থাৎ গোত্রের সদস্যরা ব্যক্তি বলে গণ্য হয় না; নিজেদের তারা ব্যক্তি গণ্য করে না। এমন গোত্র সদস্য তারা। অতএব কোন ব্যক্তিবোধের চর্চা সেখানে থাকত না। আসলে ব্যক্তি নাই মানে সেখানে প্রেম বলে কোন নাই। কারণ প্রেমের পুর্বশর্ত হচ্ছে – দুজনাই স্বাধীন ব্যক্তিবোধ হাজিরা আর তা তাদের স্বজ্ঞানে বা অজ্ঞানে। (যদিও সেটা প্রেমের পরে বাস্তব পরিবার চর্চায় সেটা আর ততটা বাস্তবে ক্রিয়াশীল নাও থাকতে পারে।)  কাজেই কোন গোত্র পরিবারের সদস্য কোন ছেলে বা মেয়ে নিজ পছন্দের বিয়ের পথে যেতেই পারে না। এটা গোত্রপ্রথারই বা গোত্রপ্রধানেরই বিরুদ্ধাচারণ।
কিন্তু একালে এসে হয়ত কোন পুরানা গোত্রসমাজ ঠিক ভেঙ্গে যায় নি; ফলে নয়া ব্যক্তিসমাজও উদয় হয় নাই। কিন্তু একটা মাঝামাঝি দশায় আছে। ফলে সেটা ঠিক গোত্র কালচারের ভেঙ্গে পড়া কিন্তু আধাখেচড়া অবস্থা। ফলে গোত্রপ্রধানের নিয়ন্ত্রণও  ঢিলা তবে তা একেবারে ভেঙ্গে না পড়ে নাই হয়ত। এছাড়া পাশে হয়ত আছে কোন বড় ও ভিন্ন ব্যক্তিভিত্তিক সমাজের উপস্থিতি আছে। ঠিক যেমন, আমাদের পাহাড়ি জনগোষ্ঠির পাশে আমরা বাঙালি জনগোষ্ঠি যারা। আমরা পাহাড়িদের অনেক আগেই আমাদেরও হয়ত কোন গোত্রজীবন যা আগে ছিল তা শেষ ও ত্যাগ করে এসে গেছি। পাহাড়িদের তুলনায় আমরা সংখ্যাতেও অনেক বড়। তাই সব মিলিয়ে এসব কারণে আমাদের প্রভাবই ওদের উপরে পড়তে ও কাজ করতে বাধ্য।  এরকম পরিস্থিতেই অনার কিলিং ধরণের ঘটনা ঘটতে দেখা যায়। যার শাস্তি হল পরিবারের তরফ থেকে (পুরুষ ডোমিনেটেড পরিবার বলে) মেয়ে সদস্যকেই আগে হত্যা করে ফেলা, সাজা দেয়া হতে দেখা যায়। অর্থাৎ গোত্র-পরিবারেরর সম্মান রক্ষার্থে হত্যা এটাই “অনার কিলিং” (honour killing)। একালের পরিভাষায় হয়ত ভাই বলবে “এটা পরিবারের সম্মান রক্ষার্থে হত্যা”। কিন্তু পিছনের কারণ এটা গোত্রসমাজের মুল্যবোধ ও প্রথা অনুসরণ করে করা হয়েছে। এছাড়াও, যেমন চোখের বদলে চোখ তুলে নেয়ার প্রথা অথবা যাকে অপরাধী মনে করা তাকে নিজের হাতে শাস্তি দিয়ে চাওয়া – এগুলো গোত্রসমাজ কালচারেরই পুরানা জের ও এর প্রভাব। যেমন ব্যক্তিসমাজের দৃষ্টিতে কেউ যদি প্রেমের কারণে  নিজ বোনকে হত্যা করে তবে নাগরিক রাষ্ট্রের আদালত পুরানা গোত্রপ্রথার যুক্তি-সাফাই মানবে না, গ্রহণ করবে না।  বরং ভাইকে সোজা হত্যাকারি বলে উলটা ফাঁসির সাজা দিবে এই বলে যে ঐ ভাই তাঁর আপন বোন যে ঐ রাষ্ট্রের স্বাধীন নাগরিক তাকে খুন করেছে – আর কোন স্বাধীন নাগরিককে আরেক ব্যক্তি খুন করতে পারে না – এই অপরাধে ব্যক্তি-ভাই মৃত্যুদন্ড সাজা পাবে।
আবার এর উল্টাও হতে পারে। যেমন ব্যক্তিসমাজ হলেও কখনও সেখানে গণপিটুনির (মব লঞ্চিং বা Mob lynching) ধারণা দেখতে পাওয়া যায়। যার সোজা মানে হল ব্যক্তিসমাজে বিচারবিভাগ বলে আলাদা কিছু একটা আইন-বিচার আদালত চালু হয়ে গেছে ঠিকই। কিন্তু দুর্নীতি আর স্বৈর হস্তক্ষেপের কারণ বিচার ব্যবস্থা গণ-মানুষ মানে পাবলিকের আস্থা পায় নাই। এই অবস্থায় ঐ ব্যক্তিসমাজে “গণপিটুনির ধারণা” ক্রিয়াশীল দেখা যেতে পারে। আমরা এখন আবার একটূ পিছনে ফিরে শুরু করব!

সংগ্রহ বা গেদারিং (gathering) সোসাইটিঃ
আরেকটা গুরুত্বপুর্ণ দিক নিয়েও আমরা নিশ্চিত থাকতে পারি – কী সেটা? আগে উল্লেখ করেছিলাম গেদারিং (gathering)) সোসাইটি। মানে তখন মানুষ বড় জোর গাছের ফলফলারি সংগ্রহ করে খাওয়া ও এ৪ভাবে দুনিয়াতে নিজেকে টিকিয়ে রাখা শিখেছে – ঐ সময়কালের মানুষ। কিন্তু কী করে তা আমরা জানলাম? কারণ গেদারিংয়ের পাশে বা সাথে আরেকটা শব্দ উচ্চারণ করা হয় –  যেমন হান্টিং (hunting) এন্ড গেদারিং সোসাইটি। অর্থাৎ শিকার ও সংগ্রহকারী সমাজ। অর্থাৎ সাথে পশু শিকার -এর কথা বলে হচ্ছে। পশু খাওয়া যায় কীনা এটা মানুষের জানা ও খেতে অভ্যস্ত হয়ে যাওয়ার আগে  অবশ্যই মানুষের কাছে আগুন আবিস্কার হয়ে থাকতেই হবে।  কারণ মানুষের পক্ষে অন্য পশুর মাংস সরাসরি খাওয়া যায় না বলে তা প্রক্রিয়াজাতকরণ বা আগুনে রান্নার কালচারাল অভ্যাস মানুষের রপ্ত বা জানা থাকতে হবে। মানে আগুনে সিদ্ধ বা ভাজা-পোড়া করা না জানলেও অন্তত ঝলসিয়েই কেবল পশু খাওয়া যায় – একাজে আগুন আবিস্কার আগেই জানা হয়ে থাকলে তবেই পশুর মাংস মানুষের খাদ্য হয়েছে। অর্থাৎ আগুনের ব্যবহার জানা আগে; এরপরে পশু মানুষের খাদ্য হতে পারে। সারকথায় তাই হান্টিং এন্ড গেদারিং সোসাইটি মানে হল পরের কৃষিকাজ ভিত্তিক থিতু সমাজের পৌছানোর বহু আগের এবং তা এক অবশ্যই নোমাড ও পশুপালক সমাজ পার হয়ে আসতে হবে। তবে শুধু গেদারিং সোসাইটি  মানে হল এটা যাযাবর জীবনের লক্ষণ; অন্তত আগুন আবিস্কারের আগের মনুষ্য-জীবন সেটা!!

তাই সোজা সিদ্ধান্ত হল, মানুষের কৃষিকাজ ভিত্তিক সমাজে পৌছানো মানে এই থিতু সমাজে পৌছানোর আগে মানুষকে বহুকিছুতে জীবন-অভিজ্ঞতার পর্ব শেষ  করে আসতে হয়েছে। সেগুলো, ফলমুল খাদ্যের কিন্তু নোমাড সমাজ, এরপর হান্টিং শিখা কিন্তু এর আগে আগুনের আবিস্কার জেনে রাখা। এরপর হান্টিং এন্ড গেদারিং সোসাইটিতে বসবাস যেটা তখনও নোমাড। এরপর সবশেষে পশুপালক (pastoral)জীবন। আর পশুর খাদ্য পাওয়া সহজ করতে যেদিকে পশুর খাদ্য ধরণের গাছপালা বেশি পাওয়া সেদিকে ক্রমান্বয়ে নোমাড মানুষের যেতেই থাকতে হবে। তাই এটাও সেই লম্বা নোমাডিক বা যাযাবর জীবন এর সম্ভবত শেষ ভাগ। আর এসবের সমাপ্তি ঘটলে তবে আসতে পারে  মানুষের কোন কৃষিকাজ জীবন। এটা আসলে আরো অনেক কিছু  যেমন, যেমন এখান থেকেই মানুষের গৃহস্থ হওয়ার শুরু। আর সর্বোপরি এটাকেই আমরা মানুষের সভ্যতার শুরুর যুগ বলছি!!

সভ্যতার শুরু মানে মানুষের কৃষিজীবনের শুরুঃ
হান্টিং এন্ড গেদারিং সোসাইটির জীবন এরও বহু পরে কৃষিকাজের জীবনে পৌছানো মানুষের জীবন-ইতিহাসের খুবই গুরুত্বপুর্ণ অধ্যায়। যেমন  মানুষের কৃষিকাজের জীবনে পৌছানো  এর এক নম্বর লক্ষণ হল নোমাড পশুপালক জীবনসহ পিছনের পুরা যাযাবর জীবন পার হয়ে সেসবের ইতি টানা। কিন্তু এটাকে থিতু জীবন বলা হচ্ছে কেন? কারণ, খুব সহজ! সেটা এজন্যই যে এটা আগের যাযাবর জীবনের ইতি অথবা অন্যভাবে বললে কৃষিকাজ মানে তখন থেকে কৃষির জমির সাথে মানুষের জীবনযাপন বসবাসের জীবন আটকে যাওয়া। তখন মানুষ চাইলেও আর পুরানা যাযাবর জীবন যাপনে ছেদ পড়তে বাধ্য। কৃষিকাজ মানে ঐ জমির সাথে মানুষের গাটছাড়া বেধে যাওয়া।  জোবঙ্ঘুরেফিরে ঐ জমিতেই বা আশে[পাশে ফিরে আসতেই হবে এক-মন দশায় আটকে যাওয়া। সব সময় মনে রাখতে পারি মানুষের আগের জীবনের যেকোন স্বভাব তখনই বদলাবে বা বদলিয়ে যেতে পারে যখন আগের চেয়ে সেটা সহজ  ও বেটার জীবনযাপনের উপায় – এই বুদ্ধিশুদ্ধি সে জেনে গেছে এবং সেটা আগের জীবনযাপনের ভিতরেই কিন্তু হঠাৎ করে ঘটনা-দুর্ঘটনায় সে জেনে গেছে মানে তা বেশিরভাগ সময় এক্সিডেন্টালি ঘটে থাকে!

নয়া এক কৃষিকাজের জীবনে আসতে গেলে মানুষের জ্ঞানবুদ্ধিতে একটা বড় উল্লম্ফন ঘটাতে, মানে এক গুণগত পরিবর্তন ঘটাতে হয়েছিল। সেটা হল জ্ঞানবুদ্ধির অনেক পরিশীলিত ব্যবহারের জগতেও প্রবেশ করতে হয়েছিল;  অর্থাৎ  গায়ে-গতরে বলপ্রয়োগের জীবন থেকে বাদ দেয়া অবশ্যই নয়, তবে এবার আর এশুধু গায়ে-গতরে বলপ্রয়োগ করে জীবন কাটানো আর নয়।
যদিও কৃষিকাজ মানে প্রথমত মানুষের নিজ জ্ঞানবুদ্ধিতে আগের জীবনের চেয়ে অনেকানেক বেশি ব্যবহারে অভ্যস্থতা। এতা অবশ্যই জ্ঞানবুদ্ধিতে মানুষের এক নয়া পরিশীলিত অবস্থা। কেন? কারণ এই জীবনের পুর্বশর্ত হল বিপুল পর্যবেক্ষণ ক্ষমতার অধিকারি আগে হতে হবে।  যেমন ছোট-বড় সব গাছগাছালির প্রকৃতি – অর্থাৎ এখন যাকে আমরা উদ্ভিদ বলতে অভ্যস্ত এর জীবন প্রণালী খুবই মনোযোগে পর্যবেক্ষণ করতে হয়েছিল। অর্থাৎ এর আগে পর্যবেক্ষণ কী জিনিষ সেটাই বুঝে ফেলতে হয়েছিল। কোনটা ধান বা গমের বীজ বা কাকে বীজ বলে তা বুঝেসুজে আর কেমন মাটিতে কী করে ফেললে তা থেকে আবার নয়া গাছ হয় ইত্যাদি সেসব “উদ্ভিদ জীবনচক্র” বুঝে ফেলতে হয়েছিল।

আবার এর আগেই আরেক পর্ব অবশ্যই ছিল। যেমন মানুষের শরীর টিকাতে গেলে দু’বৈশিষ্ঠের দুটা খাদ্য লাগবেই। বিজ্ঞানের ভাষায় কার্বোহাইডেট আর প্রোটিন, এছাড়াও সাথে অবশ্যই আরো অনেক কিছু বাড়তি খাবার কথাও ছিল। আর ঠিক উপাদানের উপযুক্ত নাম জানা নয় কোন ধরণের খাদ্যে তা থাকে এটা জানার কথা বলছি।   তাই সম্ভবত সব সভ্যতার মানুষেরা শুরুতেই মানুষই বুঝে ফেলেছিল তার অন্তত একটা কার্বোহাইডেড বা স্টার্চ (starch)এই উপাদানের কোন একটা উতস খাদ্য হিসাবে লাগবেই। কমন ভাষায় যাকে আমরা প্রধান খাদ্য বা স্টেপল ফুড (staple food) বলি। যেমন, চাল, গম, ভুট্টা, বা মাটির নিচে জন্মানো মিস্টি আলু অথবা তেফ (teff, এক ইথিওপিয়ান স্টার্চ যা গমের আটার মত পিষিয়ে নিয়ে তা খাওয়া যায় এমন খাদ্য) ইত্যাদি এসবগুলো বিভিন্ন সভ্যতায় প্রধান খাদ্য কার্বোহাইডেট-এর উৎস। বলাই বাহুল্য এমন গাছ বা খাদ্য কে চিনে নেওয়া ও বেছে নেওয়া এটাই হিউম্যান প্রজাতির এক বড় অগ্র-পদক্ষেপ –  এক বিরাট পর্যবেক্ষণ শক্তির অধিকারি হয়ে উঠা।
যেটার কারণে, আর হান্টিং এন্ড গেদারিং সমাজে অভ্যস্ত পুরানা যাযাবর মনুষ্য-জীবন  আর নয় বা একে বাই বলা সম্ভব হয়েছিল।
তাই আসলে কৃষিকাজ মানে  – এটা মানুষের শুধু বিশাল এক  পর্যবেক্ষণ শক্তি গুণই নয়, আরও বহু বহু কিছুর এক নব অধ্যায়!!

যেমন আগে যে কথা বলছিলাম মানুষের কৃষিকাজের জীবনে প্রবেশ ঘটা – এটা তার জীবনে এক বিরাট নতুন শর্ত তার অজান্তে জুড়ে দিয়েছিল।  যেমন যে কৃষিকাজে অভ্যস্ত সে আর নোমাড থাকা সম্ভব না। আল্লাহর দুনিয়ায় কোন না কোন ভুগোল-ভুমিতে তখন থেকে তাঁকে  থিতু হয়ে গেড়ে বসতেই হবে। কারণ চাষাবাদ একেক দিন একেক জায়গায় করার জিনিষ তো নয়ই  বা একেক বছরে আরেকটা পাড়াতে বা আরেক দেশে গিয়ে করতে বসা তো আর  যাবেই না। কৃষিকাজ মানেই একই জমি একই পদ্ধতি ফলে একই ভুমিতে তা হতেই হবে। অতএব, এই প্রথম যাযাবর স্বভাব ত্যাগ করে, মানুষের থিতু হওয়া অর্থাৎ মানুষ মাত্রই সুনির্দিষ্ট কোন ভুমির মানুষ হতেই হবে – এমন হয়ে যাওয়া শুরু হয়ে যায়। মানুষ মানেই তখন থেকে গোপালগঞ্জের মানুষ কিংবা ছাগলনাইয়ার মানুষ কিংবা মানুষ তখন বাবুনগর গ্রামের বলে “বাবুনগরী” হয়ে যাবে। এমন করেই সে তখন  এশিয়ার বা আফ্রিকার মানুষ হতেই হবে – এমন এই ভুগোলের শর্তযুক্ত হয়ে গিয়েছিল মানুষ।

এখন এই জীবনের সাথে আরেকটা শব্দ উচ্চারণ করব তাতে আমি যা বলতে চাচ্ছি  তা বুঝতে আরেকটু সহজ হয়ে যাবে। শব্দটা হল ডমেস্টিক (domestic) বা গৃহপালিত। শব্দটা আমাদের খুব কম মানুষের কাছেই অপরিচিত। তবু আমি কিছু বিশেষ দিক থেকে শব্দটাকে পরিচিত করাব। যেমন, কী গৃহপালিত নয়? এই প্রশ্ন থেকে তা বুঝা যেতে পারে। সংক্ষেপে জবাব হল যা বন্য [wild] তা আর গৃহপালিত নয়।  আসলে মানুষের কৃষিকাজভিত্তিক ভৌগলিক-ভুমিতে স্থিতির যে  জীবন, যা কিছু এর সাথে সামঞ্জস্যপুর্ণ তাই গৃহপালিত। এটাই হল এর বৃহত্তর সংজ্ঞা! যেমন, গৃহ শব্দটা খেয়াল করেন। যাযাবরের একেবারেই উলটা শব্দ এটা। যেমন সন্ধ্যাবেলায় যে পশু নিজ স্বভাবে ‘বাসায়’ (এখানে শুরও বাসা থাকে) ফিরে না (মানে নিরাপদ জীবনে) সেটা গৃহপালিত নয়। যে তখনও ‘বন্যই’ মানে পুরানা প্রাকৃতিক স্বভাবেই থেকে গেছে।  মানুষের সভ্যতার জীবন বা কৃষিজীবন শুরুর সাথে সাথে  প্রকৃতিতে প্রধান যে বাঁক বদল ঘটে গেছে শব্দ হিসাবে সেটাকেই আমরা বলে গৃহপালিত করে নেওয়া (domestication)। অন্য আরেকটা শব্দ আছে যেটা (tame)বা স্থিতিজীবনের উপযোগী করে নেওয়া। অর্থাৎ দুনিয়াতে মানুষই কেবল একা কোন গৃহে কোন ভুমিতে নিজেকে আবদ্ধ করে নাই। বরং যতটুকু তাঁর প্রভাব ও ক্ষমতা বিস্তৃত সবটাকেই নিজের জীভবনের সাথে বদলে নিয়েছে। কিছু পশু গাছপালা ইত্যাদি সবকিছুকেই সে বদলে পোষ-মানিয়ে মানে নিজের নয়া কৃষিজীবনের উপযোগী করে নিয়েছে। নইলে সেই প্রজাতিকে লোপাট করে দিয়েছে।  যেমন বিছুটি পাতা, যারা গ্রাম-জীবনের সাথে এখনো সম্পর্কে রাখেন তারা চিনবেন; তবে হয়ত ভিন্ন নামে। এই পাতা মানুষের গায়ে লাগলে ঐ জায়গা চিলকায় ফুলে উঠে, লাল হয়ে যায়। আর এর প্রভাব অন্তত আর্ধেক দিন পর্যন্ত থাকে। সাধারণত মাঠে মানুষের  হেঁটেচলার পথের ধারে তা জন্মায়। কিছু সমাজে এই গাছ দেখলে তা উপড়ে ফেলে দেওয়ার রেওয়াজ আছে। কেন?
এরা বলতে যায় এই গাছের “ডমেস্টিক স্বভাব” নাই। মানে এই গাছ tame হয় না। মানুষের থিতুজীবনের সাথে যায় না। তাই এরা যে বনে মানুষ যায় না বা কম যায় কেবল সেখানেই থাকুক। তাই এই গাছে দেখা মাত্র তা উপড়ে ফেলে দেওয়ার সামাজিক অভ্যাস রপ্ত করেছে।

গৃহপালিত শব্দের আসল মানে কীঃ
মজার কথা হল, সভ্যতা কোথায় বসে, কোন ভুমিতে? এই প্রশ্ন যদি করেন তাহলে এর জবাব হল, যেই মাটি ডোমেস্টিক বা যেটা (tame)বা স্থিতিজীবনের উপযোগী করে নেয়া যায়; মানে ‘পোষ মানানো’ বলে যে শব্দটা আছে সেরকম! যেমন যে মাটি সফট নয় পাথুড়ে, নাঙল দিয়েও ভাল নরম করে নেয়া যায় না, একেবারেই পানি ধারণ করে না ইত্যাদি এমন হলে হবে না। গৃহপালিত বা  কৃষিকাজভিত্তিক থিতু জীবনের সাথে সামঞ্জস্যপুর্ণ হতে হবে এককথায় বললে  যেন উদ্ভি্দের  চারা মাটি  ভেদ করে সহজেই উঠার উপযোগী হয় – কারণ এটা এক অন্য ধরণের জীবনযাপন ব্যবস্থা। এটাই সবচেয়ে বড় শর্ত। এটাই গৃহ বা গৃহপালিত শব্দের আসল মানে।

আর সবচেয়ে বড় প্রভাবশালী শর্ত বা ঘটনাটার কথা এখন বলব। মানূষের চাষাবাদ কৃষিকাজ শিখে-জেনে ফেলার তাতপর্য কী?  জবাব হল, আগে প্রকৃতি যেভাবে যে রূপে তার সামনে হাজির হত মানুষ কেবল সেভাবেই ঐ রূপের সাথে নিজেকেই খাপখাইয়ে বদলে নিয়ে তবেই একে ব্যবহার করতে পারত। নিজের ভরণপোষণের উপায় হিসাবে তা কাজে লাগাত। কিন্তু মানুষের কৃষিকাজ-চাষাবাদের জীবন সব বদলে দিয়েছে।

যেমন  কৃষিজীবন শুরুর আগের সেই প্রাকৃতিক ধানগাছটাই এখনও হবে। কিন্তু প্রাকৃতিকভাবে হবে না। মানুষ কেবল মাঝে একটু হাত ঢুকিয়ে দিয়েছে। কথাটা এভাবে বলা যায়  – সেটাই এখনও হবে তবে যেভাবে হলে মানুষের জন্য একটু সুবিধা হয় সেভাবে বা সেদিক একটু ঘুরে হলেও এরপরে আবার আগের প্রক্রিয়া প্রণালিটাই চালু রেখেছে মানুষ। ধরা যাক, কোন কোন মাটিতে প্রাকৃতিকভাবে আগে ধান হয়ত হত না, এখন মানুষ হওয়াইতেছে। এছাড়া যেমন পরিমাণেও কম-বেশি করতেছে। কোন মাটিতে বন্য (মানে আগের প্রাকৃতিকভাবে নির্ধারিত যেমন সেটাই) না গৃহপালিত চাষাবাদ হবে তা মানুষ ঠিক করে দিচ্ছে।

এতে আগের পুরা প্রাকৃতিকভাবে নির্ধারিত উদ্ভিদ-প্রকৃতিটা যা ছিল তা জন্মানো ঠিক বন্ধ করা নয়, তবে আগের মতই কিন্তু একটু মানুষের স্বার্থের দিক-ঘুরে প্রবাহিত এক উদ্ভিদ-প্রকৃতির দুনিয়া হয়ে প্রাকৃতিকতা বজায় রাখছে। এটাকেই আমরা বলতে পারি – গৃহপালিত মানুষের স্বার্থের দিক-ঘুরে প্রবাহিত হচ্ছে – এটাকেই আমরা কৃষিকাজ বলছি মানে, নতুন শর্তযুক্ত করে নেওয়া বলছি।

এখান থেকেই সবচেয়ে বড় তাতপর্যপুর্ণ ঘটনাটা দুনিয়া ঘটে গেছে। কীভাবে?
এতে দুনিয়া আগের মতই দুনিয়াটা থাকবে তবে একটা কিন্তু সহ। আগে প্রকৃতি আমার জন্য প্রাকৃতিক ভাবে বা স্ব স্বভাবে এখন খাদ্য উতপাদন নাও করতে পারত। এই হাত ঢুকানোর কারণে মানুষ তা বন্ধ করে দিয়েছে। প্রকৃতি এখন মানুষের খাদ্য উতপাদন করেই – এমন পরিবর্তনের ভিতর দিয়েই যেন গাছের জীবনচক্র বদলায় – এই শর্ত ঢুকিয়ে দেয়া হয়ে গেছে।

তবে এটা হল, আমরা প্রকৃতিকে একটা সীমার মধ্যে থেকে বদলে নিয়েছি। আগে প্রাকৃতিক ভাবে ঠিক হত সারা দুনিয়ায় ধান উতপাদন আর হবে নাকি প্রকৃতিকভাবেই বন্ধ হয়ে যাবে। আমরা প্রকৃতির মৌলিক স্বভাবের নিয়ম মান্য করে ওর শর্ত-সীমার মধ্যে থেকে ধান উতপাদন চালু থাকা নিশ্চিত করেছি। সারকথায় প্রকৃতিতে আগের মতই বদল ঘটছে তবে এই বদল মানুষের স্বার্থের বাড়ীর পাশ দিয়ে যাচ্ছে – এটাই বাড়তি। তবে এই বাড়তি ততক্ষণ গ্রহণযোগ্য ও সঠিক হবে যদি না এটা প্রকৃতির মৌলিক কোন স্বভাব বা শর্ত-সীমা লঙ্খন না করে।  কতটা বাড়ানো বা বদল হলেও ভারসাম্য ঠিক থাকবে সেটা মেনে চলার মধ্যে থাকা এটাই অন্যভাষায় পরিবেশসম্মত বসবাস। যদিও লোভী মানুষদের খপ্পরে পরে প্রায়শই এই ভারসাম্য ভাঙছে।

কিন্তু সেজন্য সাবধান; প্রকৃতির মৌলিক স্বভাব-ধরণ বুঝতে হবে। আবার খোদ মানুষই তো প্রকৃতির অংশ একথাও ভুলে যাওয়া যাবে না। প্রকৃতির স্বভাব  থেকে মানুষ নিজের মৌলিক স্বভাবও ঠাহর করতে পারে। অতএব খুব সাবধান প্রকৃতির মৌলিক নিয়ম বা স্বভাবে হাত দেয়া যাবে না, ভাঙ্গা যাবে না। না ভেঙ্গে মানে মৌলিক স্বভাবে হাত না দিয়ে যতটা ছোট বা সীমিত শর্তযুক্ত করে বদল ঘটানো যায় মানুষকে ওর মধ্যে ঐ সীমার মধ্যে থাকতেই হবে। যদি মানুষ নিজেরর সীমা না বুঝে ভেঙ্গে ফেলে তবে খোদ প্রকৃতিই ধবংস হয়ে যাবে। অর্থাৎ তাতে প্রকৃতি বা নেচারের উপর নির্ভরশীল মানুষও বিলুপ্ত হয়ে যাবে।
এটাকে আরেক ভাষায় পরিবেশসম্মত বসবাস, এনভায়রণমেন্ট সেনসেটিভ, প্রাণ পরিবেশের জ্ঞানসম্মত বসবাস ইত্যাদি কথাগুলো বলা হচ্ছে।

লেখক রাজনৈতিক বিশ্লেষক
goutamdas1958@hotmail.com

দ্বিতীয় পর্ব পেতে এখানে https://wp.me/p1sCvy-47s

 

[এই লেখাটা এর আগে এক প্রিন্টেড ভার্সান হিসাবে প্রকাশিত হয়েছিল। ছাপা হয়েছিল “ইসলামি শাসনতন্ত্র ছাত্র আন্দোলন” – এই নামের ছাত্র সংগঠনের এক সংকলনে। সেটা ছিল গত ২৪ ডিসেম্বর ২০২১, তাদের কেন্দ্রীয় সম্মেলন উপলক্ষ্যে প্রকাশিত “সভ্যতা ও সংস্কৃতি” এই শিরোনামে এক প্রকাশনায়। সেই প্রিন্টেড সংকলনে এ’লেখার শিরোনাম ছিল  সিন্ধু সভ্যতায়ঃ সভ্যতা মানে কী”।   যদিও দুঃখের বিষয় ঐ প্রিন্টেড সাময়িকীর কোন অনলাইন ভার্সান এখনও তাঁরা বের করে নাই।  হয়ত পরে করবে। তবে সেই পুরানা ছাপা লেখার একটা পিডিএফ কপি এখানে পাওয়া যাবে।  এছাড়া  সেই লেখাটারই আরেক ফাইনাল ভার্সান যেখানে এখন প্রচুর সংযোজন-বিয়োজন ও এডিট করে নয়া ভার্সান হিসাবে এখানে প্রকাশ করা হল। তাতে আগের শিরোনাম যেটা ছিল তা একটু বদল করা হয়েছে।  আর এবার লেখাটা বড় হয়ে যাওয়াতে তা দুই পর্ব করে, এখানে আজ কেবল প্রথম পর্ব প্রকাশ করা হল।  দ্বিতীয় ও শেষ পর্ব আগামি সপ্তাহে প্রকাশিত হবে। ]

Leave a comment