বাংলাদেশে ‘মুসলিম জাতিবাদ’ মানে কী ও কেন


বাংলাদেশে ‘মুসলিম জাতিবাদ’ মানে কী ও কেন
গৌতম দাস
২৪ আগষ্ট ২০২৩
https://wp.me/p1sCvy-4Rc

 

ভারত-বাংলাদেশের মিলে কিছু আওয়ামি সাংবাদিক একটা মিথ্যা প্রপাগান্ডা ছড়িয়েছিল যে বাংলাদেশের আসন্ন নির্বাচন অ্যামেরিকান চাপে ফেয়ার নির্বাচন হতে গেলে হাসিনা বিজয়ী হবে না, আর সেটা ভারত-আমেরিকার জন্য অলাভজনক, ক্ষতিকর স্বার্থের হবে। তাই, মোদি সরকার এনিয়ে  নাকি আমেরিকাকে কূটনীতিক নোট পাঠিয়েছে!!! যার কোন সত্যতা পাওয়া যায় নাই। কিন্তু  এই প্রপাগান্ডার চাপের মধ্যে বক্তব্য দিয়ে গিয়ে এর মধ্যে জড়িয়ে বিএনপির সেক্রেটারী মির্জা ফকরুল ইসলাম আলমগীর আগ বাড়িয়ে বলেছিলেনঃ

আমরা এ কথা খুব স্পষ্ট ভাষায় বলতে চাই, কোনো মৌলবাদী দল
এখানে ক্ষমতায় আসার কোনো সম্ভাবনা নেই। এ দেশের ৫২ বছরের
ইতিহাসে দেখা গেছে, কখনোই কোনো মৌলবাদী দল ক্ষমতায়
আসতে পারেনি। বরং তাদের যে শক্তি, সেই শক্তি ক্ষীয়মাণ হয়ে এসেছে”

সার সংক্ষেপঃ  [সেখান বর্ণনা করা এই মৌলবাদ মানে কী? এর অনুষঙ্গি অর্থ ও সাথে জড়ানো আরো অর্থ নিয়ে আলোচনা বিস্তার ঘটাতে গিয়ে অনুষঙ্গী হিশাবে মুসলিম জাতিবাদ ধারণাটা সেখানে এনেছিলাম। আমার সেই আগের বা পুরানা লেখাটা (এখানে লিঙ্ক) থেকে  মুসলিম জাতিবাদ  ধারণাটা আলাদা করে তুলে এনে তা আলাদা লেখা হিশাবে এখানে ছাপাচ্ছি। কারণ, মুল ধারণাটা প্রথমে অনেক সংক্ষেপিত ছিল। পরবর্তিতে, ওখানে দুদিন পরে ঐলেখার অনেক স্থানে স্থানে নয়া সংযোজনে বহু বিস্তার ঘটিয়েছি। যেটা হয়ত প্রথম দিনের পাঠকেরা পরে আর দেখেন নাই বা খেয়াল করেন নাই। তাই এখন সকলের চোখে পরার জন্য  কেবল “মুসলিম জাতিবাদ” অংশটাই এখানে আলাদা করে উঠিয়ে এনেছি।]


মির্জা ফকরুল এর এই মৌলবাদ বক্তব্য এটা আত্মঘাতি, নিজেকেই নিজে অপমান করা এই বক্তব্য। কেন?

১। মির্জার মৌলবাদি দল টা কে? মির্জার জানা উচিত এই শব্দের উতপত্তি। এই শব্দ কারা ব্যবহার করে আর এখন তা ফকরুল সাহেব ব্যবহার করলে এর ইম্পিকেশন [implication] বা আরো সংশ্লিষ্ট ও সংযুক্তভাবে জড়ানো আরো অর্থ কী দাঁড়াবে তা তাঁর খেয়াল করা উচিত ছিল।
এটা কোল্ড ওয়ার যুগ (১৯৫৩-৯১) এর শেষ আমলের শব্দ। সুনির্দিষ্ট করে  ১৯৭৯ সালে ততকালীন সোভিয়েত ইউনিয়নের আফগানিস্তান দখল করে নিয়েছিল। কারণ, ঐ বছরই খোমেনির ইরানের বিপ্লব সংগঠিত হওয়াতে নিজ সেন্ট্রাল এশিয়া ভুখন্ডও না ঐ বিপ্লবের প্রভাবে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায় এই ছিল সোভিয়েত শাসক ব্রেজনেভের ভয়। তিনি আফগানিস্তানকে দখল নিয়ে বাফার স্টেট [buffer state] বা ‘মাঝের পাহারাদার ভুখন্ড’ করতে চেয়েছিলেন। আর এর থেকে পরবর্তিতে পাকিস্তানকে সামনে রেখে এর মাধ্যমে আমেরিকা ঐ দখল হয়ে থাকা আফগানিস্তানে  সোভিয়েত এর বিরুদ্ধে স্থানীয়দের দিয়ে (মোজাহিদ যার বড় অংশই পাঠান বা পশতুন গোষ্ঠি) সশস্ত্র প্রতিরোধ সৃষ্টি করেছিল। তাই দেশে দেশে সোভিয়েত সমর্থক বিশেষ করে আমাদের মত দেশের কমিউনিস্টেরা এই মোজাহিদ প্রতিরোধকে মুসলমান বলে নিচা দেখাতেই “মৌলবাদ” শব্দ চালু করেছিল; আর তা মূলত পৃষ্টপোষক হিশাবে আমেরিকার বিরুদ্ধে।  এটা তো স্বাভাবিক আফগানিস্তানের মানুষ মানেই মূলত মুসলমান বা ইসলাম অনুসারি। কাজেই দখলদার সোভিয়েত ইউনিয়নের বিরুদ্ধে তাদের যেকোন প্রতিরোধ হলেই সোভিয়েত-প্রীতিতে কমিউনিস্টেরা তাদের আজীবনের ইসলামবিদ্বেষ এর ঝোলা মেলে বের করে সামনে আনবে; মুসলমানদেরকে বা তাদের ধর্মকে এথনিক পরিচয়কে নিচা দেখাবে ইত্যাদি; অথচ এটাই বর্ণবাদিতা। এটা সিম্পল এক গালাগালিতে – “অপর” ধর্মীয় এথনিক গোষ্ঠির বিরুদ্ধে ঘৃনা-বিদ্বেষ ছড়ানোর রেসিজম।   আর এই রেসিজম-মূলক মূল শব্দটাই হল “মৌলবাদ” পরে আমেরিকা সমর্থিত [মূলত উচ্চমাথায় টেকনিক্যাল অস্ত্র স্ট্রিনজার (Stinger missiles) রকেট যা কাঁধে নিয়ে ছুঁড়ে হেলিকপটার ফেলে দেয়া যায়]  মোজাহিদ প্রতিরোধে টিকতে না পেরে ১৯৮৯ সালে সোভিয়েত ইউনিয়ন আফগানিস্তান ত্যাগ করে ফিরে চলে যেতে বাধ্য হয়।  কিন্তু  এক বাক্যে মৌলবাদি বলতে মূলত সেটা ছিল কোল্ড-ওয়ার যুগের আমেরিকার বিরুদ্ধে কমিউনিস্ট বা “প্রগতিবাদী” অভিযোগ, কালি লাগিয়ে দেওয়ার চেষ্টা।

পরবর্তি ঘটনা সংক্ষেপ হল, বাধ্য হয়ে সোভিয়েত ইউনিয়ন ফিরে চলে যাওয়াতে আমেরিকা পরে আফগানিস্তানে আগ্রহ হারায়; ঐ যুদ্ধবিধস্ত দেশ এরপরে যেখানে খুশি যাক মনে করতে শুরু করেছিল। শুধু তাই না এর পরবর্তিতে সেখানে কী হবে সেসব দায় ফেলে আমেরিকাও নিজেকে  গুটিয়ে ফেলেছিল।  এতে মারাত্মক এনার্কিজম আর তাতে আইন-শৃঙ্খলা ভেঙ্গে চরমে যায় শুরু হয় লুটপাট আর তা ঠেকাতেই তালেবান মানে মাদ্রাসার ছাত্রের নিয়ে মোল্লা ওমরের প্রতিরোধ দাঁড়িয়ে যায়।  পরে ওর ভিতরেই পুষ্ট হয়ে গড়ে উঠেছিল আলকায়েদা মুভমেন্ট, যার প্রথম প্রকাশ হতে হতে পরবর্তি শতক এসে যায়, আর সেটাই নাইন-ইলেভেন। লক্ষণীয় যে মৌলবাদ শব্দটা এতে মলিন হয়ে পিছনে পড়ে যায় [নতুন শব্দ আলকায়েদা, আই-এস ইত্যাদি আরো অনেক কিছু এসে যাওয়াতে], আর ব্যবহার কমে গেলেও আমাদের দেশের কমিউনিস্ট-প্রগতিশীলেরা আগের মতই মুসলমানবিদ্বেষ থেকে মৌলবাদ শব্দটা ব্যবহার চালু রাখে। শেষে আমাদের এদিকের যেকোন মুসলমান জনগোষ্ঠির প্রতিরোধ ততপরতাকেই ভারত সরকার আর এদেশের কমিউনিস্ট বা “প্রগতিবাদী” গোষ্ঠি এরা মানে, পিছনের উৎস পদচিহ্ন খুঁজে বের করলে,  জমিদার হিন্দুর সেট করা স্বার্থবোধ ও ভাষ্যকে যারা একালেও নিজ স্বার্থ ও ভাষ্য মনে করে – এরাই মৌলবাদ শব্দটা চালু রেখেছিল। আমাদের দুর্ভাগ্য মির্জা ফকরুল সেই শব্দটাই হাতড়ে খুজে বার করে এনেছেন। ভেবেছেন মৌলবাদী শব্দটা বললে সেই আমেরিকা ও ভারত বিএনপির উপর সদয় ও খুশি হয়ে উঠবে – এটা এক পরিহাস!!!
মির্জা ফকরুল জানেনই না যে তিনি আসলে আমেরিকাকেই গালি দিচ্ছেন। আর চীন ঠেকাতে ঠিকা পাওয়া ভারত, এনিয়ে জোট বন্ধুত্বের সেই ভারত-আমেরিকা আর স্ট্রাটেজিক কমন সম্পর্কে নাই, বা সেই অর্থে বাংলাদেশ নিয়ে স্ট্রাটেজিক বন্ধু বা কমন স্বার্থ নাই। “ওয়ার অন টেরর” বলে ভাষ্য মার্কিন পররাষ্ট্রনীতি থেকে ট্রাম্প আমলেই বাদ গেছে।  

একটা মজার কথা হল, বাংলাদেশে মৌলবাদ বলে গালি দেয়া ব্যাপারটা দুর্বল ও কমে গেলেও ভারতের আর বাংলাদেশের কমিউনিস্ট- প্রগতিবাদি জগতে মৌলবাদ শব্দটা কোন কোন পকেটে এখনও চালু বিশেষ করে (তাদের সমর্থকের একাংশ যারা অতৃপ্ত হিন্দু-মনের এরা এখনও মৌলবাদ বলতে পছন্দ করে সুখ পায়) – অথচ তাদের কাছে মোদির বিজেপি নিয়ে কোন আপত্তি, অস্বস্তি ইত্যাদি কিছুই নাই; মৌলবাদ-বোধ নাই।  অথচ বিজেপির হিন্দুত্ববাদ যা বাংলাদেশে এমনকি ইসকন নামে বিস্তৃত অথচ এদের ততপরতাকে  বাংলাদেশের কমিউনিস্ট- প্রগতিবাদিদের মৌলবাদ-বিরোধি চোখে কোন খারাপ কিছু বা আপত্তির নয়। এটা কোন “হিন্দু মৌলবাদ” ধরণের কিছু নয়, রাজনীতিতে ধর্ম আনা নয়, হিন্দুধর্মের ভিত্তিতে রাষ্ট্র বা রাজনীতির আপত্তিকর ততপরতা নয়। তাদের চোখে হিন্দুত্ববাদ-কে তারা মৌলবাদ মনে করে না !!! ব্যাপারটা ভালো মজার না!

বিএনপি কাদের দল, ভোটার কনষ্টিটুয়েন্সি – মুসলিম জাতিবাদঃ
এক বিপরীত বাংলাদেশের ঘটনা হল, ভোটারের টাইপ মানে ভোটার কনষ্টিটুয়েন্সি হিশাবে যদি বলি সেই বিচারে তবে ” মুসলমান জাতিবাদি” সমর্থক চিন্তা ধারা – এমন ভোটারেরা এক বড় অংশ বিএনপিকেই ভোট দিয়ে থাকে। তবে সাবধান এদের দৃষ্টিভঙ্গির মৌলিক দিকের সাথে নব্বই এর দশকে উত্থিত তালেবান বা পরবর্তিকালের সশস্ত্র যেকোন ইসলামি রেডিকেল ধারা এদের কোনই সম্পর্ক নাই। মিলায় ফেলবেন না।  অন্তত ভোটার গোষ্টির টাইপ বিচারে। কারণ ইসলামি রেডিকেল কোন ধারাই ঠিক কোন ভোটার গোষ্টি নয়, ভোটের রাজনীতিটা তাদের নয়। বৃহত্তর অর্থে বললে,  এই “মুসলমান জাতিবাদি” ক্যাটাগরির ভোটার বাংলাদেশে নুন্যতম ৩৫% ধরা হয়, যার বাকি সমর্থক উঠানামা করা ভোটার।  আবার এমনকি রাজনৈতিক চিন্তা হিশাবে  “মুসলমান জাতিবাদি” চিন্তার কর্মি আওয়ামি লীগের ভিতরেও পাওয়া যাবে।
খোদ হাসিনার কথাই দেখেনঃ
ভাল করে একটু খুঁজলে দেখা যাবে সব সচেতন বাংলাদেশীর ভিতরেই কিছুটা হলেও “মুসলিম জাতিবাদ” আছে। অন্তত মনের কোন কোনায়। কথাটার মানে কী? কী বলতে চাইলাম?  শেখ হাসিনার কথাই ধরা যাক। আমার ধারণা তিনিও এর বাইরে নন! কেন?
তিনি কিভাবে এর বাইরে থাকবেন? খোদ শেখ মুজিব কী এর বাইরে? তিনি তো কলকাতায় পড়ালেখার সময় থেকে তো বটেই এর আগের জমানা থেকেই মুসলিম জাতিবাদী – সেকালে এর প্রকাশের নাম ছিল মুসলিম লীগ!    আর সবচেয়ে বড় কথা খোদ শেখ হাসিনা তাঁর বাবার এই মুসলিম লীগার নেতার পরিচয় একটুও লুকান নাই, মুঝে ফেলেন নাই বা আড়াল করে দেন নাই। গর্বের সাথেই অবলীলায় ছাপতে বলে দিয়েছেন! হাসিনার তত্বাবধানে প্রকাশিত শেখ মুজিবের অসমাপ্ত আত্মজীবনী হাসিনা কোথাও এডিট করে কিছুই একালে বাদ দিতে দেন নাই।  প্রফেসর আনিসুজ্জামান সহ যারা এডিটরিয়াল বোর্ডে ছিলেন তারা সুপারিশ করলেও হাসিনা তাদের কথা শুনেন নাই।  এর চেয়ে বড় প্রমাণ আর কী হতে পারে!! যদিও ১৯০৬ অথবা ১৯৪৭ সালের মুসলিম লীগ আর ১৯৫৪ সালের পর থেকে হয়ে যাওয়া মুসলিম লীগ আর এক থাকে নাই; ১৯৭১ সালে যেটা একেবারেই পুর্ব-পাকিস্তান অথবা বাংলাদেশ-বিরোধিই হয়ে গেছিল – সেসব কথা আলাদা। অন্যভাবে বললে এক. মুসলিম জাতিবাদ  এই কনসেপ্ট-টা সব সময় একই বা একটাই সাংগঠন এর মাধ্যমের প্রকাশিত বা প্রতিনিধিত্ব হয় নাই!  আর দুই. এটা বেশি গুরুত্বপুর্ণ। ভারত এপর্যন্ত যা করেছে – হিন্দুত্ববাদ কে যেমন যতটা তীব্র অথবা সফট মাত্রায় হাজির করেছে বা বাংলাদেশ সম্পর্কে যা নীতি-পলিসি নিয়েছে আর তাতে বাংলাদেশ এরই যে প্রতিক্রিয়া হয়েছে এর  নাম হচ্ছে “মুসলিম জাতিবাদ”; তবে এটা অবশ্যই প্রতীকী নাম!
আর সম্ভবত এজন্য বলা হয়, আমরা নিজেরাই আমাদের শত্রু বা অপছন্দের ব্যক্তিত্বের আকার-বৈশিষ্ট কেমন হবে এরই মূল জন্মদাতা!

আমাদের আদি পাপ  আমাদের বাধাঃ
কনষ্টিটুয়েন্সি
শব্দটার আক্ষরিক অর্থ ভোটার – জনপ্রতিনিধি নির্বাচন করে যারা সেই ভোটার। আবার এর আরেক বাংলা ভাষ্য আছে। যেমন আমরা বলে উনি কোন আসনথেকে দাড়িয়েছেন। কথ্য ভাষার এই আসন শব্দটাই নির্বাচন কমিশনের খাতায় লেখা আছে কনষ্টিটুয়েন্সি বলে।তসিকমিশন বলবে উনি কোন কনষ্টিটুয়েন্সি থেকে দাড়িয়েছেন। মূল বা রূট শব্দ কনষ্টিটুট [constitute] শব্দের অর্থ হল গঠন করা; সেখান থেকে এখানে রাষ্ট্রগঠনসম্পর্কিত আলাপ করছি আমরা। তাই কনষ্টিটুয়েন্সি মানে যারা রাষ্ট্রগঠন করে সেই ভোটার
এবার তাহলে বিএনপি এই দলের ভোটার কনষ্টিটুয়েন্সি কারা? এই প্রশ্নের অর্থ হল সমাজের কোন ধরণের ভোটার বিএনপি-কে ভোট দিয়ে থাকে – এমন কোর [core বাংলায় শাঁস] সমর্থক আমাদের সমাজের কোন গোষ্ঠির মানুষেরা? তাই এই প্রশ্নের জবাব হল, বিএনপি হল কোর কনষ্টিটুয়েন্সি মুসলিম জাতিবাদ।  কোর মানে যাদের ভোট নড়চড় হয় না বিএনপিতেই আসে; আর এদের ছাড়াবা  বাদে বাকি ভোটার হল ফ্লোটিং। যারা যখন পক্ষে কখনও বিপক্ষে ভোট দিয়ে থাকে। 

এখন “প্রগতিশীলতার” প্রভাবে পড়ে মুসলিম জাতিবাদ মানে মুসলিম শব্দটা শুনেই ঝাপিয়ে পড়বেন না বা দুরত্ব তৈরি করবেন না। কেবল খেয়াল করে দেখেন, বৃটিশ ভারতে প্রথম রাজনৈতিক দল কংগ্রেস এটাকে তো হিন্দু জাতিবাদি দলই বানানো হয়েছিল। যার রূট খুঁজলে ১৮১৫ সালের রাম মোহন রায়ে যেতে পারেন। পরবর্তিকালে গান্ধী-নেহেরুরা একাজই করেছে; হিন্দু জাতিবাদকে সাফাই দিয়ে গেছে।  অথচ  হিন্দু জাতিবাদ শব্দটা শুনলে আপনার মনে দুরত্ব তৈরি করার কোন প্রতিক্রিয়া না হলে বুঝবেন আপনি প্রগতিশীল এবং মুসলমানবিদ্বেষী। একথাত বিরুদ্ধে সাফাই হিশাবে আপনার মনে হতে পারে যে আপনি তো আসলে ধর্মীয় জাতিবাদের বিরোধিতা করছেন! কিন্তু না; করছেন না।  করলে তো হিন্দু জাতিবাদ শুনলেও একই দুরত্ব তৈরির প্রতিক্রিয়া হত!! তা তো হয় না। বরং প্রগতিশীলেরা কংগ্রেস দলকে আপন মানে। অনেকটা নিজেরই তবে আপনি তো জাতে উঁচা আর এরা হল আম “পপুলার অংশ”। আর তা মনে করে সাথেই রাখেন, আপন মানেন। অথচ মূল কথাটা হল, আপনি সংখ্যাগরিষ্ট এই যুক্তিতে হিন্দু জাতিবাদ এর দল খুললে এটা অবশ্যই প্রতিক্রিয়ায় একটা মুসলিম জাতিবাদি দলও অবশ্যই তৈরি হবে।  কারণ,  হিন্দু জাতিবাদ দল খুলে আপনি মুসলমান নাগরিকদেরকে একা, বিচ্ছিন্ন করে দিয়েছেন, ঠেলে দিয়েছেন মুসলিম জাতিবাদ করতে। বুঝিয়ে দিয়েছেন তারা আপনার সমান নয় – নিচা, আপনারই অধীনস্ত, পায়ের নিচের লোক!  আর এই হল আমাদের আদি পাপ!!!
এরই সবচেয়ে স্বাভাবিক প্রতিক্রিয়া ১৮৮৫ সালে জন্মানো কংগ্রেসের প্রতিক্রিয়ায় ২০ বছরের মধ্যে ১৯০৬ সালের মুসলিম লীগ!  কারণ, ব্যাপারটা হল, আপনি যদি অপরের এক ধর্মকে নিচা দেখান, গালমন্দ করেন – মনে রাখবেন সব ধর্মের চোখেই অপর সবগুলো ধর্মই মিথ্যা, তাদের ritual-রিচুয়াল  (শরীয়তি আচার নিয়মগুলো) অর্থহীন – কোন মানে হয় না – বুজরুকি ভন্ড ইত্যাদি মনে হতেই পারে। আসলে আপনি আপনার ধর্মের রিচুয়ালের সাথে মনে মনে তুলনা করছেন আপনারটাই  সবচেয়ে সহি  এই বিবেচনায়!  কিন্তু পরক্ষণেই আপনার বিবেকবান হওয়ার কথা।  সে কারণে, বুদ্ধিমান লোকেদের বুঝ এখানেই থামবে না। কারণ, সে সাথে সাথে বুঝে যায় যে তাহলে তো অপর ধর্মের লোকেরাও আমার ধর্মকেও একই নিচা বা ‘মানে হয় না’ এমন আরেক  নিচা ধর্ম ও রিচুয়ালের লোক হিশাবে দেখছে!!!  সেটাও তো আপনার কাম্য হতে পারে না! তাহলে  এথেকে মুক্তি বের হবার পথ কী? 

খুবই সহজ।  পথটা হল যে, কারোরই অপরের ধর্ম-রিচুয়াল-কে নিচা দেখানো উচিত না।  নিজের ধর্ম  সেফ রাখা বা বাঁচানোর জন্য।  তাহলেই সকল ধর্ম অপমান, নিচা দেখানো ইত্যাদির হাত থেকে বাঁচতে পারে। এজন্যই সকলের চোখে নিজ নিজ ধর্ম শ্রেষ্ঠ এই বোধ থাকলেও কোন বুদ্ধিমান মানুষ নিজ ধর্মের শ্রেষ্ঠত্ববোধ অন্যকে মানতে বাধ্য করে না, চাপায় দিতে যায় না অথবা মানতে হবে বলে দাঙ্গা বাধায় দিতে যায় না। এটা সে করতে পারে না। একমাত্র এমন হলেই সকল ধর্মই আপন আপন জগতে শ্রেষ্ঠ থাকতে পারে। কোন সমাজে এমন বোধ বেশিরভাগ মানুষের ভিতর এলে তবেই একটা রাষ্ট্রগঠন সম্ভব। যে রাষ্ট্রকে অবশ্যই  সবার  ইচ্ছামত নিজ ধর্ম পালনের স্বাধীনতা  নিশ্চিত করতে হবে – নাগরিক অধিকারের বিচারে নাগরিক মাত্রই সকলের অধিকার সমান; কোন বৈষম্য করা যাবে না – এই নীতিতে  তা গড়ে তুলতে হবে।  কিন্তু মনে রাখতে হবে আদি পাপ  আমাদের বাধা দিয়ে রেখেছে; যেটা সবার আগে পাশ কাটাতে হবে!!    

আমাদের মূল আলোচ্য প্রসঙ্গে ফিরছিঃ
ভোটার কনষ্টিটুয়েন্সির বিচারে বিএনপি এই দলের কোর সমর্থক ভোটার বেজ হল  “মুসলমান জাতিবাদি” ভোটার। বিপরীতে আওয়ামি লীগেরও বাঙালি জাতিবাদি কোর ভোটার ঐ ৩৩% এর আশেপাশে তবে এসবই ২০০৯ সালের আগের হিসাব ও অনুমান।  ভোটার হিশাবে সমর্থদের  এই মৌলিক ভিত্তিগত ফারাকের কারণেই আওয়ামি লীগ কখনও বিএনপি হতে পারে না, পারবে না; বিপরীতে বিএনপিও লীগ হতে পারবে না।  তাহলে, মির্জা আলমগীরের এই আল-টপকা মৌলবাদ শব্দের ব্যবহার এর মানে কী? নিজের পায়ে কুড়াল  মারা? হা ঠিক তাই! মানে সিপিবির কোন নেতার যেন বিএনপির সেক্রেটারি হয়ে যাবার দশা??? এমন আনফিট এক দশা-পরিস্থিতি! আচ্ছা, তাই  বিএনপি ভোটের রাজনীতিতে যে  “মুসলমান জাতিবাদি” ভোটারদের দল, সে  কি করে কথিত “মৌলবাদবিরোধি” হয়! কারণ ভারতের চোখে আর কমিউনিস্ট-প্রগতিশীলদের চোখে খোদ বিএনপি তো মৌলবাদি দল!!!  আর আমরা ভারতের অযাচিত প্রভাব বিরোধী ফলে প্রতিরোধী যেকেউই তো আসলে ভারতের চোখে মৌলবাদী ট্যাগপ্রাপ্ত!! মানে   মূলত মুসলিম জাতিবাদী ভোটারের দল বিএনপি কিভাবে  নিজ সমর্থক ভোটারের বিরুদ্ধে যাবে? চাইলেও কী যেতে পারবে? [ তবে বছর দুয়েক সময় পেলে পারবে হয়ত কিন্তু তাতে চিত্রটা দাঁড়াবে এভাবে যে “মুসলমান জাতিবাদি” ভোটার ভিত্তিক আরেকটা নয়া দল গড়ে উঠেছে। ফলে আজকের বিএনপি পরিণত হয়ে উঠতে পারে এক কথিত মৌলবাদিবিরোধী বিরুদ্ধে নয়া এক প্রগতিবাদি বিএনপি হতে চেষ্টা করতে পারে; যেটা হবে আসলে ভারতের পছন্দের এক আওয়ামি বি-টিম যার কোর সমর্থক হতে পারে বড়জোর ১০%।

মুসলিম জাতিবাদ আসলে কী কেন তা টিকে থাকতে থাকবেঃ
একালের এর পিছনের মূল কারণ গত পনেরো বছরের হাসিনা শাসনের আড়ালে ভারতের লুটপাট  – বিনাপয়সার করিডোর থেকে শুরু করে ভারতের বাংলাদেশ থেকে যা তাদের নেয়া দরকার সবই তারা নিয়ে যাচ্ছে। খোদ হাসিনার ভাষাতেই বললে তিনি আমাদের  জানিয়েছেন, “ভারতকে যা দিয়েছি ওরা আজীবন মনে রাখবে”। তাই এখনকার বাংলাদেশ হল, ভারতবিরোধিতা এক টইটম্বুর – চরমে উঠা বাংলাদেশ – মনে রাখতে হবে এটা খোদ ভারতেরই সৃষ্টি – ভারতের এই লুটপাট সব কাজে ভারতের স্বার্থ এর প্রায়োরিটি – এসবই করে চলেছে গত ১৫ বছর ধরে। সবচেয়ে বড় কথা রাষ্ট্রের শাসনের বিরুদ্ধে আপত্তি জানানোর সুযোগ বন্ধ! যার সোজা অর্থ ভারতের এই হিন্দুত্ববাদি চোখ বাংলাদেশের নিজ স্বার্থকে ভারতের পায়ের নিচে নেওয়ার বিরুদ্ধে নিরব জন-প্রতিরোধ বা রেজিসট্যান্স [resistance]   – এর প্রতীকী নামই মুসলিম জাতিবাদ। এটাই একালের মানে! অতএব ভারতের হিন্দুত্ববাদি ‘বাংলাদেশ নীতি’ এরই ডেকে আনা বিপরীতের নাম  “মুসলমান জাতিবাদি” প্রতিরোধ; তাই এই পরিচয় নিয়েই তাদেরকে আরো থাকতে হবে। তাতে বিএনপি তাদের প্রতিনিধিত্ব করবে বা যোগ্য থাকবে কিনা সেটা বিএনপি-কেই নির্ধারণ করতে হবে। ভোটার গোষ্ঠি অবস্থাকেই পুষ্ট করার জন্য নয়া কোন দল হাজির হওয়া বা আগিয়ে আসা – এসব সেক্ষেত্রে কোন অসম্ভব বা দুরের কিছু না।

আপডেটেডঃ
সর্বশেষ আপডেটেডঃ  

>
গৌতম দাস
রাজনৈতিক বিশ্লেষক
goutamdas1958@hotmail.com

 

 

Leave a comment