প্রগতিশীলতা কোনভাবেই আধুনিকতা নয়


প্রগতিশীলতা কোনভাবেই আধুনিকতা নয়
গৌতম দাস
২১ সেপ্টেম্বর ২০২৩  সন্ধ্যা ০৭ঃ ৩১
https://wp.me/p1sCvy-51v

 

 

 

                     PROGRESSIVE LOGO

শুধু প্রগতি [progress] শব্দটার একটা অর্থ অগ্রগতি। মানে, কোন একটা কিছু আগাচ্ছে কিনা, ভাল হচ্ছে কিনা, উন্নত হচ্ছে কিনা, ইতিবাচক রূপান্তর হচ্ছে কিনা ইত্যাদি এমন অর্থে।  এছাড়া শব্দটা মানুষের উপর প্রয়োগ-ব্যবহার করতে চাইলে মানে মানুষের গুণ-বৈশিষ্ট হিশাবে ব্যবহার করতে চাইলে রুট শব্দটা একটু বদলে লিখি প্রগতিশীল [progressive]।  এর একটা সাধারণ অর্থ হতে দেখা যায় যে যিনি সংস্কার চান মানে, রক্ষণশীল [conservative] নন বা পুরানাকে আঁকড়ে ধরে রাখতে চান না, এমন অর্থে। তবুও আমরা যে প্রগতিশীলতা খুঁজছি এগুলো তা না।   কারণ, আমরা এখানে খুঁজছি রাজনীতির মাঠে বা পাড়ায় প্রগতিশীল বা প্রগ্রেসিভ চিন্তা বা দল বলতে ঠিক কী বুঝায় তা বুঝতে।
সবার আগে জানিয়ে রাখি প্রগতিশীল শব্দটা আবার একেক ভৌগলিক ইতিহাস ভেদে অর্থের ভিন্নতাও আছে। আমাদের অনুসন্ধান ভারতীয় উপমহাদেশ বা অখন্ড বিবেচনায় ভারতের ভুগোলে মধ্যে সীমাবদ্ধ থেকে আলোচনা।  এর বাইরে বৃটিশ কালচারে একালের আলোচনায় রক্ষণশীলেরাও প্রগতিশীল হতে পারে বলে দাবি করা হয়েছে। যেমন, বিবিসির তবে (ইংরাজি বিবিসি) এর এক রচনার শিরোনাম হল, So, what exactly is ‘progressive’ in politics? এরকম! আর সেখানে …while the Lib Dem/Conservative coalition were “new progressives”. এমন বাক্যও পাওয়া যাবে। [এখানে Lib বলতে Liberal এর সংক্ষিপ্ত রূপ আর Dem বলতে Democrat বুঝতে হবে ]। স্বভাবতই এগুলো ব্যতিক্রম বা সুনির্দিষ্ট পরিস্থিতিতে প্রকাশিত অর্থ, এভাবে বুঝতে হবে। তবে আমরা এত জটিলতায় না গিয়ে প্রগতিশীল এর অর্থ আমাদের অঞ্চল মানে বৃটিশ-ভারতে সীমাবদ্ধ থেকে কথা বলব। আবার আমেরিকান প্রগেসিভ বলেও ধারণা আছে। এতসব দিকে আমরা এখন যাব না।

প্রগতিশীলতা কোনভাবেই আধুনিকতা নয়ঃ
এর আগের লেখায় যেকথা দিয়ে শুরু করেছিলাম যে  – আজকাল অনেকে “ভোটাধিকার”, “মতপ্রকাশের অধিকার” বা “মতপ্রকাশের স্বাধীনতা” নিয়ে বক্তৃতা হচ্ছে, করছেন। এটা কীসের ফেনোমেনা??
সরাসরি বললে এটা “প্রগতিশীলতা”। যা ঠিক আধুনিক বা রিপাবলিক রাষ্ট্রের আলাপ নয়। কিন্তু এখন কেন?
অনুমান করা ধারণাটা হল, প্রথমত প্রগতিশীলেরা হল আওয়ামী লীগ বা হাসিনার ক্ষমতার, গত ১৫ বছরের ক্ষমতার পক্ষে মূল সাফাইদাতা। ক্ষমতা মানে অবশ্যই ফিজিক্যাল বলপ্রয়োগর সক্ষমতা। এমন সক্ষমতায় যে ক্ষমতায় আসীন। কিন্তু এর বাইরে আরেকটা ক্ষমতাও দরকার, যেটা আবার ঠিক ফিজিক্যাল বলপ্রয়োগ নয়।  সেটা হল ক্ষমতায় যে আছে তার ক্ষমতাটা জায়েজ বা জাস্টিফায়েড [justified] তা দাবি করা, সাফাই দেয়া; ফলে এটা ন্যায্য এমন কথা বলা – এটাকে আমরা সাফাই ক্ষমতা বলতে পারি। সাফাই ক্ষমতা মানে ক্ষমতাসীনের পক্ষে শক্ত সাফাই-ও থাকতেই হবে।  এমন শক্ত সাফাই কথাও ক্ষমতাসীনের জন্য খুবই দরকারি। বলপ্রয়োগের সক্ষমতার মতই সমান দরকারি।  ইতিহাসে বহুবার এমন হয়েছে যে কেউ ক্ষমতা ঠিকই পেয়েছিল কিন্তু ক্ষমতায় থাকতেই পারে নাই, রাখতে পারে নাই। কারণ এই ক্ষমতাটা যে ন্যায্য বা একটা ইনসাফের ক্ষমতা এমন কোন সাফাই সে তৈরি করে নেয় নাই বা তুলে ধরে দেখাতে পদক্ষেপ নেয় নাই। হয়তবা খেয়ালই করে নাই। তাই ক্ষমতাচ্যুত হয়েছে। অতএব যেকোন বলপ্রয়োগের সক্ষমতার সাথে সাথে একটা সাফাই ক্ষমতা পাশাপাশি থাকাও সমান জরুরি বিষয়। হাসিনার গত ১৫ বছরের ক্ষমতাটাকে সমাজের যারা সাফাই ক্ষমতা-ও হয়ে তা সরবরাহ করে টিকিয়ে রেখেছে এরাই প্রগতিশীল, রাজনৈতিক পরিচয় প্রগতিশীলতা
তবে এখানে সেসব কথা তোলা তাদেরকে অভিযুক্ত করা যতটা না এর চেয়ে অনেক বেশি সামাজিক অনুভবে [social realization] তা নিয়ে আনার জন্য এবং তা অবশ্যই খুবই ইতিবাচকভাবেও হতে হবে।

কিন্তু এতে প্রগতিশীলেরাই জায়গা পেয়েছিল কেন?
কারণ সেটা ওয়ার অন টেররের আমল, হাসিনার ম্যান্ডেটে ছিল তাদের ‘টেররিজম’ সামলানো। হাসিনা্র ক্ষমতা তাই এর একটা আজীব বাংলাদেশি ভার্সান বের করে নিয়েছিল। সেটা হল ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের কথা তুলে এর আড়াল নিয়ে এই ক্ষমতাটা যেন এই বুড়াকালেও বসে যুদ্ধাপরাধের বিচার ও বিরোধিতা করছে – এই ঝুটা ভাব ও সাফাইয়ের আড়ালে কাজটা করতে চেয়েছিল। এতে আরাম হবে আর এছাড়া এই স্টাইলটা ইউনিক হবে;  কারণ এতে প্রতিদ্বন্দ্বি বিএনপির চেয়ে হাসিনার লীগকে আমেরিকার কাছে আগিয়ে রাখবে – এমন ইচ্ছা-অনুমানও ছিল। তবে একটা জিনিষ পরিস্কার ছিল যে  এই আড়ালে বসে এই ক্ষমতাটা সাধারণভাবে ইসলাম কোপাবে। আর সেটা করবে “জঙ্গীবাদ দমনের” নামে।  বলা বাহুল্য এটাকে  “ওয়ার অন টেররের কাজ” মনে করে আমেরিকা এতে সমর্থন দিবে বা বাধ্য হবে সে অনুমানও ছিল। তবে পরিণতিতে এখন যেটা পরিস্কার যে এতে একটা দানব ক্ষমতা হিশাবে হাসিনার উত্থান হয়েছে। যাকে অনেকে ফ্যাসিজম-সহ অনেক নামেও ডাকছেন। কিন্তু এটা আসলে এক একচেটিয়া জবাবদিহিতা-হীন ভয়ঙ্কর ক্ষমতা।  তাই হাসিনা প্রথম থেকেই দানব ক্ষমতা হয়ে উঠার পর থেকেই সে এরপর থেকে আরেক ভুমিকাতেও হাজির হয়ে আছে। তা হল তাঁর এমন ক্ষমতার যত রাজনৈতিক বিরোধী বা প্রতিদ্বন্দ্বি আছে, তারা ইসলাম সম্পর্কিত হোক বা হা হোক, তারাও জঙ্গি এই অজুহাত তুলে তাদের উপরেও গুম, খুন অপহরণ ইত্যাদি অবাধে করে গেছেন হাসিনা। যাতে নিজ ক্ষমতা নিষ্কন্টক বা কাঁটাহীন ভাবে পাওয়া যায়!!!
আর ওদিকে এতে প্রগতিবাদের ভুমিকাটা হল,  যেহেতু এটা  “জঙ্গীবাদ দমনের” নামে  সাধারণভাবে ধর্ম কিন্তু আসলে কেবল ইসলাম কোপানো – তাই এর পক্ষে সবচেয়ে ভাল সাফাইদাতা হিশাবে কমিউনিস্ট-প্রগতিশীলদেরকেই  একাজে হাসিনা তাদের বেছে নিয়েছিল। এককথায় বললে, কাজটা হাসিনা করেছিলেন তাদের নানা ধরণের ফেবার করে – অর্থ, সুযোগ সুবিধা, গুরুত্ব ও সামাজিক ক্ষমতা ও প্রভাব দিয়ে। এদের ততপরতার প্রতীক বলা যায় “শাহবাগ আন্দোলন” বা যা থেকে এরা “শাহবাগী” এই ধারণা সমাজে আছে। যদিও শুরুতে এরা হাসিনার পোষ মানতে অস্বীকার করেছিল; কিন্তু তাদেরকে নিরাপত্তাহীনতা শঙ্কা বা খুন হয়ে যাবার ভয় দেখিয়ে ক্রমশ নিজ ক্ষমতার নিয়ন্ত্রণে নিয়ে এনেছিল।

আমাদের এদিকের প্রগতিশীলতার প্রধান বৈশিষ্ট হল এরা ইসলাম কোপাতে সিদ্ধহস্ত; যদিও মুখে বলে তারা যেকোন ধর্মবিরোধী। যেটার কার্যকর রূপটা হল এরা চরম ইসলামবিদ্বেষী ও ঘৃণা ছড়ানি; যেটা কে একটা রেসিজমের পর্যায়ে তারা নিয়ে গেছে, সে খবর রাখেনি। তবে এই প্ররগতিশীলতার মূল উৎস কী – মানে কী গ্তারাউন্ড ওয়ার্ক ছিল যেকারণে এরা এমন প্রগতিশীল বলে সহজে হাজর হতে পেরেছিল তা খুঁজলে,  ১৭৯৩ সালের জমিদারি আইন বা এক নয়া ‘ভুমি মালিকানা ব্যবস্থা’ চালুর পরে যেটা মোটামুটি ১৮০০ সালের পর থেকেই ক্রমশ এই জমিদার-হিন্দু শ্রেণীর গড়ে উঠেছিল এরাই বৃটিশ সরকারের অধীনস্ত থেকেও লোকাল অর্থে  সামাজিক-অর্থনৈতিক-কালচারাল দিকনির্দেশনার প্রধান নির্ণায়ক ক্ষমতা হয়ে উঠেছিল। মূলত এই জমিদার-হিন্দুর কালচারাল আধিপত্য ও নির্দেশনা, মানে তাদের হুকুম চর্চার প্রতীক হয়ে উঠেছিল সাম্প্রদায়িকতা বলে এক ধারণা।   প্রথম কথা হল, জমিদার শাসনে মুসলমানেরা হিন্দুদের ( উভয়েই প্রজা হলেও) সমান না – এই হল জমিদার শাসনের প্রথম ভিত্তি। সমান না কারণ, মুসলমানেরা নাকি বাঙালি নয় – এই ফতোয়া। যে এখনো কলকাতার সবচেয়ে ডমিনেটিং প্রায় একছত্র বয়ান; আর সেটার খাতক বিজেপির তো বটেই তবে শুধু বিজেপি নয়, অনেক তৃণমুল সমর্থক বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ের শিক্ষকও এমন বয়ানের আজও অনুসারী।  এমনকি সরকারী স্কুলের শিক্ষক কিন্তু মুসলমান শিক্ষক বলে সে কলকাতায় হোটেলে থাকতে পারে নাই – এমন পত্রিকা রিপোর্টো আছে।  তবে মুসলমানেরা নাকি বাঙালি নয় এই বৈষম্যপুর্ণ অবস্থান এটাই ছিল জমিদার হিন্দুর মূল সাফাই।  তাহলে সাম্প্রদায়িকতা এই সাইনবোর্ডের তলে কী আছে? এটা বুঝাতে চায় যে  মুসলমাত্রই সে সামাজিক অবস্থানের বিচারে যেকোন হিন্দূর নিচে, সবচেয়ে নিচাজাতের হিন্দুরও নিচে। এখন এদের তো পাতে তোলা যায় না -অপাংক্তেয় করে রাখলেও তাদের বিপদ হবে ভেবে জমিদার-হিন্দুরা নয়া কিছু শর্ত তৈরি করেছিল – এটারই সাইনবোর্ড শব্দ হল অ-সাম্প্রদায়িকতা! মানে মুসলমানদেরকে অ-সাম্প্রদায়িক হতে হবে এই হল সেই শর্ত।।  তাদেরকেও স্কুল-কলেজে শিক্ষা বা চাকরি ইত্যাদি সামাজিক সুবিধা দেয়া যেতে পারে, হিন্দুদের পাশে বসতে, একই ঘরের ভিতর বসে চাকরি করতে দেয়া যেতে পারে যে শর্ত সেটাই কথিত অ-সাম্প্রদায়িকতা। তবে দেশভাগের পরে ব্যাপারটাতে লজ্জায় পরে প্রগতিশীলেরা এর অর্থ কিছুটা এক্সটেন্ড করে নেয় যে হিন্দু-মুসলমানের ভিন্নতা অসমান এরা এনিয়ে যে কথা বলে সেই সাম্প্রদায়িক। যেটা কার্যত বাংলাদেশের উপরেই প্রযোজ্য হয়েছে, কলকাতায় যার কোন আছর বা ইম্প্যাক্ট নাই। এককথায় কালচারাল দিক থেকে মুসলমানদেরকে হিন্দুদের সামাজিক সব অভ্যাস-রীতি রেওয়াজের ভিতরেই মুসলমানদেরকে থাকতে হবে। এই হল অসাম্প্রদায়িকতা যার সার কথা দাড়িয়েছে এখন জমিদারি থাক না থাক, জমিদার-হিন্দুর বয়ান ও দাবি যে তাদের আধিপত্যের মধ্যে মুসলমানদের থাকতে হবে।  কোন মুসলমানি চিহ্ন প্রদর্শন করা যাবে না। একটু ভেঙ্গে বললে দুটা ধর্মীয় অভ্যাস পাশাপাশি পারস্পরিক শ্রদ্ধার সাথে থাকলেও তারা একে অপরকে প্রভাবিত করবে কিন্তু তা ন্যাচারালি ন্যাচারাল – এটা হতেই পারে। কিন্তু এটা তা নয়। এটা একের উপরে অন্যের ঘোষিত আধিপত্য যে, মুসলমান (তুমি বাঙালি না) তুমি আমার (আমি হিন্দু) সমান নও, অধস্তন। এই চরমতম বৈষম্যের সমাজ ও এর চর্চার ভিতর দিয়েই জমিদার হিন্দুর আধিপত্য ও শাসন চলেছিল, অন্তত একেবারে ১৯৪৭ সালের ভারত ভাগ ও পাকিস্তান কায়েমের আগে পর্যন্ত। এরপরে ১৯৫১ সাল থেকে জমিদারী ব্যবস্থা উচ্ছেদ হয়ে গেলে।

কিন্তু তবু এরা হেরেও হারতে চায় নাঃ
কিন্তু তবু জমিদার হিন্দুর কালচারাল বয়ান এটা হেরেও হার স্বীকার করতে চায় না। সে ভোল বদলায়, সে কমিউনিস্ট হয়ে যায়, দলে যোগ দিয়েছিল। কেন?
কারণ, ততদিনে জমিদা্ররি হারানোর পরে জমিদার-হিন্দুর কালচারাল ধারা জেনে যায় টের পায় যে  ১৯১৭ সালে দুনিয়ায় প্রতিষ্ঠিত প্রথম কমিউনিস্ট, রাশিয়া (পরে ১৯২২ সাল থেকে সোভিয়েত ইউনিয়ন) এরা ধর্ম [অর্থডক্স ক্রিশ্চানিটি] কোপায় ক্ষমতায় এসেছিল। ফলে এই কমিউনিস্ট রাজনীতি তাদের খুব পছন্দ হয়ে যায়। তাই কমিউনিস্ট ভেক ধরলে সে এর আড়ালে বসে ইসলাম কোপাতে পারবে। তাতে যতটুকু হারানো আধিপত্য ফেরত আসে।
এখানে খুব মনোযোগ দিয়ে দেখতে হবে – না ১৮০০ সালের পরে উত্থিত জমিদার হিন্দু শ্রেণী অথবা না ১৯১৭ সালের কমিউনিজম – এরা কেউই রাজনৈতিক অধিকারে, সামাজিক মর্যাদায় সবাই সমান – এই রাজনীতির খাতক বা গ্রাহক তারা নয়।  স্পষ্ট বললে, নাগরিক মাত্রই সবাই সমান – সমান অধিকারের এমন চিন্তা এদুই রাজনৈতিক শক্তির কাছে এটা তাদের কোন এজেন্ডাই নয়। এরা বেখবর  শুধু না, এরা খাতক নয়, এটাই হওয়া উচিত মনে করে। এককথায় বৈষম্যহীন কোন রাজনৈতিক সমাজ ও শাসন ব্যবস্থা তাদের কাম্যই না।

কিন্তু আমরা দেখি, জমিদার হিন্দুর কালচারাল বয়ান আকড়ে যারা ১৯৪৭ সালের পরের সমাজে নতুন করে কমিউনিস্ট পার্টির নামে সংগঠিত হয়েছিল – এদের প্রথম সংগঠন কমিউনিস্ট পার্টি হলেও, ১৯৫১ সালে প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলী খানের আমলেই সেই কমিউনিস্ট দল নিষিদ্ধ হয়ে যায়। কারণ, তারা অবিভক্ত পাকিস্তানে সর্বপ্রথম এক সামরিক ক্যু – এভাবে ক্ষমতা দখল করতে গিয়ে ব্যার্থ হয়েছিল। যদিও এই ততপরতার কেন্দ্রটা ছিল পশ্চিম পাকিস্তানে পুবে নয় আর তা ছিল মূলত সেকালের কাশ্মীর রক্ষা করতে  যাওয়া পাকিস্তানের সামরিক অংশ।  তাই তারা আবার দল পাল্টায়। তখন এরা এর আগেই ১৯৪৯ সালে গঠিত হওয়া আওয়ামী লীগে তবে ১৯৫১ সালের পর থেকে তাতে যোগ  দেয়া শুরু করেছিল। এরাই তখন থেকে কমিউনিজমের একটা সফট ভার্সান এবং শিথিল ও বৃহত্তর রূপ হিশাবে যে নয়া শব্দ ও ধারণাটা চালু করেছিল, মোটাদাগে সেটাই হল প্রগতিবাদ বা প্রগ্রেসিভ চিন্তা।
পরে ১৯৫৭ সালের প্রধানমন্ত্রী সোহরওয়ার্দির (সংক্ষিপ্ত এক বছরের শাসন আমলে) কমিউনিস্টেরা আওয়ামি লীগ ছেড়ে এবার (আওয়ামি লীগের সভাপতি) ভাসানীর নেতৃত্বে আলাদা দল করে ভাগ হয়ে যায় যেখানে নয়া দল হয় – ন্যাশনাল আওয়ামি পার্টি এটাই সংক্ষেপে ন্যাপ [NAP]।  আরো পরে কমিউনিস্টেরা মস্কো-পিকিংয়ে ভাগ হয়ে গেলে ১৯৬৪ সালে (পুর্ব-পাকিস্তান) বাংলাদেশের মস্কো সমর্থিত অংশটার নাম হল ন্যাপ (মোজাফফর); পিকিং সমর্থিত অংশটা ভাসা্নী ন্যাপ।

কমিউনিজম ও প্রগতিবাদঃ
উপরে বলেছি,কমিউনিজমের একটা সফট ভার্সান এবং শিথিল ও বৃহত্তর রূপ হিশাবে নয়া শব্দ ও ধারণাটা হল প্রগতিবাদ বা প্রগ্রেসিভ চিন্তা।  এছাড়া আরেকটা দরকারি দিক ছিল।  শুরুতেই বলেছি, কমিউনিজমের সাথে মর্ডানিজম বা আধুনিকতার কোন সম্পর্কও নাই। কার্ল মার্কস আধুনিকতা নিয়ে দু’লাইনও লিখেন নাই। এবং আধুনিক বা রিপাবলিক রাষ্ট্র সম্পর্কেও। বরং আমরা মনে রাখতে পারি,  মার্কসের কাছে রাষ্ট্র হল শ্রেণীর রাষ্ট্র।  যার সোজাসাপ্টা মানে হল, একটা আধুনিক রাষ্ট্রে সবাই নাগরিক, বৈষম্যহীন সমান নাগরিক, সমান অধিকারের নাগরিক এসব কথা তিনি আমল করেন নাই।  তাই মার্কসের চিন্তায় নাগরিক, অধিকার, স্বাধীনতা বা রাজনৈতিক অধিকারে বৈষম্যহীনতা -ইত্যাদি কোন ধারণাই নাই। তাই কমিউনিস্ট চিন্তায় এমনকি রাষ্ট্রগঠন, কনষ্টিটিউশন, কনষ্টিটুয়েন্ট, জনপ্রতিনিধি ইত্যাদি কোন ধারনার বালাই নাই; দরকার হয় নাই। আছে কেবল, ক্ষমতাসীন “শ্রমিক শ্রেণী” – আর এর এক পার্টি ধারণা যা দিয়ে পার্টি যাকেই বুর্জোয়া আখ্যা দিবে তাকে (আর কোন বিচার-আদালত লাগবে না) গুম, খুন, অপহরণ বা কোন ‘আয়নাঘরে’ বন্দি করে রাখা, গায়েব (disappeared) করে দেয়া, পেট কেটে নদীতে ভাসিয়ে দেয়া ইত্যাদি সব জায়েজ।
তবে এতে আরেক সমস্যায় পড়েছিল তারা মানে, ব্যবহারিক কমিউনিস্টেরা (মানে এটা মার্কস নয় এমনকি ঠিক লেনিনও নয় ব্যবহারিক কমিউনিস্ট মুখ্য নেতা হলেন স্তালিন) তাই দুনিয়াতে ছেয়ে থাকা মর্ডান রিপাবলিক রাষ্ট্রের উপস্থিতি ও ততপরতার সাথে নিজেদের খাপ খাওয়াতে, বিশেষ করে আমাদের মত দেশে,  মূল কমিউনিস্ট পার্টি কে সাথে নিয়ে তো  সমাজে হাজির হওয়া মুশকিল ফলে কাজে আসবে না। এছাড়া কমিউনিস্ট হলে নাকি সাধারণ মানুষের সব সম্পত্তি কেড়ে নিয়ে যাবে এধারণাও যথেষ্ট প্রবল ফলে ভীতিকর ছিল। সব মিলিয়ে এসব ক্ষেত্রে তাই (কমিউনিজমের লিবারেল ভার্সান) নরম করে বলা বা হাজির হওয়া – এটাই প্রগ্রেসিভ পার্টি ও প্রগতিবাদ খুব কাজ দিবে এখানে মনে করা হয়েছিল। মোটাদাগে এসব থেকেই প্রগতিবাদের উত্থান। এই অর্থে ন্যাপ এক প্রগেসিভ পার্টি। 

কিন্তু তাতে কী? এর ফলে আধুনিকতার সাথে প্রগতিবাদের সম্পর্ক কী – এর জবাব মিলেছে বা দেয়া গেছে কী? অবশ্যই না, একেবারেই না। কারণ প্রগতিবাদী চিন্তার উৎস থেকে গেছে কমিউনিজম এবং বিশেষ করে কমিউনিজমের ধর্মবিরোধিতার বৈশিষ্ট। আর বিপরীতে আধুনিক রিপাবলিক রাষ্ট্রের ধারণা এর মূল ভিত্তি ব্যক্তিবোধের উত্থান থেকে – পরে নাগরিক-বোধ, জনগণ, জনপ্রতিনিধি, মানুষের মর্যাদা, ইনসাফ, অধিকার, স্বাধীনতা ইত্যাদি মৌলিক ধারণাগুলোতে সে ধারণার বিস্তার।  অতএব এককথায় প্রগতিবাদ বা প্রগতিশীলতা কোন অর্থেই আধুনিকতা নয়।

 কিছু কথা সকলের জন্য, বিশেষত প্রগতিশীলদের জন্য জরুরীঃ
এখন আসব
সকলের জন্য কিছু কথায়, যা বিশেষত প্রগতিশীলদের জন্য খুবই জরুরী। আধুনিকতা, আধুনিক রিপাবলিক ধারণার উৎস কীভাবে – চিন্তার কোন পথ-পরিক্রমায়?  প্রথমত বলে নেই আমার একথাগুলো মেনে নিবার কোনই দরকার নাই। তবে কেবল আপাতত যা এখানে বলেছি ঠিক-ঠাক সেটাই বুঝে নিলে হবে। বুঝা আর মানা এককথা নয়।  সেটা মানলেই চলবে। আমরা রিপাবলিক (রাষ্ট্র) প্রতিষ্ঠা নিয়ে কথা বলছি, এর আগের লেখায়। এটাও বলেছি  রিপাবলিক মানে এটাই  আধুনিক (মর্ডান) রাষ্ট্র ধারণাও। কিন্তু কোন মর্ডানিটি?  সেই মর্তাডানিটি বলতে কী বুঝব? তা নিয়েই এখানে স্বল্পে কথা বলব!

রেনেসাঁ [Renaissance] থেকে যার শুরু, পরে এনলাইটেনমেন্ট [enlightenment]
হয়ে
রেশনালিটি [rationality] বা বিজ্ঞান [science] – মানে যেটা মানুষের চিন্তার
পদ্ধতি সম্পর্কে
প্রথম আত্ম-সচেতনতা; সে পর্যন্ত পৌছানো [ তবে আত্ম-সচেতনতা এর কথা
বললেও তা
 হেগেল নয় বড়জোর কান্ট পর্যন্ত]। আর এই পুরা রাস্তায় ভিতরে ক্রমশ
ব্যাক্তিবোধের উন্মেষ ঘটে যাওয়া।
আর এতে সবকিছুই পরিণতি পায় ‘আধুনিকতায়’। রেনেসাঁ
এক ইতিবাচক গন্তব্য পায় যেখানে। আর সেখান থেকে
মর্ডান রিপাবলিক স্টেট বা আধুনিক
রিপাবলিক রাষ্ট্রের
আবির্ভাব।

এখন লক্ষ্য করবেন উপরের ছোট প্যারায়, চিন্তার পথ পরিক্রমার একটা সংক্ষেপ হাজির করেছি। আর  এই পুরা যাত্রা পথে প্রগতিশীলতা কোথাও নাই। কারণ প্রগতিশীলতার বড়-ভাই কমিউনিজম তখনও আসে নাই।  আর সেটা আসতে গেলে আগে চিন্তা পদ্ধতি সম্পর্কে স্বচেতনতার [self conciousness] আরেক ধাপ (কান্টের পরের ধাপ) পার হতে হবে; তবে সেটা আবার কান্টের হাত ধরে নয়, এবার হেগেলের হাত ধরে। তাতে আমরা ফেনোমেনা বুঝতে শুরু করব। পরে এসব কথার ব্যবহারিক রূপ দানকারি কার্ল মার্কস-কে জানতে চাইলে  জানতে পারব! তবেই না এরও আরো কমপক্ষে পঞ্চাশ বছর পরে মার্কসের কমিউনিজমের ছায়ায় স্তালিনের সমাজতন্ত্র পর্যন্ত আসতে পারব!  সেটা কায়েম হতে হবে আগে; কেবল এরপরেই কমিউনিজম লিবারেল বা স্মল ভার্সান হয়ে প্রগতিশীলতা [progressive] বলে কিছু হাজির হবে। যদিও মনে রাখতে হবে, প্রগতিশীলতা দরকার হয়েছিল ধর্মকে কোপাইতে। বিশেষ করে এর ভারতীয় ভার্সান হল – ইসলাম-মুসলমান কোপাইতে।

কিন্তু তামসাটা হল, প্রগতিবাদীরা তবুও একই গোঁ ধরে থাকে। আধুনিকতাই যেন প্রগতিশীলতা এই ভাব ও ভান ধরে থাকতে চায় তারা। তবে এটা একদিকে না জানা থাকা অন্যদিকে দরকারের তীব্রতাতেই এই পরিণতি!  এমনকি অনেকে মনে করে আকড়ে থাকতে চায় যেন প্রগতিশীলতা আধুনিকতার  সাথে সম্পর্কিত কোন পুর্বসুরি বা উত্তরসুরি না হলেও ভাইরাভাই!  আর এর স্বপক্ষে রেফারেন্স হিশাবে ব্যবহার করতে চায় রেনেসাঁকে বা অনেকে আধুনিকতাকেও। বিশেষত এটা আবার কবি-সাহিত্যিকদের মধ্যে প্রবল; এমনটা প্রগতিশীল রাজনীতিকের বেলায় নয় বা কম। দেখা যায় এমন কবি-সাহিত্যিকদের আধো রেনেসাঁ-বোধের ভিত্তি রোম তো নয়ই পশ্চিমকে পাঠ নয় – এমনকি যারা ইংরাজি সাহিত্যে পিএইচডি করেছেন তারাও নয়, এদের রেনেসাঁ বুঝাবুঝির উৎসও কলকাতা অন্নদা শঙ্কর রায় টাইপের!! যারা আগেই ইসলাম কোপানোর সিদ্ধান্ত নিয়ে রেখেছে এখন এসেছেন এর পক্ষে রেনেসাঁকে সাফাই হিশাবে ব্যবহার করতে গিয়ে যেসব লিখেছেন।
কিন্তু এখানকার জন্য বেজ ফ্যাক্টস হল,  উপরে  চিন্তার যে একটা খসড়া গতিপথ দেখালাম সে প্রসঙ্গে,  মার্কস এর কোন লেখায়  – না রেনেসাঁ সম্পর্কে না এর শেষের রূপ আধুনিকতা বা রিপাবলিক রাষ্ট্র ইত্যাদি এসবের কোনটাকেই রেফারেন্স হিশাবে – মার্কস নিজ চিন্তাকে হাজির  করার ক্ষেত্রে এজন্য জরুরি মনে করেন নাই। এখানে আমরা মনে রাখতে পারি, মার্কসের (১৮১৮-৮৩) আয়ুর সক্রিয়তার কাল যেটা তখন রিপাবলিক রাষ্ট্রের ধারণা ইউরোপে বাস্তবায়িত ও প্রতিষ্ঠিত-থিতু হয়ে গেছে ভালভাবেই। কিন্তু আমরা দেখছি এর প্রভাব মার্কস নিজের উপর নেন নাই।   তাই এসবের একটার সম্পর্কেও মার্কসের রচনায় কোন বক্তব্য নাই। দু’লাইন লেখা নাই। রিপাবলিক রাষ্ট্রের চেয়ে তার কাছে ও চোখে সারপ্লাস ভ্যলু থিওরি সবার উপরে গুরুত্বপুর্ণ। সেকারণে সম্ভবত আধুনিকতা বা রিপাবলিক প্রতিষ্ঠা নিয়ে তিনি কিছুই বলেন নাই। এছাড়ার তাঁর শ্রেণীর রাষ্ট্র চিন্তা – এটা কোন আধুনিক রাষ্ট্র চিন্তা তো একেবারেই নয়। বরং একেবারেই ভিন্ন কিছু ও আলাদা।  আধুনিক রিপাবলিক যেখানে সকল নাগরিককে অধিকার ও নিরাপত্তাদান এর দায়ীত্ব নিচ্ছে বলতে চায়; শ্রেণীর রাষ্ট্র সেখানে এক ক্ষমতাসীন শ্রেণী অন্য সকল শ্রেণীকে খোলাখুলি কোপায় মারবে। গুম, অপহরণ, হত্যা ইত্যাদি সব এই শ্রেণীযুদ্ধে নাকি জায়েজশুধু তাই না এর মধ্যে আবার কোন বিচার ব্যাবস্থা, কোন লিগাল প্রসেস বা আইন-আদালত প্রক্রিয়া ও ভুমিকা ইত্যাদি কিছুই লাগবে না।

কিন্তু প্রগতিবাদের এর মধ্য থেকে কেবল ঐ কোপাকুপিটা দরকার; তার ইসলাম কোপানোর দরকার!  তাই তারা কমিউনিজমের কাছে গিয়েছেন। আর যা যা ধার করে এনেছেন সেটাই প্রগতিবাদ। যার সোজা অর্থ হল,   প্রগতিশীলতার সাথে কোনভাবেই আধুনিকতা সম্পর্কিত  ধারণা নয়! তাহলে কী প্রগতিবাদিরা কার্ল মার্কসের কমিউনিজমের কাছে ধর্ম কোপানোর তত্ব আনতে গেছিলেন?
না ঠিক তাও নয়। প্রথমত একটু কারেকশন লাগবে। প্রগতিশীলেরা কার্লমার্কসের কাছে নয় তারা গেছিলেন স্তালিনের কাছে। তবে সেটা স্তালিন বেশি খারাপ লোক সেজন্যও না। বরং একটা ব্যবহারিক কারণে। অন্যদিকে, মার্কসের চিন্তা কখনই ঠিক ধর্মবিরোধী নয়।  বা সেটা অন্য কোন ধর্ম বা ইসলাম কোপানো মার্কসের চিন্তা-কাজের কোন লক্ষ্যই নয়। তাহলে?

ব্যাপারটা হল ধর্ম কোপানো মার্কসের কমিউনিজম ধারণার অংশ না হলেও স্তালিনের সমাজতন্ত্রের ক্ষেত্রে ও এই সুত্রে ব্যবহারিকভাবে তাই হয়ে গেছিল। যদিও ধর্ম কোপানো কমিউনিজমের জন্য ঠিক এসেনশিয়াল (essencial) অর্থে জরুরি না।

এনিয়ে ব্যক্তিগত কিছু অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে ধারণা ও কথাঃ
ঘটনা হল, রাশিয়া মানে সারা পুর্ব-ইউরোপে জুড়ে এই জনগোষ্ঠি অর্থডক্স [orthodox] ক্রিশ্চানিটির অনুসারী; ফলে এই ধর্ম ও এর বিশেষ চর্চার প্রভাব ছড়িয়ে আছে ঐ’অঞ্চলে। আর সেই বিশেষত্বটা হল যেমন, অর্থডক্স ক্রিশ্চানিটিতে,  মূল পাদ্রী বা প্যাট্রিয়াক [patriarch] এর ধারণা আছে যা খুবই সেন্ট্রাল। তিনি এসব  অর্থডক্ম সমাজেই খুবই প্রভাবশালী ও একক ক্ষমতাবান। প্যাট্রিয়াকের কথায় পুরা অর্থডক্স সমাজ উঠে আর বসে – এটা অর্থডক্স ক্রিশ্চানিটির বিশেষ বৈশিষ্ট; যেটা ক্রিশ্চানিটির অন্যান্য ধারা বা ফ্যাকরায় পাওয়া যাবে না;  অন্য ফ্যাকড়ায়, সেন্ট্রাল ব্যক্তিত্ব বলে কেউ আছে এমন না।  [ব্যক্তিগতভাবে আফ্রিকার ইথিওপিয়ায় প্রায় তিনবছর বসবাস আমাকে অর্থডক্স বৈশিষ্ট সম্পর্কে সচেতন করেছিল। একেবারে কাছ থেকে দেখার সুযোগ দিয়েছিল। ]  আমার ধারণায়, কোন অর্থডক্স সমাজে কমিউনিস্ট-সহ যেকোন বিপ্লবী ক্ষমতা প্রতিষ্ঠা করা খুবই কঠিন এর চেয়ে ডাবল কঠিন। কারণ, সেখানে প্যাট্রিয়াক একজন প্রধানমন্ত্রী বা প্রেসিডেন্টের চেয়ে বেশি না হলেও প্রায় সমান ক্ষমতাশালী। তফাত কেবল একটাইঃ এর একটা হল রাজনৈতিক ক্ষমতা আর অন্যটা ধর্ম-সামাজিক ক্ষমতা।  অর্থডক্সে ইস্টারের উপাস পালন টানা কমপক্ষে ৪০ দিনের; গভীরভাবে পালন ওয়ালারাদের কাছে  তা বছরের ১৮০ দিনেরও। যেটা অন্য খ্রীশ্চানিটি ফ্যাকড়ার বেলায় বড় জোর তিন দিন। এসময়ে এর পালনে সকাল থেকে তিনটা পর্যন্ত না খেয়ে প্রেয়ারেই কেটে যায়। পালনকালে এসময়ে কোন প্রাণীজ প্রোটিন খাওয়া নিষেধ। রাজধানী আদ্দিস-আবাবায় এসময়কালে কোন বেকারীতে কেক খাওয়া মানে শাস্তি পাওয়া। কারণ, কেকে ক্রিম নাই, ডিমও দেয়া হয় নাই। বাজারে মাছ-মাংসের দোকানই বন্ধ। তবে ইথিওপিয়ায় আগের প্যাট্রিয়াক যখন ক্ষমতায় অভিসিক্ত ছিলেন তখন তবু মাছ খাওয়া চলত। কিন্তু আমার বসবাসের সেসময়ের প্যাট্রিয়াক (তেলাপিয়া) মাছও খাওয়া নিষিদ্ধ করে ফতোয়া দিয়েছেন। এখন এমন ক্ষমতা ও প্রভাবের প্যাট্রিয়াক যদি কমিউনিস্ট রাজনৈতিক ক্ষমতার বিরুদ্ধে কোন ফতোয়া দিয়ে দেন, যদি মনোমালিন্য অপছন্দ শুরু হয়ে যায় তাহলে কমিউনিস্ট রাজনৈতিক ক্ষমতা মাথায় উঠবে, তা কায়েম রাখা অসম্ভব হয়ে যাবে। ইথিওপিয়াতেও ১৯৯১ সালের দ্বিতীয় কমিউনিস্ট বিপ্লবের পরে সবার আগেই পার্টি কৌশল-কায়দা করে ফেবারেবল ও পছন্দের এক প্যাট্রিয়াক বসিয়ে নেয়া হয়েছিল। প্যাট্রিয়াক বানানোর যে বোর্ড আছে সেখানেও যখন তখন প্যাট্রিয়াক বদলানোর সিদ্ধান্ত নেয়া যায় না, আগের জনের স্বাভাবিক মৃত্য না হলে।
অর্থডক্স বৈশিষ্টের এসব ব্যবহারিক কারণে, আমার ধারণা অনুমান হল, বিশেষত স্তালিন  অর্থডক্স ক্রিশ্চানিটি ব্যবস্থা বা সাধারণভাবে ধর্মের বিরুদ্ধে বয়ান তৈরি করার দিকে গিয়েছিলেন। তাতে কমিউনিজম ধর্মবিরোধিতা থাক আর নাই থাক!  যদিও পরবর্তিতে সমাজতন্ত্র মানেই ধর্ম কোপানোই এটাই প্রতিষ্ঠিত ধারণা হয়ে যায়। তাই শুরুতেই বলে রাখা ভাল আমার এই ধারণা প্রকাশ তাই কমিউনিজমকে মোলায়েম ভাবে হাজির করা একেবারেই নয়। অথবা এই উপস্থাপনের পরে তা মোলায়েম হয়ে যাবে না। বাস্তব সমাজের ধারণাতে, কমিউনিজমের শরীর থেকে ধর্ম কোপানোরপরিচিতি বা বৈশিষ্ট যা প্রতিষ্ঠিত হয়ে আছে তা আগামিতেও কাটবে না।
আসল কথাটা হল,  অন্যান্য দেশে যারা যারা নিজ দেশে ধর্ম কোপাতে দরকার মনে করেছে সে কমিউনিস্ট না হলেও প্রগতিশীল সেজে সেই কমিউনিস্ট-প্রগতিশীল সাফাইয়ে ধর্ম কুপিয়েছে। এই হল আসল কথাটা।
দুনিয়াতে এমন প্রমিন্যান্ট তিনটা দেশ দেখা যায়; ভারতীয় উপমহাদেশে, বৃটিশ ও ফরাসী দেশে। উপরে লেখায় দেখিয়েছে ভারতীয় উপমহাদেশে কিভাবে জমিদার-হিন্দুরা কিভাবে ক্রমশ কমিউনিস্ট-প্রগতিশীল হয়ে গেছিল। আর সেই থেকে মুসলমান কোপানি আর তাদের উপর সব ধরণের আধিপত্য টিকিয়ে রাখতেই  হিন্দুত্ববাদ=প্রগতিশীলতা হয়ে আছে।
এছাড়া বৃটিশ ও ফরাসীরাও প্রায় এমনই হয়েছে। তবে একটু ভিন্ন কারণে যদিও এর মুখ্য ব্যবহার এদের বেলায় তারা ভিন্নভাবে শুরু করেছিল। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পরে অটোমান সাম্রাজ্যের পতন হলে পরে এই সাম্রাজ্যভুমি  বৃটিশ ও ফরাসীরা নিজেদের মধ্যে ভাগ করে নিয়েছিল। কিন্তু তাদের ক্ষেত্রে সমস্যা একটু ভিন্ন আগেই বলেছি। তা হল, শাসক হিশাবে তারা ক্রিশ্চান কিন্তু শাসিতেরা মুসলমান।  সাধারণ ক্ষেত্রে এটা হয়ত তেমন সমস্যার নাও হতে পারত। কিন্তু ইউরোপের সাথে তুরস্ক মানে হল ক্রসেড যুদ্ধের সম্পর্ক, ইউরোপের ক্রিশ্চানিটির হেরে যাবার সম্পর্ক।  পরে যদিও ইউরোপ তাদের চার্চকে পিছনে ফেলে রাজনৈতিক ক্ষমতা হিশাবে তারা মর্ডান রিপাবলিক হয়ে গেছে। ওদিকে তুরস্ক তখন এই প্রথম অটোমান (পরাজিত বলে) থেকে বের হয়েছে। কিন্তু এরা হল সেই অটোমান তুরস্ক যারা আট থেকে বারো ক্রুসেডেও বিজয় লাভের পরে অটোমান সাম্রাজ্য শাসন শুরু করেছিল। ফলে পরাজিত অটোমান রাজতন্ত্র  বলে সেখান থেকে বের হওয়া তুরস্কের বাসিন্দারা কিভাবে নয়া ক্রিশ্চিয় বৃটিশ ও ফরাসী শাসন কে নিবে – এই ছিল বৃটিশ ও ফরাসীদের টেনশন ও শঙ্কা। সেকারনে আমরা দেখেছিলাম বৃটিশ ও ফরাসী নিজেকে প্রটেকশন এর চিন্তা। আর সেটাই ছিল কামাল তুনে কামাল কিয়া ফেনোমেনা মানে কেমেলিয়ান চর্চায় শয়তানির কথিত সেকুলারিজম আর রাষ্ট্র থেকে ধর্ম আলাদা করার বকোয়াজি! অন্যভাষায় এটাই বৃটিশ ও ফরাসীদের ইসলাম কোপানো!  খেয়াল রাখতে হবে, ইংল্যান্দের রাজা যখন এঙ্গলিকান [anglican বা ইংলিশ] চার্চ অব ইংল্যান্ডের প্রধান – সেটা থাকা অবস্থায় ( আর যেটা এখনও তাই) অবস্থায় বৃটিশেরা রাষ্ট্র থেকে ধর্ম আলাদা করার বকোয়াজি! তখনও শুরু করেছিল এখনও জারি রেখেছে!! 

His Majesty the King is the Supreme Governor of the Church of England.
The King appoints archbishops, bishops and deans of cathedrals on the advice of the Prime Minister.

ওয়ের চেয়ে বড় নখড়ামি আর কী হতে পারে?? আবার ওদিকে ফ্রান্সের এসিমিলেশন [assimilation] যার সোজা বাংলা হল, “তোমাকে আমার মতই হতে হবে“। আমার ধর্ম-কালচার সামাজিক অভ্যাস যা আছে হুবহুই তোমাকে মেনে নিতে হবে, তুমি নিজেকে বদলিয়ে আমার মত হয়ে যাও।  হতেই হবে। এই হল ফরাসি ফাজলামি! এনিয়ে আমার পুরানা লেখা দেখতে পারেন।

৩০ বছরের ইউরোপীয় ধর্মযুদ্ধঃ
আসল প্রসঙ্গটা হল, বৃটিশ-ফরাসিদের কথিত ‘সেকুলারিজমের’ ধান্দাপানি। উপরে দেখিয়েছি রাষ্ট্র থেকে ধর্ম আলাদা করার বকোয়াজিটা কী ও কেন।  আর এখন বলব, ক্লাসিক্যাল তবে পরোক্ষ এক সেকুলারিজমের ধারণা (যেটাকে আমি ক্লাসিক্যাল সেকুলারিজমও বলি) ইউরোপেই ছিল ও আছে তবে তা চাপা দিয়ে রাখা হয়েছে। সে প্রসঙ্গে যেতে কথা শুরু করতে হবে উলটা করে। আর সেকাজেই ৩০ বছরের ইউরোপীয় ধর্মযুদ্ধ কথাটা। তবে সাবধান কথাগুলো আমি বানাই নাই। আপনারা নেটে Thirty Years’ War এটা লিখে সার্চ দেন এরপর নিজেই পড়ে দেখেন। আমার কোন পুরানা লেখাতেও পাবেন। আরেকভাবে পেতে পারেন যারা ১৬৪৮ সালের ওয়েস্টফিলিয়া সম্মেলনের [Treaty of Westphalia] বা সমঝোতা সম্পর্কে জানেন। যারা  ইসলামবিদ্বেষ থেকে দুূরে সৎভাবে মন ও চিন্তা সাজাতে চান তারা চিন্তা বাধাহীন উন্মুক্ত করতে চাইলে ইউরোপের ইতিহাস বুঝতে চাইতে পারেন। মনগড়া জমিদার-হিন্দু বয়ানের খপ্পর থেকে তাদের বের হতে হবে। ইউরোপীয় রাজারা তাদের আমলে ইউরোপীয় ধর্মযুদ্ধ (যেটা আসলে খ্রীশ্চানিটির নানা ফ্যাকড়া বা ইন্টারপিটেশনের মধ্যের ঝগড়া ও যুদ্ধ) যা তারা ধর্মযুদ্ধ না বলে গৃহযুদ্ধ বলে মোলায়েম রাখতে চায় এরই কাহিনী। তবে মুখ্যত সেকালের শাসন ব্যবস্থায় এর সমাধান তারা কী বের করেছিল, যা আজও শিক্ষণীয়, তা জানা দরকার। যার সেই সমাধানের সারকথাটা হল, নাগরিককে সমান অধিকার ও মর্যাদায় রাখতে হবে। রাজাদের বেলায়, রাজার পালিত খ্রীশ্চানিটির ধারার লোক প্রজা না হলে, রাজা কী সেই প্রজাকে একঘরে করবেন, বৈষম্য করবেন, শাস্তি দিবেন? আর তাতে দুই প্রজা দুই ধারার খ্রীশ্চানিটির অনুসারী হলে কী তারা একে অপরকে খুন করে সমাধান আনবেন?
এরই সহজ সমাধান করা হয়েছিল ১৬৪৮ সালে জর্মানির এক শহর ওয়েস্টফিলিয়া-তে বসে এক সমঝোতা সম্মেলনে।  আর সেটা ছিল ১৬১৮-৪৮  এই ত্রিশ বছর ধরে ধর্মযুদ্ধ করার পরে র সমাধান হিশাবে। কি সেই সমাধান?
খুবই সহজ রাজা ফ্যাকড়া নির্বিশেষে সকল ধারার খ্রীশ্চনিটির অনুসারী প্রজার সাথেই কোন বৈষম্যহীন, সমান ব্যবহার ও সুযোগ সুবিধা দিবে – এই নীতি অনুসরণ করে। এটাই মর্ডান রিপাবলিকের মূল নীতি। সকল নাগরিকের সাথে বৈষম্যহীন সমান অধিকার ও মর্যাদাদান। এটাই বাই ডিফল্ট যে কোন মর্দান রিপাবলিক প্রতিষ্ঠা করলে সাথে আসা প্যাকেজের মত এক সেকুলারিজম। এটা শয়তানি ইসলামবিদ্বেষ আর কোপানি নয়। এটা করতে, সেকুলার বলে কোন কিছু কনষ্টটিউশনে লেখে রাখার শয়তানি বা ইসলাম-মুসলমান ঘৃণা ছড়ানির হিন্দুত্ববাদ নয়, প্রগতিশীলতা বলে আড়াল নেয়াও নয়!
লেখা অনেক বড় হয়ে গেছে। তাই এখানে এখন শেষ করছি। নিজের উপর শয়তানকে ভর করতে দিয়েন না। দয়া করে নিজে বুঝে শুনে প্রগতিবাদ ছাড়েন!  সবাইকেই নিয়ে এক সমাজ-রাষ্ট্রে বসবাসের রাস্তা খুঁজেন!
সবচেয়ে ক্ষতিকর আত্মঘাতি ধারণা প্রগতিবাদ যার হিন্দুত্ববাদের বাহক বা ক্যারিয়ারও। তাই হিন্দুত্ববাদ=প্রগতিবাদ। প্রগতিবাদ থেকে পরিস্কার ভিন্ন রাস্তা হল আধুনিকতা।

আধুনিকতা আপনাকে আধুনিক রিপাবলিক প্রতিষ্ঠার দিকে সদর রাস্তায় নিতে পারে।

আপডেটঃ  ২২ সেপ্টেম্বর ২০২৩; ভোররাত ০৩ঃ ৫৪ 
সর্বশেষ আপডেটঃ  সেপ্টেম্বর ২০২৩; ভোর 

লেখক : রাজনৈতিক বিশ্লেষক
goutamdas1958@hotmail.com

Leave a comment