দুটাই গায়েবি দাবি, ডেইলি ষ্টার – প্রথম আলোর পাল্টাপাল্টি
গৌতম দাস
১৪ মে ২০২৪ সন্ধ্যা ০৬ঃ ৫৪
একই মিডিয়া গ্রুপের দুই সম্পাদক
এটা একটা বেশ তামাসার ঘটনা! একই মিডিয়া মালিক গ্রুপ – “মিডিয়া স্টার লিমিটেডের” দুইটা পত্রিকা প্রথম আলো আর ডেইলি স্টার, এরা পরস্পরের পাল্টাপাল্টি রিপোর্ট করেছে দুদিন আগে পরে। যেভাবেই হোক যা খুশি লিখে টাকা কামাইতে হবে। কাস্টমার নাকি লক্ষী! অর্থের বরকত দেয়! তাই মোটা তহবিলের দেশি-বিদেশি কাষ্টমার যা চায় সে ফরমায়েশ পূরণে তাই করে দিতে এদুই পত্রিকা এক পায়ে খাড়া তাতে, ডেইলি স্টারের খবরের বিরোধী করে প্রথম আলোকে যদি কিছু গারবেজ ছাপতে হয় তো অসুবিধা কী তাদের! এটাই এখন শুরু হয়েছে!!
আর জার্নালিজম???
সেটা কোথায় আশ্রয় পাবে? হিমঘরে?
হা অবশ্যই তাই। এদুই পত্রিকার মূল কাস্টমার আর পাঠক যেহেতু নয়; তাই তাদের আর জার্নালিজমের দরকার কী? পত্রিকার ততপরতায় সেটাতে আর নুন্যতম জার্নালিজম হল বা থাকল কিনা এদের কাছে তার কী এসে যায়? এর বদলে আসল ভগবান / ক্রেতা হল দেশি / বিদেশি রাষ্ট্রস্বার্থ; এদের কাছে নিজেদের বিক্রি করেই একে নিজেদের জন্ম সাফল্য ভাবছে!
ঘটনা হল, সামনে হাসিনার কথিত চীন সফর নিয়ে একই মিডিয়া মালিক গ্রুপ – “মিডিয়া স্টার লিমিটেডের” দুইটা পত্রিকা প্রথম আলো আর ডেইলি স্টার পাল্টাপাল্টি রিপোর্ট করেছে দুদিন আগে পরে। পরস্পরবিরোধী সব দাবিতে এদুই পত্রিকা দুদিন আগে পরে লেখা প্রকাশ করেছে। এই বেপরোয়া কেন? এদের এই ততপরতা প্রমাণ করেছে দেশে সম্ভবত সরকার নাই হয়ত সরকারী প্ররোচনা আছে এখানে? আর দেশের নাগরিক ও পাঠক এদেরকে কোন গোনায় ধরতে চায় না এরা!
ডেইলিস্টার এর দাবিঃ
ডেইলিস্টার রিপোর্ট করেছিল – Beyond Dollar: Bangladesh to seek over 36b yuan in Chinese loans এই শিরোনামে ৮ মে ২০২৪। এবং তা ছিল এক অনামি-বেনামি সোর্সের নামে। আর বুঝা যাচ্ছিল চীনা ঋণ (“বাজেট সহায়তার” নামে যেটা ক্যাশ ডলার / ইউয়ান পাওয়া) – এক বেপরোয়া কিন্তু অকার্যকর পথ এটা।
কিন্তু ডেইলি স্টার কোন প্রমাণ ছাড়া দাবি করেছিল যে এটা নাকি আবুধাবীতে গত ২৬ ফেব্রুয়ারি ২০২৪ থেকে কয়েকদিনের WTO এর এক বাণিজ্যসভা চলাকালে, ওরই সাইড লাইনে বসে কথিত এই আলাপ হয়েছিল; চীনা “প্রতিপক্ষের” [counterpart] সাথে। অর্থাৎ আজ থেকে প্রায় আড়াই মাস আগের ঘটনা ছিল সেটা। যদিও এমন কথা যে হয়েছে এর প্রমাণ কী, তা জানা যায় না। কারণ, পুরা রিপোর্টটাই বেনামি। যেমন বলা হয়েছে, ১। According to highly placed sources in the government, ২। Sources in the finance and commerce ministries ৩। According to the sources। অর্থাৎ খবরের সোর্স গায়েবী। সবচেয়ে বড় কথা, আড়াই মাস আগের এই গায়েবি রেফারেন্স এখন হাজির হয়েছে কেন, তা এরা বলছে না। আর বাণিজ্য প্রতিমন্ত্রী যে এমন বলছে এর কোন প্রমাণও রিপোর্ট-এ নাই। নিচে ডেইলি স্টারে ঐ রিপোর্ট থেকে আমাদের বাণিজ্য প্রতিমন্ত্রীর প্রমাণহীন বরাতের বক্তব্যে অংশটা নিচে এখানে তুলে এনেছি।
“State Minister for Commerce Ahasanul Islam Titu brought up the loan issue
during bilateral talks with his Chinese counterpart on the sidelines of the
13th Ministerial Conference of World Trade Organisation in Abu Dhabi
between February 26 and March 2″.
কেন সোর্সের এত জরুরি বা সন্দেহজনক? একটা দিনকাল সময় ছিল যখন মিডিয়াকে অবিশ্বাস করারই কিছু ছিল না। মূল কারণ, তারা নাগরিক-পাঠকের বিশ্বাস-আস্থাও রক্ষক হয়ে থাকবে না কেন – আমাদের সমাজেরও এই কমান্ড তখন কাজ করত। আর এখন সব পক্ষই নিজ নিজ হীন ও সংকীর্ণ স্বার্থে এই বিশ্বাস-আস্থাটাই ভেঙ্গে দিয়েছে, পত্রিকাগুলো জার্নালিজমকেই নিলামে তুলেছে। তাই একালে এমন ঘটানাও ঘটছে যে সরকার দাবি করছে ওমুক দেশের সাথে এই আলাপ হয়েছে। কিন্তু নাগরিক-পাঠকের তা বিশ্বাস হচ্ছে না। তারা অপেক্ষা করছে যতক্ষণ সে কথিত দেশও বিবৃতি দিচ্ছে!
তাতেও সমস্যা আছে। আজকাল অনেক দেশের রাষ্ট্রদুত মনে করেন তাদেরকে নিয়ে করা সরকারের দাবির বিরোধিতা করে বিবৃতি দেয়া মানে তো প্রকাশ্যে সংঘাতে জড়ানো। যেমন চীন সেই টিকা পাওয়া নিয়ে কূটকাচালি নোংরামির সময়। আমাদের স্বাস্থ্যমন্ত্রী ভারতের সহায়তায় কলকাতা রয়টার্সের রুমা পালের কাছে দাবি করেছিল যে চীন নাকি তাদের টিকা গবেষণার তৃতীয় পর্যায়ে বাংলাদেশের সামিল করে নিতে বাংলাদেশের কাছে অর্থ চেয়েছিল। অথচ ব্যাপারটা ছিল, সামিল করার চীনা প্রস্তাব বিনা পয়সারই ছিল এমনকি লব্ধফল ব্যবহার করে নিজের প্রয়োজনীয় টিকা বাংলাদেশ নিজেই কোন ল্যাবকে নিয়ে বানিয়ে নিবার রাইটও পাবার কথা ছিল। কিন্তু ভারত তার এষ্ট্রোজেনিক টিকা কিনলে ক্রেতারা ব্যক্তিগত কমিশন পাবার সুযোগ আছে, এই লোভ দেখালে আমাদের সরকার চীনের প্রস্তাবে সময়মত তার সম্মতিপত্র চীনের কাছে পাঠায় নাই। পরে যখন পাঠায় তখন ঐ চীনা সিংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান জানায় বাংলাদেশ সময়ে সম্মতি না পাঠানোতে আর তাদের দেরির সুযগ ছিল না বলে তারা এই অফার ইন্দোনেশিয়াকে দিয়ে দিয়েছে।
এরপরেও বাংলাদেশ অনুরোধ ঝুলাঝুলি শুরু করল তারা জানাই তাদের নয়া বাজেট নাই; মানে একটা অতিরিক্ত দেশকে নতুন করে অন্তর্ভুক্তিতে যে বাজেট প্রয়োজন তা তাদের পরিকল্পিত বাজেটে বরাদ্দ নাই। তাই নিতে পারছে না। মানে কেউ যদি বলে বলে তাঁর কাছে বরাদ্দ নাই তাহলে এর মানে করা হয়েছে সে অর্থ চেয়েছে।
মজার কথা হল, ঐ ঘটনায় রুমা পালই আইসিডিডিআরবি হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের (এই প্রতিষ্ঠান স্থানীয়ভাবে চীনা টিকার তৃতীয় পর্যায়ের পরীক্ষা পরিচালনার জন্য চুক্তিবদ্ধ স্বাধীন প্রতিষ্ঠান ছিল) সাথে যোগাযোগ করে চীন অর্রথ চেয়েছে কিনা জানতে চাইলে তারা কোনই মন্তব্য করে নাই। এমনকি ঢাকার চীনা এমবেসিও “নো কমেন্টস” বলে ফিরিয়ে দেয়। কিন্তু আল্লার মাইর বলে কথা। ভারত টিকা দিবে না জানিয়ে দেয় আর বাংলাদেশকে ফের চীনকে ধরাধরি করে টকা পাবার ব্যবস্থা করতে হয়। কিন্তু কিসের বিনিময়ে চীন সেবার তাতে রাজি হয়েছিল সে আরেক উপাখ্যান। আমরা সেদিকে যাচ্ছি না।
সারকথাটা হল, চীনা কূটনীতিক অভ্যাস বা স্টাইল হল, তাদের নামে বা স্থানীয় রাষ্ট্রদুতের নামে হোস্ট সরকার মিছা কথা বললেও বা মিথ্যা দাবি করলেও তারা রা কারে না – জবাব দেয় না। মুখোমুখি বাকযুদ্ধের সংঘাত এড়ায় চলে। আর ভাল সময়ের জন্য অপেক্ষা করে; বলে আমার ধারণা। কাজেই আমাদের সরকার সাংবাদিকদের দিয়ে বা সাংবাদিক নিজে খেপ মারতে চীনা দের রেফারেন্সে গায়েবি তথ্য দিলেও চীনা না তাতক্ষণিক প্রতিক্রিয়া নাও দেখাতে পারে।
এখন আসি প্রথম আলোর দাবিঃ
ডেইলি স্টারের একই এবিষয়ে প্রথম আলো রিপোর্ট ছাপা হয় ১২ মে ২০২৪। মানে, ডেইলিস্টারের তিনদিন পরে। শিরোনাম হল, – ইউয়ানে ঋণ দিতে চায় চীন, নিতে আগ্রহী ডলার–সংকটে থাকা বাংলাদেশও এর। প্রতিবেদক জাহাঙ্গীর শাহ। আগে ভাবতাম লোকটা বোধহয় জন-বিশ্বাসযোগ্যতা রাখতে চায়। নিজ ক্যারিয়ার ইমেজ এর দিকে খেয়াল রাখে। এই রিপোর্টের পরে আমি শকড ও হতাশ! কেউ জার্নালিস্ট হতে চায় না, কেবল অর্থ চায়। যাক সেকথা।
প্রথম আলোর প্রধান (ডিইলিস্টার-বিরোধী বা) কন্ট্রাডিকটরি দাবি যা তা শিরোনামেই আছে। ইউয়ানে ঋণ দিতে চায় চীন – এইটা। যেখানে ডেইলিস্টার লিখেছিল, আবুধাবীতে মূল সভা না সাইড লাইনে বসে আমাদের বাণিজ্য প্রতিমন্ত্রী চীনা মন্ত্রীকে ঋণ (স্টারের ভাষায় ‘কাউন্টারপার্ট’) ঋণ দিতে [ভাষা লক্ষ্য করুন ……Titu brought up the loan issue…] কথা তুলেছিল। আর বিপরীতে এখন প্রথম আলোর দাবি হল, চীনই [ ইউয়ানে ঋণ দিতে চায় চীন] দিতে চেয়েছে। এমনকি প্রথম আলো আরো লিখেছে,
১। “চীন চাইছে ইউয়ানে ৫০০ কোটি ডলারের সমপরিমাণ ঋণ বাণিজ্য–সহায়তা (ট্রেড ফ্যাসিলিটি) হিসেবে দিতেঃ…।
২। [পঞ্চম প্যারায়] – ” চীনের কাছ থেকে ইউয়ানে ঋণ দেওয়ার আগ্রহ এমন সময় প্রকাশ করা হয়েছে,”…
৩। [নবম প্যারায়] এ বিষয়ে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সচিব তপন কান্তি ঘোষপ্রথম আলোকে বলেন, ডলারের চাপ সামলে রিজার্ভ বাড়ানোর জন্য চীনের আমদানি ব্যয় ইউয়ানে মেটাতে এই ঋণ নেওয়ার চিন্তাভাবনা চলছে। এই ঋণ কীভাবে ব্যবহার করা হবে, তা ঠিক করবে বাংলাদেশ ব্যাংক। ঋণের সার্বিক দিক পর্যালোচনা করতে শিগগিরই একটি কমিটি গঠন করবে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়” –……[কিন্তু সরি প্রথম আলো, সচিব এটা কোথায় বলেছেন? রেফারেন্স কী? বলেছেন এর প্রমাণ কী এর কোন হদিস রেফারেন্স নাই গায়েবি]
অর্থাৎ প্রথম আলোর স্পেশালিটি হল, সে দাবি করে চলছে যে বাংলাদেশ সরকার বা এর কোন মন্ত্রী নয়; বরং চীনই গায়ে পড়ে বাংলাদেশকে পাঁচ বিলিয়ন সমতুল্য অর্থ ঋণ দিতে চাচ্ছে। এটা এক হেভভি মজার দাবি! এমনকি এটা ডেইলি স্টারকেও নাকচ করে দিয়েছে। কারণ, ডেইলিস্টার তবু দাবি করছিল যে বাণিজ্য প্রতিমন্ত্রী টিটোর চীনার মন্ত্রীর কাছে ঋণের অনুরোধ থেকে ঘটনা শুরু।
কিন্তু এবার একেবারে বেপরোয়া প্রথম আলোঃ
তার নতুন তথ্য হল, টিটোর সাথে আবুধাবিতে চীনা মন্ত্রীর বৈঠক চলাকালে ঢাকায় কী ঘটেছিল? নিচে প্রথম আলো থেকে তুলে আনা অংশ দেখেন। সেই বৈঠক চলাকালেই নাকি ঢাকার দৃশ্যপটে ঢাকায় চীনা রাষ্ট্রদুত ইয়াও অয়েন নিজে যেচে ৫ বিলিয়ন ডলার (৫০০ কোটি ডলার) নিএই আগ্রহ করে ঋণ দিতে চেয়েছিল। আর চীনা রাষ্ট্রদূতের এই আগ্রহ প্রকাশের পর আমাদের আমলারা ততপর হয়েছে ঋণ পেতে…।
“…বৈঠক চলাকালে ঢাকায় চীনা রাষ্ট্রদূত ইয়াও ওয়েন দুই দেশের বাণিজ্য ঘাটতি
মোকাবিলায় বাণিজ্য–সহায়তা বাবদ ৫০০ কোটি ডলারের সমপরিমাণ ইউয়ান
ঋণের প্রস্তাব দিতে অনুরোধ করেন। চীনা রাষ্ট্রদূতের এই আগ্রহ প্রকাশের পর এ নিয়ে ঢাকায় আলোচনা শুরু হয়”…।
সত্যিই মজার গল্প!
বাংলাদেশ নিজে চায় নাই চীন নিজেই ঋণ দিতে চেয়েছে – এর চেয়ে মজার গল্প আর কী হতে পারে! তাও আবার এই ররণ যে সে ঋণ নয়! এটা বাজেট সহায়তা ঋণ; মানে হল, ক্যাশ বৈদেশিক মুদ্রা (ডলার / ইউয়ান) পুরাটাই এবং একবারে এটা হস্তান্তর হবে।
এর আরো মানে হল, এটা প্রকল্প ঋণ নয়। সোজা মানেটা হল, কোন ঋণদাতাই ক্যাশ (ডলার / ইউয়ান) দিতে চায় না।
কারণ, ৫ বিলিয়ন ক্যাশ ডলার মানে হল এটা দিয়ে ৫০ বিলিয়ন ডলারের প্রকল্প দেয়া সম্ভব। [তুলনা করে নেন ২০১৬ সালে চীন ২৬ বিলিয়ন ডলারের প্রকল্প অনুমোদন দিয়েছিল। অনুমোদিত হলেও এর অর্থ ছাড় ও বাংলাদেশে তা খরচ করা যায় নাই। কারণ অর্থ ছাড় ততটুকুই হয় বা আগায় যতটুকু কাজ প্রতিবছর বাস্তাবায়িত হয়। আর এতে এখনও অর্ধেক অর্থ পেন্ডিং। ] এসবের সোজা অর্থ হল, চীন বাংলাদেশকে একটা প্রকল্পই যদি মোট দশ বিলিয়নেরও হয় তবু বছরে হাফ থেকে বড় জোর এক বিলিয়ন ডলার অর্থই কেবল ঐ প্রকল্প ছাড় করাতে সক্ষম হবে মানে চীনকে এতটুকু ডলারই কেবল সরবরাহ করতে হবে। অথচ প্রথম আলো দাবি করতেছে চীনা রাষ্ট্রদুত নাকি নিজেই যেচে ৫ বিলিয়ন ক্যাশ ডলার দিতে চেয়েছে…। আমার মনে হচ্ছে না ৫ বিলিয়ন ক্যাশ ডলার মানে কী তা নিয়ে রিপোর্টার জাহাঙ্গীর শাহের কোন ইমাজিনেশন / অনুমান আছে!
এবার এই রিপোর্টে প্রথম আলোর চাতুরির দিকটা বলি।
এই রিপোর্টের শুরুতে তিনটা বুলেট পয়েন্ট বা সারাংশ লিখে শুরু হয়েছে। তার আবার প্রথম বুলেট পয়েন্টটা হল এরকম –
- দুই দেশের মধ্যে ১৯০০ কোটি ডলার বাণিজ্যঘাটতি।
আসলে সাবধান হতে হয় যখন কোন রিপোর্টে কেউ বাণিজ্য ঘাটতি নিয়ে কথা তুলে। কেন? কারণ, এটা কিছুই মানে করে না আবার ইঙ্গিত টা বুঝা যায়। বাংলাদেশ চীন থেকে প্রচুর পণ্য আমদানি করে তুলনায় নিজে রফতানি করে ১০% ও না। এমন হতে পারে। কিন্তু সব্দেশ মিলিয়ে আমি কত রফতানি করি আর সবদেশ মিলিয়ে কত আমদানি করি – এমন গ্রস ফিগারটা অনেক গুরুত্বপুর্ণ যে আমার অর্থনীতি মোটা দাগে ভাল না খারাপ। তাহলে শুরুতেই চীন-বাংলাদেশের বাণিজ্যঘাটতি ১৯ বিলিয়ন ডলারের এই তথ্য প্রথম আলো হাজির করল কেন?
এক. খুব সম্ভবত প্রথম আলোর রিপোর্টটা দিল্লির দিক থেকে করা; সেক্ষেত্রে ডেইলি স্টারেরটা আমাদের সরকারের।
দুই. ইন্ডিয়া কঠর অর্থনৈতিক জাতিবাদি; তাই তাদের কাছে বাণিজ্যঘাটতি – এই শব্দ ও ধারনাটা একটা ভাল টুল। যা দিয়ে আপাতভাবে প্রতিপক্ষকে ভড়কে দেয়া যায়।
তিন. এখানে চীনেরই যেচে হাসিনাকে ডলার দেওয়া উচিত কারণ চীনের থেকে বাংলাদেশের আমদানি বেশি প্রায় ১৯ বিলিয়ন – এই আর্গুমেন্ট দিয়ে চীনকে দায়ী করা হয়েছে।
চার. এখন এই দাবি যদি মেনে নেই তাহলে, ভারত-চীনের বেলায় ফিগার হল, ভারত ১০১ বিলিয়ন ডলার চীন থেকে আমদানি করে আর রফতানি করে এক মাত্র ৮-৯% মাত্র। দেখা যাচ্ছে এই বাণিজ্য ঘাততি তো আমাদের চেয়েও বড়! তাহলে এই ঘাটতি পূরণে কী চীণ-ভারত ঋণ ক্যাশ ডলারের আলোচনা চলছে নাকি??? নাই কেন??
পাঁচ. ইন্ডিয়া-বাংলাদেশ বাণিজ্যে, ভারতের রপ্তানি প্রায় ১৪ বিলিয়ন ডলার (২০২২ সালের) তুলনায় বাংলাদেশের রপ্তানি ২ বিলিয়নের নিচে। মানে সাত গুণ বাণিজ্য ঘাটতি। তাহলে ভারত কেন বাংলাদেশকে ক্যাশ ডলার ঋণ দিচ্ছে না?
তাহলে কী দাঁড়ালোঃ
প্রথম আলো কারও স্বার্থে [সম্ভবত ভারত] এই প্রপাগান্ডা রিপোর্টটা করেছে। আর তাতে এতে দাবি করা বক্তব্য তিনদিন আগের ডেইলি স্টারের সাথে কনট্রাডিকটারি হয়ে গেলেও। মানে প্রথম আলোর দাতা-কাস্টমারের মোটা এমাউন্ট বিষয়টাকে তারিত করেছে। তাতে ঘরের ভাই বেইজ্জতি হলে হোক; অর্থ তো মিলবে! আর তা থেকেই সম্ভবত একই মিডিয়া গ্রুপের দুই ভাইয়ের পরস্পরের দাবির (গায়েবি সুত্রে) পাল্টাপাল্টি; আর এই তামাসা আমাদেরকে দেখতে হচ্ছে।
সবচেয়ে বড় কনট্রাডিকশন হল, ডেইস্টার দাবি করছে আমাদের মন্ত্রী অর্থ-ঋণ চেয়েছে। আর পালটা প্রথম আলোর রিপোর্ট দাবি করছে ঢাকার চীনা রাষ্ট্রদুত নিজেই দিতে চেয়েছে; মানে, অর্থ দিতে চেয়ে বাংলাদেশের কাছে প্রস্তাব চেয়েছে।
এই ঘটনা, বাংলাদেশের অর্থনীতির দুর্দশা আর আমাদের মিডিয়ায় “দাতা-কাস্টমারের” অর্থের দাপটের জার্নালিজমের এক ভাল উদাহরণ হয়ে থাকবে, নিঃসন্দেহে!
আর প্রথম আলো আর ডেইলি স্টার নিজেরা বসে ঠিক করুক – সবার আগে চীনই কী ৫ বিলিয়ন ডলার সমতুল্য অর্থ দিতে চাইছে? নাকি এর আগেই বাংলাদেশ থেকে অর্থ চাওয়া হয়েছে? এনিয়ে তাদের দুই অবস্থান নিয়ে পালটা পাল্টির তো কোন মানে হয় না। আর সবচেয়ে বড় মিথ্যা চীন এই অর্থ দিতে নীতিগতভাবে রাজি এই কথার প্রমাণ কি?
এদিকে ডোনাল্ড ল্যুঃ
ঢাকার কিছু মিডিয়া জানাচ্ছে ঢাকায় এসে গেছেন ডোনাল্ড লু। কিছু মিডিয়া তো ইতোমধ্যেই সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদেরের বরাতে লিখেছে, ডোনাল্ড ল্যু নিজ দেশের এজেন্ডা বাস্তবায়নে আলোচনা করতে এসেছেন: ওবায়দুল কাদের। এখন এর প্রথম মানে হল, কাদের আশাহত অন্তত। কারণ, এসময়ে সরকারের একটাই এজেন্ডা বৈদেশিক মুদ্রা যোগাড়। তাই কাদেরের কথার অর্থ কী এটা যে ডোনাল্ড ল্যু এব্যাপারে কোন সাহায্য করতে পারছেন না; বা করবেন না? ল্যু এর নিজ দেশের এজেন্ডা নিয়ে আসা মানে তো এটাই হয়!
অবস্থায় পাঠকদেরকে বলব ডলার যোগাড়ে ল্যু এর দৌড় বড়জোর আইএমএফ পর্যন্ত, আমেরিকা সরকার নিজের থেকে কাউকে ক্যাশ দিবার অবস্থায় এই শতকেই আর উদাহরণ নাই। আর আইএমএফ এর বেলায়, সে নগদ ডলার সহায়তা এটা কাউকে দেয় বা দিয়েছে আমার মনে পড়ে না। তবু ধরা যাক খুবই জবরদস্ত অনুরোধ করেছেন ল্যু! এটাও যদি ঘটে তবে এই অর্থের পরিমান হাফ বিলিয়নের (৫০০ মিলিয়ন মাত্র) আশে-পাশে থাকবে। যেমন প্রথম যখন এসেছিলেন তখন তার অনুরোধেই চলতি ৪.৭ বিলিয়ন আইএমএফ সাহায্য যেটা প্রতি ছয় মাসে অগ্রগতি দেশে ছাড় হয় যা বছরে গড়ে ৭০০ মিলিয়নের মত। সবচেয়ে বড় কথা গত অর্থমন্ত্রী ঠাট্টা করে বলেছিলেন এমন ছোট অর্থ – “তিনি নিজেই ধার দিতে পারেন”।
কাজেই এখানে লীগ বা সরকারের এমন আশাহত বক্তব্যই তো বের হবে।
আবার ল্যু-কে আসলে দেখতে হবে – এবারের বাইডেন সরকারের মুখ্য সব ব্যর্থতার প্রধান নায়ক হিসাবে। ল্যু এর প্রধান এজেন্ডা ছিল ইন্দো-প্যাসেফিক স্ট্রাটেজি যার বাংলা মানে এশিয়ার বিভিন্ন দেশ থেকে চীন হঠাও। সেটা অবকাঠামো ররণ, স্ট্রাতেজিক উপস্থতি সহ যে কোন উপস্থতি।অথচ এশিয়ার একটা দেশেও তা নুন্যতম সফলতার আলো দেখে নাই। গত একবছর বাইডেন-ল্যু এটা আর উচ্চারণ করাই ছেড়ে দিয়েছে।
একচুয়ালি ল্যু-এর করুণ পরিণতির বেস্ট উদাহরণ হল পাকিস্তান! শুরু ইমরান সরকারকে উতখাত দিয়ে আর চোর দুই মার্কা মারা নওয়াজ ভাইকে ক্ষমতায় বসিয়েছিল। পরে পাকিস্তানের নির্বাচনের ইতিহাসে এই ওপেন কারচুপিতে তারা অভ্যস্থ ছিল না, এই প্রথম দেখলো যে এবার আর্মিই সেকাজে ল্যু এর হয়ে প্রধান হোতা। কিন্তু ঝগড়া লাগলো নির্বাচনের পরের ঘটনাবলীতে, কেউ আর এর দায় নিতে চাইলো না যখন আমেরিকা নিজেকে এই কথিত বিজয় থেকে কারচুপি থেকে নিজের দায় অস্বীকার করে বসল। এত নির্বাচন কমিশ্ন বিভক্ত হয়ে গেলে নওয়াজ শরীফো কারচুপির দায় আর নিতে চাইলেন না, ফলে প্রধানমন্ত্রী হতে অস্বীকার। ফলে ল্যু এর ক্রেডেনশিয়াল সুনাম কেমন হয়েছে বুঝতেই পারছেন! কিন্তু শেষেরটা আর মজার। তারা কিছু করতে বাকি রাখে নাই। পাকিস্তান-ইরান সীমান্তে ট্রাইবাল (একই ট্রাইব দুদেশের আছে) ইস্যুতে যুদ্ধ লাগায় দিতে চেয়েছিল আমেরিকা। কিন্তু পাকিস্তান-ইমরান তা তে নিজেদেরকে সামলে সম্বরণ-ই শুধু করেন নাই। পরে ইরানী প্রেসিডেন্টের পাকিস্তানী সফর ঘটা শুরু হলে তাতে তারা যেন বাণিজ্য চুক্তি স্বাক্ষর না করে এজন্য বাইডেন প্রশাসন ল্যু ভাইয়া হুমকি দিতে থাকলেন! কী মজা! পাকিস্তান কী এমন একটা ল্যু দেখতে চেয়েছিল? নাকি ল্যু-ভাইয়া এমন একটা শাহবাজ শরীফ দেখতে চেয়ে ইমরানকে ক্ষমতাচ্যুত করা, হস্যকর অভিযোগে তাঁকে জেলে দেওয়া আর শেষে এমনকি ইতিহাস ছারানো নির্বাচনী কারচুপি করতে গেছিলেন? তাহলে ল্যু ভাইয়াকে বাইডেনের বা পাকিস্তানের আর দরকার কী? ল্যু পাকিস্তান থেকে বাইডেনের জন্য কী নিয়ে গেলেন? নিজের তৈরি প্রধানমন্ত্রীকেই যদি স্যাংশন আরোপের ভয় দেখায়ে নিয়ন্ত্রণ করতে হয় তাহলে ল্যু ভাইয়াটা কার কে??? কায় না মাথায় দেয়? হা হা হা।
সেই ল্যু ভাইয়া এখন ঢাকায়; আমাদের যে কী মজা লাগছে তা আর কী বলব!!!! নিশ্চয় তিনি তাঁর ক্যারিসমা দেখাবেন, সব মুসকিল আসান করবেন! আমরাও প্রীত হবই!
লেখকঃ
গৌতম দাস, রাজনৈতিক বিশ্লেষক
goutamdas1958@hotmail.com
[এই লেখা কোন নিউজ নয়, ব্যক্তির নিজস্ব রাজনৈতিক বিশ্লেষণ মাত্র। ফলে পাঠকের এ’লেখা পড়ে কিছুই বহন করা বা মান্য করার বাধ্যবাধকতা নাই। কেবল জানলেন যে এমন একটা মতামত আছে!]
আপডেটঃ এপ্রিল ২০২৪ সন্ধ্যা

