“জনগণতন্ত্রী” কনষ্টিটিউশন সংস্কার কমিটি
গৌতম দাস
১৬ জানুয়ারি ২০২৫ রাত আটটা
https://wp.me/p1sCvy-6dV
গতকাল কয়েকটা সংস্কার কমিশন তাদের রিপোর্ট ইউনুস সরকারের কাছে জমা দিয়েছে। প্রায় তিন মাস আগে সেপ্টেম্বরে ইউনুস (প্রথম পর্যায়ের) যে ছয়টা কমিশন গঠন করেছিলেন তাদেরই অনেকে গতকাল এমন রিপোর্ট জমা দিয়েছেন। এগুলোর মধ্যে আলী রীয়াজের নেতৃত্বে গঠিত হয়েছিল সংবিধান সংস্কার কমিশন, এরা তাদের একটা।
“সংস্কার কমিশনের প্রধান অধ্যাপক আলী রীয়াজ বিবিসি বাংলাকে বলেন, সংস্কারের প্রস্তাবনা তৈরি করার ক্ষেত্রে ক্ষমতার এককেন্দ্রীকরণ রোধ, ভারসাম্যপূর্ণ বণ্টন, জবাবদিহিতা, রাষ্ট্র পরিচালনায় সবার প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করার মত বিষয়গুলোকে বিবেচনায় নিয়েছেন তারা”। এই বাক্য থেকে আমরা একটা ধারণা করতে পারি পারে যে তাদের কাজের মূল উদ্দেশ্য-লক্ষ্য কী ছিল!
অনেক মিডিয়ার ভাষ্য অনুসারে, সংস্কার এর উল্লেখযোগ্য সুপারিশ মূলত ছয় টাঃ
উল্লেখযোগ্য সুপারিশ
• ‘গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ’ পরিবর্তন করে ‘জনগণতন্ত্রী বাংলাদেশ’।
• পাঁচ মূলনীতি হলো সাম্য, মানবিক মর্যাদা, সামাজিক সুবিচার, বহুত্ববাদ ও গণতন্ত্র।
• দ্বিকক্ষবিশিষ্ট আইনসভা, সংসদের মেয়াদ ৪ বছর।
• নিম্নকক্ষে ১০ শতাংশ আসনে তরুণ-তরুণীদের মধ্য থেকে প্রার্থী। ২১ বছর হলে প্রার্থী হওয়া যাবে।
• অর্থবিল ছাড়া নিম্নকক্ষের সদস্যরা দলের বিপক্ষে ভোট দেওয়ার পূর্ণ ক্ষমতা থাকবে।
• নারী আসনেও সরাসরি ভোট।
যার মধ্যে আবার একটা দেখা যাচ্ছে দ্বিকক্ষবিশিষ্ট আইনসভা।
এখন কথা হচ্ছে এক. দ্বিকক্ষবিশিষ্ট আইনসভা জিনিষটা কী ও কেন?
মানে প্রচলিত জাতীয় সংসদ ছাড়াও আরও একটা ভিন্ন নামে ও পদ্ধতির আলাদা সংসদ। আমেরিকাকে অনুসরণ করলে সাধারণত এর নাম হয় সিনেট। সংস্কার কমিশন কী সিনেট বুঝিয়েছেন? এটা একেবারেই স্পষ্ট নয়। বরং যার যা খুশি ভাবে ব্যাখ্যা পাবার সম্ভাবনাই বেশি। এমনিতেই সাধারণভাবে বললে এই সংস্কার প্রস্তাবে অনেক কিছুই সংস্কার করে তাঁরা নয়া কী করতে চায়, নয়া রূপ কী দিতে চায় ইত্যাদি এনিয়ে অনেক সুপারিশই আছে। কিন্তু যা নাই তা হল সাফাই বা জাস্টিফিকেশন যে কেন এভাবে সংস্কার? এই জবাবটা প্রায় নাই-ই। এতে সংস্কারের সব কথাই খেয়াল [whim] এর কারবার মনে হতে পারে! কারণ, যেকোন সংস্কার সেটা এভাবে কেন – এই কেন এর জবাব সহ না ব্যাখ্যা বা সংস্কারের প্রস্তাব না করলে সেটা হুইম বা খামখেয়ালি, চটকদার বাক্যবাগীশতাই হয়ে দাঁড়াবে!
এছাড়া দ্বিতীয় কথা টা হচ্ছে, যেসব সুপারিশ করা হয়েছে এর প্রতিটা কীভাবে এই সংস্কার কমিটির লক্ষ্য-উদ্দেশ্য [সেটা যদি ক্ষমতার এককেন্দ্রীকরণ রোধ, ভারসাম্যপূর্ণ বণ্টন, জবাবদিহিতা, রাষ্ট্র পরিচালনায় সবার প্রতিনিধিত্ব ধরে নেই] এর সাথে ও কেন সামঞ্জস্যপুর্ণ? সেটা কী সংস্কার কমিটি ব্যাখ্যা করা দরকার ছিল; ফলে পাঠক এর অভাব বোধ করবে। যদি উদ্দেশ্যের দিকে লক্ষ্য রেখে তাঁরা যথেষ্ট সাফাই-মূলক বক্তব্য না দেন তবে এই সংস্কার কমিটি খামোখা হয়ে দাঁড়াতে পারে।
তাই এসব প্রস্তাব দরকার কেন, সেই কেন এর জবাব সহঃ
কথাটা সোজা আপনি এমন বা অমন যেকোন সংস্কার প্রস্তাব তো করতেই পারেন। কিন্তু সেটা অর্থপুর্ণ কিনা গুরুত্বপুর্ণ কেন এর জবাব পাবলিককে পেতেই হবে।
যেমন, এব্যাপারে সবচেয়ে গুরুত্বপুর্ণ ইস্যু হল সিনেট বা দ্বিকক্ষ আইনসভা কেন!
এমনিতেই কমিটির সদস্যরা কে কতটা “সিনেট” বিষয়ে স্টাডি করে নিয়েছেন তানিয়ে আমার ধারণা নাই বা জানা নাই। কারণ, ইস্যুটা যথেষ্ট গভীর, গম্ভীর ও সুনির্দিষ্ট। যেমন দুনিয়াতে সিনেট ধরনের আইনসভা বা পার্লামেন্ট থাকা রাষ্ট্র বলতে এর সফল ও পরীক্ষিত ধারণার রাষ্ট্র হল আমেরিকা; মানে ১৭৭৬ সালের স্বাধীন ঘোষিত আমেরিকা [USA, United States of America]। বলাই বাহুল্য যে আমেরিকা এটা এক রিপাবলিক স্টেট এর ধারণা এর উপর এটা আসলে আবার এক ফেডারল [Federal] স্টেট এর ধারণা। ফেডারল এর বাংলা অর্থ হতে পারে একই ধরনের ও সমমর্যাদাপুর্ণ বন্ধু রাজ্য; ফলে – এমন রাজ্যগুলোর রাষ্ট্রই হল ফেডারল (রিপাবলিক) রাষ্ট্র। যেমন আমরা জানি আমেরিকা স্বায়ত্বশাসিত এবং আলাদা এমন সমমর্যাদার ৫০টা রাজ্যের এক ফেডারল (রিপাবলিক) রাষ্ট্র।
এখন ফেডারল রাষ্ট্র হলেই সেখানে সিনেট বলে আলাদা বা দ্বিকক্ষ সংসদের ধারণা থাকতে দেখা যায়। অন্যভাবে বললে, ফেডারল আর সিনেট ধারণা – এদুইয়ের আন্তঃসম্পর্ক টা কী? সংস্কার কমিটি কী এদিকটা নিয়ে নিজেদের মধ্যে আলোচনা করেছেন?
মনে রাখতে হবে শেখ মুজিবও একটা বাংলাদেশকে ৬১ জেলায় বিভক্ত মানে ৬১ টা গভর্ণর শাসিত জেলার বাংলাদেশ ঘোষণা করে গেছিলেন! যার উদ্দেশ্য ছিল কথিত কমিউনিস্ট সংস্কার নামের আড়ালে সবক্ষমতা একেবারে একহাতে কুক্ষিগত করা! কাজেই সব সংস্কার মানেই তা কাজের এবং অর্থপুর্ণ – সেটা নাও হতে পারে!
আর সংস্কার কমিটির লক্ষ্য যদি হয় ক্ষমতার এককেন্দ্রীকরণ রোধ, ভারসাম্যপূর্ণ বণ্টন, জবাবদিহিতা, রাষ্ট্র পরিচালনায় সবার প্রতিনিধিত্ব ইত্যাদি – তবে অতি অবশ্যই এই কমিটিকে বাংলাদেশে একটা সিনেট বা দ্বিকক্ষ আইনসভা কেন দরকার সেই ন্যায্যতা প্রতিষ্ঠা করতেই হবে। এমন প্রমাণ চিহ্নও যেখানে থাকবে!
ভয়ের কথা আরো আছেঃ
ওদিকে ইউরোপ কখনই ফেডারল ধারণাকে গ্রহণ বা প্রশংসা করে নাই বা নিজেরা ব্যবহার করে নাই। বিশেষ করে যারা সারা দুনিয়ায় “কলোনি দখলদার” রাষ্ট্র (বৃটিশ, ফ্রেঞ্চ, ডাচ, স্প্যানিশ বা পর্তুগীজ) বলে পরিচিত। যারা অন্যের দেশ-ভুখন্ড দখল করাটা, লুটের শাসন করাটা জায়েজ মনে করে তারা কীভাবে নিজ ভুখন্ডের মধ্যে ফেডারল শাসন দরকার মনে করবে, দিতে চাইবে? খুব সম্ভবত এটাই ইউরোপের ফেডারল ধারণা গ্রহণ না করার কারণ! আবার আমরা এই -ঐতিহাসিক সত্যও ভুলতে পারিনা যে দুনিয়াতে রাজতন্ত্রের বিপরীতে পাবলিক বা গণপ্রজাতন্ত্রী শাসন ও সরকার ব্যবস্থা ইউরোপেই (ইংল্যান্ডে) প্রথম শুরু হলেও সেই রিপাবলিক রাষ্ট্রশাসন ব্যবস্থা এর অর্থনৈতিক ভিত্তি ছিল “কলোনিদখল” – নানান ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি – মানে ব্যবসায়িক কোম্পানী খুলে জাহাজ ভাসিয়ে এবার কলোনিদখল ও তাদের সম্পদ লুটপাট! আর এটাই ছিল রিপাবলিক রাষ্ট্রের প্রধান অর্থনীতি!
আরেকটা মজার তথ্য হল, আমেরিকা যখন নিজেদেরকে বৃটিশ কলোনিদখলকে (কোম্পানি) উচ্ছেদ করে নিজেরা স্বাধীন হচ্ছে শুধু নাীর সাথে নিজেদের নয়া রাষ্ট্র গড়ছে এক ফেডারল (রিপাবলিক) রাষ্ট্রকাঠামোতে তখনও ইউরোপ মেতে আছে কলোনিদখলের অর্থনীতির উপরে দাঁড়ানো এক জাতিরাষ্ট্রের রিপাবলিক হয়ে! অর্থাৎ আমেরিকা থেকে পিছিয়ে পড়ে ও বেখবর থেকে গিয়ে!
অথচ এখনও আমাদের দেশে নাদানি তর্ক হল আমরা কী ওয়েস্ট মিনিস্টারি বা প্রেসিডেন্সিয়াল সরকার কাঠামো চাই!
অতএব আমার সন্দেহ আছে সংস্কার কমিটি কী ভেবে, কতদূর ভেবে দ্বিকক্ষ আইনসভা এর সুপারিশ জানিয়েছে? যদি তারা কেন এই সুপারিশ – এর জবাব সহ পরিস্কার সুপারিশ রাখতে পারে বা করে তখন আমাদের তাদের কথা বা ব্যাখ্যা থেকে তাদের ভাবনা বুঝতে পারতাম! আমরা নিশ্চয় আশা করি না, দ্বিকক্ষ আইনসভা এর সুপারিশ এটা কোন চটকদারি বকোয়াজ হোক!
সমস্যা অনেকঃ
আমাদের সমস্যার শেষ নাই! গত শতকের শেষ চল্লিশ বছরের (১৯৭০-২০০০) কথাই যদি বলি আমরা সেটা সহ এই নয়া শতকে প্রথম দশকের পরেই কেবল এমন এক ভাবনা ত্যাগ করে খুবই ধীরে ধীরে বের হচ্ছি – যা প্রগতিশীলতা, কমিউনিজম নামে পরিচিত। আর ঐসময়কালের এমন চিন্তায় সমাজে তখন গণ্য হয়ে এসেছিল যে প্রগতিশীলতা, কমিউনিজম নাকি সবচেয়ে অগ্রসর চিন্তা। অথচ গভীর সমস্যা টা হল, কমিউনিজম তাদের রাষ্ট্র চিন্তায় বা ভোকাবুলারিতে কোন রিপাবলিক ধারণা নাই; বিচারের [Justice] ধারণা নাই! আছে কেবল শ্রেণী বা শ্রেণীর একনায়কতন্ত্র এমনকি কথিত শ্রেণীস্বার্থে গুম-খুন-অপহরণ কে জায়েজের ধারণা! যার ফলে, আমাদের সংস্কার কমিটিগুলোতেও কমিউনিস্ট বা প্রগতিশীল চিন্তাই এখনও (ডমিনেটিংলি) আধিপত্য করে আছে, থেকে আছে! যার সোজা মানে যে রিপাবলিক রাষ্ট্রের আলাপ-সংস্কার এরা করতে এসেছেন তাতে তাতে প্রগতিবাদিতা আধিপত্যে; উলটা করে বললে এটাই রিপাবলিক-ফেডারল বোধ বা এমন রাষ্ট্রবোধ ততটাই কম! আপনি তো একই সাথে শ্রেণীর রাষ্ট্র-বোধ আর রিপাবলিক-ফেডারল বোধ (ডানপন্থি) এদুটা একসাথে অনুসারী হতে পারবেন না। এমনকি যেখানে প্রগতিবাদী এরা রিপাবলিক, ফেডারল বা সংসদ ইত্যাদির ধারণাকে তারা “ডানপন্থী” বা নিচা ধারণা বলে শিখে বিশ্ববিদ্যালয় পার করেছে! এর উপর আবার একালে যখন প্রগতিশীলতা মানে তা আর লুকানো নাই, প্রায় খোলাখুলিই হিন্দুত্ববাদ হয়ে গেছে!
আবার যেমন ধরেন ভারতের রাজ্য সভা – এটা কী ফেডারেলিজম মানে ফেডারল রাষ্ট্র ব্যবস্থা? কারণ, অনেকেই সাফাই দিতে পারেন যে ওটাও তো দ্বিকক্ষ ব্যবস্থা!!!! তাহলে আমাদের সংস্কার কমিটির প্রস্তাবিত “দ্বিকক্ষ” এটাও কেন রাজ্যসভা ব্যবস্থা নয়? ইন্ডিয়ান হেজিমনি ফিরিয়ে আনার যে মরিয়া চেষ্টা চলছে যাতে আমাদের অনেক রাজনৈতিক দলও এতে সামিল হয়ে গেছে এরা কী আমাদের সংস্কার কমিটির প্রস্তাবিত “দ্বিকক্ষ” প্রস্তাব – এটাকে রাজ্যসভা ধরনের দ্বিকক্ষ-ব্যবস্থা বলে চালিয়ে দিতে মাঠে নেমে যাবে? কারণ, আমাদের এমন অনেক দলের সংস্কার প্রস্তাবেও দ্বিকক্ষ আইনসভা করার কথা আছে!
আবার আরেক তথ্য হল, ইন্ডিয়া, বাংলাদেশ ও পাকিস্তান এই তিন দেশের মধ্যে একমাত্র পাকিস্তানেই দ্বিকক্ষ বা “সিনেট” ব্যবস্থা বিদ্যমান। এর জন্ম বাবা-ভুট্টোর আমলে সেই ১৯৭৩ সালের কনষ্টিটিউশন লেখার সময়ে। আর যদিও পরে সময়ের সাথে এর সদস্য সংখ্যা বাড়ানো হয়েছে এখন ১০০ এর কাছাকাছি। কিন্তু হতাশার কথা হল এটা অকেজো, খামোখা হয়ে আছে!!! এটা খায় না মাথায় দেয়, সেটা জানা নাই এমনই অবস্থায়!
একটা দুঃখ আর হতাশার কথা বলে শেষ করব!
“প্রজা” শব্দটা নিয়ে সংবিধান সংস্কার কমিটি বিরাট পেরেসানিতে পরেছে, বুঝা যাচ্ছে। উপরে দেখেন লেখা হয়েছে সংস্কার কমিটি – ‘গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ’ পরিবর্তন করে ‘জনগণতন্ত্রী বাংলাদেশ’ – চেয়েছে। আমাদের অনেকের ধারণা –প্রজা– “শব্দটার ব্যবহার আমাদের করা উচিত না। আমরা কী কারো প্রজা নাকি? প্রজা মানে তো অধস্তন, সাব-অর্ডিনেট তাই! এটা খুবই পশ্চাতপদ ধারণা……ইত্যাদি ইত্যাদি!” – এমন প্রশ্নবোমা তাদের আছে!
অথচ ব্যবাপারটা হয়েছে এরকম যে কারো নাম গোলাম রহমান; তাই নিজেকে বুদ্ধিমান ভাবা কেউ বলতে চাইছেন, গোলাম – এটা কোন নাম হল? অথচ প্রত্যেক শব্দের বা অর্থের একটা পশ্চাৎ-পটভুমি বা প্রেক্ষিত থাকে; থাকে ইতিহাসও! সেসব সেগুলো না জেনে বা পাশ কাটিয়ে আমরা এমন অনেকেই ছদ্ম বুদ্ধিমান সাজতেই পারি! কী আর করা। অথচ মানুষের নাম গোলাম থাকা মানেই এর অর্থ আল্লাহর গোলাম (বা রহমানুর রহিম এর গোলাম) এমন ধারণা থেকে আসছে! কাজেই পটভুমি-ইতিহাস-প্রেক্ষিত না জেনে বুঝে এমন মন্তব্য নিজেকেই ছোট করা হবে! এরপরেও তা সমাজে হয় অনেক আসরে!
প্রজা নিজেই তেমন কান্ডই হয়েছে!
কমিউনিস্ট-প্রগতিশীলের অত্যাচারে আমরা খুব কম জনই রিপাবলিক শব্দের উতপত্তির ইতিহাস, ব্যবহার ও তাতপর্য জানি। খোদ কার্ল মার্কসই রিপাবলিক শব্দ বা এর ধারণা নিজের লেখায় ব্যবহার করেন নাই। অথচ থেকেছেন (1849-1883) ইংল্যান্ডের বৃটিশ লাইব্রেরীতে কাটিয়ে এমন এক সময়ে যখন রিপাবলিক, সার্বজনীন ভোটাধিকার এর ধারণা ইউরোপের আকার নিচ্ছে বলা যায়! সংক্ষেপে ঘটনাটা হল, যখন কোন ভুখন্ডে রাজতন্ত্র চালু আছে প্রবল দাপটে সেই সময়ে সেই রাজা-সম্রাটের শাসনের বিপরীতে মানুষ সমবেত হয়েছিল বিকল্প শাসন ব্যবস্থা কী করা যায় এনিয়ে। ফলে সে আমলে বলে রাজার শাসন বা রাজার তন্ত্রের বিপরীত ধারণা হিসাবে তারা সেকালে কল্পনা করেছিল যে এবার প্রজার শাসন শুরু করলে কেমন হয়????
যেমন তুলনা করে দেখেন, যে কোন রাজাই বলতে পারবে না যে তাকে শাসন ক্ষমতা কে দিয়েছে? এর বিপরীতে জনগণের ম্যান্ডেট-অনুমতি-ভোট অর্থাৎ জনপ্রতিনিধিরাই দেশ শাসন করবে, নির্দিষ্ট সময়ের জন্য এবং প্রজাদের অনুমতিতে! আর এটাই ছিল সেই প্রজাতন্ত্র ধারণা। এখান থেকেই ধারনা ও শব্দটা আকার নিয়েছিল প্রজাতন্ত্র হিসাবে রিপাবলিক আকারে! আজ রাজতন্ত্র নাই বলে কনটেক্সট-টা বদলে গেছে তাই বুঝতে কষ্ট হতেই পারে। আর প্রজার শাসন ধারণার আমলে পাবলিক বা জন অথবা গণ ইত্যাদি ধারণাগুলো তখনো আসে নাই বা স্পষ্ট হয় নাই, এটাও এক বড় কারণ। ফলে যাদের মধ্যে প্রজা শব্দ বদলানোর চুলকানি – বুঝতে হবে সে সম্ভবত কমিউনিস্ট আর নয়ত চটকদারি দেখানোতে পেয়ে বসেছে!
জনগণতান্ত্রিক কেন কোথা থেকেঃ
আবার জনগণতান্ত্রিক এই ধারণাটা চীনা কমিউনিস্ট প্রভাবিত! আমাদের সর্বহারা পার্টি ধরনের যারা বিশেষত চীনাধারার কমিউনিস্ট পার্টি তারাই এর বেশি ব্যবহার করে থাকে। লক্ষ্য করেন এরা মূল রিপাবলিক ধারণা থেকে অনেক দূরে আর ততটাই গণতন্ত্র ধারণায় প্রবেশ করে গেছে। অর্থাৎ রিপাবলিক বলব না গণতন্ত্র – এই বিভ্রান্তি এখানে প্রবল! সংস্কার কমিটিতেও এই বিভ্রান্তি প্রবল মনে হয়েছে। আসলে বিভ্রান্তি থেকে এর জন্ম। চীনের মাও রিপাবলিক আর গণতন্ত্রের ঝামেলা মিটাতে ব্যবহার করেছিলেন আরেক শব্দ পিপলস [Peoples]। আর এতে সবচেয়ে গুরুত্বপুর্ণ দিকটা হল, তিনি লেনিনের এবিষয়ে কী অবস্থান বা সে তর্কে না গিয়ে রিপাবলিক মেনে নিছিলেন তবে সাথে একটা বিশেষণ লাগিয়ে দিয়েছিলেন সোভিয়েত – নয়া বিপ্লবী দেশের নাম রেখেছিলেন সোভিয়েত রিপাবলিক [ইউনাইটেড সোভিয়েত সোশালিস্ট রিপাবলিক, USSR]। কিন্তু এটাই মাও এর জন্য অসুবিধাজনক কারণ চীনা বিপ্লব কোন ধরনের সোভিয়েত গড়ে গড়ে সম্পন্ন হয় নাই। [সোভিয়েত শব্দের মুখ্য অর্থ হবে প্রতিরোধ কমিটি বা আমাদের দেশের রাজনৈতিক কালচারের স্টাইলে যেটাকে আমরা সংগ্রাম পরিষদ বলে যা বুঝি, তাই।] মাও এসব ঝামেলা থেকে মুক্ত থাকতেই পিপলস শব্দের ব্যবহার শুরু করেন যেমন, তাঁর নয়া বিপ্লবী দেশের নাম পিপলস রিপাবলিক অব চায়না [PRC]। আর এখান থেকেই ওদের – আমাদের বাংলাদেশে ব্যাংক মানে কেন্দ্রিয় ব্যাংক এর সমতুল্য চীনা প্রতিষ্ঠানের নাম পিপলস ব্যাংক অব চায়না [PBOC] । তাই এখান থেকেই আমাদের চীনাপন্থিরা মাওয়ের পিপলসের বাংলা করেছিল জনগণতন্ত্র!
তাহলে, সংস্কার কমিটি কী সচেতনে চীনা ধারণার দিকেই যদি যাবেন তো পিপলস নিলেই ভাল চাইনিজ পন্থা হত হয়ত!!!!
অর্থাৎ আবার সেই ‘কেন’ এর প্রশ্ন। মানে কেন? এই কেন এর জবাব না দিয়ে কিছুই লুকানো যাবে না যে আপনারদের মনে কী চলতেছে!!! সব খামোখা হয়ে যাবে????
আর শেষে আবার সেই গোড়ার প্রশ্ন – “কেন” এমন সেই সংস্কার প্রস্তাব এনেছেন আর এতে নিশ্চয়তা কী ও কেন যে এটা ক্ষমতার এককেন্দ্রীকরণ রোধ করতে নয়া হাসিনার উত্থান ঠেকাতে পারবে-???
আসলে আপনাদের যারা নিজেদের খোলাখুলি ডানপন্থী মনে করতে পারেন না; ডরান; তারা কিছুই পারবেন না। কারণ ঐতিহাসিকভাবে রিপাবলিক গড়ার কাজটা তো বামপন্থীদেরই না; এটা ডানপন্থী কাজ!!! সাহস থাকলে চিল্লায় বলেন!
লেখকঃ
গৌতম দাস
রাজনৈতিক বিশ্লেষক
goutamdas1958@hotmail.com
আপডেটঃ দুপুর ১১ঃ ৩৪ ১৭ জানুয়ারি ২০২৫


