ডেস্ক রিপোর্টিংয়ের নামে
গৌতম দাস
১২ মে ২০২১ ভোর ৪:৫০
প্রথম আলোর মতিভাইয়েরও তাল রাখা কঠিন হয়ে যাবে। এভাবে হবে না। হুশ-জ্ঞান ওয়ালা কিছুলোক অন্তত লাগবে। এমনিতেই বাংলাদেশের মিডিয়াগুলো প্রায়শই দিকভ্রান্ত থাকে ফলে যার যেটুক সামর্থ আছে সেটুকুও নিয়েই তারা বাংলাদেশের মানুষের কাজে নিজেদেরকে লাগাতে পারে না। প্রথম আলোরও যেটুকু দক্ষতা ছিল তা উপযুক্ত দিক-নির্দেশনার অভাবে মৃত অতৃপ্ত আত্মার মত ‘ভটক রাহা হ্যায়’ মানে বেঘোরে ঘুরে মরছে যেন!
যেমন আমাদের বাংলা মিডিয়ায় /পত্রিকায় বিদেশি খবর ছাপা হওয়া মানেই একটা ত্রাস যেন। মিডিয়ার বেদিশ কর্মিগুলা নিরুপায় হয়ে এক জবরদস্ত সুবিধা তাঁরা বানিয়েছে, “ডেক্স রিপোর্ট” নাম দিয়ে। মানে কারখানাটার নাম ‘ডেক্স’ যেখানে সব কিছু বানানো যায় অথচ মেটেরিয়াল বিদেশি পত্রিকার। আর মূখ্যত যেখানে ভুলে যাওয়া হয়েছে যে এটাও তো একটা জার্নালিজমের নামেই চলছে!
বাংলাদেশে প্রো-আমেরিকান মিডিয়া কম নাই। এর সাথে প্রো-চাইনিজও থাকুক কিংবা প্রো-ইন্ডিয়ান তাও থাকুক! কী আর করা যেখানে মিডিয়াটা চলে মালিকদের অন্য ব্যবসার আয়ের টাকার উপরে! কিন্তু সে থাকারও তো একটা নিয়ম থাকতে হবে! মানে কিভাবে তারা থাকবে সেটা মুল প্রশ্ন এড়ানো যাবে না। এমনিতেই বাংলাদেশের মিডিয়ায় বিদেশি পত্রিকা থেকে তুলে আনা নিউজ প্রায় নিজের ভাষ্য বলে ছাপিয়ে দেয়ার রেওয়াজ শুরু হয়েছে, যেন তারা নিজেরাই সেগুলার মুল রিপোর্টার বা ফাস্ট রিপোর্টার। এরপর আরো আছে। “ডেক্স রিপোর্ট” মানেই তা প্রথমত কোন রেফারেন্সই ছাড়াই রিপোর্ট করার মহোতসব। “ডেক্স রিপোর্ট” এর নামে প্রথম যে এটা চালু করেছিল তার ছবি বাধিয়ে রাখা উচিত। তিনি এর একেবারেই পথ প্রদর্শক!
এছাড়াও এরপর কখনও যদি দয়া করে কখনও তাঁরা এক কোনায় লিখে যে অমুক বিদেশি ও ইংরাজি পত্রিকায় সেখবরটা দেখেছে ধরা যাক শিনহুয়া, তবু ওখানেই শেষ। সেটা কবেকার পত্রিকা, রিপোর্টের শিরোনাম কি ছিল, লেখক-রিপোর্টারের সম্পর্কে কোন বাড়তি তথ্য ইত্যাদি তা কিছুই সাথে দিবার বলার রেওয়াজ তাদের নাই। এদিকে আবার রেফারেন্স মানে যে উলটা কমা দিয়ে সুনির্দিষ্ট করে দিতে হয় কোন শব্দগুলো ওখানে বিদেশি বা অন্য পত্রিকার! না এরা মনে হয় উলটা কমার ব্যবহারই জানে না। অবস্থা এতই শোচনীয় যেটা আসলে ‘যা ইচ্চছা তাই’ করার এক জগত যেন।
অথচ দেশের ভিতরের ঘটনাবলিতে তাদেরই নিজস্ব নিউজ রিপোর্টিং যথেষ্ট স্টান্ডার্ড। যার মানে হল, তারা এই বেপরোয়া হওয়াটাকে সুবিধা হিসাবে নেন, যেন কা্রো হয়ে প্রপাগান্ডা করে দিবেন এরই কাজ এটা! আর সবচেয়ে বড় কথা “ডেস্ক রিপোর্ট” এই সেকশন কীভাবে চলবে এর স্টান্ডার্ড বা কী নীতিতে চলবে এর মা-বাপ বলে কিছু থাকতে নাই যেন।
তাই মনে হয় এটা বলার সময় পার হয়েছে, যে অনেক হয়েছে প্লিজ এবার একটু দায়ীত্ববান হন। এই বেপরোয়া, খামখেয়ালিপনা আত্মঘাতি! আসলে সমস্যাটা হল, ধরেন আপনি প্রো-আমেরিকান হয়ে থাকতে চান। সেটা হয়ত খুব সমস্যা না। কিন্তু সমস্যা হল, বুঝবেন কেমনে কী করলে সেটা প্রো-আমেরিকান হবে, নাকি না বুঝার কারণে নিজেই নিজের মাথার উপরেই বোমা মারবেন? মূল সমস্যাটা এখানে!
ভারতের এক কথিত থিঙ্কট্যাঙ্ক ফেলো (নাকি মালিক) হলেন ব্রহ্ম চেলানি। ভারতে তার দোকানের নামটা তার লেখার শেষে পরিচয়ে দেওয়া আছে এভাবে – নয়াদিল্লিভিত্তিক সেন্টার ফর পলিসি রিসার্চের স্ট্র্যাটেজিক স্টাডিজ বিষয়ের অধ্যাপক। আজকাল গ্লোবাল অর্থনীতিক নেতৃত্বের পালাবদলের যুগ, আমেরিকানেরা তাই আরো বেশি করে সংগঠিত হয়ে কাজ করার চেষ্টা করে থাকে। অনেকে আবার উতসাহি হয়ে আমেরিকানদেরকে একাজে সাহায্য করে থাকে। তেমনই এক উদ্যোগ হল “প্রজেক্ট সিন্ডিকেট“, মানে কলাম-মতামত লেখা শেয়ার করে অনেকগুলো পত্রিকায় ছাপানোর সুযোগ করে দেওয়া। এখন প্রথম আলোই দেখা যায় অনেক সময় প্রজেক্ট সিন্ডিকেট এর লেখা অনুবাদ করে ছাপে। আর তা থেকেও “ডেক্স রিপোর্ট” ঘটিত বিশৃঙ্খলা বা আত্মঘাতি হওয়া কম নয়!
যেমন “ডেক্স রিপোর্ট” সেকশনের জন্য লেখা বাছাই এক বিরাট ধাপ। যে ইংরাজি কোন পত্রিকার কোন লেখাটা অনুবাদ করতে দেওয়া হবে! যেমন প্রজেক্ট সিন্ডিকেট বা যেকোন বিদেশি পত্রিকার কোন লেখা অনুবাদ করতে হবে এটা কে বাছাই করবে। কারণ সারাদিনে যত বিদেশি লেখা প্রকাশিত হয় বা হাতে লাগে তার সবগুলো তো ছাপা যাবে না। ফলে অনুবাদ করার মানে হবে না। আবার সেসব লেখা নিজ পত্রিকার যে লাইনে আর্গুমেন্ট করে সেই তালের সাথে যায় এমন হতে হবে। লেখা বাছাই ব্যাপারটা তাই খুব এক্সপার্ট কাজ। এরপরেও ধরা যাক আপনি ভাবলেন এটা “নাম জমা দিবার” এক পদ্ধতিতে সেরে ফেলবেন। সেটা এভাবে যে ‘ডেস্ক ইনচার্জ’কে নাম জমার এক চিরকুট ধরায় দিবার ব্যবস্থা করলেন। যে এই চিরকুটের নামের লেখা হলে ছাপবেন, এই হল কন্ট্রোল সিস্টেম। কিন্তু না, এটাও কাজ করবে না!
আগেই বলেছি পালাবদলের কাল এটা। তাই আমেরিকা গত প্রায় ২০বছর ধরে নিয়মিত অর্থ ঢেলেছে ইন্ডিয়ান একাদেমিক জগতের এক অংশের (থিঙ্কট্যাংক) উপর নিয়ন্ত্রণ নিতে। যাতে সে চীন ঠেকানোর [China containment] কাজে ভারতকে ব্যবহার করতে পারে। যার কেন্দ্র আছে আমেরিকান কিছু থিঙ্কট্যাঙ্ক যারা নিজেদের সংগঠনের ভারতে এক্সটেনশন শুধু না, তাদেরকে দিয়ে ভারতের কিছু গ্রাজুয়েটদের ধরে পশ্চিমে মাস্টার্স বা পিএইচডি করতেও পাঠানোর মাধ্যমে তাদেরকে আমেরিকান পলিসির প্রবক্তা বানানো। তেমনই এক ছোট দোকান চালিয়ে থাকেন ব্রহ্ম চেলানি। দোকান ছোট আবার ফান্ড যোগাড়ের কম্পিটিশন য়াছে এলাইনে। ফলে চটকদারি হিন্দুত্বের লাইনে কড়া প্রো-আমেরিকান অবস্থানে চীনবিরোধী এক ভারতের সরকারি অবস্থান খাড়া করা নিয়ে তিনি অনেক কষ্টে নিজের দোকান টিকিয়ে রাখেন ব্রহ্ম চেলানি। তবু যেভাবেই হোক “প্রজেক্ট সিন্ডিকেট” হয়ে প্রথম আলোর “ডেস্ক” পর্যন্ত তিনি পৌছে গেছেন। নেটওয়ার্ক তাকে হেল্প করেছে। কিন্তু প্রথম আলোর ম্যানেজমেন্ট সমস্যা তাতে একেবারেই যায় নাই। বরং সবই কপাল খারাপ।
মোদী মহাশয় হিন্দুত্বের রাজনীতি দিয়ে ছেয়ে ভারত তোলপাড় করে ফেলতেছিলেন গত সাতবছর ধরে, তা ভারতের প্রথম সারির কোন ইংরাজি দৈনিকের ফরেন এফেয়ার্স এডিটরের অজানা থাকার কিছু নাই। তিনি আবার হিন্দু হয়ে প্রেমের টানে মুসলমান বিয়ে করেছেন। অথচ যার বাবা আবার বিজেপির জাঁদরেল এক নেতা-এমপি। তাই যেন তিনি আবার সকাল-বিকাল মুসলমান-বাংলাদেশকে দখল করে নিবার হুমকি দিয়ে থাকেন এমন অবস্থা। এহেন সম্পাদকের তাই বাপ থেকে দূরে গিয়ে কথিত সেকুলারজমই ভরসা করবেন এমনই হবার কথা হয়েছেও। কিন্তু কাহিনী হল সেই ফরেন এফেয়ার্স এডিটর – সেই সম্পাদকই আমরা দেখছি তিনি আবার প্রচন্ড মোদী সরকারের ও তাঁর ফরেন পলিসির ভক্ত। কেন? ব্যাপারটা এমন জটিল কেন?
খুব সোজা। মোদী হিন্দুত্ব করুক বা যা খুশী সেটা সম্পাদকের চোখে সমস্যা না। কারণ মোদীর রাজনীতি যত নোংরা হিন্দুত্বই হোক মোদী নিজের এক ইমেজ খাড়া করতে পেরেছেন এই সম্পাদকের কাছে যে তিনি ভারতকে নাকি এই এক সুপারপাওয়ার প্রায় বানাইয়েই ফেলেছেন। আবার মোদীর কিছুটা শুবিধা হল সম্পাদকেরা পরাশক্তি কী অথবা তা ভাল চিনেন তাও না। কাজেই সম্পাদকেরা যদি তার হিন্দুত্বের উপেক্ষা করে দেশপ্রেমে গদ্গদ হয়ে মোদীকে সাহায্য না করেন তাহলে মোদী সফল হবেন কী করে? মোদীর এই ভাষ্য ওমন সম্পাদকেরা খুবই পছন্দ করেছেন! অতএব বাপেরবিরোধী এমন সম্পাদক যে আবার মোদীভক্ত! – এই কম্বিনেশন ঘটতে পেরেছে।
কিন্তু তারও কপাল খারাপ! কারণ, কুম্ভমেলা করে মোদী এখন করোনার সেকেন্ড ওয়েভে সবাইকে নিয়ে মাখায় ফেলেছেন, এখন ধরাশায়ী। তাঁর পরাশক্তি ভারতের গল্প এখন থার্ল্ড ওয়ার্ল্ডের ভারতে নেমে গেছে। ফলে সম্পাদকেরাও স্বপ্নভেঙ্গে হতাশ!
এদিকে কান্ড ঘটেছে একটা। আমেরিকান চেম্বার অফ কমার্স বিপদ গুনেছে। ব্লিঙ্কেনের উপ্সথিতিতে তাদের অনুমান-সিদ্ধান্ত যে ভারতের ইকোনমিতে একেবারে ধবস আসন্ন। কাজেই আগামি জুলাইয়ে ফার্স্ট কোয়ার্টারে সেটা সবাই জেনে যাবে। এর ফলে গ্লোবাল ইকোনমিতে বা ওয়ার্ল্ড ব্যাংকে খবর হয়ে যাবে। আর যা থেকে আমেরিকান ইকোনমিতে। কাজেই ইীনিয়ে আগাম কী ব্যবস্থা নেয়া যায় তা আলোচনার মিটিং ছিল সেটা। না এটা সেই “কান্ড” নয়।
কান্ডটা হল, সিএনএনের এক নারী সাংবাদিক মোদী-যোগীর উত্তরপ্রদেশের এক হাসপাতালের অব্যবস্থতায় প্রয়োজনীয় সরঞ্জামের অভাব আর অভাব, মানুষের শেষ প্রাণবায়ু কিভাবে বের হয়ে যাচ্ছে এরই এক প্রামাণ্য সচিত্র প্রতিবেদন হয়ে দাড়িয়েছে যা তিনি নিয়েছেন সেটা। দেখা যাচ্ছে যেটা ইউটিউব-ফেসবুক ছেয়ে ফেলেছে। কারণ এটা আমেরিকান চেম্বারের অবস্থানকে আরও শক্ত বা কোরাবোরেট করেছে ও সচিত্রভাবে। শুধু তাই নয় এর ইমিডিয়েট এফেক্ট হবে আরো আগাম আমেরিকান সব ব্যবসা-পুঁজি দ্রুত ভারত থেকে প্রত্যাহার। কারণ মূল ভয় এখানে, যেকোন দিন মোদী সরকারের পতন ঘোষিত হতে পারে। তাই এর আগেই সব প্রত্যাহার, পালাও পালাও রব!
কিন্তু সেই ব্রহ্ম চেলানি এবার আবার মাঠে নেমেছেন ঠিকই কিন্তু কলম ধরেছেন উলটা করে। তিনি এখন পশ্চিমা সমাজের সমালোচক এই বলে যে তারা ভিকটিম ভারতের প্রতি সংবেদনশীল না। মানে কেন সিএনএনের ঐ নারী সাংবাদিক ভিডিওও ক্লিপ প্রচার করল! অর্থাৎ তিনি এখন ভারতে আমেরিকান ব্যাবসা বা স্বার্থের এজেন্ট না। তিনি এখন হিন্দুত্বের দেশপ্রেমিক হয়ে মোদী সরকারের পক্ষে, বিদেশের বিরুদ্ধে স্বদেশী।
কিন্তু এতে প্রথম আলোর কী জটিলতায় পড়েছে? প্রথমত আমরা স্পষ্ট না সেবুঝেছেই যে সে জটিলতায় পড়েছে। কারণ চেলানি তার ঐ লেখা ছাপিয়েছে আমেরিকান স্বার্থের বিরুদ্ধে আমেরিকাকে ফেলে মোদীর পক্ষে দাঁড়িয়ে গিয়ে। কিন্তু সে যে আমেরিকান গ্লোবাল লাইনের যে ব্রহ্ম চেলানি ছিল তা সে নয়। অথচ প্রথম আলোতে ব্রহ্ম চেলানির লেখা অনুবাদ করে ছাপে তিনি তো আমেরিকান গ্লোবাল লাইনের ব্রহ্ম চেলানি।
তাহলে ডেস্ক রিপোর্টিং চালানোর সমস্যা কোথায় এর কিছুটা আমরা এখানে দেখলাম। কিন্তু কথা আরো আছে। ভারতের ভিতরেই আবার অন্য মিডিয়াগুলো সবাই কী সিএনএনের অথবা ঐ নারী সাংবাদিকেরা বিরুদ্ধে হিন্দুত্বের দেশপ্রেমে মজে থেকে রিপোর্ট করে যাচ্ছে?
একেবারেই না। ভারতের আরেক টপ মিডিয়া “দ্যাপ্রিন্ট”। তার এক রিপোর্টের শিরোনাম হল – “না ওয়েস্টার্ণ মিডিয়া ভারতের কোভিড নিয়ে পক্ষপাতের রিপোর্ট করে নাই। কেন, এখানে দেখুন” [No, the Western media isn’t biased in reporting Indian Covid. Here’s why] ০৯মে ২০২১ দ্যাপ্রিন্ট। অন্তত শিরোনাম থেকেই প্রথম আলোর বুঝা উচিত সে কী ভুল করেছে। কিভাবে তার মুখে মাটি গেছে!
এছাড়া আরো পথ ছিল যদি ধরে নেই, লেখা বাছাইটা প্রথম আলো গুরুত্বপুর্ণ মনে করে। তবে সেই বিচারে তারা একা চেলানির বায়াসড লেখা না। উপরে দ্যাপ্রিন্টের লেখাটার অনুবাদ করেও ছাপতে পারত!
গৌতম দাস
রাজনৈতিক বিশ্লেষক