এখন ভোটাধিকার, বাকস্বাধীনতা নিয়ে কথা বলার মানে কী?


এখন ভোটাধিকার, বাকস্বাধীনতা নিয়ে কথা বলার মানে কী?
গৌতম দাস
১৮ সেপ্টেম্বর ২০২৩    রাত ০৭ঃ ৫৮
https://wp.me/p1sCvy-507

Civil Rights Movement Concept Pro Vector

আমরা আজকাল অনেকে “ভোটাধিকার”, “মতপ্রকাশের অধিকার” বা “মতপ্রকাশের স্বাধীনতা” নিয়ে মানে, এসব শব্দ ব্যবহার করে কথা বলছেন বা বক্তৃতা করছেন – দেখছি আমরা। শাহবাগে বসে মিটিং-বক্তৃতা করছেন তারা – এসব খুবই কমন দৃশ্যাবলী ইদানিং আমরা দেখতে পাচ্ছি। মানে এখন আর এসব কোন নয়া জিনিষ না। আসলে হাসিনার ১৫ বছরের শাসন আমলে ভোট দেয়া জিনিষটার আর বালাই নাই; সব উঠে গেছে বলে – এজন্যই “ভোটাধিকার” শব্দটা আমরা কোন কোন কর্ণার থেকে উঠছে – এমনই মোটামুটি অনুমান করছি।

এখানে ‘ভোটাধিকার’ বলতে ‘ভোট দেওয়ার অধিকার’ – আমার ধারণা, শব্দের ব্যবহারকারীরা এটাই বুঝাতে চেয়েছেন। আর এতে মনে পড়ল ‘অধিকার’ শব্দটাও আমাদের রাজনৈতিক সাহিত্যে অত প্রচলিত কোন শব্দটা নয়। যতটা ধরা যাক, ‘প্রগতিশীল’ শব্দটা – এটা যতটা প্রচলিত। প্রগতিশীল শব্দটা বরং একটা রাজনৈতিক ধারার” মধ্যে অনবরতই ব্যবহার হয় এমন শব্দ। সে প্রসঙ্গে আসব।

ভোটাধিকার, বাকস্বাধীনতা মানে কী ও কেনঃ
এখন “ভোট” বা “ভোট দেয়া” -এই ভোট ব্যাপারটা কী আসলে? আমরা কে কবে থেকে ভোট ব্যাপারটা শুনেছি অর্থে কিছু জানি বা জেনেছি? আমার কথা দিয়েই শুরু করলে বলতে হয়, তখন আমি সম্ভবত আট বছর বয়সের আর আমার মা আর দাদি ভোট দিতে গেছিলেন পাড়ারই আরেক কোণের এক স্কুলে, এটুকু মনে করতে পারি। কারণ কিছু গোলযোগ হয়েছিল আর মা-দাদি সেটা বাসায় ফিরে এসে বিশাল আসর জমিয়ে তা বর্ণনা করেছিল আর আমরা ছোটরা আশেপাশের কৌতুহলী ঘোরাঘুরিতে যতটুকু বুঝেছিলাম আর তা আবার এখনও যতটুকু মনে আছে সেই বর্ণনা; এছাড়া তখনকার আধো আধো ধারণায় জেনেছিলাম মানে, একটা নাম শুনেছিলাম ফাতেমা জিন্নাহ। আমার মা-দাদি তাঁকেই ভোট দিয়ে এসেছিলেন। পরে একালে বইপত্র-নেট ঘেটে নিশ্চিত হয়েছি সেটা ছিল পাকিস্তানের জেনারেল আয়ুব খানের প্রথম নির্বাচন ১৯৬৪-৬৫, তবে সেটাও পরোক্ষ নির্বাচন – মানে ইলেকটোরাল কলেজ নির্বাচন যা আমাদের দেশি-ভাষায় (৮০,০০০ ডেলিগেটের) বেসিক ডেমোক্রাসির নির্বাচন। আর সে নির্বাচনেই বিরোধী রাজনৈতিক দলের দিক থেকে সম্মিলিত প্রার্থী ছিলেন ফাতেমা জিন্নাহ। মানে যিনি হলেন সম্পর্কে – পাকিস্তান জন্মের নায়ক, মূল ব্যক্তিত্ব মোহম্মদ আলী জিন্নাহ এর ছোট বোন।
বাংলাদেশ মানে সেকালের পুর্ব-পাকিস্তানের ইতিহাস ধরে এভাবে আরো পিছনে গেলে যে নির্বাচন পাই তা হল ১৯৫৪ সালে, পাকিস্তানের প্রথম সাধারণ নির্বাচন। আরো পিছনে গেলে বৃটিশ-ভারতে ১৯৩৭ ও  ১৯৪৬ সালের প্রাদেশিক নির্বাচন। মানে আমরা কলোনি-দখলদারের অধীনে থাকলেও প্রাদেশিক (রাজ্য বা প্রদেশ ওয়ারী) স্তরে নির্বাচন এর সুযোগ ঘটেছিল।  অথবা অন্যভাবে বললে ভারতের কেন্দ্রীয় সরকারের ক্ষমতা – এই মূল ক্ষমতাটাকে বাদ দিয়ে নিচের বড় জোর প্রাদেশিক সরকারগুলো পর্যন্ত ভোট-নির্বাচনের এক সীমিত ব্যবস্থা চালু হয়েছিল – সেটার কথাই বলছি। তাও এটুকু পেতেই অনেক কাঠখড় লেগেছিল মানে ১৮৫৭ সালের একটা সিপাই বিদ্রোহ লেগেছিল। আর তাতে হাজার হাজার সিপাই ও সাধারণ মানুষের আত্মত্যাগ লেগেছিল। যদি আমরা ১৭৫৭ সালের কলোনি-দখলদারদের হাতে নবাব সিরাজদৌল্লার পতনের বছরকে মনে রাখি তবে এর প্রথম ১০০ বছরে কোন ভোট-নির্বাচন কী জিনিষ আমরা অখন্ড ভারতের কেউই জানতামই না। আমাদের জানার সুযোগ হয় নাই। তবে সেই প্রথম একশ বছর এক বাণিজ্যিক (বৃটিশ ইস্ট-ইন্ডিয়া) কোম্পানির দখলে থাকা যে বৃটিশ- ভারত তা পেরিয়ে, ১৮৫৮ সালের বৃটিশ-ভারত যখন কোম্পাস্নি শাসন ছেড়ে সরাসরি বৃটিশ সরকারের শাসনের অধীনে চলে যায় এরপরেই ক্রমশ ধীরে ধীরে পরিবর্তনের এক পর্যায়ে  “রাজনীতি” শব্দটার সঙ্গে আমরা প্রথম পরিচিত হতে থাকি। এখানে সরাসরি একটা অনুসিদ্ধান্ত টেনে দেয়া যায় যে, সবার আগে একটা সমাজ-ভুখন্ডের বাসিন্দাদেরকে “রাজনীতি”  শব্দটার সাথে পরিচিত হতে হয়। আর এরপরেই কেবল ক্রমশ ভোট-নির্বাচন ইত্যাদি আনুষাঙ্গিক শব্দ ও ধারণার সাথে সেই সমাজ পরিচিত হতে পারে , আগে নয়। যেমন ১৮৮৫ সালে বৃটিশ-ভারত সরকার প্রথম কোন ভারতীয় রাজনৈতিক দল খুলার অনুমতি দিয়েছিল। মানে ১৮৫৮ সাল থেকে সরাসরি ইংল্যান্ডের বৃটিশ সরকারের অধীনে ভারত শাসিত হতে শুরু করার পরে – এবং এরপরেও আরো ২৮ বছর পরে নেটিভ ভারতীয়রা নিজের রাজনৈতিক দল খুলার অনুমতি পেয়েছিল। আর মাঝের এই ২৮ বছরে আমরা আরো কিছু ছাড় পেয়েছিলাম যেমন, পাড়ার ক্লাব, সংঘ, দাতব্য প্রতিষ্ঠান বা সাধারণভাবে যেকোন ধরণের সামাজিক প্রতিষ্ঠান (রাজনৈতিক দল বাদে) খুলবার অনুমতি দেয়া শুরু করেছিল বৃটিশ শাসকেরা।

আর বলাই বাহুল্য “রাজনীতি” এই শব্দটার ফলে অনুষঙ্গী হিশাবে ভোট-নির্বাচন শব্দ ও ধারণাটা আমরা পেয়েছিলাম। আর তা পেয়েছিলাম, ইংল্যান্ডে বৃটিশ শাসন ব্যবস্থাটা কেমন তা জেনে-দেখে, মানে আমাদের মধ্যে একেবারেই এলিট, সমাজের উপরের মাখন অংশ যারা ইংল্যান্ডে ঘুরবার সুযোগ ও ব্যয়নির্বাহের সক্ষমতা রাখতেন তারাই সরার আগে শিখেছিলেন যে, “রাজনীতি” রাজনৈতিক ব্যবস্থা, ভোট-নির্বাচন ইত্যাদি মিলিয়ে ব্যাপারটা কী ও কেমন। কেন এমন বলছি? আর এত নিশ্চিত ভাবে বলছি কী করে?

আমাদের মোগল শাসনামলে রাজনীতি, পাবলিক-জনগণ বা ভোট ইত্যাদি শব্দ ও ধারণা ছিল না, কেনঃ 
রাজার রাজ্য বা সম্রাটের সাম্রাজ্য বলতে কী বুঝব? কেমন শাসন ব্যবস্থা এটা? এনিয়ে আরও মুখ্য প্রশ্ন মানে, আসলে ক্ষমতার প্রশ্ন!  কথাটা হল, রাজা-বাদশা বা সম্রাটকে শাসন ক্ষমতা কে দিয়েছে? 
এককথায় উত্তর হল, আমরা বৃটিশ দখল ও শাসনের অধীনে যাবার আগে আমরা ছিলাম মোগল শাসনে। মানে যা ছিল একটা মনার্কি [monerchy] বা রাজতন্ত্র মানে, যেটাকে আমরা রাজা, বাদশা, সম্রাট, খলিফা, আমীর ইত্যাদি যে নামেই ডাকি এমন রাজার রাজ্য বা সম্রাটের সাম্রাজ্য – সেটা ছিল এমনই এক “রাজতান্ত্রিক” শাসন ব্যবস্থা।
এখানে একটা কথা পরিস্কার রাখার সুযোগ নিতে চাই। দুনিয়াতে কোন-না-কোন শাসন ব্যবস্থা হাজির থাকা শুরু করা মোটামুটিভাবে মানুষের সমাজবদ্ধভাবে বসবাসের শুরু থেকেই। মানে যেমন শুরুতে গোত্রভিত্তিক শাসন ব্যবস্থা থেকেই যদি ধারাবাহিকভাবে বলি তাহলে ওর পর থেকে পরে ব্যক্তিবোধ এই ধারণার উদয় (তবে শুরুতে অসচেতন উদয় হলেও পরে সেটা অনেক সচেতন উদয়) হবার পর থেকে ক্রমশ ব্যক্তিভিত্তিক শাসন শুরু হয়েছিল।  অবশ্য এর শুরুটা ছিল সাধারণত ছোটখাট রাজার রাজ্যের শাসন ব্যবস্থা দিয়ে। এভাবে একটা না একটা ধরণের শাসন ব্যবস্থা আমরা তখন থেকেই সবকালের ইতিহাসে আমরা দেখতে পাব। কিন্তু কোন একটা শাসন ব্যবস্থা থাকা মানেই তা রাষ্ট্র নয় মানে,  একে “রাষ্ট্র গড়ে শাসন ব্যবস্থা” কায়েম হিশাবে গণ্য করা ভুল হবে। কারণ রাষ্ট্র গড়তে চাইলে এর আগে সমাজে পাবলিক-জনগণ ধারণা হাজির থাকতেই হবে, যা রাজার সমাজে গরহাজির, মানে থাকে না।   সারকথায়, সমাজে একটা শাসন ব্যবস্থা থাকা মানেই সেখানে তখনও তা এক রাষ্ট্র ছিল – এভাবে এই অনুমান ভুল ও ভিত্তিহীন!  আসলে “শাসন ব্যবস্থা” মানে হল একটা শাসকের রুল [rule বা শাসন] ও রুলার[ruler বা শাসক] থাকা।   কিন্তু কোন রাজতান্ত্রিকতা [monerchy] শাসন ব্যবস্থা হলেও তা রাষ্ট্র ব্যবস্থা নয়। কাজেই শাসন ব্যবস্থা মানেই তা রাষ্ট্রীয় শাসন ব্যবস্থা তা মোটেও নয়। আর কোন শাসন ব্যবস্থাকে রাষ্ট্র-শাসন ব্যবস্থা হতে হলে সেখানে পাবলিক (public বা জনগণ) ধারণাটা থাকতে হবে। আর এরই পিছনের রুট ধারণা হল “রাজনীতি” ( politics বা পলিটিক্স) এই শব্দ ও ধারণাটাই সমাজে আবির্ভাব ও চালু থাকতে হবে। মানে রাজনীতি ধারণাটা সমাজে পরিচিত থাকলে তবেই সেখানে “পাবলিক” ধারণাটাও পাওয়া যাবে; এর আগে নয়।

লক্ষ্য করবেন কোন রাজা, বাদশা আমীর খলিফার দেশে তাই তারা শাসক কিন্তু সেখানে ‘রাজনীতি’ বলে শব্দ নাই। তাই পাবলিক বলেও কোন শব্দ-ধারণা নাই। যে কারণে মোগল শাসনের ভারতেও ‘রাজনীতি’ বা ‘পাবলিক’ ইত্যাদি এসব শব্দ-ধারনাগুলো শব্দ নাই। মধ্যপ্রাচ্যের কোন বাদশা-আমীরের দেশে ‘রাজনীতি’ বা ‘পাবলিক’ ইত্যাদি নাই –  মানুষ আছে, বাসিন্দারা আছে কিন্তু পাবলিক নাই; তাই কোন রাজনৈতিক দলও নাই।

মনার্কি আর রিপাবলিক শাসনব্যবস্থার তুলনা ও ফারাকঃ
‘রাজনীতি’ বা ‘পাবলিক’ ইত্যাদি এসব শব্দ নাই তা না হয় বুঝলাম কিন্তু  একটা মনার্কি (রাজতন্ত্র) আর রিপাবলিক শাসনব্যবস্থার মধ্যে মূল ফারাকটা কী?
আগে বলে নেই আমি উপরে যে রাষ্ট্র বা রাষ্ট্র ব্যবস্থা বলে যা লিখেছে সেটা বলতে আসলে “রিপাবলিক রাষ্ট্রে শাসন ব্যবস্থা” বুঝিয়েছিল।
এই বাক্যে লক্ষ্য করবেন re-public মানে পাবলিক ধারণাটা পরোক্ষে এনেছি আর সাথে আছে “শাসন ব্যবস্থা” শব্দটা। বহু পুরান কাল মানে, ধরেন যীশুর জন্মের আগে থেকেই সে আমলেরও আগে থেকেই একটা না একটা ‘শাসন ব্যবস্থা’ [রুল বা রুলার] আমরা দেখতে পাব। কিন্তু “পাবলিকের শাসন ব্যবস্থা” সেই প্রথম সমাজ দেখেছিল তখন। তাই এটাকে রিপাবলিক রাষ্ট্র ব্যবস্থা নামে আলাদা বৈশিষ্টে ডাকা হয়।

তাহলে কোন একটা শাসন ব্যবস্থা সেটা একটা রিপাবলিক রাষ্ট্র ব্যবস্থা বলে নিশ্চিত বুঝবার উপায় কী?
কেউ রিপাবলিক কিনা তা বুঝবার সহজ উপায় হল একে রাজতান্ত্রিক বা মনার্কি ব্যবস্থার সাথে তুলনা করে বুঝতে হবে। তবেই ভাল ভাবে বুঝা যাবে।
একটা রাজতন্ত্রে থাকে রাজা আর প্রজা (বা বাসিন্দা)। লক্ষণীয় যে যেকোন রাজার প্রজা মানে কিন্তু “পাবলিক” নয়। এর চেয়েও বড় কথা কোন প্রজাই স্বাধীন ব্যক্তি নয়। কারণ, প্রজা মানেই তো সাবঅর্ডিনেট [sub-ordinate] বা অধীনস্ত;  অথবা টেনেন্ট [tenant] বা যে শাসককে খাজনা দেওয়ার বিনিময়ে চাষাবাদের রাইট পায়; তাই সে রাজার অধস্তন। এছাড়া আরেক মূলকথা হল, রাজার সমান বা মতনই আরেক ব্যক্তি তো কোনভাবেই সে নয়ই।  বরং  রাজা-সম্রাট এরা হল শাসক আর, প্রজা হল রাজার অধস্তন ও শাসিত। অধীনস্ত কেউ মানেই সে স্বাধীন  ব্যক্তি নয়, স্বাধীন অস্তিত্ব তার নাই;  freedom, free – ধারণাগুলো তার জন্য নয়। বরং রাজার ইচ্ছাই প্রজার ইচ্ছা।
বিপরীতে রিপাবলিকেও শাসক-শাসিত থাকলেও  – মৌলিক ফারাক হল, শাসনের ক্ষমতায়। শাসককে শাসন করার ক্ষমতা কে দিয়েছে? এই হল ফান্ডামেন্টাল প্রশ্ন। যেটা উপরে কিছুটা বলেছি।
এই প্রশ্নের জবাবে রাজা মাত্রই নিরুত্তর থাকবে। জবাব দিতে পারবে না। আর নয়ত শেষে হয়ত বলে ফেলবে যে, গায়ের জোরে তিনি নিজেই  বা তাঁর পুর্বপুরুষ একসময় ক্ষমতা নিয়েছিল আর এরপর থেকে এটা ডায়নেস্টি [dynasty] মানে,  রাজার সন্তান বলে সেই রাজার মৃত্যুর পরের রাজা। অথবা আরেকটু বুদ্ধিমান কোন রাজা হলে সে দাবি করবে গড বা ভগবান তাকে ক্ষমতা দিয়েছেন – এই অর্থে তা গড় গিফটেড। আর এই মিথ্যার স্বপক্ষে স্বাক্ষ্য দিতে সে কোন পুরোহিত বা পাদ্রী ধরণের কাউকে হাজির করবে।
সারকথায় যে শাসক নিজ ক্ষমতার উৎস কী, কে দিয়েছে এর সদুত্তর, ব্যাখ্যা করতে পারে না সেই রাজা-সম্রাট।

আর এর বিপরীতে রিপাবলিকে ক্ষেত্রে এমন রাষ্ট্র মাত্রই সে বলতে পারবে আমার ক্ষমতার উৎস আমার ভুখন্ডের বাসিন্দা জনগণ বা পাবলিক। তারা আমাকে তাদের জনপ্রতিনিধি মেনেছে, নির্বাচিত করেছে; কিছু সুনির্দিষ্ট কথার উপর ভিত্তি করে ম্যান্ডেট দিয়েছে।    তারা নির্দিষ্ট সময় অন্তর (যেমন পাঁচ বছর) যাকে সম্মতি দিয়ে মানে ভোট দিয়ে তাদের প্রতিনিধি নির্বাচিত করে আমিই সেই জনগণের শাসক এবং আমি তাদের সেই ম্যান্ডেট প্রাপ্ত প্রতিনিধি হিশাবে ক্ষমতার প্রধান নির্বাহী; তা প্রেসিডেন্ট বা প্রধানমন্ত্রী। অতএব আমার ক্ষমতার উৎস জনগণ। কথাগুলো আইডিয়ালি [ideally]  মানে কী হওয়া উচিত সেই অর্থে বললাম।
আর বাস্তবের শাসক আমরা হয়ত কোথাও হাসিনা সরকারকে দেখব; সে অন্যকথা। কিন্তু অবু একটা মজার কথা হল হাসিনা অনেক চোখ উল্টানো মিছা কথা বললেও তিনি কখনও এটা বলেন  না যে তার বাবা তাঁকে শাসন ক্ষমতা দিয়ে গেছে – একটা ডায়নেস্টিক রাজতন্ত্রে যেমন হয়। অর্থাৎ এজায়গাটাই তিনি মেনে নিচ্ছেন যে শাসন ক্ষমতার উৎস জনগণ হওয়া উচিত বা হতে হবে। রাজার সন্তান রাজা এমন রাজতান্ত্রিক শাসন অন্তত তাঁর টা নয়। কিন্তু কেবল একটা জায়গায় তিনি  মিছা কথা বলতেছেন যে জনগণ তাকে জনপ্রতিনিধি বানায়েছে, তাঁর দলকে ভোট দিয়েছে – সে “রাতের ভোট” করে নাই ইত্যাদি; এগুলোই তিনি চোখ উলটানো মিছাকথা বলতেছেন।

তাই এখানে জনপ্রতিনিধি বা নির্বাচিত পাবলিক রিপ্রেজেন্টেটিভ খুবই গুরুত্বপুর্ণ ধারণা। আর এখানে আরেকটা সাবধানতা দরকার আছে। অনেকের মনে হতে পারে, জনপ্রতিনিধি বলতে সমাজের এলিটদের থেকে এলিটদের দ্বারা বেছে নেওয়া ব্যক্তিকে এমন জনপ্রতিনিধি বলে চালিয়ে দিলেই তো হয়; বিশেষ করে কোন ‘জ্ঞানী’ কিন্তু অনির্বাচিত ব্যক্তিকে!  সরি এটা অগ্রহণযোগ্য। এটা মারাত্মক ভুল। যেমন ব্যবহারিকভাবে কল্পনা করা যাক, ধরেন এটা হল কেবল ঢাকার তাও আবার গুলশান-বারিধারার এলিট লোকেরা, তারা তাদের মধ্য থেকে এমন যাকে ভোট না, হুদাই বেছে নিবেন – প্রধানমন্ত্রী ঠিক করবেন তাহলেই তো হয় – এমনই এক ধারণা। কিন্তু না , সরি। এটা ভুল। এটা এলিটের বেছে নেয়া কেউ হলে হবে না।  কারণ,  এর সঙ্গে “পাবলিক” বা ‘রিপাবলিক’ ধারণার কোন সম্পর্ক নাই। পাবলিক আর একমুঠো এলিট কখনও এককথা নয়। এছাড়া, ওপেন অবাধ নির্বাচনে তাকে জনগণের নির্বাচিত প্রতিনিধি হতে হবে।
রিপাবলিকে পাবলিক এই ধারণা আর পাবলিকের ক্ষমতা তাই এই সেন্ট্রাল ধারণা।  সেটা একেবারেই আম-আদমিকে-সহ সকল নাগরিককে আমল করে আর সবচেয়ে মারজিনালাইজড ব্যক্তিকেও তিনি কী বলেন তা শুনতে হবে, শোনা নিশ্চিত করতেই হবে। এই পাবলিক বা জনগণ ধারণা – এখান থেকেই যেমন, জন-প্রশাসন [public admin] মন্ত্রণালয়, জনস্বাস্থ্য [public health], জন-পরিবহণ (পাবলিক ট্রান্সপোর্ট), জনস্বার্থ (পাবলিক ইন্টারেস্ট) ইত্যাদি ধারণাগুলো। যেমন “জনস্বার্থে” আদালতে রীট করা সম্ভব যেটাকে পাবলিক ইন্টারেস্ট লিটিগেশন (PIL) বলা হয়। জনস্বার্থ রক্ষার্থে কোন ব্যক্তির জমি অধীগ্রহণ বা একোয়ার [acquire] করে তাকে বাজার দরে দাম শোধ করে দিয়ে ঐ ভুমিতে যেকোন পাবলিক অবকাঠামো (রাস্তা, ব্রিজ, স্টেশন ইত্যাদি) যেকোন কিছু গড়ে তোলা সম্ভব। এটাই প্রতীকীভাবে সাধারণ ইচ্ছা বা কমন ইন্টারেস্ট।

তাহলে এর সারকথাটা হল, রিপাবলিক রাষ্ট্র ধারণাটা বুঝতে গেলে তা কখনই বুঝা পুর্ণ হবে না যদি না তা এর আগের শাসন ব্যবস্থা-  মানে, আমরা কোন রাজতন্ত্রের শাসনের সাথে তুলনা করে একে না বুঝি। বিশেষ করে একালে্র প্রজন্ম যারা আমরা কোন রাজা-সম্রাটের শাসন দেখি নাই। আবার এমনও হতে পারে নাটক-সিনেমায় কোন কোন সম্রাটের শাসনের কিছু একটা দেখে তাঁর ভাল লেগে যায়। অর্থাৎ এরা কোন মনার্কি শাসন ব্যবস্থা দেখেই নাই। এমনকি এরপরের কলোনিদখল ওয়ালাদের শাসন সেটাও দেখে নাই। তা সত্বেও! কিন্তু  কেবল বড়জোর হয়ত ভোটে দেয়া দেখেছে। আবার রাজনীতি বলে কী জানি একটা আছে দেখেছে। আর ধরে নিয়েছে ওমন একটা সম্রাটের শাসন ফিরিয়ে আনলে সমস্যা কী???  তাদের জন্য কোন রিপাবলিক রাষ্ট্র সম্পর্কে বুঝাবুঝি এবং পাবলিক  – এই ধারণাটাকে বুঝা  কেন গুরুত্বপুর্ণ তা উপলব্দি করা খুবই জরুরি এবং তা করতে হবে রিপাবলিক ধারণা বা স্বাধীন ব্যক্তি ও তার অধিকারের ধারণার আলোকে।  তবে  এমন তরুনেরা আবার ভেবেও দেখতে পারেনযে  একটা রাতের ভোটের সরকারই আপনার কাছে অসহ্য লাগছে, প্রতিবাদ করছেন! তাহলে একটা মনার্কি সহ্য করবেন কী করে???

এবার ইতিহাসের সময়কালের দিক থেকে কথা বলি, দুনিয়াতে রাজতন্ত্রের বিরুদ্ধে লড়তে লড়তে এর বিপরীতে রিপাবলিক রাষ্ট্র ধারণাটা এসেছিল। তবে এটা ইউরোপীয় অভিজ্ঞতা। আর আমেরিকার অভিজ্ঞতাটা  আরেকটু আলাদা। কমন আমেরিকান তারাও  তাদের কলোনি শাসক যারা তাদের মত সাদা ককেশিয় হলেও মূলত বৃটিশ কলোনি মাস্টারদের বিরুদ্ধে তাদেরকে লড়তে হয়েছিল সশস্ত্রভাবে আর তাতেই ১৭৭৬ সালে বিজয়ী হয়ে তবেই তাঁরা তাদের স্বাধীন রিপাবলিক গড়েছিল। আর তাদের অভিজ্ঞতার বাইরে এশিয়ার আরেক কোনের আমরা, আমাদের মত দেশগুলো কলোনিদখলদার শাসকদের কাছ থেকেই প্রথম রিপাবলিক রাষ্ট্র সম্পর্কে জেনেছিল। তবে সেক্ষেত্রে এটাকে রিপাবলিক রাষ্ট্র এই নামের চেয়ে একে নেশন স্টেট বা এক জাতিরাষ্ট্রের ধারণা হিশাবে তাঁরা জেনেছিল। তবে এটাকেই অনেকে আধুনিক রাষ্ট্র বলেও চিনে থাকে।
এখন থেকে আমি বেশি বিস্তারে না গিয়ে সংক্ষেপে মূলকথাগুলো বলে এলেখা শেষ করতে চাইব। লেখা বড় হয়ে যাচ্ছে তাই; তবে পরে লেখা আরো বিস্তার করব কেমন সাড়া পাওয়া যায় সেই সাপেক্ষে!

ইউরোপে প্রথম রিপাবলিক প্রতিষ্ঠাঃ
সময়কাল হিশাবে বললে ইংল্যান্ডের ক্রমওয়েলের বিপ্লব [Cromwellian revolution] যেটাকে ইংলিশ সিভিল ওয়ার (১৬৪২-৫১) বলা হয়; তা সংগঠিত হয়েছিল রাজাকে উতখাত করে একটা রিপাবলিক প্রতিষ্ঠার চেষ্টা হিশাবে। যদিও ক্ষমতাদখল সম্পন্ন হলেও একটা থিতু ব্যবস্থা হয়ে তা টিকতে পারে নাই; ফেল করেছিল।  সাধারণভাবে সারা ইউরোপের রিপাবলিক প্রতিষ্ঠার সবগুলো প্রথম প্রচেষ্টার মত এটাও ফেল করেছিল। মানে রিপাবলিক প্রতিষ্ঠা করেই টিকাতে বা থিতু হতে পারে নাই। রাজতন্ত্র আবার ফিরে এসেছিল। ফরাসী দেশে এসেছিল ১৭৮৯ সালের বিপ্লবের পরে। আর আগেই বলেছি আমেরিকার ক্ষেত্রে সেটা ১৭৭৬ সালে। যদিও ইউরোপ জুড়ে, রিপাবলিক প্রতিষ্ঠার চিন্তা তা দানা বাধা, পোক্ত হওয়ার সামাজিক তর্কাতর্কি মোটাদাগে সেটা ১৬০০ সালের পর থেকেই শুরু হয়েছিল। আর একটা নোক্তা দিয়ে রাখি (বিস্তারে যাব না এখন) যেটাকে আমরা কলোনিদখল বলে চিনি মানে যেটা আসলে সেকালের মত কোম্পানি বানিয়ে জাহাজ ( যুদ্ধজাহাজ ও দেশ দখলের উপযোগী) কিনে এরপর  কলোনিদখল ব্যবসায় নেমে যাওয়া – সেটাও শুরু হবারও কাল। প্রথম এমন দখল অভিযান ছিল ১৬০৭ সালে, আজকের আমেরিকার ভার্জিনিয়া রাজ্যের জেমসটাউন [Jamestown, Virginia]। কিন্তু কেন  রিপাবলিক প্রতিষ্ঠার আলাপের মধ্যে এসব কথা কেন তুললাম?

কারণ, রিপাবলিক প্রতিষ্ঠা নিশ্চয় খুবই ভাল কাজ একটা, অন্তত রাজতন্ত্রের বিরুদ্ধ বিবেচনায়। কিন্তু ওর সবচেয়ে কালো দিকটা হল নিজে রিপাবলিক প্রতিষ্ঠার লড়াই করছে ঠিকই কিন্তু বিপরীতে আমাদের মত দেশগুলোকে একই সাথে জাহাজ কোম্পানি খুলে কলোনিদখল শুরু করেছে। এটাই ছিল সেকালের ইংল্যান্ডের প্রধান ও সবচেয়ে প্রফিটেবল ব্যবসা। কথাটা আরো সোজা করে বললে, ইউরোপের এমন আসন্ন রিপাবলিক রাষ্ট্রগুলোর অর্থনৈতিক ভিত্তি ছিল কলোনিদখল ব্যবসা – একথাটাও আমাদের মনে রাখতে হবে। তবু এভাবেই পশ্চিমাদেশে প্রথম রিপাবলিক প্রতিষ্ঠা ঘটেছিল। পরে অখন্ড ভারত কলোনিদখল হয়ে গেলে রাজা রামমোহন রায় এর গুরুত্ব প্রথম আমল করেছিলেন বলে মনে করা হয়।

কিন্তু পরাজয়ের একটা কালো দাগঃ
রিপাবলিক প্রতিষ্ঠা কথাটা যত মহান কিছু মনে হয় এর প্রথম রূপটা তেমন মহান থাকে নাই। মানে হিন্দু দেবতা শিব গড়তে গিয়ে কারিগর বানর বানিয়ে ফেলা যেন!  রিপাবলিক প্রতিষ্ঠা ধারণার ব্যবহারিক রূপ হয়ে গেছিল  – আমরা একটা জাতি এমন একটা নেশন স্টেট বা জাতি-রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করার কাজ যেন তা। অথচ আমরা কেউ কোন এথনিক জাতি কিনা সেটা তো রিপাবলিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার লক্ষ্য উদ্দেশ্য ছিল না। কেন এমন হয়েছিল সেসব বিস্তারে এখন যাব না; তা আরেকটা পরের ভার্সানে বা বিস্তারিত লিখব। এই পরিণতির সারকথাটা হল রিপাবলিক প্রতিষ্ঠা মানে হয়ে যায় জাতিরাষ্ট্র। মানে বাঘ হয়ে যায় বিড়াল!! তবে আমার এই কথার স্বপক্ষে এখন কেবল একটা ক্লু বা কিছু চিহ্ন দিয়ে যাব। প্রফেসর আব্দুর রাজ্জাক এর নাম অনেকেই শুনেছেন; যাকে শিক্ষকদের শিক্ষক বলেন অনেকে।  যত প্রগতিবাদী কুতুব আছেন – রেহমান সোবহান , আনিসুজ্জামান থেকে  যারা ১৯৮০ সালে বিশ্ববিদ্যালয়ে সেকেন্ড ইয়ারে ছিলেন এই অর্থে যারা কমবয়েসী কিন্তু একালে বুদ্ধিবৃত্তিক কথা বলেন এমন সকলেই প্রত্যক্ষ-পরোক্ষে যার প্রভাবে গড়ে উঠেছেন। আর আহমদ ছফা যাকে নিয়ে যদ্যাপি আমার গুরু রচনা করেছেন। তবে আমার নিজের কানে শোনা আশির দশকে প্রগতিশীল জগত তাঁকে একজন মুসলিম লীগার বলে তুচ্ছ করতেন।  সেই প্রফেসর আব্দুর রাজ্জাক সবসময় নেশন স্টেট বলতেন, তার রচনা পড়ে দেখতে পারেন। যা অবশ্যই ঠিক কোন রিপাবলিক প্রতিষ্ঠা তো নয়ই!
আসলে আমার কথা সেদিকেও নয় তাই সেদিকে আর এখন যাব না। আমি আসলে নজরে আনতে চাচ্ছি যে প্রফেসর আব্দুর রাজ্জাক এর সেটা জাতিরাষ্ট্র ধারণা মানে,  সেটা কোন জাতীয়তাবাদ বা জাতীয়তাবাদী রাষ্ট্র ধারণা কিন্তু নয় কিন্তু তা আমাদের মনে রাখতে হবে। কেন?

জাতিরাষ্ট্র আর জাতীয়তাবাদী রাষ্ট্র এদুইয়ের ফারাক কীঃ
 অনেকেরই ধারণা জাতিরাষ্ট্র আর জাতীয়তাবাদী রাষ্ট্র  হয়ত একই কথা। চাইকি অনেকে মনে করতে পারেন  – জাতীয়তাবাদ শব্দ এটা তো অগ্রসর মানে প্রগেসিভ ধারণা!!! তাই এটা আরো ভাল!! কিন্তু  কারা এরা?
বলাই বাহুল্য এই প্রগেসিভ [Progressive] এরাই মূলত প্রগতিশীল! যাদেরকে আরেকভাবে কমিউনিস্টদের লিবারেল ভার্সান বা আগমনি গান গাওয়া ছোটভাই মনে করা যেতে পারে।  তবে জাতিরাষ্ট্র ধারণাটা কেন বদলে গিয়ে জাতীয়তাবাদী রাষ্ট্র হলে গেছিল সে বিস্তারে এখন যাব না। কেবল বলব এটা প্রগতিবাদী চিন্তার দৌরাত্ম বা দুর্দশা! পাঠক নিজেও খুঁজে দেখতে পারেন।

তবে কথা এখন অন্যদিক থেকে শুরু করব। উপরে বলেছি কবে ইউরোপের সকল রাষ্ট্র রিপাবলিক রাষ্ট্র হতে চেয়ে বাস্তবে তা জাতিরাষ্ট্র হয়ে গেছিল? আর এভাবে জাতিরাষ্ট্র -কেই যেন রিপাবলিক প্রতিষ্ঠা একই বলে মনে করা শুরু করেছিল? কিন্তু এরও তো একটা শেষ আছে। অর্থাৎ কখন সারা পশ্চিম ইউরোপ জাতিরাষ্ট্র গড়া শেষ বা একাজকে ফুলস্টপ বলে দিয়েছিল??  এর জবাবঃ  সেটা কে বলা যায় ১৯৪৫ সালের পরে। আরো সুনির্দিষ্ট করে বললে, ১৯৫০ সালে ইউরোপের ৪৭টা রাষ্ট্রের এক সম্মেলন ডেকেছিল। সেটার নাম কাউন্সিল অফ ইউরোপ [Council of Europe – CoE].। আগ্রহীরা বিশেষ করে আইনের ছাত্রেরা এটা নিয়ে ঘাটাঘাটিতে গভীরে যেতে পারেন!  তবে সাবধান এর সাথে ইইউ [EU] বা ইউরোপীয় ইউনিয়নের কোন সম্পর্ক নাই, একই নয়। সেই সম্মেলন থেকেই ৪৭টা ইউরোপীয় রাষ্ট্র নিজেদের জাতিরাষ্ট্র এই জাতি-ভিত্তি থেকে সরে গিয়ে নিজ নিজ রাষ্ট্রকে নয়া এক অধিকারভিত্তিক রিপাবলিক রাষ্ট্র করে গড়ে নিয়েছিল। আর তা কার্যকর হয়েছিল ১৯৫৩ সাল থেকে। কিন্তু তামাশার কথা হল যখন ইউরোপ অতিষ্ঠ হয়ে ওদের জাতিরাষ্ট্র ধারণাকে ছুড়ে ফেলে দিল আর সেসময়েই তাদের সেই ছুড়ে ফেলে দেয়া  ধারণাকেই আমরা কুড়িয়ে নিয়েছিলাম। অথচ আমরা কলোনি-মুক্ত হয়ে নিজেদেরকেই সেই জাতিরাষ্ট্র  হিশাবে গড়তে গর্তে ঢুকে গেছিলাম – যে গাড্ডার মধ্যে আমরা এখনও আছি। কোন ধর্মীয় জাতিরাষ্ট্র শ্রেষ্ঠ নাকি উগ্র হিন্দুত্ববাদ-ই আনপ্যারালাল সবার উপরে এর তান্ডবকালে আছি আমরা

প্রগতিশীলতা কোনভাবেই আধুনিকতা নয়ঃ 
কেন আধুনিকতার মধ্যে প্রগতিশীলতার কোন স্থান নাই, সম্পর্কিত চিন্তাই নয় – এনিয়ে কালকে আরেকুটা লেখা আলাদা করে দিবে। তাই এখানে সেদিকে যাচ্ছি না। কেবল সিদ্ধান্তটা ব্যবহার করব।
তাই স্পষ্ট করে বললে, প্রগতিবাদিরা ঠিক রিপাবলিক প্রতিষ্ঠার আগ্রহ নয়।  এদের কী করে চেনা যাবে?  একেবারেই সোজা। যারা রাষ্ট্র কী বা রিপাবলিক প্রতিষ্ঠা কী তা বুঝতে বা বুঝাতে একেবারেই আগ্রহী নয় – এরাই প্রগতিশীল।   এরা সম্পর্কটাও ধরতে পারে মনে হয় না। সবচেয়ে বড় কথা এদের আরেক প্রিয় কিন্তু অর্থহীন শব্দ ও ধারণা আছে সেকুলার। তামাসাটা হল, এটা রিপাবলিক  এই মুখ্য লক্ষ্যের ধারণাই বুঝল না, নিজে এর আমল-যোগ্য হল না । অথচ অবুঝ-নাবুঝ সেকুলার আর  জাতিয়তাবাদ শব্দের জপ শুরু করে দিল।
কেন এমন হয়ে গেল তারা? কারণ এরা মূলত প্রথমে ছিল হিন্দু জাতিবাদের সমর্থক যারা সত্তর দশকে এসে নিজের হিন্দুত্ব আড়াল করতে সেকুলার আর জাতিয়তাবাদ নিয়ে এসেছিল। এরা ক্লাসিক সেকুলারিজমের (১৬৪৮) কেউ নয়, এরা উপরে পালক লাগানো সেকুলার। এদেরকে চিনবার সবচেয়ে সহজ উপায় হল, এরা মনে করে কনষ্টিটিউশনে সেকুলার শব্দটা লিখে সেকুলার হতে হয়। যেটা কার্যত মুসলমান বিদ্বেষ। কথ্য ভাষায় বললে মুসলমান কোপানোর স্পৃহা! আর পরে এদেরই আড়াল ভাঙ্গা রূপ্টাই হচ্ছে মোদির বিজেপি – উগ্র হিন্দুত্ববাদ। বাংলাদেশে এটাই প্রগতিশীলতা! যা ইউরোপের প্রগতিশীলতা থেকে অল্প ফারাকের হয়ত!

কথা আরো আছেঃ

কমিউনিস্ট চিন্তা বা তাদের ভোকাবুলারিতে
অধিকার [right] বলে কোন ধারণা নাই।

যারা এখন ভোটাধিকার বা বাক-স্বাধীনতা নিয়ে কথা বলছেন এদের অনেকেই নিজেকে পরিচয় করাচ্ছেন যে ” আমি প্রগতিশীল লেখক” এই বলে!  আগে বলেছি প্রগতিশীলতা কমিউনিস্টদের সাথে সম্পর্কিত ছোট বা ভাইরাভাই!
তামাসার কথা হল এরা একালে অধিকার নিয়েও কথা বলছে।  যেমন “মতপ্রকাশের অধিকার” বা “মতপ্রকাশের স্বাধীনতা” এসবের কথা বলছেন। কিন্তু একেবারে পরিস্কার করে দেই, কমিউনিস্ট চিন্তা বা তাদের ভোকাবুলারিতে অধিকার [right] বলে কোন ধারণা নাই। “স্বাধীনতা” [freedom] বলে ধারণাও নাই।  এসব শব্দ ও ধারণা রিপাবলিক ধারণার অনুষঙ্গি ধারনা। সমাজে ব্যক্তিবোধ এর উত্থানের পরে এ’থেকেই অধিকার, স্বাধীনতা ইত্যাদি ধারণা উঠে এসেছে। তবে পাঁড় কমিউনিস্ট বা রিয়েল প্রগতিশীল যারা এরা বুঝেন ব্যক্তিবোধ এর উত্থান –  এটাও তাদের শব্দ-ধারণা নয়।  আসলে কমিউনিস্ট বা প্রগতিশীল রাষ্ট্র ধারণা হল রাষ্ট্র মানে  শ্রেণীর রাষ্ট্র। আর তারা কেবল শ্রমিক শ্রেণীর এক একনায়ক রাষ্ট্র গড়ার সৈনিক। যার সোজা মানে তাদের চোখের বাকি সব শ্রেণী (যাদেরকে বুর্জোয়া খেতাব দিয়ে) তারা এদেরকে গুম, খুন, উঠায় নিয়ে যাওয়া, গায়েব অপহরণ, এক্সট্রা জুডিশিয়াল কিলিং সবকিছু করাই জায়েজ। [চীনে এখনও পররাষ্ট্রমন্ত্রী বা প্রতিরক্ষামন্ত্রীরও  ভাগ্যে এমনটা একালেও হচ্ছে আর হওয়াটা এই চিন্তারই পরিণতি।]
এজন্য অনেক বুদ্ধিমান কমিউনিস্ট নিরন্তর এক বিরাট দ্বিধাদ্বন্দ্বে ভুগেন এই বলে যে, একজন কমিউনিস্ট হিশাবে তিনি ১৯৭১ সালের এপ্রিলের রাষ্ট্রঘোষণায় থাকা তিন নীতি – সাম্য, ইনসাফ আর মানবিক মর্যাদা –  এটা সমর্থন করবেন কী করে? শ্রেণীর রাষ্ট্রবোধের কোন কমিউনিস্ট তো একাজ করতে পারে না।  শেষে এরা নিজের বিরুদ্ধে নিজেই চাতুরি করে তিন নীতিও ফেরি  হয়ে হাজির হয়ে থাকেন। অথচ এদের মন পড়ে থাকে তিন নীতির বিরোধিতায়!!

আসলে মূল কথাটা হল গ্লোবাল পরিসরে ১৯৪৫ সালের পরে (আমাদের এদিকে) ১৯৪৭ সালে ভারত স্বাধীন ও দুই রাষ্ট্র হয়ে যাবার পর থেকে আগের  রিপাবলিক প্রতিষ্ঠার ধারণাটাকে প্রথম জবেহ করেছিল কমিউনিস্টেরা, তাদের শ্রেণীর রাষ্ট্র-বোধ দিয়ে। এখানে একটা কথা মনে করিয়ে দেই তাহলে সবকিছু পরিস্কার হয়ে যাবে। খেয়াল করবেন ১৯৪৭ সালের পর থেকে কমিউনিস্ট জোয়ার উঠেছিল – বিশেষ করে ১৯৫৩ সাল থেকে –  যারাই  অধিকার, স্বাধীনতা, ভোট বাক স্বাধীনতা, মতপ্রকাশের স্বাধীনতার কথা তখনও বলত কমিউনিস্ট-প্রগতিশীল চোখে এদের সকলকে তারা বলত ডানপন্থী বা রাইটিস্ট।  মানে তারা হল তারা নিজেদের বামপন্থি মনে করে তাই এই সাপেক্ষে এরা ডানপন্থী। তাই রিপাবলিক প্রতিষ্ঠা বা স্বাধীনতা, অধিকারের কথা যারা বলে এরাই ডানপন্থি। আর বলাই বাহুল্য  বামপন্থী চোখে এরা নিচা চিন্তার মানুষ।  অতএব ডানপন্থিরা হল প্রগতিশীলতার বিরুদ্ধে প্রতিক্রিয়াশীল।  এমনকি একালে বিডিনিউজ২৪, এরা “অধিকার” এই মানবাধিকার সংগঠনের আদিলুর রহমানের নাম লিখার আগে বিশেষণ যোগ করে তারা লিখেছে ডানপন্থি  আদিলুর রহমান শুভ্র। কারণ সম্ভবত মানুষের অধিকার নিয়ে কথা বলা লোক তো প্রগতিশীলদের চোখে ডানপন্থী-ই!!!

তাহলে এই লেখার সারকথাটা কী? সারকথাটা হল – যারা ‘ভোটাধিকার”, “মতপ্রকাশের অধিকার” বা “মতপ্রকাশের স্বাধীনতা”, অধিকার বা স্বাধীনতা শব্দ ব্যবহার করতে চান তারা অবশ্যই তা করেন যত বেশি পারেন, অবশ্যই বক্তৃতা করেন। সেটা কড়ারই সময় এটা। কিন্তু যদি এটাই আপনার এখনকার রাজনীতিক অবস্থা হয়ে থাকেন তবে আর আপনি আর প্রগতিশীল নন। থাকেন না। একথাটা ভাল করে বুঝে নেন। আর যদি প্রগতিশীল থাকতেই চান,  ইউ আর ওপেন – তবে সেক্ষেত্রে আর  ভোটাধিকার”, “মতপ্রকাশের অধিকার” বা “মতপ্রকাশের স্বাধীনতা”, অধিকার বা স্বাধীনতা ইত্যাদি শব্দগুলো ব্যবহার বন্ধ করেন।

আসলে একটা মর্ডান রিপাবলিক রাষ্ট্র ধারণা যদি বুঝে থাকেন তবে প্রগতিশীলতার হাত ছাড়তে হবে আপনাকে। কারণ, প্রগতিশীলতার সাথে সামঞ্জস্য ধারণা হল শ্রেণীর রাষ্ট্র । আর সেটা কেমন তা তো আপনারা বানিয়েই দেখিয়েছেন। গত পনেরো বছরে বাংলাদেশ যে গুম-খুন অপহরণের রাষ্ট্র হয়ে হাজির হয়েছে সেটাই তো প্রগতিশীল রাজনীতির সমর্থনে গড়ে উঠা  শ্রেণীর রাষ্ট্রএক মুক্তিযোদ্ধা শ্রেণীর রাষ্ট্র – চেতনার রাষ্ট্র!  বাংলাদেশের বাকি অ-মুক্তিযোদ্ধা শ্রেণীকে গুম, খন, অপহরণ এর জন্য পারফেক্ট এক রাষ্ট্র – হয়ে আছে সেই থেকে। আর এটাই কী প্রগতিশীলতার সমর্থনে হাসিনার বর্তমান রাষ্ট্র-টা নয়?
এজন্যই কী ২০১৪ বা ২০১৮ সালে নির্বাচনের আগে আমরা কোন  “ভোটাধিকার”, “মতপ্রকাশের অধিকার” বা “মতপ্রকাশের স্বাধীনতা”, অধিকার বা স্বাধীনতা ইত্যাদি নিয়ে সমাবেশ বক্তৃতা দেখি নাই…??????

শেষ কথাঃ
আমাদের কোন জাতিবাদ নয়, অধিকারভিত্তিক রাষ্ট্র এর পক্ষে দাড়াতে হবে। এটাই হবে আমরা সবাই নাগরিক এই একমাত্র পরিচয় – যেখানে আপনি আর কোন জাতিবাদের সমর্থক নন; অথবা কোন পাহাড়ি জুম্মু জাতিবাদ কিনা তাও  আর নন। সব ফেলে এই ভুখন্ডের সকলেই এক পরিচয় তারা সকলেই নাগরিক। শুধু তাই না। এর চেয়েও বড় কথা  নাগরিক অধিকার এর দিক থেকে সকলের তারা সমান। কেউ সংখ্যাগরিষ্ট বলে সে একটু বেশি অধিকারের বা সামাজিক বা কালচারাল আধিপত্য যাতে সে ফেলো নাগরিক এর উপর করতে পারবেন না – এমন বৈষম্যহীন ফলে সমান অধিকারের রাষ্ট্র হতে হবে সেটাকে। সেকুলার বলে কোন ধান্দাবাজিতে হিন্দুত্ববাদ বা এর আধিপত্য কায়েমের চেষ্টা করা এখানে নিষেধএই সুযোগে ভারতের দালালিও নিষেধ।  রাষ্ট্র প্রসঙ্গে  ইত্যাদি এসব খুটিনাটি দিক নিয়ে আমাদের বিস্তর চিন্তা করতে হবে।

এটা গণতন্ত্র শব্দটাও নয়। এটা অধিকারভিত্তিক রিপাবলিক রাষ্ট্র কায়েমের কাজ।  প্রশ্ন করতে পারেন করে দেখেন, ১৭৭৬ সাথে আমেরিকায় রিপাবলিক প্রতিষ্ঠার (এক ফেডারল রিপাবলিক আমেরিকা রাষ্ট্র সেটা) পরে আরো পনেরো বছর পার হয়ে গেছিল। এরপরে আমেরিকান কনষ্টিটিউশনে ফাস্ট এমেন্ডমেন্ট  এর মাধ্যমে কেন অধিকারের প্রসঙ্গগুলো আনা হলো? সেসব নিয়ে চিন্তা করে দেখেন।  আগেই কেন ছিল না? কার্যত সেই থেকে রিপাবলিক মানে যে তথাকথিত গণতন্ত্র নয় তা অন্তত পরিস্কার হয়ে গেছিল। কাজের রিপাবলিক ধারণাতে মনোযোগ দেন, গণতন্ত্র এই বিদ্ঘুটে ধারণাটা্র সাথে একে মাখায় ফেলবেন না, প্লিজ!

এমন রাষ্ট্র যেখানে নাগরিক অধিকার বা মানবাধিকারের প্রশ্নে নাগরিকেরা সকলে সমান। এটাই হল আমরা যে যে ধরণের রাজনীতিই  অনুসরণ-চর্চা করিনা কেন সকলে এই রাষ্ট্রে সমান অধিকারের এবং আমরা প্রত্যেকের কাজেই  তাঁর যে অপর তারও আমার সমান অধিকার স্বীকার করে নেওয়া ও  প্রতিশ্রুতিবদ্ধতায় আসলে  সকলে আমরা সকলের কাছে আবদ্হধ থাকব এমন হতে হবে। এটাই আমাদের আমাদের কমন পয়েন্ট, তাতে আমাদের রাজনীতি ভিন্ন হলেও! অর্থাৎ মুসলমানদের মানবাধিকার নাই, মুসলমানে তো জঙ্গি – এসব ইতরোচিত ভাষ্যকে আমাদের পিছনে ফেলে সামনে আগাতে হবে!!! কারণ, জঙ্গি মানে অপরাধী কেউ হতেই পারে। এর জন্য আইনি প্রক্রিয়ায় অনুসরণে যা হবে তা হতেই পারে। কিন্তু তা বলে রাষ্ট্র বা আদালতের চোখে তার মানবাধিকার নাই এটা মিথ্যা। আর এটাই মুসলমানবিদ্বেষ! এখান থেকে বের হতে হবে আমাদেরকে! আমাদের কমন পয়েন্ট আমরা সকলেই নাগরিক, সকলেই সমান অধিকারের নাগরিক!  আমরা অপরের সমান অধিকার রক্ষায় প্রতিশ্রুতিবদ্ধ হয়ে এক রাষ্ট্রগঠন করতে সক্ষম হলে অনেক মেজর সমস্যা থেকে সবপক্ষই মুক্তি পাব!!!

আপডেটঃ  ১৮ সেপ্টেম্বর ২০২৩; রাত ০৮ঃ ২৮
সর্বশেষ আপডেটঃ  ১৯ সেপ্টেম্বর ২০২৩; ভোর ০৬ঃ ৩৮

লেখক : রাজনৈতিক বিশ্লেষক
goutamdas1958@hotmail.com

Leave a comment