আরব স্প্রিং – বাঘ আসছে বলে এক ভুয়া প্রপাগান্ডা
গৌতম দাস
১৯ ডিসেম্বর ২০২৩ ১৯ঃ ৫৭
Timeline: How the Arab Spring unfolded
শেষের কথা এখন শুরুতেঃ
আজ এখন ১৯ ডিসেম্বর ২০২৩ রাত পোনে বারোটা। আজ এনটিভি নিউজে দেখলাম ঢায় রাশিয়ান রাষ্ট্রদুতের একটা বক্তব্য প্রচার ও দেখানো হয়েছে। যার সারকথা হল, তিনি বলছেন রাশিয়া বাংলাদেশে বয়াসে আমেরিকার সাথে প্রভাব বিস্তারের প্রতিযোগিতা করবেন না – মোটাদাগে এই হল বয়ান। যেটা ঢাকায় ম্যানুফাকচার্ড আরব স্প্রিং সংক্রান্ত অসৎ প্রপাগান্ডা থেকে তারা সরতে চায় এমন বলে মনে হয়েছে।
প্রিন্ট মিডিয়া থেকে এখন ভোরবেলা পাওয়া বয়ানটা হলঃ
“বাংলাদেশ নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র বা পশ্চিমা বিশ্বের দেশগুলোর সঙ্গে কোনও প্রতিযোগিতা করছে না রাশিয়া। তবে পশ্চিমা দেশগুলো কী করেছে, আর কী করতে পারে, তা মস্কো তুলে ধরেছে”।
কিন্তু কী করতে পারে বলে আগাম যা ঘটে নাই তা নিয়ে এই প্রপাগান্ডার দরকার কী? সেটা আমরা বুঝতে পারি নাই। একাজটা নিজেই কী এক হস্তক্ষেপ নয়? ঢাকার রাশিয়া দুতাবাসের কী কাজের অভাব পড়েছে? বাংলাদেশের পাবলিক কী নিজস্বার্থ নিজে বুঝতে অক্ষম? disgusting! এটা রাষ্ট্রদুত-সুলভ এক্সপেক্টেড আচরণ হয় নাই!
এমনিতেই সবচেয়ে বড় কথা মুখপাত্রের জাখারভা কথিত বিবৃতি যেই দিয়ে থাকুক এটা সীমা ছাড়ানি। ঐ বিবৃতি লিখেছে – “গত ১২-১৩ ডিসেম্বর বাংলাদেশে সরকারবিরোধীরা রাস্তাঘাট অবরোধ করে, যানবাহনে আগুন ধরিয়ে দেয় এবং পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষে লিপ্ত হয়”। এই বক্তব্য একেবারে খুবই এক্তিয়ার বহির্ভুত। ফলে এটা রাশিয়ার প্রমাণিত হস্তক্ষেপ। কারণ, রাশিয়া কিভাবে নিশ্চিত হল যে গত ১২-১৩ ডিসেম্বর বাংলাদেশে সরকারবিরোধীরা রাস্তাঘাট অবরোধ করে, যানবাহনে আগুন ধরিয়ে দিয়েছে??? এটা রাশিয়ার কেউ কিভাবে জানল, নিশ্চিত হল? কোন জুডিশিয়াল তদন্ত কী হয়েছে? কে করেছে? তদন্তকারীদের সাথে রাশিয়ার যেকেউ এর কী সম্পর্ক? কী এক্তিয়ার??? ঢাকার রাশিয়ার দুতাবাসের আমেরিকা হস্তক্ষেপের অভিযোগ তুলেই চলেছে।
তাহলে সেই রাশিয়ান দুতাবাসের এই লিখিত বয়ান এটা কী আমেরিকানদের হস্তক্ষেপ এর চেয়ে বড় হস্তক্ষেপ নয়? তারা তো আমাদের ঠুঠো বিচার বিভাগেরও বাপ হয়ে বসেছে যে রায় দিয়ে বলে দিচ্ছে কে আগুন দিয়েছে!!! এটা কিভাবে তারা করতে পারে??????
মূল লেখার শুরু এখান থেকেঃ
আরব স্প্রিং – এই বাঘ আসছে বলে প্রপাগান্ডা শুরু হয়েছে বাংলাদেশে! বলা হচ্ছে এনিয়ে নাকি এক বিবৃতি দিয়েছে রাশিয়া! এনিয়ে বাংলায় রিপোর্ট করেছে সমকাল; যদিও তাদের প্রিন্ট ভার্সানে এর হদিস পাওয়া যায় নাই। তবে বাংলা বিবিসি আবার অফ চান্সে কিছু কামিয়ে নিতে নিজ মুরোদে বা বরাতে না বরং, সমকালের প্রিন্ট বা ই-পেপার ভার্সানের ঘাড়ে চড়ে একখানা রিপোর্ট ছেড়ে দিয়েছে। আবার যুগান্তর এর রিপোর্টটা এককাঠি সরেস আর সেটা মিথ্যা প্রপাগান্ডা। মিথ্যা বলছি কারণ যুগান্তর লিখেছে, ১৫ ডিসেম্বর এ বিষয়ে একটি বিবৃতি দিয়েছেন রুশ পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের আনুষ্ঠানিক মুখপাত্র মারিয়া জাখারোভা। খবর তাসের। অথচ এই প্রপাগান্ডা খবরটা তাস (রাশিয়ান নিউজ এজেন্সী তাস বা TASS) এর সাথে সম্পর্ক খুঁজে পাওয়া যায় নাই।
আরেকটু ভেঙ্গে বলা যাক!
এই প্রপাগান্ডা খবরের সোর্স বা উতস বানানো হয়েছে ঢাকার রাশিয়ান দুতাবাসের ফেসবুক ভেরিফায়েড পেজ থেকে করা এক স্টাটাস কে। যদিও সেখানেও একটা টুইস্ট আছে। বলা হয়েছে এটা রাশিয়ান পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র মারিয়া জাকারভা তাঁর এক মন্তব্য থেকে নেয়া [Comment by Russian Foreign Ministry Spokesperson Maria Zakharova on the danger of destabilization of the situation in Bangladesh], কিন্তু সেই মন্তব্য কোথায় পাবলিকলি দেখা যায়, ছাপা হয়েছে এমন এর হদিস দেয়া হয় নাই। মানে পাবলিকলি কোথায় ছাপা হয় নাই, হয়ত আভ্যন্তরীণভাবে রাশিয়ান সরকারি ইন্টার-অফিস মেমো কোন হতে পারে। অথবা আসলে জাকারভা এমন কোন মন্তব্য করেনই নাই। তবে ঢাকার রাশিয়ান দুতাবাসের এই ফেসবুক পেজ – এটা ভেরিফায়েড পেজ সেখানে এটা ছাপা হয়েছে– তাই এটাই কেবল ভরসা! আর আমাদের সাদা চোখে অন্তত এটুকু বলা যায় যে – ঢাকার রাশিয়ান দুতাবাস-ই সবকিছুর জনক!!
এটা তাসের খবর নয়ঃ
কিন্তু যুগান্তরের ভাষ্য অনুসারে “এটা তাসের খবর” এর প্রমাণ পাওয়া যায় নাই। যদিও এটা সত্য যে মুখপাত্র মারিয়া জাকারভার তাস-কেই তার বিবৃতিগুলো সাধারণত দিয়ে থাকেন। কিন্তু কথিত এই আরব স্প্রিং- নিয়ে খররেরটা – এটা তাসের লিস্টে নাই। জাকারভা তাসকে যে বিবৃতির কপি দিয়ে থাকেন তার চলতি এমাসের লিস্ট এখানে দেয়া হল, তাস এর ওয়েব সাইট ঘেটে। তাতে বাংলাদেশ প্রসঙ্গে কোন বিবৃতি নাই। কাজেই যুগান্তর এর দাবি ভিত্তিহীন!
প্রসঙ্গ দুইঃ আরব স্প্রিং নিয়ে মূল ফেসবুক স্টাটাসে কী লেখা আছে
আগেই বলেছি এই প্রপাগান্ডা খবরের একমাত্র উতস হল ঢাকার রাশিয়ান এমবেসি এর ফেসবুক পেজ। আর সেখানে আরব স্প্রিং প্রসঙ্গে এক প্যারায় শেষ বাক্যে কয়েকটা শব্দ আছে মাত্র। তা হল,……the lines of the Arab Spring are likely.। বাংলায় বললে আমেরিকা বাংলাদেশকে অস্থিতিশীল করতে, আরব স্প্রিংয়ের লাইন নিতেও পারে – এরকম।
এর বাইরে আরব স্প্রিং সংক্রান্ত কোন ভাষ্য-বক্তব্য ঐ বিবৃতিতে নাই। এর সোজা মানে হল আরব স্প্রিং বলতে রাশিয়ান এমবেসি আসলে অস্থিতিশীলতা মানে আমেরিকার তৈরি অস্থিতিশীলতা বুঝিয়েছে। কিন্তু আরব স্প্রিং জিনিষটা কী? মনে করার কারণ আছে যে ঢাকার রাশিয়ান এমবেসি বা মুখপাত্র জাকারভা -প্রমুখের আরব স্প্রিং বুঝাবুঝিতে ঘাটতি আছে!
আরব স্প্রিং জিনিষটা কীঃ
প্রথম কথা বাংলাদেশ সরকার বহুদিন থেকেই আমেরিকান সরকারকে বাংলাদেশ আরব স্প্রিং কর্মসুচী চালাতে সহযোগিতা করে আসছে। কিভাবে সেটা?
আর বহুদিন থেকেই মানে কবে থেকে? আরব স্প্রিং এর জন্ম মোটামুটি ২০১১ সাল থেকে, সেসময় থেকেই। উপরে সেই টাইম্লাইন নিয়ে আল-জাজিরার একটা রিপোর্টে প্রকাশিত ছবিতে সেই লিঙ্ক দিয়েছি। বাংলাদেশের প্রধান সরকারি-বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় বা অনেক কলেজে ইয়ুথ প্রোগ্রাম বলে একটা কিছু চালু আছে । এই ইয়ুথ প্রোগ্রাম টাই আরব স্প্রিং এর থিতু ভার্সান। এটাই আমেরিকান সরকারি দাতা প্রতিষ্ঠান USAID এর প্রধান প্রোগ্রাম বা কর্মসুচী। আর আরব স্প্রিং অবশ্যই আমেরিকার সরকারি কর্মসুচি কিন্তু এর উদ্দেশ্য কোন দেশকে ঠিক “অস্থিতিশীল করা” – এটা বেশি কথা বলা, too much। তবে অবশ্যই এটা ওয়ার অন টেরর [war on terror] এর সাথে সংশ্লিষ্ট কাজ।
কিন্তু পাঠকেরা এখন খুঁজে দেখতে পারেন দুনিয়া ১৯৩ টা দেশ (যারা সবাই জাতিসংঘের সদস্য) এদের মধ্যে কেন দেশের সরকার এতে সামিল ছিল না? বরং সবাই বুশের জমানায় (২০০১-২০০৯) বিশেষত প্রথমদিকে ওয়ার অন টেরর এরঅংশ বা সমর্থক ছিল !!! যেমন সেসময়ের পুতিনের রাশিয়া চেচেন সমস্যার কারণে, চীন উইঘুর সমস্যার কারণে (ওদিকে ভারতের কথা আর কী বলব) এতে এমন সবাই সক্রিয়ভাবে ওয়ার অন টেররে যুক্ত ছিল; মানে এভাবে কোন দেশের সরকারই বাদ ছিল না। আর সেসময়ে বাদ থাকার চেষ্টা করলে কী হত এর উদাহরণ বাংলাদেশের বিএনপি! কারণ, সেটা ছিল বাংলাদেশে বিএনপি সরকারের আমল (২০০১-৬)। এই দল ‘বুদ্ধিমান’ সাজতে গিয়ে বেশি করে ধরা খেয়েছিল, যার প্রভাবে এখনও বিএনপি ভুগে থাকে!! বিএনপি’র সরকার বুদ্ধিমান সাজতে আমেরিকার সাথে ‘এলাইনে না থেকে’ গড়িমসি করতে গেছিল, দুনিয়া বা জাতিসংঘ বুঝে নাই বলে! তাই আমেরিকান থাবড়া খেয়েছিল। আর ঠিক এটারই সুযোগ নিয়ে হাসিনা কথিত জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে লড়াকু থাকার প্রতিশ্রুতি দিয়েই তো পরে ২০০৯ সাল থেকে ক্ষমতায় এসেছিল।
ঘটনা হল ২০০৫ সালের মাঝামাঝিতেই এটা আমেরিকার পলিসি লেভেলে এটা পরিস্কার হয়ে যায় যে এই ওয়ার অন টেরর-এ বিশেষত, আফগানিস্তানে আমেরিকার পা আটকে গেছে। কোনদিন শেষ হবে না এমন এক যুদ্ধে আমেরিকা আটকে গেছে। এমনকি আবার এই যুদ্ধ থেকে প্রত্যাহার করে গুটিয়ে বাড়ী ফিরে যাওয়াও সহজ না। সেটা ছিল আমেরিকার এমনই এক দশা পরিস্থিতি। অথচ এই যুদ্ধের সব শরীকদের খরচও আমেরিকাকে একা বইতে হচ্ছিল। তাই প্রথম কাজ হয়ে পড়েছিল বিকল্প কী করা যায় এনিয়ে পলিসি বদলাবার জন্য গবেষণায় নামা। একাজে যে গবেষণা ও সুপারিশটা বেশি গৃহিত হয়েছিল সেকাজটা ছিল RAND Corporation (এক চ্যারিটি প্রতিষ্ঠান, ‘স্বাধীন’ থিঙ্ক-ট্যাঙ্ক ধরণের) এর করা গবেষণা-সুপারিশ। [ এনিয়ে আমার পুরানা লেখায় বিস্তারিত আছে। এমনকি এনিয়ে RAND এর রিপোর্টটা তারা পাবলিকলি কপি পাবার ব্যবস্থা করেছিল সেসময়, আমার সে লেখায় এর হদিস ও রেফারেন্স আছে। আমাকে খুজে বের করতে পাঠক একটু সময় দিবেন।] লিঙ্কটা এখন পেলাম এখানে । আর সবচেয়ে গুরুত্বপুর্ণ RAND এর সেই রিপোর্ট এখানে দিলাম।
এখন বুশের দুই টার্মের পরের ওবামা-হিলারি প্রশাসন (২০০৯-২০১৭ জানুয়ারি) ক্ষমতায় এলে তাঁরা এই RAND এর রিপোর্টটা বাস্তবায়নের জন্য কাজে নেমে পরেছিল। ওবামার সেই নয়া পলিসিরই টোকেন নাম ছিল আরব স্প্রিং [Arab Spring]। যদিও আমেরিকান রেওয়াজ অনুসারে ওবামা প্রশাসন এনিয়ে তারর মূল পলিসিটা (RAND এর রিপোর্টটার কোনটা আর কতখানি এর বিস্তারিত দিকটা) প্রকাশ্য পাবলিক ডকুমেন্ট করা হয় না। তবে তাদের প্রশাসনের প্রকাশ্য কাজগুলো অনুসরণ করলে বা এনিয়ে কংগ্রেস-সিনেটের তৎপরতা একেবারেই প্রকাশ্যে লাইভ-টিভিতে দেখানোর যোগ্য বলে তাদের থেকে এর অনেকটাই জানা যায়। এছাড়া, আমেরিকান এলিটদের ফরেন এফেয়ার্স ম্যাগাজিনে হিলারি ক্লিনটন পররাষ্ট্রমন্ত্রী থাকা অবস্থায় কি কী লেখা ছেপেছিলেন [তা নিয়ে দুইটা লেখা এখানে আর এখানে পাবেন]। তাথেকেও অনেকটাই জানা যায়।
আরব স্প্রিংয়ের দুই(!) ভার্সানঃ
কমকথায় সংক্ষেপে বললে, ওবামার এই আরব স্প্রিং [Arab Spring] এর আবার দুটা ব্যবহারিক রূপ বা ভার্সান দেখতে পাওয়া যায়। একটা বলা যায় কাতার-কেন্দ্রিক; যার মধ্যে জড়িত ছিল ইসলামি স্কলার কারযাভী [Yusuf al-Qaradawi]। এরই আবার সবচেয়ে বড় প্রোগ্রামটাই ছিল মিসরেরটা; যেটা পরিণতিতে মিসরে মোরসি’কে ক্ষমতায় এনেছিল। যদিও রাখতে পারে নাই। আর বাংলাদেশ থেকে অনেককেই এই ভার্সানটা দেখতে-জানতে কাতারে দাওয়াত করা হয়েছিল। তার গিয়েছিলেনও। যতদুর মনে পরে হাসিনা নিজেও আমেরিকান আমন্ত্রণে তা দেখতে গেছিলেন। আবার জামায়াতের নিজামী-মুজাহিদ তখনও বেঁচে। তাদের থেকেও একটা টিম গেছিল। মূল কারণ, সেখানে মানে কাতারে কারযাভীর নেতৃত্বে আরব স্প্রিং [Arab Spring] অফিস-ট্রেনিং কর্মসুচী যেমন ছিল তেমনি খোদ আমেরিকান প্রশাসনের আরব স্প্রিং এর নিজ অফিসও কাতারে ছিল।
আবার ওবামা-হিলারির আরব স্প্রিংয়ের নামে আরেক ভয়ঙ্কর ভার্সানও ছিল। যেমন লিবিয়ার গাদ্দাফিকে হত্যা ও উতখাত; যেটাতে পরে বেনাগাজীতে আমেরিকান নিজ রাষ্ট্রদুতসহ স্টাফেরা খুন হয়ে যান। কারণ, সেটা ছিল বেনামে আই-এসের সাথে এলায়েন্স তবে তখনও এই গ্রুপ আই-এস নামধারণ করে নাই। আবার এই গ্রুপকেই কথিত আছে যে আমেরিকা সিরিয়ায় আসাদকে নামানোর প্রোগ্রাম দেয়া হয়েছিল। কিন্তু ততদিনে এরা আই-এস নামধারণ করে নিয়েছে। আর তাদের স্বার্থ ও লক্ষ্য ছিল বা হয়ে যায় ইরাক ফিরে দখল। কিন্তু এবার ওবামা এই আই-এস গ্রুপকেই দমন ও খতম করতেই ইরানের সাথে এলায়েন্স করে [ যেটা P5+1 চুক্তি] ও ইরানকে দিয়েই আই-এস কে উতখাত করে এই ধারার আরব স্প্রিং-র পরিসমাপ্তি ঘটায়।
তবে মনে রাখতে হবে এই দ্বিতীয় ধারার আরব স্প্রিং যেটা বলা হচ্ছে এর ততপরতাগুলো RAND এর সুপারিশের মধ্যে ছিল না। তাই একাদেমিশিয়ানেরা আই-এস এর সাথে জড়িয়ে পরা বা সশস্ত্রভাবে ইসলামের নামেই এসব বিরুদ্ধ কাজ-ততপরতাগুলোকেও আরব স্প্রিংয়ের আরেক ধারা বলতে নারাজ। কারণ তাদের যুক্তি হল, আরব স্প্রিংয়ের মৌলিক সারকথা এটা থেকে আলাদা। আর ইরাক-লিবিয়া-সিরিয়া নিয়ে যাকিছু ওবামা-হিলারি করেছেন বা কংগ্রেসে সমালোচিত হয়েছেন সেসব ছিল RAND এর সুপারিশের অবশ্যই বাইরের; তবে সেগুলো ওবামা প্রশাসন-সরকারেরই আলাদা কাজ-প্রোগ্রাম বা স্বার্থ বটে!
আরব স্প্রিংয়ের সারকথা কীঃ
সারকথা হল, মুসলমান দেশ-রাষ্ট্রের বাসিন্দাদেরকে নাগরিক অধিকার এর ধারণা বা বোধ শিখানো – এভাবে সাজিয়ে নেয়া। এজন্য এখন ঢাকায় যে ইয়ুথ প্রোগ্রাম চলছে এর প্রধান দিক হল, বাংলাদেশ রিপাবলিক রাষ্ট্রের তরুণ নাগরিকদেরকে অধিকার শিখানে বা একটা অধিকারভিত্তিক রাষ্ট্রের মূল বৈশিষ্টগুলো সম্পর্কে ওয়াকেবহাল করা। বাংলাদেশের কলজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের ইয়ুথ প্রোগ্রাম বলতে এটাই এখনও কার্যকর। অনেক স্টুডেন্ট কে দেখবেন ফেসবুকে পরিচয় হিসাবে নিজেই ইয়ুথ কর্মসুচীতে নিজের যোগ দেওয়ার কথা বলছেন। এর আরেক সবচেয়ে ভাল বা উপযুক্ত উদাহরণ হল মিসরের “অক্টোবর সিক্স গ্রুপ”। যেটা মিসরের মোরসির নির্বাচিত হওয়া পর্যন্তও ছিল সামাজিক সংগঠন। আর এখন যা এক রাজনৈতিক দল যারা নাগরিক রিপাবলিক রাষ্ট্র গড়তে চায়, এমন রাজনীতি সচেতন একটা দল।
কেন RAND এমন সুপারিশে গেছিলঃ
বুশের ওয়ার অন টেরর সম্পর্কে একটা মৌলিক মুল্যায়ন হল, যে তিনি সেখানে আগ্রাসী ও মুসলমান-বিদ্বেষী হয়েছিলেন; এই অর্থে যে এথনিক-ধর্মীয় মুসলমানকে তিনি নিচা ও বৈষম্যমূলক চোখে দেখে চলেছিলেন। তাই কেউ সশস্ত্র ইসলামি রাজনৈতিক ধারার না হলেও মুসলমান মাত্রই যে কেউই বুশের বৈষম্য ও নৃশসতার শিকার হয়েছিলেন। এছাড়া সাথে ছিল আরেক কারণ যে, সোভিয়েত পতনের পরে আমেরিকা তখন দুনিয়ায় একক মেরুর ঝান্ডাধারী। সোভিয়েত ইউনিয়ন পতন হয়ে গেছে বলে। ফলে বুশের আমেরিকা চাইলে যাখুশি করতে পারে – এই মিথ্যা ও বোকার উদ্ধত্য ছিল বুশের!! ঘটনাচক্রে, ১৯৯১ ডিসেম্বরে সোভিয়েত পতনের পরে আমেরিকান রিপাবলিকান পার্টি নয় ক্ষমতায় নয় বরং দুই টার্ম প্রেসিডেন্ট ছিলেন ডেমোক্রাট ক্লিনটন। যারা রিপাবলিক বুশের চোখে বোকা অকর্ম! যারা (তখন আমেরিকা একক পরাশক্তি ফলে ) পড়ে পাওয়া সুবিধা নাকি নিতে জানে না!!! ইত্যাদি এসবই বুশ-কে কার্যত এমন মিথ্যা শ্রেষ্ঠত্ব ও বোকার উদ্ধত্য – এরই প্রেসিডেন্ট বুশ বানিয়েছিল। যেকোন বিশেষত, মুসলমান অধ্যুসিত রাষ্ট্র হলে তো কথাই নাই – প্রেসিডেন্ট বুশ – তিনি হতে চেয়েছিলেন এমন যেকোন দেশের রেজিম চেঞ্জের আমেরিকান প্রেসিডেন্ট!
RAND রিপোর্ট তাই উদাহরণ হিসাবে বলেছিলঃ মানে তারা সেসময়ের ওয়ার অন টেররের আমলের (আমাদের মত) গরীব মূসলমানের দেশের এক সন্ধ্যাবেলার চিত্র এঁকেছিল এভাবে; যে সন্ধ্যার পর ডিনার টেবিলে পরিবার যখন টেবলে একত্রিত হত তখন কোনায় রাখা টিভিটা চালু করে তাদের কমন প্রথম ডায়লগের বাক্যটা হত – “আজ কয়জন”? মানে হল আজ কয়জন আমেরিকান সেনা মরল! আর সেটাই এরা উতযাপন করত! কারণ এমন প্রত্যেকটা দেশেই থাকত এক স্বৈরাচারি জনবিচ্ছিন্ন সরকার যে আমেরিকা সমর্থিত বলে জন-ঘৃণিত। অতএব ওমন দেশে মধ্য বা উচ্চ মধ্যবিত্ত সমাজ পরিবারগুলো নিজ সরকার-রাজনীতিকে না বলত, দূরে থাকত। অথচ একেবারে গ্লোবাল পরিসরে্র মূল হোতা আমেরিকাকেই গালাগালি মুন্ডপাত করত। তাই এককথায় যেকোন তৃতীয় বিশ্বের দেশে আমেরিকা-বিরূপতা কমানো RAND এর লক্ষ্য ছিল। আর তা অর্জনের জন্য মুসলমান অধ্যুসিত দেশগুলোতে সরকার ব্যবস্থায় সংস্কার, নুন্যতম জবাবদিহিতা ও পাবলিক অংশগ্রহণের সুযোগ সৃষ্টি করাই ছিল লক্ষ্য। আর এতে নুন্যতম অধিকারভিত্তিক রাষ্ট্রচিন্তায় এক রিপাবলিক হয়ে উঠুক তাদের নিজ নিজ দেশ এই ছিল লক্ষ্য; যাতে মুসলমান অধ্যুসিত দেশগুলোতে স্থানীয় জনগণ আমেরিকাবিরোধী কম হয় ও নিজদেশের সরকারের সাথে সংস্লিষ্টতাবোধ বাড়ে!
তবে সাবধান এর সাথে একালে বাইডেনের মানবাধিকারের পররাষ্ট্রনীতি বা স্যাংশন আরোপ করে চাপ সৃষ্টি ইত্যাদি এসবের সাথে সেকালের আরব স্প্রিং এর কোন সম্পর্ক নাই, ছিল না। আমরা যেন মাখায় না ফেলি।
তাহলে কথাগুলো এখন গুছিয়ে সারাংশে বললে,
১। গত ২০০৩ সালে বুশের ইরাক দখলের আগে পর্যন্ত দুনিয়ার প্রায় সব সরকারই নিজ নিজ স্বার্থে ওয়ার অন টেররের এককাট্টা পক্ষে ছিল বা থাকতে বাধ্য হয়েছিল; এমনকি জাতিসংঘের যেকোন সিদ্ধান্তেও এরা সকলে একপক্ষে ছিল। যেমন আফগানিস্তান ইস্যুতে (তাই পরে আমেরিকার আফগানিস্তান দখলেও) নিরাপত্তা পরিষদে সকলেই একই পক্ষে মানে আল-কায়েদাবিরোধী দিকে ভোট দিয়েছিল। কেবল ইরাক দখলের আগে ফ্রান্স-জর্মানি এর বিরোধিতা করেছিল কিন্তু বছর খানেক পরে এরাও ইরাক-আফগানিস্তানে সেনা পাঠিয়ে অংশ নিয়েছিল।
২। পরে ওয়ার অন টেরর এর এক সংস্কার রূপই হল আরব স্প্রিং। লিবিয়া-সিরিয়ার ঘটনাগুলো বাইরে রাখলে রাশিয়া কখনও আরব স্প্রিং-কে সমালোচনা করেছে জানা যায় না। তাহলে এখন আরব স্প্রিং এর কথা তুলে খোঁচা মারা নেতি দেখানো রাশিয়া – এটা তো নতুন ঘটনা। তাই রাশিয়া আসলেই কী বুঝাতে চাইছে? তারা কী আরব স্প্রিং এর বিরুদ্ধে ছিল? নাকি এখন হাসিনা সরকারের পক্ষে লিপ সার্ভিস এসেছে – তা নিয়ে সন্দেহ থেকে যায়।
৩। আবার এখন রাশিয়ার আরব স্প্রিং এর ভয় দেখানো এতে কার্যত সরকার কী খুশি হয়েছে? না তাও নয়! পররাষ্ট্রমন্ত্রী মোমেন এতে খুশি হয়েছেন তা বলতে-দেখাতে পারেন নাই। কারণ, মোমেন-কে প্রতিক্রিয়া দেখাতে হয়েছে সেটা এই বলে যে এখন আর বাংলাদেশে আরব স্প্রিং এর সম্ভাবনা নাই। তার মানে আসলে সরকারকে দেখাতেই হয়েছে যে সে রাশিয়ার আরব স্প্রিং ভয় ছড়ানোর বিরুদ্ধে!!! তাহলে রাশিয়ার কথিত এই অবস্থান নেয়া – এটা কার পক্ষে গেছে??? মানে কেন মোমেনকে বলতে হয়েছে আরব স্প্রিং এর ভয় নাই???? এটাই হল হাসিনা সরকারের স্ববিরোধ!
৪। এটা সবচেয়ে গুরুত্বপুর্ণ পয়েন্ট যে মোমেনের “আরব স্প্রিং বাংলাদেশে আসবে না” এই কথাটা বলার কোনই মানে হয় নাই! কারণ, ইতোমধ্যে USAID ফান্ডেড আরব স্প্রিং এর ইয়ুথ প্রোগ্রামগুলোকে সরকারি (এনজিও ফান্ড হিসাবে) অনুমোদন দিয়েছে বলেই তো এগুলো বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে চলছে। তাহলে মোমেনের “আরব স্প্রিং বাংলাদেশে আসবে না” কথাটার কোনই মানে কী থাকল; পুরাটাই অপ্রাসঙ্গিক!!!
এর মানে রাশিয়ার “আরব স্প্রিং’ নাম বলে রাশিয়ার যা কিছু খোচাখুচি তা অপ্রাসঙ্গিক, অর্থহীন। মানে এটা কীন সিরিয়াস বক্তব্য-প্রতিক্রিয়া নয়! বাংলায় বললে, এগুলোকেই আমরা খামোখা বলি!!! জমে নাই এমন অকেজো প্রপাগান্ডা মাত্র! এজন্য কী মুখপাত্র মারিয়া জাকারভা নিজে এই কথিত বিবৃতি দেন নাই!!!
আবার আরব স্প্রিংয়ের অনেক ফজিলত আছে! যেমন ২০১৩ সালে পাকিস্তানের ইমরানের উত্থান এমনই এক পাকিস্তানি আরব স্প্রিং থেকে।
শাহবাগের গণজাগরণ মঞ্চকে এক “আরব স্প্রিং” বানানোর আগ্রহ ছিল আমেরিকার, কিন্তু হয় নাইঃ
আর একটা তথ্য দেই। শাহবাগের গণজাগরণ মঞ্চকে এক “আরব স্প্রিং” বানানোর আগ্রহ ছিল আমেরিকার, কিন্তু হয় নাই। দেখেন এখানে। অন্য স্বার্থের কাছে হেরে যায়, সফল হতে পারে নাই! সেই ২০১৩ সালের প্রথম আলোতে প্রকাশিত এক রিপোর্টের শিরোনাম ছিলঃ
শাহবাগে বাংলা বসন্ত
এমন অনেক লেখা এখনও পাবেন। আর ভাষ্যগুলো খেয়াল করেন। কথিত শাহবাগী আন্দোলনের ইমরান এইচ সরকার, তিনিও আসলে ছিলেন President at Youth for Peace & Democracy, Bangladesh (YPD)এই [YOUTH PROGRAM] মানে আরব স্প্রিংয়ের সাথে জড়িত নেতা। তাকে আমেরিকানেরা পুশ করে শাহবাগে পাঠিয়েছিল। প্রথম আলো এনিয়ে দুটা ফিচারও ছেপেছিল।

ইমরান এইচ সরকার
কিন্তু পরে রাজীব বা থাবা বাবা খুন হয়ে গেলে ইমরান সহ সকলেই নিরাপত্তা পেতে উন্মুখ হয়ে উঠে আর সরকারের কোলে গিয়ে উঠেছিল। মানে আমেরিকান এই ইয়ুথ প্রোগ্রামের দিকটা আর সামনে আসতে পারে নাই। সোজা কথার শুরুর দিকে আমেরিকা চেয়েছিল শাহবাগ আন্দোলনকে মিসরের আরব স্প্রিংয়ের মত করে গড়ে দেয়া যায় কিনা……। যেটা শুরুতেই হেরে গেছিল, ফলে পারে নাই।
… আপডেটঃ ১৯ ডিসেম্বর ২০২৩, রাত ৯ঃ ৩০
সর্বশেষ আপডেটঃ ২০ ডিসেম্বর ২০২৩, সকাল ০৭ঃ ১০
গৌতম দাস
রাজনৈতিক বিশ্লেষক
goutamdas1958@hotmail.com




