শেখর গুপ্তার ইউনুস পাঠ ভুয়া!


শেখর গুপ্তার ইউনুস পাঠ ভুয়া!
গৌতম দাস
১৪ জানুয়ারি ২০২৫   বিকাল ০৪ঃ ৪২
https://wp.me/p1sCvy-6cg

 

Prof Yunus, ThePrint

ছবিতে শেখর গুপ্তা

আজ সকালে ডেইলিস্টারের খবর হল, বিএনপি এবছরের মাঝামাঝিতে নির্বাচন চায় [BNP wants national polls by mid-2025 ]। গতকাল সন্ধ্যায় বিএনপির যে স্থায়ী কমিটির মিটিং ছিল সেখানকার সিদ্ধান্ত এটা। এর চেয়েও বড় খবর হল, কিন্তু তা সত্বেও নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক স্থায়ী কমিটির সদস্য একথা ডেইলিস্টারকে বলেছে।
এবার এর সাথে মিলিয়ে দেখেন গতকাল (১৩ জানু.২০২৫) সারাদিনে ইন্ডিয়ান মিডিয়ায় বাংলাদেশে নির্বাচন তারা এবার ঘটাবেই – সবচেয়ে দ্রুত – এমন আক্রমণের এক নয়া উদ্যোগ যেটা শুরু হয়েছে। ইন্ডিয়ান সেনাপ্রধান থেকে শুরু করে ইন্ডিয়ার সকল মিডিয়া ভয়েজ এখন এটাই।
মোদির ইন্ডিয়া ও র-এর পরিকল্পনা একেবারে ডেস্পারেট (মানে পাগলা হয়া গেছে) বা মরিয়া যে বাংলাদেশে একটা নয়া হাসিনা দল ও সরকার কায়েম তারা এবার করবেই! এতদিন একাজে মোদির মিথ্যা প্রপাগান্ডা-মিডিয়াগুলোকে লাগিয়ে একাজ করছিল; বিশেষত সেই চিন্ময়-ইসকন কান্ড থেকে। এর মানে হল, নয়া হাসিনা আর নয়া হাসিনার দল যাকে মোদি বানাবেন  তা তিনি এবার পেয়ে গেছেন।
কিন্তু এবার এতে আরো সংযোজন হল একেবারে প্রথম সারির মিডিয়া – দ্যা প্রিন্ট ও এর বর্ষীয়ান সম্পাদক (আসলে তিনি এখন এর সম্পাদক মন্ডলীর সভাপতি ও মালিক) শেখর গুপ্তা।  পাঞ্জাবের কোন এক অখ্যাত গ্রামে ১৯৫৭ সালে জন্ম নেয়া এই গ্রামের ছেলে যার যাত্রা শুরু হয়েছিল আরএসএস পরিচালিত এক প্রাইমারি স্কুল থেকে সেকালে সে ব্যাপারটা শেখর গুপ্তার  নিজেরই ভাষায় বললে, -” আরএসএস এর দুইটা অনুগ্রহের সুযোগ নিয়ে সেই শেখর গুপ্তা নানা পথ পরিক্রমের পরে এখন দ্যা প্রিন্ট এই পত্রিকার 56.39% শেয়ার  বা   ১৩৯ কোটি রুপির শেয়ারের মালিক তিনি এক শেখর গুপ্তা।   এই দ্যা প্রিন্ট এটা একটা   ব্রান্ড নাম বলা যায় যার কোম্পানী নাম প্রিন্টলাইন মিডিয়া । যার অফিসিয়াল জন্ম ২০১৬ সালে।

 

কিন্তু কেন এত ডিটেইল বলছিঃ
বলছি এজন্য যে মোদি যখন শেখর গুপ্তাকে বাংলাদেশের বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে ইউনুস, এই ব্যক্তি ও সরকারের বিরুদ্ধে প্রপাগান্ডা করতে নিয়োগ দিয়ে দিছেন তখন বুঝতে হবে এটা অনেক বড় বাজি ধরা স্টেক। তাহলে কে এই শেখর গুপ্তা?
অন্যভাবে বললে, এক অর্থে ভারতের মিডিয়ার উত্থান বিকাশ ও শেষে – গোদি মিডিয়া – হয়ে যাওয়া এর সবটাই যেন  শেখর গুপ্তার উত্থান বিকাশ ও গোদি মিডিয়াম্যান হয়ে যাওয়া! প্রায় সমার্থক ঘটনা! যেমন ভারতের মিডিয়া বুঝতে গেলে দুটা টার্ণিং পয়েন্ট আপনাকে মনে রাখতে হবে। অনেক আগেও বলেছি, ভারতের প্রিন্টেড মিডিয়া বাংলাদেশের মত নয় যে এর কোনটাই মালিকের ভর্তুকিতে চলে। মানে বাংলাদেশে যেমন প্রত্যেকটা প্রিন্ট মিডিয়াই মালিকের অন্য ব্যবসার আয় সেখান থেকে আনা লাভ এখানে ভর্তুকি হিসাবে ব্যবহার করে করে বলেই এটা টিকে আছে। আর মালিক বিনিময়ে এই প্রিন্ট মিডিয়াকে ব্যবহার করে থাকে হুমকি দিয়ে অন্যের ক্ষমতাকে ম্যানেজ করতে! বা ক্ষমতাসীন সরকারকে সেবা দিয়ে সন্তুষ্ট করতে! এই হল বাংলাদেশি মিডিয়া ব্যবস্থা!
বিপরীতে ইন্ডিয়ান প্রিন্ট মিডিয়া নিজে কোম্পানি যে নিজের আয়ব্যয় সামলাতে হয়; যার অনেকগুলো সেই বৃটিশ আমলে জন্ম!  কিন্তু একালে এসে এসব পুরান ভ্যানিটি-গৌরব সব শেষ!  যার প্রথম দুর্যোগটা ২০১৪ সালের শেষে বা ২০১৫ সালের শুরুতে; যা আসলে এককথায় বিজেপির মোদির প্রথমবারের মত ২০১৪ সালে প্রধানমন্ত্রী হবার পরে পরেই। কারণ,  মোদি সরকার ও র-এর প্রকল্প হল, মিডিয়াকে টাকা খাইয়ে ম্যানেজ করা তাই শুরু হয়ে যায় অর্ণব গোস্বামীদের যুগ!  পত্রিকার লাইসেন্স যার নামে তিনি জানেনই না আজ পত্রিকার প্রধান শিরোনাম কী!  তিনি এমন ভাবেই মোদি ও র-এর হাতে ম্যানেজমেন্ট-পরিচালনা ছেড়ে দিয়েছেন। বিনিময়ে নিজ স্বার্থ বুঝে নিয়েছেন।  মোটা দাগে এই হয়ে উঠেছিল ট্রেন্ড।
এরপর ঘটে আরেক দ্বিতীয় ঘটনা। সেটা হল, কোভিড পরবর্তী ইন্ডিয়া যখন অর্থনীতির সবকিছু ভেঙ্গে পড়েছিল আর এর ঝাপটায় ২০২১ সাল থেকে প্রায় সকল মিডিয়াই কম-বেশি মোদির ভিক্ষায় টিকে থাকা মিডিয়া হয়ে যায়।
এদুই ঘটনাই বলে দেয় মোদি মিডিয়া কিনে নেওয়া কিভাবে শুরু  হয়েছিল আর তা কত মারাত্মক ছিল। পরের বছর ২০২২ সালে বিবিসি এই প্রসঙ্গে একটা রিপোর্ট করেছিল; শিরোনাম ছিল, ভারতের মূল ধারার মিডিয়া যেভাবে সরকারের বশংবদে পরিণত হচ্ছে। এবং  এই রিপোর্টের মধ্যেই এক উপশিরোনাম আছে – ‘কিনে নাও সব চ্যানেলকেই’ এভাবে।

এদিকে, ঘটনাক্রমে এই শেখর গুপ্তা খুবই প্রভাবশালী হয়ে উঠেছিলেন সাথে যার একটা তুলনামূলক ক্লিন ইমেজও ছিল অনেককাল। কথাটা এভাবে বলা যায় যতদিন তিনি ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস পত্রিকার সম্পাদক ও প্রধান নির্বাহী [CEO] ছিলেন 19 years from 1996 to 2015। তাঁর পেশাদার জীবন সেকালে মূলত এই ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস আর ইন্ডিয়া টুডে তেই কেটেছে। সাথে এক লম্বা সময় প্রায় ১৯ বছর তিনি  ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস এর সম্পাদক ছিলেন। এটাই তার ইমেজ শিখরে উঠবার সময় ছিল। বিশেষ করে এনডিটিভি তে তাঁর ওয়াক অন টক [Walk on Talk] এই শিরোনামে ইন্টারভিউ গুলো তাকে পপুলার করেছিল। তিনি সেকালে কত বড় কেউকেটা ছিলেন এনিয়ে কৌতুহলীরা দেখতে পারেন এই লিঙ্কে । যখন তাঁর বাসা-বাড়িটা হয়ে উঠেছিল ক্ষমতার করিডোর!
কিন্তু ২০১৬ সালের পরে নিজের মালিকানাধীন পত্রিকা দ্যা প্রিন্ট বের করার পর থেকে তিনি আস্তে আস্তে গোদি মিডিয়ার (এলিট অংশ) হয়ে উঠতে শুরু করেন। শুরুতে শেখর গুপ্তা-সহ  এসব মিডিয়া মোগলেরা এদের অজুহাত ও সাফাইয়ে তারা বলত কোভিড কালে কর্মচারিদের বেতন দিতে না পারাতে মোদির সহায়তায় যেতে এটা করতে হয়েছিল। পরে আমরা দেখি এতে নানান ইস্যুতে শেখর গুপ্তার  ভাষ্য বক্তব্যও বদলাতে শুরু করে। [আমার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা হল, মূলত এসময়কাল থেকেই আমি এরপর থেকে আর এই পত্রিকাটা নিয়মিত ফলো করা থেকে সরে আসি। অথচ আমার অনেক পুরানা লেখায় দেখবেন আমি মূলত দ্যা প্রিন্ট কেই রেফার করেছি। ]। যেমন, তিনি মোদির হিন্দুত্ববাদী বা ইসলামবিদ্বেষী অবস্থানের পক্ষে দাড়াতে শুরু করেন – অপ্রত্যক্ষের ভাব ধরে। তাঁর আরেক বৈশিষ্ট হল, তিনি বড় সম্পাদক হলেও নিয়মিত তিনি কলাম লেখা (বা ভিডিও ক্লিপ তৈরি) চালিয়ে গেছেন। আর তার কলাম প্রকাশিত হত – ন্যাশনাল ইন্টারেস্ট কলাম – এই নাম দিয়ে।

আসলে এটাই শেখরের কারসাজিঃ
জার্নানিজম আর দেশপ্রেমিকতা কী একই জিনিষ? বা একই সাথে করার জিনিষ?   নাকি আগে জার্নানিজম আর পরে দেশপ্রেমিকতা? এই জিনিষটাই গোলমাল পাকিয়ে রেখে দিয়েছেন শেখর গুপ্তা!
মূল তর্কে গোলমাল পাকানো হয়েছে যেন দেশপ্রেমিক জার্নালিজম বলে কিছু একটা আছে। যেখানে দেশপ্রেমিকতার নামে অপ-জার্নালিজম-কে জায়গা করে দেয়া যায়! এমনকি শেখরের নিজ লেখা কলামের নাম  ন্যাশনাল ইন্টারেস্ট নাম দেওয়াটাই এর প্রমাণ। মানে তিনি বলতে চাইছেন, যেন তিনি জাতীয় স্বার্থের জার্ণালিস্ট! শুনে আর না বুঝে ব্যাপারটা অনেকের ভালই লাগবে হয়ত! কিন্তু সাবধান! জাতিবাদি হয়ে যেয়েন না এত সহজে। যদি প্রশ্ন করি আপনি কী মোদির স্বার্থের পক্ষে  থাকাটাকে জাতীয়স্বার্থ বলে ভেবে এর পক্ষে থাকবেন নাকি যা সত্যি ফ্যাক্টস অর্থে সত্যি এর পক্ষে থাকবেন? [একই কথা আরেকভাবে বলা যায় যেমন মুসলমান কী মুসলমানের পক্ষে থাকবেই নাকি সবসময় তাকে ইসলাম / না-ইসলাম নির্বিশেষে ইনসাফের পক্ষেই থাকতে হবে?]
শেখর যেন বলতে চান ন্যায়পরায়ণতা নয় -ইনসাফ নয়, ফ্যাক্টস অর্থে সত্যি ঘটনা নয় বরং কথিত জাতীয় স্বার্থের পক্ষে থাকাটাই জার্নালিজম! আর এটাই নাকি তথাকথিত দেশপ্রেমিকতা!!!! মানে ন্যাশনাল ইন্টারেস্ট????  অথচ জার্ণালিজম চোখবন্ধ দেশপ্রেমিকতা বা জাতিবাদিতা একেবারেই নয়! বরং এব্যাপারে মুলকথাটাই হল, ন্যায়-ইনসাফ বোধ! অথচ এই ছুপা হিন্দুত্ববাদি দেশপ্রেমিকতা এরা জাতিবাদিতার নামে অসৎ জার্ণালিজম কে জায়েজ করে ফেলতে চায়!  আর এভাবেই তিনি প্রায় দেড়শ কোটি রুপির মালিক!
কবছর আগে G-20 এর সম্মেলন ইন্ডিয়ায় হলে মোদি এই সম্মলনের একটা সেশন বিতর্কিত কাশ্মীরে অনুষ্ঠিত করতে চেয়েছিলেন। আর তাতে সমর্থন যুগিয়ে সাফাই দিয়েছিলেন এই শেখরগুপ্তা কলাম লিখেছিলেন।

আর এবার? এবার ইউনুস কোপানির ঠিকাঃ
এবার শেখর গুপ্তা ইউনুস কোপানির বড় ঠিকা নিয়ে এসেছেন।  তিনি এবার ইউনুস (ব্যক্তি ও ইউনুস সরকার) এদেরকে কোপাবেনই! তাতে খেলার নিয়ম-আইন ভেঙ্গে [বক্সিং খেলায় রিং এর মধ্যে প্লেয়ারেরা একে অপরের তলপেটে হিট করতে পারে না] হলেও শেখর এখন ইউনুস সাব কে কোপানো শুরু করেছেন। কিভাবে?
শেখর স্বভাবসুলভ এক কলাম লিখেছেন, যার শিরোনামঃ  “প্রফেসর ইউনুসকে লেখা এক খোলা চিঠি” [ছাপা হয়েছে An open letter to Prof Muhammad Yunus দ্যা প্রিন্ট পত্রিকায় ১১ জানু. ২০২৫ । এতে শেখর তাঁর এই কলাম-বক্তব্যের সারকথা নিজেই করে দিয়ে লিখেছেন, “হাসিনা আপনার ব্যাংক [গ্রামীন ব্যাংক বুঝিয়েছেন] নিয়ে গেছে তাই আপনি হাসিনার উপর প্রতিশোধ নিয়েছেন” [Hasina took away your bank and you’ve served revenge.]।

ঘটনা হল বিষয়টা তা ছিলই না! মানে ইউনুস সাব এক সাক্ষাৎকার দিয়েছিলেন ২০১৬ সালে শেখরকে। সেখানে শেখর সাজেশন রেখে জিজ্ঞাসা করেছিলেন হাসিনা আপনার ব্যাংক নিয়ে নিয়েছেন বলেই কী আপনি প্রতিহিংসায় পশিমা দেশে আপনার ব্যাংক খুলেছেন? সেখানে ইউনুস সাব পরিস্কারই বলেছিলেন, না অবশ্যই প্রতিহিংসাবশত কিছু করি নাই। সেকথা এই কলাম লেখাতেই শেখর উল্লেখ করেছেন। শেখর লিখেছেন, “You said we’re not seeking revenge, but just doing the right thing.”।  তাহলে ইউনুস সাবের এই কথার পরও শেখর কেন লিখছেন এটা প্রতিহিংসা???

 

আমরা এবার শেখরকে দেয়া এই সাক্ষাৎকারকে পাশে ফেলে রেখে অন্যদিকে মানে, ভিতরে তাকাবোঃ
শেখরের এসব দাবি শুনে মনে হইয়েছে শেখর ধরেই নিয়েছেন যে, ইউনুস সাহেব যেন ৫ আগষ্ট বিপ্লব বা হাসিনার ক্ষমতাচ্যুতির নেতা! তিনিই মূল নেতা !!! তাই  ইউনুস সাব এখন  তিনি হাসিনার উপর প্রতিহিংসাবশত হাসিনাকে ক্ষমতাচ্যুত করেছেন!!! অথচ এর চেয়ে হাস্যকর কথা আর হয় না!
আমি অনেকবার বলেছি, ফ্যাক্টস হল – হাসিনার পতনে ভুমিকা রাখা ফ্যাক্টর তিনটাঃ [যার একটাতেও ইউনুস সাহেব সংশ্লষ্টই নয়] এক. কোটা আন্দোলনকে কেন্দ্র করে ক্রমশ তাতে দেশের হাসিনাবিরোধী জনগণের জনসমর্থন আর এছাড়া, দূর থেকে হলেও রাজনৈতিক দলের সমর্থন এভাবে সব মিলিয়ে এক ছাত্র-জনতার উত্থান – এই ছিল প্রধান ঘটনা। আর এটাকে লক্ষ করে একে কাজে লাগিয়ে সেনাবাহিনীর নিজস্ব আভ্যন্তরীণ ক্ষমতায় (কমান্ডিং ক্ষমতা) বদল ঘটিয়ে নেয় (যারা হাসিনা-মুক্ত হবার চেষ্টায় ছিল অনেকদিন ধরে সেই অংশ)। এরা হল দ্বিতীয় ফ্যাক্টর। এরাই ছাত্র-জনতার সাথে হাত মিলানোতেই তা মিলিতভাবে নিয়ামক নির্ধারক ফ্যাক্টর হয়ে উঠেছিল। আর তৃতীয় ফ্যাক্টর হল, জাতিসংঘের মানবাধিবাধিকার কমিশন (তাদের নিয়মিত হুশিয়ারি; যার সোজা অর্থ ইউএন মিশন থেকে আমাদের সেনাদের মানবাধিকার লঙ্ঘনের দায় বের করে দেয়া হতে পারে)।
এই তিন ফ্যাক্টরের কোনটার সাথে ইউনুসের নুন্যতম সম্পর্ক, যোগাযোগ কিছুই ইউনুসের ছিল না। এছাড়া সেসময় তিনি দেশে নয় ছিলেন আমেরিকায়;  ফিরেছেন ঐ ৮ আগষ্টই যেদিন সন্ধ্যায় ফিরে তিনি ক্ষমতার শপথ নেন!  এককথায় হাসিনার পতন ও পলায়নের আগে ঢাকার কেউই তার সাথে যোগাযোগও করেন নাই। আর এমনিতেই তিনি  রাজনীতিবিমুখ, বিশেষত ১/১১ এর ঘটনার পর থেকে! তাহলে কিসের ভিত্তিতে শেখর গুপ্তার এই ভুয়া অনুমান?  এককথায় বললে যেখানে এটা হাসিনা বনাম ইউনুসের ক্ষমতার পাল্টাপাল্টি ধরণের কিছুই নয়??? হাসিনা পতনের নুন্যতম অবদান রাখা কোন ছোট-বড় নায়ক এর কিছুই নন ইউনুস সাব! আর এমনটা ইউনুস সাহেব কোথাও দাবিওও করেন নাই!
তাইলে?
তাহলে, এতে যা দাঁড়িয়েছে তা হল, এতে শেখর গুপ্তার হাসিনা-প্রেম প্রকাশ হয়ে পড়েছে! যা আসলে মোদির হাসিনা প্রেম!!!!  এটা প্রমাণ করে যে শেখর তিনি মোদির বা গোদি মিডিয়ার এসাইমেন্টে নেমেছেন, তাই নয় কী?

দ্বিতীয়তঃ
প্রধান উপদেষ্টা হবার পরে ইউনুস সাব গ্রামীণ ব্যাংকের কেউ কী না; অথবা গ্রামীণ ব্যাংকের স্বার্থে তিনি ক্ষমতাকে ব্যবহার করতে চান কিনা – এককথায় গ্রামীণ ব্যাংক নিয়ে তিনি কোন বক্তব্য বা ইস্যু তার মাথায় আছে তা তিনি কোথাও প্রকাশ করেন নাই; কোথাও প্রকাশ পায় নাই। তিনি নিজের পুরানা পরিচয় গত প্রায় ৫ মাসে আলাদা করে রেখে দিতেই সক্ষম হয়েছেন। কাজেই এতে হাসিনার প্রতি ইউনুসের প্রতিহিংসা তো অনেক দুরের কথা! এমনকি কমপক্ষে শপথের পরের প্রথম কয়েক সপ্তাহ তিনি ও তার উপদেষ্টা (মন্ত্রীদের) এটিচ্যুড ছিল হাসিনা বা তার দলের সাথেও কোন সরাসরি সংঘাত ছাড়াই তারা মিলজুল করে বা পাশ কাটিয়ে তাদের কার্যকাল শেষ করে দিতে চান! আর এই নীতি প্রকাশ হয়ে পড়লেই ববং রিভল্ট আসে। এনিয়ে প্রকাশ্যে আমারই কঠোর সমালোচনা আমি লিখেছি কয়েকটা। যার পরে তার সরকার এটা কারেক্ট করে এমনকি এর পরিণতিতে মন্ত্রীসভা ঢেলে সাজানো বা রিসাফল হয়; বিশেষ করে নয়া স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা নিয়োজিত হয়। এমনকি পরের সেপ্টেম্বর মাসে ফেনীসহ ঐ অঞ্চলে ভয়াবহ বন্যা দেখা দেওয়ার আগে পর্যন্ত তিনি চেষ্টা করেছেন হাসিনা বা ভারত ইস্যু নিয়ে বিরোধ এড়িয়ে চলতে। প্রত্যক্ষ নাম উল্লেখ না করে কথা বলতে!  কিন্তু মূলত ফেনীর উজানে ত্রিপুরায় বাঁধ খুলে দেয়া থেকেই যখন তাকে ইন্ডিয়ার বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থা-আপত্তি না তোলার জন্য অভিযুক্ত করা শুরু হয়েছিল (আমিওও কঠোর আপত্তি জানিয়ে তাকে তুলোধনা করেছিলাম) একমাত্র তখনই তিনি প্রকাশ্যে ইন্ডিয়ার বিরুদ্ধে বক্তব্য দিয়েছেন। আর সেখান থেকেই ভারতের সাথে কমন নদীর পানির ন্যায্য হিসস্যা; ভাটির দেশের পানির অধিকার, ইন্ডিয়ার সাথে সম-মর্যাদা ও সম-অধিকার – এভাবে বাংলাদেশ ভারতের আচরণ আশা করে -ইত্যাদি সব ভান্ড-পোটলা একসাথে খুলে যায়! ততদিনে ইউনুস সরকারের আয়ু একমাস ও এক সপ্তাহ পার হয়ে গেছিল।
তাহলে কী দাঁড়ালো? দাঁড়ালো এই যে এটা শেখর গুপ্তার জন্য একটা শিক্ষা! যে এরপর থেকে মোদির এসাইমেন্ট পেলেই দৌড় দিবেন না। আগে একটু পড়াশুনা করে নিবেন মাঝের যেমন ইউনুস সরকার গঠন হবার পরের এক-দুই মাসে বাংলাদেশে কী হয়েছে কীভাবে কেটেছে! আর তা না করলে এই এসাইনমেন্টের জার্নালিজম এটাও সফল দূরে থাক এটাও টিকবে না।
শেখর গুপ্তা কে বুঝতে হবে ইউনুস বা তাঁর গ্রামীণ ব্যাংক নিয়ে ততপরতার বিরুদ্ধে সমালোচনা কী করে করতে হয় সেটা শেখরকে বাংলাদেশ থেকেই শিখতে জানতে হবে। আমার নিজেরই  এমন বহু সমালোচনামূলক লেখা আছে। কিন্তু সেগুলোর একটাও ইউনুস সরকারের কোন সমালোচনার মধ্যে আনি নাই। আমার বিশ্বাস ইউনুস সাহেব এটা জানেন যে সমাজে গ্রামীণ নিয়ে সমালোচনা আছে যেগুলোকে তিনি তাঁর এখনকার সরকারের গায়ে অযথা লাগিয়ে মাখায় ফেলা ঠিক হবে না। এবং দূরে আলাদা রাখা এটাই তো সঠিক সিদ্ধান্ত। আবার শেখর গুপ্তাকে জেনে রাখতে হবে গ্রামীণ ব্যাংক বা মাইক্রোক্রেডিটের ভাল দিক কী? কেন পশ্চিমাদেশ এটাকে গুরুত্বপুর্ণ মনে করে! পশ্চিমারা নিশ্চয় আবেগী বা বোকা না। আর এছাড়া সারা পশ্চিমে সবাই ক্লিনটন নন!  এমনকি ইন্ডিয়াতে কেন মাইক্রোক্রেডিট চিন্তাটাকে বাণিজ্যিক ব্যাংক হিসাবে হাজির করানো হল? এদিকটা খোঁজ করেন, আমাদেরকে না নিজেদেরকেই দয়া করেন একাজ করে; আপনাদের অবশ্যই এতে বরকত মিলবে! গ্যারান্টি!!!

ইন্ডিয়া বাংলাদেশে একটা ফেয়ার নির্বাচন চায় সেটা আবার যতদ্রুত সম্ভবঃ
কী সাংঘাতিক কথা! তাহলে হাসিনার আমলে কী করেছেন?
এটা একটা সত্যিই তামাসা যে  ইন্ডিয়া বাংলাদেশে একটা ফেয়ার (অবাধ, সুষ্ঠ কারচুপিহীন) নির্বাচন চায় সেটা আবার যতদ্রুত সম্ভব! আচ্ছা, গত ১৬ বছর আপনারা কোথায় ছিলেন? এমন কথা কখনও বলেন নাই কেন?  ঐসময়ের বিনা নির্বাচনের হাসিনাকে নিয়ে আপনাদের খুশিতে গদগদ থাকা, উতফুল্লতা এসবের পক্ষে  অন্তত একটা সাফাই দেন তো দেখি? আপনারা কীভাবে এখন বাংলাদেশে একটা ফেয়ার ও দ্রুত নির্বাচনের সৈনিক হয়ে গেলেন?? এনিয়ে এখন ইউনুস সরকারকে সবদিক থেকে চাপাচাপির রাস্তা ধরে ফেললেন, কেন? এমন রাতারাতি ফেয়ার ও দ্রুত নির্বাচনের সৈনিক? এটা আমরা বুঝি যে নয়া হাসিনা পার্টি আপনারা খাড়া করে ফেলেছেন; সাথে জামায়াতকেও রেখেছেন। আবার বিভ্রান্ত করতে প্রকাশ্যে জামায়াতের বিরুদ্ধে হিন্দুত্ববাদী গোলাগুলিও ছুড়ছেন, তাও বুঝি! আদানির অর্থ ছড়িয়েও আপনারা বাংলাদেশের দল নিয়ন্ত্রণ করতে চাইছেন!  তাই বলে কেন ধরে নিচ্ছেন যা চাইবেন তাই পাবেন?
উল্টাটাও হতে পারে! সাধারণ মানুষ একবার যদি টের পায় যে ইন্ডিয়া বিএনপিকে নয়া হাসিনা বানায়ে বাংলাদেশে ভোটারদের সামনে পেশ করতে চাইছেতাই ইন্ডিয়ার এত চাপাচাপি এবং ফেয়ার ও দ্রুত নির্বাচনের সৈনিক হয়ে যাওয়া তাহলে এতে সাধারণ মানুষ জাস্ট উলটা দিকে ঘুরে যাবে বলেই আমার ধারণা। হাসিনার অত্যাচারে সাধারণ মানুষের কী পরিমাণ ক্ষুব্ধ এটা বুঝলে আপনাদেরকে থামতে হবে! এত বুদ্ধিমান ভাবা বন্ধ করতে হবে।  সাধারণ মানুষের সবচেয়ে খারাপ প্রতিবাদটা হবে যদি এমন ঘটে যায় যে তারা আর কোন উপায় না পেয়ে (হাসিনা আমলের মত) ভোটকেন্দ্রেই না যায়; ১০-১২% ভোট পরে?
আপনাদেরকে মনে রাখতে হবে কোন রাজনৈতিক মুল্যবোধ, নুন্যতম মুল্যবোধ আপনাদের নাই – এটাই ইন্ডিয়ার সবচেয়ে বড় অযোগ্যতা! যা যখন ইন্ডিয়ার স্বার্থে আপনারার তখনই তার ভক্ত – এই হল আপনাদের মোদি বা ইন্ডিয়ার নীতি!

এই কারণে, এখন ফেয়ার ও দ্রুত নির্বাচনের সৈনিক হয়ে যাওয়া অথবা আমাদের কনষ্টিটিউশনে কী আছে কী নাই আপনাদের ইত্যাদি নিয়ে আপনাদের কোন বক্তব্যই আমাদের কারো কাছে পাত্তা পাবে না, কোন গুরুত্ব নাই! কারণ আপনারা নৈতিক ভাবে স্খলিত; নুন্যতম মূল্যবোধ নাই! আপনারা যদি গত ১৬ বছর একবার অন্তত ফেয়ার ও দ্রুত নির্বাচনের সৈনিক বলে হাজির হতেন, আমরা হাসিনা সরকারে যে কনষ্টিটিউশন মানে না এরই অধীনে; বরং হাসিনা ইচ্ছামত আইন নিয়ম বানিয়ে চলছে এসবের বিরুদ্ধে একবার অন্তত কথা তুলতেন! পররাষ্ট্রসচিব সুজাতা সিং এসে ঠিক করে দিতেন না যে আমাদের বিরোধীদল বিএনপি নয় জাতীয় পার্টিই হবে??????

 

ভারতের পররাষ্ট্রসচিব সুজাতা সিং এসে ঠিক করে দিতেন না যে আমাদের বিরোধীদল বিএনপি নয় জাতীয় পার্টিই হবে! আর আজ তারাই ফেয়ার ও দ্রুত নির্বাচনের সৈনিক! কী সাংঘাতিক!!!!

 

তাহলে এখন কোনমুখে আপনারা গণতন্ত্রী সাজতেছেন?  ফেয়ার ও দ্রুত নির্বাচনের সৈনিক সেজে কনষ্টিটিউশন শিখাচ্ছেন? বিএনপিকে নয়া হাসিনার দল হিসাবে সাজাতে চাইছেন? আমি নিশ্চিত এতে বিএনপিরই কপাল পুড়বে!  এটা একটা নয়া হাসিনার আওয়ামি লীগ এই ইমেজ পেয়ে বসলে এই দল শেষ!!!! তখন আপনারা কী করবেন??? সেটাও ভাবুন! দুনিয়া এত সহজ নয়! অথচ শেখর গুপ্তার পত্রিকা দ্যা প্রিন্টই আরেকটা ভিডিও ক্লিপ বানিয়েছে ইউনুস কে খাটো দেখানোর জন্য।

শুনে রাখেন, আপনাদের (বোকার) স্বার্থের দিক থেকে হাসিনা আপনাদের চোখে মডেল হতে পারে!  আর বিএনপিকে হাসিনার জায়গায় বসানোর লোভ দেখাতে পারেন! কিন্তু হায়! হাসিনার খুনী সিদ্ধান্তে মাত্র একমাসের মধ্যে ১২-১৫শত হত্যা, ১০৫ জন দুগ্ধপোষ্য শিশুকে তাদের বিছানায় শুয়ে থাকা অবস্থায় মেরে ফেলা হয়েছে, প্রায় ৭০০-হাজার গুম- অপহরণ করা হয়েছে; জঙ্গী বলে যাকে তাকে হত্যা,   ছাত্রশিবিরের কতগুলো কর্মি যে পায়ে গুলি খাওয়া চিরতরে পঙ্গু হয়ে গেছে এর খবর নাই! আর আনুপাতিকভাবে এবার দশগুণ করেন তবে আনুমানিক আহত দের সংখ্যা পাবেন! যাদের চোখ অথবা হাত-পা নাই!!! এখন বলেন, আমাদের সমাজ-রাজনীতি এসব ভুলে যাবে, এর কোন ইমপ্যাক্ট নাই, পড়বে না?  ভোটের বাক্সেও না?  বা আপনাদের নয়া হাসিনা বানাতে চাওয়া বিএনপির উপরে এর কোনই ছাপ পড়বে না, ছাপ থাকবে না????? সবই ক্ষমতা আর টাকাপয়সা দিয়ে, বিলিয়ে মুখবন্ধ সমাধান করে ফেলবেন!!!

নিশ্চিত থাকেন আপনারা হেরে যাবেন! কারণ,  আপনাদের পলিটিক্যাল বা থিওলজিক্যাল কোন মূল্যবোধ, নুন্যতম ইথিকস, নীতিকথা ইত্যাদি কোন কিছুর দরকার নাই? মনে করেন, জাস্ট মানুষের কেবল বিষয়-আশয়ের স্বার্থ আছে????  ঘিনঘিনানি স্বার্থ? দুনিয়া এভাবে চলে নাই, এ’পর্যন্ত আসে নাই!!!!! আগামিতেও চলবে না!

 

লেখকঃ
গৌতম দাস
রাজনৈতিক বিশ্লেষক
goutamdas1958@hotmail.com

আপডেটঃ   রাত ০৮ঃ ৫৯     ১৪  জানুয়ারি ২০২৫

Leave a comment