ভলকার টুর্ক কেন আমাদের জুলাই ইতিহাসের এক গুরুত্বপুর্ণ ব্যক্তিত্ব!


ভলকার টুর্ক কেন আমাদের জুলাই ইতিহাসের এক গুরুত্বপুর্ণ ব্যক্তিত্ব!
গৌতম দাস
০৭ মার্চ ২০২৫
https://wp.me/p1sCvy-6li

ভলকার টুর্ক [Volker Türk]

 

কিছু প্রাক-পরিচিতিঃ
ভলকার টুর্ক [Volker Türk] হলেন বর্তমানে জাতিসংঘ হিউম্যান রাইট ইস্যুতে মুখ্য প্রতিনিধি। আরো ভেঙ্গে বললে, জাতিসংঘ [United Nations; সংক্ষেপে  UN] এই মুল প্রতিষ্ঠানের অধীনে স্পেশালাইজড আরো প্রায় ১৫ টা প্রতিষ্ঠান আছে যাদেরকে ইউএন এর এজেন্সি প্রতিষ্ঠান বলা হয়;  যার মধ্যে সম্ভবত সবচেয়ে বড়টা হল ইউএনডিপি [UNDP] যা আমাদের মত সবদেশেই অফিস আছে কারণ, এটা সামাজিক অবকাঠামোগত প্রকল্প দেখাশুনা্র প্রতিষ্ঠান; তাই ‘ডিপি’ মানে ডেভেলপমেন্ট প্রোগ্রাম। তো সবদেশেই এই UNDP মানে, মূল UN বা জাতিসংঘের অধীনের এজেন্সি প্রতিষ্ঠান হলেও যেকোন দেশের UNDP অফিসের প্রধানকে, মূল জাতিসংঘ প্রতিষ্ঠানের স্থানীয় প্রতিনিধি / প্রতিষ্ঠান মানা হয়।
ঠিক সে রকমই জাতিসংঘ হিউম্যান রাইট ইস্যুতে এক এজেন্সি প্রতিষ্ঠান হল OHCHR [Office of the United Nations High Commissioner for Human Rights]। যার দেখাশুনা বা ডিল করার ইস্যু হল হিউম্যান রাইট বা মানবাধিকার। তাই এটাকে ‘মানবাধিকার হাইকমিশনারের অফিস’ বলাও হয়।  আর এই ভলকার টুর্ক নিজেই হচ্ছেন সেই জাতিসংঘের হিউম্যান রাইট হাইকমিশনার; OHCHR এর প্রধান কর্তা
একটা ছোট আরেকটা কথা এখানে জানায়ে রাখি। সেটা হল, সবাই জানি ইউএন এর হেড কোয়ার্টার আমেরিকার নিউ-ইয়র্কে। হা অবশ্যই, মূল অফিস সহ একগুচ্ছ এজেন্সি হেডকোয়ার্টারও সেখানে একসাথে। কিন্তু এর বাইরে আরেকগুচ্ছ জাতিসঙ্ঘের হেডকোয়ার্টার হল জেনেভায় [Geneva, Switzerland]। এর মধ্যে সবচেয়ে বড়টাই হল এই  মানবাধিকার হাইকমিশনারের অফিস OHCHR।  জাতিসংঘের মোট প্রায় ১৯৩-৪ সদস্য রাষ্ট্রের প্রায় সকল প্রতিনিধিকেই (নিউইয়র্কের বাইরে) জেনেভাতেও অফিস খুলে রাখতে হয়েছে যাতে স্ব স্ব রাষ্ট্রের স্থায়ী প্রতিনিধিরা OHCHR এর সাধারণ সভায় অংশ নিতে পারে।  এই বিচারে জেনেভা হয়ে উঠেছে আসলে লবিইং [lobbying] এর শহর। OHCHR এর কোন সাধারণ সভায় হয়ত দেখা যাবে  কোন ছোট (বাংলাদেশের কাছে অচেনা) রাষ্ট্রকে দিয়ে আমেরিকা  বাংলাদেশের বিরুদ্ধে / পক্ষের কথা ঐ সভায় তুলিয়েছে। এভাবেই ছোট বা বড় সবদেশের ভয়েজ জেনেভায় গুরুত্বপুর্ণ!
গত দুদিন আগে এমনই এক সভাতেই বাংলাদেশে হাসিনার ২৪ শের জুলাই-আগষ্ট হত্যাকান্ড নিয়ে জাতিসংঘ যে প্রাথমিক অনুসন্ধান রিপোর্ট  তৈরি করেছে তা পেশ করা হয়েছে। বাংলাদেশের আইন মন্ত্রী / উপদেষ্টা সহ ভিকটিমদের কয়েকজন স্বজনও ঐ সভায় অংশ নিয়েছে।  অর্থাৎ এই সভা থেকে হাসিনার অপরাধের চিত্র ও  ডকুমেন্ট এখন থেকে গ্লোবাল হয়ে উঠল। মনে রাখতে হবে, হাসিনার অপরাধ নিয়ে কোন ভুয়া বিতর্ক তৈরি করে হাসিনা (সাথে মোদির ইন্ডিয়া) যেন পালিয়ে না বাঁচতে পারে তা ভেবে  ইউনুস সাব সরাসরি ভলকার টুর্ক এর সাথে কথা বলে এই অনুসন্ধান শুরু করার আহবান রেখেছিলেন সাথে তাঁর সরকারের পুর্ণ সহযোগিতার আশ্বাস দিয়েছিলেন বলেই জাতিসংঘের এই প্রাথমিক অনুসন্ধান এর কাজ সহজেই অল্প সময়ের মধ্যে এক সলিড প্রমাণ আমাদের সবার কাছে তুলে ধরা সম্ভব হয়েছে। ফলে তা সারা দুনিয়ার কাছেও।

বিবিসির হার্ডটক প্রোগ্রামে বাংলাদেশ প্রসঙ্গে ভলকার টুর্কঃ
বিবিসির (ইংলিশ) হার্ডটক [Hard Talk] শিরোনামের এক বহু পুরানা প্রোগ্রাম আছে – মুখের উপর শক্ত প্রশ্ন করা হয় বলে সেখান থেকে এই নাম। এককালে (১৯৯৭-২০০৬)  Tim Sebastian ছিলেন এর এঙ্কর [anchor] বা প্রধান হালধরা ব্যক্তি পরিচালক। আমরা সে আমলের লোক, বলতে পারেন প্রেসিডেন্ট বুশের ওয়ার অন টেরর আমল অথচ আল-জাজিরা তখনও চালু হয় নাই (হয়েছিল ২০০৫ সালে); এমন একটা সময় সেটা। তো সম্প্রতি এই হার্ড টকের  অতিথি হয়েছিলেন  ভলকার টুর্ক নিজেই। এই ফাঁকে একটা কথা সবাইকে বলে রাখিঃ নোট করে রাখতে পারেন। আমাদের জুলাই অভ্যুত্থানের রাজনৈতিক ইতিহাসে এই ভলকার টুর্ক এর নাম ইতোমধ্যেই গুরুত্বপুর্ণ ব্যক্তিত্ব হিসাবে জড়িয়ে গেছে, যার নাম আর আলাদা করা যাবে না। এর পিছনের মূল কারণ একাধিক। কী সেই গুলা?

১৬ জুলাই ২০২৪ ছিল শেষ দিন। কীসের? এদিক দুপুরের পর থেকে সশস্ত্র ছাত্রলীগ ও দলবাজ পুরা পুলিশ বাহিনী মাঠ থেকে প্রত্যাহার করা হয়েছিল। এরপর সন্ধ্যায় ডিএমপি হেড কোয়ার্টারে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অধীনের সব বাহিনীর শীর্ষকর্তাদের বৈঠকে সব বাহিনী প্রত্যাহার করে সরাসরি সামরিক বাহিনীর হাতে সিভিল আইন-শৃঙ্খলা রক্ষার দায়ীত্ব তুলে দেয়া হয়েছিল। যেটা ছিল আসলে হাসিনার দিক থেকে দেখলে এক আত্মঘাতি সিদ্ধান্ত। যদিও তিনি ভেবেছিলেন সীমাহীন বলপ্রয়োগে কঠোর হাতে দমন আর বেপরোয়া গোলাগুলির ব্যবস্থা করলে ভয়ে ছাত্র-জনতা সব মাঠ ছেড়ে চলে যাবে। কিন্তু ঘটেছিল উলটা! এমন অতিরিক্ত বলপ্রয়োগ, হাই-হ্যান্ডনেস ইত্যাদি এসবই  আসলে ঘুড়ে মাঠের ছাত্র-জনতার পক্ষে আরো ব্যাপক হারে সাধারণ মানুষের সমর্থন পেয়ে বসেছিল।  শুধু তাই না এই পরিস্থিতিটাই আরেক নির্ধারকশক্তি জাতিসংঘ কে পটভুমিতে হাজির করেছিল – এরাই ওয়াকারের নেতৃত্বের সেনাবাহিনী ও হাসিনার বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান নিয়ে সতর্কতা ওয়ার্নিং জানিয়ে এদের উলটা বিপদের দিকে ঠেলে দিয়েছিল। ওয়ার্নিং দিয়েছিল যে এমন করলে সেনাসদস্যদের জন্য জাতিসংঘ শান্তিমিশনের দরজা বন্ধ হয়ে যেতে পারে!

সুবিধাটাই যখন অসুবিধাঃ
জেনেভা মানবাধিকার হাইকমিশনারের অফিস – এদের কাজই হচ্ছে কোন সদস্য রাষ্ট্রে ব্যাপক মানবাধিকার লঙ্ঘনের কোন  ঘটনা চলছে কীনা সেদিকে তা নজর রাখা বা করা।  কিন্তু আমাদের কমিউনিস্ট ভায়েরা এটা জাতিসংঘের জন্মের পর থেকে কখনই এই ভাষ্য হজম করতে চায় নাই বা পারে নাই। উলটা তাদের কথা হল, জাতিসংঘ দিয়ে কিছু হয় না, হবে না!  হা সেকথাও  অবশ্যই আংশিক হলেও সত্য; যার মূল কারণ হল, আমেরিকান প্রভাব জাতিসংঘের সব অফিসের উপরই প্রবল!আবার এর পিছনের মূল কারণ, আর কোন রাষ্ট্র জাতিসংঘ প্রতিষ্ঠান চালানোর ব্যয় বহণ করতে চায় না বা সক্ষম নয় বলে অপারগ! আর উলটা দিক থেকে বললে, এটাই গ্লোবাল নেতা রাষ্ট্রের (আমেরিকার) দায় হয়ে আছে বা যায়!  কিন্তু তাই বলে জাতিসংঘের সবই তুচ্ছ বা অহেতুক এই প্রতিষ্ঠানের থাকা না থাকা – এই অনুমানও একেবারেই ভিত্তিহীন – আমার বাড়িটা পড়শির চেয়ে নিশ্চয় ভাল ধরনের শ্রেষ্ঠত্ববাদিতা বোধ!

সেই একই ভঙ্গিতে প্রসঙ্গ তোলা হয়েছিল  হার্ডটক অনুষ্ঠানে যেখানে ভলকার টুর্ক ছিলেন প্রধান অতিথি। তিনি সেখানে শক্তভাবে পরিস্কার করে দাবি করেন তাঁর অফিস থেকে বাংলাদেশের সেনাপ্রধানকে ওয়ার্নিং বা সতর্কতামূলক বার্তা দেয়া হয়েছিল (বলে ক্রমেই হাসিনার ক্ষমতা দুর্বল হয়ে পড়েছিল) ১৬ জুলাই ২০২৪ তারিখের পরে।  আসলে সেসময় এই বার্তা দেয়া হয়েছিল দুইভাবে। একটা তো সরাসরি মানবাধিকার হাইকমিশনের অফিস থেকে বাংলাদেশের সেনাপ্রধানকে ভায়া ইউএন মিশন নিউইয়র্ক [DPKO], যেখানে মিশন সংশ্লিষ্ট সব সদস্য রাষ্ট্রের প্রতিনিধিরা বসেন তাদের মাধ্যমে, এভাবে। এটাই ভলকার উল্লেখ করেছেন হার্ডটক অনুষ্ঠানে সেটা এখানে  বাংলাদেশ নিয়ে ফলকার টুর্ক  দেখতে পারেন। বাংলাদেশের সেনাবাহিনী (তিন বাহিনীই) ইউএন মিশনে সর্বাধিক সেনা সরবরাহকারী প্রথম দুই দেশের একটা।  এমনকি কোন কোন সুনির্দিষ্ট মিশনে সবার চেয়ে বেশি তা এক নম্বরে। তবে মিশনে অংশ নেবার ক্ষেত্রে একটা রুল করা হয়েছে একালে – যেকোন সেনা সদস্যের নামে নিজ দেশের অপরাধীর লিস্টে মানবাধিকার লঙ্ঘণের অভিযোগ থাকলে তিনি বাদ পড়বেন সাথে ওদেশের খোদ সরকারই যদি ব্যাপক লঙ্ঘণকারী সরকার হয় সেক্ষেত্রে ঐ সদস্য রাষ্ট্র থেকে সব সেনা সদস্যকেই নিজ দেশে ফিরে যেতে জাতিসংঘ মিশন বলতে পারে। এর পিছনের মুল যুক্তি যে দেশের সেনা নিজ দেশেই মানবাধিকার লঙ্ঘণকারি সেদেশ কীভাবে আরেক দেশে শান্তি মিশন স্থাপনে অংশগ্রহণকারী হতে পারে!!! এটা যথেষ্ট শক্ত যুক্তি অবশ্যই!

এছাড়াও আরেকটা হুশিয়ারি গিয়েছিল মানবাধিকার র‍্যাপোটিয়ারের কাছ থেকে।  OHCHR অফিসের অনেকগুলো  র‍্যাপোটিয়ার [Rapporteur] থাকেন যারা অবশ্যই OHCHR অফিসের কোন পেড [paid] স্টাফ নন, বেতনভুকও নন; বরং একেবারেই স্বাধীন এবং সুনাম থাকা দেশি-বিদেশি ব্যক্তিত্ব। এই স্বাধীন র‍্যাপোটিয়ারের দেয়া রিপোর্ট এটাকেই মাঠের সত্যের ভিত্তি গণ্য করে আভ্যন্তরীণ ভাবে OHCHR অফিসের যেকোন কমিটি আলোচনা-পর্যালোচনা শেষ সিদ্ধান্ত নিয়ে থাকে। বাংলাদেশ ইস্যুতে তখনকার র‍্যাপোটিয়ার  আইরিন খান সরাসরি  হাসিনা সরকার ও সেনাপ্রধানের অফিসের সাথে বাদানুবাদে জড়ান। তিনি পাল্টা চ্যালেঞ্জ জানিয়ে দাবি করেন মারাত্মক মানবাধিকার লঙ্ঘণের প্রমাণ আছে তার কাছে। আসলে ফিল্ড লেবেলে বাংলাদেশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা মানবাধিকার ডিফেন্ডার কর্মীরা ভলিনটিয়ারেরাই এসব তথ্য-প্রমাণ জড়ো করে আইরিনের হাতকে শক্তিশালী করে রেখেছিলেন। তাই তিনিও পাল্টা এমন চ্যালেঞ্জ জানাতে পেরেছিলেন।

আসলে এর সাথে যুক্ত হয়েছিল দুইটা ইস্যু।
সেনা তত্বাবধানে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষার দায়িত্ব তাদেরকে দেয়ার  মধ্যে –  হেলিকপ্টার থেকে র‍্যাবের গুলি ছোড়া,   বিভিন্ন বাসার উচু ছাদ থেকে আশেপাশে নিচে পুলিশের ( বা সাদা পোষাকে) নির্বিচারে গুলি ছোড়া আর বিশেষ করে রামপুরা-মৌচাক রোডে হাই স্পিডে আর্মোড কার [ armoured car লোহার খাঁচায় মুড়ানো] ফলে ভিতর থেকে বসে আরামে নির্বিচার গুলি ছোড়া ঘটেছিল। এর উপর ঐ কার গুলো ছিল জাতিসংঘের লোগো মার্কা লাগানো সাদা কার – মানে জাতিসংঘ মিশন থেকে ফেরত আসার পর আর রঙ বদলানো হয় নাই গরিমসি করে। তাই এনিয়ে জাতিসংঘ থেকে শক্ত আপত্তি দেয়া হয়েছিল যে এই নিপীড়ন ও হত্যাযজ্ঞা এতে যেন জাতিসংঘ জড়িয়ে আছে এমন ইঙ্গিত বহন করা হচ্ছে।
সব মিলিয়ে এক ব্যাপক গ্লোবাস্ল ও স্থানিয় সামাজিক চাপ তৈরি হয়েছিল এতে। আর এর প্রভাবে আমাদের খুবই ঘন বসতির সমাজে আমাদের সেনা সদস্য আর তার সিভিল সমাজ খুব দুরের কিছু নয়। তাই এর সামাজিক উত্তাপ সেনাবাহিনী মেস-ক্যান্টিনের – এই ধরনের কমন সময় কাটানোর জায়গায়  তা জুনিয়র অফিসারদের জন্য প্রকাশ্যেই আলোচনার প্রসঙ্গ হয়ে যায়। সেটা এই বলে যে নিজ জনগণকে নির্বিচারে হত্যার দায় এসে লাগছে তাদের  সেনাসদস্য, কলিগ সকলকে আর তাদের প্রতিষ্ঠানের উপরে!!!!   এনিয়ে সেনাবাহিনীতে  আত্মীয় বন্ধুবান্ধব যাদের আছে তাদের কাছে থেকে ভিতরের ঘটনাবলীতে প্রতিক্রিয়াও বাইরে আসতে থাকে। এসব কথাই আমিও বিস্তারিত তখনই জেনেছিলাম।   অর্থাৎ বাংলাদেশের কম-বেতনপ্রাপ্ত [poor paid] সৈনিক সদস্যদের জন্য জাতিসংঘে যেতে পারা যেমন তাদের জন্য এক বিরাট রিলিফ বা আয়ের বিকল্প ব্যবস্থা হয়ে উঠেছিল   আর সেই বিকল্প ব্যবস্থাটাই আবার হাসিনা ফ্যাসিস্ট-শাসকের জন্য এক বিরাট গলার ফাঁস হয়ে উঠেছিল। সাধারণ সৈনিক আর জুনিয়র অফিসার যারা সেনাজীবনে মোট তিনবার মিশনে যাবার সুযোগ পেয়ে থাকে তারাই এতে হাসিনার নির্বিচার গোলাগুলি গুম-খুনের প্রবল প্রতিবাদি এবং বিরোধী হয়ে উঠেছিল। কারণ পরিস্থিতি তাদের জন্য শান্তিমিশনে যাবার বিরুদ্ধে এমন হয়ে যাচ্ছিল। এটাই ১৯ জুলাই থেকে সেনাপ্রধানকে দিয়ে নির্বিচারে গুলির ভয় দেখিয়ে হাসিনার নিজ জনগণের বিক্ষুব্ধ জনরোষকে নিয়ন্ত্রণ একেবারেই অসম্ভব করে তুলেছিল।  সেনাপ্রধান ওয়াকার এর পরাজয়ের (আত্মীয়ের স্বার্থ -খায়েসের পক্ষে সার্ভিস দিতে না পারা) মূল কারণ ছিল এটাই। শুধু তাই নয়, সেই অপরাধের অভিযোগ এখনও তার মাথার উপরে ঝুলছে। এভাবে  সেনা প্রতিষ্ঠানের এভাবে বিপক্ষে ঘুরে যাওয়া এটাই হাসিনার ক্ষমতা হারানোতে ও পলায়নে  নির্ধারক হয়ে গেছিল। এর কারণে, ওয়াকার তখন বিপরীত পদক্ষেপে,  সেনাসদরে দরবার ডেকে নতুন করে নতুন নীতিতে অস্ত্র সংবরণ এর ঘোষণা ও সংশোধন করে নেয়া ছাড়া ওয়াকারের সেনা-নেতৃত্বের আর কোন উপায় ছিল না।  এটাই সেনাপ্রধানের একক কর্তৃত্ব হারানোর ক্রমশ শক্ত কারণ হয়ে উঠেছিল। পদবী তিনি শেয়ার করছেন না কিন্তু কার্যত তিনি কর্তৃত্ব হারানো বা তা শেয়ার করতে বাধ্য হয়ে যাওয়া অবস্থায় আছেন। বাংলাদেশের সেনা ইতিহাসের এ’এক আজীব পরিস্থিতি বলেই অনুমানে মনে হয়!

ইতোমধ্যে আপনারা এখন সবাই জানেন ৫ আগষ্ট ২০২৪ হাসিনা পলাতক হন, দেশত্যাগ করেন।  ওদিকে বাসায় বসেই নিয়মিত সব খবরাখবর আমি পেতে থাকি। এরকমই এক ঘরোয়া কথাবার্তায় আমার এক ছোটভাই মাসুদ [Masud zakaria] ক্যামেরা নিয়ে হাজির হয়েছিল একদিন যাতে জুলাই গণঅভ্যুত্থান নিয়ে আমার টাটকা মন্তব্যগুলো (আগামিদিনের ইতিহাস হিসাবে যা গণ্য হতে পারে) সে রেকর্ড করে রাখতে পারে। সময় দিনক্ষণটা যতটা অনুমান করা যায় তা ২০ আগষ্টের আগে নয়, আমার বাসায় বসেই প্রায় আড়াই ঘন্টার সেই কথোপকথন রেকর্ড করা হয়েছিল। এই কথোপকথন নানা কারণে খুব বেশি প্রচার করা হয় নাই। আমি নিজে পাবলিকলি তা শেয়ার করি নাই। আজ এখানে তা তুলে দিব হয়ত!

কোন গভীর বা ব্যাপক রাজনৈতিক পরিবর্তন – যেমন আমাদের জুলাই গণঅভ্যুত্থান – এর ইতিহাস লেখা বর্ণনা করা সহজ নয়। এছাড়া তা দেরি করে লেখা ভাল। যাতে এই ভাল-মন্দ দিক পাবলিক ততদিনে ঠান্ডা মাথায় ভেবেচিন্তে রিভিউ করতে সক্ষম হয়। টাটকা অস্থির বা থিতু হয় নাই যখন তখনকার চেয়ে এতে স্থিরতার সুবিধা বেশি পাওয়া যায়।  তবু ঐ কথোপকথন  রেকর্ডিংয়ে আমার চোখে ঘটনাবলি বর্ণনায় আমি তিনটা মুখ্য নির্ধারকের কথা উল্লেখ করেছি – ১। ছাত্র-জনতা  ২। সেনাঅভ্যন্তরে নেতৃত্ব-ক্ষমতায় বদল আর ৩। জাতিসংঘের ভুমিকা(OHCHR অফিস)। বেশিরভাগ জনই এই তৃতীয় ফোর্স ও ফ্যাক্টর টার কথা জানেই না। সেটাই গতকাল ভলকারের বক্তব্যে উঠে এসেছে, শিরোনাম হয়েছে।   যেটা আমার ২০ আগষ্টের পরের রেকর্ডিংয়ে আমি স্পষ্ট  উল্লেখ করেছিলাম।

ঘটনাবলি বর্ণনায় আমি তিনটা মুখ্য নির্ধারক বা ফ্যাক্টর এর কথা উল্লেখ করেছি –
১। ছাত্র-জনতা
২। সেনাঅভ্যন্তরে নেতৃত্ব-ক্ষমতায় বদল আর
৩। জাতিসংঘের ভুমিকা(OHCHR অফিস)।

 

আর প্রথম দুইটা নির্ধারক ফোর্স ও ফ্যাক্টর এর কথা প্রসঙ্গে বলব – এই দুইটা ফোর্স বা ফ্যাক্টর আসলে পরস্পরের পরিপূরক!  তবুও  সেনাঅভ্যন্তরে নেতৃত্ব-ক্ষমতায় বদল এই ফ্যাক্টরটাকে  আমি আগিয়ে রাখব। তা এজন্য যে আমার জানামতে এই শক্তির জন্ম ও বিস্তার প্রস্তুতি সেই ২০১৯ সাল থেকে হলেও বাইরের রাজনৈতিক পরিস্থিতি কখনই এর জন্য অনুকুলে আসে নাই। এমনকি লাগাতর তিন বছর বাইডেনের (স্যাংশন ও মানবাধিকারের খড়্গ ) হাসিনার উপর ঝুলে থাকলেও এর সুবিধা নিয়ে হাসিনাবিরোধিদের আন্দোলন মাঠে নামা পর্যন্তই সবকিছু থেমে থেকেছিল – এরপরে দুইটা রাজনৈতিক দলের বারবার অনিহা – মূলত এর (তাদের বিশেষ স্বার্থ, বিশেষ হিসাব মিলে নাই বলে) কারণে এটা আর আগাতে পারে নাই। আর ২৮ অক্টোবর ২০২৩ এটা একেবারেই হাতগুটানো মৃতপ্রায় হয়ে যায়। ইতোমধ্যে এর আগেই অবশ্য বাইডেনও পল্টি মেরেছিল সেপ্টেম্বর ২০২৩ থেকে – রে যা বাইডেন-হাসিনার সাথে এক হয়ে কাজ করবে  – বলে ফতোয়া দেয়া বাইডেনের হাসিনাকে লিখিত চিঠি প্রকাশ্যে এসেছিল।
এই বিচারে বলা যায়, যেখানে রাজনৈতিক মাঠ আটকে পড়েছিল সেখান থেকে একে উঠানোর কাজটা বলা যায় নিজের অজান্তেই সম্পন্ন  করে ফেলেছিল ছাত্রদের কোটা আন্দোলন। যা পরে এক দফা বা হাসিনা পতনের ডাক পর্যন্ত উঠে আসার ইচ্ছা ব্যক্ত করাটা এটাকেই পুঁজি করে ‘সেনাঅভ্যন্তরে নেতৃত্ব-ক্ষমতায় বদল”   ব্যাপারটা ঘটিয়ে দিবার সুযোগ নিয়েছিল।
তাই এককথায় বলা যায়, ছাত্র-জনতা সবল্ভাবে সেসময়ে মাঠে যদি হাজির না হতে পারত তবে ‘সেনাঅভ্যন্তরে নেতৃত্ব-ক্ষমতায় বদল’ – কোনভাবে সম্পন্ন হতে পারলেও এটাকে গণঅভ্যুত্থান বলা দূরে থাকে এটা এক ব্যারাকের ক্যু মানে সামরিক ক্ষমতা দখল বলেই আমাদের ইতিহাসে হাজির হত – একথা নির্দ্বিধায় বলা যায়!
আবার উলটা দিক থেকে বললে, ‘সেনাঅভ্যন্তরে নেতৃত্ব-ক্ষমতায় বদল’ এর লক্ষ্য বলে যদি কিছু নাই থাকত তবে এই ছাত্র-জনতা রক্তস্নান করে কয়েক হাজার মরে রাস্তায় রাস্তায় পড়ে থাকত! এতে হাসিনা রক্তস্নাত হত অবশ্যই কিন্তু ক্ষমতা নিজ মুঠোর মধ্যেই রেখে দিতে সক্ষম হয়ে যেত!  এই হল মোটা দাগে আমার অনুমান বিশ্লেষণ!
তবু এরপরে এখনও শেষ একটাই কথা যা অব্যক্ত রেখে দিয়েছি তা হল, সশস্ত্র ছাত্রলীগ ও আওয়ামি-বেপরোয়া-পুলিশ লীগ কীভাবে ও কেন পরাজিত হয়ে গেছিল। আর এর ফলাফলে যা থেকে হাসিনাকে আর্মির উপর নির্ভরশীল করে দিয়েছিল। তা বলা হয় নাই।  ইতিহাসের বহু অধ্যায় বলা হয় ১৫-২০ বছরের আগে ওপেন বলা যায় না।  এটা সম্ভবত সেই অধ্যায়; কেউ হয়ত বলবে সেকথা!

শেষ করব দুটা কথা বলেঃ
ভলকার টুর্ক এর অফিস যদি সেনাবাহিনীকে ওয়ার্ণিং না দিত, আপত্তি না তুলত তাহলে  ‘সেনাঅভ্যন্তরে নেতৃত্ব-ক্ষমতায় বদল’ – এটা ঘটত বা সহজে ঘটানো যেত না। এই অর্থে এটা যেন সবকিছুর উপরে প্রধান ফ্যাক্টর-নির্ণায়ক।
কিন্তু এর উপরও আরেকটা নির্ণায়ক আছে। সেটা হল, কেন বাইডেনের আমেরিকা  ভলকার টুর্ক এর অফিস কে এই স্বাধীনভাবে কাজ করতে এলাও করেছিল?????

এটা বিলিয়ন ডলারের প্রশ্ন!
যদিও জানা থাকলে জবাবটা খুব সহজ মনে হবে!  সাধারণত, ভলকার টুর্ক এর অফিস কে আমেরিকা তার স্টেট ডিপার্ট্মেন্ট মানে আমেরিকান পররাষ্ট্র বিভাগ সব সবসময় নিজ সহায়ক অভিমুখে চলতে সব সময় বাধ্য করে থাকে। যতটা যতক্ষণ আমেরিকা একে প্রভাবিত করতে পারে। এটা সাধারণভাবে সবসময় সত্য! কিন্তু আমাদের আলোচ্য ক্ষেত্রে এটা একটা নতুন ঘটনা হয়ে হাজির ছিল। তা হল,  ৫ ফেব্রুয়ারি ২০২৪ বাইডেন আনুষ্ঠানিকভাবে হাসিনা সরকারের সাথে একযোগের কাজ করবে বলে চিঠি লিখে তা পাঠিয়েছিল রাষ্ট্রদুত পিটার হাসের হাত দিয়ে। আর তা ব্যাপক মিডিয়া পরিচিতিতেই ঘটেছিল, এমনকি এর আগে ৭ জানু. ২০২৪ কথিত নির্বাচনটা বাইডেন হাসিনাবিরোধী সকলের সাথে বিশ্বাকসঘাতকতা করে হাসিনার কথিত নির্বাচনকেই সমর্ত্থন দিয়েছিল। ফলে এককথায়, বাইডেন ১৮০ ডিগ্রী ঘরে হাসিনার পক্ষে পতাকা উড়িয়ে দিয়েছিল। ফলে বাইডেন প্রশাসন ভাবতেও পারে নাই যে এর চার মাসের মাথায় খোদ হাসিনা ঢাকার এক গণঅভ্যুত্থানে উতখাত হবেন, দেশছাড়া হবেন। তাই এই মিরাকেল হাসিনা উতখাত ঘটে যাওয়া আসন্ন হয়ে উঠলে বাইডেন প্রশাসন নিজ পরাজয় নিজ বোকামিতে মুখ লুকানোটা ফরজ হয়ে যায়।
কারণ আসলে, বাইডেন-হাসিনা একসাথে কাজ করবে একথা বলে ফেলার পরে হাসিনার উতখাত হয়ে যাওয়া মানে তো বাংলাদেশ থেকে বাইডেন প্রশাসনেরও উতখাত হয়ে যাওয়া। এবং বাস্তবে ঘটে গেছিল সেটাই। ফলে এখন কী হাসিনা পতনের পরে বাংলাদেশে আমেরিকা নিপাত যাক, কমিউনিস্টদের সাম্রাজ্যবাদ নিপাত যাক, ঢাকায় বাইডেনের কুশপুত্তলিকা দাহ কংবা আমেরিকান ফ্ল্যাগ পায়ে দলা বা পুড়ানো শুরু হবে? হাসিনা উতখাতের সাথে তো তাই হওয়াটাই উচিত ও স্বাভাবিক ছিল। কিন্তু হয় নাই; হতে দেয়া হয় নাই। প্রাকটিক্যাল কারণে। যা্রাই কেবল মাত্র দূরের জিনিষও দেখতে পায় তারাই এটা নিয়ন্ত্রণ করেছিল! এককথায়, আমেরিকা অপরাধী কিন্তু একে সাথে নিয়েই আমরা সামনের দিকে তাকাতে চাই! এটা এজন্য যে আমেরিকা যেন তা আমল করে সামনে আমাদের বিরোধিতা না করে আর ভারতকেই উলটা আমাদের পিছনে লেলায় না দেয়। এতে আমাদের সুবিধা হবে, আমেরিকা-বিচ্ছিন্ন এক ইন্ডিয়াকে আমরা পাবো যাকে মোকাবিলা করতে আমাদের জন্য তুলনামূলক সহজ বাস্তবতা আমাদের সামনে থাকবে। আর আমেরিকা মনে করিয়ে দেয়া যে তুমি অপরাধী; আর তা হলেও আমরা আমেরিকার সাথে ইতিবাচক সম্পর্ক চাই। এই পররাষ্ট্র-নীতির কারণে ইউনুস সরকার এক গ্লোবাল ভারসাম্য তৈরি করে টিকে থাকতে পারছে।
যদিও (নিজ অযোগ্যতা ও ছদর ঢাকতে) মোদি-জয়শঙ্কর মিথ্যা প্রপাগা্নডার চেষ্টা করেছিল যে বাইডেন প্রশাসনের বিরূপতার কারণেই হাসিনা নাকি উতখাত হয়েছে। কিন্তু এই বয়ান ভাত পায় নাই! আমরা বিজয়ী হয়েছি!
তাহলে বাইডেন প্রশাসন জুলাই ১৬, ২০২৪ থেকে ভলকার টুর্ক এর অফিস কে কী বলেছিল, কী আমেরিকার নীতি জানিয়েছিল? তা এককথায় বললে,   ভলকার বাংলাদেশ আর্মিকে ওয়ার্ণিং দিতে মনস্ত করলে বাইডেন প্রশাসন তাতে কোন বাধা দেয় নাই। এটুকুই আমাদের জন্য যথেষ্ট উপকারি ছিল! ফলে ভলকার টুর্ক ওয়াকার এন্ড হাসিনা গংয়ের উপর প্রবল হুমকি ও চাপ সৃষ্ট করতে সক্ষম হয়েছিল। আসলে বলতে গেলে এটাই ভলকার টুর্ককে ওয়াকারের উপর (বাই বুক মানে মানবাধিকারের বইয়ে যেভাবে লেখা থাকে সেভাবেই) স্ব উদ্যোগ যা তিনি সফলভাবে চাপ প্রয়োগ করতে পেরেছিল।
এককথায় বাইডেনের আমেরিকা হাসিনার সাথে এক দড়িতে ফাঁসির আসামি হয়ে গেছিলেন তখন – এটা জানলে পেরে নিজ অপরাধ কমাতে আমাদের সাথে কাজ করতে টুর্ক এর অফিস একে “গো এহেড” জানাইয়েছিল বাইডেন তবে প্রকারন্তরে – আপত্তি নাই মর্মে!  আর এতটুকুই আসলে আমাদের জন্য যথেষ্ট ছিল ওয়াকার এন্ড গং কে পরাজিত করতে!
আবার এক্সট্রা সুবিধা একটা আমরা পেয়েছিলাম ইউনুস সাবের এক তীক্ষ্ণ বুদ্ধিতে! তিনি ভলকার টুর্ককে ডেকে তাদের হাতে স্বাধীনভাবে তারা তদন্ত করে হাসিনার হাতে গুম-খুনের বিশেষ করে জুলাই-আগষ্ট্রের খুনের ততপরতার স্বাধীন অনুসন্ধান করতে ওপেন হ্যান্ড দিয়েছেন। এতে আমরা ভলকার টুর্কের জাতিসংঘের অফিসের স্বাধীন এক অনুসন্ধান রিপোর্ট আজ পেয়ে গেছি। যাকে নিয়ে কোন ধরনের সন্দেহ বা ইউনুস সরকারের কোন সংশ্লিষ্টতাহীন এক বিশ্বাসযোগ রিপোর্ট আমরা হাতে পেয়ে গেছি।
এতে গ্লোবালি হাসিনার অপরাধ এর একটা উল্লেখযোগ্য অংশ আজ পানির মত স্বচ্ছভাবে প্রকাশিত হয়ে গেছে!

লেখকঃ
গৌতম দাস
রাজনৈতিক বিশ্লেষক
goutamdas1958@hotmail.com

 আপডেটঃ  রাত ০৯ঃ ০৪, ০৭ মার্চ ২০২৫

 সর্বশেষ  আপডেটঃ রাত ১২ঃ ১৫, ০৮ মার্চ   ২০২৫

 

 

2 thoughts on “ভলকার টুর্ক কেন আমাদের জুলাই ইতিহাসের এক গুরুত্বপুর্ণ ব্যক্তিত্ব!

  1. মাসুদ জাকারিয়ার সাথে আপনার সেই ২ ঘন্টার আলোচনা কোন চ্যানেল এ পাবো দয়াকরে জানাবেন।

    ধন্যবাদ

    Like

Leave a comment