ঘরের ভিতরে-বাইরে বড় সংকটে ইন্ডিয়া!
গৌতম দাস
০৪ সেপ্টেম্বর ২০২৫ সন্ধ্যা ০৭ঃ ৪৭
https://wp.me/p1sCvy-6wC
গত কয়েকদিন হল, ইন্ডিয়া-আমেরিকার মানে ট্রাম্পের আমেরিকা আর মোদির ইন্ডিয়ার মধ্যে “যুদ্ধ” তুঙ্গে উঠেছে। বিষয়টা হল, ট্রাম্পের ভারতের ওপর ৫০ শতাংশ বাড়তি শুল্কারোপ কার্যকর হওয়ার ইস্যু। মানে এতদিন যা ছিল প্রস্তুতি পর্ব, এবার সেটি পাগলা ট্রাম্প বাস্তবে শুরু করে দেখিয়েছেন! এর সঙ্গে শুরু হয়েছে উভয় পক্ষের বাকযুদ্ধ!
যেমন, ভারতের ওপর ট্রাম্পের নয়া শুল্কনীতি আরোপ কার্যকর হয়েছে ২৭ আগস্ট ২০২৫ বা গত মাসের ২৭ তারিখ থেকে। আর এ ‘‘নতুন নিয়ম চালু হওয়ার কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই যুক্তরাষ্ট্রের জনপ্রিয় গণমাধ্যম ‘ব্লুমবার্গ’কে সাক্ষাৎকার দিয়েছেন মার্কিন প্রেসিডেন্টের বাণিজ্য উপদেষ্টা পিটার নাভারো।’’
এ বাড়তি শুল্কারোপ কেন জায়েজ আর তা প্রমাণ করার জন্য ইন্ডিয়া (এখন কত খারাপ) আর মোদি আমেরিকার বিরুদ্ধে কী কী খারাপ কাজ করেছে এর বর্ণনা উল্লেখ করেছেন ট্রাম্পের এই বাণিজ্য উপদেষ্টা। এ নিয়ে আনন্দবাজারের এক বর্ণনাও পাওয়া যাচ্ছে। সেটি হল, ঐ ‘ব্লুমবার্গ’ সাক্ষাৎকারে নয়াদিল্লিকে ‘একগুঁয়ে’ বলে তোপ দাগেন তিনি। পাশাপাশি, ইউক্রেন সংঘাতকে ‘মোদির যুদ্ধ’ বলেও উল্লেখ করেছেন নাভারো।
আমেরিকার চোখে ইউক্রেন যুদ্ধের শুরু থেকেই আমেরিকা কোন দেশের রাশিয়ার পণ্য কেনাবেচা নিষিদ্ধ বা অবরোধপ্রাপ্ত বলে ঘোষণা করেছিল। সোজা কথায় রাশিয়ান তেল রপ্তানি / কেনাবেচা বন্ধ। ফলে, আমেরিকার চোখে ইন্ডিয়ার কেনাকাটাটা অন্যায় ও অপরাধ! বিপরীতে ইন্ডিয়া মনে করে, এমন তেল আমদানি-বাণিজ্য এটা তার নিজ বাণিজ্য সিদ্ধান্ত নেওয়ার “সার্বভৌম অধিকার”। আর এর বিপরীতে আমেরিকার ট্রাম্প বা তার বাণিজ্য উপদেষ্টা নাভারো বলবেন বা মনে করেন, রাশিয়া/ভারতকে বাধা দেওয়াটাও তার অধিকার! সেই অধিকার ফলাতে ট্রাম্প ইন্ডিয়ার উপরে ৫০ শতাংশ শুল্কারোপ করে ঠিক করেছেন!
এমন পরিস্থিতিতে এ্টাকে অধিকারের তর্ক করে রাখলে এথেকে কোনো সমাধান আসবে না তা বলাই বাহুল্য! বিশেষ করে সারা ইন্ডিয়ান অর্থনীতির আমেরিকায় রপ্তানি বন্ধ হওয়াতে ইমিডিয়েটলি যখন প্রবল ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে ইন্ডিয়া! তাই, ইন্ডিয়ার দরকার এখনই সমাধান!
আসলে প্রশ্নটা এখানে নয়। ২০০১ সালে বুশের ‘মুসলমান কোপানো’ শুরু হয়েছিল ‘ওয়ার অন টেররের’ নামে। আর ইন্ডিয়া তাতে খুবই খুশিতে হাততালি দিয়ে উঠেছিল, এতে চারদিকে নিজের ফায়দার সয়লাব দেখতে পেয়ে! আর সেই থেকেই আমেরিকার কোলে উঠে বসে গলা জড়াজড়ি করে ধরা কঠিন বন্ধু হয়ে উঠার শুরু ইন্ডিয়ার! সেসব কি এখন ইন্ডিয়ার মনে পড়ছে? পড়ছে না!
বরং পররাষ্ট্রমন্ত্রী জয়শঙ্কর কূটনৈতিক জ্ঞানবুদ্ধি ফেলে রেখে এখন এ বাণিজ্য উপদেষ্টা নাভারোকে সামলাতে গেছেন এই বলে যে, মুসলমান ‘এই জাত’ মানে এই ‘এথনিক-জাত গোষ্ঠীটাই খারাপ’ একথা বলে! মানে জয়শঙ্কর আঙুল তুলে বলছেন, ট্রাম্পের সঙ্গে এখন পাকিস্তানের সম্পর্ক ভালো কেন? কিংবা মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোর? জয়শঙ্করের চোখে এগুলা হল, ট্রাম্পের মুসলমান প্রীতির নিদর্শন!
তাই জয়শঙ্কর এবার ব্যাপক ফিরিস্তি দিয়েছেন, “মুসলমান রাষ্ট্রের সঙ্গে আমেরিকার সারা জীবন খাতির ছিল” আর সেকারণেই।আমেরিকা এখন মোদি-জয়শঙ্করদের চোখে খুবই খারাপ দেশ! আর স্বভাবতই তাতে শীর্ষে এসেছে পাকিস্তানের নাম!
কিন্তু মোদি-জয়শঙ্করের মনে রাখা উচিত, ভারত-আমেরিকার যৌথ উদ্যোগে আইএসের সঙ্গে একালে সম্পর্ক রাখছে, এটা কিন্তু আমরা ভুলিনি! বিশেষ করে আফগানিস্তানে আইএসের (খোরসান) সঙ্গে সম্পর্ক এবং স্যাবোটাজের যৌথ উদ্যোগগুলোতে! পাকিস্তানে চীনা ‘গোয়াদার অবকাঠামো প্রজেক্টে’ হামলা কিংবা সর্বশেষ বেলুচিস্তানে আস্ত একটা ‘প্যাসেঞ্জার-ট্রেন ছিনতাই’-এর মতো ঘটনা; এগুলো কীসের প্রমাণ? একাজে আমেরিকা-ইন্ডিয়ার যৌথ প্রযোজনায় ‘মুসলমান কোপানো’-এটা তো নিশ্চয় খুবই সুস্বাদু লেগেছিল মোদি-জয়শঙ্করের! এভাবে এই আমেরিকারই হাত ধরে এতদিন ফায়দা নিতে?
তাহলে এটা কেমন মোদি-জয়শঙ্করের হিন্দুত্ববাদ? যেটা খোদ আইএস এর সাথে সম্পর্ক রেখে চলে এমন হিন্দুত্ববাদ? যেখানে আইএস (খোরসান) বা উইঘুরের বিদ্রোহী মুসলমান; এদেরকে মোদি-জয়শঙ্করেরা নিজেদের অ্যালায়েন্স পার্টনার/বন্ধু হিসাবে কোলে তুলে নেয় কেমন করে? এটা কেমন হিন্দুত্ববাদ?
যাই হোক, বোঝা যাচ্ছে, এতদিনের ভারত-আমেরিকার বিশেষ অ্যালায়েন্সের মাখন এরা দুই রাষ্ট্র মিলে খেয়ে গিয়েছিল অসুবিধা হয়নি; আর মুসলমান এ ‘এথনিক-জাত গোষ্ঠীটাই খারাপ’ বলে নিজেদের হীন কাজের সাফাই দিয়ে গেয়েছিল, যারা আজ সেই মোদি-জয়শঙ্করের হিন্দুত্ববাদই বিপদে পড়ে গেছে; আমেরিকার সঙ্গে খাতিরদারি সব সম্পর্ক ভেঙেচুরে গেছে, এমনকি উলটা ঘটনাটা হল, মোদি এবার খোদ চীনের কোলে উঠে বসেছে! কেন?
কারণ, নাভারো বলেছেন, ইউক্রেন যুদ্ধ তো আসলে ছিল ‘মোদির যুদ্ধ’!
কিন্তু তাতে এটা মোদি-জয়শঙ্করের কেন এত লেগেছে? কারণ, এটা কোন কূটনৈতিক বাতচিতের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকা ঝগড়া-বাকযুদ্ধ নয়। এ্টটা একেবারে ভারতীয় অর্থনীতির বিশেষ করে রপ্তানি-বাণিজ্যের ভেঙে পড়ার সংকট! যা সরাসরি ভারতের ভাতের স্বার্থ! যেটি থেকে বের হতে, হিন্দুত্ববাদ বেচে মোদি-জয়শঙ্করেরা কোনো সমাধান বা উপায় বের করতে পারছে না! এমনই গভীর সংকট এটা!
প্রসঙ্গ দুইঃ
এদিকে মোদির ইন্ডিয়ার ঘরের বা অভ্যন্তরীণ ইস্যুতেও শান্তি নেই! একের পর এক অভ্যন্তরীণ ইস্যুতে মোদির সরকার পর্যদুস্ত! যেমন, ভুয়া ভোটার লিস্ট ইস্যু! এটা আর এখন প্রমাণহীন বা প্রমাণ করতে হবে তারপর – না, এমন ইস্যু নয়! বরং একেবারেই মোদি কোণঠাসা! তিনি এখন চেষ্টা করছেন এর দায় যতটা সম্ভব নির্বাচন কমিশনের ওপর চাপাতে!
ওদিকে এতদিন মোদির ভাড়াটে মিডিয়া বিবিসি বাংলা এবার মোদিবিরোধী এক রিপোর্ট ছেরেছে। মারাত্মক এর হেডলাইনটা দেখেন –‘ত্রুটিপূর্ণ ভোটার তালিকার নির্বাচনে জিতেই কি মোদি প্রধানমন্ত্রী।’ এই এক শিরোনামই অনেক কিছু বলে দিচ্ছে। সাথে ভেতরের উপশিরোনাম –‘ভোট চুরির অভিযোগ, এসআইআর বিতর্ক’। আবার রাহুল গান্ধীর অভিযোগ থেকে উপশিরোনাম, ‘গুজরাট মডেলের ভোট চুরি’। আর সবচেয়ে মারাত্মক রাহুলের এসব অভিযোগের প্রতি ডিএমকে, সমাজবাদী পার্টি, আরজেডি, তৃণমূলের সমর্থন। এমনকি মুখ্যমন্ত্রী মমতার ভাতিজা তৃণমূল নেতা অভিষেক ব্যানার্জি … দাবি করেছেন, ভোটার তালিকায়… কারেকশন ‘সেটা করতে হবে আর সেই প্রক্রিয়ার সূচনা হতে হবে প্রধানমন্ত্রীর পদত্যাগের মধ্যে দিয়ে’। মমতাও অনেক জায়গায় ভারত ভেঙে যাবে কিনা সেই সংশয়ের ইঙ্গিত জানিয়ে আজকাল কথা বলতে শুরু করেছেন। এসব শিরোনাম থেকেই পাঠক বুঝতেই পারছেন, কেমন অভ্যন্তরীণ সংকটে পড়েছে মোদি-অমিত শাহেরা!
‘পঁচাত্তর বয়সে পা দেওয়া’ বিতর্কঃ
ওদিকে দ্বিতীয় অভ্যন্তরীণ প্রসঙ্গঃ যেটা আরও বড় সংকটের- সেটা হল, বিজেপি-আরএসএসের নেতাদের ‘পঁচাত্তর বয়সে পা দেওয়া’ বিতর্ক! মোদি ২০১৪ সালে নিয়ম এনেছিলেন, নেতাদের বয়স পঁচাত্তর হয়ে গেলেই প্রধান প্রধান পদ থেকে অবসরে যেতে হবে। এভাবে তিনি আদভানিসহ বড় নেতাদের সরিয়ে নিজে প্রধানমন্ত্রী হয়েছিলেন। আর সেই নিয়মে পড়ে এখন তিনি নিজের ফ্যাসাদ এনেছেন। ওদিকে আরএসএসের প্রধান ভগবতও সেপ্টেম্বরে মোদির ছয় দিন আগে পঁচাত্তর বয়সে পা রাখবেন জানা যাচ্ছে।
বিজেপি-আরএসএস দ্বন্দ্বটা মূলত ২০২৪ -এর নির্বাচনের সময় থেকে – যখন নিজেদের দ্বন্দ্ব মিটাতে না পেরে আরএসএসের সমর্থন ছাড়াই সেবার (২০২৪) বিজেপি একাই নির্বাচন করবে বলে মোদি-অমিত ঘোষণা দিয়েই নির্বাচন করেছিলেন। আর এখন মোদি অবসরে গেলে কে হবেন প্রধানমন্ত্রী-এ তর্কে মোদির প্রার্থী অমিত শাহ আর আরএসএসের প্রার্থী উত্তরপ্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী যোগী!
সর্বশেষ ২৮ আগস্ট এনডিটিভি এর রিপোর্টঃ
সর্বশেষ ২৮ আগস্ট এনডিটিভি আরএসএসের প্রধান ভগবতের রেফারেন্সে বলেছেন, তিনি কোনো পদত্যাগে যাচ্ছেন না; এসব নিয়ে তিনি কথা বলছেন না। আর এতে এ বক্তব্যের মানে করা হয়েছে এভাবে যে, মোদি পদত্যাগ না করলে, তিনিও পদত্যাগ করবেন না।
ভারতের জন্য এটাও আরেক বিরাট সংকট! কেন?
বিজেপি-আরএসএস দ্বন্দ্বটা যে মূল থেকে, তা হল, ১৯৪৭ সাল থেকেই একমাত্র হিন্দুত্ববাদ দিয়ে ভারতকে শাসন বা জবরদস্তিতে এক করে ধরে রাখা এক ভারত রাষ্ট্র থেকে, যেটা শুরু হয়েছিল-এখন এটাই এর শেষের দিনের দিকে যাচ্ছে। তথাকথিত ‘কেন্দ্রের শাসনের’ কথা বলে নেহেরু যেটা (সফট হিন্দুত্ববাদ দিয়ে) শুরু করেছিলেন, সেটা নেহেরুর ১৯৬৪ সালে মৃত্যুর পরে ১৯৯০ সাল পর্যন্ত টিকতে পেরেছিল। পরের নরসীমার কংগ্রেসি শাসন ছিল যেন বিজেপিকেই প্রস্তুত হয়ে আসার সময় দেওয়া। কাশ্মীরের (১৯৮৯ সালে) খোলাখুলি ভোট চুরি, যা কাশ্মীরের রাজনীতিকে সশস্ত্র পথে পাঠিয়ে এবার সেই থেকে জঙ্গিবাদের অভিযোগ (মুসলমান কোপানো) শুরু করা, ২. বাবরি মসজিদ ধ্বংস, ৩. বাজপেয়ির সীমা পাড় কী আতঙ্কবাদ বলে পাকিস্তানকে দায়ী করে চোটপাট; ৪. আর এরপর থেকেই ক্রমশ উগ্র হিন্দুত্ববাদ প্রতিষ্ঠা করে মোদির শাসন দিয়ে (২০১৪) ইন্ডিয়া এক করে ধরে রাখার যে প্রচেষ্টা চলতি শতকে শুরু হয়েছিল, সেটাও এবার যেন ২০২৫ সালে এসে মুখ থুবড়ে পড়তে যাচ্ছে!!!
মূল কথাটা হল, তাতপর্যপুর্ণভাবে, এবার সব ধরনের হিন্দুত্ববাদেরই শেষ হওয়া আসন্ন সম্ভবত! এমন কঠিন ইঙ্গিত, এটাই মুখ্য হয়ে উঠা শুরু করেছে ভারতের চারদিকে!
আজকে প্রকাশিত ইন্ডিয়া টুডে তে এই রিপোর্ট যা বাংলাদেশে এক মিডিয়ার অনুবাদ দেখেন জনমতের পাল্টা হাওয়া, পতনের মুখে মোদির জনপ্রিয়তা: সমীক্ষা।
গৌতম দাস
রাজনৈতিক বিশ্লেষক
goutamdas1958@hotmail.com
আপডেটঃ ৪ সেপ্টেম্বর ২০২৫ সন্ধ্যা ০৭ঃ ৪৮
[এই লেখাটা এর আগে প্রথম ভার্সানে ছাপা হয়েছিল দৈনিক যুগান্তর পত্রিকায় আমারই লেখা এক কলাম হিসাবে, গত ৩১ আগষ্ট ২০২৫। আজ এখানে সে লেখাটারই আরেক বর্ধিত এক নয়া এডিটেড ভার্সান এখানে আমার নিজ সাইটে ছাপা হল। বলাই বাহুল্য এখানে শিরোনামটাই শুধু নতুন নয় বরং এমন অনেক প্রসঙ্গই নয়া এখানে যোগ করা হয়েছে যেটা পত্রিকার ভার্সানে ছিল না। আসলে পত্রিকার কলাম ভার্সান মানে যেটা যুগান্তরের এডিটরিয়াল পলিসি সঠিক মনে করে সেই ভার্সান; এভাবে দেখাটাই সঠিক হবে। আর তুলনায় এটা আমার নিজ পরিবর্ধিত-এডিটেড ভার্সান মনে করলেই সঠিক হবে বলে আমার বিশ্বাস! ]


