“ভারত মাতা কি জয়” বলা-না-বলা


ভারত মাতা কি জয় বলা-না-বলা
গৌতম দাস
১২ এপ্রিল   ২০১৬,   মঙ্গলবার, ১৯:৩২

http://wp.me/p1sCvy-Tv

বিজেপির কল্যাণে ভারতে “দেশপ্রেমের রাজনীতি” এক বিরাট ইস্যু হয়ে উঠেছে। বলা বাহুল্য, এসবের সারকথা হল – এক উগ্র জাতীয়তাবাদী বা এক বর্ণবাদী রাজনীতি হাজির করা। নিজেকে অন্য সবার চেয়ে ‘একমাত্র’, ‘মহান’ বা ‘শ্রেষ্ঠ’  দেশপ্রেমিক বলে হাজির করা। দেশপ্রেমিকতার সংজ্ঞা সঙ্কীর্ণ করতে করতে এমন কিছু শব্দে নামিয়ে আনা বা সীমিত করে ফেলা, যেটা কেবল নিজ দলীয় রাজনীতিকেই বুঝায়। যাতে কেবল নিজের দলই দেশপ্রেমের দাবিদার একমাত্র দল হয়ে দাঁড়ায়। বাংলাদেশেও “চেতনার” রাজনীতিটাও প্রায় এমনই। তাই এটা বেশ মজার ব্যাপার যে এ জায়গায় এসে ভারতের মোদি সরকার আর বাংলাদেশের বর্তমান সরকারের দেশপ্রেমের রাজনীতিটা এক। আবার এর রাজনৈতিক বয়ানেও আরেক সাধারণ মিল দেখতে পাওয়া যায়। দু সরকারের কাছেই দেশপ্রেমের বিপরীত শব্দ হলো পাকিস্তান; এনিমি আর পাকিস্তান শব্দটি অদলবদল করে ব্যবহার করা হয়েছে বলে।  নিজের যেকোন রাজনৈতিক বিরোধীর বিরুদ্ধে ভারত ও বাংলাদেশের কমন ডায়লগ হল, পাকিস্তান পাঠিয়ে দেয়া হবে। বাংলাদেশ থাক, ভারত এখানে প্রসঙ্গ।
ভারতে বিগত দু-তিন মাসে দিল্লির জওয়াহেরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয়ের (জেএনইউ) ছাত্রসংসদের নেতা গ্রেফতার ও রাষ্ট্রদ্রোহের মামলা দেয়াকে কেন্দ্র করে এই ‘দেশপ্রেমের রাজনীতির’ এক ভালো বহিঃপ্রকাশ ঘটেছিল। আগেই বলেছি এভাবে ‘দেশপ্রেমের রাজনীতি’ স্বভাবতই এক উগ্র জাতীয়তাবাদ হাজির করেছিল। নিজের দলকে অন্য সবার তুলনায় ‘একমাত্র দেশপ্রেমিক’ দল হিসেবে হাজির করা হয়েছিল।
এভাবে ক্ষমতাসীন বিজেপিকে এক কট্টর হিন্দু জাতীয়তাবাদী লাইনে নিয়ে গেলে দলের লাভ হবে, সঠিক রাজনৈতিক লাইন নেয়া হবে বলে এখনো বিজেপির তরফে মনে করা হয় দেখা যাচ্ছে। বিজেপির সেন্ট্রাল ওয়ার্কিং কমিটির সভা সমাপ্ত হয়েছে গত মাসে ২০ মার্চ রোববার; দলের জাতীয় কর্মসমিতির ওই বৈঠকে গৃহীত রাজনৈতিক প্রস্তাবে স্পষ্ট বলা হয়েছে, “বাকস্বাধীনতার যুক্তিতে দেশবিরোধী, জাতিবিরোধী বক্তব্যকে কোনোভাবে রেয়াত করা হবে না”। অর্থাৎ উগ্র জাতীয়তাবাদী দেশপ্রেমের রাজনীতি আরও  চলবে, টার্গেট পূরণ হয় নাই। অন্য দিকে এর পাল্টা কংগ্রেস-কমিউনিস্টরা মিলে এক সরকার-বিরোধী জোট গড়ার চেষ্টা চলছে। বলা বাহুল্য, এর লক্ষ্য বিজেপির ক্ষমতার বিরোধিতা। কিন্তু সেই বিরোধযী রাজনীতিক বয়ানটা কি উগ্র জাতীয়তাবাদ, দেশপ্রেম, পাকিস্তান ইত্যাদি শব্দগুলো ব্যবহার না করে তৈরি করা হচ্ছে? এই প্রশ্নের জবাব স্পষ্ট করে ‘হ্যাঁ’ একেবারেই বলা যাচ্ছে না, তাই ‘হা বলা মুশকিল’ বলে থামতে হবে। তবে এতটুকু বলা যায়, এরা অন্তত আপাতত এ শব্দগুলোতে একটু কম জোর দিয়ে বা কম গুরুত্ব দিয়ে পেছনে আড়ালে ফেলে নিজেদেরটা এক লিবারেল রাজনীতির অনুসারি লাইন বলে হাজির করতে চাইছে। কিন্তু মনে রাখতে হবে, ভারত রাষ্ট্রের ভিত্তি ‘হিন্দুত্ব হতেই হবে’ এর বাইরে চিন্তা করার সক্ষম এমন প্রমাণ কেউ রাখে নাই। ফলে বলা যায় ভারতের কমিউনিস্টসহ প্রধান ধারার দলগুলোর মধ্যে এমন কোনো রাজনৈতিক ধারা নেই।  অতএব বিজেপির রেসিজমের বা উগ্র দেশপ্রেমের রাজনীতির বিপরীতে এক “আপাত-লিবারেল” রাজনীতি যেন দাঁড়াচ্ছে; তা ভুয়া হলেও এমন একটা ভাবও সৃষ্টি হয়েছে। সরকার বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর দিক থেকে কংগ্রেস-কমিউনিস্ট জোট গড়ার চেষ্টাকে এমন উদ্যোগ বলেই চিহ্নিত করা যায়। এর মূল উদ্দেশ্য ভোটের রাজনীতি; ভোটের রাজনীতিতে বিজেপির চেয়ে ভালো অবস্থান পাওয়া। কোনো লিবারেল রাজনীতির পক্ষে দাঁড়ানো নয়। রাজনৈতিক দল ছাড়াও এমন রাজনীতির (ছল করে হলেও এক আপাত-লিবারেল রাজনীতি) সমাজের আরেক বড় এমন খাতক বা সমর্থক হল ভারতের মিডিয়া। ভারতের মিডিয়ার প্রধান ধারাও এমন আপাত-লিবারেল অবস্থান নিয়েছে। নিজেদেরকে বিজেপির চেয়ে অনেক ভাল এবং লিবারেল বলে হাজির করছে। আমাদের প্রথম আলোর দিল্লি প্রতিনিধি সৌম্য বন্দ্যোপাধ্যায় তেমনদের একজন। গত ১৪ মার্চ ‘দেশপ্রেমের নতুন সংজ্ঞা ও হিন্দুত্ব’ শিরোনামে প্রথম আলোতে লেখায় এ বিষয়টিই তুলে এনে তিনি বিজেপিকে গালমন্দ করে নিজেকে লিবারেল বলে হাজির করেছেন। এককালে সোভিয়েত ইউনিয়ন যখন টিকে ছিল, পঞ্চাশের দশকের শুরু থেকেই সেকালে “কোল্ড ওয়ার” চালু হয়েছিল। তখনকার রাজনীতিতে সোভিয়েত ইউনিয়নসহ দুনিয়া কমিউনিস্টদের মধ্যে নিজেদের এনিমিকে তারা ‘দক্ষিণপন্থী’ বলে চেনানোর একটা রেওয়াজ চালু করে  রেখে ছিল। একালের ফেসবুকীয় ভাষায় বললে বাক্যটা হবে, কমিউনিস্টরা নিজের শত্রুদেরকে ‘দক্ষিণপন্থী’ বলে ট্যাগ লাগাত।  অর্থাৎ আমরা বামপন্থীরা ভালো আর বিপরীতে দক্ষিণপন্থী যারা ওরা খারাপ- এই ছিল বয়ানের ভেতরের মুল প্রম্পট বা সাজেশন। কিন্তু ১৯৯১ সালে সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে যাওয়ার পর আমেরিকার সাথে সেই কোল্ড ওয়ার সম্পর্ক আর দুনিয়ার কারো সাথে কারও আর নাই। এছাড়া সেই থেকে এখন এক গ্লোবাল ক্যাপিটালিজমের অংশ আমরা সবাই, সব রাষ্ট্র। ফলে কাকে কে দক্ষিণপন্থী বা বামপন্থী বলবে এর তাল কেটে সব অর্থহীন হয়ে গেছে। যদিও অনেকে পুরানা অভ্যাসবশত অথবা নতুন চিন্তা করতে অক্ষম বলে, বা সারা দুনিয়াটাই যে এখন একই গ্লোবাল ক্যাপিটালিজমের অধীন হয়ে গেছে এটা খোলা দিনের মত পরিস্কার থাকলেও তা দেখতে বুঝতে আমলে নিতে অক্ষম বলে, অথবা নিজেরা ভুয়া ভ্যানিটিতে ‘প্রগতিশীল’ বলে দাবি করে আলাদা মর্যাদা পেতে চায় বলে কোল্ড ওয়ার স্টাইলে দক্ষিণপন্থি-বামপন্থি ট্যাগ করা ছাড়া কথা বলে না। বুঝা যাচ্ছে সৌম বন্দোপাধ্যায় তেমনই একজন যে পুরনো অভ্যাসে অগ্রপশ্চাৎ বিবেচনা না করে অপছন্দের কাউকে দক্ষিণপন্থী বলার অভ্যাস অনেকে এখনো ছাড়তে পারেনি। এতে প্রকারান্তরে যে নিজেকে চিন্তা করতে অক্ষম পুরানা “বামপন্থী” বলে দাবি করা হয়ে যায় সে হুঁশও সেখানে থাকে না। সৌম্য বন্দ্যোপাধ্যায় নিজেকে সেভাবেই হাজির করে বিজেপি সম্পর্কে লিখেছেন, “ধারাবাহিকভাবে ক্ষমতায় না থাকা এবং আদর্শগত অনমনীয়তা এ দেশে প্রাতিষ্ঠানিক প্রভাব বিস্তারের ক্ষেত্রে দক্ষিণপন্থীদের বরাবরই পিছিয়ে রেখেছে। পক্ষান্তরে নেহরুর সমাজতন্ত্র, ইন্দিরা গান্ধীর বামঘেঁষা রাজনীতি প্রশ্রয় দিয়েছে বামপন্থী ভাবধারাকে”।
এ সময়ের বিজেপির এই সুনির্দিষ্ট রাজনৈতিক অবস্থান আরো এক ধাপের বৈশিষ্ট্য, আকার ও মাত্রা ধারণ করেছে। আরএসএস বা রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘকে বিজেপির মূল মতাদর্শিক সংগঠন মনে করা হয়, বিজেপিও তা অস্বীকার করে না। সেই আরএসএসের প্রধান মোহন ভগত দেশপ্রেম বিষয়ে এক ফতোয়া জারি করেছেন। তিনি বলেছেন, “ভারত মাতা কি জয়” বলতে হবে- এটা হল ফিল্টারে পাস করা সেই দেশপ্রেমের স্লোগান। একমাত্র এই শ্লোগানটা বলা  সব ভারতীয়কে বাধ্যতামূলক করতে চান তিনি। কোন ভারতীয় একমাত্র এই শ্লোগান দিতে পারলেই তিনি তাঁকে দেশপ্রেমিক মানবেন, নইলে না। তিনি এমনই আইন দেশে চালু করার পক্ষপাতী বলে জানিয়েছেন। সম্প্রতি তাঁর এই ফতোয়া ভারত জুড়ে স্বভাবতই  রাজনৈতিক হইচই সৃষ্টি করেছে। এটাই বিজেপির নিজেকে টগবগে সবার মুখে মুখে থাকার ভালো কৌশল মনে করে। ভারতের হায়দ্রাবাদ ও মুম্বাইয়ের এক আন্চলিক ইসলামি দলের নাম অল ইন্ডিয়া মজলিস-এ-ইত্তেহাদুল মুসলিমিন (AIMIM)। এই দলের সভাপতি হায়দ্রাবাদের বাসিন্দা আসাদউদ্দিন ওয়াসি। ওয়াসির বাবা এবং দাদাও এই দলের সভাপতি ছিলেন। ব্যারিস্টার আসাদউদ্দিন ওয়াসি নব্বইয়ের দশকে প্রথমে হায়দ্রাবাদের প্রাদেশিক বিধানসভার সদস্য নির্বাচিত হন। পরে পরপর তিনবার তিনি হায়দ্রাবাদ (বর্তমানে তেলেঙ্গনা রাজ্যের অংশ) আসন থেকে কেন্দ্রীয় লোকসভার এমপি নির্বাচিত হয়ে আছেন। এবছরের মার্চ মাসে মোহন ভগতের “ভারত মাতা কি জয়” বাধ্যতামূলক করার দাবির পরে ওয়াসি মুম্বাইয়ে এক জনসভার বক্তৃতায় আরএসএস সভাপতি মোহন ভগতের দাবির বিরোধীতা করেন।
তিনি আরএসএসের প্রধান মোহন ভগতের দাবির বিষয়ে তার আপত্তি জানিয়ে পাল্টা প্রস্তাবমূলক বক্তৃতা করেছেন। তিনি সরলভাবে বলেছেন, ‘ভারত মাতা কি জয়’ কথাটি বাধ্যতামূলকের জায়গায় অপশনাল রাখলেই, তাহলে তাঁর আর কোন আপত্তি নেই। কিন্তু তাতেই বিজেপি, শিবসেনা নেতারা হৈ চৈ শুরু করে দেয়। রামদেব প্রমুখ নেতারা তাকে পাকিস্তান পাঠিয়ে দেয়ার, নাগরিকত্ব কেড়ে নেয়ার দাবি জানাতে থাকেন। ওয়াসির নিজের বক্তব্যের স্বপক্ষের প্রধান যুক্তি হল দেশকে মা-রূপে কল্পনা করা এবং পূজা করা সব নাগরিকের বেলায় প্রযোজ্য করা ঠিক হবে না, আর সেটা জরুরিও নয়। আর এমন কথা ভারতের কনস্টিটিউশনেও নেই।
গত মাসে ভারতের রাজ্যসভা সেশনে ছিল বা চালু ছিল। ওয়াসির মুম্বাই বক্তব্যের পরে পরেও দিল্লীতে রাজ্যসভার সমাপ্তি অধিবেশন চলছিল। জাভেদ আখতার একজন হিন্দি সিনেমার গীতিকার এবং সিনেমার স্ক্রিপ্ট লেখক। তিনি কোন রাজনীতিক নন, তবে আশি দশকের জনপ্রিয় ও বিখ্যাত অনেক হিট সিনেমার কাহিনী লেখক। “সেলিম-জাভেদ” (একালের নায়ক সালমান খানের বাবা সেলিম খান এর সাথে মিলে জয়েন্ট ক্রেডিটে) নামে তাঁরা সিনেমার কাহিনী লিখতেন। তবে এখনও তিনি কেবল সিনেমার গানের নামকরা গীতিকার হিসাবে সক্রিয়। তিনি কংগ্রেস দল থেকে নমিনেশন পাওয়া রাজ্যসভা সদস্য। রাজনৈতিক বিশ্বাসে তিনি সেকুলার বলে রাজ্যসভায় তিনি ওয়াসিকে মুসলমান রাজনীতিক আর তিনি সেকুলার রাজনীতিক এই ভাগ বজায় রেখে কথা বলার চেষ্টা করেন। ফলে নিজের সেকুলারিজম স্পষ্ট করার তাগিদে তিনিও ওয়াসিকে সমালোচনা করা দরকার মনে করেন। তবে তিনি ভাবলেন মধ্যমপন্থা তার জন্য সঠিক হবে। বলে রাখা ভাল এই ইস্যুতে অন্য সময়ের মতই কংগ্রেসের দলকে বেকায়দায় ফেলে রেখেছে বিজেপি। কংগ্রেসের সমস্যা হল দেশকে সে মা কল্পনা করেই না, এমন আপত্তির কথা যদি বলে তবে হিন্দু কনস্টিটুয়েন্সি না বেজার হয়,ভোট দেয়া থেকে না মুখ ফিরিয়ে নেয় এই ভয়ে এই ভয়ে কংগ্রেস দেশকে মা জ্ঞান করাই সঠিক মনে করে। অর্থাৎ বিজেপির অবস্থানই কংগ্রেসের প্রকাশ্য অবস্থান। তাই জাভেদ আখতার রাজ্যসভায় বললেন, “ভারত মাতা কি জয় বলা বাধ্যতামূলক দায়িত্ব কি না এটা তিনি জানেন না। আবার এমনকি তিনি জানতেও চান না। তবে আমি জানি ‘ভারত মাতা কি জয়’ বলা আমার অধিকার।” মুল ইংরাজি অংশটা হল, He simplistically argued, “I don’t know whether it is my bounden duty to chant ‘Bharat Mata ki Jai’. I don’t even want to know that. All I know is it is my right to chant ‘Bharat Mata ki Jai.’, অনুবাদ আমার। ভারতের দিল্লী থেকে প্রকাশিত এক ইংরেজি ওয়েব দৈনিক আছে, ওয়াইর (WIRE) নামে। আমি সে পত্রিকার ২১ মার্চ সংখ্যার বরাতে লিখছি।
এভাবেই মোহন ভগতের মুখ্য দাবি ‘বাধ্যতামূলক করতে হবে’ প্রসঙ্গটাই জাভেদ আখতার এড়িয়ে গেলেন এবং প্রকারান্তরে মোহন ভগতকে হিন্দুত্বের দাবিকে জায়গা করে দিলেন।WIRE পত্রিকা এপর আরও জানাচ্ছে, “Later, he was pointedly asked the same question at the India Today conclave –can anyone be forced to chant ‘Bharat Mata ki Jai’? Here Akhtar became more nuanced and said even if Owaisi had the right not to do so he should have expressed it in a less confrontational manner. So it was the form he was objecting to, not so much the content!”। [আমার করা অনুবাদ] বাংলায়, “পরে যখন তাকে সুনির্দিষ্ট করে জিজ্ঞেস করা হয়, কাউকে ওই স্লোগান দিতে বাধ্য করা যায় কি না, এর জবাবে এবার তিনি ব্যাপারটাকে আরও তুচ্ছ করে বললেন, ‘ওয়াসির অধিকার থাকলেও তিনি সেটা সঙ্ঘাত-প্রকাশ পায় বলে তা এড়িয়ে গিয়ে বলা উচিত ছিল। তাই ওয়াসির ব্যাপারে তার আপত্তিটি বিষয়বস্তু নিয়ে ঠিক নয়।’ এরপর WIRE এর রিপোর্টার মন্তব্য করছেন, ‘জাভেদ আক্তারের এই মোচড়ামুচড়ি বেশ মজার'”।
আমরা এতক্ষণ সেকুলার তামাশা দেখলাম। কিন্তু এই তামাশার এখানেই শেষ না, আরও আছে। এরপরে ঘটনাস্থল রাজ্যসভার অধিবেশন স্থলের বাইরের লবি, এই পাবলিক প্লেস। জাভেদের স্ত্রী অভিনেতা শাবানা আজমি স্বামীকে নিতে এসেছেন। সেখানেই স্ত্রীর সাথে  জাভেদ আখতার হাটতে হাটতে ঐ রিপোর্টারের সাথে কথা বলতে বলতে এগিয়ে আসছিলেন। শাবানা আজমি প্রশ্নের সম্মুখীন জাভেদ আখতারের সাহায্যে এগিয়ে এসে বলেন, “আমি ওয়াসিকেই জিজ্ঞেস করতে চাই তিনি “ভারত ‘আম্মি’ কি জয় বলতে রাজি কি না”। এখানে শাবানার তামাশার দিকটা হল, শাবানা আজমি মনে করতে পারেন যে ‘মাতার’ জায়গায় ‘আম্মি’ বসিয়ে তিনি মহা সেকুলার এক রসিকতা করে দেখিয়েছেন। আসলে কিন্তু তিনি বিতর্কটাই বুঝেন নাই। শাবানার মন্তব্য প্রমাণ করে ওয়াসির আপত্তির পয়েন্ট – কেন দেশকে মারূপে জ্ঞান করা তিনি সব নাগরিকের উপরে চাপিয়ে দিবার বিপক্ষে কথা বলছেন, জরুরিও মনে করেন না বরং বাধ্যতামূলক না করে অপশনাল রাখার পক্ষপাতি – এসব কথার গুরুত্ত্ব তিনি বুঝেনই নাই।
সবশেষে ঐ পত্রিকা রিপোর্টারের মন্তব্য করেছেন, “জাভেদ আক্তারের সমস্যা ও জটিলতা আমরা যে কেউ বুঝতে পারি। ব্যাপারটা হল, ‘ভারত মাতা কি জয়’ বলে নিজের সাংবিধানিক অধিকার চর্চা করা – এটা আজকাল  যেকোনো তবে কেবল হিন্দুর জন্য সবচেয়ে সহজ। রাজনীতি আজ এমনই প্রহসন এবং ভয়ঙ্কর হয়ে উঠেছে। আর বিপরীতে, ‘আজকের রাজনৈতিক পরিবেশে মুসলমান থাকা সহজ নয়, যেখানে আগ্রাসী জাতীয়তাবাদের পরিণতির দিকটি হল, মুসলিম কমিউনিটিকে প্রাতিষ্ঠানিকভাবে উত্ত্যক্ত করা’।”
এখানে সারকথা হলো, সেকুলার অবস্থান মানে কংগ্রেসের অবস্থান এবং সেকুলার জাভেদ আখতারের অবস্থান আমরা চেয়ে চেয়ে দেখলাম। যারা কেউই আরএসএসের প্রধান মোহন ভগতের নাগরিকের ওপর জোর খাটিয়ে বাধ্যতামূলক করার (মৌলিকভাবে অসাংবিধানিক) দাবির বিরুদ্ধে মুখ খুলতে পারলেন না। হিন্দু ভোট হারানোর ভয়ে চুপ থাকলেন। উল্টা ওয়াসিকে দোষী করলেন। অন্য আর এক ভা্রতীয় পত্রিকায় দেখা গেল জাভেদ আখতার ভোটের রাজনীতির খেলাটা বুঝেছেন। সেখানে তিনি বলছেন, …..Please forget next election and think about the country”। কিন্তু বকে শুনে কার কথা – না কংগ্রেস, না বিজেপি। আবার তিনিও জানেন কেউ শুনবে না। এখান থেকে এক সাধারণ শিক্ষা হল, আরএসএসের প্রধান মোহন ভগত সবার আগে একটা সঙ্কীর্ণ সম্প্রদায়গত অবস্থান নিলেন এবং অন্যদের ওপর তা চাপিয়ে দেয়ার চেষ্টা করাতে অন্যরাও যার যার আরেক কোটারি স্বার্থ বাচাতে সেই সংকীর্ণ সম্প্রদায়গত অবস্থান নেয়ার দিকে সবাইকে বাধ্য করলেন। সব রাজনৈতিক বিভেদের উপর সম্প্রদায়গত বিভক্তির রাজনীতি সবচেয়ে প্রভাবশালী অধিপতির জায়গা পেয়ে গেল।

ঘটনার ডালপালা আরও আছে। এবার ঘটনাস্থল ঐ একই ১৬ মার্চ মহারাষ্ট্রের প্রাদেশিক বিধানসভার বাজেট অধিবেশন চলছিল। ঐ বিধানসভায়  AIMIM দলের মুসলমান দুই  নির্বাচিত সদস্য ওয়ারিস পাঠান এবং ইমতিয়াজ জলিলকে চলতি বাজেট অধিবেশন পর্যন্ত বহিস্কার করা হয়। তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ তাঁদেরকে ভারত মাতা কি জয় বলতে বলা হলে তাঁরা তা অস্বীকার করে দেশকে অপমান করেছে। ভোটের রাজনীতির হিসাব এবং লোভ এমনই যে বিজেপি ও শিবসেনার আনা বহিস্কারের প্রস্তাব AIMIM বাদে সর্বসম্মতিক্রমে অনুমোদিত হয়। হা সর্বসম্মতিক্রমে, মানে কংগ্রেস সহ যে দলই সংসদে আছে সবাই হিন্দু ভোট হারানোর ভয়ে বহিস্কারের পক্ষে ভোট দিয়েছে। এমনকি কংগ্রেস সদস্যরা বহিস্কারের পক্ষে বক্তব্য রেখেছে। এই হল কংগ্রেস এবং সেকুলারিজম।  অথচ এখনও পর্যন্ত ভারতের কনষ্টিটিউশনে “ভারত মাতা কি জয়” বলা না বলা কোন আইনী বিষয়ই নয়। কারণ “ভারত মাতা কি জয়” বললে অথবা না বললে কনষ্টিটিউশন ভঙ্গ হবে বা কোন আইন ভঙ্গ হবে এমন কোন আইন নাই। ব্যাপারটা দাড়িয়েছে এমন যে কোন সাংবিধানিক ভারতীয় প্রজাতন্ত্র বলে কিছু আসলে নাই। আছে “ভারত মাতা কি জয়” এর এক ভারত। সবার উপর এটাই একমাত্র সত্য।
এতক্ষণকার ঘটনা শুনে মনে হতে পারে হিন্দু-মুসলমান বিষয়ক সঙ্ঘাত তো আমরা বুঝিই, এর আর নতুন করে কী বোঝার আছে!
উপরের এসব ঘটনা সর্বশেষ ২১ মার্চের, এরপর ২৩ মার্চ। আমাদের অনেকের ধারণা ভারতের পাঞ্জাবের শিখ, এরা বোধহয় হিন্দুই। না তা নয়। সারা আশির দশকজুড়ে ভারতে পাঞ্জাবের ভারত থেকে আলাদা রাষ্ট্র হবার লক্ষ্যে বিচ্ছিন্নতাবাদী সশস্ত্র আন্দোলন চলেছিল। এটা তাদের ভাষায়, সশস্ত্র খালিস্তান কায়েমের আন্দোলন। ভারত কেন্দ্রীয় সরকারের বহু দমন-পীড়নের জেল জুলুম গুম হত্যার পর তা কোন রকমে থিতু হয়। পলাতক রাজনৈতিক কর্মীদের এক বিরাট গ্রুপ পশ্চিমা নানা দেশে রাজনৈতিক আশ্রয় নিয়ে থেকে যায়। যার সবচেয়ে বড় অংশটা কানাডায় আশ্রয় পায় ও নেয়। এদিকে ভারতের কনষ্টিটিউশনের অধীনে আইনী দল হিসাবে অনেকে আঞ্চলিক শিখ আকালি দল খুলে এর ভিতরে থিতু হয়। পরে এই দলের আবার অনেক বিভক্তি আসে। সেই থেকে এই দলের দুই অংশের কোনো একটা পাল্টাপাল্টি করে বিধানসভা দখল মানে রাজ্য সরকার গঠন করে আসছে। শিখদের শিরোমণি আকালি দল (অমৃতসর) নেতা সিমরনজিৎ সিং মান সংবাদ সম্মেলন করে বলেছেন, শিখরাও ‘ভারত মাতা কি জয়’ স্লোগান দিতে পারবে না। আকালি দল নামের দলগুলোর মধ্যে এই ফ্রাকশনটায় খালিস্তান আন্দোলনের রাজনৈতিক সমর্থক বেশি। তবে এরা এই কোন সশস্ত্র না সংসদীয় রাজনীতিতে লিপ্ত। সভাপতি সিমরনজিৎ সিং মান একজন প্রাক্তন পুলিশের আইজিপি, যিনি ১৯৮৪ সালে অপারেশন ব্লু স্টার এ গোল্ডেন টেম্পলে হামলার প্রতিবাদে পদত্যাগ করেছিলেন। সিমরনজিৎ সিং মান সাংবাদিকদের বলেন, শিখরা কখনই নারীদের পূজা করে না, এ জন্য তারা ‘ভারত মাতা কি জয়’ বলবে না।

যে কথা বলছিলাম, এতক্ষণকার ঘটনা শুনে মনে হতে পারে হিন্দু-মুসলমানবিষয়ক সঙ্ঘাত তো আমরা বুঝিই, শিখনেতা মানের বিবৃতি আসায় আমাদের জন্য সুবিধা হিসেবে এসেছে যে আমাদেরকে রাষ্ট্র, রাজনৈতিক পরিসর গড়ার কাজ ও কথা ভাবতে হবে। বিষয়টি সিরিয়াস।

goutamdas1958@hotmail.com

[লেখাটার প্রাথমিক ভাষ্য এর আগে দৈনিক নয়াদিগন্ত পত্রিকায় ২৮ মার্চ ২০১৬ ছাপা হয়েছিল। তা এখানে আবার পরিবর্ধিত ও এডিট করে ফাইনাল ভাষ্য হিসাবে ছাপা হল। ]

 

 

 

Leave a Reply

Fill in your details below or click an icon to log in:

WordPress.com Logo

You are commenting using your WordPress.com account. Log Out /  Change )

Facebook photo

You are commenting using your Facebook account. Log Out /  Change )

Connecting to %s