‘৪৭এর দেশভাগ – সকলেই সুবিধাভোগী, দায় নেয়নি কেউ (দ্বিতীয় পর্ব)


‘৪৭এর দেশভাগ – সকলেই সুবিধাভোগী, দায় নেয়নি কেউ
দ্বিতীয় পর্ব

২৬ মার্চ ২০২১  বৃহস্পতিবার

https://wp.me/p1sCvy-3qT

প্রথম পর্বের লিঙ্ক এখানে

দ্বিতীয় পর্বঃ
রাষ্ট্রক্ষমতা সম্পর্কে বলা হয় প্রধানত, ক্ষমতার রূপ হয় দুইটা বা ক্ষমতার প্রকাশ ঘটতে পারে দুইভাবে। এক হল ফিজিক্যাল ক্ষমতা; যেটা আমরা সকলেই চিনি বুঝি। মানে সৈন্য সামন্ত আর অস্ত্র বা ব্যারাকে যা স্টোর করা থাকতে দেখা যায়, যা বস্তুগত বা সামরিক ক্ষমতা যেমন। আর অন্যরূপটা হল, ভাবগত ক্ষমতা। মানে বয়ান বা ইডিওলজি (ভাবাদর্শ) রূপে ক্ষমতা। মানে যাকে ইংরাজিতে জাস্টিফিকেশন বলে সেই ন্যায্যতা বা সাফাই। কিন্তু এদুইয়ের পারস্পরিক সম্পর্কটাকে অন্যভাষায় বললে – কোন ফিজিক্যাল ক্ষমতা টিকবে না যদি না বিশেষত সে ক্ষমতাটা কায়েম বা কার্যকর হবার পর ওর স্বপক্ষে কোন সাফাই বয়ানও সাথে হাজির না থাকে। সেজন্য এটাকে ক্ষমতার “ন্যায্যতা বা সাফাই যোগানোও” বলা হয়। পাকিস্তানের জন্ম অন্তত পুর্ব-পাকিস্তানে তা এমন কঠিন সাফাই বয়ানের ঘাটতি ও অভাবের সমস্যায় পড়েছিল।

যেমন, কেন পাকিস্তান কায়েম সঠিক হয়েছিল এর স্বপক্ষে অন্তত পুর্ব-পাকিস্তানে কোন সাফাই-বয়ান হাজির ছিল না, কেউ করে নাই। এমনকি এমন বয়ান দাঁড় করানোর কোন চেষ্টাও করা হয় নাই, সমাজের কোন কর্ণার থেকে।। যদিও কার্যত জমিদারি উচ্ছেদ ঘটে যায় সাতচল্লিশের পনেরোই আগষ্টের পর থেকেই। তাই প্রজা-কৃষকের হাতে জমির ভোগদখলে, এর দলিল পাবার আগেই তা চলে এসেছিল। অর্থাৎ জমি প্রজার ভোগদখলে এসে গেছে যদিও সেই দলিল হাসিল করেছিলাম ১৯৫১ সালে এসে। কিন্তু কেন পাকিস্তান আন্দোলন করা সঠিক ছিল আর পাকিস্তান কায়েম করা জায়েজ ছিল এর স্বপক্ষে আমরা বয়ান-ন্যায্যতা তুলে আমাদের ইতিহাস লিখে নেই নাই। আমাদের এডুকেশন সিস্টেমে টেক্সটবুক লিখা হয় নাই, ফলে তা পড়ানোও  হয় নাই। কিন্তু এটা কেন সম্ভব হয় নাই? আবার এমনটা কী করে ও কেন ঘটা সম্ভব হয়েছিল?

টেক্সটবুক ও ১৯৪৭ এর দেশভাগের সম্পর্কঃ ১৯৭১ এর সাথে তুলনা
যেমন ১৯৭১ সালের সাথে তুলনা করলে আমরা দেখব, ১৯৭১ সালের স্বাধীন বাংলাদেশের পক্ষে নতুন বাংলাদেশ রাষ্ট্র কায়েম করা যে সঠিক হয়েছে এনিয়ে নতুন করে ইতিহাস লেখা হয়েছিল। কালক্রমে যদিও মোটাদাগের মূল ইতিহাস এবং সাথে এর মুলকাঠামো ও ঘটনাক্রম ঠিক রেখেও কোন কোন প্রসঙ্গে একাত্তর সালের ঘটনা বা জন্ম নিয়ে দুতিনটা লিখিত ভাষ্য বা ব্যাখ্যা-বয়ানই বাংলাদেশে এখন হাজির আছে পাওয়া যায়। দুনিয়ার সব রাষ্ট্রের জন্মের ক্ষেত্রেই তাদের ইতিহাস কোনটা হবে তা নির্ধারণের বেলাতেই ওর ভাষ্য এমনই চার-পাঁচটা পর্যন্ত হতে  দেখা যায়। ফলে “মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস একটাই হয়” – এধরণের হাসিনা আওয়ামি লীগের দাবি একেবারেই অবাস্তব। আর “সঠিক” বা “খাটি” ইতিহাস কথাটাও অর্থহীন।  বরং বাস্তবে যা দাড়ায় তা হল কিছু বিষয়ে যার যার কয়েকটা ভিন্ন বয়ান দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা যায়।  দুনিয়ার সবদেশেই এটাই ঘটে। সেকারণে একদেশে কখনও একটাই ইতিহাস একটাই বয়ান থাকে না, যদিও মোটাদাগে বলা ইতিহাসের মূল কাঠামোটা সব বয়ানের মধ্যে একই থাকে। অর্থাৎ মোটের উপর একটা ইতিহাসের বয়ান থাকে আর সেটাই একাদেমিকভাবে শিক্ষাব্যবস্থায় লেখা টেক্সটবুকে পড়ানো হয়।

কিন্তু এবার তুলনা করেন ১৯৪৭ সালে পাকিস্তান কায়েমের সাথে। পাকিস্তান আন্দোলন করা সঠিক হয়েছিল এমন দাবি করা আমাদের কোন  লিখিত ইতিহাস নাই, কখনই করা হয় নাই। একথা ঠিক ১৯৪৭ সালে পাকিস্তান কায়েমের প্রায় ২৪ বছর পরে ১৯৭১ সালের মুসলিম লীগ আর পাকিস্তান আর্মি খুবই নিন্দিত ভুমিকা, গণহত্যার মত অভিযোগে অভিযুক্ত হয়েছিল। ক্লিনজিং বা জাত নির্মুলের মত নৃশংস ও রেসিজমের অভিযোগ তাদের বিরুদ্ধে। কিন্তু সেকারণে ১৯৪৭ সালে ও তার ইমিডিয়েট পরবর্তিতে মুসলিম লীগের সমস্ত ইতিবাচক অর্জন ও ভুমিকাকে অস্বীকার বা আড়ালে লুকিয়ে রাখতে হবে বা থাকবে এটা একেবারেই অগ্রহণযোগ্য। এছাড়া এর চেয়েও বড় কথা নিজের ইতিহাস না লিখে উলটা “জমিদারের  বয়ানটাকেই (যেটা উলটা বয়ান) আপন করে তুলে নেওয়া হয়েছিল। যারাই ১৯৪৭ এর পরে ‘শিক্ষিত হবার সুযোগ’ পেয়েছিল  তারাই বিশেষ করে শিক্ষিত মুসলমানেরা  “জমিদারের বিপরীত বয়ানটাকেই” আপন করে নিয়েছিল। তাও আবার সেটাই নাকি প্রগতি বা রেঁনেসার বয়ান এই মারাত্মক বিভ্রম থেকে বা কারণে। অথচ তা ছিল একেবারেই  মূলত এক ইসলামবিদ্বেষ ছাড়া আর কিছুই না।

মূল কারণ পুর্ব-পাকিস্তানের কেউ নিজের স্বাধীন রাষ্ট্র পাবার ইতিহাস লেখে নাই। অথচ জমিপাবার সমস্ত সুবিধাভোগী একমাত্র ও মূলত সে-ই। ফলে নিজ ইতিহাস নিজে না লিখলে পরিণতি কী হয় এরই প্রমাণ পুর্ব-পাকিস্তান। বরং উলটা এক তামসার কথা হল, জমিদারি আমলের পুরানা সকল প্রজা –  আজকের পুরা বাংলাদেশের যারা আমাদের পুর্বসুরিরা আমাদের বাপ-দাদাদের দাদারা; এদের প্রায় সবাই আজ যারা জমির মালিক এরা সকলেই কিন্তু ১৯৪৭ সালের জমিদারি উচ্ছেদে ভূমিলাভের প্রথম সুবিধাভোগী। কিন্তু সেই আমরাই যখন মর্ডান এডুকেশন লাভের উদ্দেশ্যে ইস্কুল কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ে গেছি, সেখানে গিয়ে যে ইতিহাস বইটা পড়েছি সেটা পাকিস্তানে (বা পুর্ব-পাকিস্তানে নতুন করে) লেখা হয় নয়, তাই পাকিস্তানের ইতিহাস নয়। জমি পাবার ইতিহাস নয়। বরং আমরা দ্রুত কলকাতায় লেখা ও ছাপা হওয়া বইটাকেই আমাদের পাঠ্য করেছি, সেটা আসলে কলকাতার লেখা তাঁদের ইতিহাস যেটা আমরা কপি করে ততকালীন পুর্ব-পাকিস্তানে ছেপেছিলাম। যেন  হিসট্রি টেক্সটবুক ব্যাপারটা ফিজিক্স বা কেমিস্ট্রি বইয়ের মত যে সেটা কলকাতার বইটাই কপি করি কী লন্ডন কেমব্রিজেরটা কপি করে আনি না কেন কোন অসুবিধা নাই। কঠিন বাস্তবতটা হল, ফিজিক্স বা কেমিস্ট্রি বইয়ের মত হিস্টি বই অন্যেরটা কপি করে এনে নিজ দেশে চালু করা যায় না। নিজ ইতিহাস নিজে লিখতেই হয়। কারণ এক রাষ্ট্রের ইতিহাস বয়ান দিয়ে আরেক রাষ্ট্র চলতেই পারে না। কারণ সবারই জন্ম ইতিহাস ও সাফাই-ন্যায্যতা্র বয়ান আলাদা ও ভিন্নই হয়।

কঠিন বাস্তবতটা হল, ফিজিক্স বা কেমিস্ট্রি বইয়ের মত হিস্টি বই অন্যেরটা কপি করে এনে নিজ দেশে চালু করা যায় না। নিজ ইতিহাস নিজে লিখতেই হয়।

অর্থাৎ আমরা ধরেই নিয়েছিলাম কলকাতার ইতিহাসের ভাষ্য আর আমাদের (পুর্ব-পাকিস্তানের ইতিহাসের) ভাষ্য যেন একই। যেন কলকাতারটা যেহেতু “আধুনিক শিক্ষার” (মানেই প্রগতিশীলতার ইতিহাস) বই কাজেই, কলকাতার ইতিহাসটা পড়লেই পুর্ব-পাকিস্তানের নিজের ভাষ্য-ইতিহাসিটা জানা হবে আর তাতে আমাদের চলবে। অথচ দুটার বাস্তব ইতিহাস ভাষ্যের সবচেয়ে মুখ্য ও বিরাট ফারাকটা হল, একটা জমিদার হিন্দুর ভাষ্য আরেকটা প্রজার ভাষ্য।  অথচ আমরা এমন দাবিও করতে দেখি যে প্রগতিশীলেরা নাকি সবচেয়ে বেশি শ্রেণী সচেতন!  অথচ এরা জমিদারের ভাষ্যটাকে অবলীলায় প্রজার ভাষ্য বলে চালিয়েছে।

প্রগতিবাদের সমস্যাঃ
প্রগতিবাদও কম পুরানা নয়। খুবই অল্প কথায় মূল জিনিষটা বললে, ইংরাজি প্রগ্রেসিভ (progressive) শব্দের বাংলা করে নেয়া হয়েছে প্রগতিবাদ। এটা বৃহত্তর অর্থের এক ধারণা। যেমন সব কমিউনিস্ট প্রগতিবাদী কিন্তু প্রগতিবাদীরা সবাই কমিউনিস্ট নাও হতে পারে। মানে কমিউনিস্টরা আরো খাঁটি প্রগতিবাদী এমন বলা যেতে পারে।  প্রগতিবাদের রূট পাওয়া যাবে রেনেসাঁর মধ্যে। যদিও একালের প্রগতিবাদ রেনেসাঁ সম্পর্কে প্রায় কিছুই জানে না, কিছুই পড়ে নাই। আবার  সব ধর্ম নয়, কেবল ইসলাম কোপাতে হবে এটা জানে। সেই সুত্রে নিজেকে প্রগতিবাদী বলে দাবি করে থাকে। যদিও কমিউনিস্টরা তাদের পাঠ্য সিলেবাসে কখনও রেনেসাঁ আন্দোলনকে পাঠ্য হিসাবে রেখেছি তা দেখা যায় না। ঠিক যেমন মর্ডানিজম বা মর্ডান রাষ্ট্র কমিউনিস্টদের পাঠে থাকতে দেখা যায় না এটা সেরকমই যেন। তবে

রোমের তিন শহরে তারা রোমের খ্রীষ্টধর্ম গ্রহণের আগে সময়ের কিছু প্রাচীন নিদর্শন আবিস্কার করেছিল যা ১৪৫০ সালে বসে তাদের মনে হয়েছিল সেগুলো তাদের আমলের চেয়ে উন্নত, তাদের চিন্তাভারণা অনেক উন্নত ছিল। ফলে তারা প্রাচীন রোম যা খ্রীষ্টধর্ম গ্রহণের আগে ছিল সেই রোমকে পুনঃআবিস্কার বা পুণর্জন্ম দেওয়ার এক সংগ্রামে সংগঠিত হয়ে ঝাপিয়ে পড়েছিল। এটাকে তারা রেনেসাঁ  বা রি-বার্থ (re-birth) এর আন্দোলন বলে নামকরণ করেছিল। অর্থাৎ প্রকারন্তরে বলা যেন যে খ্রীশ্চান হওয়াটাই প্রাচীন রোমের জন্য কাল হয়েছিল।
এখন রোমের রেনেসাঁ আন্দোলন মানে কী?
সেটা কী এটাই বলা যে সাধারণভাবে সব ধর্মই পশ্চাদপদ (প্রগতির বিপরীত)? নাকি খ্রীশ্চানিটিই পশ্চাদপদ ও সব সমস্যার গোড়া? কিন্তু সেক্ষেত্রেও আরও প্রশ্ন আছে। খ্রীশ্চান হবার আগের যে প্রাচীন রোম সেকালেও কী স্থানীয় ধর্ম মানে গ্রীক দেব-দেবীর ধারণা ছিল না? অবশ্যই ছিল। তাহলে সাধারণভাবে ধর্ম মানে সকল ধর্মতত্বকেই (Theology) আক্রমণের নিশানা করার কোন সুযোগই এখানে নাই। অথচ রেনেসাঁ মানে ধর্ম-কোপানী এই ধারণা ছড়িয়েই তো এর প্রপাগান্ডা শুরু হয়ে গেছিল?
আবার যেমন মধ্যযুগ মানে কী?
আক্ষরিক অর্থে ও মোটাদাগে এটা হল ৫০০-১৫০০ খ্রীস্টাব্দ; এই মাঝের হাজার বছর। প্রাচীন রোমের বিচারে এটাই রেনেসাঁর আবির্ভাবের আগের খ্রীষ্টিয়-রোমের হাজার বছর।  এটাই প্রাচীন রোমের সেই  হাজার বছর বা মধ্য যুগ।  কিন্তু সাবধান, রোমের রেনেসাঁর প্রভাবশালী প্রথম দশজনের নাম যদি ধরা হয় তবে এদের মাত্র একজন নবমতম জন হলেন পেট্রার্ক  (Petrarch)। কেবল তিনিই এই ডার্ক যুগ বা অন্ধকার যুগ কথাটা বলতেন।  আর একালের “রেনেসাঁ মানে ধর্ম-কোপানি” এমন মানে কারিরাই এই অন্ধকার যুগ কথাটা প্রচার করেন।

অবিভক্ত বৃটিশ ভারতে আমাদের সাথে রেনেসাঁ চিন্তা-ধারণাকে পরিচয় করিয়ে দেন – রাজা রামমোহন রায়। বলাই বাহুল্য বৃটিশ কলোনি মালিকদের থেকে ঐসুত্রে পাওয়া রেনেসাঁ ধারণাই তিনি আমাদের কাছে এনেছিলেন, ১৮১৫ সালের পরে। কমিউনিস্ট পার্টি ও ইতিহাসের অধ্যাপকেরা তাঁকেই বাংলায় রেনেসাঁর “আদিগুরু” মনে করেন।  আবার ১৮৩০ এর দশকে বৃটিশ-ইন্ডিয়ায় মর্ডান এডুকেশন চালু হলেও এতে মুসলমানদের অংশ নেয়া শুরু হয় ১৮৫৭ সালে সিপাহী বিদ্রোহের পরাজয়ের পরবর্তিকালে (Anglo-Oriental College on 24 May 1875, দেখেন )। এই দেরিতে অংশ্নেয়াকে পুঁজি করে মুসনমানেরা পশ্চাদপদ তারা কূপমন্ডুক তারা প্রগতি বুঝে না ইত্যাদি প্রপাগান্ডা করে তাদেরকে দাবিয়ে নিজেদের আধিপত্য বিস্তারে একে কাজে লাগানো হয়েছিল।
আর এছাড়াও, সর্বশেষ মুসলমানদের উপর বড় ধাক্কাটা আসে ১৯৪৭ সালের পরে। প্রথম পর্বে বহুবার উল্লেখ করেছি বৃটিশ আমলে – বাংলা জমিদারি ব্যবস্থার কারণে, বেশিরভাগ জমিদার হিন্দু হওয়ার কারণে বাংলা সর্মময়ভাবে  হিন্দুদেরই রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক, ও অর্থনৈতিক আধিপত্য ছিল।  এর আরোওও কিছু মজার নমুনা যা এখনও সমান বহাল আছে তা দেখাব। যাহোক, ১৯৪৭ সালে পাকিস্তান রাষ্ট্র কায়েম হওয়াতে  জমিদার-হিন্দুদের এই  রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক, ও অর্থনৈতিক আধিপত্য এইবার ভেঙ্গে পরেছিল, বিশেষ করে পুর্ববাংলায় (পুর্ব-পাকিস্তানে)।  যারা এতদিন  কমকরে হলেও গত দেড়শ বছর ধরে ছড়ি ঘুড়িয়ে রুস্তমি দেখিয়ে ঘুরেছিল তাদের পক্ষ এটা হয়ে গেছিল এই দুঃসহ অবস্থা। যা মেনে নিতে তাদের কষ্ট হিচ্ছিল। তাই এ’অবস্থায় যারা পাকিস্তানে থেকে গেছিল এম্ন জমিদার ও তাদের জ্ঞাতিগোষ্ঠি প্রভাবশালী এরা সদল বলে পুর্ব-পাকিস্তান কমিউনিস্ট পার্টি যোগ দিয়েছেন। যারা ভারতে চলে যায়নি এমন সদস্যদের নিয়ে ১৯৪৮ সালে এই পার্টি পুনর্গঠন করা হয়। কিন্তু কমিউনিস্ট পার্টি কেন?

কারণ কমিউনিস্ট পার্টি ধর্ম মানে না বলে প্রচারিত। তাই পার্টিতে ঢুকে ধর্ম না মানা প্রগতিশীলতা এই বয়ানের আড়ালে ইসলাম-কোয়ানি আর এই বিনিময়ে যতটুকু রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক, ও অর্থনৈতিক প্রভাব তারা অর্জন করতে পেরেছিল তা দিয়েই তারা সমাজে টিকে থাকার চেষ্টা করেছিল।  একারণ, প্রগতিশীলতা মানে ধর্ম মানে ইসলাম-কোপানি, এরা পশ্চাদপদ এসব অভিযোগ এখান থেকেই। আর জমিদার-হিন্দুরা পাকিস্তান কায়েমের ফলে জমিদারি খুইয়ে ইসলামকেই এর প্রধান শত্রু গণ্য করে এসেছে। যেন অনেকটা মুসলমানেদের ধর্মটাই খারাপ পশ্চাদপদ বলেই মুসলমানেরা খারাপ ফলে তাঁর জমিদারি হারানি – এমন একটা সম্পর্ক সুত্র গেথে হাজির করে জঁপতে থাকে তারা। ফলে এটা জমিদার-হিন্দুর ভাষ্য না কমিউনিস্ট ভাষ্য   এদুইয়ের মধ্যে কোন ফারাক নাই। তাই আমাদের এই অঞ্চলের “প্রগতিবাদের” আসল অর্থ দাঁড়িয়ে গেছে জমিদার-হিন্দুর হারানো প্রভাব প্রতিপত্যি আর সেই দুঃখ থেকে উঠে আসা এক ইসলামবেদ্বেষ।

পাকিস্তান কায়েম ছিল জমিদার-হিন্দু সরাসরি স্বার্থবিরোধীঃ
এই লেখার শুরু থেকেই আমরা বলে আসছি পাকিস্তান কায়েম ছিল জমিদার-হিন্দু সরাসরি স্বার্থবিরোধী এক জমিদারী ব্যবস্থা উচ্ছেদের বিপ্লব। তাতে পাকিস্তান কায়েমের মধ্যে যতই খামতি, খারাপ দিক বা সীমাবদ্ধতা থাক না কেন!  অতএব এটাও স্বাভাবিক যে জমিদার হিন্দু সুনির্দিষ্ট করে মনেই করবে যে পাকিস্তান কায়েম তার সরাসরি স্বার্থবিরোধী। আর সেটা অন্তত একারণে যে পাকিস্তান বাস্তবে আলাদা রাষ্ট্র হয়ে যাওয়াতেই তারা পুর্ব-পাকিস্তানের আইনে জমিদারি উচ্ছেদ হয়ে যাওয়া আর কলকাতায় বসে তাঁরা ঠেকাতেই পারে নাই। কাজেই সোজা কথাটা হল, জমিদার হিন্দুর চোখে “দেশভাগ হওয়া” মারাত্মক ভুল হয়েছে। খুবই ভুল! অথচ আমরা প্রজারা, পুর্ব-পাকিস্তানি (বাংলাদেশিরা) হলাম জমিদারি উচ্ছেদের সরাসরি সুবিধাভোগী এবং তা হিন্দু-মুসলমান নির্বিশেষে জমির মালিকানা লাভের সুবিধাভোগী বেনিফিসারি।  অথচ সেই আমাদেরকেই পাকিস্তান আমলে কমিউনিস্টরা প্রগতির লোভ দেখিয়ে ফুসলিয়েছিল যে কলকাতার ইতিহাস মানে নাকি “প্রগতি-চিন্তাধারায়” লেখা ইতিহাস। কিন্তু কে না জানে “প্রগতি-চিন্তাধারীরা” মনে করে তাদের কথিত “স্বদেশি আন্দোলন” (যা আসলে এক ভুয়া জিনিষ) কারণ এটা  জমিদারের আপন স্বার্থ-ইতিহাসের বয়ান। তাঁদের কাছে আপন ইতিহাস এবং যা আসলে কলকাতার বা জমিদার হিন্দুর ইতিহাস।  এমনকি এখনও স্বাধীন বাংলাদেশেও একাদেমিকভাবে যে ইতিহাসের টেক্সট পড়ানো হয় সেটাও ডমিনিটিংলি কলকাতার জমিদার হিন্দুর অনুমোদিত ইতিহাস –  “প্রগতিশীলতা” বলে সেটাকেই পুর্ব পাকিস্তানের ইতিহাস বলে পড়ানো হয়। এই হল আমাদের ট্রাজেডি! এর মূলকথাটা হল, প্রগতিশীলদের চোখে দেশভাগ একটা খুবই খারাপ জিনিষ, খারাপ কাজ! যেমন নিচে দেখা যাক!

বঙ্গভঙ্গ বা ১৯০৫ সালঃ
একইভাবে বঙ্গভঙ্গ বা ১৯০৫ সালের বাংলা ভাগকে দেখেনঃ এখানেও এমনকি অবিভক্ত কমিউনিস্ট পার্টিও মনে করে বঙ্গভঙ্গ বা ১৯০৫ সালের বাংলা ভাগ করা (পুর্ববঙ্গ আর আসাম মিলে পশ্চিমবঙ্গ থেকে আলাদা নতুন প্রদেশ করা) বৃটিশদের ভুল সিদ্ধান্ত। এই নতুন প্রদেশ হওয়া বা  বঙ্গ  ভঙ্গ হওয়া ঠেকিয়ে দেয়াটা এটাই কলকাতার বা জমিদার হিন্দুস্বার্থ। এটা তার নিজের কোর স্বার্থ মনে করেছিল। অথচ বাস্তবে পুর্ববঙ্গের বাসিন্দাদের কাছে ব্যাপারটা ছিল উলটা। ১৯০৫ সালে পুর্ববঙ্গের প্রজারা মনে করেছিল ঢাকাকে রাজধানী করে আসামসহ বাংলায় নতুন প্রদেশ করা হলে সেটা জমিদার-হিন্দু আধিপত্যের সেন্টার কলকাতার নাগপাশ ত্যাগ করা হবে, আর সেটাই তাঁদের স্বার্থ। কলকাতার প্যারালাল ঢাকাকেন্দ্রিক পুর্ববঙ্গ ও আসা্মের নতুন রাজধানী – এটাই জমিদার-হিন্দুর কাছে চক্ষুশূল হয়েছিল। আসাম সহজেই তা উতপাদিত চা পুর্ববঙ্গের উপর দিয়ে বন্দরে নিতে পারবে, এই আশা করেছিল। মূলকথা জমিদার হিন্দুর স্বার্থ কখনই পুর্ববঙ্গের প্রজার স্বার্থ ছিল না,  তারা কলকাতায় বসে সব  নিজের নিয়ন্ত্রণে নিতে চেয়েছিল। এই হল বাস্তবের মূল স্বার্থদ্বন্দ্ব। কাজেই বাংলার স্বার্থ বলে জমিদার হিন্দুর স্বার্থ আমাদের উপর সবসময় চাপিয়ে দেওয়ার চেষ্টা হয়েছে আর আমরা পুর্ববঙ্গের প্রজারা আমাদেরকেই তা উলটে দেওয়ার চেষ্টা করতে হয়েছে। অতএব ১৯০৫ সালের লড়াই ছিল কলকাতার অধীনস্ত সারা বাংলায় জমিদার স্বার্থ বনাম কলকাতার প্যারালাল ঢাকাকে রাজধানী করে জমিদার আধিপত্য সবটা নাহলেও কৃষির উদ্বৃত্ব বা পুজির  সঞ্চয় বা একুমুলেশন কলকাতার সমান্তরালে ঘটানোর কেন্দ্র হিসাবে ঢাকাকে খাড়া করা; যেই ঢাকা তখন ছিল মুসলমান সংখ্যাগরিষ্ট।  একারণেই ঢাকাকে রাজধানী করে পুর্ববঙ্গ ও আসামকে নিয়ে নতুন প্রদেশের ঘোষণা – এতা কলকাতার জমিদার-হিন্দুর মাথায় আকাশ ভেঙ্গে পড়ার মত প্রতিক্রিয়া সৃষ্ট করেছিল।  সেটা আরেকভাবে বুঝা যায় যখন আমরা দেখি জমিদারেরা সশস্ত্রভাবে মানে জঙ্গি হয়ে গিয়ে বৃটিশ সরকারের বিরুদ্ধে অস্ত্রহাতে দাঁড়িয়ে গেছিল। জমিদারি স্বার্থ এর নাম দিয়েছিল কথিত “স্বদেশি আন্দোলন”।  অর্থাৎ ১৭৯৩ থেকে ১৯০৫ সাল, এই একশ বারো বছর ধরে তারা বৃটিশ কলোনি দখলদারদের ঔরসে জন্ম নিয়ে জমিদারির দাপট চালিয়ে রক্ত চুষে গেছে।  আর বৃটিশ শাসকেরা ১৯০৫ সালে বাংলায় নতুন এক প্রদেশ ঘোষণা দেওয়াতেই সেই জমিদারের অবৈধ বাবা বৃটিশেরা তখন হয়ে গেছিল কথিত “সাম্রাজ্যবাদ”।  কারণ “স্বদেশি আন্দোলন দাবি করে তারা নাকি ১৯০৫ সালে “সাম্রাজ্যবাদ-বিরোধী সংগ্রাম”  করেছেন – এই হল কমিউনিস্টদের বয়ান। । অর্থাৎ যেন জমিদারেরা হইল গিয়া “সাম্রাজ্যবাদ-বিরোধী সংগ্রামি বীর”। সারা বাংলার জমিদারি ক্ষমতা কেবল কলকাতায় কুক্ষিগত করে রাখাটাই নাকি তাদের বীরত্বের প্রমাণ! হায় রে কমিউনিস্ট! একশ বারো বছর ধরে যে জমিদার-হিন্দুরা টানা প্রজার রক্ত চুষে গেল এরাই নাকি সংগ্রামি বীর! কার জন্য এই কথিত বীরত্ব প্রদর্শন? কলকাতা কেন্দ্রীক একছত্র জমিদারি ক্ষমতা ধরে রাখার জন্য?  আর তাহলে কী জমিদারেরা প্রজার নেতা ও প্রতিনিধি!  এটাই শ্রেণী সংগ্রাম? মানে শিয়াল হল যেন মুরগীর নেতা ও প্রতিনিধি! বাহ রে “শ্রেণী সংগ্রাম বুঝ’ ও ‘প্রগতিবাদ’!

জয়া চ্যাটার্জির ১৯৯৪ সালে প্রকাশিত “বাঙলা ভাগ হল” বইটার সবচেয়ে খারাপ দিক ও ডি-মেরিট হল, বাংলা দুই দুই বার ভাগ হল – ১৯০৫ আর ১৯৪৭ সালে; এটাকে তারা নেতিকাজ ও অন্যায় সিদ্ধান্ত মনে করেছে। এটা ধরে নিবার পর এবার এই ধারণার উপরে দাঁড়িয়ে বইটা লেখা হয়েছে।  আর ঠিক এর উলটা – এই দুবারই বাংলা ভাগ করা বা হওয়াকে সঠিক কাজ বলে মনে করেছিল পুর্ববঙ্গ বা পুর্ব পাকিস্তান। বাস্তবে এই ছিল তাদের অনুভব এবং বলাই বাহুল্য কলকাতার জমিদার-হিন্দুর ভাষ্যের চেয়ে এটা আলাদা বা উলটা। অথচ জয়া চ্যাটার্জি ঐ বইয়ে বাংলা ভাগ একটা “খারাপ কাজ” এটা ধরে নিয়ে এই অনুমানের উপর দাড়িয়ে লিখা, যা আমাদের উপরে চাপিয়ে দিয়েছে। অন্তত এভাবেও বলে নাই যে – ফ্যাক্টস হল (পুর্ববঙ্গ)বাংলাদেশের স্বার্থ অনুভব ছিল কলকাতার চেয়ে ভিন্ন। আর পাকিস্তান সম্পর্কে সরাসরি ফ্যাক্টস হল,  পুর্ব পাকিস্তানের প্রজা কৃষক সকলে ১৯৪৭ সালে জমিদারি উচ্ছেদের ফলেই জমির মালিক হয়েছিল অথচ তাঁদের সন্তানেরা স্কুল-বিশ্ববিদ্যালয়ে গিয়ে শিখতেছে জমিদারেরাই নাকি সঠিক ছিল, পাকিস্তান কায়েম করাই ঠিক হয় নাই, ভুল। এরচেয়ে বড় তামাশা আর কী হতে পারে!
কমিউনিস্ট-প্রগতিবাদের বয়ানের ভিতর পাওয়া যায়  –  সুর্যসেন, কল্পনাদত্ত বা প্রীতিলতার কথা – এরা কলকাতার জমিদারের স্বার্থে সশস্ত্রভাবে বৃটিশদের বিরুদ্ধে অস্ত্র হাতে লড়েছে, মা কালীর পুজা করে অস্ত্রহাতে বের হত তাঁরা। জমিদারেরাও ১৯০৫ সালে প্রত্যক্ষভাবে কলকাতার রাস্তায় ব্যাপক মিছিল মিটিং করেছিল। এগুলাই নাকি তাঁদের স্বদেশীপনা, সেসময়ের স্বদেশী আন্দোলন। অথচ  পুর্ববঙ্গ চেয়েছিল বাংলা ভাগ করে আসামকে সাথে নিয়ে ঢাকাকে রাজধানী করে নতুন প্রদেশ করতে।  বৃটিশ শাসকের বাংলা ভাগের মধ্যে পুর্ববঙ্গ তার স্বার্থ দেখেছিল। কারণ এতে কলকাতার অধীনস্ততা থেকে বের হওয়ার কিছু সুযোগ ছিল। আর বলাই বাহুল্য এটা কলকাতার জমিদার হিন্দু স্বার্থের পুরাপুরি বিরুদ্ধে, পুর্ববঙ্গের স্বার্থ। সুর্যসেন আমাদের এই স্বার্থের বিরুদ্ধে জমিদারস্বার্থকে রক্ষা করতেই অস্ত্র ধরেছিল। অথচ সুর্যসেন বা প্রীতিলতার নামে হল বা একাদেমিক প্রতিষ্ঠানের নামকরণ করি আমরা। আর এটাই নাকি ‘প্রগতিশীল’ কাজ।

এখানে ফাঁকিটা হল, বৃটিশদের বিরুদ্ধে অস্ত্র ধরা মানেই “কমিউনিস্টরা” তা বিপ্লবী কাজ ফতোয়া দিয়েছে, কথিত সাম্রাজ্যবাদবিরোধী কাজ ধরে নিয়েছে, প্রচার করেছে। অথচ জমিদারের অস্ত্র ধরেছে সারা বাংলায় একছত্র জমিদার-হিন্দুর দাপট রক্ষা করতে। কলকাতাকেন্দ্রিক তাদের একচেটিয়া ক্ষমতায় যেন ঢাকা ভাগ না বসায়, ঢাকা প্রতিদ্বন্দ্বি হিসাবে না দাঁড়াতে পারে।  জমিদার-হিন্দুর সব ধরণের জমিদারি উতসারিত আধিপত্য যেন অটুট থাকে, মুসলমান-প্রজাদের উপর জমিদারি-ক্ষমতা আর ধর্ম-পরিচয়ে নিস্পেষণ ও মার্জিনালাইজ করে রাখা যেন অটুট থাকে। কাজেই সরি, প্রগতিবাদ! আমরা দুঃখিত, জমিদার-হিন্দুর সংকীর্ণ স্বার্থের পক্ষে অস্ত্রহাতে সুর্যসেনদের নামানো এটা কোনভাবেই সাম্রাজ্যবাদবিরোধিতা নয়। আপনাদের দাবির কোন সত্যতা নাই। কারণ, সুর্যসেনেরা ছিল বড়জোড় আমরা বলতে পারি জমিদার হিন্দুর লাঠিয়াল মাত্র। তারা অস্ত্রাগার লুন্ঠন করেছে বাংলায় জমিদার-হিন্দুর ক্ষমতা ও স্বার্থ রক্ষার্থে।

একারণে সোজাকথাটা বললে, দুদুবার বাংলাভাগ হওয়া তা “খারাপ কাজ বা ভুল” এমন কথাটা আগাম ধরে নেয়া এটাই মূলত জমিদা্র-হিন্দুর স্বার্থ ও দৃষ্টিভঙ্গি। আর এটাকেই জয়া চ্যাটার্জি জবরদস্তিতে পুর্ববঙ্গ বা বাংলাদেশের উপর চাপিয়ে দিয়ে ঐ বই লিখেছেন। সুর্যসেনের বাড়ি কক্সবাজার হতে পারে কিন্তু তার পলিটিক্যাল এক্ট এটা কলকাতার বাবু জমিদার-হিন্দুরই স্বার্থ। আর সরাসরি কথাটা হল, তার বৃটিশদের বিরুদ্ধে অস্ত্র ধরা মানেই তা সাম্রাজ্যবাদবিরোধি কাজ নয়। এমন চালিয়ে দিবার সুযোগ নাই। বরং এটাই পুরাপুরি জমিদার-হিন্দুর স্বার্থে। এবং পুব-পশ্চিম সারা বাংলার প্রজা-কৃষকের সরাসরি স্বার্থবিরোধী। কমিউনিস্টরা শ্রেণী সংগ্রাম, শ্রেণীস্বার্থ শব্দগুলো নিয়ে জান পেরেসান ভাব দেখায়। অথচ সারা বাংলার প্রজা-কৃষকের স্বার্থের প্রশ্ন যখন উঠেছে অথচ তখন  সুর্যসেনেরা জমিদারের পক্ষে দাঁড়িয়ে গেছে। একারণে, বাংলাদেশের সিপিবি বা বাসদ অথবা যেকোন কমিউনিস্ট এদের ভুল ইতিহাসবোধ সংশোধন করে নেয়া উচিত। সময় অনেক গড়িয়ে গেছে আর কত! কিছু না করতে পারলে অন্তত আর বিভ্রান্ত ছড়ানোতে তাদের ইস্তফা দেয়া উচিত। নিজেদের ভুল রাজনৈতিক ইতিহাসবোধটা রিভিউ করা উচিত। আবার রানা দাসগুপ্ত যিনি এখন হিন্দু বৌদ্ধ খৃশ্চান ঐক্য পরিষদের সেক্রেটারি, তিনি আসলে সুর্যসেনের আত্মীয় ও সমর্থক। তিনি কী এখনও  জমিদার-হিন্দুস্বার্থের পক্ষেই লড়ে যাচ্ছেন না!

তরুণ মুসলিম লীগারগণ এখন প্রগতিশীলঃ
এবার কথা বলব, স্কলার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরাজির এমিরেটাস অধ্যাপক ডঃ সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী অথবা ভারতের ‘পদ্মভূষণ’ বাংলার প্রফেসর মৃত ডঃ আনিসুজ্জামানকে নিয়ে। এঁরা প্রত্যেকেই তাঁদের কিশোর যৌবন কাটিয়েছেন পাকিস্তান আন্দোলনের সাথে যুক্ত থেকে। ১৯৪৭ সালের আশেপাশের কালে তাদের তখন টিনেজ বয়স তাঁরা পার হচ্ছিলেন। সেকথা তারা নিজেই পরিণত বয়সে তাঁদের আত্মজীবনীতে (আনিসুজ্জামানের ‘কাল নিরবধি’ বই  অথবা সাজ্জাদ শরীফের নেয়া সাক্ষাতকার দেখুন) বা এ’সংক্রান্ত যেকোন লেখাতেও তারা এমনকি সেসব পুরানা ঘটনাকে গৌরবের বিষয় হিসাবেই তুলে ধরেছেন। তাহলে তাঁরা বদলে গেলেন, প্রগতিবাদী হয়ে গেলেন কবে,  কখন থেকে? জমিদারেরা আমাদের প্রগতিবাদ শিখায় কী তামসা! সব ফকফকা তামাসা! আর এই  প্রগতিবাদী হওয়া জমিদারদের স্বদেশি আন্দোলনকে আপন করে নেয়া – এমন পক্ষবাদী এরা হয়ে গেছিলেন কখন? সেটা হল, যখন ১৯৪৭ সালের পরে পাকিস্তান কায়েম হয়ে গেছে অথবা তাঁরা এরপর বিশ্ববিদ্যালয়ে ঢুকে গেছেন। কিন্তু ঢুকে দেখেছেন পুর্ব-পাকিস্তানের নিজের ইতিহাস বই নাই। এবার পাকিস্তানের জন্মের স্বপক্ষে সাফাই বয়ানে লেখা পাকিস্তানের কোন ইতিহাস তাঁরা খুঁজে পান নাই। আর সেই সাথে বিবেচনা বাছবিচারহীন প্রগতিবাদের প্রতি মোহ ও লোভ; প্রগতি মনে করে কলকাতা বা জমিদার হিন্দুর তত্বাবধানে লেখা ইতিহাস, তাই পড়েই এঁদের বড় হতে হয়েছে।
তবে আবার সাবধান, পাকিস্তানের জন্মের পরেকার প্রবল বয়ান সংকট কেবল দুচারজন শিক্ষকের জন্য বলে মনে করা একেবারেই নয়, তা বড় ভুল হবে। আমি কেবল এখানে দুজনের উদাহরণ দিয়ে দেখালাম সেকালের ইয়াং মুসলিম লীগারদের পরিণতি পাকিস্তান কায়েমের পরে কী হয়েছিল। প্রগতিবাদীতার লোভ দেখিয়ে এদেরকে কলকাতার জমিদার হিন্দুর স্বার্থবয়ানের ইতিহাসটাই তাঁদের নিজেদের ইতিহাস বলে খাওয়ানো হয়েছিল।
আগেই বলেছি জমির দলিল পেতে পেতে আমাদের বাপ-দাদাদের কমপক্ষে ১৯৫১ সাল লেগে গিয়েছিল। আবার ১৯৫২ সাল থেকেই (যদিও এর শুরু ১৯৪৮ সালে জিন্নাহ-র পুর্ব পাকিস্তান সফর থেকেই) ওদিকে ভাষা আন্দোলন প্রবল হয়ে উঠেছিল। আর এটা হল পাকিস্তানের দু অংশের ইন্টিগ্রেশন কত দুর্বল ছিল তার প্রকাশ।  আর স্বভাবত এতেই পাকিস্তানকে আপন মনে করতে গিয়ে পুর্ব-পাকিস্তান যে ধাক্কা খায় এর এক বড় চিহ্ন। কিন্তু সেটাই কী প্রথম? না, একেবারেই না। কিন্তু কিভাবে বুঝব আর মানব?

আওয়ামি লীগের জন্মঃ
আওয়ামি লীগের জন্ম যদি আমরা দেখি। সেটা ২৩ জুন ১৯৪৯ সালে। সেসময় পুরা ও আসল নাম “আওয়ামি মুসলিম লীগ”। মুসলিম লীগের বিরোধী এক “আওয়ামি মুসলিম লীগ”। মানে যেন এবার ‘পাবলিকের’ এক মুসলিম লীগ গঠন হচ্ছে, এটা অনেক অর্থে অবশ্যই যথেষ্ট বড় ধাক্কা। না এটা দল ভেঙ্গে দল করার জন্য, তা একেবারেই নয়। তবে নতুন দলের আসল ভুল হল, আগের মুসলিম লীগ করাটাকে এরা পুরাপুরি ভুল কাজ মনে করে বসল। অর্থাৎ তখনও জমিদার-হিন্দু স্বার্থের যে বয়ান উঠেছিল সেই ভিত্তিতেই  নতুন দলটা করা হয়েছিল। কেন এমন হল?
এর মূল কারণ, যারা পরবর্তিতে ‘আওয়ামি মুসলিম লীগ’ খুলেছিলেন তারা দেশভাগের আগে থেকেই মুসলিম লীগের কোন অর্জনকে আর নিজেদের অর্জন বলে মনে করা ছেড়ে দিয়েছিলেন। যেমন, জমিদার উচ্ছেদ আইন পাস করা এর চেয়ে গৌরবময় অর্জন  এবং মুসলিম লীগের জন্য আর পুর্ব-পাকিস্তানে কিছুই হতে পারে না। এটা শুরু হয়েছিল ১৯৩৭ সালের নির্বাচিত প্রথম বাংলার প্রাদেশিক সংসদ থেকে। সেখানে একটা জমিদার উচ্ছেদ কমিশন (ফ্লাউড কমিশন) গঠন করা থেকে। যেটা ১৯৪৬ সালের দ্বিতীয়বারের প্রাদেশিক সংসদের হাতে ঐ কমিশনের রিপোর্ট সেবার বাস্তবায়নের প্রসঙ্গ এলে প্রস্তাব উঠে যে স্বাধীন পাকিস্তানে বসে তা বাস্তবায়ন করা হবে তাই তখন মুলতবি হয়েছিল। আর সত্যসত্যই ১৯৫১ সালে পুর্ব-পাকিস্তান প্রাদেশিক সংসদে জমিদারি উচ্ছেদ আইন পাস হয়ে যায়।

অথচ ইতোমধ্যে নবগঠিত আওয়ামি মুসলিম লীগের এতে কোন প্রতিক্রিয়া হয়েছিল জানা যায় না। এই উচ্ছেদ আইনকে নিজের বলে আপন মনে করেছিল অথবা উলটা নিন্দা  – না, তাও জানা যায় না।  ১৯৫১ সালের জমিদারি উচ্ছেদ আইন পাস যেন এক অবৈধ সন্তানের উপেক্ষায় জন্ম নেয়া। সকলেই এর সুবিধাটা নিয়েছিল, প্রজারা জমি বুঝে পেয়েছিল।  তারা মুসলিম লীগকে অস্বীকার করুক কিন্তু উচ্ছেদ আইনটাকে আপন মনে করবে না কেন? কিন্তু কেউ এর ক্রেডিট স্বীকার করে নাই। এটা ভাল কাজ তা বলে নাই। কারণ এই আইনের কারণে জমিদার-হিন্দুর স্বার্থ সমুলে উতপাটিত হয়েছিল। আওয়ামি লীগ কী তাতে প্রগতির লোভে দুঃখবোধ করেছিল?  তাহলে কেন জমিদারি উচ্ছেদ ও বিলুপ্ত হওয়ার দিবস বা ঘটনাকে নিয়ে জন্মের পর থেকে আজও আওয়ামি লীগের কোন উতযাপন কখনও করে নাই কেন? আবার বিপরীতে মুসলিম লীগও কী কোন উতযাপন করেছিল কখনও? না তাও জানা যায় না। কারণ ততদিনে দিনকেদিন মুসলীম লীগ মানে হতে থাকে কেবল পশ্চিম পাকিস্তানের স্বার্থ।

অথচ আজকে বাংলাদেশের যে অর্থনৈতিক সক্ষমতা ও সমৃদ্ধি এর ফাউন্ডেশন তৈরি হয়েছে ঐ জমিদারি উচ্ছেদ ও বিলুপ্তর কারণে। (পুর্ববঙ্গে) বাংলাদেশের পুঁজির সঞ্চয় (Capital accumulation & formation) ও গঠন এরপর শিল্পের পথে যাবার শর্ত তা শুরুই কখনও হতে পারত না। এই উচ্ছেদের সিদ্ধান্ত ছিল এই ফান্ডামেন্টাল। আজ বাংলাদেশ ৩৫ বিলিয়ন ডলারের গার্মেন্টস পশ্চিমাদেশে রপ্তানি করতে সক্ষম। জমিদারি উচ্ছেদ না হলে এটা কখনই সম্ভব হত না।  নুন্যতম কোন শিল্পায়ন, পুঁজিগঠন সম্ভব হত না।

আগেই বলেছি ১৯৪৮ সালেই নতুন করে পুর্ব-পাকিস্তানের কমিউনিস্ট পার্টি গঠন করা হয়েছিল। যার মধ্যে দিয়ে নতুন করে প্রবেশ ঘটেছিল ব্যাপক সংখ্যক জমিদারি হারানি বা জমিদার সংশ্লিষ্ট হিন্দু যারা পাকিস্তান জন্ম নেওয়াতে তাঁদের আগের রাজনৈতিক, সামাজিক ও অর্থনৈতিক – একছত্র ক্ষমতা সব খুইয়েছিল। তারাই এই কমিউনিস্ট পার্টিতে যোগ দিয়েছিল।

তাই এরপর বলাই বাহুল্য যে কমিউনিস্ট পার্টিও জমিদারি উচ্ছেদ আইনের পক্ষে কোন বিবৃতি, পক্ষে বা বিপক্ষে কোন টু-শব্দ, আপন করে নেয়া বা বিরোধিতা করা প্রশ্নই উঠে না। কারণ পুরান জমিদার বা সন্তান ও আত্মীয়্রাই তখন কমিউনিস্ট। । আজও কমিউনিস্ট পার্টি এনিয়ে কোন গর্বও করে না, নিন্দাও করে না। যেন জমিদারি উচ্ছেদ আইন পাস এটা ঘটে নাই।  এরা এমনই কমিউনিস্ট যারা জমিদারি ব্যবস্থা উচ্ছেদে দুঃখবোধ করে! খুব সম্ভব, এসবের পিছনের একটাই মূল কথা বলা যায় যে আসলে ততদিনে তাদের হারানি জমিদারি স্বার্থের দুঃখে ‘প্রগতিশীল’ হয়ে গেছিলেন। যতটা প্রগতিশীল হয়ে গেছিলাম ততটাই যেন জমিদারি উচ্ছেদ বা প্রজার জমি পাওয়া এটা আর কোন ‘কমিউনিস্ট রাজনীতি’ বলে মনে হয় নাই। আসলে দেখা যাচ্ছে পাকিস্তান কায়েমের স্বপক্ষে কোন বয়ান-ইতিহাস নাই লেখা হয় নাই – এই কথাটার তাতপর্য সহজ কোন বিষয় ছিল না। এর ভিতর দিয়েই কোথায় কী ক্ষয় ধরেছিল তা ফুটে উঠে। যদি পাঠ করতে চাই, আমরা এখনও ধরতে পারি, ভুল শুধরাতে পারি। কিন্তু করব কী?

এদিকে ১৯৫৪ সালের নির্বাচন অনুষ্ঠিত হলে তাতে পুর্ব পাকিস্তানে মুসলিম লীগ গো’হারা হেরে একেবারে উতখাত বেখবর হয়ে যায়। এতে ১৯৪৭ এর সময় থেকেই খাজা নাজিমুদ্দিন আর আকরাম খাঁ দের হাতে পুর্বপাকিস্তান মুসলিম লীগের স্থানীয় নেতৃত্ব দেয়া হয়েছিল তাতে বিবেচনায় নেয়া হয়েছিল কারা জিন্নাহ ও পশ্চিম পাকিস্তানের নেতাদের অনুগত। কিন্তু তারা পুর্ব-পাকিস্থানকে প্রতিনিধিত্ব করে কতটুকু তা কোন বিবেচ্য ছিল না। কিন্তু কেন?
আবার ফজলুল হক বা সোহরওয়ার্দী দেশভাগের আগে প্রায় বছরসময়টা ব্যয় করেছেন কিভাবে দেশভাগ না করে কংগ্রেস বা মহাসভার সাথে সরকার গড়ে থাকা যায়। তাদের আগ্রহ ও স্বার্থ এতই সংকীর্ণ হয়েছিল। এই প্রশ্নে জিন্নাহর সাথে তাঁদের বিরোধ সবচেয়ে বড় হয়ে যায়, যা আর জীবনে কখনই মিটে নাই। বরং জিন্নাহর চোখে এরাই  দেশভাগের বিরুদ্ধের, আলাদা পাকিস্তান রাষ্ট্র না করার পক্ষের ‘এজেন্ট’ বলে চিত্রিত হয়ে যায়। তাই খাজা নাজিমুদ্দিন আর আকরাম খাঁ দেরকে সামনে এনে এদের হাতেই পুর্বপাকিস্তান মুসলিম লীগের নেতৃত্ব দিবার পিছনে জিন্নাহর সিদ্ধান্তের পক্ষে জিন্নার সাফাই ছিল এটাই। বদরুদ্দিন উমর সাহেবের অবস্থান ও ব্যাখ্যাটা হল, জিন্নাহ বা পশ্চিমপাকিস্তানের নেতাদের এই “খাজা-গজা প্রীতি” – এটাই মুসলিম লীগ ভেঙ্গে যাওয়ার কারণ। এরকম ব্যাখ্যাদাতা যারা তারাও অনেকে দেশভাগ ঘটা ব্যাপারটাকে ভাল ছিল না মনে করে থাকেন। অথবা অস্পষ্ট রাখেন।
এভাবে হক বা সোহরওয়ার্দী এরপর থেকে আর না মুসলিম লীগে না আওয়ামি মুসলিম লীগে সক্রিয় কেউ হয়েছিলেন। কেবল ১৯৫৪ সালের নির্বাচনের আগে আগে এরা দুজন সক্রিয় হন তবে ঠিক কোন দলের হয়ে নামার চেয়েও তারা “যুক্তফ্রন্টের” নেতা এভাবে কোনভাবে আবছা দলীয় পরিচয়ের মধ্যে দিন কাটিয়েছেন। তবে তাতেও মুখ্য বিষয় ছিল মুসলিম লীগ বিরোধীতা সেই দলটাকে বেইজ্জতি করে দেয়া। এটাই মুখ্য ছিল এবং তারা সফল হয়েছিলেন। কিন্তু  সে উদ্দেশ্যেই  সোহরওয়ার্দী কলকাতা থেকে পাকিস্তানে ফেরেনই ১৯৫৪ নির্বাচনের আগে মাত্র। আর হক সাহেব পাকিস্তানেই ছিলেন তবে রাজনীতিতে নয় কারণ তিনি হয়েছিলেন পুর্ব-পাকিস্তানের এটর্নী জেনারেল। ফলে আসলে দেশভাগের পরে পুর্ব পাকিস্তান হয়ে যায় যেন বাপ-মা হারা এতিম কোন সন্তান। যাকে নিয়ে গর্ব বা অর্জন বোধকরার কেউ নাই। কেবল তবু কিভাবে যেন ঠেলে গুতায় ১৯৫১ জমিদার উচ্ছেদ আইনটা পাশ হয়ে গেছিল। আবার পশ্চিম পাকিস্তানের নেতারা পাকিস্তানের সব ক্ষমতা একচেটিয়া নিজেদের হাতে কুক্ষীগত করতে কসুর ছাড়ে নাই। তাঁদের এসব কাজের পক্ষে একটাই ঠুনকো সাফাই যে ছিল যে হক বা সোহরওয়ার্দী পাকিস্তান লাভ করার চেয়ে দুই বাংলার মুখ্যমন্ত্রীত্ব করতে আগ্রহী ছিলেন বেশি। ঠুনকো বলছি এজন্য যে একবার পাকিস্তান স্বাধীন হয়ে যাবার পরে আর এই অভিযোগ তোলা বা ধরে বসে থেকে আর এই অভিযোগ সারা পুর্ব-পাকিস্তানকে বঞ্চিত বা বৈষম্য করা এটাও তো অন্যায্য কম নয়। এটাই তো ধীরে ধীরে পাকিস্তান ভাঙবার দিকে যাবার রাস্তা খুড়ে ফেলা আর তাই তো ঘটেছিল।

কাগমারি সম্মেলনঃ
আবার দেখা যাচ্ছে হক বা সোহরওয়ার্দী কেউ কিন্তু নবগঠিত আওয়ামি মুসলিম লীগে হাল ধরেন নাই। এমনকি ৫৪ সালে নির্বাচিত হবার পরেও না। কেবল ১৯৫৭ সালে হঠাত সোহরওয়ার্দীর পশ্চিম পাকিস্তানের সাথে শেষবার আপোষে (আমেরিকান মধ্যস্ততায়) কেন্দ্রীয় পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হবার সময়ি যা একটা ব্যতিক্রম হতে দেখা যায়। যেটা এক বছরও টিকে নাই।  তবে কাগমারি সম্মেলনের মুখ্য কারণ হল সোহরওয়ার্দীকে আমেরিকানেরা প্রজেক্ট করেছে তুলে ধরেছে বলে সোভিয়েত-আমেরিকার দ্বন্দ্বে কমিউনিস্টরা আর আওয়ামি করবে না – এই ভাগাভাগির সম্মেলন। কিন্তু একাজও ছিল অর্থহীন। কারণ সোহরওয়ার্দীর প্রধানমন্ত্রীত্ব কয়েকমাসও টিকে নাই। আমেরিকা আর আস্থা ও ধৈর্য রাখতে পারে নাই। আয়ুব খান ১৯৫৮ সালে সামরিক ক্ষমতা দখল করেছিল।

অর্থাৎ এগুলো আসলে একটা উপ বা সাইড-ঘটনা। তা হল আওয়ামি মুসলিম লীগের জন্ম হলেও হক বা সোহরওয়ার্দীর বিহনে এতে এক ভাসানী ছাড়া (যিনি ঠিক মুসলিম লীগের লোক ছিলেন না) বড় নেতা কে ছিলেন? কেউ না। তাহলে ১৯৪৯ সালে জন্মের পরে আওয়ামি মুসলিম লীগ দল চালিয়েছিল কারা? চালিয়েছিল মূলত জমিদারি হারানো হিন্দু কমিউনিস্টেরা।  আবার এটাই ছিল জিন্নাহ-লিয়াকত ইত্যাদি পশ্চিমের নেতাদের পুবের আওয়ামি মুসলিম লীগ অথবা হক বা সোহরওয়ার্দীদের প্রতি আরেক বড় অভিযোগ যে তারা সোভিয়েত-কমিউনিষ্ট-জমিদারি হারানি হিন্দুদের চক্রে বা পাল্লায় পড়েছে। পাকিস্তানের পুর্ব-পশ্চিমের বিভেদ বাড়বার পিছ্নে এগুলোও বড় ভুমিকা রেখেছিল। ইতোমধ্যে কাগমারি সম্মেলন (১৯৫৭ ফেব্রুয়ারি) এর তাতপর্য হল হক বা সোহরওয়ার্দীরা (মূলত  সোহরওয়ার্দীরা) প্রো-আমারিকান অবস্থান নিলেন আর প্রগতি-কমিউনিস্ট জমিদারপক্ষ যেটা আসলে সোভিয়েত পক্ষ। এই পক্ষ এবার আওয়ামি মুসলিম লীগ ছেড়ে ভাসানি ন্যাপ গড়ছেন। মূলত সোহরওয়ার্দীর জীবনে পশ্চিমের সাথে আমেরিকান মধ্যস্ততায় শেষ আপোষ করে প্রধানমন্ত্রী হওয়া এটাই ছিল ভাসানি ন্যাপ জন্মের ব্যাকগ্রাইন্ড, যদিও এর স্থায়ীত্ব মাত্র এক বছর। কারণ আয়ুব খান ক্ষমতা নিয়েছিলেন।

জিন্নাহর উর্দুকে রাষ্ট্রভাষাকে ভেঙ্গে দেখলেঃ
ওদিকে একটু যদি পিছনে ফিরি,অনেকে ১৯৪৮ সাল থেকেই উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা করা নিয়ে জিন্নাহর জবরদস্তিকে দুই পাকিস্তানের বিভেদের একটা বড় কারণ মনে করেন। এককথায় জিন্নাহ হয়ত ইতিবাচক ভেবেই জবরদস্তিটা করেছিলেন।

শেষবিচারে, জিন্নাহর পাকিস্তান রাষ্ট্র চিন্তাও কিন্তু একটা নেশন-স্টেট জাতিচিন্তা। ফলে মারাত্মক ভুল। কিন্তু এটাকেই ইতিবাচক মনে করা।  কিন্তু জিন্নাহ ভাষা ইস্যুটা মুলত জবরদস্তি বলে এটা তাঁর সিরিয়াস ভুল পদক্ষেপ। তার উচিত ছিল আপত্তিগুলো শুনে বুঝতে মনোযোগ দেয়া, এতে ভুল সংশোধনের সুযোগ হতেও পারত।

তবে আমরা নিশ্চিত থাকতে পারি নেশন-স্টেট কায়েম করার রাজনীতি যারা করেন এরই জাতি পরিচয়ের রাজনীতি এমনই ধরা খাবার সম্ভাবনা সবসময়, এখানে অথবা সেখানে। তাই পরিস্কারভাবে মনে রাখতে হবে এটা মুসলিম জাতিবাদি বা মুসলিম জাতিরাষ্ট্র কায়েম যারা চায় এটা কেবল তাঁদের ত্রুটিও নয়। এর ভাল উদাহরণ হল যেমন ভারতের নেহেরু আমরা অনেকেই জানি না যে ঠিক জিন্নাহর মত জবরদস্তিতে রাষ্ট্রভাষা করার সমস্যা তিনিও তৈরি করেছিলেন বা পড়েছিলেন। কারণ নেহেরুও ভেবেছিলেন সারাভারতের সবাইকে তিনিও এক জাতি করে গড়তে সবাইকে হিন্দি বলাবেনই ,শিখাবেনই; রাজকার্য বা রাজভাষা বানাবেনই। তাই স্কুলে হিন্দি শিখা বাধ্যতামূলক করেছিলেন। আর এখানেই ফলাফল খুবই নিম্নচাপ হয়েছিল। এতে পুরা দাক্ষিণার্ত মানে, ভারতের দক্ষিণের কর্ণাটক থেকে তামিলনারুসহ চার রাজ্য যারা অহিন্দিভাষী দ্রাবিড়ীয় প্রতিরোধ অঞ্চল তারা  হিন্দির বিরুদ্ধে ১৯৬২ সালে ব্যাপক আন্দোলন ও বিদ্রোহে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাবার হুকমি দিয়েছিল। কারণ অহিন্দিভাষী দ্রাবিড়ীয় প্রতিরোধ এটা ভারতীয় আদি ইতিহাসের আর্য আধিপত্য ঠেকানোর সবচেয়ে বড় প্রতিরোধ। সেই ঐতিহাসিক স্মৃতিতে লড়ে ১৯৬২-৬৬ এর লড়াই সেই থেকে তামিলনারুতে নিজেদের আঞ্চলিক দল ডিএমকে (দ্রাবিড়ীয় মুনেত্রা কাজাঘাম) গড়ে তুলেছিল। আর তারা ছাড়া কেউ আজও  তামিল প্রাদেশিক সরকারে ক্ষমতায় আসে নাই। সেই দুঃখে নেহেরু ১৯৬৪ সালে মারা যান। পরবর্তি প্রধানমন্ত্রী লাল বাহাদুরকে আপোষ করতে হয়েছিল আর সেই থেকে ভারতের কনষ্টিটিউশনে রাষ্ট্রভাষা বলে কিছুই নাই।। যদি সরকারি দাপ্তরিক ভাষা বলে আছে আর সেটা ইংরাজি। এটা মূলত জাতিরাষ্ট্র চিন্তার রাজনীতি যারা করেন,এমন একটা না একটা জাতিবাদী ‘পরিচয়ের’ রাজনীতি যারা করেন তাঁদের সমস্যা। ঠিক যেমন অন্যদিকে,  মুসলমান মাত্রই তাদেরকে একই আরবি ভাষা রপ্ত করানো বা আরবি কালচার রপ্ত করিয়ে এক পরিচয়ে আনতে হবে এমন পরিচয়ের রাজনীতি – এটাও একই “জাতি”  চিন্তাগত মারাত্মক ত্রুটি। তবে মূলকথা এটা পাকিস্তান বলে “উর্দুর” সমস্যা নয় একেবারেই। এটা হিন্দু কাশ্মীরি ব্রাক্ষ্মণ নেহেরুরও একই জাতি-রাষ্ট্র চিন্তা বা ত্রুটিপুর্ণ “পরিচয়ের রাজনীতি” খাড়া করার গভীর সমস্যা। বাংলাদেশেও এমন বাঙালি জাতিরাষ্ট্র কায়েমের জিদে আমাদেরকেও নতুন করে “পাহাড়ি সমস্যার” জন্ম দেওয়ার জালে ফাঁসতে হয়েছে।

এরপর তৃতীয় পর্বে একটা সামগ্রিক মুল্যায়ন আনব। তবে  “রেনেসাঁ কী” (যা এই দ্বিতীয় পর্বে খুবই সংক্ষেপে এনেছি) এনিয়ে একটা বিস্তারিত লেখা প্রায় শেষ করে রেখেছি। সেটা আলাদা পর্বে বা তৃতীয় পর্বের সাথে আনব।

গৌতম দাস
রাজনৈতিক বিশ্লেষক
goutamdas1958@hotmail.com

Leave a comment