ইসকনের মন পেতে দুদলের প্রতিযোগিতা আত্মবিলীনতা


  ইসকনের মন পেতে দুদলের প্রতিযোগিতা আত্মবিলীনতা

গৌতম দাস

০১ নভেম্ববর ২০২১, ০০:০৬ সোমবার

https://wp.me/p1sCvy-3MV

 

আ.লীগ কি আওয়ামী মুসলিম লীগের দিকে যাচ্ছে— প্রশ্ন রানা দাশগুপ্তের

গত বৃহস্পতিবার ২৮ অক্টোবর   চট্টগ্রামে ইসকনের এক জনসমাবেশ হয়েছে। পরদিনের প্রথম আলোর রিপোর্ট অনুসারে এ সমাবেশের আয়োজকদের সম্পর্কে লেখা হয়েছে- “বৃহস্পতিবার দুপুরে চট্টগ্রামের নন্দনকানন চত্বরে আন্তর্জাতিক কৃষ্ণভাবনামৃত সংঘ (ইসকন) চট্টগ্রাম বিভাগীয় কমিটি আয়োজিত এক সমাবেশ হয়েছে”।

‘ইসকন’ [ISCKON] ১৯৬৬ সালে আমেরিকায় রেজিস্টার্ড এক হিন্দুধর্মীয় প্রতিষ্ঠান, যা ‘কৃষ্ণনাম চর্চার এক বিশেষ ব্যাখ্যা’ প্রচারের সংগঠন হিসেবে যাত্রা শুরু করেছিল। কিন্তু তা সত্বেও চলতি শতকে এসে আমেরিকান সংসদে ও সিনেটে ভারত সরকারের পক্ষে আমেরিকান নীতি পলিসিকে প্রভাবিত বা লবি[lobby] করতে ভারত আমেরিকায় যেসব প্রতিষ্ঠান ও ব্যক্তির মিলিত এক নেটওয়ার্ক গড়ে তুলেছিল, ক্রমেই ইসকনও তার অংশ হয়ে যায়। এর নিট ফলাফল হল ইসকন আর নেহায়েতই ধর্মপ্রচারের সংগঠন থাকেনি। এর ফোকাস বদলে রাজনৈতিক সংগঠন হয়ে যায়।

       চট্টগ্রামে সম্প্রীতি পুনরুদ্ধার সমাবেশ

আমেরিকা হল এমন সমাজ যেখানে বহু বছর আগে থেকেই মানুষের জীবনে থিওলজি [theology] মানে ধর্ম বা ধর্মতত্বের আর প্রয়োজন নেই; মানুষের থিওলজিক্যাল নিড বা ধর্ম-বিষয়ক কোন চাহিদা আর নেই – এমন মনে করা, রটিয়ে বা  ঘোষণা করে দেয়া এক সমাজ। এই অনুমান-ধারণাটা যে ভিত্তিহীন এবং যথেষ্ট ভেবেচিন্তা বলা ভাষ্য নয় এরই প্রমাণ হল সেকালের জন্মের শুরুতে ইসকনের টিকে যাওয়া। যেকোন থিওলজির সারকথাটা  হল এটা এক আন্তঃসম্পর্ক বোধ, যা আমাদের ভেতরে এক ‘সম্পর্কিত’ বা  কানেকটেড বোধ জাগিয়ে দেয় বা রাখে। আমার যায় আসে আমাকে টানে, এমন একটা টান-বোধ করা কাজ করে টের পাই। সে আন্তঃসম্পর্ক বলতে তা হতে পারে মানুষে-মানুষে অথবা প্রকৃতির (মানুষ বাদে) সব কিছুর সাথে মানুষের আন্তঃসম্পর্ক বোধ। আর এসব যেকোনো দুইয়ের সম্পর্কের মাঝে থাকে ‘আল্লাহ’ ধরনের এক ধারণা যার মাধ্যমে মধ্যস্থতায় আসলে আমরা সবাই সব কিছুর সাথে কানেকটেড বা সম্পর্কিত বোধ করতে থাকি। এতে মানুষের বেঁচে থাকাটা মিনিংফুল এবং উদ্দেশ্যসম্মত মনে হতে থাকে। কিন্তু মডার্নিটির সস্তা বা দায়দায়িত্বহীন ব্যাখ্যার কারণে নিজেরা থিওলজিক্যাল নিড শূন্য ঘোষণা করে দেয়াতে পশ্চিম নিজের ক্ষতি করে ফেলেছে; অথচ বাস্তবে মানুষমাত্রই কম-বেশি একটি থিওলজিক্যাল চাহিদা থেকেই যায়। আমেরিকান সমাজের থিওলজিক্যাল নিড নাই, দীর্ঘদিন ধরে জেঁকে বসা এই ধারণা  এতে তৈরি হওয়া যে শুণ্যতা বা গ্যাপটা পূরণ করতেই এশিয়ান থিওলজিগুলোর অনেকেই পশ্চিমে এসে পপুলারিটি পেয়ে যায়। কারণ মানুষ মাত্রই তার থিওলজিক্যাল নিড থাকে থাকবেই। কম অথবা বেশি; জীবনের শুরু থেকেই নয়ত শেষের দিকে, তরুণ জোঁসে নয়ত অবসর জীবনে – এসব খুবই স্বাভাবিক ঘটনা। এছাড়া বুঝা যায় আরো বহু যূগ থিওলজিক্যাল নিড থাকবে। ফর্ম বা আকারে হয়ত বদল আসবে।  বহুবার দেখা গিয়েছে মানুষ মারাত্মক আত্মঘাতি ভুল করেছে, তাঁর জানা জ্ঞান কোনটাই তাকে সতর্ক বা সাহায্য করে নাই।  পরে আবার থিওলজি থেকে, পড়তে গিয়ে বুঝছে তাকে সাবধান করা হয়েছিল কিন্তু সে বুঝে নাই, মোল্লাদের কারবার বলে তুচ্ছ করে গেছিল। আবার সাথে বলে রাখা ভাল যে তাই বলে জীবনের বস্তুগত দিকটাও উদাসিন, নজর আন্দাজ বা বেখেয়ালি হওয়া বা থাকাটাও সমান বিপদের হবে।
যা হোক আমেরিকার সমাজের থিওলজিক্যাল গ্যাপ আছে-ছিল বলেই  ইসকন আমেরিকায় হবার  প্রথম দিকে এ সূত্রেই ‘জায়গা’ করে নিতে না পেয়ে গিয়েছিল। কিন্তু পরে ভারতের লবি প্রতিষ্ঠানগুলোর জোটের অংশ হয়ে যাওয়াতে ইসকনের ফোকাস সরে গেছে। এমনকি নেতৃত্বও বদলে যায়, পরিচালন ক্ষমতায় এমন এক ক্যু হয়ে গিয়েছিল। যারা ভারত সরকারের পক্ষে সরাসরি কাজ করতে চায় ইসকন সংগঠনের এই ধারা প্রতিষ্ঠানের কর্তৃত্ব নিয়ে নেয়। এতে আগের ধর্মপ্রচারের উছিলায় আমেরিকায় জন্মানো এশিয়ান থিওলজির প্রতিষ্ঠানটা এবার হয় ঘোরতর এক রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান। বিশেষত ভারত সরকারের বর্ধিত হাতের ভুমিকায় তার গোয়েন্দা সংস্থার পক্ষে কাজ করার প্রতিষ্ঠান হয়ে দাঁড়ায়। বর্তমানে বাংলাদেশ ইসকন হল বাংলাদেশের হিন্দুদের সাথে ও কাছে ভারত সরকার ও তার গোয়েন্দা সংস্থার যোগাযোগ ঘটিয়ে দেয়ার বা পৌঁছানোর হাতিয়ার। ইসকন এখন বাংলাদেশের রাষ্ট্রবিরোধী এক সংগঠন; যদিও পরিকল্পিতভাবেই ইসকনের আগের ধর্মীয় ভাব ও এর বাইরের আদল সবই বজায় রেখে দেয়া হয়েছে। আর ওদিকে এই নয়া ইসকন এখন ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থা ও বিদেশে নাশকতা ও অপতৎপরতার সংগঠন ‘র’-এর বর্ধিত হাত হয়ে নিজেকে সাজিয়ে হাজির করতে থাকে।

শুধু তা-ই নয়, এতে অবস্থা এখন এমনই যে, একালের আরএসএস-মোদির যুগে বাংলাদেশের ইসকনের তৎপরতায় বাংলাদেশের হিন্দুরা যেন কালচারালি আর বাঙালি হিন্দু নয়; তারা যেন আরএসএসের যে উত্তর প্রদেশের হিন্দু ব্যাখ্যা আছে – তার অনুসারী করে নেয়ার এক প্রোগ্রাম। এটাই ইসকনের প্রধান কর্মসূচি এবং তা নিশ্চিত করাই এর কাজ। যেমন বাঙালি হিন্দুকে উত্তর প্রদেশের হিন্দুর স্টাইলে নিরামিশাষী হতে শেখাচ্ছে তারা, ইসকন মার্কা কৃষ্ণভক্ত হওয়ার নামে। অথচ এথনোলজিক্যাল [ethnological] জাতির বিচারে এটা  প্রতিষ্ঠিত যে  বাঙালির খাদ্যাভ্যাস হল সে আমিষ-ভোজী। আর সেখান থেকেই প্রবাদ তারা ‘মাছে-ভাতে বাঙালি’। সেও হিন্দু অবশ্যই কিন্তু উত্তরপ্রদেশের মত এথনিক প্রজাতি্তে এক নয়। মানে এরা নিরামিষের লোক নয়। সোজা কথায় এথনোলজির বিচারে আমরা বাঙালি হিন্দু, উত্তর প্রদেশের আর্য অনুসারী হিন্দু নই। এই পুরান কাহিনী হিসাবে আর্যদের ভারত দখল অভিযানে দুটো অংশে গিয়ে তাদের অভিযান আর আগে বাড়তে পারে নাও, মূলত প্রাকৃতিক গাহাড় বা নদীর কারণে। এক হল ভারতের দক্ষিণে যেখান থেকে ভারতের দাক্ষিণার্ত-এর শুরু ধরা হয় – অন্ধ্র-হায়দ্রাবাদের কিছু অংশ থেকে দক্ষিণের পুরাটাই। আর এদিকে ভারতের পুবদিকে মারাঠা-বিহার পেরিয়ে বাংলায় প্তবেশের পরে পরেই। ভাষার স্টাইল, খাদ্যাভাস, দেবদেবীর ভিন্নতা এমন কী আর্টকালচার গানের সুর-রাগ, বাদ্যযন্ত্র ইত্যাদি অনেক কিছুতেই এথনিক ভিন্নতাগুলো বেঁচে যায় টিকে যায়।
অথচ বাংলাদেশে ইসকন এসেছে পুরো উল্টা-পাল্টা হয়ে, আরএসএস-হিন্দুর প্রতিনিধি হয়ে।  তারা বাংলাদেশে এসেছে হিন্দু বাঙালি  সবাইকে আরএসএস বর্ণিত হিন্দু সাজাতে। পশ্চিমবঙ্গের গত নির্বাচনে মমতা (হিন্দু-মুসলমান) বাঙালি বনাম আরএসএসের হিন্দু এই প্রশ্ন তুলে নির্বাচনের জয় নিজের পক্ষে এনে মোদিকে ঠেকিয়েছিল।
আর এসব কারণের বাংলাদেশে ইসকন আবার এদিকে, হিন্দু বাঙালিকে বাইরে থেকে দেখে চেনার উপায় চিহ্ন হিসেবে গলায় ‘কাঠের মালা’ পরাচ্ছে। অথচ ফ্যাক্টস হল, গলায় কাঠের মালা মূলত যারা নদীয়ার গৌড় বা বৈষ্ণব অনুসারী তাদের রেওয়াজ; এবং সবচেয়ে বড় কথা, বাঙালি হিন্দু মাত্রই সবাই নদীয়ার শ্রীচৈতন্যের অনুসারী বা বৈষ্ণব নয়। অর্থাৎ বাঙালি হিন্দু মাত্রই গলায় কাঠের মালা পরা তাদের রেওয়াজ নয়। অথচ ইসকনের আরএসএসের হিন্দু হল, তারা এটিকে এক ইউনিফর্ম ধারণায় (গলায় কাঠের মালা) সাজিয়ে নিতে চায়। তাই হিন্দু বাঙালি মাত্রই ইউনিফর্মের মতো সবাইকে কাঠের মালা পরার রেওয়াজে নিতে চায়; অর্থাৎ পুরোটাই রাজনৈতিক ও ভিন দেশের অসৎ রাজনৈতিক স্বার্থ তারা চাপিয়ে রাজত্ব করতে চায়। মূলত এর মূল উদ্দেশ্য হল আরএসএসের উত্তর প্রদেশকেন্দ্রিক যে হিন্দুত্ববাদী ব্যাখ্যা আছে, বাংলাদেশের হিন্দুদেরও বলপ্রয়োগ করে হলেও এর অংশ করে নেয়া – তাও খাঁটি রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে।

কাজেই আরেক অর্থে বাংলাদেশে ইসকন হয়ে উঠেছে ‘র’-এর “ফুট সোলজার”; মোদি সরকারের ‘বাংলাদেশ দখল নীতি’ বাস্তবায়নের ভয়ঙ্কর হাতিয়ার। স্বাধীন দেশে এটা বাংলাদেশের কোনো নাগরিকের কাছ থেকে ‘আশা’ করা যায় না। বাংলাদেশের কোনো নাগরিক মোদির নীতির বাস্তবায়ক হতে পারেন না। কারো প্রভাবহীন নয় ও স্বাধীন থাকতে চাইলে বাংলাদেশ সরকারও এসব দিকে কোন নাগরিককে কোন ছাড় দিতে পারে না; উলটা সরকারকে এসব দমন করতেই হবে। এটা তার কনষ্টিটিউশনাল নাগরিক নিরাপত্তা নিশ্চিতের দায়ীত্ব ও মুখ্য কাজ।  এটা রাষ্ট্রস্বার্থের গুরুতর প্রশ্ন।

এসবের পটভুমিতে এটা হতবাক করার বিষয় যে, গত ২৮ অক্টোবর সেই ইসকন চট্টগ্রামে জনসমাবেশ ডেকেছে আর তাতে যোগ দিতে আওয়ামী লীগ ও বিএনপির মধ্যে লেগেছে প্রতিযোগিতা যে, কে বেশি ইসকনের সুনজর ও অনুগ্রহ লাভ করবে! এর প্রতীকী অর্থও খুবই বিপদের ও লজ্জাজনক! অর্থাৎ কে বেশি ভারতের অনুগ্রহ লাভ করবে? আর তাতে আওয়ামী লীগ যদি ১৩ বছরের শাসন চালাতে পারে তবে বিএনপির ভাগ্যেও নিশ্চয় এর কাছাকাছিই কিছু একটা হবে! এমন অনুমান, তাই কি? ওদিকে মিডিয়া রিপোর্টের এনিয়ে ইঙ্গিতে উপস্থাপনটাই মারাত্মক। লিখেছে, ‘সমাবেশে চট্টগ্রামের উত্তর-দক্ষিণ, নগর আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতাদের পাশাপাশি নগর বিএনপির নেতারা উপস্থিত ছিলেন”। কিন্তু মজার কথা হল, ওখানে বিএনপির কেবল একটি নেতার নাম আছে। অথচ আওয়ামী লীগের সবচেয়ে ছোট নেতাটার নামও সেখানে দেয়া আছে। আর ভোরের কাগজ লিখেছে, “নগর বিএনপির আহ্বায়ক ডা: শাহাদাত হোসেন” সেখানে বক্তৃতা করেন।

সাম্প্রদায়িক হামলা নয়, এটা ষড়যন্ত্র’
গুগল সার্চে প্রকাশিত মিডিয়া রিপোর্টগুলোতে দেখা যায় “সাম্প্রদায়িক হামলা নয়, পরিকল্পিত ষড়যন্ত্র: “ এমন বক্তব্যে সবচেয়ে বেশি রেফারড হয়েছেন আইনমন্ত্রী। আর ভারতের কিছু মিডিয়ায় দেখা গেছে একই বক্তব্য দিয়েছেন বলে কোট করা হয়েছে খোদ আমাদের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীও। এমনকি গতকাল পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেছেন, ‘ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের মৃত্যু ও ধর্ষণের নানা গল্প ছড়ানো হচ্ছে।’ অর্থাৎ সরকারের বিরুদ্ধে পরিকল্পিত প্রপাগান্ডা মানে ষড়যন্ত্র হচ্ছে বলে দাবি। অথচ এরপরও চট্টগ্রামের সমাবেশের নাম হল – ‘সাম্প্রদায়িক হামলার প্রতিবাদে’ এই সমাবেশ। কেউ সরছেনা; প্রচলিত শব্দ ‘সাম্প্রদায়িক হামলা’ কথাটা দিয়েই সব জায়গায় কুমিল্লার ঘটনাকে বর্ণনা করা হচ্ছে। অথচ ইকবাল হোসেন গং তারা এখনো রিমান্ডে আর তাদের পেছনে কে আছে? নিয়োগ বা অ্যাসাইনমেন্ট দাতা কারা? ‘র’ না ‘ইসকন’ না থার্ড কেউ? এখনো তা পরিষ্কার নয়। কিন্তু এই অংশটা ঢেকে দেয়ার প্রপাগান্ডা চলছেই! ইকবাল হোসেনেই যেন সবশেষ খোঁজাখুজি শেষ ধরা হয়, এর পিছনে আর কেউ নাই; ভারতীয় মিডিয়ায় এমন  আকাঙ্খাই প্রবল!

এদিকে চট্টগ্রামে ইসকনের সমাবেশে প্রধান গুরুত্ব পায় দু’জন হিন্দু-ব্যক্তিত্বের বক্তব্য। এর প্রথমজন রানা দাসগুপ্ত, তিনি হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রিষ্টান ঐক্যপরিষদের সাধারণ সম্পাদক। তাদের দেয়া ‘সাম্প্রদায়িক’ শব্দের বর্ণনা অনুযায়ী কি খোদ রানা দাসগুপ্তের সংগঠনের নামটাই তাদের কথিত ‘সাম্প্রদায়িক’ নয় কি? আর দ্বিতীয় ব্যক্তিত্বের নাম ডঃ অনুপম সেন।

আবার লক্ষণীয়, ওই সমাবেশে সবচেয়ে বেশি সমালোচনা ও আক্রমণের মুখে পড়েছে আওয়ামী লীগ। সময়ে মনে হয়েছে কেউ কেউ আওয়ামী লীগের বিকল্প এবার পেয়ে গেছে। যেন এবার তারা বিএনপিকে ক্ষমতায় আনবে। রানা দাসগুপ্ত বলেছেন, ‘প্রধানমন্ত্রী ছাড়া কোনো রাজনীতিবিদের ওপর আমাদের আস্থা নেই। আমরা সরকারি দলের মধ্যে আত্মশুদ্ধি চাই”। কেউ কেউ এই দ্বিতীয় বাক্যটাকেই মিডিয়ায় শিরোনাম করেছে। কিন্তু রানা দাসগুপ্তের বক্তব্য স্ববিরোধী।
রানা দাসগুপ্তই কড়া অভিযোগগুলো তুলেছেন। এমনকি এটাও বলেছেন, ভোরের কাগজ লিখেছে, ‘আওয়ামী লীগ ক্রমেই ১৯৪৮ সালের আওয়ামী মুসলিম লীগের দিকে চলে যাচ্ছে”।  এর জবাব আওয়ামি লীগ কী দেয় আমরা দেখব।  তবে এটা বহু পুরনো দিন থেকেই মুসলিম লীগ নিয়ে হিন্দু নেতাদের অভিযোগের শেষ নেই। এসব অভিযোগ, রাগ বা ক্ষোভের আদি উৎস হল – ভারত ভাগ করে পাকিস্তান কেন করা হল।  কারণ এতে পুর্ববঙ্গেও   হিন্দু জমিদারদের যে পলিটিক্যাল, কালচারাল ও সামাজিক ধরণের আধিপত্য ছিল তা এক নিমিষেই নাই হয়ে  গিয়েছিল। তাই একালে যদি জিজ্ঞাসা করা যায় তারা এখন কী চায় আর যদি তারা মনে্র কথা খুলে বলতে রাজি হয় তাহলে সম্ভবত এর জবাব আসবে তারা সেই পুরানা আধিপত্যটাই ফেরত চায়। এমনকি একালের প্রজন্ম যারা তারাও ঘুরেফিরে একালের ভারত না হলেও কলকাতাকে যেভাবে দেখে জানে তেমন একটা পলিটিক্যাল যদি নাও হয় তবে অন্তত একই কালচারাল ও সামাজিক ধরণের আধিপত্য দেখতে চাইবে। কিন্তু খুবই দুঃখিত এটা এবসার্ড, এক অবাস্তব কল্পনা!   আবার আমরা খেয়াল করলে জানব  যদিও খোদ শেখ মুজিবও এর নিন্দা করেননি বা নিজে মুসলিম লীগার ছিলেন বলে কখনো অস্বীকার করেননি। এমনকি হাসিনা শেখ মুজিবের আত্মজীবনী প্রকাশ করেছেন তাকে মুসলিম লীগার হিসেবেই বর্ণনা বজায় রেখে এবং কোনো রাখঢাক না করেই। কিন্তু “মুসলীম লীগ” শব্দটা হিন্দু নেতাদের কাছে একটা গভীর পাপের নাম।

অথচ ভারতের কংগ্রেস যেমন এক হিন্দু-জাতিবাদী দল; সমতুল্যভাবে (পূর্ব) পাকিস্তানে মুসলিম লীগ মুসলমান-জাতিবাদী দল।  বাংলাদেশের হিন্দু নেতারা কংগ্রেসের চোখ দিয়ে কংগ্রেস যেমন মুসলিম লীগকে তার মুখ্য প্রতিদ্বন্দ্বি-শত্রু  দল হিসেবে দেখে, সেভাবে ঐ চোখেই তারা দেখে গেছে। অথচ কংগ্রেসের দৃষ্টিভঙ্গি ও রাজনীতি কোনো সর্বজনীন স্ট্যান্ডার্ড নয়, কারণ এটা তো হিন্দু-জাতিবাদী চোখ। বরং কোন সর্বজনীন, কোন সুনিদ্দিষ্ট পরিচয়হীন দৃষ্টিভঙ্গীর এক অবিভক্ত ভারতের কল্পনা করতে না পারার অযোগ্যতা আর ব্যর্থতা থেকেই তো তিনদেশে বিভক্ত হয়েও তো আমরা আজও মূল প্রশ্ন সমাধান করতে পারি নাই, হাতড়ে মরতেছি। য়ার এমনিতেই  পূর্ব পাকিস্তান বা বাংলাদেশ ভারতের ওই দৃষ্টিভঙ্গি কখনো গ্রহণ করেনি, করার কথাও না। কারণ মূল ত্রুটি ওটা হিন্দু-জাতিবাদী বা যা এই শতক থেকে আরো হিন্দুত্ববাদী দৃষ্টিভঙ্গী।  অথচ রানা দাসগুপ্তরা অযথা এই পণ্ডশ্রম করে গেছেন। এখানেও করেছেন। কংগ্রেস বা একালের বিজেপি তাদের হিন্দুত্ববাদীর চোখ দিয়ে তারা আগের পূর্ব পাকিস্তান বা এখনকার বাংলাদেশকে দেখতে হবে এবং সাজানোর দাবি করতে হবে এই অদ্ভুত কল্পনা তারা করে গেছেন।  হিন্দু-জাতিবাদী ভারত বা যা এই শতক থেকে আরো হিন্দুত্ববাদী  ভারত এটাই এখনও তাদের চোখে সেকুলার রাষ্ট্রের মডেল। তাদের কল্পনা শুধু না দাবিও যে বাংলাদেশকে তাদের কল্পনা মত হিন্দু-জাতিবাদী বা হিন্দুত্ববাদী “কথিত সেকুলার রাষ্ট্র” করে গড়ে দিতে হবে।  নইলে ‘সাম্প্রদায়িক’ বলে ট্যাগ লাগিয়ে দেবে।
অবশ্য এখানে আরেক  সূক্ষ্ম দিক আছে। লক্ষণীয়, আসলে রানা দাসগুপ্ত কিন্তু “মুসলিম লীগ” বলেনইনি। বলেছেন ‘আওয়ামী মুসলিম লীগ’। দুটার অর্থ একেবারেই উলটা। অর্থাৎ যেটা আওয়ামী লীগেরই আগের নাম বা প্রথম জন্মকালীন নাম সেটাসি ছিল আওয়ামী মুসলিম লীগ। মানে আজকের হাসিনা আওয়ামি লীগের  আগে “আওয়ামী মুসলিম লীগ” নামেই জন্ম নিয়েছিল ১৯৪৯ সালে ২৩ জুন। সবচেয়ে বড় কথা তারা পাকিস্তান মুসলিম লীগ ত্যাগ করে বেড়িয়ে এসেই নতুন এইদল খুলেছিলেন।  তা হলে আওয়ামী মুসলিম লীগের দিকে যাওয়া বলতে তিনি আজকের হাসিনা আওয়ামী লীগের জন্ম হওয়াটাই দোষ বলছেন যেন। এককথায় মুসলিম লীগের উলটা এবং শত্রুদল হল আওয়ামী মুসলিম লীগ। তাহলে রানা দাসগুপ্ত এতে আপত্তির দেখছেন কী বা তার বিশেষ অভিযোগটা কী? আসলে  পুরোটাই ভুয়া।  রানা দাসগুপ্ত কি তাহলে ভাসানী-শামসুল হকের ১৯৪৯ সালের আওয়ামী মুসলিম লীগের গায়ে হিন্দু-জাতিবাদী কংগ্রেসের চোখে তাকিয়ে দাগ লাগিয়ে দিতে চাইছেন? নাকি কিছু ভেবেচিন্তে বলেননি?

আসলে ব্যাপারটা হলো, কংগ্রেস যদি হিন্দু-জাতিরাষ্ট্রের প্রবক্তা ও কায়েমকারী হয় তা হলে এই দলের বা সমর্থকের কি আর মুসলিম লীগকে বিরোধিতা বা নিন্দা করার সুযোগ থাকে?  কেন? কারণ কংগ্রেসই কি মুসলিম-জাতিরাষ্ট্রের জনক নয়? সেটা আবার কীভাবে? তাদের হিন্দু জাতিরাষ্ট্র গড়তে বেপরোয়া হওয়াটাই কি অবিভক্ত ভারতের মুসলমানদের মুসলিম-জাতিরাষ্ট্র গড়তে ঠেলে দেওয়া, বাধ্য করা ও উৎসাহ দেয়া নয়? অর্থাৎ হিন্দু-জাতিবাদী দল খাড়া করে একটা  কংগ্রেস দলের জন্মই কী সমস্ত বিপর্যয় ডেকে আনার মূল প্রতিষ্ঠান ছিল না বা ঘটনা নয়? ভারতকে কংগ্রেস যদি হিন্দু-জাতিরাষ্ট্র করে আকার দিতে চায়, তবে এটাই কি প্রকারান্তরে মুসলমানদের ঠেলে দেয়া নয় যে, মুসলমানেরা তোমরা শুনে রাখ – ভারত বা কংগ্রেসে তোমাদের জায়গা নেই তাই তোমরা একটি পাল্টা মুসলিম-জাতিরাষ্ট্র গড়ে নাও? নইলে আমাদের তৈরি ভারত বা কংগ্রেসে আমাদের আধিপত্য ও অধীনতা মেনে চেপে গিয়ে কোনার চিপায় পড়ে থাকতে পারো। কাজেই এই অবস্থায় অতএব – হিন্দু-জাতিরাষ্ট্রধারী কংগ্রেসের মুসলিম লীগকে কোনো সমালোচনা বা আপত্তির জায়গা কই? করলে সেটা তো তাদের নিজেরই সমালোচনা হবে!

আবার দেখেন,  মনে হচ্ছে সূর্য সেনদের রাজনীতি রানা দাসগুপ্ত এখনো করে যাচ্ছেন। কলকাতাকেন্দ্রিক অবিভক্ত বাংলার জমিদাররা ১৯০০ সালের পরেও আগের শতবছরের (১৮০০-১৯০০) রামরাজত্ব  তাদের পুরানা সব ক্ষমতা ও প্রভাব কলকাতাকে কেন্দ্র করে ধরে রাখতে চান। আবার এ-ও আবদার যে, ততদিনে ব্রিটিশদের প্রায় দেড়শ বছরের সব অবকাঠামোগত ব্যয় সব কলকাতাতেই হোক, থেকে যাক। কিন্তু ব্রিটিশরা তা মানেনি, সম্ভব ছিল না। তারা বাংলাকে ভাগ করে ঢাকাকে রাজধানী করে আলাদা নতুন অবকাঠামো গড়তে ব্যয় করতে চেয়েছিল। কেন? মূল কারণ ততদিনে আসাম চা উৎপাদন যোগ্যতার জন্য তৈরি ও সম্পন্ন হয়ে গেছিল। অথচ চা বিক্রি, বিতরণের জন্য সেই চা চট্টগ্রাম বন্দরে নিয়ে যেতে ঢাকা পেরিয়ে নারায়ণগঞ্জে ছোট জাহাজে তুলে তা চট্টগ্রাম বন্দ্রের উদ্দেশ্যে নিবার কোনো অবকাঠামোই ছিল না। না আসাম থেকে ঢাকা হয়ে নারায়নগঞ্জ পর্যন্ত। এ’কারণে ঢাকাকে রাজধানী করে আসাম ও পূর্ববঙ্গকে নিয়ে আলাদা প্রদেশ করা হয়েছিল ১৯০৫ সালে। এটাই ‘বঙ্গভঙ্গ’।  মানে  ঢাকাকে কেন্দ্র করে আরেক বাংলা প্রদেশ বানানো।  আর এটাই সহ্য হয়নি কলকাতাকেন্দ্রিক হিন্দু জমিদারদের, চ্যালেঞ্জ বোধ করেছিলেন যে, ঢাকা তো তাহলে কলকাতার প্রতিদ্বন্দ্বি হয়ে যাবে তাতে। সক্ষমতাতেও ছাড়িয়ে যেতে পারে। কারণ এখানে বাণিজ্যিক দিক এখানে ভারী – চায়ের সাথে পাটও আছে; আর বিস্তীর্ণ ধানের জমিতো আছেই। যার উপর আসামের লোভ ছিল। কারণ পুর্ববঙ্গ এব্যাপারে আসামের চেয়ে এগিয়ে ও দক্ষ। এসব ছাড়াও আরো দিক আছে। পূর্ববঙ্গে জনসংখ্যার দিক থেকে মুসলমানরা বেশি, সংখ্যাগরিষ্ট; ফলে কলকাতার ম একচেটিয়া কুক্ষিগত প্রভাব  হিন্দু জমিদারেরা ঢাকায় সামাজিক সাপোর্ট সমর্থনে  জমাতে নাও পারতে পারেন। এসবই ছিল হিন্দু জমিদারদের মূল ভীতি। আর এসব স্বার্থে তারা নতুন প্রদেশ করতে বঙ্গভঙ্গের বিরোধিতা শুরু করেছিলেন। এবং এনিয়ে তারা এত মরণপণ সিরিয়াস হন যে যে জমিদারেরা একশ বছরে বৃটিশদের সমর্থন ও ঔরসে  জমিদারি কামাইলেন অবিভক্ত বাংলার একছত্র নেতা হলেন যেই বৃটিশদের বদৌলতে সেই বৃটিশদের তারা অস্ত্র হাতে বিরোধীতার করতে লোক নিয়োগ ও সন্ত্রাসী দল গড়ে  শাসকদের বিরোধিতা করেছিলেন। তা হলে সূর্য সেনরা ছিল মূলত হিন্দু জমিদারদের স্বার্থে কাজ করেন এবং সবচেয়ে বড় কথা, চট্টগ্রামের লোক হয়েও সূর্য সেনরা নিজ পূর্ববঙ্গের স্বার্থের বিরোধী। কলকাতাকেন্দ্রিক হিন্দু জমিদারদের লেঠেল। আর তারা জমিদার স্বার্থের পক্ষে দাঁড়ানো লোক হলেন। পূর্ববঙ্গের বা, বাংলাদেশের কেউ হতে পারেন না। বরং সরাসরি কলকাতার হিন্দু জমিদারের পক্ষের লোক। কাজেই পূর্ববঙ্গের চোখে তারা কোনো বীর নন,  না হতেই পারেন না।  বরং পূর্ববঙ্গের বা ঢাকার স্বার্থের বিরোধী।  মানে চট্টগ্রামের লোক হয়ে ঢাকার কথা ভুলে মাড়িয়ে কলকাতার পক্ষে অস্ত্র হাতে মাকালীর নাম নিয়ে দাড়িয়ে গেলেন। কাজেই আপনারা নাকি কথিত স্বদেশী এটা কাদের আন্দোলন? কোন স্বদেশ? কলকাতার এবং হিন্দু জমিদারদের জন্য স্বদেশী!  কিন্তু দেখা যাচ্ছে এটা তো পূর্ববঙ্গের কোন স্বার্থই নয়। অথচ জবরদস্তিতে কলকাতা বা কংগ্রেসের স্বার্থটা বারবার আমাদের ওপর চাপিয়ে দেয়ার চেষ্টা করা হচ্ছে এখনও।

দেখা যাচ্ছে, এখনো কংগ্রেসের স্বার্থ ও অবস্থানের চিন্তাটাই রানাদের মাথায় সবসময় ভর ও ডমিনেট করে এবং গাইড করে থাকে। ফলাফলে হিন্দু জমিদার স্বার্থ তাদের চোখে হয়ে যায় কথিত অসাম্প্রদায়িক আর কেউ এর বিরোধিতা করলেই হয় ‘সাম্প্রদায়িকতা’। এই মুখস্থ কথা আর কত দিন?

একালে কিছু হলেই আরেক বক্তব্য হল রাষ্ট্রধর্ম বলে ইসলামের বিরোধিতা। আচ্ছা,  আজ পর্যন্ত বাংলাদেশের আদালতে কোনো হিন্দু নাগরিক কী মামলায় হেরে গেছে এজন্য যে, আদালত তাকে এক মুসলমান নাগরিকের মতই সমতুল্য ও  সমান অধিকারের সাথে সমান অধিকারের ট্রিটেড হননি বলে এবং শুধু তাই না  সেটা ইসলাম রাষ্ট্রধর্ম হওয়ার কারণে এবং এমনটা চালু হবার পর থেকে? এমন রেকর্ড কোথাও আছে কি?

অর্থাৎ আদালত  অধিকার ও ট্রিটমেন্টে এর দিক থেকে কখনও নাগরিক বৈষম্য করে নাই, কোনো অসাম্য হয়নি। তবে ডেকোরেটেড পিস হিসেবে  রাষ্ট্রধর্ম শব্দগুলো অবশ্যই আছে। যা না থাকলে ভাল হত। অর্থাৎ এটা একটি জেদ-ক্ষোভের  সিম্বল। ফলে একটু ভেদের সিম্বলও অবশ্যই। কিন্তু তা-ই-বা কেন থাকবে? কারণ ইন্দিরা গান্ধী প্রগতিশীলতার নামে, অসাম্প্রদায়িকতার নামে হিন্দুত্ববাদী রাষ্ট্রচিন্তায় কল্পিত এক অর্থহীন ‘সেকুলার’ শব্দ ও ধারণা আমাদের উপর চাপিয়ে দিয়েছিলেন। এবং বুঝা যাচ্ছিল কারণ তখন তিনি  একাত্তরের শেষের দিকে সম্ভবত অক্টোবরে পাঁচবার আমাদেরকে স্বীকৃতির অনুরোধের ফাইল ঘুরাচ্ছিলেন।  পরে আমাদেরকে পরোক্ষে জানানো হয় এটা না মানলে আমাদের অনেক ভোগান্তি হবে।  ফলে এতে আবার সেই ইসলামবিদ্বেষ ফোবিয়া হিন্দু-জাতিবোধের চিন্তা ও  ডোমিনেন্স যা ভারতে গড়ে উঠেছে তাই আমাদের উপর চাপিয়ে দেয়া হয়েছিল। এটাই তো ইসলামবিদ্বেষ। যেন তাজউদ্দিন সাহেব যত নিজেকে ইন্দিরা গান্ধীর সামনে নিজেকে বাঙালি বলে পরিচয় করান না কেন, ইন্দিরা ভুলতেই পারছিলেন না যে তাজুদ্দিন তো আসলে মুসলমান!  তাই তিনি যেন “সেকুলার” সাবধানতার জোরাজুরি্তে তাজুদ্দিনকে বলতে চাচ্ছিলেন তাজউদ্দিন তুমি মুসলমান নও, তুমি সেকুলার……।
আবার সেকুলার মানে কী তা তো তিনি ইন্দিরা বা আজকের রাজনৈতিক ভারত জানে  এর প্রমাণ তাদের রচিত কনষ্টিটিউশনে আজও নাই। তাদের ধারণা একটা হিন্দু-জাতিবাদী বা হিন্দুত্ববাদী রাষ্ট্রচিন্তা ভিত্তিক রাষ্ট্রে কোন সমস্যাই নাই। কেবল “আমাদের নীতি সেকুলারিজম” একথা ঢুকিয়ে দিলেই রাষ্ট্র সেকুলার হয়ে যায়!
অথচ বাংলাদেশে আমরা তো সবাই হিন্দুও নই। আমরা সেসময় ছিলাম রাজনৈতিকভাবে “বাঙালি জাতিবাদী”। ফলে ফেলে আসা জমিদার আধিপত্যের ইমেজ আমাদের ক্ষুব্ধ আশংকিত করবে এটাই স্বাভাবিক। আমাদের নতুন বাংলাদেশ বলে কী হচ্ছে এনিয়ে সন্দেহ করবে। জনমনের মনে আবার  সাতচল্ভেলিশের আগের জমিদারি অত্যাচারের ছবি ভেসে  উঠবে  চালু হবে।  এসব ভেবেও   আমাদেরকে সব মেনে নিতে হয়েছিল। (এনিয়ে বিস্তারিত আরো অন্য অনেক বইয়ে আছে। এখানে সেদিক আর টানছিনা।
আবার মজার গোলমেলে ফ্যাক্টস হল, ১৯৪৭ সালে ভারতকে হিন্দু জাতিরাষ্ট্র (নেশন-স্টেট) বানালেও নেহরু-গান্ধী কখনোই ভারতের কনস্টিটিউশনে ‘সেকুলার’ শব্দটা রাখেননি; বরং আমাদের ওপর ১৯৭১ সালে জবরদস্তি করার বহু পরে ইন্দিরা গান্ধী ১৯৭৬ সালে এবার ভারতের কনস্টিটিউশনের ৪২তম সংশোধনী হিসেবে ‘সেকুলার’ শব্দটা অন্তর্ভুক্ত করেন। [ সংশোধনীর প্রথম পাতাতেই  STATEMENT OF OBJECTS AND REASONS এই শিরোনামের অধীনে তৃতীয় পয়েন্টে]। এই লিঙ্কে গিয়ে দেখুন। আর সেই থেকে অনেকের ভুল অনুমান হল, যেকোন রাষ্ট্রে এমনকি তা  হিন্দুত্ববাদী রাষ্ট্রচিন্তায় কল্পিত রাষ্ট্র হলেও এতে  আমাদের রাষ্ট্রনীতি হল  ‘সেকুলারিজম’ এই শব্দ থাকলেই রাষ্ট্র সেকুলার হয়ে যায়। ফলে এভাবেই ইন্দিরা গান্ধী আগে আমাদের দেশে এমন নীতি ঘোষণা করতে বাধ্য করেওছেন ১৯৭১ সালে পরে ১৯৭৬ সালের ভারতেও তাই করেছেন। এসব এমনই রাষ্ট্রচিন্তায় নাজুক  অবস্থা, দুরবস্তা। আসলে  নিশ্চয় আমাদের কনস্টিটিউশনেও  এই সকুলারিজম এই শব্দ থাকতে পারলেই এদিয়ে তারা মুসলমানদের ঠেকিয়ে রাখতে পারবেন আর তারা তাদের হিন্দুত্ববোধ বুদ্ধিকে সেকুলার বলে চালাতে পারবেন, রাষ্ট্রে ছেয়ে রাখতে পারবেন এতটুকুই তাদের লক্ষ্য।  অথচ যারা সেকুলার শব্দ কোথাও না লিখে কায়েম করা যায়। মূলকথা সবাই নাগরিক আর নাগরিক অধিকারের রাষ্ট্র হতে হয়ে যেখানে সবাই একমাত্র পরিচয় নাগরিক হতে হয় ও সমান অধিকারের নাগরিক  – এই ভিত্তিতে রাষ্ট্র গড়তে হয়।  এতে কে কী হিন্দু না মুসলমান না পাহাড়ি এটা এখন যা আছে তাই থাকি কিন্তু কনষ্টিটিউশন এই পরিচয় সামনে অধিকারে কোন কমবেশি বা ভাগাভাগি করে না। সবাই নাগরিক এবং সমান অধিকারের নাগরিক। ফলে মুসলমানের দেশে সেকুলার লিখে রেখে ইসলামবিদ্বেষ জারি রাখার যে সন্দেহ আমাদের দেশের মুসলমান নাগরিকদের মনে ভাসে, সন্দেহ জাগে তা তো অমূলক নয়।
এভাবেই আরেক সন্দেহযুক্ত শব্দ হল “অসাম্প্রদায়িক”। এটা ডিকশোনারিতেই নাই। হিন্দু জাতিবাদের সৃষ্টি এই অদ্ভুত শব্দ।  এটাও হিন্দু-জাতিরাষ্ট্রের বোধবুদ্ধিতে খাড়া করা শব্দ যা দিয়ে যেকোন অ-হিন্দুর উপর চাপ সৃষ্টি বা তাকে, কোনঠাসা করার হাতিয়ার হয়। য়ার তারা আরামে অসাম্প্রদায়িক এই শব্দের আড়ালে হিন্দু-জাতিবাদিতা বা হিন্দুত্ববাদ এর আধিপত্য কায়েম করে নিতে পারে। আবার এই আকামকে তারা সেকুলার বলেও সার্টিফাই বা সাফাই দিতে পারে। অথচ  নতুন বাংলাদেশ তো অন্তত ইন্দিরাদের হিন্দু-জাতিরাষ্ট্রই নয়। এ্টা ছিল মুজিবের “বাঙালি নেশন স্টেট”; ভারতের মতো ‘হিন্দু নেশন স্টেট’ও কোনোভাবেই নয়। ফলে ভারতকে কপি করতে হবে কেন আর তা ফিট করবে কেন? ফলে সেই থেকে রানা দাসগুপ্তরা তাদের ‘কল্পিত দুঃখে’ আমাদেরও মাথা খাচ্ছেন।
ওদিকে ১৯৭১-৭২ সালের এই সেকুলারিজম চাপিয়ে দেয়ার বিরোধিতা সহজ বা সময়ের সাথে মানানসই ছিল না বা হতো না। এজন্য এমনকি শেখ মুজিবও দেশে ফেরত আসার পর পরিস্থিতি বুঝে তখনই তা বিরোধিতা করতে যাননি। তাই পঞ্চম সংশোধনী লেখার সময় সেই প্রথম আর পরে অষ্টম সংশোধনী লেখার সময় আমাদের হাতে সুযোগ এসেছিল। ফলে সেকুলারিজম উঠিয়ে ফেলে দিলেও ঐ জায়গা ফাকা ফেলে রাখতে চায় নাই। এছাড়া রাগ-জিদও ছিল। তাই সেই জিদ উসুল করা হয়েছিল।  যদিও ‘সেকুলারিজম’ বা ‘অসাম্প্রদায়িকতা’ ইত্যাদি যে অসৎ শব্দ, খারাপ উদ্দেশ্যের শব্দ সেটা চিনতে আমাদের আমজনতার কোন অসুবিধা হয় নাই।
যেমন এই রাগ-জেদের দিকটা ভালো বোঝা যায় যখন পঞ্চম সংশোধনীতে সেকুলারিজম ফেলে দিয়ে লেখা হয়েছিল “আল্লার উপর অগাধ বিশ্বাস”। এটা তো লিখে কায়েমের কিছু না। কিন্তু দেয়া হয়েছিল অনেকটা হুশিয়ারি বা পাল্টাপাল্টি হিসাবে। অর্থাৎ যেন বলতে চেয়েছে, ভারতের এক হিন্দু নেশন স্টেট রাষ্ট্রচিন্তায় কল্পিত ‘সেকুলার’ শব্দটা বাংলাদেশে তোমরা চালু করতে চেয়েছো অযথাই, খারাপ উদ্দেশ্যে। কারণ বাংলাদেশ তো হিন্দু নেশন স্টেট কখনোই নয়। কাজেই ইসলাম বা মুসলমানদের কন্ট্রোল করা আবদ্ধ রাখা জাতীয় কোনো শব্দ ইসলামবিদ্বেষ ও ফোবিয়া থেকে জন্ম নেয়া বুদ্ধি। আর এর প্রতিবাদ চিহ্ন লটকে দিতেই ১৯৮৮ সালে আরো পোক্ত হবে ভেবে রাষ্ট্রধর্ম যুক্ত করে দেয়া – এমন মনে করা যায়। অথচ এর কোনো ব্যবহারিক বা লিগ্যাল ইমপ্লিকেশন নেই, কারো কারো জন্য হয়ত কিছুটা অস্বস্তি ছাড়া। আর এটাই মুসলমান হিসেবে ইন্দিরা গান্ধী অ্যান্ড গংদের ওপর শাস্তির মত বা প্রতিবাদ চিহ্ন লটকে দেয়া।

তবে আমার ধারণা একদিন পুর্ণ ও স্বাধীন জনগোষ্ঠির ক্ষমতা অর্জন করতে পারলে নতুন কনষ্ঠিটিউশনে আমরা কোন বিভেদ চিহ্ন রাখব না।  জেদাজেদি করারও কিছু থাকবে না। সব মাফ করে দিয়ে পুরানা ভুলে জনগোষ্ঠি হিসাবে আমরা হয়ে দাড়াতে পারব। বৈষম্যহীন এক  সম-নাগরিক অধিকারের সমাজে আমরা জীবন গড়ব।

উপরেও রানা দাসগুপ্ত বা অনুপম সেনদের চিন্তায় যে ফোবিয়ার কথা বলেছি এসব কথার সবচেয়ে ভালো প্রমাণ হলো সম্ভবত তারা এখন কী বলছেন তা যদি দেখি। ইসকনের ওই সভায় সারকথায় তারা বলছেন, তাঁরা বাহাত্তরে ফিরে যেতে চান। অথচ খোদ শেখ হাসিনাই তো ১৫তম সংশোধনীতে রাষ্ট্রধর্ম আর সেকুলারিজম দুটোই রেখে  দিয়েছেন। যা এখনও লেটেস্ট ভাষ্য।  অথচ কায়দা করে রানা দাসগুপ্ত বলছেন, ‘প্রধানমন্ত্রী ছাড়া কোনো রাজনীতিবিদের ওপর আমাদের আস্থা নেই। আমরা সরকারি দলের মধ্যে আত্মশুদ্ধি চাই”। অর্থাৎ কথার কোন তাল-ঠিকানা নাই।

আসলে এসব কায়দা করে লাভ নেই। কিন্তু তারা এখন এসব কথা তুলছেন কেন? আমাদের দুই রাজনৈতিক দলই এখন ভারতের আনুগত্য লাভের প্রতিযোগিতায় লিপ্ত এবং দেখা যাচ্ছে তা আবার সরাসরি ভারতের কাছেও না, তার ‘র’-এর কাছেও না। একেবারে ‘র’-এর হ্যান্ডলার ইসকনের কাছে হাত পেতেছে আর তা দেখে রানা দাসগুপ্তদের নিজেকে অনেক পাওয়ারফুল মনে হচ্ছে? তাই তো?  কিন্তু আর কত? ২০০ বছর হয়ে গেল এই মুসলমানদের দাবড়ে রাখতে হবে নাইলে নাকি মাথা চাড়া দিবে – এমন এই দাবড়ানোর চিন্তা এটাই তো ফ্যাসিজম, হিটলারি চিন্তা।  আপনার এই দাবড়ানির চিন্তার জন্যই তো আপনাকে বিশ্বাস করবে না কেউ, কোন আস্থার সম্পর্ক তৈরি হবে না। এটা এমনই ক্ষতিকর চিন্তা তা একবারও ভেবে দেখেন নাই। এজন্য হিন্দুত্ববাদি বা হিন্দুজাতিবাদ চিন্তাকে আমাদের এদিকের হিটলারিজম বলা হয়! এমন চিন্তার জন্যই আজ আমরা তিন দেশই বিচ্ছিন্ন, ধুঁকছি। হাতড়াচ্ছি।  খারাপ চিন্তাই প্রতিহিংসায় অন্য খারাপ চিন্তাকে ডেকে আনে। মানুষ নিজেই নিজের শত্রুর স্বভাব বৈশিষ্ট তৈরি করে।

আসুন হিংসা পাশে ফেলে রাখি। আর আপনাদের চোখে ধর্মই যদি সব সমস্যার উৎস হয়ে থাকে তবে ব্রাহ্মধর্ম বা ব্রাহ্মসমাজের কথা তো শুনেছেন। অবিভক্ত ভারতে রাষ্ট্র ধারণার গোড়া যেখান থেকে, সেই ১৮১৫ সালের রামমোহন রায় তাঁর আত্মীয় সভা আর যিনি আবার বেঙ্গল রেনেসাঁর নাকি আদিগুরু কমিউনিস্টরা দাবি করে, তা হলে তিনি রেঁনেসার আদিগুরু হয়ে নতুন করে ব্রাহ্মধর্ম বা ব্রাহ্মসমাজ চালু করেছিলেন কেন? করেন কী করে? রেনেসাঁর আদিগুরুর সাথে ধর্ম? কেমন মিলাবেন? এতো দুধ আর লেবুর চেয়েও খারাপ মিশ্রণ! হবে? তাই নয় কী এবং কেন?  আপনাদের উচিত হবে এর কারণ খুঁজে দেখা। ব্রাহ্মসমাজ জন্মের কারণ ধরতে পারলে বুঝে যাবেন, ধর্ম (আসলে ইসলাম ধর্ম) নিয়ে আপনাদের অনুমান কতটা ভিত্তিহীন, অপ্রয়োজনীয় ঈর্ষা!

অথচ খুবই সহজ এসবের সমাধান। আমাদের ‘জাতি-রাষ্ট্র’ ধারণা ত্যাগ করতে হবে। বদলে তা অধিকারভিত্তিক নাগরিক রাষ্ট্র হতে হবে যেখানে সবাই সমান অধিকারের নাগরিক। ফলে হিন্দু বা মুসলমান (বা জুম্ম জাতি) জাতি পরিচয় নিয়ে লড়ার কিছু থাকবে না। তখন দেখবেন, সেকুলার বা অসাম্প্রদায়িক ধরনের শব্দের আড়াল আর দরকার নেই, লাগছে না।

শেষ কথা
এত সেকুলারপ্রিয় আপনারা যারা সেকুলার ভারতের কনস্টিটিউশনকে আদর্শ মনে করেন,  তাহলে ভারতের এই কনস্টিটিউশনই আরএসএসের মোদিকে রাজত্ব করতে জায়গা করে দেয় কেমন করে? সেই প্রশ্ন করুন না। ভারতের সুপ্রিম কোর্ট, নির্বাচন কমিশনও বিজেপি দলকে অনুমোদন রেজিষ্ট্রেশন দিয়েছে কী করে? সহ্য করে কী করে? এতে কোনো সেকুলারিজমের সমস্যা দেখে না! কী অদ্ভুত? সহ-বাস! হিন্দুত্ববাদ আর সেকুলারিজম সহ-বাস করে কেমন করে? তাহলে কেবল মুসলমান-বাদ দেখলেই এবার ‘অসাম্প্রদায়িকতা’ হাতে দৌড়ে আসেন কেন?

এছাড়া  বাংলাদেশের হিন্দুনেতাকেই দেখি এই মোদির সাথে দেখা করে এসে বলশালী অনুভব করেন। আবার দেশে ফিরেই সেকুলার বাংলাদেশ নাই, কিংবা রাষ্ট্রধর্ম আছে বলে কান্নাকাটি করেন। কিভাবে করেন এগুলো? তা হলে আপনারা ঠিক কী চান? বাহাত্তরের কনস্টিটিউশন নামের আড়ালে মোদির ভারতের আধিপত্য ও অধীনস্থতা কায়েম? এসবের জন্য আপনারা বিশ্বাসযোগ্য পার্টনার হতে পারেন না। পারস্পরিক বিশ্বাসযোগ্যতা না বাড়ালে স্বল্প কিছু পরিবর্তনও কাজ করার কোন কারণ নাই।

লেখক : রাজনৈতিক বিশ্লেষক
goutamdas1958@hotmail.com

 

 

 

[এই লেখাটা  গত  ৩০ অক্টোবর ২০২১, দৈনিক নয়াদিগন্ত পত্রিকার ওয়েবে ও পরদিন প্রিন্টে   “ইসকনের মন পেতে প্রতিযোগিতা – এই শিরোনামে  ছাপা হয়েছিল।
নয়াদিগন্তে ছাপা হওয়া লেখাগুলোকে আমার লেখার ‘ফার্স্ট ড্রাফট’ বলা যায়।  আর আমার এই নিজস্ব সাইটের লেখাটাকে সেকেন্ড ভার্সান হিসাবে এবং  থিতু ভাষ্য বলে পাঠক গণ্য করতে পারেন। পরবর্তিতে ‘ফার্স্ট ড্রাফট’ লেখাটাকেই এখানে আরও অনেক নতুন তথ্যসহ বহু আপডেট করা হয়েছে। ফলে সেটা নতুন করে সংযোজিত ও এডিটেড এক সম্পুর্ণ নতুন ভার্সান হিসাবে ও নতুন শিরোনামে এখানে আজ ছাপা হল। ]

Leave a comment