মোদি কীভাবে পশ্চিমাদের তদন্তে সহযোগী হবেন


কানাডায় ‘র’-এর খুনঃ
মোদি কীভাবে পশ্চিমাদের তদন্তে সহযোগী হবেন

গৌতম দাস
২৭ সেপ্টেম্বর  ২০২৩  সন্ধ্যা ১৮ঃ ৫৯
https://wp.me/p1sCvy-52J

 

        …Canada row wake-up call on rival India

কানাডায় নাগরিকত্ব নিয়ে বসবাসকারি এক শিখ নেতাকে খুন করতে মোদির ভারত রাষ্ট্রের এক অন্তর্ঘাতমুলক খুনাখুনির প্রতিষ্ঠান ‘র’ [RAW] কানাডায় গিয়ে একাজ করে এসেছে। কানাডায় ‘র’ এর স্টেশন চিফ, যিনি নিজের আসল পরিচয় লুকিয়ে মিথ্যা ‘তিনি যেন কূটনীতিক’ এই ছুপা পরিচয় নিয়ে কানাডায় ছিলেন। তিনি এই খুনের পরিচালনা ও নিয়ন্ত্রণ করেছেন বলে ইন্টেলিজেন্স তথ্য থেকে ধারণা করা  ও অভিযোগ উঠেছে। তাই তাকে, কানাডা সরকার ‘বহিস্কার’ [‘অনাকাঙ্খিত ব্যক্তি ঘোষণা’ বা persona non grata] করে দিয়েছে।
এই ঘটনা নিয়ে খোদ  আমেরিকা থেকেই বহু মিডিয়া রিপোর্ট  প্রকাশিত হয়েই চলেছে। এখনও আসছে। বিশেষ করে শুরুর দিকে রয়টার্সের খবরগুলো আর পরে  নিউ ইর্য়ক টাইমসে এই রিপোর্টটা সারা ফেলেছে। এতে প্রকাশিত ভাষ্য থেকে এর স্টোরির সারাংশটা এরকম যে, আমেরিকা প্রতিদিনই গোয়েন্দা তথ্য সংগ্রহের উদ্দেশ্যে অসংখ্য বিদেশি দুব্যক্তির কথোপকথনের মধ্যে বা-হাত-ঢুকিয়ে [intercept]  তা শুনে থাকে। কিন্তু এত তথ্যের ভিড়ে এক কথোপকথন (যেটার এক প্রান্তে ছিলেন এখন বহিস্কৃত কানাডায় কানাডায় ‘র’ এর স্টেশন চিফ বলে অনুমান করা হচ্ছে) আমেরিকার হাতে এসে যায়। সেই তথ্যসহ আরো অনেক কিছুই আমেরিকা কানাডা সরকারের সাথে শেয়ার করেছিল। এমনিতেই সাধারণভাবে এদুই রাষ্ট্র পরিচালনা ও ব্যবস্থাপনায় অনেক কিছুই তারা শেয়ার করে, পরস্পরকে সাহায্য করে থাকে, যেন একই রাষ্ট্র এর দুই অংশ তারা।
খুনের ঘটনাটায় ভুক্তভোগীর নাম [Hardeep Singh Nijjar] হরদীপ সিং নির্জ্জার,  যিনি ভারত থেকে বিচ্ছিন্ন স্বাধীন এক শিখ রাষ্ট্র কায়েমের  – মানে খালিস্তান আন্দোলনের কর্মী; এই অর্থে বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলনের রাজনীতির অনুসারী।
অনেকের ধারণা হতে পারে যে বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলন মানেই তা টেররিজম বা একালে জঙ্গীবাদের ক্যাটাগরিতে ফেলে একে নিন্দা করা যায়। ব্যাপারটা ঠিক তা নয়। আপনি যদি দাবি তুলেন বিচ্ছিন্ন হয়ে যাবার জন্য আমি রেফারেন্ডাম চাই – আর এটাই আমার দাবী সেক্ষেত্রে নেতিভাবে দেখিয়ে কোন শাসকেরই এথেকে  সুবিধা খাবার সুযোগ থাকে না। কানাডায় বসে শিখ কমিউনিটি এভাবে তাদের দাবি পরিচালিত করছে। যা সম্পুর্ণ আইনিভাবেও বৈধ আন্দোলন!
হরদীপ সিং তিনি কানাডায় খুন হন চলতি বছরের গত জুন মাসে। এরপর পরেই ব্যাপারটা ভারত-কানাডার মধ্যে সরকারি পর্যায়েই আলোচনা হয়েছিল, তবে তা মিডিয়া থেকে গোপন রাখা হয়েছিল। এমনকি সদ্য সমাপ্ত গত ৯-১০ সেপ্টেম্বর ভারতে অনুষ্ঠিত জি২০ এর সম্মেলন চলার কালেই কূটনৈতিক চক্রে কিছু পশ্চিমা রাষ্ট্রের মধ্যে একসাথে এবং সাথে মোদিকে নিয়েও কিন্তু গোপনে আলোচনাও হয়েছিল। (যেটা এখন জানা যাচ্ছে এমন সংশ্লিষ্ট পশ্চিমা রাষ্ট্রগুলো তা মিডিয়ায় স্বীকার করছে)। বিশেষ করে ইন্টেলিজেন্স তথ্য শেয়ার করার  আরেক অপ্রকাশ্য গ্রুপ ‘৫ আই’ [5 EYE] – এই গ্রুপ যার নাম বাংলা করলে হয় পাঁচ চোখের গ্রুপ। আর এর সদস্যরা হল, আমেরিকা, ইউকে, কানাডা, অষ্ট্রেলিয়া ও নিউজিল্যান্ড। সোভিয়েতের সাথে কোল্ড ওয়ার রেষারেষির আমলে এটা আমেরিকা, ইউকে এর মধ্যে এক গোপন চুক্তিতে প্রথম এর জন্ম হয়েছিল যার সাথে কালক্রমে অন্য তিন দেশ যুক্ত হয়েছিল। কেবল ২০১০ সালে এমন জোটের তথ্য প্রকাশ্যে এনে উন্মোচিত করে দেয়া হয়েছিল। কিন্তু এবার জি২০ সম্মেলনে এই জোটও তা গোপনে বিস্তর আলোচনা করলেও  এ’থেকে কোন অগ্রগতি, দিশা বা পরের পদক্ষেপ কী তা বের না হওয়াতে এখন খোলাখুলি একে-অপরের  কূটনীতিক বহিস্কার-সহ, এখন আমেরিকা খোলাখুলি ভারতকে – খুনী কে তা বের করতে – কানাডিয়ান তদন্তে সহযোগিতা করার জন্য প্রকাশ্যে শক্ত আহবানে এসে ঠেকেছে। যার মানে হল, ভারতকেই এখন ‘র’ এর দিক থেকে যারা যারাই এই খুনের সাথে জড়িত ছিল তাদেরকে বিচারের জন্য কানাডার হাতে তুলে দিতে হতে হবে – এই হল সারা পশ্চিমের হয়ে ভারতকে আমেরিকান পরামর্শ ও অনুরোধ।  আর আমেরিকান অনুরোধ মানে এখন এটা ক্রমশ ভারতের জন্য বাধ্যবাধকতা হতে থাকবে!  আর বলাই বাহুল্য যে এটা হল আপোষে ব্যাপারটা সবচেয়ে কম আন্দোলিত করে সমাপ্তি টানার প্রস্তাব। এখন মোদি এতে একমত না হলে ক্রমশ ভারতের উপর চাপ বাড়বে এবং অবশ্যই এই ইস্যুকে কেন্দ্র করে পশ্চিমাদেশের সাথে ভারতের শত্রুতার চরমে যেতে থাকবে – এতে কোনই সন্দেহ নাই।
আপনি একটা রাষ্ট্র মানে একটা রাষ্ট্রস্বার্থ হলেও অপর এক রাষ্ট্রের ভিতরে ঢুকে গোপনে সেদেশের নাগরিক কাউকে খুন করে আসতে পারেন না। এটা আন্তর্জাতিক বা দেশীয় আইনেও ক্রিমিনাল অপরাধ। তাতে ঐ খুন হওয়া ব্যক্তি আপনার কাছে আপনার রাষ্ট্রের যতবড়ই শত্রু বিবেচিত থাক না কেন! এই যে অপর দেশ-ভুমিতে ঢুকে ঐ দেশের নাগরিককে হত্যা এটা সেই অন্যদেশের সাথে যুদ্ধ ঘোষণার সামিল!  এতে আইনি পথ ছিল মানে হতে পারত যে ভারত কানাডা সরকারের কাছে হরদীপ সিং এর নামে ভারতে মামলা আছে তাই তাঁকে ভারত সরকারের হাতে হস্তান্তরের দাবি করা। কিন্তু এখন যা হয়েছে তা হল কানাডার সাথে যুদ্ধ ঘোষণা করে ফেলার মত এক্ট করে ফেলার কুটনীতিক-সামরিক দিক তো আছেই এছাড়াও হরদীপ সিং কে নিয়ে ভারত কোন বিচার প্রক্রিয়া অনুসরণের আগেই  মানে ভারতে চোখেও তো  বিচার-প্রমাণ প্রক্রিয়া শেষে প্রমাণিত কোন  অপরাধী নয় তাহলে তাকে আগেই খুন করা হল কেন? মানে ভারত হরদীপ সিং কে কোন বিচার প্রক্রিয়ায় আনতেই চায় না যুদ্ধের এনিমি যেন এমন বিবেচনায় খুন করেছে!!!  অর্থাৎ বলা যায় মোদি সরকার তাঁকে নিয়েই বিচারের পথে না গিয়ে আইন বহির্ভুত [extra judicial] খুন বা কিলিং ঘটিয়েছে !! এটা তো ভারতের নির্বাহী ক্ষমতার প্রধান প্রধানমন্ত্রী মোদির সরাসরি নির্দেশে এক কিলিং!!!! আর না হলে যুদ্ধের এনিমি হিশাবে ট্রিট করেছে – এর দুটোতেই মোদির ভারত অপরাধী!

অন্তর্ঘাতমুলক [subversive] মানে কীঃ
ভারতের বিদেশে গোয়েন্দাগিরি ও অপততপরতার সংগঠন হল ‘র’ [RAW]। এসব অপততপরতাকে বাংলায় অন্তর্ঘাতমূলক ততপরতা বলাই সঠিক! যদিও অনেকে এটাকে স্যাবোটাজ [sabotage] শব্দে ব্যাপারটাকে ধরতে চেষ্টা করেন।
অন্তর্ঘাত শব্দটা ডিকশনারী মানে দেখলেই বুঝা যায় এটা কত ভয়ঙ্কর। এর ডিকশনারি মানে হল, ভিতরে থেকে বসবাস করেও গোপনে কারো ক্ষতি করা। এখানে ভিতরে বলতে যাকে খুন করবে বা ক্ষতি করবে তার দেশে কিংবা খোদ তাঁর বাড়িতেই মেহমান হয়েও এবং বন্ধু সেজে এমন খুন বা ক্ষতি করবে। অর্থাৎ শব্দটা নিজ থেকেই এক ক্ষতিকর শব্দ। এর উপর আছে এর বিশ্বাসঘাতক দিকটা।  এখানেই শেষ না, আরো আছে। সব মিলিয়ে সেটা মানে, মানুষের এমন কাজ হল চরম অনৈতিক ও অসৎ[immoral] কাজ। তাহলে  এটা তো এমনিতেই অধঃপতিত এক ধারণা  তবু, মানুষের সমাজেই তো এমন অন্তর্ঘাতমূলক কাজের প্রতিষ্ঠান যেমন ‘র’-কে লুকিয়ে থাকতে/আছে পাওয়া যায়!!! হ্যা একথা সত্য তবে কেবল একটা জায়গায় অন্তর্ঘাত ততপরতার পক্ষে কিছু সমর্থকও পাওয়া যায়। সেখানে আসছি পরে, এর আগে…।

এর মূল ইংরাজি  শব্দটা হল সাবভারসিভ [subversive] যারই সংস্কৃত ঘেঁষা এক বাংলা করা হয় অন্তর্ঘাতমুলক; বা এমন কাজ বা ততপরতা। সাবভারসিভ এর আক্ষরিক মানে হল ‘উপড়ে ফেলা’ [overthrow something]।  আর এই উপড়ে ফেলার অর্থ সরকার উপড়ে ফেলা, ব্যক্তিকে উপড়ে ফেলা মানে খুন করা এবং তার বাসায় গিয়ে খুন করা সহ কোন সরকার বা কোন প্রতিষ্ঠানকেই দমন করা, দাবড়ে দেয়া ইত্যাদি। ভারতের ‘র’ হল তেমনই এক সাবভারসিভ প্রতিষ্ঠান।
সবচেয়ে বড়কথা যে কোন রাষ্ট্রের আইনের বিচারে ও চোখে সাবভারসিভ কাজটা সবসময়ই ‘অবৈধ’। তাতে এটাও সম্ভব যে, সাবভারসিভ কাজ মানেই প্রো-একটিভ মানে নিজেই আগাম “আইন নিজের হাতে তুলে” নিয়ে – উপড়ে ফেলার খুন জখম বলতে যা যা বুঝায় এর সবই করে আসা। আর মনে রাখতে হবে,  ‘র’ ভারতের হলেও সেই  ভারতেরই আইনেও ভিনদেশের কোন  ‘র’  সমতুল্য প্রতিষ্ঠান ও এর ততপরতাও চলে তবে সেটাও অবৈধ। শুধু তাই না, ভিনদেশে গিয়ে ‘র’ এর মত প্রতিষ্ঠানের অন্তর্ঘাতমুলক ততপরতা সে দেশের বিরুদ্ধে ভারতের যুদ্ধ ঘোষণার সামিল!!  একারণে, ধরা যাক বাংলাদেশে কোন ‘র’ এর এজেন্ট এসে প্রকাশ্যে বলতেই পারবে না যে সে ‘র’ এর এজেন্টকারণ, ‘র’ সাবভারসিভ কাজের প্রতিষ্ঠান বলেই তা এক অবৈধ প্রতিষ্ঠান।  আপনি ‘র’ – এই প্রতিষ্ঠানে চাকরি করেন এই পরিচয় দিয়ে বাংলাদেশের (বা যেকোন দেশের) ভিসা পাবার প্রশ্নই আসে না!  আর এই অনৈতিক ও অসৎ সংগঠন বলেই এর সাথে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা প্রকাশ্যে আপনার অফিস বা বাসার ড্রয়িং রুমে প্রবেশ-বসবাস অনুমতি পাবে না!

কোথায় অন্তর্ঘাতমূলক ততপরতার পক্ষে কিছু সমর্থকঃ
উপরের পুরা প্যারাগ্রাফটাই অন্তর্ঘাত শব্দটার নেতি ও বিশ্বাসঘাতক দিকটা উন্মোচন করা হয়েছে এর প্রতিটা বাক্যে। তাহলে অন্তর্ঘাত কাজের এর পক্ষে এর সমর্থক কারা? কারা হয় এমন সমর্থক?

এককথায় এর জবাব উগ্র জাতিবাদি চিন্তার লোকেরা!
লক্ষ্য করলে দেখা যাবে উগ্র জাতিবাদি চিন্তা বা রাজনীতির যেখানে রমরমা বা ইতিহাসের যেসব যুগে তা রমারমা ছিল সেসব কালে উগ্র জাতিবাদি চিন্তার পাশে বসে থাকতে আমরা পেয়েছিলাম সাবভারসিভ বা অন্তর্ঘাতমুলক ততপরতা ও প্রতিষ্ঠানকে। ১৯৫০ সালের আগের সাড়ে তিনশ বছর ছিল পশ্চিমাদেশে বিশেষত ইউরোপ ছিল জাতিরাষ্ট্র বা উগ্র জাতিবাদি চিন্তার যুগ। পরে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরে নানান কারণে এর অনেক কিছুই একেবারেই বদলে যায়। সবচেয়ে বড় কারণ, খোদ ইউরোপই জাতিরাষ্ট্র ধারণার রাষ্ট্র চর্চা বন্ধ করে অধিকারভিত্তিক রাষ্ট্রে নিজেদের রূপান্তরিত করে নিয়েছিল। এছাড়া আরও  পরে কোল্ড ওয়ারের আমলে তা কিছুটা দেখা দিলেও তা সীমিত ও নিয়ন্ত্রিতই থেকে যায়। এককথায় এর মূলকারণ আন্তঃরাষ্ট্রীয় বাণিজ্য চালু ও এর বিস্তার। কারণ, রাষ্ট্রগুলো পরস্পরের সাথে অন্তর্ঘাতমূলক ততপরতাও চালাবে আবার আন্তঃরাষ্ট্রীয় বাণিজ্যও চালাবে এটা কঠিন। মানে এদুটো একসাথে চালানো খুবই মুশকিল। যেমন ইতোমধ্যেই কানাডা-ভারত আবার কানাডা-ইউকে যে বাণিজ্য আলোচনা চলছিল তা এখন পিছনে পরে সব এলোমেলো হয়ে গেছে।    তাই যেমন,  সোভিয়েত ব্লক আর পশ্চিমাদেশ এদের মধ্যে কোন আন্তঃরাষ্ট্রীয় বাণিজ্য ছিল না, সম্ভবও ছিল। একারণে এদের – পরস্পরের বিরুদ্ধে পরস্পর অন্তর্ঘাত্মূলক ততপরতা  চলতে পেরেছিল কোল্ড ওয়ার আমলে। তাই পশ্চিমাদেশে এটা কমে গেলেও এশিয়ায় বিশেষত ভারতে তা ব্যতিক্রম। দুটা কারণে। এক .  ভারতে এটা হিন্দুত্ববাদ এই উগ্রজাতিবাদে আচ্ছন্ন এক জাতিরাষ্ট্র। আর দ্বিতীয় কারণ, জন্ম থেকেই ভারত-পাকিস্তান রেষারেষি সম্পর্ক। যদিও সাধারণভাবে সাবভারসিভ বা অন্তর্ঘাতমুলক ততপরতা চালানোর মত প্রতিষ্ঠান অনেক রাষ্ট্রই সক্ষম থাকে। কিন্তু  তা করে না, কেবল গোয়েন্দা ততপরতার মধ্যে সীমাবদ্ধ সে সক্ষমতা সীমাবদ্ধ রাখে। আর ভারত-পাকিস্তান এদের মধ্যেই এর ব্যাপক ব্যবহার – এটাই গুরুত্বপুর্ণ জায়গা। এর উপর এসব প্রতিষ্ঠানের অন্য দেশে গিয়ে অন্তর্ঘাতমুলক ততপরতা ঘটানোর পরে দেখা যাবে কেবলমাত্র উগ্র জাতিবাদি দেশেই দেখা যাবে যে শাসক একাজকে গৌরবের বলে ইঙ্গিত দিচ্ছে বা ওদেশের মিডিয়া প্রকাশ্যে এটা গৌরবের কাজ বলছে।

তাই উগ্র জাতশ্রেষ্ঠত্ববাদ- হিন্দুত্ববাদী ভারত আর এই ভারতের প্রতিষ্ঠান র-এর কোন ততপরতা পাকিস্তানে ঘটিয়ে এলে তা ভারতের মিডিয়া প্রকাশ্যে তাতে উতযাপনের বিষয় হিশাবে তুলে ধরে থাকে।
কানাডায় হরদীপ সিং-কে খুন করা আসার প্রেক্ষিতে কলকাতার আনন্দবাজার ঠিক একাজটাই করেছে।

কলকাতার আনন্দবাজারের র-এর অন্তর্ঘাতি ততপরতার পক্ষে প্রকাশ্য উতযাপনঃ
উপরে বলেছি, অনেক রাষ্ট্রেরই  সাবভারসিভ বা অন্তর্ঘাতমুলক ততপরতা চালানোর মত সক্ষম প্রতিষ্ঠান থাকলেও এমন ততপরতায় তারা যায় না বা এনিয়ে কথিত দেশপ্রেমি উতযাপন তারা করে না। সম্ভবত কাজটার মধ্যে অনৈতিক, অসততার দিক আছে তা খেয়াল রাখে বলে। কিন্তু মফস্বলী কলকাতার কাছে এই খারাপ দিকটার কথা খেয়াল রেখে বা ভেবে এথেকে দূরে থাকার মত কোন ক্রিটিক্যাল সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গি গড়ে উঠে নাই। এর উপর ক্ষমতায় যখন মোদি তখন সে আরেক হিন্দুত্ববাদী রাহুলের বাবা রাজীব গান্ধীর আমলের র-এরও আবার বিশেষ অন্তর্ঘাত-বাহিনী (‘টিম জে) বানিয়ে কী করে পাকিস্তানে অপ-ততপরতা চালিয়ে এসেছিল সেই কথিত গর্বের কাহিনী এখন ছেপেছে আনন্দবাজার। অন্তর্ঘাত বিশ্বাসঘাতকতামূলক কাজটা যেন খুবই গর্বের তা একালেও এই পত্রিকা পাঠকের মনে এখন হরদীপ হত্যার সময় যাতে জনমত কানাডার হত্যাকে গৌরবের মনে করে সে উস্কানি তুলতেই আনন্দবাজারের এই উদ্যোগ। এর শিরোনামেই ব্যাপারটা খুবই গৌরবের এমন উস্কানি তুলতে লেখা হয়েছে – “পাকিস্তানের ঘরে ঢুকে শত্রু নিধন, খলিস্তানিদের ঠেকাতে রাজীব গান্ধীর গোপন তাস ছিল ‘টিম জে“। এই ‘টিম জেহল র-এর ভিতরেই আরেক বিশেষ বাহিনী যা রাজীব গান্ধী তৈরি করিয়েছিলেন। মনে রাখতে পারি ইন্দিরা গান্ধী খুন হয়েছিলেন শিখ বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলন দমন করতে গিয়ে শিখদের কাছে পবিত্র “স্বর্ণমন্দিরে হামলা ও তছনছ করে সেখানে আশ্রয় নেয়া সকল আন্দোলনকারীদেরকে হয় হত্যা করেছিল বা বের করে গ্রেফতার করেছিলেন। আর স্বর্ণ মন্দিরে সেনা অপারেশনের বদলা নিতেই ১৯৮৪ সালের ৩১শে অক্টোবর তারা প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরাকে গুলিতে ঝাঁঝরা করে দিয়েছিল। রাজীব গান্ধীও প্রায় একইভাবে শ্রীলঙ্কার তামিল বিচ্ছিন্নতাবাদী ইস্যুতে খুন হয়ে গেছিলেন। এমনকি খোদ দিল্লিতেই ইন্দিরার হত্যা হয়ে যাবার কয়েকদিন পরে শিখ-জাতির বাসিন্দা পেলেই তাদের উপর কংগ্রেসিরা এথনিক ক্লিনজিং করেছিল!

সাধারণভাবে বললে, ভারতে বারবার বিচ্ছিন্নতাবাদের সমস্যা হাজির হচ্ছে জন্মের সময়ে ভারত রাষ্ট্রের রাষ্ট্রগঠনে কিছু মারাত্মক ত্রুটির কারণে। নেহেরুর রাজনৈতিক চিন্তার বৈশিষ্ট হল ১। এটা কলোনিশাসক মডেল। জবরদস্তিতে ঘাড়ে চড়তে হবে আর শুষে নিতে থাকতে হবে  তাতে সেটা আভ্যন্তরীণভাবে কেন্দ্রিভুত ক্ষমতার নামে অথবা পড়শির উপরে চড়াও ধরণের হলেও একই ফর্মুলা। ২। ভারতের রাজ্যগুলোর উপরে একমাত্র তথাকথিত কেন্দ্রের কড়া নিয়ন্ত্রণেই ভারতকে এক রাখা সম্ভব। এটা নেহেরু বিশ্বাস করতেন। আর এরই প্রতিফলন তিনি ঘটিয়ে রেখেছেন যা এখনও বর্তমান ভারত রাষ্ট্র কাঠামোর মধ্যে।   আর একারণেই পালটা প্রতিক্রিয়ায় সব সময় কোন না কোন রাজ্যে ভারত ভেঙ্গে রাজ্যগুলোর আলাদা হবার উপক্রম!! উল্টোদিক থেকে পড়লে অন্যভাষায় বললে, এটাই বিচ্ছিন্নতাবাদ। আর তা ঠেকাতে উগ্র জাতিবাদী প্রপাগান্ডা যে বিচ্ছিন্নতাবাদ মানেই অপরাধ! সোজা ভাষায় বললে, নেহেরুর কাছে শাসন বলতে কলোনিশাসক যেভাবে ভারতকে অধীনস্ত রেখে শাসন করেছিল, সেটাই মডেল। এর বাইরে ১৭৭৬ সাল থেকে স্বাধীন আমেরিকা যে ফেডারল বলে আরেক রাষ্ট্র ধারনার হাজির ও সবচেয়ে স্টেবল-থিতু ধারণা বলে প্রতিষ্ঠা করে রেখেছে এটা তিনি বেখবর। বরং বৃটিশেরা চলে গেলেও তিনি নেহেরুই যেন তখনও বৃটিশ রানীর ভাইসরয় এই মনে করে তিনি ভারত রাষ্ট্র কাঠামো ও শাসন সাজিয়েছেন।
আবার এর সাথে ছিল উগ্র হিন্দুত্ব জাতিবাদী ও এর কথিত অর্থহীন দেশপ্রেম!!! আর সেটাই তবে আরো উগ্র উপস্থাপনায় একালে মোদির আমলে তা হয়ে উঠেছে হিন্দুত্ববাদী শাসনের প্রধান হাতিয়ার। আর তা থেকেই কথিত হিন্দুত্বের দেশপ্রেম এর আবেগ তুলে ভোটের বাক্স ভরা। তাই শিখ কমিউনিটির উপর যে নিরবিচ্ছিন্ন নিপীড়ন এটাকেই মিথ্যা করে ইতিবাচকভাবে হাজির করতে উগ্র জাতিবাদী দেশপ্রেম ছড়িয়ে দেয়া উস্কে তোলা – একাজটাই করেছে আনন্দবাজার। তাতে আরেক দেশে গিয়ে গোপন ও গুপ্ত হত্যা করে আসা যে আন্তর্জাতিক অপরাধ এমন কোন বোধ তাদের নাই। অথচ ভারতে  ২০০৮ সালে পাকিস্তানের ২৬/১১ মুম্বাই হামলা সেই একই ঘটনার উলটা পিঠ। মানে একই জিনিষ ভারত করলে তা দেশপ্রেম ও বীরত্ব; কিন্তু পাকিস্তান করলে সেটা অন্যায় আর মুসলমানের বিরুদ্ধে ঘৃণা-বিদ্বেষ দিয়ে একে প্রতিবাদ ও বিচার করে দেখাতে হবে!!! এই হলো উগ্র জাতিবাদের মূলনীতি।  সেটা অনুসরণ করেই আনন্দবাজার বলতে চাচ্ছে কানাডায় গিয়ে হরদীপ সিং-কে হত্যা এই অন্তর্ঘাতি ততপরতা এটা ভারতীয় দেশপ্রেম এবং এটা যেন বৈধ এবং ভারতীয় দেশপ্রেম ও বীরত্বের নজির! জনমনে এই উগ্র হিন্দুত্বের জাতিবাদ এবং এর শ্রেষ্ঠত্ব প্রচার করেছে আনন্দবাজার যাতে তারা কানাডায় গিয়ে হত্যা করাটাকে অন্যায়-অবৈধ না একেবারে উলটা দেশপ্রেমের বীরত্ব হিশাবে দেখে!

মফস্বলি আনন্দবাজারের বেকুবিটা হল, তারা ভেবেছে সারা দুনিয়াটাই যেন মুসলমানের পাকিস্তান তাই মুসলমানদেরকে তো যা খুশি শাস্তি দেয়া যায় এই হলো অনুমান! তাই পাকিস্তানে ভারতের র-এর ‘টিম জে যেটা করতে পেরেছে সেটা যেন সে কানাডাতেও করতে পারবে!! এটা যেন কোন ব্যাপারই না!!! এই হলো তাদের হিন্দুত্ববাদের গাধামি! তারা বুঝেই নাই যে কানাডার গায়ে হাত মানে এটা অলিখিতভাবে আমেরিকার [সাদা ককেশীয়] গায়ে হাত তোলার সামিল! এর উপর কানাডা আমেরিকার সাথে জি৭ জোটের সদস্য! শুধু তাই নয় কানাডা ন্যাটোর সদস্য এবং ইন্টেলিজেন্স শেয়ার গ্রুপ ফাইব আই [Five EYE]  এর সদস্যও বটে! তাই মোদি যদি আমেরিকান “সহযোগিতার প্রস্তাবে” রাজি না হন তবে এই বিরোধ ক্রমশ চরমে না উঠে উপায় থাকবে না।

ওদিকে মোদি হরদীপ সিং হত্যার পথে পা বাড়িয়েছেন আরেক কারণে! শুধু ভারত দেশের বাইরের হিসাবের কথাটা হল, পশ্চিমাদের চীন-ঠেকানোর কাজে ভারত গুরুত্বপুর্ণ পিলার ও বন্ধু তাই সেই ভারত এক্ষেত্রে কানাডায় গিয়ে খুন করেও পার পেয়ে যাবে; এছাড়া এতটুকুই না। মোদি আসন্ন আগামি নির্বাচনে শিখ বিচ্ছিন্নতাবাদীদেরকে শায়েস্তার পদক্ষেপ নিয়ে বীরত্ব আর গর্ব প্রকাশ করে হিন্দু শ্রেষ্ঠত্বের জজবা উঠাবে -ভোটারদের আবেগী করেও তুলবে যাতে এর প্রভাব মোদি-বিজেপির ভোটের বাক্সে প্রতিফলিত হয়!  কাজেই আমেরিকার দাবি যে “কানাডার সাথে  তদন্তে ভারতকে সহযোগিতা” এই আহবান – মোদির এতে সায় দেয়া এটা প্রায় অসম্ভব ও অবাস্তব একটা ঘটনা হয়ে থাকার সম্ভাবনা বেশি! আর সেক্ষেত্রে আমেরিকার নেতৃত্বের পশ্চিমের কাছে ভারত যতই চীন-ঠেকানোর দেয়াল- এই গুরুত্বের দেশ হোক না কেন মোদির ভারতকে পশ্চিম এক্ষেত্রে তারা পাচ্ছে না!!! সে সম্ভাবনাই সবচেয়ে বেশি!

আবার অন্যদিকে; আগামি বছরের শুরুতেই এপ্রিল-মে মাসের মধ্যে ভারতে নির্বাচন, তাতে কংগ্রেসের রাহুলের নেতৃত্বে বিরোধীদলকে ক্ষমতায় দেখতে চায় বাইডেনের নেতৃত্বে পশ্চিম; যা কানাডায় খুনের ঘটনার বহু আগে থেকেই একটিভ হয়ে ছিল। মোদির হিন্দুত্ববাদের এক ব্যবহারিক রূপ হল মুসলমানের উপর চরমতম বৈষম্য ও পায়ের নিচে দাবিয়ে রাখার নানান বেআইনি পদক্ষেপ নেয়া – অন্যদিকে ভয় আর প্রলোভন দেখিয়ে  বিচার বিভাগকেই নিস্ক্রিয় রাখা, বদলি বা ডিপার্টমেন্ট বদল পর্যন্ত ঘটিয়ে বিচার বিভাগ বা নির্বাচন কমিশনকে স্থবির রাখা -সহ সবকিছু করে মোদি এক রামরাজত্ব কায়েম করে রেখেছেন। আর এসব করেই আবার বাড়তি হিশাবে মুসলমান ঘৃণা বা শিখদের প্রতি ঘৃণা উস্কে তা বিক্রি মানে, এভাবে ভোটের বাক্স ভরার নীতিতেই মোদি গত দশবছর ধরে ক্ষমতায় টিকে আছে।
কিন্তু এখন মোদির সেসব পরিকল্পনা ও ছকের কী হবে, কী প্রভাব পড়বে সেসবও দেখার বিষয়!  আসন্ন নির্বাচনের সময়ে, কানাডায় অন্তর্ঘাত কাজ যে যুদ্ধ ঘোষণার সমান কাজ তা হলেও – সেটা করা মোদির ঠিক আছে এমন জোশ তুলে আনা  – এটামোদির বিজেপি করতে যাবে আর টিকাতে পারবে?  আবার মোদি যদি পেরে যায় তাহলে এই মোদিকে বাইডেনের নেতৃত্বের পশ্চিম কী বোকার মত দাঁড়িয়ে দেখবে??? এসবই হয়ে উঠবেই আগামির ঘটনাবলীতে মুখ্য নির্ধারক সব প্রশ্ন!!!

সর্বশেষঃ একটু আগে প্রথম আলো জানাচ্ছে পররাষ্ট্রমন্ত্রী জয়শঙ্কর পালটা কানাডাকে অপরাধীদের আশ্রয় দিবার অভিযোগ করেছেন। এর অর্থ বাইডেনের নেতৃত্বে পশ্চিমের সাথে কোন আপোষের পথ বের করার পথে মোদির ভারত হাটবে না, যাচ্ছে না।

সর্বশেষ আপডেটঃ   ২৮ সেপ্টেম্বর ২০২৩; দুপুর ০১ঃ ৪৫
সর্বশেষ আপডেটঃ  

লেখক : রাজনৈতিক বিশ্লেষক
goutamdas1958@hotmail.com

Leave a comment