টাইমস অব ইন্ডিয়ার চশমা বদলঃ বাংলাদেশে ‘কর্তৃত্ববাদী’ শাসনে নিজের বিপদ দেখছে


টাইমস অব ইন্ডিয়ার চশমা বদলঃ
বাংলাদেশে ‘কর্তৃত্ববাদী’ শাসনে নিজের বিপদ দেখছে

গৌতম দাস
২৬ নভেম্বর ২০২৩  সন্ধ্যা ১৮ঃ ২৭
https://wp.me/p1sCvy-59d

 

 

“Halting Hasina: India should worry about Bangla PM’s authoritarian…”

বাংলাদেশ নিয়ে ভারতের অন্তত একটা মিডিয়া টাইমস অব ইন্ডিয়া,  গত ২২ নভেম্বর ২০২৩ এক উলটা হাওয়া বইয়ে দিয়েছে। এটা হল, কংগ্রেসের প্রণব মুখার্জির আমল বা একালের বিজেপির মোদির আমল মিলিয়ে গত সতেরো বছর ধরে অনুসরণ করে চলা ভারতের মিডিয়াগুলোর নীতির বিরুদ্ধ বা বিপরীত অবস্থান। বাংলাদেশের রাজনীতি বা ক্ষমতায় যেই আসুক ভারতের মিডিয়া এর কোন ভালমন্দ দেখতে পাবে না। তবে কেবল যে ঘটনায় ভারতের স্বার্থ আছে সেটাই সহি – এই হল বাংলাদেশ সম্পর্কে ভারতের মিডিয়াগুলোর অবস্থান!
আবার যেমন,  কোন পত্রিকায় অনেক রকমের লেখাই ছাপা হয় – নিউজ রিপোর্ট, ভিউজ-মতামত, সত্য-মিথ্যা প্রপাগান্ডা বা ফিচার  অথবা এমনকি উপ-সম্পাদকীয় ইত্যাদি সবই ছাপা হয়। কিন্তু পত্রিকায় যেটা সম্পাদকীয় বা এডিটরিয়াল [editorial] লেখা ছাপা হয় সেটাই একমাত্র পত্রিকার মালিক, সম্পাদক বা সম্পাদকীয় গ্রুপ বা বোর্ডের সকলের স্পষ্ট নিজস্ব  অবস্থান বা রাজনৈতিক বক্তব্য। এটা পত্রিকার পরিচালনাকারীদের নিজস্ব অবস্থান এবং নিজ দায় নিয়ে বলা কথা!  তা হলেও বাংলাদেশের রাজনীতি বা ক্ষমতা কেমন কী চলছে সেখানে এনিয়ে ভারতের প্রিন্ট- মিডিয়াগুলোর কোন সম্পাদকীয় মন্তব্য কখনও দেখেছি বলে মনে পড়ে না! তবে বাংলাদেশে যেটা ভারতের স্বার্থ সেটাই সহি ধরে নিয়ে প্রিন্ট-মিডিয়ার অবস্থান দেখতে পাওয়া যায়!

এদিকটাই আরেক ভাষায় বললে, গত পনেরো বছরের বেশি হবে কোন ভারতীয় পত্রিকা বাংলাদেশের মানুষের হিউম্যান রাইট বা নাগরিক অধিকার রক্ষার পক্ষে কথা বলেছে – এমন রেকর্ড নাই। এমনিতেই,  যদিও ১৯৪৭ সালে কলোনিমুক্ত স্বাধীন তবে বিভক্ত ভারতের জন্মের আগে থেকে এখনও পর্যন্ত “হিউম্যান রাইট ও নাগরিক মৌলিক অধিকার” কখনই ভারতীয় রাজনীতিতে ইস্যু ছিল না। উচ্চারিত হয় নাই; এমনকি তা ভারতের আভ্যন্তরীণ রাজনীতিতেও উচ্চারিত নয়। কারণ, সেই ১৮১৫ সাল থেকেই ভারতে রাষ্ট্র-রাজনীতি বলতে জাতি-রাষ্ট্র বা নেশন স্টেট বুঝা হয়ে এসেছে। আর এতে বলাই বাহুল্য এখানে জাতি মানে একমাত্র সেটা উগ্র হিন্দু-বোধের এক হিন্দুত্ববাদ। অধিকার বা নাগরিক ধারণার যেখানে বালাই নাই! সারকথায়, ভারতে রাজনীতি বলতেই সেটা হল – জাতিবাদ এবং তা এক উগ্র-জাতিবাদ; যা এর বাইরের সব এথনিক-জাতিকে অস্বীকার, তাঁদের উপর চাপায় দেয়া মার্জিনালাইজ বা কোনঠাসা করে রেখে অ-হিন্দু বিশেষ করে মুসলমান নাগরিক এর উপর সামাজিক, কালচারাল ও রাজনৈতিক আধিপত্য কায়েম করে রাখার রাজনীতি।
হিন্দুত্ববাদ মানে যেখানে অধিকার বা নাগরিক ধারণা নাই; কাজ করে না। হিন্দু-শ্রেষ্ঠত্ববাদের এক হিন্দুত্ববাদ ও বোধ সেখানে সব। আর এর বাইরে সবাই কে তারা মেরে, পিটিয়ে অবাধে নির্মুল করবে; এক আধিপত্যের জগত কায়েম করবে করতে হবে এই হল যার সারকথা। এমনকি পড়শি বা অন্যরাষ্ট্র তাঁদেরও যেন নিজ স্বার্থ বলে কিছু নাই। পড়শিসহ অন্য সকল (ছোট) রাষ্ট্রকেই যেন ভারতের রাষ্ট্রস্বার্থকেই  নিজস্বার্থের উপর জায়গা দিতে হবে, তুলে রাখতে হবে। এমনকি খেলাধুলাতেও ভারতের কোন হেরে যাবার দুঃখে ভিন-রাষ্ট্রকেও দুখী হতে হবে, দুঃখবোধ দেখাতে বা প্রকাশ করতে হবে! এটা হিটলারকেও ছাড়িয়ে যাওয়া এমনই এক চরম উগ্র-জাতিবাদ!

ফলে এসব কারণে, ভারতের রাজনৈতিক পরিচয় সম্পর্কে যা কিছুই জানি না দেখি তা দেখলেও সেখানে মানুষের মৌলিক মানবাধিকার বা নাগরিক অধিকার ধরণের কোন ধারণাই ভারতের রাজনীতিতে বা সামাজিক কালচারে নাই।

ভারত ভিন-রাষ্ট্রের কর্তৃত্ববাদী হয়ে উঠার বিরোধীঃ
কিন্তু এই প্রথম ভারতের টাইমস অব ইন্ডিয়া নিজের অবস্থান জানিয়ে সম্পাদকীয়তে বলছে, “হাসিনাকে থামাতে হবে। কারণ তিনি কর্তৃত্ববাদী; বিরোধীশুন্য করতে-দেখতে চান। আর এটা নাকি ভারতেরও স্বার্থবিরোধী ও উদ্বিগ্ন হওয়ার মত হাসিনার এমন এই কর্তৃত্ববাদী স্বভাব!”। এই কথাগুলো তুলে এনেছি,  টাইমস অব ইন্ডিয়া-তে তাঁদের  নয়া অবস্থান জানিয়ে যে সম্পাদকীয় লেখা হয়েছে তার শিরোনাম থেকে। সেটা হল, ” Halting Hasina: India should worry about Bangla PM’s authoritarian streak. It will hurt her interests as well as New Delhi’s” । আমাদের মানবজমিন এর অনুবাদ রিপোর্ট ছেপেছে।

 

“Halting Hasina: India should worry about Bangla PM’s authoritarian
streak. It will hurt her interests as well as New Delhi’s” –

সবচেয়ে মজার কথা শুরুতেই বুকফুলিয়ে টাইমস বলছে, “টাইমস অব ইন্ডিয়ার এডিটরিয়াল টিম যা সিনিয়র জার্নালিস্টদের নিয়ে গঠিত তারা নিজেদের মধ্যে নাকি বিস্তর তর্ক-বিতর্ক শেষে একালের খবরাদি সম্পর্কে নিজেদের মতামত-অবস্থান নিয়ে থাকে [Times of India’s Edit Page team comprises senior journalists with wide-ranging interests who debate and opine on the news and issues of the day] । তাহলে, মানে কী দাঁড়ালো?

গত ১৯৪৭ সালের আগের কথা বাদই রাখলাম। একালে মানে ইন্দিরা গান্ধীর ছেলে রাজীব গান্ধীর আততায়ীর হাতে মৃত্যু হয়েছে ১৯৯১ সালে। অনেকের মনে হতে পারে একালে ভারত উগ্র হিন্দুত্ববাদী হয়ে উঠেছে বোধহয় বিজেপির মোদীর হাতে। না এটা মিথ্যা। বরং এর আগেই রাজীব গান্ধীর হাত ধরেই একালে মুসলমান এথনিক ক্লিঞ্জিং যেটাকে বলে বা “মুসলমান-নির্মুল” নীতি- এর শুরুটা হয়েছে ১৯৮৯ সালে। সেসময়ে এটা হয়েছিল কাশ্মীরে। সেখানে ১৯৪৭ থেকে যতই অস্থিতিশীলতা বা বিরোধ-সমস্যা থাকলেও রাজনীতিতে কোন সশস্ত্রতার ধারা নয় বরং  সেখানকার রাজনীতি ছিল চলে আসা নির্বাচনকেন্দ্রীক এক রাজনীতি। প্রকাশ্য এক গণ বা মাঠের রাজনীতি! রাজীব গান্ধী ১৯৮৯ সালের রাজ্য নির্বাচনে   কারচুপির করে জিতবার সিদ্ধান্ত  ও নীতি নিয়েছিলেন। সেটা এই অজুহাতে যে সেবার ১৯৮৯ এর নির্বাচনে ওমন কারচুপি না করলে নাকি বেশিরভাগ আসনে অ-কংগ্রেসি কাশ্মীরি মুসলমান সেখানে জিতে যাবেন। আর তিনি এই সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন ফারুক আবদুল্লাহর পরামর্শে ও তাঁকে সাথে নিয়েফারুক আবদুল্লাহও ঠিক কংগ্রেসি নন তবে তাঁর বাপের আমল থেকে তাঁদের দল প্রো-কংগ্রেসী!

আর এরপরে বাবরি মসজিদ আক্রমণ থেকে শুরু করে ১৯৯৯ সালে ভারতে বাজপেয়ীর বিজেপির কোয়ালিশন সরকার গঠনের মধ্য দিয়ে ক্রমশ বিজেপি-আরএসএসের উত্থান ঘটে। ইতোমধ্যে নাইন-ইলেভেন মানে (২০০১ সালের ওয়ার অন টেরর) মানে আমেরিকা-ইন্ডিয়ার “জঙ্গী-মারার নামে” এলায়েন্স মানে এশিয়ায় হিন্দুত্ববাদের এক রাজনৈতিক ঐক্য প্রতিষ্ঠা হয়েছিল প্য়রথমে। কিন্তু  অচিরেই সেখান থেকেও আবার সরে গিয়ে সেটা আমেরিকার হয়ে ভারতে চীন ঠেকানোর অজুহাতে ভারতকে ঠিকা দেওয়া; মানে বাংলাদেশকে ভারতের হাতে তুলে দেওয়া – যেটা এভাবে এখন বাংলাদেশ ১৭ বছর পার করেছে। স্বভাবতই এর স্বপক্ষে পুরা সময় জুড়েই ভারতের সমগ্র মিডিয়া ইসলাম কোপানোর বয়ান তুলে মশগুল থেকেছে।
আমরা দেখেছি, বাংলাদেশের প্রতি ভারতীয় মিডিয়ার এটিচ্যুড  সবচেয়ে ভয়াবহ অবস্থা হয়েছে মোদির গত দশ বছরে। এমনিতেই কোভিডের কারণ ভারতের মিডিয়া নিজে চলতে পারে নাই, ঠিকমত বেতন দিতে পারে না। অতএব পত্রিকা চালানোর খরচ মিটাতে মোদির হয়ে মিথ্যা প্রপাগান্ডার হাতিয়ার হয়ে উঠো – সব জায়েজ! আর তাতে ভারতের ‘র’-এর বা গোয়েন্দা বিভাগের প্রমোটেড  ঘরে বসে বানানো রিপোর্ট – ভারতে যারা ছাপে তাঁদের শিখন্ডি মিডিয়া হয়ে উঠো! এই ছিল সেসময়ের মূলনীতি! তাঁদের সে এক মহা কসরত, কার উপর দিয়ে কে যাবে! যার ফলশ্রুতিতে ফাইনালি দাড়ায় মূলত হিন্দুস্তান টাইমসের রেজাউল লস্কর অথবা শিশির গুপ্তা এবং টাইমস অব ইন্ডিয়ার দীপাঞ্জন রায় চৌধুরী এরা হয়ে উঠেন ‘র’-এর হয়ে শ্রেষ্ঠ প্রপাগান্ডিস্ট! যারা র-এর চাহিদা মত রিপোর্ট লিখতে ওস্তাদ! আগ্রহিরা এবিষয়ে আমার পুরানো লেখা পড়ে নিতে পারেন।  আমরা ভারত টাইমস অব ইন্ডিয়াকে এভাবেই চিনতাম!

 

কিন্তু এখন এটা কী হলঃ
কিন্তু হায়!! এটা কোন টাইমস অব ইন্ডিয়া??? যে হাসিনাকে কর্তৃত্ববাদি শাসক বলছে? মোদিকে হাসিনা থেকে সাবধান করে ইডিটরিয়াল লিখছে??? গত ২২ নভেম্বর ২০২৩ টাইমস অব ইন্ডিয়ার এডিটরিয়াল কম করে বললেও গত পন্বরো বছরের একেবারে ১৮০ ডিগ্রি বিপরীত! কেন?
এটা বুঝা কঠিন না যে ২০০৬-৭ সাল থেকে আমেরিকার বাংলাদেশকে ভারতের হাতে তুলে দিবার পর থেকে ভারতীয় মিডিয়া অবাস্থান ছিল যে – যেভাবে পারো বাংলাদেশকে ভারতের পক্ষে লুটে নেও! সব জায়েজ আছে!  বাংলাদেশের উপর দিয়ে আসামের করিডোর থেকে শুরু করে সবকিছু বিনা পয়সায় খাবলে তুলে নিয়ে খাওয়া, বিনা পয়সায় পোর্ট ব্যবহার কিংবা সব নদীর পানি, বাংলাদেশকে ভারতের বাজারে পরিণত করা, সীমান্তে সমানে বাংলাদেশি হত্যা ইত্যাদি যাকিছু ভারতের স্বার্থের পক্ষে যায় বলে তারা মনে করেছে তাই ভারতের মিডিয়া সঠিক ও জায়েজ মনে করে মিথ্যা প্রপাগান্ডা রিপোর্ট লিখে গেছে! সাথে ছিল জঙ্গী আবিস্কার আর জামায়াত কোপানোর নামে ইসলাম কোপানো মুসলমানবিদ্বেষে ভরপুর এক মহোৎসব চালিয়ে গেছে ভারতের মিডিয়া। বাংলাদেশের  প্রতিটা নির্বাচনে ভোটবিহীন তামাসা চলেছে – অথচ ভারতের একটা মিডিয়া এগিয়ে আসে নাই, টু শব্দটাও করে নাই! তখন তারা কোথাও হাসিনার কর্তৃত্ববাদ দেখে নাই; রাতের ভোট হয়েছে তারা জানে নাই! সবচেয়ে ভয়ঙ্কর ছিল ২০১৩ সালের ডিসেম্বর ভারতের পররাষ্ট্র সচিব সুজাতা সিংয়ের বাংলাদেশের নির্বাচনে হস্তক্ষেপের সফর। বিএনপি ও জামায়াত-কে বাদ দিয়ে নির্বাচন করতে হবে; আর এরশাদের জাতীয় পার্টিকে বিরোধি দল বানাতে হবে। এই ব্যববস্থাপনার কারিগর ছিলেন সুজাতা সিং যা এরশাদের সাথে মিটিয়ের পরেই খোদ এরশাদ-ই তা মিডিয়ার সামনে প্রকাশ করে দিয়েছিলেন। কিন্তু মজার কথা কোন ভারতীয় মিডিয়া এনিয়ে কোন রিপোর্ট করে নাই। কারণ তাঁদের নীতি ছিল দুনিয়াতে ন্যায়-অন্যায়, সাংবাদিকতা-অসাংবাদিকতা, সঠিক-মিথ্যা বলে কিছু নাইযাই ভারতের স্বার্থে তাই জায়েজ এই ছিল তাঁদের নীতি; তাই পুরাটাই মিথ্যা ও অন্যায় হলেও সেই অন্যায়ের পক্ষেই ভারতের মিডিয়াকে থাকতে হবে…!  এই ছিল গত পনেরো বছরের (দু-একটা ব্যতিক্রম বাদে) ভারতীয় সাংবাদিকতা! যা এখনও বর্তমান!!!
কিন্তু তাহলে এর ভিতরে – এটা কোন টাইমস অব ইন্ডিয়া??? যে হাসিনাকে কর্তৃত্ববাদি শাসক বলে বুঝছে???

কথা আরও আছেঃ
টাইমসের রিপোর্টের ছন্দ-মিলানো প্রথম বাক্যটাই রীতিমত শায়েরি! বলছে, বাংলাদেশ ৭ জানুয়ারি যাচ্ছে নির্বাচনে [POLL]; কিন্তু বিরোধীরা যাচ্ছে সাজাপ্রাপ্ত আসামী হিশাবে জেলে[JAIL] । ইংরাজিতে পোল আর জেলের অলংকার মিলিয়েছে। আর এর চেয়েও মারাত্মক হল কোন ভারতীয় মিডিয়ার সম্ভবত এই প্রথম জামা‍য়াতে ইসলামী এই রাজনৈতিক দলের প্রতি সহানুভুতি প্রকাশ। লিখছে, [one big party stays banned.]; মানে জামায়াত নিষিদ্ধ করে দেয়া রায় বলবত রাখাকে এক ভারতীয় মিডিয়া ইউজুয়াল বদ-দোয়া দেওয়ার বদলে সহমর্মিতা জানিয়ে রিপোর্ট করছে!  যার ইঙ্গিতটা হল, এটা মতপ্রকাশের অধিকার, কনষ্টিটিউশনের সীমার মধ্যে থেকে রাজনৈতিক  দল খুলার ও জমায়েতের অধিকারকে জবরদস্তিতে কেড়ে নেওয়া, কোনঠাসা করা – মানে এককথায় রাজনীতিক ও দৈহিক নিপীড়ন করা হয়েছে এই রাজনৈতিক দলকে। তাই রিপোর্টটা একারণে জামায়াত-কে এই প্রথম ভিকটিম হিশাবে দেখছে ও দেখাচ্ছে!!! তাহলে এটা কোন টাইমস অব ইন্ডিয়া!!!  অথচ একালের এই ভারতই অন্তত গত ১৭ বছর ধরে লাগাতরভাবে জামায়াতের একাত্তর সালের ভুমিকার বিরোধিতার আড়ালে ইসলাম-মুসলমান রিলেটেড সবকিছুর বিরুদ্ধে বিদ্বেষ চালিয়ে গেছে; শত্রুতা চালিয়ে গেছে। জামায়াত জঙ্গী-সংগঠন বলে প্রচার চালিয়ে নিজেদের সব অনৈতিক ততপরতাকে জায়েজ করতে গিয়েছে!
একইভাবে বিএনপির পক্ষেও সহানুভুতিশীল হয়ে রিপোর্ট করেছে; যা অবিশ্বাস্য! বলেছে বিএনপির ১৩৯ জন নেতাকে সাজা শুনিয়ে দিয়েছে; তারা যেন নির্বাচন থেকে দূরে থাকে এর ব্যবস্থা করেছে!  এমনকি হাসিনার নিজে ক্ষমতায় থেকে নির্বাচন মানে কোন কেয়ার-টেকার সরকারের অধীনে নির্বাচন করার যে আইনটা ছিল সেটা হাসিনারই বাতিলের জন্যও এই প্রথম হাসিনাকেই দায়ী করলো এক ইন্ডিয়ান মিডিয়া!! মানে টাইমস অব ইন্ডিয়া, বাংলাদেশে তত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন হওয়া উচিত এই দাবির প্রতি (তবে পরোক্ষে) সমর্থন জানিয়ে দিল!!!  আর এভাবে বিএনপির রাস্তার আন্দোলনকে জায়েজ করে দিয়ে এই মিডিয়া লিখেছে BNP is just doing street theatre when demanding restoration of the caretaker system.। যা নিয়ে একটা ভারতীয় মিডিয়াকে আমাদের বলার আছে একটাই – এটা আন-ইউজুয়াল! আমরা ভারতের মিডিয়ায় এটা দেখতে অনভ্যস্ত ছিলাম!

“one big party stays banned.
The top court upheld a previous ban
on Jamaat-e-Islami – Bangladesh’s
largest Islamist party – from contesting elections.”

এতদুর পর্যন্ত যা দেখলাম তাতে এটা পরিস্কার ভাবে বুঝা গেছে যে টাইমসের এটা এক বড় ধরণের অবস্থানের পরিবর্তন। এতদিন যা ছিল ‘র’-এর মুখপাত্র হয়ে সার্ভিস দেওয়ার এক মিডিয়া প্রতিষ্ঠান সেই টাইমস অব ইন্ডিয়া এখন বাংলাদেশের শাসক শক্তি অথরিটিটিয়ান – মানে বাংলাদেশের শাসক কত খারাপ তা দাবি করে দেখানোর প্রতিষ্ঠান – হয়ে উঠতে চাইছে! তাহলে এই পরিবর্তনের কারণ কী? আবার যেখানে এটা ভারতের অন্য আর কোন মিডিয়ার মধ্যে এমন পরিবর্তন এখনও দেখা যায় নাই!
এককথায় বললে, ভারতের মিডিয়া এখনও একালেও এমন নুন্যতম পলিটিক্যাল এথিক্স মেনে কেনে চলার প্রতিষ্ঠান হয়ে উঠতে পারে নাই। যেমন আগে এতদিন যা ছিল ‘র’-এর মুখপাত্র হয়ে সার্ভিস দেওয়ার এক মিডিয়া প্রতিষ্ঠান; বুঝাই যেত সেটারও মূল চালিকাশক্তি ছিল অর্থ; কোন আদর্শিক অবস্থান তা ছিল না! তাহলে এখনকার এই পরিবর্তনও  অনুমান করি কোন আদর্শিক অবস্থান নয়! যার সোজা মানে বিক্রেতা-মিডিয়ার ক্রেতা-গ্রাহক সম্ভবত এখন বদলে গিয়েছে! আগে ছিল ক্রেতা ভারত সরকারের এক প্রতিষ্ঠান ‘র’-এর মুখপাত্র হয়ে  সার্ভিস দেওয়ার প্রতিষ্ঠান। আর তাহলে এখন?

টাইমস অব ইন্ডিয়ার সার্ভিস ক্রেতা এখন কেঃ
তাহলে টাইমস অব ইন্ডিয়ার  এখন এই অবস্থান বদল হওয়াতে এখনও কী মোদি সরকারই আছে? তা মনে হচ্ছে না। যদিও এটা সত্য যে জয়শঙ্করের অফিস বা পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় হাসিনা আবার ক্ষমতায় আসুক কিংবা না – সেব্যাপারে তার খুব কিছু করণীয় আছে তা মনে করা না। যদিও তাই বলে কিছু লিপ-সার্ভিস বা কিছু রুটিন সম্পর্ক অবশ্যই আগের মত ভালই বহাল আছে।  তবুও বাংলাদেশের সরকার কর্তৃত্ববাদী কী না সেটা  টাইমসের এই দ্দেখে ফেলার সাথে কখনই মোদির রাজনীতির কোন সম্পর্ক নাই। কাজেই টাইমস অব ইন্ডিয়ার নয়া অবস্থানের পৃষ্টপোষক-অর্থদাতা অন্তত বিজেপি-মোদি নন। তাহলে কে হতে পারে?

এর তালাশে আমরা এখন টাইমস অব ইন্ডিয়ার এই সম্পাদকীয়ের বাকি অংশে ফোকাস করব। যদিও কোন সম্পাদকীয় ছোট লেখাই হয় আর টাইমসের এই সম্পাদকীয়ও ছোট পাঁচশ- অক্ষরের নিচে। তাহলে এই শেষের অংশে কী আছে?

সম্পাদকীয়ের শেষ অংশ ‘মারাত্মক’ কী আছেঃ
সংক্ষিপ্তভাবে মারাত্মক সেই কথা হলঃ উপরে আমরা দেখেছি, টাইমস অভিযোগ হাসিনা সরকার অথরিটি-টেরিয়ান যে নিজেকে বিরোধিশুন্য দেখতে চায় মানে তার রাজনৈতিক সকল বিরোধী শক্তিকে সমাজ থেকে নির্মুল করতে ও দেখতে চায় ক্ষমতাসীনেরা। এবং সেই লক্ষ্যে এগিয়ে যাচ্ছে। এখন বিরোধীশুন্য কথা টার অর্থ-তাতপর্য কী? কারণ, যেকোন ক্ষমতাসীনরা দাবি করতেই পারে যে বিরোধী দল আমাদের চাপ সহ্য করে মাঠের রাজনীতিতে টিকে থাকতে না পারলে আমরা কী করতে পারি – এমন বয়ান দিতেই পারে। কিন্তু এমন বয়ান কী জায়েজ? নাকি এটা ইনোসেন্ট বা নিঃস্পাপ বয়ান যে ভাজা মাছ উলটে খেতে জানে না?

না অবশ্যই না। এই বয়ান জায়েজ নয়! এর সোজা সহজ উদাহরণ হল, ক্ষমতাসীন যদি নির্বাচনে কৌশলে রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানকে বিরোধীদলের জন্য সুবিধাজনক নয় – এভাবে করে সাজায়? মানে হল, রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোকে দল নিরেপেক্ষ করে না সাজায়? মানে ক্ষমতাসীন দলের পক্ষে কান্নি মেরে থাকা পুলিশ ও প্রশাসন হয়ে হাজির হয়?
এখন এই ব্যাপারটাই হয়েছে কীনা এর সবচেয়ে ভাল প্রমাণ হল – ক্ষমতাসীনদের কিছু বয়ান এর দিকে তাকাতে হবে। যেমন বাংলাদেশের ক্ষমতাসীন হাসিনা সরকারের এক প্রিয় শ্লোগান হচ্ছে তারা মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষের শক্তি আর অন্যদিকে জামাত-বিএনপি এর বিপক্ষের! এতদুর শুনে কেউ মনে করতে পারে এর মধ্যে খারাপ কী আছে?  অথচ এটাই হল, সরকারের দিক থেকে রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোকে দেয়া ম্যাসেজ যে তোমরা এখন বিরোধীদের সাথে সবকিছুতে বৈষম্যমূলক আচরণ করতেই পার, এটা জায়েজ আছে! কারণ তারা সবাই তো মুক্তিযুদ্ধের বিপক্ষের শক্তি! আমি সরকার সেটা বলে দিয়েছি! সুতরাং এটাই তোমাদের প্রটেকশন ভাষ্য! যেমন খেয়াল করে দেখেন বাংলাদেশের একজন অভিনেতা সম্প্রতি ক্রিকেটে ভারতীয়দের হারে খুশি হওয়া যাবে না – যারা খুশি হয় তারা  মুক্তিযুদ্ধের বিপক্ষের শক্তি বলে ব্যাখ্যা খাড়া করছে! আর এমন বয়ান এটারই চরমতম রূপ হল, আমাদের রাষ্ট্রটাকে গুম-খুনের  রাষ্ট্র হিশাবে হাজির করা – এটাই হয়ে যাবে আর যার সাফাই হবে যারা “মুক্তিযুদ্ধের বিপক্ষের শক্তি!” বলে সরকার প্রচার করবে তাঁদের কোনই রাজনৈতিক নাগরিক অধিকার তো নাই-ই!  তাই তাদেরকে গুম-খুন অপহরণ ইত্যাদি সব তো করাই যায়! এবং যাবে!!!

তাহলে সারকথাটা হল, আমি ক্ষমতায় আর আমার রাজনৈতিক-বিরোধিদের যদি আমি আমার মতই সমান রাজনৈতিক, নাগরিক অধিকার না দিয়ে (নানা উসিলায়)  দাবায় রাখতে পারি তাহলে সেটাই পরিণতিতে ২০১৪, ২০১৮ বা ২০২৪ সালের মত নির্বাচনই হবে! শুধু তাই না, সেটা এবার এই রাজনীতিক মাঠশুন্যতা – এটাই কাশ্মীরের মত রাজনীতি আর তখন নির্বাচন-কেন্দ্রিক থাকবে নাসশস্ত্রতার রাজনীতির পথে পা বাড়াতে চাইবে!

ঠিক এদিকটা খেয়াল রেখে তাই টাইমস তার সম্পাদকীয়ের শেষের দিকে বলছেঃ “But what raises eyebrows and concerns is the vacuum previously occupied by the opposition. Marginalising mainstream opposition parties is an invitation to radical elements in Bangladeshi politics”
মানে হল, বিরোধীদলদেরকে মিথ্যা মামলায় সাজা দিয়ে জেলে রেখে নির্বাচন, মাঠে মিটিং মিছিল জমায়েত, মতপ্রকাশ ইত্যাদি সবকিছু থেকে তাঁদের বঞ্চিত করে দেওয়া – মানে এক শুন্যতা বা ভ্যাকুয়াম তৈরি করা – এর সোজা মানে হল, সশস্ত্র রেডিক্যাল রাজনীতিকে দাওয়াত দেয়া। বাংলাদেশের রাজনীতির প্রধান ধারা হয়ে উঠতে সশস্ত্র রাজনীতিকে দাওয়াত দেয়া বা ঠেলে দেওয়া।

এরপরে আরো দুইটা প্যারা আছে। এর প্রথমটায় বলছেঃ
“Then there is the US factor. Washington is clearly concerned about charges of authoritarianism against Hasina and is viewing Bangladesh as part of its larger strategic tussle with China.”
মানে হল বলছেঃ “এর সাথে আছে আমেরিকা ফ্যাক্টর। যারা তাই হাসিনার এভাবে কর্তৃত্ববাদী উত্থানে উদ্বিগ্ন বিশেষ করে এর সাথে চীন-আমেরিকার যে কৌশলগত টানা-হেচড়া আছে সেদিক থেকে দেখলে”।  অর্থাৎ টাইমস ইঙ্গিত দিচ্ছে আমরা অনুমান করি যে এর অর্থ হবেঃ কর্তৃত্ববাদী হাসিনার থেকে যাওয়া মানে তাতে বাংলাদেশে চীনের প্রভাব বাড়বে!


আর টাইমস অন ইন্ডিয়ার লেখার শেষ বা সিদ্ধান্ত বাক্য টা হল এভাবেঃ

“Unless the opposition is given the space it should have, radical elements will create space they don’t currently have. That’s terrible news for India. A radicalised Bangladeshi establishment can bring Pakistan back into play. New Delhi should tell Hasina to change tack, in its, and her, interest.”

অর্থ হলঃ “হাসিনা যদি তার রাজনৈতিক বিরোধীদেরকে রাজনীতিক-বিরোধীতা করার জায়গা না দেন (অর্থাৎ জেলে রেখে নির্বাচন, মাঠে মিটিং মিছিল জমায়েত, মতপ্রকাশের অধিকার ইত্যাদি সবকিছু থেকে বঞ্চিত করে দেয়) তবে রেডিক্যাল বা সশস্ত্র রাজনীতিক ধারা ঐ স্থানটা দখল করবে যাদের জায়গা এখনও বাংলাদেশে তেমন নাই! আর এটাই ভারতের জন্য খুবই ভয়ঙ্কর সংবাদ হবে!”।

এরপরের বাক্যের অর্থ এটা একেবারেই কোন ভারতীয় লেখকের হিন্দুত্ববাদী ঘৃণা। এছাড়া তারা কখনই কোন রেফারেন্সে-ছাড়াই পাকিস্তানকে না জড়িয়ে বা গালি না দিয়ে থাকতে পারে না। সেই পটভুমিতে পরের বাক্যটা হলঃ একটা রেডিক্যাল (সশস্ত্র) বাংলাদেশ এটা পাকিস্তানকে মাঠে ফিরে ডেকে আনতে পারে! (অর্থাৎ এরমধ্যে পাকিস্তান কোথা থেকে এল কেউ জানে না) “তাই নয়াদিল্লির উচিত হবে হাসিনাকে সামলানো তাকে স্বার্থ-অভিমুখ বদলাতে বাধ্য করা!”।

এই শেষের বাক্যটাও একই মিথ্যা হামবড়া তবে মুরোদহীন ভারতকে জাগানোর বা এর এখনও হাসিনাকে নিয়ন্ত্রণের যেন ক্ষমতা আছে এই ভাব নিয়ে বলা কথা! কারণ, ভারত যেন একটা বিরাট ক্ষমতাবান কুতুব  এই ভাব না ধরলে ভারতীয় সাংবাদিকের কলমের আগায় যেন কালি আসে না !  অথচ এতদিন হাসিনা যতটুকু চীনের সাথে সম্পর্ক বা ঘনিষ্ঠতা কায়েম করেছে তা কী ভারত ঠেকাতে পেরেছে? কাজেই হাসিনার যা সক্ষমতা সেটার সবই যেন ভারতের দেয়া এমন ভুয়া দাবির দরকার কী??? আর ভারত যা চায় এর বাইরেও হাসিনার নিজস্ব স্বার্থ বলে অনেক কিছু আছে এবং তা থাকাই স্বাভাবিক! তাতে হাসিনার স্বার্থের কোন ন্যায্যতা থাকুক আর নাই থাকুক!


তাহলে টাইমসের এই অবস্থান বদল কেন ঘটলঃ

টাইমসের এই অবস্থান বদল কেন ও এর তাতপর্য কী, এনিয়ে কিছুটা উপরে দাবি করে বলেছি যে, এই বদল বিজেপির মোদির আগ্রহে ঘটে নাই। কারণ টাইমসের বদলি অবস্থান কোনভাবেই সেটা মোদির রাজনীতি নয় যে মোদি হিউম্যান রাইট বা নাগরিক অধিকারের পক্ষে কথা বলবেন বা টাইমস-কে বলতে বলবেন বা অর্থ দিবেন!
আর টাইমস মানে টাইমস অব ইন্ডিয়া কোন অর্থপ্রাপ্তি ছাড়াই এমন সম্পাদকীয় লিখার কারণ নাই! তাহলে?

খুব সম্ভবত এটা কোন আমেরিকান উদ্যোগ! এমন অনুমান করাটা আশা করি ভুল হবে না!  যা সাধারণত কোন থিঙ্ক-ট্যাংক বা এনজিও এর মাধ্যমে হয়ে থাকে। আর এটা বাইডেনের মানবাধিকার, নাগরিক অধিকার বা স্যাংশনের পররাষ্ট্রনীতির সাথে সামঞ্জস্যপুর্ণ, মানে সাথে যায়!
তবে মূলকথাটা হল, হাসিনা যদি এবারও ২০১৪, ২০১৮ এর মত একই পথে বিজয়ী হতে পারে তবে টাইমস অব ইন্ডিয়ার মুখ দিয়ে প্রকাশিত এই আশঙ্কা সত্যি হবার সম্ভাবনা!

 

আপডেটঃ  ২৬ নভেম্বর  ২০২৩,  সন্ধ্যা ০৭ঃ ৪০
সর্বশেষ আপডেটঃ ২৭ নভেম্বর  ২০২৩,  রাত ১২ঃ ৪৭

গৌতম দাস
রাজনৈতিক বিশ্লেষক
goutamdas1958@hotmail.com

 

 

 

2 thoughts on “টাইমস অব ইন্ডিয়ার চশমা বদলঃ বাংলাদেশে ‘কর্তৃত্ববাদী’ শাসনে নিজের বিপদ দেখছে

  1. স্যার আসসালামু আলাইকুম।

    স্যার আপনি অখণ্ড ভারত নিয়ে অনেক লিখেছেন। ২৪-২৫ বয়স হওয়ায় আপনাকে বছর তিনেক ফলো করি। বাংলাদেশের নতুন শিক্ষা কারিকুলাম কোনো ভাবেই অখণ্ড ভারত নীতি সফট ভাবে যুক্ত আছে কি না তা নিয়ে যদি কিছু লিখতেন। https://youtu.be/DjZaURvER28?si=mP0RHLaRrdfBt5Oe

    Like

Leave a comment