আমাদের নির্বাচন ও একজন প্রতীম রঞ্জন বোস


বাংলাদেশের নির্বাচন ও একজন প্রতীম রঞ্জন বোস
গৌতম দাস
২৯ ডিসেম্বর ২০২৩  রাত ২০ঃ ২৭
https://wp.me/p1sCvy-5ef

        Bangladesh: As elections draw close, India needs to rethink its strategies

বাংলাদেশে নির্বাচন হচ্ছে মনে করে এনিয়ে পাড়া-পড়শি বিদেশি বিশেষ করে ভারতের ঘুম নাই। আপ্রাণ খেদমত করে চলেছে, যেভাবে পারে যেন কোনকিছুই মিস না হয়!। এর উপর আছে ভারতের মিডিয়াগুলো তারা গড়ে মনে হয় প্রতিদিন একেকটা করে মন্তব্য আর্টিকেল ছেপে চলেছে। যেসবের হিসাব রাখাও কঠিন! গত ২১ ডিসেম্বর ২০২৩ তেমনই একজন প্রতীম রঞ্জন বোস [ PRATIM RANJAN BOSE]; তিনি লিখেছেন MONEY CONTROL নামে এক পত্রিকায়। যেটা বিজনেস ইনভেস্টমেন্ট ফোকাস এক ওয়েব পত্রিকা। যাকে বাংলাদেশের খুব কম মানুষই চিনে আবার নামটা বিদঘুটে  ও একটু অপ্রচলিত বলে হয়ত বাংলাদেশে অপরিচিত তো বটেই; আমিও আগে দেখেছি কিন্তু এই প্রথম এর এত ভিতরে গিয়ে খোঁজ নিলাম। কিন্তু সেটা না, এর এই লেখক বরং নিজের পরিচয় দিয়েছেন এভাবে যে তিনি ইন্ডিপেন্ডেন্ট কলামিস্ট, রিসার্চার ও কনসালটেন্ট!  এসব কিছুর মধ্যে ভারতের প্রেক্ষিতে ইন্ডিপেন্ডেন্ট শব্দটা বড় অদ্ভুত ও বেমানান। ভারতে এখন মিডিয়া ও এর লেখক বলতে বুঝায় যারা জার্ণালিজম ভুলে পেশাদার প্রপাগান্ডিস্ট যারা সত্য-মিথ্যা মিশিয়ে এর ঢোল পিটানোর ওস্তাদ লোক হয়েছে! আর তাই বেশির ভাগ সময়ে দেখা যাচ্ছে যার টাকা আছে বা খোদ মোদি সরকার যে অর্থ বিলায় এরা চোখ বন্ধ করে তা খেয়ে নিয়ে এরই ঢোল পিটায়, প্রপাগান্ডা করে বেড়ায়। এটাকে সাংবাদিকতা মনে করে আবার, স্পেশালিস্ট বলে দাবিও করে।  তাতে ভারতের শেখর গুপ্তার মত সিনিয়র সম্পাদক  হলেও সবার স্বভাব এখন এক; মানে  ‘একই ওষুধ প্যারাসিটামলের’ স্বভাব বৈশিষ্ঠই সকলের! লক্ষ্য যা করেই হোক অর্থ আয় আর খেয়ে পড়ে বৌ-বাচ্চা নিয়ে টিকা থাকাই তাদের জীবন ব্রত!  মোদির পক্ষে সাফাইয়ের চিল্লা দিলে সবচেয়ে বেশী অর্থ মিলে তাই সবার লক্ষ্য এখন সেদিকে! কার উপরে কে যাবের প্রতিযোগিতা!

তো ভারতের এমন মিডিয়া আসরে কেউ যখন লিখে দাবি করেন তিনি ইন্ডিপেন্ডেন্ট, এটা একটা কাহিনী তো বটেই। এর অবশ্য এক নেগেটিভ মানেও হয় যে বাজারের যারা প্রপাগান্ডা-সওদা কিনবেন এমন কাউকে তিনি যোগাড় করতে পারেন নাই তাই তিনি ইন্ডিপেন্ডেন্ট বা স্বাধীন সাজছেন হয়ত।  সেটা যাই হোক তবে আমরা সেটাও পরীক্ষা করব।

ন্যায়-ইনসাফ  নাকি দেশপ্রেমঃ
একটা বিতর্কে প্রবেশ করা যাক!  ন্যায়-ইনসাফ  নাকি দেশপ্রেম – সবার আগে কোনটা  মানুষের বিবেচনায় প্রধান্য হওয়া উচিত? মানুষের এদুইয়ের কোনটার ভিত্তিতে পরিচালিত হওয়া উচিত? কোনটা বেছে নিব আমরা?  মানে, ধরা যাক কোন দেশ বা মানুষের জন্য  কোন  বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে হবে। এখন এক্ষেত্রে দুইটার একটা বেছে নিতে হবে – ন্যায়-ইনসাফ  নাকি দেশপ্রেম – তাহলে আমাদের কী বেছে নেয়া উচিত?  এই মারাত্মক প্রশ্নটা আগে ফয়সালা করতে হবে; খুব জরুরি এটা।

“দেশপ্রেম” নিয়ে একটু বলে নেই। দেশপ্রেম ধারণাটা প্রবল হয়ে উঠেছিল বিশেষ করে বিশ্বযুদ্ধের (১৯৪৫) পরে যখন সারা দুনিয়া কলোনিমুক্ত হয়েছিল তখন আমাদের মত দেশের মানুষ স্বাধীন জাতিরাষ্ট্র (নেশন স্টেট বা Nation State) হয়েছিল। জনগণের শাসনের ব্যবস্থা বলতে রিপাবলিক রাষ্ট্রই বুঝা হত। তবে তা নেশন স্টেট বা জাতিরাষ্ট্র রূপ্টাই রিপাবলিক রাষ্ট্র মনে করা হত। অর্থাৎ কোন না কোন জাতি পরিচয়ের রাষ্ট্র ধারণা ছিল সেটা। আর বলা বাহুল্য সেটা এর বিপরীতে অধিকার-ভিত্তিক রিপাবলিক রাষ্ট্র ধারণা ছিল না। যাই হোক জাতিরাষ্ট্র ধারণার সাথে সংশ্লিষ্ট কিছু বোধের অন্যতম হয়ে উঠেছিল এই “দেশপ্রেম” ধারণা। সে কারণে “দেশপ্রেম” ধারণাকে সর্বোচ্চ জ্ঞানের কথা  বলে জেনেছে-শিখেছে বলে মনে করাও শুরু হয়েছিল তখন। আর দেশপ্রেম-বোধ এটাকে এক উচ্চমার্গের জ্ঞানবোধ মনে করা হয়েছিল। আর এরই ফাঁদে পড়ে তারা এতদিনের ন্যায়-ইনসাফ বোধ যাকে যেকোন জ্ঞানের মুখ্য ও কেন্দ্রিয় বিষয় বলে আমাদের মত দেশের  মানুষ ভাবত যেখানে বাকি সবকিছু এর পরে সেই নীতি – এই ভুল পথে এবার তারা পুর্ব অবস্থান ত্যাগ করা শুরু করেছিল,  তুচ্ছ করে ফেলেছিল।  ফলে এদের চোখে দেশপ্রেম বড় বা প্রধান হয়ে যাওয়া থেকেই বা গণ্য হওয়াতেই ন্যায়-ইনসাফ বোধ পিছনে পরে যাওয়া শুরু হয়েছিল।  আর তারা দেশপ্রেমের চক্করে পরে নিজের বিচার-বিবেচনার উপর ভরসা না করে আবেগ বা দেশপ্রেমের আবেগ – এর ব্যবহার বা কাজে লাগানোর বাটপারীর পথেও রওনা হয়েছিল। আর তাই জাতিরাষ্ট্র মানেই হয়ে উঠেছিল হুশ হারিয়ে আবেগ-সর্বস্ব দেশপ্রেমের জয়গান গাইতে শুরু করা। অথচ যুগ যুগ ধরে একমাত্র ন্যায়-ইনসাফই সমাজকে ভিত্তি দিয়েছে, স্থিতিশীলতা দিয়ে গেছে; তা ভুলে এরা সকলে দূরে চলে যেতে লাগল। যেখানে এই কথিত দেশপ্রেমের জাতিরাষ্ট্র এমনও বলতে শুরু করল যে আমার নিজ ধর্মের অনুসারীদের পক্ষে থাকাই নাকি দেশপ্রেম! অথচ এব্যাপারে ধর্মের ভাষ্য-অবস্হানও হল ইনসাফ! দেশপ্রেম নয়।  আর ওদিকে এই আলগা বুঝের দেশপ্রেমের কারণে, তাতে দেশের সব ধরণের নাগরিক সমান অধিকার, সমাদর (সম-আদর বা ট্রিটমেন্ট) ও সমান মর্যাদার ধারণ আর জায়গা পেল না; আর এসব কথিত দেশপ্রেমিকেরা এথেকে বেখবর থেকে গেল!   অথচ ন্যায়-ইনসাফের পক্ষে ও ভিত্তিতে নেয়া সিদ্ধান্ত ও এমন থাকার নীতিই কেবল একমাত্র এক দেশপ্রেমের রাষ্ট্র হতে পারে। যেখানে দেশপ্রেমকে ন্যায়-ইনসাফের অধীনে রাখতে হবে – এই হল নীতি!  যেখানে ন্যায়-ইনসাফ ছাড়া কোন কিছুকে দেশপ্রেমের ভিত্তি বলে বিবেচিত হতে পারে না।

ঠিক যেমন, সমাজে গায়ের জোরে কোন ব্যক্তি শক্তিশালী এর ভিত্তিতে সমাজ পরিচালিত হতে পারে না আর কোনটা বা কারো কোন কাজটা সঠিক তা নির্ধারণ হতে পারে না। এভাবে সমাজ উঠে দাড়ায় না। একমাত্র ন্যায়-ইনসাফের ভিত্তিতেই সমাজ গড়ে উঠতে পেরেছিল, স্থিতিশীল হয়েছিল; এটা আমরা ভুলতে পারি না!
আমরা শরীরের প্রবাহিত রক্ত কেমন ও কী জাতের কোন পুর্বসুরি জনজীবনের – এই অর্থে রেস [race]  এর বাংলা জাতি। এই অর্থে দুনিয়ার নানা ভুগোলে নানান মানুষ-জাতিতে আমরা অনেক রেস হয়ে দুনিয়াতে আছি। আবার  ধর্ম, সমাজ, কালচার, খাদ্যাভাস, ভাষা ভিত্তিক ইত্যাদির আরেক জাতি ধারণাও আছে যাকে এথনিক [Ethnic] জাতি বলা হয়। এটা আরেক ধরণের জাত-পরিচয়। যে অর্থে আমরা বাঙ্গালী – সেটা আসলে এক এথনিক জাতি পরিচয়। তাহলে এখন কথা হল, আমার বাঙালি জাতির লোকের পক্ষে থাকা মানেই কী সেটা আপনাতেই এক ন্যায়-ইনসাফের পক্ষে থাকা হবে বা হয়ে যাবে???? কথাটা আরও সোজা করে বললে, বাঙ্গালী জাতিরাষ্ট্রে স্বার্থের পক্ষে থেকে দাঁড়িয়ে দেশপ্রেম দেখানো মানেই কী সেটা ন্যায়-ইনসাফের পক্ষে থাকা হয়ে যাবে?  না, অবশ্যই না। যেকোন দেশপ্রেমের কথারও আগেই মানে, সবার আগে ন্যায়-ইনসাফের কথা বা বিবেচনাবোধ আসতেই হবে।  কিন্তু এখানে কেন দেশপ্রেমের আগেই ন্যায়-ইনসাফের কথাটা তুললাম?

ইন্ডিপেন্ডেন্ট প্রতীম রঞ্জন বোস, আসলে কেঃ
উপরের ন্যায়-ইনসাফ বনাম দেশপ্রেম তর্কটা এনেছিলাম এজন্য যে  প্রতীম নিজেকে ইন্ডিপেন্ডেন্ট মানে স্বাধীন বলে দাবি করছে। তাতে তিনি হয়ত মোদির যুগে ব্যাপকভাবে বিক্রি হয়ে যাওয়া মিডিয়া মানুষ নন তিনি – এই যুগেও হয়ত কারও দ্বারা প্রভাবিত নন বা কেউ তাকে কিনে পরিচালিত করছেন এমন না; এই অর্থ সেটা হতেও পারে। কিন্তু এই অর্থেও হয়ত প্রতীম নিজেকে স্বাধীন দাবি করছেন বললেও এই কথাটাও সঠিক না। কেন? কথাটা আরেকভাবে বলি,  এটা সত্যি যে তিনি সুবীর ভৌমিক, আবদি বা চন্দন নন্দীর মত “র”-এর প্রপাগান্ডা এসাইনমেন্ট খাটা বা নেওয়া ব্যক্তিরা যেমন হয় ঠিক সেরকম লেখক নন হয়ত, এমনই মনে হয়েছে। এই বিবেচনায় হয়ত তিনি স্বাধীন নিজের মতামত-ই লিখেছেন। কিন্তু তিনি দেশপ্রেমি নেগেটিভ অর্থে! যারা ধরে নিয়েছেন দেশপ্রেমের পক্ষে থাকা মানেই তা ন্যায়-ইনসাফ এর পক্ষে নেয়া অবস্থান।  ফলে এদের কাছে কথিত দেশপ্রেম মানেই তা জায়েজ!! এই হল প্রতীম রঞ্জনের এক গভীর ও মূল সমস্যা!

এমনিতেই ইন্ডিয়া হিন্দুত্ব জাতবাদী এক ‘নেশন স্টেট’ হয়ে আছে জন্ম থেকেই; এর উপর আছে আবার উগ্র-হিন্দুত্ববাদী এক রাষ্ট্র ও সরকার; ফলে এর যেখানে দেশপ্রেম মানেই হিন্দুত্ববাদ ভিন্ন আর কোন ব্যাখ্যা নাই মানে,  এখানে উগ্র দেশপ্রেমের আড়ালে চলা  উগ্র হিন্দুত্ববাদের দেশ এটা – সেখানে এই লেখক প্রতীম রঞ্জন বোস তিনিও দেশপ্রেমের নামে আউড়ালে এর মানে কী দাঁড়ায় পাঠক বুঝে নেন; আর প্রতীম তার সব কাজ জায়েজ করতে এসেছেন দেশপ্রেমের কথা তুলে!!!। বলাই বাহুল্য এটা চরম বে-ইনসাফি ন্যায়ভ্রষ্ট; এই হল মারাত্মক ফারাক! কারণ, তার কথিত দেশপ্রেম যা ভারত রাষ্ট্রের স্বার্থের পক্ষে থাকার দেশপ্রেম বলে আপাত মনে হয় সেটা আসলে ন্যায়-ইনসাফের তোয়াক্কা না করা এক অন্ধ বিপদজনক দেশপ্রেম। এককথায়, ভারতের স্বার্থের পক্ষে থাকা মানেই দেশপ্রেম তাতে, এতে ন্যায়-ইনসাফের লেশমাত্র না থাকলেও তা জায়েজ! এই ভিত্তির উপর দাঁড়িয়ে এলেখা লেখা হয়েছে!

লেখা কলামের পর্যালোচনাঃ
প্রতীমের এই লেখার শিরোনাম বাংলা করে লিখলে – “বাংলাদেশঃ এর নির্বাচন ঘনিয়ে আসছে, ভারতের উচিত নিজ অনুসৃত কৌশল পুনর্বিবেচনা করা” [Bangladesh: As elections draw close, India needs to rethink its strategies]।  আমাদের মানবজমিন (২২ ডিসেম্বর ২০২৩) অবশ্য এর একটা অনুবাদ ছেপেছে, শিরোনাম – বাংলাদেশে নির্বাচন আসন্ন, ভারতকে তার কৌশল পুনর্বিবেচনা করতে হবে

শুরুতেই প্রীতম তার লেখার এক সারসংক্ষেপ নিজেই লিখেছে এভাবেঃ “
ভারতের এই পুবের পড়শি (মানে বাংলাদেশ) একটা নিখুঁত ফ্রি-ফেয়ার নির্বাচন-ই করতে হবে এমন গোঁ ধরা ধ্যান-জ্ঞানের দেশ কখনই ছিল না। তার মানে আবার এও নয় যে এখানে নির্বাচনকে একটা ধারাবাহিক ঠাট্টা বানায় ফেলতে হবে তা নয়। তবে এটা জানা বেশ উতসাহের হবে যে ঢাকার আজকের উপস্থিত পরিস্থিতি এটা কীভাবে ভারতের স্বার্থের পক্ষে এখন যাচ্ছে ও আগামিতেও যাবে। Holding a free and fair election was never a virtue of India’s eastern neighbour. But elections had never been as consistently farcical either. It would be of keen interest to know how the prevailing scenario in Dhaka had been helping and would help the Indian cause.

উপরে প্রীতমের শেষ বাক্যটা লক্ষ্য করা যাক। লিখেছেন, ঢাকার আজকের উপস্থিত পরিস্থিতি এটা কীভাবে ভারতের স্বার্থের পক্ষে  এখন যাচ্ছে ও আগামিতেও যাবে। কিন্তু এমন যাওয়াটা কী ঠিক? ন্যায়সঙ্গত বা ইনসাফের? না, সরি। প্রীতম এদিকে উতসাহী নন একেবারেই। বরং  প্রতীম এটা ভারতের স্বার্থের দিকেই যাচ্ছে তাতেই চরম আহ্লাদিত!!! আর এটাকে ভারতের অন্যায়ের স্বার্থমুখী করে নেয়া হয়েছে কীভাবে ও তা কারা করেছে তা নিয়েও প্রতীম মোটেই উতসাহী হয়। তার কাছে নিজ দেশপ্রেমের স্বার্থই পরম!! সবার উপরে; আর বাকি সব মিথ্যা!
এমনকি গত ২৮ ডিসেম্বর মোদির আরেক চ্যালা শুভজ্যোতি ঘোষ, ভারত কী করে গত ১০ বছরের মধ্যে বাংলাদেশের তিন নির্বাচনে  অন্যায়ের পক্ষে থেকে বাংলাদেশকে ক্রিমিনালের মত লুটেছে তা বিবিসিতে এক লেখায় বেপরোয়াভাবে লিখেছে। দেখুন এখানে, বাংলাদেশে বিগত তিনটি সংসদ নির্বাচনে ভারতের যে ধরনের ভূমিকা ছিল। ভারত যে  ক্রিমিনাল অপরাধীর মত লুটেছে সেটা খোদ শেখ হাসিনাও মনে করেন। তিনি প্রকাশ্যেই বলেছেন, তিনি ভারতকে কী না দিয়েছেন (মানে তবু তিনি প্রতিদান পাননি), এটা ভারত একদিন বুঝবে (মানে আপসোস করবে)।  কিন্তু একালে প্রতীম সেসব ঘটনাবলী-ইতিহাস নিয়ে মোটেও আগ্রহি না। তাঁর দেশপ্রেমের চোখে তিনি দেখছে – নিজ দেশ পেয়েছে, পেয়ে যাচ্ছে পেয়েও নাকি যাবে। এসবই তার কাছে সুপ্রীম – ফলে ন্যায়-ইনসাফ আবার কী!!

প্রতীম সাফাই দিতে বলছেন, “মোট ২৯ টা দল নির্বাচনে অংশ নিয়েছে” (বলতে চাইছেন, সুতরাং এটা নিশ্চয় নির্বাচন হচ্ছে) আর বলছেন তৃতীয় বৃহত্তম দল জাতীয় পার্টি অংশ নিচ্ছে (বলতে ইঙ্গিত দিচ্ছেন তাহলে তো আর কথাই নাই) “A total of 29 parties including League and a faction of the third-largest, Jatiya Party, will contest the election.”। কিন্তু তিনি এখানে যা লুকালেন তা হল এই কথিত তৃতীয় পার্টিকে (এরশাদের জাতীয় পার্টি) বিরোধীদল হতেই হবে সেটা সাজিয়ে দিয়ে গেছিল ২০১৩ সালে ভারতের পররাষ্ট্র সচিব সুজাতা সিং। আর বাংলাদেশের উপর ভারতের এই প্রকাশ্য হস্তক্ষেপ এই  তথ্য বিবিসির শুভজ্যোতিও স্বীকার করেছেন। কিন্তু প্রতীম মহাশয় মনে হচ্ছে তবু তা জানতেই পারেন নাই!  আর সেঘটনার পুনরাবৃত্তি এবারও হয়েছে। এরশাদের ভাই এখনকার জাপা নেতা কাদেরও ভারত থেকে ফিরে সে ইঙ্গিত দিয়ে কথা বলেছিলেন।  আর অনেক নাটক করে শেষে নির্বাচনে সঙ্গি হয়েছেনও। কিন্তু খুব সম্ভবত এবার তিনি অতি চালাকি আর নাটক করতে গিয়ে ধরা খাবেন, দেখা যাক! কিন্তু প্রতীক মহাশয়ের চোখে সবই ভারতের সাফল্য!!

প্রতীমের পরের প্রসঙ্গ আর্মিঃ
সামরিক আর বেসামরিক শাসন নিয়ে তুলনা আর শেষে খোদ যেকোন প্রকারের বেসামরিক শাসনের পক্ষে রায় দেয়া – এই চাতুরি বয়ানের  চর্চা চালু করে গেছিলেন প্রথম আলোর মিজানুর রহমান খান (এখন মারা গেছেন)। তিনি নিজেই একালেও বাকশালের পক্ষে কথা বলতে লজ্জা পেতেন না, এতই অবুঝ বাকশাল-প্রেমি ছিলেন। আসলে, তখন রাষ্ট্রটাকেই নাই করে দেয়া হয়েছিল এমন কনষ্টিটিউশন সংশোধনী আনা হয়েছিল; যেটাকে আমরা বাকশাল বা চতুর্থ সংশোধনী বলে চিনি। মিজানুর বলতেন রাজনৈতিক দলের এই কান্ডটাও জায়েজ কারণ তা মুজিবের বেসামরিক শাসন সেটা করেছিল।  মানে তুলনায় সামরিক শাসন সেটা খুবই খারাপ!

এই বক্তব্য শঠতাপুর্ণ বা চাতুরির। সাধারণভাবে বাংলাদেশে –  রাজনীতি জিনিষটা কী এনিয়ে চিন্তা-বোধ এর বিকাশ খুবই দুর্বল। এর পিছনের প্রধান কারণ সমাজতন্ত্রী-প্রগতিশীলতা ধারণা।  সমাজতন্ত্রী-প্রগতিশীলরা মনে করেই তারাই নাকি সবচেয়ে অগ্রসর ধারণা। কাজেই রাষ্ট্র-রাজনীতি কী সেটা জানার দরকার নাই, এগুলো তো পশ্চাতপদ, ডানপন্থি বা বুর্জোয়া ধারণা। অথচ  যারা মৌলিকভাবে রাজনীতি-রাষ্ট্র জিনিষটা কী, রিপাবলিক ধারণাটা কী এসবনিয়ে নুন্যতম ধারণা জানা-বুঝার আগেই সমাজতন্ত্রী-প্রগতিশীল হয়ে গিয়ে এমন আত্মঘাতি হয়ে আছেন। অবশ্য সেটা এমন হয়ে যাবার যুগও ছিল, সেটা অন্তত গতশতকের শেষ অর্ধেক জুড়েই (১৯৪৫-২০০০) মৌমাছির মত সেকালের তরুণদেরকে টেনেছিল। সোভিয়েত পতনের পরে এটা আর টিকে থাকতে পারে নাই। নিজ-অযোগ্যতায় এর জোশের সিংঘভাগই এখন খামোশ হয়ে গেছে।  কিন্তু আমাদের বেলায় যা ক্ষতি করে দিয়ে যাবার তা ঘড়েগিয়েছিল। এরই প্রমাণ হল, বাকশাল সম্পর্কে – কেন বাকশাল আপত্তিকর তা হল তা নিয়ে প্রকাশিত ধারণা গুলোকে দেখেন। ন্যাপ-কমিউনিস্ট বা ইসলামিদল গুলোর (পরে এরা বিএনপি করা শুরু করলেও) সবার মুখে মুখে সেসময়ের বয়ান হল যে, এটা একদলীয় ব্যবস্থা আর চারটা সংবাদপত্রের শাসন; এটাই মুখ্য অভিযোগ। এই হলো আমাদের বুঝ ও সমালোচনা। অথচ রিট [writ] কী আমরা খবর নেই নাই, জানি না। একটা কনষ্টিটিউশনে যদি রিট করার সুযোগ না থাকে তাহলে কী ক্ষতি; কী আসে যায় আমরা জানি নাই। সমাজতন্ত্রী-প্রগতিশীলতার এতই দৌরাত্ম! বাকশাল সংশোধনী আমাদের কনষ্টিটিউশন থেকে রিট করার সুযোগ তুলেই দিছিল – তা আমরা বাকশালবিরোধীরা কেউ টের পাইনি!

মানে? মানে হল – রিট কথাটার সোজা মানে হল যে কোন কনষ্টিটিউশনের মুখ্য বা কেন্দ্রীয় বিষয় বা জায়গা হচ্ছে নাগরিকের মৌলিক অধিকার আর তার রক্ষাকবচ কিসাবে কী রাখা হয়েছে সেসব অংশগুলো। আমাদের কনষ্টিটিউশনের এটাই তৃতীয় অধ্যায়। এখন নাগরিকের প্রাপ্য মৌলিক অধিকার যদি সরকার বা কনষ্টিটিউশন প্রণেতারা রোধ করে দেয় বা রোধ-কারী কোন আইনই সংসদ পাশ করে দেয় তাহলে প্রতিকার হিসাবে নাগরিকের কী করার আছে? আইডেয়েলি বললে, নাগরিক তখন অধিকার হারানোর বিষয়টা হাইকোর্টের নজরে আনতে পারে। এটাই সব সৎ কনষ্টিটিউশন প্রণেতারা স্কোপ করে রাখেন। এভাবে আদালতের এই নজরে আনা বা প্রতিকার চেয়ে নালিশ দেয়াটাই রিট করা। পরে আদালত ঐ নালিশের শুনানিতে একমত হলে এরপর আদালত সরকারকে বাধ্য করতে আদেশ দিতে ক্ষমতা রাখে। এমনকি সংসদে পাশ করা কোন আইন তৈরি হয়ে গেলেও তা বাতিল ঘোষণা করে দিতে পারে। এই হল, খুবই সংক্ষেপে রীটের সারকথা।
আর আমাদের ঐ বাকশাল সংশোধনীর আগের কনষ্টিটিউশনে দুই জায়গায় আলাদা করে এমন রীট করার অধিকার দেয়া ছিল। প্রথমটা নাগরিককে দেয়া তাদের যেকোন ইস্যুতে রীট করার অধিকার হিসাবে। আবার একইভাবে ১০২ অনুচ্ছেদে উচ্চ-আদালত (হাইকোর্ট ও এর উপরের) সকল বিচারককে রীট শুনবার অধিকারও পরিস্কার ও আলাদা করে দেয়া ছিল। আর গুরুত্বপুর্ণ কথা হল ২৫ জানুয়ারী ১৯৭৫ সালে পাশ হওয়া চতুর্থ সংশোধনী বা বাকশাল সংশোধনী রীট সংক্রান্ত এদুই অধিকারকেই হয় বিলুপ্ত বা স্থগিত করে রেখে দিয়েছিল। ফলে বাকশাল চালুর পরে দেশে কারও পক্ষেই আর রীট করা বা রীট শোনার আর কোন বালাই এক্তিয়ার থাকে নাই।

মজার কথা হল পরে প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক হিসাবে জিয়াউর রহমান  তিনিই নাগরিকের রীট করা ও আদালতের তা শোনার অধিকার ফিরে কায়েম করেছিলেন – সেকালের সিনিয়র এডভোকেট বা সাবেক বিচারকদের পরামর্শে জিয়া একাজ করেছিলেন। তিনি এই মর্মে এক প্রেসিডেন্সিয়াল অধ্যাদেশ জারি করেছিলেন। এখন পাঠকেরাই বলেন বা ভাবেন বেসামরিক শাসন ক্ষমতার জোরে বাকশাল সংশোধনী জারি করা নাকি সামরিক শাসনের ক্ষমতাবলে (যা আবার পরে পঞ্চম সংশোধনীতে জায়েজ করে নেয়া) রিট করার অধিকার ফেরত দেয়া কোনটা জায়েজ বা কোনটা তুলনায় ভাল ও সৎ পদক্ষেপ?

তবে আমাদের এই আলোচনার জন্য মুখ্য ইস্যু হচ্ছে এটা বুঝতে পারার যে নাগরিকের রিট করার অধিকার কেন ফান্ডামেন্টাল? কেন রিটের অধিকার না থাকার মানে সেটা  আর কোন রাষ্ট্র-ই না; বরং কার্যত তা এক রাজতান্ত্রিক শাসন, সেটা আর রিপাবলিক বা জনগণের ক্ষমতার শাসন নয়!   অথচ সমাজতন্ত্রী-প্রগতিশীল মন ও শিক্ষা আমাদের টেরও পেতে দিল না যে বাকশাল সংশোধনীতে বাংলাদেশ এই স্বাধীন রিপাবলিক খোদ রাষ্ট্রটাই নাই হয়ে গেছিল। এমনই সমাজতন্ত্রী বোদ্ধা সব একেকজন!  বাকশাল-কে গালি বানাতে পেরেছি কিন্তু রাষ্ট্র-রাজনীতি-জনগণ এসবের অর্থ আজও ঠিকমত বুঝি নাই! এনিয়ে আমার অনেক পুরানা একটা লেখা আছে। লেখাটা এখন খুঁজে পেয়েছি যার শিরোনাম ছিল – “পঞ্চম সংশোধনী বিতর্ক”। লিঙ্ক এখানে।  আর সেটা সেই ২০১০ সালে লিখেছিলাম। [আর ২০১০ সালে আমি তখনও জাতিসংঘে কর্মরত। আর ওয়ার অন টেররের পরে আমাদের একটা ইন্টারনাল সার্কুলার হয়েছিল যে আমরা যিন কোন রাজনীতির পক্ষে-বিপক্ষে না জড়াই, মতামত না রাখি। রাখলে এর পরিণতি হবে ২৪ ঘন্টার মধ্যে দেশে ফিরার টিকিট হাতে ধরিয়ে দেয়া। তাই আমি বেনামে ফিদা হাসান নাম নিয়ে লিখেছিলাম এই লেখাটা] এখনই সেই পুরানা লেখাটার একটা লিঙ্ক এখানেও পারেন।
। সাথে সংশ্লিষ্ট আরেকটা লেখাও পড়তে পারেন আগ্রহিরা। এটা ২০১৭ সালে লেখা – প্রথম আলোর রাজনীতির একটি ব্যবচ্ছেদ। এটা আমার লিজের নামেই লেখা।


কিন্তু এর সাথে প্রতীম রঞ্জনের কী সম্পর্ক?

তিনি লিখেছেন, “Army was at the helm in Bangladesh between 1975 and 1990.”। বাংলা করলে, “১৯৭৫ ও ১৯৯০ সালের দিকে বাংলাদেশে আর্মি সব ক্ষমতার শীর্ষে ছিল!”।  এই বাক্যটা মিজান খানের বাকশালী সামরিক বনাম বেসামরিক এর মধ্যে কোনটা তুলনায় ভালো এই চাতুরির ধারণা লুকিয়ে আছে। বেসামরিক শাসন হলেই একে ভাল বলতে হবে – এটা একেবারেই শঠতার এক বক্তব্য! সেজন্যই উপরে দেখালাম, বেসামরিকতা দিয়েই [বেসামরিকতা মানেই যেন এক পবিত্র ক্ষমতা] একটা জনগণের ক্ষমতার রাষ্ট্র বা রিপাবলিক রাষ্ট্রকে নাই করে দিয়ে একে রাজতান্ত্রিক বা স্বৈরাচারি শাসন বানিয়ে ফেলা হয়েছিল। কিন্তু এই মিজান এন্ড বাকশালী গং আমাদেরকে বেসামরিক শাসনের পবিত্রতা শিখাচ্ছে! আর একালের প্রতীম মহাশয়ও আমাদের সেই সামরিক শাসনের ইঙ্গিত দিচ্ছে।

এমনিতেই সেকালের সোভিয়েত-মার্কিন [ সেটা ছিল ব্লকের যুগ মানে  দুই দেশের দুই ব্লকের সদস্য হওয়ার যুগ] বা কোল্ড ওয়ারের যুগে (১৯৫৩-৯১)। আমাদের মত দেশে আমেরিকা মাস-পপুলার লেবেলে  সোভিয়েত প্ররভাবের সাথে না পেরে সামরিক শাসন জারি করে আমাদের মত দেশগুলোর উপর নিজ সব ধরণের প্রভাব জারি রাখত। তাই সামরিক শাসনের সরকার ছিল প্রধান ফেনোমেনা। আবার আমাদের বেলায় ছিল আরেক সমস্য। ১৯৭১ সালের যুদ্ধ থেকে স্বাধীন বাংলাদেশে পৌছানো কখনই হত না যদি না আমরা সেই সময়ে স্পষ্ট করে সোভিয়েত ব্লকে যোগ না দিতাম! আবার এতে কমিউনিস্ট গিরি সমাজে রাজনীতিতে বেড়ে যাওয়াতে স্বাধীনের পরের সাড়ে তিন বছর কথিত সমাজতন্ত্রের অর্থনীতি করতে আমরা বাধ্য হয়েছিলাম। আর তাজউদ্দিন এন্ড গংয়ের এই প্রচেষ্টাইয় গিয়ে তা শেষে এমন পরাজয় ও ব্যর্থতা আসলো যে দুর্ভিক্ষে মানুষ মারলাম। আবার দুর্ভিক্ষের জন্য একে-তাকে দোষ চাপালাম। আবার অন্যদিকে কোন রাষ্ট্র একবার সোভিয়েত ব্লকে ঢুকলে তা থেকে বের হওয়া বিরাট খেসারত, বিরাট মুল্য চুকাতে হয়। আমাদের বেলাতেও এর ব্যতিক্রম হয় নাই। শেখ মুজিব আমাদের সোভিয়েত ব্লক থেকে বের করার ব্যবস্থা করে গেছিলেন কিন্তু তা দেখে যাবার আগেই জীবন দিয়েছিলেন। এই ছিল আমাদের সত্যিকার ১৯৭৫।  যা সবদিক থেকে দেখে ব্যাখ্যা করতেই হবে কারণ পুরা ফেনোমেনা-ঘটনাটা নেহায়তই কোন সামরিক শাসনের প্লট নয়! এটা শ্রেফ একটা সামরিক শাসন জারি করার মামলা একেবারেই নয়!
আর ১৯৯০ সাল বলে – যেটা বলছেন সেটা আসলে এরশাদের ১৯৮২ সালের সামরিক ক্ষমতা দখল। কিন্তু এই ক্ষমতা দখলের মূল উদ্দেশ্য ছিল বিশ্বব্যাংকের আমাদের অর্থনৈতিক ও প্রশাসনিক সংস্কার। ফলে এটাও কোন সামরিক প্লট না। যা সামরিক শাসন খুবই খারাপ বলে ব্যাখ্যা করা যাবে না।  সেই আশির দশকের শুরুতেও আমাদের দেশে কমিউনিস্ট প্রভাব যথেষ্ট ভারি ছিল। বিশেষত ট্রেড ইউনিয়নে আর রাজনৈতিক কালচারে। যেমন প্রায় সব উতপাদন ছিল সরকারি মালিকানায়। যেকোন অর্থনৈতিক প্রতিষ্ঠানে সংস্কার মানেই প্রথম পর্যায়ে শ্রমিক বা কর্মি ছাটাই হবেই। কিন্তু সংস্কারের বা ঢেলে সাজানোর পরে কত মানুষ চাকরি পাবে সেটা দিয়ে এর সাফল্য মাপতে হবে।  শুধু শ্রমিক ছাটাই হচ্ছে কেন তা দিয়ে নয়! এখন বাংলাদেশে সংস্কারের কাজে নামলে বিশেষত বিশ্বব্যাংক একাজে কমিউনিস্ট চাপে (বিশেষত ছাটাই ইস্যুতে) পড়তে পারে যেটা তারা মুখোমুখি হতে চায় না। তাই আগে সামরিক শাসন জারি করে নিয়ে সংস্কার কাজ শুরু করতে মনস্থ করেছিল আইএমএফ-বিশ্বব্যাংক। তাই এরশাদের ক্ষমতা দখল। নিশ্চয় এরশাদ এত বুদ্ধিমান ছিলেন না যে প্রশাসনিক সংস্কার (পপুলারলি উপজেলা) তার মাথা থেকে বের হয়েছে!
এখন এখানে এতসব দিককে আপনি স্রেফ সামরিক লোকেরাই সবকিছুর নষ্টের গোড়া বলে বাহাদুরি-গাথা গাইতেই পারেন! অজ্ঞতায় কতকিছুই না দাবি করে ফেলা যায়!
আর কিছুই না-বুঝে  প্রতীম রঞ্জন বোস এসব  সামরিকবিরোধী বাহাদুরি-গাথার পাল্লায় পড়েছে। আসলে এতে বুঝা গেল ভারতের ১৯৯০ সালের আইএমএফের সাথে ব্যালেন্স অফ পেমেন্টের ঘাটতিতে পরে তা মোকাবোলায় সেখান থেকে কেন ভারতকে সংস্কারের পথে যেতেই হয়েছিল এসব নিয়ে প্রতীম রঞ্জন বোস এর কোন স্টাডি অনুমান কিছুই নাই। এমনকি এখনও এই মোদি আমলে ভারতে আরও অর্থনৈতিক সংস্কারের কথা উঠছে কেন; সেটা কখনও তিনি আমল করেন নাই বলেই মনে হয়।
অথচ তিনি এসেছেন গাধা-বোকাদের সামরিক-বেসামরিক তর্কে প্রবেশ অরে এনিয়ে কথা বলতে!!!

চীনা প্রসঙ্গঃ
প্রতীম রঞ্জন বোস খুবই নাদান কিসিমের তাই যেসব ইস্যু নিয়ে তিনি কথা তোলার যোগ্য হন নাই, সাবজেক্টটা বুঝতেই শেখেন নাই তা নিয়ে তিনি কলাম লিখে ফেলায়ছেন। তার আপত্তি হল, বাংলাদেশে চীনের গুরুত্ব কেন ভারতের নাই কেন?  অথচ উনি কী জানেন  একই ভাবে খোদ ভারতের চীনের গুরুত্ব আছে, দেয়া হয়? যে জানে সে দেয়! কিন্তু চীনের গুরুত্ব কথার মানে কী?

এটা কেউ চীনকে বেশী ভালবাসে বলে দেয় ব্যাপারটা কী সেরকম?
একেবারেই না। চীনের গুরুত্ব কথার সিধা মানেটা হল, আমাদের মত দেশ (এমনকি ভারতেও) অবকাঠামো খাতে একালে ঋণ দেবার সক্ষমতা একমাত্র চীনের আছে। যা সমতুল্য আমেরিকারও নাই।  তবে এটাই আমেরিকারও ছিল। সেকারণেই একালে চীনের এই গুরুত্ব। এখন প্রতীম কী জানেন ভারতেও চীনা এমন অবকাঠামো প্রকল্পগুলো ছিল? বিশেষত ২০১৪ সালে মোদি প্রথম ক্ষমতায় আসার পরে! কোথায় সেসব প্রকল্পগুলো, তাদের কী হল? সেগুলো বাতিল করে দেয়া হলে সেই সরকারি ঘোষণাটাই বা কই? রেল ব্যবস্থা আধুনিকিকরণ, স্টাফ ট্রেনিং সহ যে চীনা প্রকল্প ছিল তা এখন কোথায়? আগামিতে ভারতে আরো প্রায় পঞ্চাশটা শহর গড়ে উঠতে যাচ্ছে। সেগুলোর অনেকগুলোই পরিকল্পিতভাবে গড়ে তোলার অবকাঠামোগত বিনিয়োগের দায়ীত্বে চীনের যাবার কথা হয়েছিল সেগুলোই বা কোথায়? এর সব তথ্য নেট থেক সরায় নেয়া হয়েছে কেন? গৌতম আদানিরা চীনা লোন (হংকং থেকে এনেছে বলে চালিয়ে দিয়ে) বিদ্যুৎ কেন্দ্র বানিয়ে সেই  বিদ্যুৎ বাংলাদেশে রপ্তানি করে এবার ভারত নিজেকে চীনবিরোধী দাবি করছে? এতে করে লাভ কি?
এখন ভারত কী অবকাঠামো ঋণ দেয়ার ক্ষেত্রে বাংলাদেশে চীনের প্রতিদ্বন্দ্বি? নাকি ভারত নিজেই অবকাঠামো ঋণের এখনও খাতক?  কাজেই এসব সম্পর্কে নুন্যতম ওয়াকেবহাল না থেকে এক দেশপ্রেমিক ভারতীয় সেজে বাংলাদেশে সব ইস্যুতে চীন কেন – এই প্রশ্ন করা মানে বুঝিয়ে দেয়া যে আপনি ইস্যুই বুঝেন না, আর আপনার কাছে নুন্যতম তথ্যই নাই।

তিনি লিখেছেন,
Despite all the drumbeating about bilateral co-operation, the last five years were marked
by unprecedented consolidation of Chinese interests in Bangladesh while Indian interests suffered.

সারকথায় বললে তিনি প্রশ্ন তুলেছেন বাংলাদেশে চীনা স্বার্থ কেন উপরে আর ভারতের স্বার্থ কেন নিচে? প্রশ্নটা তিনি তুলছেন অবকাঠামো প্রসঙ্গে। তবু প্রথম কথা হল, বাংলাদেশ এমনকি হাসিনার বাংলাদেশে তিনি কাকে বেশী গুরুত্ব দিবেন ভারত না চীনকে – এটা নির্ধারণের এক্তিয়ার তো হাসিনার?  নাকি না?  প্রতীম মহাশয় তিনি কী বলতে চাইছেন হাসিনা ভারতের দালাল তাই তিনি ভারতকে চীনের উপরে দিচ্ছেন না কেন? এরকম?
আসলে এসব কথা নিয়ে নিজেকে ইন্ডিপেডেন্টে বুঝানো যায় না! বরং এসব ইস্যু নিয়ে কথা বলার ক্ষেত্রে নিজে কতটা অযোগ্য তা বুঝা যায়!  আমরা কেবল এতটুকু বলতে পারি এই নির্বাচন যদি হয়েই যায় তখন ভারতের কী দুর্দশা হয় সেটা নিয়ে বরং মুরোদে কুলালে প্রতীম মহাশয় ব্যস্ত হয়ে উঠতে পারেন। কারণ, এটাই সম্ভবত হট-কেকে হয়ে উঠতে যাচ্ছে!

ভারত কেন বাংলাদেশে কখনই পপুলার নয়ঃ
সবক্ষেত্রেই দেখা যাচ্ছে যা প্রতীক মহাশয় ডিল করলে পারেন না সেসবেই তার আগ্রহ!   এভারেজ এক ইন্ডিয়ানের মত তাঁরও পুঁজি হল কেবল এক উগ্র দেশপ্রেম? থচ columnist, researcher, and consultant.এর আকাঙ্খা রাখেন? সেকাজে তো নুন্যতম সমাজতত্ব, সমাজবিজ্ঞান ও অর্থনীতির পাঠ থাকতে হবে, নাকি? অথচ তিনি বলতেছেন,

… India was never popular in Bangladesh, not even in December 1971, when Delhi
became a party to their Liberation War. This is largely due to religious differences
that were the prime inspiration behind the creation of Pakistan.

এটা কী কোন গবেষকের বক্তব্য হতে পারে? যোগ্য? বলছেন ১৯৭১ সাল থেকেই ভারত কখনও বাংলাদেশে পপুলার ছিল না। ভালকথা, কিন্তু কেন? এর একটা বুদ্ধিমত্তা-সম্পন্ন ব্যাখ্যা করেন তাহলে! কিন্তু না। এই মহা বিদ্যান লোক ফতোয়া দিলেন এক মহা আবিস্কারের যে নাকি ধর্মীয় ভিন্নতার কারণে ভারত বাংলাদেশে পপুলার না! কান্ড দেখেন, প্রতীম রঞ্জন মফস্বলের চা দোকানের বেঞ্চিতে বসা আলাপ তুলেছেন তিনি!!!
সাধারণভাবে বললে, প্রায়ই এই প্রশ্নটা সামনে চলে আসে যে ভারত আমাদের সাহায্য করতে আসার উসিলায় নিজের স্বার্থ হাসিলে ততপর। এখন এমন প্রশ্ন উঠাই স্বাভাবিক। তাই আগাম এমন বুঝাবুঝি যেন না উঠে আসা তা নিয়ে সতর্ক থাকা। কিন্তু তা তো হয় নাই। বরং সব জায়গায় ১৯৪৭ সালের দেশভাগের প্রতিশোধ নিবার বাসনা প্রকাশিত হয়েছে যেন! আর সবচেয়ে খারাপ কাজটা করেছেন ইন্দিরা গান্ধী! তাঁর তো অন্তত এমন কিছুই করা উচিত না যেটা ভারতের নিজের ক্ষতি ডেকে আনবে। অথচ তিনি তাই করেছেন। কেন তিনি হবু বাংলাদেশ কী হবে কী পরিচয় তা নিয়ে এমন সব ধারণা ব্যবহার করেছেন যা ভারত নিজেই নয়। যেমন কথিত সেকুলার, অসাম্প্রদায়িক, প্রগতিশীল, জাতীয়তাবাদ, সমাজতন্ত্র ইত্যাদি হয়ে হবে হবু বাংলাদেশকে! কিন্তু কেন?
তারচেয়েও বড়কথা খোদ ভারতই তেমন কোন রাষ্ট্র নয়; আর এর কথার বেশির ভাগই অর্থহীন!  অথবা যা বলছে ওর ব্যবহারিক রূপটা এর উলটা। বরং সারকথায় বাংলাদেশ ৯০ ভাগের মত মুসলমান জনসংখ্যা। এখন কী বলে কী করে ঈই মুসলমান পরিচয় দাবিয়ে রেখে দেয়া যায় এই ছিল ইন্দিরার সব কসরতের মূল্কথা! অথচ সবচেয়ে বড় অসংগতি হল খোদ ভারত-ই তো হিন্দুত্ব বা হিন্দু-জাতিরাষ্ট্রের দেশ হয়ে আছে যে পথ  কংগ্রেস নিয়েছে সেই ১৮৮৫ সাল থেকে! তাহলে হবু বাংলাদেশের ভারতকে অনুসরণের সুযোগ বাস্তবতা কোথায়?

আসলে কথা একটাই জমিদার আমল থেকেই জমিদার-হিন্দুদের মুসলমানদের উপর আধিপত্যের আকাঙ্খার শুরু সেই নীতি সব জায়গায় থেকেই গেছে। মূল সমস্যা আধিপত্য – রাজনৈতিক বা সাংস্ক্ররতিক আধিপত্য ভারতকে বা জমিদার হিন্দুদেরকে করতেই হবে বা পেতেই হবে – এটাই রূপ সমস্যা। অথচ সকলেই আম=বার ব্যভারিকভাবে বুঝুক না বুঝউক   এক রিপাবলিক রাষ্ট্রই গড়তে গিয়েছে। যার সারকথা হল, নাগরিক সাম্য। মানে এক জনগোষ্ঠির অপরের উপর আধিপত্য করা বা সুযোগ নেয়া নয়। বরং আধিপত্যের উলটা, এক নাগরিক সাম্য। যেটা সেকালের না ইন্দিরা বা কোনকালে খোদ কংগ্রেস বুঝতেই পারে নাই। একেবারে প্রতীম রঞ্জন বোস পর্যন্ত একই গান চলছে!

যা হোক, এই গল্প-কেচ্ছার শেষ নাই। কেবল আমাদেরকে আমাদের মত থাকতে দেক, এটাই কাম্য!

প্রতীম রঞ্জনের সবচেয়ে বিরক্তিকর কান্ডটা হল, তিনি শিরোনামে বলছে ভারতকে নিজ স্ট্রাটেজি পুনর্বিবেচনা করতে হবে। অথচ তিনি পরিস্কার বলতেই পারলেন না বদল করে কোথায় নিবে? মানে চাপাবাজির ভাবসাব আরকি!!!

 

সর্বশেষ আপডেটঃ    ৩০  ডিসেম্বর ২০২৩,   দুপুর ১২ঃ ৩৬

গৌতম দাস
রাজনৈতিক বিশ্লেষক
goutamdas1958@hotmail.com

Leave a comment