“বাংলাদেশে ভারতের কপাল পুড়তেছে” – সুমিত গাঙ্গুলী
গৌতম দাস
২৭ ডিসেম্বর ২০২৪ সকাল ১০ঃ ৪১
https://wp.me/p1sCvy-67F
চলতি বাইডেন প্রশাসন মানে যার ক্ষমতার আয়ু আগামি ২০ জানুয়ারি ২০২৫, ট্রাম্পের শপথের মধ্য দিয়ে শেষ হতে যাচ্ছে – সেই বাইডেন প্রশাসনের ফেভরিট মিডিয়া ছিল আমেরিকার “ফরেন পলিসি” পত্রিকাটা; বাইডেন প্রশাসনের গৃহিত নীতি-পলিসি বিভিন্ন দেশে বিশেষ করে এশিয়ায় আমাদের মত দেশে কী প্রতিক্রিয়া আনছে তা বুঝা ও বাইডেন প্রশাসনের কাছে পক্ষের লোকজনকে পৌছে দেওয়ার জন্য এখানে লেখালেখি করতেন। এই ছিল “ফরেন পলিসি” এর সাথে এরেঞ্জমেন্ট। আবার এর মাধ্যমে যদি এশিয়ান স্থানীয় জনমতও প্রভাবিত করা যায় সেটাও বাড়তি। যেমন ধরেন এমনই এক থিঙ্কট্যাংক ফেলো কুগেলম্যান; তিনি এখানে প্রতি সপ্তাহে এশিয়াতে বাইডেন প্রশাসনের স্বার্থগুলো কোন দিকে হাঁটছে বা লাইনে আছে কিনা এর আগাম ইঙ্গিত প্রশাসনকে জানাতে নিয়মিত লেখা ছাপতেন তিনি এই ফরেন পলিসি পত্রিকায়। আরো সুনির্দিষ্ট করে যেমন ধরেন, গত ১০ ডিসেম্বর ২০২২ বিএনপি এক কালজয়ী সমাবেশ করেছিল সায়েদাবাদ-গোলাপবাগ মাঠে; হাসিনার শত বাধা সত্বেও তা উপেক্ষা করে। অথচ এই কুগেলম্যান লিখলেন এটা তেমন কোন সমাবেশই নয়! কারণ, কুগেলম্যান সম্ভবত জানতেন, পরের সাত মাসের মধ্যেই মানে সেপ্টে. ২০২৩ বাইডেন-লু পল্টি মারবেন। বিরোধীদলকে রাস্তায় নামানোর পরে হঠাত তাদের হাত ছেড়ে দিবেন। আর উলটা হাসিনার হাত ধরেই “আমরা একসাথে কাজ করব” বলে হাসিনাকে চিঠি (৫ ফেব্রু.২০২৪) লিখবেন! আর এসবের আগে, আরেকবার হাসিনাকে (৭ জানু.২০২৪) ভোটচুরির ক্ষমতায় হাসিনাকে আসীনে সহায়তা করবেন। ভোটচুরি দেখেন নাই ভান করবেন! আশা করি পাঠক এখন বুঝতে পারছেন “ফরেন পলিসি” কী ও কত প্রকার! তো সেরকমই “ফরেন পলিসি” তে এমন আরেকজনও প্রায়ই লিখেন এমন কলামিস্ট ব্যক্তিত্ব হলেন সুমিত গাঙ্গুলী।
[যারা বিস্তারিত পড়তে চান না তারা নিচের প্যারাটা বাদ দিয়ে পরের প্যারায় চলে যেতে পারেন।]
সুমিত গাঙ্গুলী নামটা শুনে মনে হতে পারে তিনি ইন্ডিয়ার মানে অন্তত কলকাতায় জন্ম ও বড় হয়েছেন নিশ্চয়! কথাটা আংশিক সত্য! যদিও হ্যা, তাঁর নাম থেকে বুঝা যায় তিনি মানে তাঁর ফ্যামিলি কলকাতার ব্রাহ্মণ কোন পরিবার। কিন্তু সুমিত গাঙ্গুলীর জন্ম ও বেড়ে উঠা ঠিক কী কলকাতায় বা ইন্ডিয়ায়? না, নেটে খুঁজে তা কোথাও পাওয়া যায় না। বরং জানলাম তিনি আমেরিকার কেন্টাকি রাজ্যের খুবই সস্তা টিউশন ফি [দানের চাঁদা তুলে চলা বলে] এর এক কলেজ হল Berea College । আর সেখান থেকে গ্রাজুয়েশন-অনার্স দিয়ে তাঁর একাদেমিক লাইফ শুরু করেছিলেন। আর এখন? এখন তিনি পুরা দস্তুর এক আমেরিকান (ভারতীয় নয়) একাদেমিসিয়ান; আর অন্তত দুডজন ইন্সটিটিউট বা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাথে তিনি জড়িত। শুধু আমেরিকান হুভার [Hoover Institution] ইন্সটিটিউট মানে প্রাক্তন পররাষ্ট্রমন্ত্রী কন্ডালিসা রাইস যার ডিরেকটর সেই হুভার ইন্সটিটিউট থেকে সুমিত গাঙ্গুলির যে পরিচয়টা হুভার দিয়েছে সে তথ্য প্রায় আধা পাতা জুড়ে ঠাসা বিশ্ববিদ্যালয় আর ইন্সটিটিউটের নামে। সেই লিঙ্ক এখানে দিলাম আগ্রহিদের জন্য। তবে সবচেয়ে মজার কথা হল, উইকি যা লিখছে -“Sumit Ganguly is an American political scientist. He is a senior fellow at the Hoover Institution and a professor of political science at Indiana University … “। অর্থাৎ সুমিতের পড়াশুনার ভিত্তি হল পলিটিক্যাল সাইন্স কিন্তু তিনি আমেরিকান (কোন ভারতীয় নন) পলিটিক্যাল সাইনটিস্ট। তবে তাঁর সবচেয়ে বড় পরিচয় হুভার ইন্সটিটিউটে হান্টিংটন প্রোগ্রাম এর পরিচালক তিনি। আসলে ক্যালিফোর্নিয়ার স্টামফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়, এই বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে (খরচ-বাজেটের দিক থেকে নিজস্ব পরিচালনা বোর্ড আছে) এমন যে “হুভার ইন্সটিটিউশন” যা মূলত এক কনজারভেটিভ থিঙ্কট্যাংক। আর সবচেয়ে গুরুত্বপুর্ণ হল, হুভারে তিনি এখানে ইন্ডিয়া-আমেরিকা সম্পর্ক খুবই শক্ত করা যায় কী করলে [Huntington Program on Strengthening US-India Relations] তেমন এক প্রোগ্রাম চালান।
তবে সম্ভবত আরো বিষ্ময়কর হল ব্লুমিংটন শহরে যে ইন্ডিয়ানা ইউনিভার্সিটি আছে সেখানে ভারতীয় সংস্কৃতি চর্চার এক টেগোর চেয়ার [নামেই রবীন্দ্র গবেষণা ফান্ড বলতে পারি] এরও বড় কর্তা তিনি।
কেন সুমিত গাঙ্গুলীঃ
এতক্ষণ ধরে কেন সুমিত গাঙ্গুলীর পরিচয় নিয়ে এত কথা বললাম! এক নম্বর কারণ, তিনি আমেরিকা-ইন্ডিয়ার সম্পর্ক শক্ত রাখার এক গবেষণার বড় কর্তা। আর দুই নম্বর কারণ হল, তিনি ঐ “ফরেন পলিসি”তে গত ১৬ ডিসে. ২০২৪ এক কলাম লিখেছেন যার শিরোনাম হল, “বাংলাদেশে ভারতের কপাল পুড়তেছে” [India’s Fortunes Shift in Bangladesh]। এই একই লেখার বাংলা অনুবাদ করে অবশ্য ছেপেছে আমাদের মানবজমিন ২০ ডিসে. ২০২৪ শিরোনাম, “ঢাকা প্রসঙ্গে বদলাতে পারে ভারতের পররাষ্ট্রনীতি“।
এখন আমাদের অনেকের নিশ্চয় মনে আছে ট্রাম্পের বিজয়ের পর থেকে মোদির বিজেপি শুধু না খোদ শেখ হাসিনাও খুশিতে নেচে আমাদের ভয় দেখাচ্ছিলেন যে এইবার তাদের ট্রাম্প-ভাইয়া এসে পড়েছেন; আর চিন্তা নাই; তিনি নিশ্চয় এবার মোদিকে দিয়ে বাংলাদেশে হাসিনাকে আবার ক্ষমতায় বসায়ে দিবেন???
সাথে আরো আছে যে আর চিন্তা কইরেন না তুলসি গাবার্ড [Tulsi Gabbard, এককালে ইসকনের চেলা ও দুবছরের জন্য কংগ্রেস মেম্বার ও ‘র’-এর সাথে কাজ করা] ট্রাম্প বাবাজি তাঁর নির্বাচনি প্রচার কালে হঠাত করেই তুলসিকে তাঁর দলে ভিড়িয়ে নিয়ে স্টেজে তুলেছিলেন। দলে ভিড়িয়ে নেয়া বললাম এজন্য যে মোদি যে তুলসি কে চিনতেন তিনি ডেমোক্রাট দলীয়। পরে তিনি ডেমোক্রাট দল থেকে পদত্যাগ করেছেন। এবং এরপর থেকে ইন্ডিয়া বা র-এর সাথে তুলসির আর সম্পর্ক আছে কিনা তা জানা যায় না। কিন্তু তবু কর্মিদের চাঙ্গা রাখতে বিজেপি মা মোদি তুলসি আসছে বলে প্রপাগান্ডা শুরু করে দিয়েছে।
বাংলাদেশে ভারতের কপাল পুড়তেছে – কথার অর্থ তাতপর্য কীঃ
এমনিতেই মোদির ট্রাম্প ভাইয়া আসতেছে প্রপাগান্ডায় ট্রাম্প আসলে – কী ইন্ডিয়া নীতি – নিয়ে এবার ক্ষমতাসীন হচ্ছেন সেদিকটা মোদি সামনে বা আমাদের জানতে আগ্রহী নন। কিন্তু কঠিন সত্যিটা হল আগামি ২০ জানু ২০২৫ শপথের পরের দিনগুলোতেই ট্রাম্পের ডিপোর্টেশন [deporation] মানে বিদেশি অভিবাসী (শ্রমিক, হোয়াইট কালার সব) খেদানো প্রোগ্রাম শুরু হয়ে যাবে। ইন্ডিয়ার দৈনিকগুলোর শিরোনাম হল প্রথম পর্যায়েই “18,000 Indians At Risk Of Deportation……” মানে প্রাথমিক ধাক্কায় ১৮ হাজার ইন্ডিয়ানক্র বের করে দেয়া হবে। এটা গত ১৪ ডিসেম্বরের ইন্ডিয়ার প্রধান নিউজ ছিল। তবে এটা মনে করা ভুল যে এটা কেবল ইন্ডিয়ার বেলায়; বরং এটা কমবেশি সব দেশের বেলাতেই সত্য; এমনকি বাংলাদেশি যারা হাসিনার আমল দেখায় এই অজুহাতে আমেরিকা ঢুকেছে তারাও ডিপোর্টেশনের আওতায় আসবেন। আর ওদিকে ল্যাটিন আমেরিকা মেক্সিকো ইত্যাদি তো বটেই এমনকি কানাডার বিশেষ সুবিধা যা ছিল তাতে টান পড়বে (কানাডাকে আমেরিকান রাজ্য হয়ে যেতে বলা) ইত্যাদি এসব কিছু।
এর সাথে আছে যারা এর আগে আমেরিকায় মাইগ্রেন্ট হয়ে পরে একটা (নাগরিকত্ব নয়) রেসিডেন্ট পারমিট হাতে পেলেই (মানে বসবাস ও কাজে যোগ দেওয়ার অনুমতি প্রাপ্ত হয়েছে), এরপর এদের কোন সন্তান আমেরিকায় জন্মগ্রহণ করলেই তারা আমেরিকান নাগরিক হয়ে যেত; এই শর্ত এখন ২০ জানু. ২০২৫ থেকে প্রত্যাহার করা হবে। ফলে বাংলাদেশের যারা আগেভাগে দেশে ছুটে এসে এরা (বিএনপির খেদমতে বিশেষত মিডিয়া জগতে ঢুকে পড়ার জন্য) ডেনপারেট তারা ঠিক হাসিনা পতনের জন্য না ট্রাম্প এসে পড়ছে বলেই তাদের এই আমেরিকা ত্যাগের মরিয়া অবস্থা আর বিএনপির নেতাদের পিছনে লাইন দিয়ে খাড়া হয়ে যাওয়া। এমনকি H-1B ভিসায় (টেকনোলজি জ্ঞান থাকাদের জন্য যেমন আইটি টেকনোলজি) বিশেষ করে ভারতীয়রা যেমন এতদিন ধরে নিত যে এই H-1B ভিসা থেকে তাদেরকে আমেরিকা সহজে বের করে দিতে পারবে না; এমন ভিসাধারীরাও এখন একই ভাবে অনিশ্চিত নড়বড়ে হবে। একাজে ট্রাম্পকে বুদ্ধিদাতা আর সবচেয়ে ঘনিষ্ট দোস্ত হল ইলন মাস্ক [Elon Musk] যিনি কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা [AI Tech] টেকনোলজিতে বড় বিনিয়োগকারি। মানে হল। আইটি প্রোগ্রামার বলে যে পেশাটা আমাদের মত দেশগুলা চিনি এই পেশা বা এরা হল তাদের কাজে প্রোডাক্ট তৈরিতে সবচেয়ে শ্রমঘন লেবার অংশটা – মানে কোড বসানোর কাজ হল এদের। আর এটাই এলন মাস্ক মনে করেন AI Tech দিয়ে করানো সম্ভব। ফলে H-1B ভিসায় টেকনোলজিস্টদের ভারত থেকে আনা আর তত জরুতি থাকবে না। এই হল ইলন মাসকের দাবি!
আর এবারের ট্রাম্প প্রশাসনে সবার উপরে যে মূল নীতি-পলিসি হতে যাচ্ছে এর কেন্দ্রটা হল – টেকনিক্যাল ভাষায় ইকোনমিক ন্যাশনালিজম। [এনিয়ে আমার প্রথম পর্বের ভিডিও প্রকাশিত হয়েছে। পরে আরও দুই ডিটেল পর্ব আসতেছে] । সোজা বাংলায় আমদানি-রপ্তানি কমানো; বিশেষ করে আমদানি; আর সেজন্য অন্য যেকোন দেশের পণ্যের উপরেই নুন্যতম ১০% আমদানি ট্যাক্স বাড়ানো আর চীনের মত দেশের বেলায় নুন্যতম ৬০% ট্যাক্স আরোপের এক অর্থনীতি তিনি চালু করবেন। এক কথায় যাই নিজ দেশের মানুষ ভোগ-ব্যবহার করবে এমন সব পণ্য দেশেই যেন হয় সেই মুখি এক অর্থনীতি! তবে একটা হল সেই কল্পিত আকাঙ্খাটার [imagined aspiration] কথা বললাম। বাস্তবে তা কতদূর কী করা যাবে সেটা আলাদা প্রশ্ন!
কথাটা শুনে এলেখার বেশির ভাগ পাঠক নীতি হিসাবে এটাকে খুবই ভাল মনে করবেন হয়ত; কারণ আমরা বেশির ভাগ পাঠক আসলে জাতিবাদি – নিজেই কামাবো আর নিজেই খাব এর চেয়ে ভাল আর কী নীতি হতে পারে। ধারণাটা মোটা দাগে এধরণের। আমরা, আমরা আর আমরাই! কিন্তু আমি সরি; এই নীতি এখন যতই শুনতে ভাল লাগুক না কেন এটা এখন অকেজোই শুধু না বাস্তবায়নও অসম্ভব। স্রেফ এককালের কাগুজে কল্পনা। বিশেষ করে ১৯৮০ সালের পরে দুনিয়ার অর্থনীতি এ্টা ত্যাগ করে অন্যদিকে চলে গেছে। এমনই অন্যদিকে যে সেটা আর পুরানা দিনে বা চেহারায় ফেরানো অসম্ভব, ফলে অ-বাস্তবানযোগ্য এক কল্পনা মাত্র।
কেবল একটা মন্তব্য করব এখানে বিস্তারে যাব না, কমিউনিজম এর (মার্কসের নয় স্টালিনের বুঝের মার্ক্সবাদি) অর্থনীতি এর বুঝও ছিল ঠিক এটাই। এখন ডোনাল্ড ট্রাম্প যেটা করতে চাইছেন এটা সেটাই। যদিও মিলটা কাকতলীয় মানে, ট্রাম্প কমিউনিস্ট হতে চলেছেন ব্যাপারটা ঠিক তা নয়। তবে সারকথাটা হল আন্ত-রাষ্ট্রীয় বাণিজ্য অদরকারি জিনিষ! মনে করা – এমন এই বোকা বোধ! আর একটা লাইনে বলিঃ এর মানে হল, কল্পনা করেন বাংলাদেশ থেকে সব গার্মেন্টস বা লেদার প্রডাক্ট রফতানি বন্ধ ফলে কারখানাও বন্ধ; কিংবা আপনাদের গর্বের পাট রপ্তানি অপ্রয়োজনীয় – এমনটা মবনে করলে যা হবে এটা তাই! বিস্তারে পরে অন্য কোথাও আনবো ইস্যুটা। আর এটাই টেকনিক্যাল ভাষায় ইকোনমিক ন্যাশনালিজম; যেটা ট্রাম্প প্রশাসনের মুখ্য নীতি পলিসি হতে যাচ্ছে। কিন্তু আমাদেরেকে এই লেখার মূল প্রসঙ্গে ফিরে যেতে হবে, ফলে নিচে সেদিকে যাচ্ছি…।
অর্থাৎ ইন্ডিয়া -আমেরিকা সম্পর্ক যেটা মুখ্যত ক্রম-উত্থিত গ্লোবাল অর্থনীতির নেতা হয়ে উঠতে চাওয়া চীন, এই চীনকে ঠেকাতে ভারতকে ব্যবহার করা (বিনিময়ে বাংলাদেশকে ইন্ডিয়ার হাতে তুলে দেয়া) – এটাই ছিল এই নয়া শতক ২০০১ সাল থেকে আমেরিকান নীতি। যার আয়ু এখন প্রায় ২৪ বছর; আর এতদিনে এখন আমেরিকান নীতি-নির্ধারণী মহলের অনুভব হল এই নীতি-পলিসি আকামের; এতে কোনই লাভ হয় নাই; সব পন্ডশ্রমে গেছে। তাই ২০০০ সালেরও আগের ইন্ডিয়াবিরোধী (বঙ্গোপসাগর, আন্দামান বা উপরের নর্থ-ইস্ট বা বার্মা ইত্যাদি কেন্দ্রিক) যা কিছু স্ট্রাটেজি আমেরিকার ভাবনায় ছিল (কিন্তু ভারতকে জড়িত করে চীন ঠেকানোর লোভে) পরে সেসব নীতি কার্পেটের নিচে লুকায় ফেলে রেখেছিল এতদিন আমেরিকা। সেসব নীতি-ইচ্ছা-খায়েশগুলো আমেরিকার এখন বের করে আনছে।
দুঃখ আর হতাশার কথা সুমিত এখনও কলকাতার হিন্দুত্ববাদী জমিদার ব্রাহ্মণের দৃষ্টিভঙ্গিতেঃ
উপরে ইন্ডিয়া-আমেরিকা সম্পর্কে যে ব্যাপক পরিবর্তন ট্রাম্প আনতে যাচ্ছেন সে সম্পর্কে সুমিত গাঙ্গুলী টের পেয়েছেন বা জানেন এমন কোন বাক্য বা ধারণার ইঙ্গিত তার পুরা লেখার মধ্যে কোথাও নাই! মূলত াজকের নয়া পরিস্থতিতে মোদি বাংলাদেশের উপর আগের মত আধিপত্য এর কিছুই পাবেন না; সব সে খুইয়েছে। আর এটার কারণেই সুমিতের দেয়া শিরোনাম “বাংলাদেশে ভারতের কপাল পুড়তেছে” এর আসল অর্থ; যদিও তা বুঝে সুমিত এই শিরোনাম দেন নাই। তিনি মূলত বলতেছেনঃ হাসিনা ইন্ডিয়ার বসানো পুতুল-ক্ষমতা ছিল ফলে ইন্ডিয়ার তাতে সব সুবিধা ছিল কিন্তু হাসিনা এখন উতখাত হয়েছে বলে তিনি মনে করেন না যে হাসিনা আবার ক্ষমতায় ফিরতে পারবেন – অতএব একারণেই ভারতের কপাল পুড়েছে।
সুমিত যিনি প্রায় পঞ্চাশ বছর ধরে আমেরিকায় একাদেমিক জীবনে আছেন এবং বিরাট পদবী ও ক্ষমতায় আমেরিকা-ইন্ডিয়া সম্পর্ক বিশেষজ্ঞ বলে পরিচিত; অথচ ট্রাম্পের হাত ধরে আমেরিকা-ইন্ডিয়া সম্পর্ক যে নয়া মোড় উলটা যাত্রা নিচ্ছে; ইন্ডিয়া আর আমেরিকার জন্য অত গুরুত্বপুর্ণ থাকছেনা – (কারণ চায়না কনটেইনমেন্ট বা গত ২০১০ সাল থেকে নেয়া “চীন ঠেকানোর” আমেরিকান নীতি আজ অকেজো প্রমাণিত) অথচ এদিকটা নিয়ে সুমিত একেবারেই বেখবর? এটা অবিশ্বাস্য এবং এতে তাঁর চিন্তার স্টুপিডিটি বা সীমাবদ্ধতা বাইরে প্রকাশিত! আর এতে ফাইনালি তিনি যে এক ইসলামবিদ্বেষী হিন্দুত্ববাদী জমিদারি আধিপত্যের মধ্যেই আছেন তাও প্রতিভাত! পঞ্চাশ বছর আমেরিকায় কাটানো একজন রাষ্ট্রবিজ্ঞানের একাদেমিক আর উনার পাশাপাশি একজন যে এই পুরাটা সময় কলকাতা নিবাসী আম-হিন্দুত্ববাদী বাসিন্দা ছিলেন – এমন দুজনকে পাশাপাশি রেখে তুলনা করলে দেখা যাবে এদের মধ্যে আসলে কোন ফারাকই জন্ম নেয় নাই!!!! অবিশ্বাস্য! ছোট থেকে মা, দাদি-নানির কোলে শুয়ে যে মুসলমানবিদ্বেষী গল্প শুনেছে সেগুলোও একজন আমেরিকা নিবাসী লাগাতর পঞ্চাশবছর রাষ্ট্রবিজ্ঞানের একাদেমিককে কী এখনও তাড়া করে? কীভাবে? তিনি কীভাবে এসব আবর্জনাকে এখনও তাঁর চিন্তার মূল কাঠামো বানিয়ে রাখতে পারেন???
পঞ্চাশ বছরের আমেরিকান একাদেমিক লাইফ কাটানো সুমিত বেচারার দুঃখঃ
এক. সুমিত লিখছেন, “যারা হাসিনাকে ক্ষমতাচ্যুত করতে সাহায্য করেছিল তাদের মধ্যে ইসলামপন্থী এবং ভারতবিরোধী দল রয়েছে” ????? আচ্ছা এর মধ্যে অস্বাভাবিক জিনিষটা কী? হাসিনা আর মোদি মিলে যদি বাংলাদেশকে গুম-খুন-অপহরণের আয়নাঘর বানায় রেখে ১৫ বছর ধরে দেশটা চালায় তো তাতে তো হাসিনা উতখাতে বাংলাদেশের সব অংশের জনগণের অংশগ্রহণ থাকাটাই স্বাভাবিক; নাকি? ইসলামপন্থি মানে ইসলামি রাজনৈতিক দল হলে এটা অপরাধ হবে? – এটা কেমন বোধ উনার? এটাই তো গভীর মুসলমান ঘৃণা! কিন্তু উত্তরপ্রদেশের বুলডোজার মুখ্যমন্ত্রী যোগী যাকে ভারতের সুপ্রীমকোর্ট তিরস্কার করেছেন, কাজকে অপরাধের ঘটনা বলে সাব্যস্ত করেছেন অথবা বজরং দলের ততপরতা হলে এসব কী সুনিত দেখতেই পান না? সব মাফ হাততালি দিবেন উনি? মানুষ হিসাবে নিজের সব ইন্দ্রিয়-বোধ সব ভোতা করে রেখে দিয়েছেন উনি? তাইকি?
আবার তার আরেক নয়া আবিস্কার দেখেন।
দুই. তিনি লিখেছেন, “ভারতের দৃষ্টিকোণ থেকে, বাংলাদেশ থেকে অনিয়মিত অভিবাসন সর্বদাই একটি জটিল সমস্যা ছিল-যে সরকারই অফিসে থাকুক না কেন……“। আমি খুবই সরি, এটা আসলে একটা গাধার বক্তব্য। অভিবাসন বা মাইগ্রেশন শব্দের অর্থ উনি বুঝেন না এটা ভাবা আমাদের জন্য কঠিন। কোন একটা দেশ যেমন ইন্ডিয়া তাদের বাড়তি লেবারের চাহিদা থাক আর না থাক সেখানে সীমান্ত পেরিয়ে বাংলাদেশের হিন্দুরা প্রবেশ করে বসবাস করে। এখন ১৯৪৭ সালের পর থেকে বাংলাদেশ থেকে হিন্দুরা ভারতে বা মুসলমানেরা বাংলাদেশে আসা – এটা কী কারও শখের অভিবাসন? এটা কে কী অভিবাসন বা ইমিগ্রেশন বলছেন উনি কোন বুদ্ধিতে? নাকি এটা ফোর্সড বা বাধ্য করার এক সামাজিক অবস্থা। – যা ১৮১৫ সালের রাজা রাম মোহনের চিন্তাততপরতা থেকে শুরু করে কংগ্রেসের জন্ম ও হিন্দুত্ববাদী ভারত বানানোর ইমাজিনেশন পরিকল্পনারই এক করুণ পরিণতি!!! দ্বিতীয়ত ও সবচেয়ে গুরুত্বপুর্ণ ফ্যাক্টস হল, বাংলাদেশ থেকে মূলত তুলনামূলক অবস্থাপন্ন হিন্দুরাই ভারতে গিয়েছে অর্থাৎ তারা তাদের সঞ্চিত সম্পদও সাথে নিয়েই গিয়েছে যেটা কলকাতার অর্থনীতিতে বাড়তি পুঁজির সরবরাহের উতস হিসাবে কাজ করেছে। ফলে কোন সংজ্ঞায় – বাংলাদেশ থেকে হিন্দুদের যাওয়া – এটাকে তিনি অভিবাসন বলছেন? আসলে গাধা-গরুর ধরনের চিন্তারও একটা ক্লাস থাকে! আবার ১৯৪৭ এর পরে কলকাতার অর্থনৈতিক পতন হয়েছে পুর্ববাংলা হাতছাড়া হওয়াতে। কারণ পুর্ববাংলার জমিদারেরা তাদের কালেকশন কী ঢাকায় রাখতেন??? না কলকাতায়? এটা বুঝতে কী ডক্টরেট ডিগ্রি লাগে? আর সেটাই মানে সেই জমিদারিই তো উচ্ছেদ হয়ে যায় পুর্ববাংলা থেকে পাচার হওয়া সেই বাড়তি সঞ্চিত পুঁজি থেকে বঞ্চিত হয় কলকাতা!!! এখন সুমিত আপনি বলেন, আপনি এজন্য কাকে দায়ী করবেন? এর জন্য দায়ী যারা হিন্দুত্বভিত্তিক অখন্ড ভারত বানাতে চেয়েছিল সেই কংগ্রেস নয় কী? সাহস আছে আপনার? থাকলে চিল্লায় বলেন দেখি? বুঝা যাচ্ছে যা উনার সাবজেক্ট না, দখল নাই তা নিয়ে তিনি কথা বলছেন!!!
তিন. তিনি লিখছেন, “…কিছু ভারতীয় প্রতিবেদন বাংলাদেশের মাটিতে পরিস্থিতিকে ভুলভাবে উপস্থাপন করেছে, কিছু ঘটনাকে ‘গণহত্যা’ হিসাবে চিত্রিত করা হয়েছে”! অর্থাৎ তিনি বলতে চাইছেন মোদির এই বাংলাদেশে হিন্দু নির্যাতনের অভিযোগ – এটাকে তিনি ঠিক মনে করছেন না। ভালো, এটা তিনি বুঝছেন! তাই বলছেন এটা তারা ভুলভাবে উপস্থাপন করেছে, তাই কিছু ঘটনাকে ‘গণহত্যা’ হিসাবে চিত্রিত দেখানোটা ভুল মনে করছেন।
কিন্তু আবার সেই ঘৃণার লাইনঃ
লিখেছেন, “হাসিনা বাংলাদেশের ইসলামপন্থী বাহিনীকে নিয়ন্ত্রণে রেখেছিলেন, ভারতীয় বিচ্ছিন্নতাবাদী সংগঠনকে আশ্রয় দেননি এবং ভারতীয় বিনিয়োগকে স্বাগত জানিয়ে এসেছেন। প্রতিক্রিয়ায়, নয়াদিল্লি হাসিনার অধীনে ঢাকায় গণতন্ত্রের অভাব উপেক্ষা করতে, ভারতীয় বাজারে প্রবেশাধিকার প্রদান করতে এবং আন্তঃসীমান্ত রেল ও সড়ক যোগাযোগ বাড়াতে ইচ্ছুক ছিল।”
এর মানে কী এখন বাংলাদেশের “ইসলামপন্থী বাহিনীকে” তাহলে নিয়ন্ত্রণ করছে কে? মোদি??? দেখেন এই লোকের কথার কোন তাল আছে? আবার দেখেন আগে লিখতেছিলেন শুধু ইসলামপন্থী, আর এখন সাথে লিখতেছেন ইসলামপন্থী বাহিনী? সারা দুনিয়াতেই বুশ যদি ওয়ার অন টেরর এর নামে সন্ত্রাস চালায় তো এর প্রতিক্রিয়ায় সারা দুনিয়ায় ইসলামপন্থী বাহিনী বা ইসলামপন্থী হওয়া ছাড়া আর কী হবে? মানে বাংলাদেশের কেউ বুশের প্রতিবাদ করবে না? আর বাংলাদেশ কী দুনিয়ার বাইরে?
এছাড়া আরেকটা মারাত্মক দিক আছে। সুনিত নিজেই বলছেন বাংলাদেশে হাসিনা মোদির সাথে মিলে ঢাকায় গণতন্ত্রের অভাব উপেক্ষা করেছে – তাহলে এই দোষ কার? আবার মোদি বাংলাদেশকে ইন্ডিয়ার একচেটিয়া বাজার বানিয়েছে আর বিনা পয়সায় করিডোর সুবিধা নিয়ে গেছে – এসব কথা সুমিত নিজেই স্বীকার করছেন। তাহলে বাংলাদেশের মানুষ যেকোন পন্থি হয়ে হাসিনাকে উতখাত তো করবেই, নাকী? তো তাহলে ইসলামপন্থী হওয়াটা অস্বাভাবিক কীভাবে???
হাসিনা তার শাসন আমলে যত কী তার রাজনৈতিক বিরোধী ছিল তাদেরকে তিনি গুম-খুন আয়নাঘর করেছেন – তাদের গায়ে মিথ্যা ইসলামি জঙ্গীর ট্যাগ লাগিয়ে তাদেরকে নিচা দেখায়ছেন।। মজার কথা হল এটা আমার কথা না। এবার মানে ২০২৩ সালের আমেরিকান সন্ত্রাস বাদ ও প্রতিরোধ রিপোর্ট ২০২৩ যা সম্প্রতি প্রকাশিত হয়েছে এতে বাংলাদেশ চাপ্টারে আমেরিকাই একথা লিখে স্বীকার করেছে। কিন্তু আমেরিকায় বসে থেকে এই হিন্দুত্ববাদের চেলা কলকাতা বামুন সুমিত গাঙ্গুলী সেটা টের পান নাই; খবর করে নাই! নেন প্রথম আলোর বাংলা করা অংশটাই দিলাম। শিরোনাম দেখেন, …“রাজনৈতিক বিরোধিতাকে সন্ত্রাসবাদ বলে চালিয়েছে আওয়ামী লীগ সরকার“। আবার এখানে ইংরাজি মূল রিপোর্টটাও দিয়ে রাখলাম সুমিত গাঙ্গুলীর জন্য [Country Reports on Terrorism 2023: Bangladesh] – আমেরিকায় বসে উনি এটা নাও খুঁজে পেতে পারেন!!!
আসলে এসব সুমিত গাঙ্গুলীরা আমেরিকার জন্যও কলঙ্ক! এরা এখনও কুয়ার ব্যাঙ হয়ে জমিদার-হিন্দুর বয়ান আগলে ওর উপরে বসে আছে। অথচ সুমিত খোদ আমেরিকান সরকারের বয়ান না পড়ে, আমেরিকাতেই বসে আছে্ন। আর তীব্র মুসলমানবিদ্বেষী হয়ে আমাদেরকেই ইসলামপন্থী (যারা হাসিনাকে উতখাত করেছে) বলে ট্যাগ লাগাইতেছেন; এছাড়া আমরা নাকি সশস্ত্র এর ইঙ্গিত দিতে ইসলামপন্থী বাহিনী লিখেছে!!!
আবার কত নিচা মনের কলকাতার কোন স্টেশনের এক ফেরিওয়ালা যেন তিনি!!! তাই তার এই লেখা শুরু করেছেন, কেন বাংলাদেশে পাকিস্তান থেকে বাণিজ্যের মালবাহী জাহাজ কেন বাংলাদেশে ভিড়ল। আবার লিখেছেন …Dhaka has also boosted its acquisition of arms and ammunition from Islamabad। মানে ইউনুস সাহেব পাকিস্তান থেকে নাকি অস্ত্র আমদানি করেছেন। অথচ এই তথ্যের কোন সোর্স কোথাও নাই। কলকাতার কোন বস্তিবাসীও এমন নাইভ বা ভোতা চিন্তার মানুষও এমন বক্তব্য দিবে না। অথচ তীব্র মুসলমান ঘৃণা মনে পুষে রেখে স্মিত গাঙ্গুলী – মুসলমান মানেই খারাপ, মুসলমান মানেই জঙ্গী, মানেই অস্ত্রবাজ এসব হচ্ছে তার বমি!!!! …… সুমিত গাঙ্গুলী একজন স্কলার পেশার লোক এত ঘৃণা আর এত মিথ্যা লিখতে গিয়ে টায়ার্ড হয় না?????
তবে শেষকথাটা হল, বাংলাদেশে মোদির খবর আছে এইটা যেদিক দিয়েই তিনি বুঝছেন বলে আমাদের জানাইছেন! তাই শিরোনাম দিছেন [India’s Fortunes Shift in Bangladesh]।
লেখকঃ
গৌতম দাস
রাজনৈতিক বিশ্লেষক
goutamdas1958@hotmail.com
আপডেটঃ বিকাল ৪ঃ ৩২ ২৭ ডিসেম্বর ২০২৪


