জাসদ ও আওয়ামী লীগের দ্বন্দ্ব ও সম্পর্ক


জাসদ ও আওয়ামী লীগের দ্বন্দ্ব ও সম্পর্ক
গৌতম দাস
১৯ সেপ্টেম্বর ২০১৫
http://wp.me/p1sCvy-bY

সম্প্রতিকালে জাসদ নিয়ে বিস্তর আলোচনা উঠেছে। আওয়ামী লীগের কিছু নেতা জাসদের ১৯৭২-৭৫ সালের আওয়ামি লীগের বিরুদ্ধে চরম ততপরতা কার্যকলাপের প্রসঙ্গ তুলছে। তাঁরা দাবি করছে শেখ মুজিব হত্যার জন্য জাসদের নেতা বিশেষত হাসানুল হক ইনু মত নেতারা দায়ী। যেমন মানবজমিন ২৭ আগষ্ট লিখেছে, আওয়ামী লীগের প্রভাবশালী প্রেসিডিয়াম সদস্য শেখ ফজলুল করিম সেলিম বলেন, জাসদই বঙ্গবন্ধু হত্যার পথ পরিষ্কার করে দিয়েছিল। স্বাধীনতা বিরোধীরা কখনোই বঙ্গবন্ধুর ওপর আঘাত হানতে পারতো না যদি গণবাহিনী,জাসদ বঙ্গবন্ধুর বিরোধিতা করে বিভিন্ন জায়গায় ডাকাতি, মানুষ হত্যা করে এমপি মেরে পরিবেশ সৃষ্টি না করতো। বঙ্গবন্ধু যেদিন মারা যান সেদিন কর্নেল তাহেরও রেডিও স্টেশনে যান”। পরের দিন “শেখ ফজলুল করিম সেলিমের বক্তব্য সমর্থন করে বক্তব্য দেন আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুবুল আলম হানিফ। একইদিনে প্রাক্তন জাসদ ছাত্রলীগ নেতা,বর্তমানে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য গয়েশ্বর চন্দ্র রায় দাবি করেন, ১৯৭৪ সালে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর বাড়ি ঘেরাও কালে হাসানুল হক ইনু এবং অধ্যাপক আনোয়ার হোসেনই প্রথম গুলি করেন”। এরপরে জাসদ ইনুও পালটা আওয়ামী লীগের নেতাদের শেখ মুজিব হত্যা উত্তর মোস্তাক মন্ত্রীসভায় যোগদানে কাড়াকাড়ির প্রসঙ্গ তুলে খোচা দেয়া জবাব দেন। নিশ্চয় এই সময়ে প্রত্যেকের বক্তব্যের পিছনের প্রত্যেকের উদ্দেশ্য কী তা তাঁরাই ভাল বলতে পারবেন। তবে আওয়ামী লীগ ও জাসদ উভয়ের উদ্দেশ্যের একটা কমন দিক এখানে দেখা গেছে। তা হল, কে কতটা শেখ মুজিবের কাছের থাকেন নাই বা ছিলেন না তা নিয়ে হাসিনার কাছে নালিশ দিয়ে কান ভারী করা।

ঘটনার পিছনের উদ্দেশ্য যাই থাক, ১৯৭২ সালে স্বাধীনের পরের সাড়ে তিন বছরে শেখ মুজিব বেঁচে থাকা এবং সরকার প্রধান থাকা অবস্থায় আওয়ামী সরকারের সবচেয়ে চরম ও কার্যকর রাজনৈতিক বিরোধীতা করেছিল জাসদ। এটাই স্বাধীন বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসের সেসময়ে সবচেয়ে বড় অধ্যায় জুড়ে থাকা ঘটনা ছিল। ততকালীন সরকারের রক্ষীবাহিনী দিয়ে বলপ্রয়োগে দমন নির্যাতনের শাসনের বিরুদ্ধে কার্যকর বিরোধীতা সক্ষম করে দেখাতে পেরেছিল একমাত্র জাসদ। এই অর্থে জনগণের উপরে সরকারের দানবীয় দমন নির্যাতনকে জনগণের সামনে উদোম করে দেখিয়ে সরকারকে চরম অ-জনপ্রিয় করে তোলা এবং সরকারের রাজনৈতিক পতনের শর্ত তৈরি হয় এমন মৌলিক কাজটা ঘটেছিল জাসদের হাতে। ফলে জাসদ ১৫ আগস্ট সরাসরি ভুমিকা নিয়ে থাকুক অথবা না – এটা ঐতিহাসিক সত্য যে শেখ মুজিব সরকারকে অ-জনপ্রিয় করা ও পতন ত্বরান্বিত করার দিকে ঠেলে দেয়ার রাজনৈতিক পটভুমি জাসদের রাজনৈতিক ততপরতাতেই নির্মিত হয়েছিল। জন্মের পর থেকে সেসময় এটাই ছিল জাসদের ঘোষিত লক্ষ্য। এদিক থেকে শেখ সেলিম অথবা মোহম্মদ হানিফ ইত্যাদি যেসব আওয়ামি নেতা জাসদের নেতা হাসানুল হক ইনুর বিরুদ্ধে যেসব অভিযোগ তুলছেন তা জেনুইন। যদিও আওয়ামি লীগের কিছু নেতাদের দিক থেকে জেনুইন অভিযোগ আর জাসদের দিক থেকে দেখলে  এটাই তার জেনুইন গর্ব। এখনকার চলতি সরকার বা দলের সাথে সম্পর্ক রাখে না এমন যেকোন জাসদ কর্মী এটাকে গর্ব বলে মনে করবে। কারণ এটাই জাসদের ইতিহাস। এটা নিজের গর্ব মনে করেই জাসদ জাসদ হয়েছিল। নইলে তো সে আওয়ামী লীগ থাকত। একালে এই গর্বের চেয়ে মন্ত্রীত্ব ক্ষমতা দামি হয়ে উঠতে পারে। কিন্তু সেজন্য ইতিহাসকে তো এখন আর বদলে নেয়া যাবে না। তবুও আওয়ামী নেতারা এখন এসব অভিযোগ কেন তুলছেন সে টাইমিং বা সময়জ্ঞান অর্থে তাদের উদ্দেশ্য কী সে প্রশ্নটা আলাদা হয়ে থেকে যাচ্ছে।

আর এক কারণে টাইমিং এর প্রশ্ন উঠাও খুবই স্বাভাবিক। কারণ ২০০৯ সালে চলতি সরকার গঠনের শুরু থেকে জাসদ আর আওয়ামি লীগ যেন একাকার দুজনে দুজনার,পরস্পর পরস্পরের জন্য যেন জন্মিয়েছে এমন এক ঐতিহাসিক মিথ্যা ধারণা তৈরি করে সেটা শুরু করা হয়েছিল। বাইরের দিক থেকে যদি দেখি, জাসদ ও আওয়ামি লীগ ১৪ দলীয় জোটের পরস্পর দুই সাথী ও গঠিত সরকারের জোটসঙ্গী মাত্র। দুটো দল মানেই দুটো রাজনীতি। আর অবশ্যই তা পরস্পরের বিরোধী রাজনীতি। এই আলাদা রাজনীতিতে গভীর ভাবে পরস্পরের রাজনৈতিক বিরোধিতা থাকা সত্ত্বেও কোন একটা জোটে আবার দুই দলেরই তাতে যোগ দেয়া, জোটে আবদ্ধ হওয়া এবং সে জোটের সরকার গঠন করে ফেলা- সারা দুনিয়ার রাজনীতিতে এমনটা কোন অস্বাভাবিক ঘটনা নয়। ফলে এবিচারে জাসদ আর আওয়ামি লীগ এই দুদলের রাজনৈতিক সখ্যতার বিরুদ্ধে কোন প্রশ্ন তোলার কিছু নাই। এরপরেও জাসদ আর আওয়ামি লীগের রাজনৈতিক সখ্যতার বিরুদ্ধে প্রশ্নটা উঠছে সম্ভবত এজন্য যে এটার পিছনে এক আনহোলি এলায়েন্স বা অশুভ আঁতাত কাজ করছে; যার নাম প্রতিহিংসার রাজনীতি।
কোন দেশেই নিজের ইতিহাসের বয়ান একটা থাকে না। একাডেমিক পর্যায়ে ইতিহাস নিয়ে নানান বিতর্ক তো থাকেই। আর এছাড়া রাজনৈতিক পর্যায়ে ব্যাখ্যা বয়ানের ফারাক থাকে। এটা স্বাভাবিক। বাংলাদেশেও স্বাধীনতার পরবর্তী ইতিহাস নিয়ে বিতর্ক আছে। বিশেষত পঁচাত্তর পরবর্তী ঘটনাবলী নিয়ে। আর নভেম্বরের ঘটনাবলী নিয়ে আওয়ামী লীগ, জাসদ এবং বিএনপি এই তিন দলের কোন কমন ভাষ্য নাই ঘটনার সময় থেকেই। অথচ জাসদের জন্ম ১৯৭২ সাল থেকে চলতি সরকার গঠনের আগে পর্যন্ত এতে দেখানোর চেষ্টা হয়েছে যেন বাংলাদেশের কোন কালেই এই দুই দলের মধ্যে রাজনৈতিক অবস্থানে কোন ভিন্নতা ছিল না।

যে কোন দুটো দল মানেই দুটো ভিন্ন রাজনীতি। ফলে তাদের মধ্যে সমাজের বিভিন্ন বিরোধ ইস্যুকে দেখবার ক্ষেত্রে ভিন্নতা, ফলে রাজনৈতিক অবস্থানের ভিন্নতা আছে। এমনটা থাকবেই। এটা স্বতসিদ্ধ, আপনা আপনি সত্য। কারণ ভিন্নতা আছে বলেই তো ওরা আলাদা আলাদা দুটো রাজনৈতিক দল। এমন ভিন্নতা যদি না-ই থাকত তবে তো তারা আসলে একই দল। বলা হয়ে থাকে কোন রাজনৈতিক দলের মধ্যে কখনও যদি দুটো পরস্পর বিরোধী রাজনৈতিক লাইন বা চিন্তা জন্ম নেয় যে সে বিরোধ নিরসন করে তারা এক কমন অবস্থানে পৌছাতেই পারল না। সম্ভব হল না। এর অর্থ ঐ দল তখন থেকে বাস্তবত দুটা আলাদা দলে পরিণত হয়ে গেছে। ফলে এরপর থেকে ওরা আনুষ্ঠানিক আলাদা দল হয়ে যাবার পথে রওনা দিবে বা দিয়েছে। সেটা আনুষ্ঠানিক কবে ঘটবে কেবল সেই সময়ের অপেক্ষা। অতএব জাসদ ও আওয়ামী লীগ দুটো আলাদা দল বলা মাত্র বুঝতে হবে দল দুটোর রাজনীতি আর এক নয়। কিন্তু ২০০৯ সা্ল থেকে এই মিথ্যা ভান তৈরি করা হয়েছিল।
এটা কমবেশী অনেকেই জানেন যে আওয়ামী লীগের ভিতর থেকে যারা ১৯৭২ সালে স্বাধীনতা পরবর্তীতে জাসদ নামের রাজনৈতিক দল হিসাবে নিজেদের হাজির করেছিল সে উপধারার মুল নেতা সিরাজুল আলম খান। তখন থেকেই সিরাজুল আলম খানের রাজনীতি আর আওয়ামী লীগের রাজনীতি এক নয়। যদিও পাকিস্তান আমলে ষাটের দশক থেকেই তিনি আওয়ামী লীগের ভিতরেই একটা উপধারা এবং সবচেয়ে শক্তিশালী প্রভাবশালী ঐ উপধারার মূল নেতা। আবার আওয়ামী লীগ বললাম বটে কিন্তু সিরাজুল আলম খান নিজে কখনও আওয়ামী লীগের কোন সাংগঠনিক কমিটির আনুষ্ঠানিক সদস্য ছিলেন তা জানা যায় না। তবে ষাটের দশকের শুরুর দিকে তিনি ছাত্রলীগের সভাপতি হবার পর থেকে পরবর্তি গঠিত প্রত্যেক কেন্দ্রিয় কমিটিতে (তখনকার দিনে প্রত্যেক বছর সম্মেলন হত ফলে প্রতি বছর নতুন নেতৃত্বের কমিটি) প্রভাবশালী ধারাটা হত বা থাকত ব্যতিক্রমহীনভাবে সিরাজুল আলম খানের অনুসারীদের। অনুসারীদেরকে নিয়ে পরিচালিত এই গ্রুপটাকে নিজেদের মধ্যে “নিয়ক্লিয়াস” বলে হত। নিউক্লিয়াস কথাটার সারার্থ হল যারা ভবিষ্যতে আওয়ামী লীগের রাজনীতি ছাড়িয়ে এক র্যা ডিকাল বিপ্লব করতে চায় তাদেরই আলাদা গ্রুপ,আওয়ামী লীগের ছাত্র লীগের ভিতরে তাদেরই ভ্রুণ – এই অর্থে নিউক্লিয়াস। বাইরে থেকে দেখলে ততকালীন কোল্ড ওয়ারের যুগে যে কোন রাজনৈতিক সংগঠনের ভিতরেই যেমন বামপন্থী আর ডানপন্থী বলে উপধারা দৃশ্যমান দেখা যেত,যারা পরস্পর লড়াই ঝগড়া করত আবার কোন কাজ কর্মসুচিতে সিদ্ধান্তের বেলায় আপোষ মীমাংসা করে একসাথে একই সংগঠনে কাজ করত। ঠিক তেমনই আওয়ামী ছাত্রলীগের মধ্যেকার এই “নিউক্লিয়াস” নিজেদেরকে বামধারা মনে করত। এখানে নিউক্লিয়াস বা সিরাজুল আলম খানের রাজনীতি সম্পর্কে যা বলা হচ্ছে তা আমার মুল্যায়্নের দিক থেকে বলা নয়, তার চেয়ে তাঁরা নিজেরা নিজেদের কি মনে করত সেদিক থেকে লেখা। সিরাজুল আলম খানের বিশেষ কৃতিত্ত্ব ছিল,শেখ মুজিবের আপন ভাগনে শেখ মনিকে নিজের গ্রুপের পক্ষে ও নিজের নেতৃত্বের অধীনে রাখতে পারা। এভাবে রাজ্জাক,তোফায়েল,রব,শাহজাহান সিরাজ এরা সবাই ছিল নিউক্লিয়াসের সদস্য। নিউক্লিয়াসের বিপরীতে বা বাইরে ছিলেন নুরে আলম সিদ্দিকী,আব্দুল কুদ্দুস মাখন, ফেরদৌস কোরেশী ইত্যাদি এদের মত নেতারা যারা আওয়ামী লীগের নানান কেন্দ্রীয় নেতার অনুসারি। কিন্তু সিরাজুল আলম খানের চেয়ে বেশী প্রভাব ছাত্রলীগের উপর কেউই রাখতেন না। ওখানে একছত্র প্রভাব সিরাজুল আলম খানের। আবার বিষয়টা এমন নয় যে সিরাজুল আলম খান মুল আওয়ামি লীগের বাইরের কেউ। কিন্তু আওয়ামী লীগের সাথে তাঁর সম্পর্কটা কেবল শেখ মুজিবের সাথে ও মাধ্যমে আর সরাসরি। এই দুজনের পারস্পরিক বোঝাপড়া আস্থা ছিল খুবই গভীর। ব্যক্তিগত সম্পর্কও গভীর,সৎ এবং স্পর্শকাতর। যদিও সব কিছুর উপরে রাজনৈতিক মুল্যায়ন ও বিশ্বাসের দিক থেকে সিরাজুল আলম খান নিজেকে “বিপ্লবী” আর শেখ মুজিবকে “বুর্জোয়া” মনে করতেন। ফলে মনে করা যেতে পারে যে, মূলত তাঁর এই ধারণার দিনকে দিন যথেষ্ট শক্তিশালী হয়েছিল বলে সিরাজুল আলম খান ১৯৭২ সালে নবগঠিত মুজিবের রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে সশস্ত্রভাবে উঠে দাঁড়িয়েছিলেন। সঠিক অথবা বেঠিক রাজনৈতিক লড়াই করেছেন। যদিও ১৯৭২ সালের জানুয়ারীতে শেখ মুজিবের পাকিস্তানের বন্দীদশা থেকে ফেরার পর থেকে পরের তিন মাস সিরাজুল আলম খান নিজের “বিপ্লবী” অবস্থান ও রাজনীতি নিয়ে মুজিবের সাথে দীর্ঘ আলাপ আলোচনা করার সুযোগ পেয়েছিলেন বা নিয়েছিলেন। তাদের উভয়ের রাজনৈতিক সম্পর্ক, ঘনিষ্ঠতা এবং বিতর্ক কোন তাত্ত্বিক ধরণের ছিল না। বা তত্ত্ব নিয়ে করেন নাই। তাঁরা কথা বলেছিলেন, সিরাজুল আলম খানের তোলা বিভিন্ন ইস্যু বা দাবীতে একমত হতে পারেন কি না। ফলে তাত্ত্বিক রাজনীতির বদলে একেবারেই ব্যবহারিক রাজনীতির – পদক্ষেপ ও করণীয় বিষয়ের দিক থেকে ছিল তাদের তর্ক ও মতভেদ। ফলে শেষ দিন পর্যন্ত সিরাজুল আলম খানের একটা আশা ছিল, হয়ত তিনি তাঁর “মুজিবভাইকে” বুঝিয়ে রাজি করাতে পারতেও পারেন – যুক্তির জোরে নয় ব্যবহারিক সম্পর্কের জোরে।
যেমন স্বাধীনের পর প্রথম ১৯৭২ সালের মে মাসে ছাত্রলীগের কেন্দ্রিয় সম্মেলন ডাকা হয়। একই দিনে একই রাজধানী শহরে কিন্তু দু জায়গায় আলাদা আলাদা দুই আহবায়ক সে সম্মেলন ডেকেছিল। আর দুই সম্মেলনেই প্রধান অতিথি হিসাবে পোস্টারে নাম ছিল শেখ মুজিবের। স্বভাবতই শেখ মুজিব শেষমেষ সিরাজুল আলম খানের সমর্থিত অংশের বদলে এর বিরোধী অংশের সম্মেলনে অতিথি হিসাবে গিয়েছিলেন। আর এর মাধ্যমে এর পর থেকে শেখ মুজিব ও সিরাজুল আলম খানের মধ্যকার রাজনৈতিক অবস্থান বিরোধ প্রকাশ্য ও চিরস্থায়ী আলাদা পথে এবং দলে পরিচালিত হতে শুরু করেছিল। আলাদা রাজনৈতিক দল জাসদ গঠনের ঘোষণা এসেছিল আরও পাঁচ মাস পরে অক্টোবরে। কিন্তু সম্ভাব্য হবু জাসদ নামের রাজনৈতিক দলের ছাত্র সংগঠন হিসাবে আলাদা ছাত্রলীগ ঐদিন থেকেই আলাদা ও প্রকাশ্য সংগঠন হয়ে যায়। শুরু হয় শেখ মুজিব ও সিরাজুল আলম খানের মধ্যকার প্রথম রাজনৈতিক বিচ্ছেদ। এই বিচ্ছেদ ঘটানো বাংলাদেশের জন্য সঠিক হয়েছিল কি না সেটা আলাদা মুল্যায়ন। ফলে আলাদা সময়ে করতে হবে। কিন্তু আপাত প্রসঙ্গের প্রয়োজনের এই বিরোধটাকে সার করে এভাবে বলা যায় যে, শেখ মুজিব ও সিরাজুল আলম খানের একসাথে করা আন্দোলন লড়াই ও সশস্ত্র যুদ্ধের শেষে ফসল হিসাবে গঠিত শেখ মুজিবের নেতৃত্বের রাষ্ট্রটাকেই এবার সরাসরি ও মুখোমুখি সশস্ত্রভাবে বিরোধীতা করা শুরু করেছিলেন সিরাজুল আলম খান। আগেই বলেছি এটা ঠিক না ভুল ছিল সেদিকে যাব না । কেবল জাসদ ও আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক বিরোধ জন্মের শুরু থেকেই যে গভীর এবং চিন্তার পার্থক্য মৌলিক, সেদিকটা নজর করাব। এর ফলে তখন থেকে সিরাজুল আলম খানের সাথে রাজনৈতিক বিচ্ছেদ ঘটিয়ে শেখ মনি রাজ্জাক,তোফায়েলকে সাথে নিয়ে মামা শেখ মুজিবের পক্ষে চলে যান।
অতএব সারকথা দাঁড়াল, শেখ মুজিব ও সিরাজুল আলম খানের ব্যক্তিগত সম্পর্ক যতই ঘনিষ্ঠ থাক না কেন উভয়ের রাজনৈতিক বিরোধ হয়ে পড়েছিল খুবই তীব্র,যার তুলনায় ব্যক্তিগত সম্পর্ক খাটো পড়ে গেছিল। ফলে সেটা খুবই ম্লান। যেমন ৬৯ সালে শেখ মুজিবকে বঙ্গবন্ধু বানানোসহ তাকে কাল্ট ও ক্যারিসমায় মুল জননেতা হিসাবে হাজির করার পরিকল্পনা ও কৃতিত্ব মূলত সিরাজুল আলম খানের। কিন্তু জাসদ গঠনের পর থেকে দলের আভ্যন্তরীণ কালচারে অথবা পাবলিক বক্তৃতায় আর কখনই জাসদের কোন নেতা শেখ মুজিবকে বঙ্গবন্ধু ডাকে নাই,কেবল শেখ মুজিব বলেছেন। এ’যেন নিজের দেয়া খেতাব মুকুট নিজেই খুলে নিতে চেয়েছিলেন তারা আর,বলতে চেয়েছিলেন জাসদের বিপ্লবী রাজনীতির চোখে শেখ মুজিব ও তাঁর রাজনীতি বিশ্বাসঘাতক।

শুরুতে যেকথা বলছিলাম ২০০৯ সালে তবু এক মিথ্যা ভান তৈরি করা হয়েছিল যে জাসদ ও আওয়ামী লীগ যেন একই দল ছিল। যেন বলার চেষ্টা করা মুসলীম লীগ করা লোকেরাই তো আওয়ামি লীগ করেছে,ফলে তারা একই লোক ও একই রাজনীতি করে। তবে ইনুর জাসদ এর চেয়েও আরও বড় শঠতার আশ্রয় নেয়। হঠাত করে গোপনে ইনু জাসদের নেতারা বঙ্গবন্ধু বলতে শুরু করে দেন।
যে কোন রাজনৈতিক দল নিজের অতীতের কোন কোন রাজনৈতিক অবস্থান ভুল ছিল বলে পরবর্তিকালে মুল্যায়ন করতেই পারেন। সেটা কোন অনৈতিক বা অন্যায় নয় অথবা অস্বাভাবিক বিষয় নয়। কিন্তু তা হতে হবে প্রকাশ্য প্রক্রিয়ায়,ঘোষণা দিয়ে এবং কারণ ব্যাখ্যা করে। জন্মের সময় থেকে চলে আসা জাসদীয় কালচারের চর্চা এবং আওয়ামি লীগের সাথে তার উল্লেখযোগ্য প্রতীকী ফারাক নির্দেশক ঘটনা ছিল “বঙ্গবন্ধু” আর না বলা। অথচ সেসব মৌলিক দিক ও সততার দিক বেমালুম ভুলে অস্বীকার করে ইনুর জাসদ হঠাত করে বঙ্গবন্ধু বন্ধবন্ধু বলে ঢলে পড়া শুরু করে দেয় ২০০৯ সালের সরকার গঠনের পর থেকে। এটা হল প্রতিহিংসার রাজনীতি থেকে ব্যক্তিগত ফয়দা বের করা। আর বিনিময়ে বাংলাদেশের রাজনীতিতে জাসদের যেটুকু ইতিবাচক অবদান ছিল এর গায়ে কালি লাগিয়ে তাকে ধুলায় লুটায় দেয়া।
তাই ঐ একই সময় থেকে গোপনে আর এক সমঝোতা হতে দেখা যায়। সেটা হল, খালেদ মোশারফের ক্যু এর ঘটনাকে কেন্দ্র করে। এই ঘটনা ১৯৭৫ সালের ২ ও ৩ নভেম্বরের মাঝের রাতে্। ১৯৭৫ এর নভেম্বরের পর থেকে ঐদিনের ঘটনা সম্পর্কে দল হিসাবে আওয়ামী লীগের আনুষ্ঠানিক অবস্থান ছিল,এটা এক ক্যু এর ঘটনা। আর এর নায়কদের সাথে আওয়ামী লীগের কোন ধরণের রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টতা বা দায় ছিল বলে স্বীকৃতি না দেয়া । লীগ ২০০৯ সালের আগে পর্যন্ত এই অবস্থান থেকে সরে নাই। বরং আওয়ামী লীগ যে কোন ক্যু, ক্ষমতাদখল বা হত্যার রাজনীতির নীতিগত বিরোধী; “বেসামরিক সরকার” উচ্ছেদ করে “সামরিক সরকার” কায়েমের বিরোধী – এই ছিল আওয়ামী লীগের সাধারণ ও নীতিগত অবস্থান। ১৯৮১ সালে হাসিনা ভারত থেকে দেশে ফিরে এসে দলের সভাপতির হাল ধরার পরও এই অবস্থান বজায় ছিল। বরং খালেদ মোশারফের ক্যু এর ঘটনার প্রতি কোন বিশেষ প্রতিক্রিয়া না দেখিয়ে সুনির্দিষ্টভাবে তেসরা নভেম্বর (চার নেতার) “জেল হত্যা দিবস” প্রতিবছর পালন করে এসেছে আওয়ামি লীগ। এটাই লীগের দলীয় অবস্থান। বিপরীতে জাসদ খালেদ মোশারফের ক্যু এর ঘটনাকে ঘটনার পরের দিন থেকে নিজে দেখেছিল এবং লিফলেট ছড়িয়ে জনগণকে দেখিয়েছিল যে এই ক্যু আওয়ামী লীগ ও ভারতের সমর্থনের এক ক্ষমতা দখল। মনে রাখতে হবে, ১৯৭৫ সালের ৭ নভেম্বর তাহেরের পাল্টা ক্ষমতা দখলের পক্ষের লিফলেটে ন্যায্যতা টানার তাহেরের ভাষ্য ছিল সেটা। অর্থাৎ আওয়ামী লীগ ও ভারতের সমর্থনের এক সামরিক ক্ষমতা দখলের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ করতেই তাহের পাল্টা “সিপাহি-জনতার ক্ষমতা দখলে” প্ররোচিত হয়েছেন। এই ছিল তাহেরের ক্ষমতা দখলের পক্ষে দেয়া সাফাই। এই অর্থে ৭ নভেম্বর সম্পর্কে জাসদের সোজা ব্যাখ্যা বয়ান হল, “৭ নভেম্বর হল, ভারতীয়-আওয়ামী ক্যু এর বিরুদ্ধে জাসদের প্রতিরোধ”। জাসদের এই বয়ান ২০০৮ সাল পর্যন্ত বহাল ছিল। এবং বলাই বাহুল্য যে এই বয়ান আওয়ামীকে অভিযুক্ত করা বয়ান। অনুসন্ধিৎসু আগ্রহিরা এবিষয়ে ফলে একালেও এখান থেকে আওয়ামী লীগ ও জাসদের বয়ানের মিল খুজে আনা অসম্ভব।

২০০৯ সাল। এই দুই বিপরীত ভার্সনের বিরোধ নিরসন মিটমাটের গোপন সমঝোতায় নতুন কমন ভার্সন খুঁজার চেষ্টা শুরু হয় ২০০৯ সাল থেকে। সেই চেষ্টায় শেষে আসে “মুক্তিযোদ্ধা হত্যা দিবস” বলে চিহ্নিত করে আওয়ামী লীগের প্রপাগান্ডা কমিটিগুলোর পক্ষ থেকে ৩-৭ নভেম্বরের যে কোন দিনকে পালনের চেষ্টা করা হয়। একইভাবে জাসদও এমন মুল্যায়নেই পালন করতে চায় এবং করে; তবে কেবল ৭ নভেম্বরের দিনটা বাদ দিয়ে। কারণ ১৯৭৫ সাল থেকে জাসদ এটাকে সিপাই-জনতার অভ্যুত্থান দিবস হিসাবে পালন করে আসছে। যেটা আবার আওয়ামী লীগের পক্ষে একইভাবে অন্তত ৭ নভেম্বরকে পালন করা, মনে করা অসম্ভব। আওয়ামি লীগ ও জাসদের “মুক্তিযোদ্ধা হত্যা দিবস” নামে একটা কমন ভার্সান চালু করার পিছনের তাগিদ হল এই বয়ান হাজির করা যে জিয়াউর রহমান বা বিএনপি ঐ দিনগুলোতে মুক্তিযোদ্ধাদের হত্যা করেছে এই অভিযোগ তোলা, যাতে এসব বয়ান দিয়ে আওয়ামি লীগ ও জাসদের কমন শত্রু বিএনপির বিরুদ্ধে কামান দাগানো যায়। এটাই তাদের কমন এবং ২০০৯ সাল থেকে চালু করা নতুন মুল্যায়ন। এটা নিঃসন্দেহে এক প্রতিহিংসার রাজনীতি।
কিন্তু এরপরেও এই কমন মুল্যায়ন যে সাধারণ যুক্তিবুদ্ধিতে সিদ্ধ,তালমিল আছে তা দেখানো যায় নাই। কারণ সত্য হল, ১৯৭৫ সালের আগষ্ট থেকে নভেম্বর এই সময়কালেও আওয়ামি লীগ ও জাসদ আগের মতনই পরস্পর পরস্পরের বিনাশ নিশ্চিহ্ন দেখতে চায় এমন দুই রাজনৈতিক দল ও শত্রু ছিল। ফলে এই শত্রুতাকে আজ ঢেকে আড়াল করে, তারা সেসময়ে “বন্ধু ছিল” বলে এমন কোন কমন বয়ান খুজে হাজির করা এককথায় বললে অসম্ভব। কারণ তাহলে জিয়াউর রহমানকে ২-৩ নভেম্বর ১৯৭৫ এর রাতে বন্দী করে খালেদ মোশারফের সামরিক ক্ষমতা দখলকে জায়েজ বলতে হবে যেটা -আওয়ামি লীগ ও জাসদ উভয়ের কেউই দাবি করতে রাজি হবে না। তাই এমন কোন কমন বয়ান খাড়া করা এককথায় অসম্ভব। তাতে আজকে তারা উভয়ে যতই বিএনপিকে তাদের কমন শত্রু মনে করে কামান দাগাতে চাক না কেন।
প্রতিহিংসা সবসময়ই এক মারাত্মক ধ্বংসের কাজ, নেতিবাচক কাজ। মানুষের সম্ভাবনার অপব্যবহার। এরচেয়েও বড় বাজে ব্যাপার হল,ঐ প্রতিহিংসাকেই রাজনীতি করা বলে মনে করা। রাজনীতি বলে চালিয়ে দেবার চেষ্টাই তবু এখন চলছে। প্রতিহিংসা বড়জোর কোন সাইকিক পেসেন্টের মনের ব্যক্তিগত জ্বালা মিটায় হয়ত। কিন্তু তাঁর রোগ ভাল হয় না তাতে। এছাড়া তবু এরপরেও তা রাজনীতি নয়।

এভাবেই গত কয়েক বছর ধরে আমরা আওয়ামি লীগ-জাসদের প্রতিহিংসার আগুন দেখছিলাম। কিন্তু হঠাত করে গত এক মাসে তাতেও আবার ছন্দপতন দেখছি আমরা। হাসিনা নিজের মুখে বলেন নাই সত্য কিন্তু শেখ সেলিম অথবা মোহম্মদ হানিফ যারা দুজনেই শেখ হাসিনার ঘনিষ্ট আত্মীয় এরা ইনু জাসদের কাপড় খুলে দেবার চেষ্টা লক্ষ্য করার মত ছিল। এর এক সম্ভাব্য ব্যাখ্যা হতে পারে এমনঃ
সম্প্রতি একটা বিষয়ে হাসিনার সরকারের বিগত দুবছরের অবস্থান পল্টি খেতে দেখা গেছে। শুরু হয়েছিল পুলিশের আইজি, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী, আইনশৃঙ্খলা বিষয়ক মন্ত্রীসভা কমিটি আর সবশেষে খোদ প্রধানমন্ত্রী আর এরও পরে সংস্কৃতিসেবী রামেন্দ্র মজুমদার –এভাবে। আমরা দেখলাম হঠাত করে সবাই বলতে শুরু করলেন যে, – ধর্মীয় অনুভুতিতে আঘাত দেয়া, ধর্মবিদ্বেষ ছড়ানো জাগানো এবং ঘৃণা ছড়ানোর কাজ করলে অন্যের মানবাধিকার লঙ্ঘন করা হয়; ফলে এই লঙ্ঘন কেউ ঘটালে তাকে ১৪ বছরের সাজা দেয়া হবে। এমন পোল বদল, এটা আক্ষরিক অর্থেই নাস্তিকের আল্লাহর পথে ফিরে আসার মত ঘটনা। অথচ গত দুবছর ধরে সরকার এর উলটা নীতিই অনুসরণ করেছে। ব্লগার নামের উতপাতকারিদের অন্যের “মানবাধিকার লঙ্ঘনের” কাজকে সরকার সুরক্ষা দিয়ে গেছে। নবীকে অপমান করা ও কুৎসা রটনা করার কাজকে সেকুলারিজমের স্বাধীনতা চর্চা বলে প্রশ্রয় দিয়ে গেছে। আর এর প্রতিবাদকারিদেরকে “জঙ্গী আসছে” অথবা এগুলো “জঙ্গী ততপরতা” বলে দাবি করে তাদেরকে গুলি নির্যাতনের মুখোমুখি করা হয়েছে। আর একে কেন্দ্র করে সমাজে অস্বস্তিকর পোলারাইজেশন বিভেদ বিভক্তি চরমে পৌচেছে। সমাজের গাঠনিক তন্তু ভেঙ্গে ছিন্নভিন্ন হয়ে গেছে।

কিন্তু সরকারের হঠাত এমন উল্টাপথে পিছটানের কারণ কী? তবে কী এটা সরকারের জনগণের প্রত্যক্ষ মুখোমুখি হওয়া অর্থাৎ ভোট চাইতে যাওয়া আসন্ন? এরই ইঙ্গিত?
কে না জানে হাসিনার নির্বাচনে ভোট চাওয়ার রাজনীতি হল মাথায় কালো কাপড় বেধে তিনি ভোট চাইতে যান। আবার ক্ষমতাসীন হয়ে গেলে এবার সেকুলারিজমের নামে পাবলিক ন্যুইসেন্স করা লোকেদেরকে সুরক্ষার দেয়ার কাজে নামেন। একবার ক্ষমতাসীন হয়ে গেলে এসময় তাঁর ক্ষমতার ন্যায্যতার বয়ান যোগাড়ের জন্য তিনি ভর করতে চান তথাকথিত বাম প্রগতিশীলতার নস্টামির উপর। অথচ আবার নির্বাচনের মুখোমুখি হওয়া যখন আসন্ন হয় তখন এই তথাকথিত বাম প্রগতিশীলতার সঙ্গ তিনি অসহ্য মনে করতে শুরু করেন,ভোটের রাজনীতিতে লায়াবিলিটি দায় মনে করেন।

শেখ সেলিম অথবা মোহম্মদ হানিফ কি তাহলে হাসিনাকে সেই দায়ের কথা স্মরণ করিয়ে দিতে চাইছেন? সে ইঙ্গিত আরও খোলসা হওয়া পর্যন্ত আমাদের অপেক্ষা করতে হবে। তবে নানাদিকে নানাভাবে আর একটা প্রহসনের নির্বাচন আয়োজন কিভাবে করা যায় নানাদিকে সেসব কথাবার্তা উঠছে লক্ষ্য করা যাচ্ছে।

[এই লেখাটা আগে অন্যদিগন্ত পত্রিকায় ০৯ সেপ্টেম্বর ২০১৫ ছাপা হয়েছিল। এখানে আরও এডিট করে আবার ছাপা হল।]

Leave a Reply

Fill in your details below or click an icon to log in:

WordPress.com Logo

You are commenting using your WordPress.com account. Log Out /  Change )

Facebook photo

You are commenting using your Facebook account. Log Out /  Change )

Connecting to %s