ভারতের ব্যর্থ নেপাল-নীতির পরিণতি কী নির্দেশ করে


ভারতের ব্যর্থ নেপাল-নীতির পরিণতি কী নির্দেশ করে
গৌতম দাস
১০ নভেম্বর, ২০১৫

http://wp.me/p1sCvy-cG

নেপালে গত সাত বছরের মধ্যে দুই বারের কনষ্টিটিউশনাল এসেম্বলি বা সংবিধান সভার নির্বাচন ও সভা পরিচালনা শেষে গত ২০ সেপ্টেম্বর ২০১৫ নতুন কনষ্টিটিউশন গৃহীত ও প্রণয়নের কাজ সমাপ্তির ঘোষণা দিতে সক্ষম হয়। এর মধ্য দিয়ে নেপাল এক রিপাবলিক জনরাষ্ট্র হিসাবে আত্মপ্রকাশ করেছে। কিন্তু ভারত প্রকাশ্যেই এর বিরুদ্ধে নিজের আপত্তি অসন্তুষ্টি জানায়। কোন রাষ্ট্রের কনষ্টিটিউশন প্রণয়ন সমাপ্তি ও গৃহীত হবার ঘোষণা বিষয়গুলো একান্তই সে রাষ্ট্রের আভ্যন্তরীণ নিজস্ব ব্যাপার। এটা ভিন রাষ্ট্রের আপত্তির বিষয়ই নয়।  ফলে এনিয়ে ভিন রাষ্ট্রের আপত্তির এক উদাহরণ দেখলাম আমরা।

“নিজে গণতান্ত্রিক দেশ হিসাবে ভারত নিঃসন্দেহে সীমা ছাড়িয়ে পা ফেলেছে, শুধু তাই নয় পড়শি ছোট দেশের উপর নিজের খায়েস চাপানোর চেষ্টা করেছে। বিভিন্ন আন্তর্জাতিক ফোরামে ভারত বারবার যে কোন রাষ্ট্রের আত্ম-নিয়ন্ত্রণের অধিকারের পক্ষে আওয়াজ তুলে গেছে। দুর্ভাগ্যবশত এই নীতি ভারত নেপালের বেলায় প্রয়োগে ইচ্ছুক নয়” – ডিপ্লোম্যাট ৭ অক্টোবর ২০১৫।  ডিপ্লোম্যাট এশিয়া প্যাসিফিক জোনে ফোকাস করে  জাপান থেকে প্রকাশিত ওয়েব ম্যাগাজিন। এশিয়ায় আমেরিকা-জাপান মিলিত উদ্যোগে কমন ষ্ট্রাটেজিক স্বার্থে পরিচালিত এক থিঙ্কট্যাংকের মন্তব্য, বিশ্লেষণ প্রকাশ করে থাকে। এতে ভারতকেও সামিল করে নেয়া হয়। নিজেদের স্বার্থের দিক থেকে মূলত চীনের বিকাশ, উত্থানকে ষ্টাডি করা  এর মূল ফোকাস। এর এডিটরিয়াল ষ্টাফদের বেশির ভাগই ভারতীয়।

তো এই ডিপ্লোম্যাট পত্রিকার পক্ষেও ভারতের নেপাল নীতি ও পদক্ষেপকে কঠিন সমালোচনা না করে থাকা সম্ভব হয় নাই। নিরবে কিন্তু কঠিন শব্দের এই মন্তব্যে ভারতের মৌলিক নীতিগত বিচ্যুতি দিক ভুলে আঙুল তুলে এটাকে “ওভারষ্টেপিং” বলা হয়েছে। ডিপ্লোম্যাটের অবস্থান ও বিশ্লেষণ খুব ইন্টারেষ্টিং। ভারতের ইন্ডায়ান এক্সপ্রেস পত্রিকা দাবি করেছে, নেপালের কনষ্টিটুশন সংবিধান সভায় অনুমোদিত হয়েছে এই ঘোষণা আসার পরও ভারত সাতটা অনুচ্ছেদে পুনরায় সংশোধন আনার জন্য অফিসিয়ালি এক তালিকা হস্তান্তর করে দাবি জানিয়েছে। ভারত এতই মরিয়াভাবে  হস্তক্ষেপ করেছে। ভারত এই রিপোর্ট অস্বীকার করে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে থেকে অস্বীকার করলেও বিবৃতি দিলেও ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস নিজের দাবি থেকে এক চুলও পিছু হটে নাই।

নতুন নেপাল রাষ্ট্র বৈশিষ্ঠের দিক থেকে সাত প্রদেশে বিভক্ত এক ফেডারল কাঠামোর রাষ্ট্র। যদিও প্রদেশগুলোর সীমানা বিষয়ক বিতর্ক এখন জারি আছে, তা টানার কাজ এখনও চূড়ান্ত করা হয় নাই, হবে। কিন্তু এটা নিয়ে নেপাল-ভারত সীমান্তের মাধোসি (Madhesi) ও তরাই সমতলি অঞ্চলের বাসিন্দাদের অসন্তোষকে উস্কে দিয়ে যেন কনষ্টিটিউশন প্রনয়নের কাজ সমাপ্ত হয় নাই – এবং হয় নাই বলার ভিতর দিয়ে নেপালের রাষ্ট্রগঠন ও ক্ষমতা তৈরিতে ভারতের এক ভাগীদার বা স্টেক আছে তাই সে প্রমাণ রাখতে চেয়েছে। নেপালের প্রধান তিন রাজনৈতিক দলের (মিলিত আসন সংখ্যা ৮৪%) এদের অভিযোগ ভারত মাধোসি ও তরাইদের মধ্যে অসন্তোষ ও উস্কানি ছড়াচ্ছে। পরিশেষে ভারত নেপালের বিরুদ্ধে অঘোষিত ভাবে বাস্তবে কার্যকর এক অবরোধ আরোপ করেছে। ল্যান্ড-লকড নেপাল, পণ্য চলাচলের দিক থেকে যা সম্পুর্ণত ভারতের উপর নির্ভরশীল, বিশেষত তেল-গ্যাস জ্বালানীর সরবরাহের দিক থেকে ১০০ ভাগ নির্ভরশীল নেপালের উপর এই অবরোধ আরোপ করে ভারতের নেপাল উপর নিজের নিয়ন্ত্রণ কত গভীর তা জাহির করতে গিয়েছিল। একথা ঠিক যে অবরোধের প্রথম ৪২ দিন ধরে নেপালের প্রতিটা নাগরিক তা হারে হারে নিজের জীবন দিয়ে বুঝেছিল যে ভারতের কত শক্তি । তবে ভারতের এই শক্তির ব্যবহার নেপালীদের কাছে অত্যাচারীর নির্যাতনকারির হিসাবেই হাজির হয়েছিল। এর প্রতিক্রিয়ার এতে ভারতের প্রাপ্তি পুরা জনগোষ্ঠির বদ-দোয়া। নেপালের জনগণ আশা করে না যে ভারত তাদের বসিয়ে খাওয়াবে। আবার এটাও আশা করে না যে ভারত তাদের স্বাভাবিক জীবন দুর্বিষহ করে তুলবে।

প্রকৃতির নিয়ম কোন জায়গা খালি থাকে না। ফলে ভারত নেপালকে জ্বালানি সরবরাহ না দিয়ে মারবে এই সিদ্ধান্ত খোদ ভারতের জন্যই বিশাল বিপদ হয়ে হাজির হতে বেশি সময় লাগে নাই। জ্বালানি সরবরাহ-হীন পরিস্থিতি নেপালকে মরিয়া হয়ে বিকল্পের সন্ধানে নামতে বাধ্য করেছিল। গত সপ্তাহ ০২ নভেম্বর থেকে ভারতের মিডিয়ার মনে পড়েছিল যে ট্রাডিশনালি ভারত নেপালের একমাত্র জ্বালানীদাতা, যা এখন আর নয়। সে জায়গা পুরণে এখন চীন হাজির হয়ে গেছে। ভারতের মিডিয়া শিরোণাম এখন এই হারানোর ব্যাথা প্রকাশ করা শুরু করে দিয়েছে। ভারতের টাইমস অব ইন্ডিয়া শিরোনাম করে লিখেছিল, “চীন নেপালে তেল সরবরাহ পাঠানো শুরু করে দিয়েছে, ভারতের একচেটিয়া সরবরাহকারির ভুমিকা হারাল”।

নেপাল ভুখন্ড পুব-পশ্চিম দিক করে বিস্তৃত যার পুরা দক্ষিণ সীমান্ত জুড়ে আছে ভারত। আর ঠিক একইভাবে উত্তর সীমান্ত জুড়ে আছে চীন। নেপালের উত্তর দিক  দক্ষিণ দিকের চেয়ে আরও বেশি উচু পাহাড়ি, সমুদ্রের খবর দক্ষিণ দিকের চেয়ে উত্তর সীমান্ত দিকে আরও বেশি দূরে। এছাড়া ট্রাডিশনালি ভারতের সাথে ও দিক থেকে নেপালের বহিঃবাণিজ্যের আনা-নেওয়া চালু বেশি। এবারের ভারতের নেপাল অবরোধ বিপরীত ফল বয়ে আনতে শুরু করেছিল, ভারতের একচেটিয়ার অবসান ঘটাতে যাচ্ছে তা। নেপাল-চীনের সীমান্তে চলাচলের রাস্তা ও সড়ক কাস্টম দুয়ার চার স্থানে। এর মধ্যে সবচেয়ে চালু ও যোগাযোগ সুবিধাজনক “তাতোপানি” এবং “কেরুঙ” স্থল সীমান্ত। গত ভুমিকম্পে দুটা সীমান্তেই পাহাড়ের পাথর ধ্বস নেমে পুরা রাস্তা ব্লক হয়ে গিয়েছিল। জরুরি ভিত্তিতে তা পরিস্কার করে রাস্তা উন্মুক্ত করা হয়েছে এখন। জ্বালানী তেল সরবরাহের চুক্তি নিয়ে কথা চলছে, চুক্তি সম্পন্ন হয়েছে। দর আর বিস্তারিত বিষয় নিয়ে আলোচনা চলছে। এর আগে শুভেচ্ছা স্বরূপ অনুদান হিসাবে ১০০০ টন জ্বালানীর চালান আসা শুরু হয়ে গেছে গত ১ নভেম্বর থেকে। নেপালের মোট চাহিদার কমপক্ষে এক-তৃতীয়াংশ নেপাল চীন থেকে আমদানির স্থায়ী চুক্তি করতে চায়। এই অবস্থা দেখে ভারতের মিডিয়ার সুর নরম ও হতাশার। নেপালকে চাপ দিয়ে ধরার অস্ত্র ভোতা অকেজো হয়েছে দেখে এখন উলটা তা ভারতের উপর চাপ প্রয়োগ করতে শুরু করেছে বলে। ভারতের ভুল নেপাল নীতি এখন সকলের কাছে পরিস্কার হতে শুরু করেছে। ফলে নেপালকে চীনের দিকে নিজেরাই ঠেলে দিয়েছে বলে ভারতীয় মিডিয়ায় এখন আত্মসমালোচনা শুরু হয়ে গেছে। এই অবস্থায় প্রতিযোগিতা অনুভব করে, দোষ কিছু কাটাতে ভারত কিছু কিছু সীমান্ত অবরোধ শিথিল করে তেল ট্যাঙ্কার নেপাল প্রবেশ করতে দেয়া শুরু হয়েছে।
সার করে বললে, ভারতের চাপের কৌশল ভাঙতে, অকেজো করতে নেপাল সরকার সফল হয়েছে। স্বভাবতই এখন ক্রমশ তা বাকি পণ্যে অবরোধ দুর্বল হতে থাকবে।
এই প্রেক্ষিতে ভারতের নেপাল নীতিতে যে সুরে পরিচালিত এর প্রাপ্তি কী তা নিয়ে প্রশ্ন উঠতে শুরু করেছে । ফলাফল ও ভবিষ্যত নিয়েও মুল্যায়ন শুরু হয়েছে।

ভারতের দিক থেকে ভারত-নেপালের সম্পর্ককে শুরু থেকেই এপর্যন্ত কলোনি অধস্তন সম্পর্ক হিসাবে দেখা হয়েছিল। ভারত সেখানে দাতা বড় ভাই। শুরু থেকে মানে ১৯৫০ সালের ৩১ জুলাই মাসে স্বাক্ষরিত ভারত-নেপাল শান্তি ও বন্ধুত্ব চুক্তি স্বাক্ষরের সময় থেকে। ভারতের বিরুদ্ধে এমন এক অভিযোগ করে কথা শুরু করতে হল কারণ এই চুক্তি স্বাক্ষর হয়েছিল পুরানা আগের চুক্তির ধারাবাহিকতায়। আগের কলোনি মাস্টার বৃটিশ-ইন্ডিয়া ও নেপাল সরকারের মধ্যকার চুক্তির ধারাবাহিকতা রক্ষা করার প্রয়োজনে। কলোনী মাস্টারের সাথে নেপালের রাজার সর্বশেষ চুক্তিটা স্বাক্ষর হয়েছিল ১৯২৩ সালে, যেখানে ঐ চুক্তির কার্যকারিতা সমাপ্তির তারিখ উল্লেখ করা ছিল ৩১ জুলাই ১৯৫০। সেকারণেই স্বাধীন ভারতের নেহেরু ও নেপালের রানা রাজবংশে রাজার মধ্যে ঐ ৩১ জুলাই ১৯৫০ তারিখেই নতুন চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছিল। অনেকের মনে প্রশ্ন আসতে পারে ভারতের সাথে নেপালকে চুক্তি করতে হবেই কেন? বাধ্যবাধকতাটা কোথায়? আর এটা আসলে কীসের বা কী বিষয়ক চুক্তি? সংক্ষেপে এর জবাব হল, পুরান কাল থেকেই নেপাল এক ল্যান্ড-লক ভুখন্ড; অর্থাৎ এভুখন্ড সমুদ্র যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন, নেপালকে অন্য রাষ্ট্রের ভুমি মাড়িয়ে তবে সমুদ্রের নাগাল পেতে হয়। একমাত্র এভাবেই দুনিয়ার তৃতীয় যে কোন দেশের সাথে নেপালের বৈদেশিক বাণিজ্য বিনিময় সম্ভব হয়। ফলে বৃটিশ ইস্ট-ইন্ডিয়া কোম্পানীর আমল থেকেই ভারতের ভুমি ব্যবহার করে নেপালকে বৈদেশিক বাণিজ্য বিনিময় চালু রাখতে হয়েছে। আর তাই এই প্রয়োজনে সবসময়ই নেপালকে ভারতের সাথে ভুমি ব্যবহারের চুক্তির উপর নির্ভর করে, হাত জোর করে থাকতে হয়েছে। নির্ভর মানে আক্ষরিক অর্থেই বিষয়টা শুরু থেকেই সবসময় ভারতের ইচ্ছাধীন থেকেছে। প্রত্যেকবার চুক্তির ভারসাম্য ভারতের পক্ষে থেকেছে, এমন শর্ত লিখে চুক্তি করতে হয়েছে যেন নেপাল সমুদ্র বদরে প্রবেশ পেতে বিনিময়ে পুরা দেশ দাসখত হিসাবে লিখে দিয়েছে। বৃটিশ ইস্ট-ইন্ডিয়া কোম্পানীর আমলে প্রথম চুক্তি হয়েছিল ১৮১৬ সালে (Treaty of Sugauli 1816)। সে সময় এই চুক্তি করা হয়েছিল নেপালের এক তৃতীয়াংশ ভূমি বৃটিশ-ভারত কলোনী মাস্টারকে দিয়ে দেয়ার বিনিময়ে। বৃটিশ রাজ প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পরে সদয় সন্তুষ্ট হয়েই তুলনামূলক ছাড় দেয়া এক নতুন চুক্তি করেছিল ১৯২৩ সালে। সে চুক্তির পঞ্চম দফাতেও লেখা ছিল নেপাল সরকার অস্ত্র-শস্ত্রসহ সবকিছুই আমদানী করতে পারবে (“British Government is satisfied that the intentions of the Nepal Government are friendly”) যতক্ষণ বৃটিশ সরকার সন্দেহাতীতভাবে সন্তুষ্ট থাকবে। কিন্তু কী হলে বা বৃটিশ সরকার কীসে সন্তুষ্ট হবে এর কোন তালিকা বা তাল ঠিকানা দেয়া হয় নাই। অথবা সুনির্দিষ্ট করে কোন তালিকা করে কখনও বলা হয় নাই যে কী কী জিনিষ নেপাল আমদানী করতে পারবে। অর্থাৎ কিছুই স্পষ্ট করে উল্লেখ না করে পুরা ব্যাপারটা বৃটিশ সরকারের খেয়ালী ইচ্ছাধীন করে রাখা হয়েছিল।

কেন এরকম করে রাখা হয়েছিল, রাখতে পারে কী না – এমন প্রশ্ন করার সুযোগ ঐকালে ছিল না। অন্য রাষ্ট্রকে দখল করে কলোনি দাস বানিয়ে রাখা অন্যায় – এমন কোন আন্তর্জাতিক আইন বা কনভেনশন বলতে কোন কিছু ১৯৪৪-৪৫ সালে জাতিসংঘ গঠিত হবার আগে দুনিয়াতে ছিল না। ফলে বরং কলোনি দখলের পক্ষে এক ধরণের জোর-যার এর সাফাই এর ইঙ্গিত তখন কাজ করত। কিন্তু জাতিসংঘ গঠিত হয়েছিল আটলান্টা চার্টার চুক্তির উপর ভর করে। বৃটিশ প্রধানমন্ত্রী চার্চিল ও আমেরিকান প্রেসিডেন্ট রুজভেল্টের মধ্যে ১৯৪১ সালে ঐ চুক্তি স্বাক্ষর হয়েছিল। “দুনিয়ায়ে আর কলোনী শাসন চলবে না” – ঠিক এমন ভাষায় না লিখে তবে কলোনী শব্দটা এড়িয়ে আটলান্টা চুক্তির সার কথাটাই ছিল। লিখা হয়েছিল “প্রত্যেক জনগোষ্ঠী নিজের ইচ্ছাধীনের সরকার গঠন, কার অধীনে থাকবে তা নির্ধারণের সার্বভৌমত্ত্ব অধিকার থাকবে”– এই ভাষায়। অর্থাৎ যুদ্ধশেষে জাতিসংঘ গঠন হয়ে যাবার পরে যে কলোনি দখল ও শাসন বেআইনি ও নিন্দনীয় হয়ে যাবে সেটা বুঝা যাচ্ছিল। হয়েছিলও তাই।
কিন্তু তা সত্ত্বেও নেহেরুর ভারত ১৯৫০ সালে আগের কলোনী বৃটিশের অধীনস্ততা চুক্তিটাকেই রাস্তা দেখিয়ে দেয়া মডেল মনে করে, ধরে নিয়ে নেপাল-ভারতের মধ্যে নতুন আর এক দাসখত চুক্তি করেছিল।
দাসখত বলছি এজন্য যে ১৯২৩ সালের চুক্তিতে  তাল ঠিকানাহীন বৃটিশ সরকারের “সন্তুষ্টির” উপর দাড় করানো হয়েছিল। আর ১৯৫০ সালের চুক্তিতে দশ দফা শর্তের পঞ্চম দফায় সন্তুষ্টি কথাটা সরিয়ে আরও অস্পষ্ট করে বলা হয়েছে, কী শর্তে নেপাল অস্ত্র-শস্ত্র আনতে পারবে তার প্রক্রিয়া কী হবে তা চুক্তির বাইরে কেস টু কেস ভিত্তিতে পরবর্তিতে দু সরকার বসে ঠিক করবে। এছাড়া ষষ্ঠ দফায় নেপালে ভারতীয় ব্যবসায়ীদেরকে নেপালী নাগরিকের মতই সমান সুযোগ সুবিধা দেয়ার শর্ত আরোপ করা হয়। আর সপ্তম দফায় ভারতে নেপালীরা বসবাস, সম্পত্তির মালিক হওয়া, ব্যবসা করা, চলাচল ইত্যাদির সুবিধা পাবে বলে এর “রেসিপ্রোকাল” বা পালটা নেপালে ভারতীয়দেরও একই সুবিধা দেয়ার শর্ত রাখা হয়। েটা বলার অপেক্ষা রাখে না যে, সুবিধা দেয়া আর তা নিতে পারা বা কাজে লাগানোর মধ্যে বিরাট ফারাক আছে। মূলত নেপালের অর্থনীতির ক্ষমতা ও সাইজ ভারতের তুলনায় নস্যি বলে শেষের ষষ্ঠ ও সপ্তম দফার মাধ্যমে রেসিপ্রোকাল সুবিধার কথা বললেও এর সুবিধা নিবার যোগ্যতার দিক থেকে ভারতীয়রাই এগিয়ে থাকবে, ভারতের ব্যবসায়ীরাই তা নিবার যোগ্য হবে। নেপালীরা পারবে না। ফলে কার্যত এটা বিরাট অসাম্য।  ফলে এই ছলে কৌশলে চুক্তিটাকে ভারতের পক্ষে কান্নি মারা ভাবে হাজির করা হয়েছে। এই কারণে ১৯৫০ সালে স্বাধীন ভারতে নেহেরুর করা চুক্তিটাকেও নতুন ধরনের এক কলোনি চুক্তি বলা যায়।
নেপালের দিক থেকে আইডিয়াল চুক্তি হতে পারে, নেপালকে সবকিছুই বাধাহীন আমদানি করতে দিবার বিনিময়ে ভারত বিনিময়ে ঠিক কি চায়, কী শর্তপূরণে তা দিতে চায় এর মধ্যে কোন অস্পষ্টতা না রাখা, ভারতের খেয়ালের উপর ছেড়ে না দেওয়া, সন্তুষ্টি-জাতীয় আবছা নন-কমিটনেন্টের শব্দ এড়ানো সঠিক উপায় হতে পারে। এছাড়া ভারতের দেয়া বিনিময় শর্তের ইকোনমিক মূল্য কত তা যাচাই করা এবং শর্তের পক্ষে ভারতের ন্যায্যতা কী তা শুনতে চাইতে হবে। যেমন ভারতে ব্যবসা করার সুযোগ নেপালীদের দরকার নাই। নেপালের দরকার সমুদ্রে প্রবেশের অধিকার। অথচ এটাকে কি যুক্তি র‍্যাশনালিতে ষষ্ঠ ও সপ্তম দফা হাজির করা হয়েছে তা অস্পষ্ট।
ভারতের দিক থেকে বললে প্রথমত, বৃটিশ উপনিবেশিক বাস্তবতায় সেকালে নেপালের সঙ্গে চুক্তিতে কলোনী দাসখতের বিষয়াদি থাকবে হয়ত এটা স্বাভাবিক।  কিন্তু সে চুক্তি ভারতের সাথে সম্পন্ন হবার কালে তখন বাস্তবতা ভিন্ন। কলোনি শাসন ইতোমধ্যে প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে গিয়েছিল। ফলে ভারতের পুরান বৃটিশ চুক্তিটাকে অনুসরণ করার কোন কারণ নাই। এটা ভালোমানুষি প্রশ্ন নয়। রাষ্ট্রস্বার্থ ভালমানুষির কাজ বা বিষয় নয়। বিষয়টা হল, পুরাণ বৃটিশ-নেপাল চুক্তিটাকে অনুসরণ করা মানে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ভিতর দিয়ে দুনিয়াটা নতুন কী আকার নিল – এর সম্মক উপলব্দি করতে কোন বোধবুদ্ধি না থাকার প্রমাণ। দুনিয়ার এই পরিবর্তনের এর বৈশিষ্ঠসূচক দিক গুলো আঙ্গুলে গুণে নোট নিতে অক্ষমতার প্রমাণ রাখা। যেমন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সমাপ্তিতে দুনিয়াটা দেখতে কেমন হবে – ইমাজিন করে কল্পনায় একে দেখতে রুজভেল্ট চেয়েছিলেন যে, আগের কলোনি ধরণের দখল ও শাসনের কারণে বিশ্ববাণিজ্য বিনিময় খুবই সীমিত পর্যায়ে রয়ে গেলে। কলোনি সম্পর্কের উচ্ছেদ ঘটিয়ে রুজভেল্ট ব্যাপকতর বিশ্ববাণিজ্য বিনিময়, পণ্য ও পুঁজি চলাচলের এক নতুন দুনিয়া দেখতে চেয়েছিলেন। মূল এই বিষয়টা অর্থনের লক্ষ্য তিনি মেপে প্রতিটা পদক্ষেপ নিয়েছিলেন। তবে শুরুর ইমাজিনেশন সবসময় ও সবটা পরবর্তিতে বাস্তবে হাজির হয় না। কিন্তু কলোনি সম্পর্ক উচ্ছেদের বিষয়টার ক্ষেত্রে তা হয়েছিল। জাতিসংঘ প্রতিষ্ঠানও অনেক সীমাবদ্ধতা, অকেজো, ঠুঠো হয়ে থাকা, কান্নি মেরে থাকা সত্ত্বেও অনেক আন্তর্জাতিক আইন, কনভেনশন, নর্মস হাজির করতে পেরেছে। শুধু তাই না ল্যান্ড লকড রাষ্ট্রগুলোর তৃতীয় রাষ্ট্র মাড়িয়ে সমুদ্রে প্রবেশ বিষয়টাকে কতগুলো বিশেষ আগাম শর্তে রাষ্ট্রগুলোর অধিকার হিসাবে আন্তর্জাতিক কনভেনশন ডেকে স্বীকৃতি দিবার পক্ষে এখন কাজ চলছে। ইতোমধ্যে জাতিসংঘের সদস্য এমন ৩১টা ল্যান্ড-লকড রাষ্ট্র এই উদ্দেশ্যে জাতিসংঘের আঙ্কটার্ডের অধীনে সমবেত হয়েছে। ল্যান্ড-লকড রাষ্ট্রগুলোর স্বার্থ রক্ষার্থে তাদেরকে যেন পড়শী রাষ্ট্রের কলোনি-খায়েশের খোরাক না হতে হয় এর জন্য আইন কনভেনশন আনা – এটার এর মূল উদ্দেশ্য। এসব থেকে রাষ্ট্র বা রাষ্ট্রস্বার্থ বিষয়ক আন্তর্জাতিক চিন্তা প্রকৃতির সাধারণ অভিমুখকে চিনিয়ে নেয়া সম্ভব। এবং বলা যায়, দুনিয়া অন্তত আর কলোনি দখল ও শাসনকে আইনি ন্যায্যতা দিবে না। এমনকি ল্যান্ড-লকড বলে পড়শীর কলোনি-খায়েশের শিকার না হতে হয়, সমুদ্র পর্যন্ত প্রবেশ যেন তারও অধিকার হিসাবে দেখা হয় সে চেষ্টা এখন চলছে।
কাজেই নেহেরু পুরান কলোনিচুক্তি সুত্রে নেপালের উপর আবার কলোনি চুক্তি চাপিয়ে দিবার সুযোগ পাওয়া গেছিল বলেই তা নিতে হবে, নিয়েছেন সেটা কোন দুরদৃষ্টিসম্পন্ন কাজের কথা নয়। এছাড়া, কলোনি সম্পর্কের বিরোধীতা প্রত্যেক জনগোষ্ঠির কাছে একটা নীতিগত ইস্যু। নিশ্চয় ভারতের বেলায় বৃটিশদের কলোনি খায়েশ খারাপ আর নেপালের বেলায় ভারতের কলোনি খায়েশ ভাল – এটা কোন নীতিগত অবস্থান হতে পারে না। তবে আবার একথাও ঠিক যে কোন রাষ্ট্রেরই পড়শী রাষ্ট্রের ভিতর নিজের স্বার্থ দেখতে পাওয়া দোষের নয়। কিন্তু তা পাবার চেষ্টা করতে হবে আন্তর্জাতিক আইন কনভেনশন এসবের সীমা বজায় রেখে। আর সবচেয়ে ভাল হবে কাউন্টার ইন্টেলিজেন্সের ততপরতায় বল প্রয়োগে পাবার পথে না হেঁটে এর বিপরীতে সদিচ্ছায় পড়শি নাগরিকের মন জয় ক্তে হবে দেয়া-নেয়ার বিনিময় ও বাণিজ্যের মাধ্যমে।

বিগত ষাট বছরে ভারতের কূটনীতি চেয়েছে পরিচালিত হয়েছে নেপালে একটা বশংবদ দল ও নেতা তৈরি করে পুরান বৃটিশ কলোনি পথে নেপালকে নিজের অধীনে রেখে নিজের স্বার্থ আদায় করা। আজ নেপালে দেখা যাচ্ছে রাজনৈতিক দল্গুলো ভারতের হাত থেকে এক এক করে সবাই হাতছুটে চলে গেছে। সব হারিয়ে নেপালের একমাত্র মাধোশি-তরাই জনগোষ্ঠিই ভারতের ভরসা। ভারতের নীতির ভুলে অবস্থা এমন যায়গায় পৌচেছে যে নেপালী কংগ্রেসের পক্ষেও আজ নেপালে বসে ভারতের পক্ষে থাকা কথা বলার সুযোগ ভারতই রাখেনি। কারণ পুরা নেপাল আজ ভারত-বিরোধী হয়ে গেছে। অথচ বিগত ষাট বছরে রাজা ও নেপালী কংগ্রেসের কাছ থেকে সবচেয়ে বেশি সময় ধরে ভারত খেদমত পেয়েছে। রাজনীতি ও রাষ্ট্রস্বার্থ বিষয়ে আইন কনভেনশনের রাজনীতি ও অর্থনীতি বিষয়ক গ্লোবাল ট্রেন্ড বুঝবার ক্ষেত্রে ভারতের আমলা-গোয়েন্দারা যে নাদানিতে আছে এব্যাপারে নেপাল একটা ভাল উদাহরণ। রাষ্ট্র হিসাবে এদের কাছে এমন মডেল হল বৃটিশ কলোনি এমপায়ার। অথচ একালটা  আর এমপায়ার হওয়ার না। না হয়েও বহু কিছু ভোগ অর্জন করা সম্ভব। বল থাকলেই বড়ভাই সেজে, ক্ষমতা দেখিয়ে তা ব্যবহার করতে হবে এই পথে সব কিছু আদায় করতে হবে – এটা খুবই আনকুথ একটা কাজ। এভাবেই আদায় করতে হবে এটা খুব কাজের কথা নয়।
ইতিহাস স্বাক্ষী নেপালের বিরাট তাতপর্যপুর্ণ রাজনৈতিক পরিবর্তনে রাজতন্ত্র উচ্ছেদ ও একটা রিপাবলিক রাষ্ট্রের পক্ষে নেপালের রাজনৈতিক শক্তিগুলোকে সমবেত করে দেবার ক্ষেত্রে ভারতের ইতিবাচক ভুমিকা নির্ধারক ও অনুঘটকের এবং এক ইন্টারলকেটর হোস্ট এর। এমনকি আমেরিকার পক্ষেও ইতিবাচক ভুমিকা রাখা সম্ভব ও সহজ হত না ভারতের এমন ভুমিকা না নিলে। তাহলে এটা আজ জ্বলজ্বল করা প্রশ্ন সেই ভারতকে আজ নেপালের মূলধারার তিনসহ সব রাজনৈতিক দল বাদ একমাত্র ভরসা নাম ও যোগ্যতাহীন মাধোসী কেন? মাধোসি যারা নিজেদেরই এখনও কোন পরিপক্ক রাজনৈতিক শক্তি নয়, নেপালের রাজনৈতিক ক্ষমতা গঠনে গোনায় ধরে এমন স্টেকহোল্ডার মাধোসিরা কেউ নয়, হয়ে উঠতে পারে নাই। তাহলে কী বুঝে ২০০৫ সালে ভারত নিজের কোন স্বার্থের কথা ভেবে নেপালের রাজনীতিতে ভুমিকা রাখতে গিয়েছিল? অথচ প্রধান তিন রাজনৈতিক দলের ভারতের বড় প্রভাব রাখার সুযোগ কী সে সময়টাতেই ছিল না! নেপালে ভারতের যা জেনুইন স্বার্থ তা খোলাখুলি সৎ ভাবে এই দলগুলোর সাথে আলাপ করতে পারত। না কোন চুক্তির পুর্বশর্ত হাজির করার জন্য নয়। সে হিসাবে না। উদ্দেশ্য হত ভারতের জেনুইন স্বার্থ প্রসঙ্গে নেপালি রাজনীতিবিদদেরকে স্পষ্ট ধারণা দিয়ে রাখা। আগানোর এপ্রোচের ধরণ দেখে মনে হয় না ভারত এমনভাবে ভেবেছে। বরং আমরা দেখি ভারত সব সময় বশংবদ নেপালি রাজনৈতিক দল পালা-পুষে আগানোর পথে হেটেছে। চিন্তার এই ধারাটাই উপনিবেশিক ও পশ্চাতপদ। ফলে অযোগ্যতা। এই প্রশ্ন উঠছে তাহলে ভারত নেপালি কংগ্রেস আর দুই কমিউনিষ্ট পার্টিকে – প্রধান এই তিন দলকে কেন সাহায্য করেছিল, কী বুঝে করেছিল?
এটাই কী ভারতের রাজনীতিক, আমলা-গোয়েন্দাদের যোগ্যতার সঙ্কটের ইঙ্গিত নয়! এটা অবিশ্বাস্য যে ভারত ২০০৫ সালে নেপালকে আজকের নেপাল হতে নির্ধারক ভুমিকা রেখেছিল সেই তারা আজ নেপালের ধুলায় গড়াগড়ি যাওয়া ভিলেন কেন হবে? চিন্তার অযোগ্যতার পরিণতি এমন করুণই হয়!

[লেখাটা প্রথম ছাপা হয়েছিল দৈনিক নয়া দিগন্ত ০৮ নভেম্বর ২০১৫ সংখ্যায়। এখানে তা আবার আরও সংযোজন ও সম্পাদনার পর ফাইনাল ভার্সান হিসাবে ছাপা হল।]

Leave a Reply

Fill in your details below or click an icon to log in:

WordPress.com Logo

You are commenting using your WordPress.com account. Log Out /  Change )

Facebook photo

You are commenting using your Facebook account. Log Out /  Change )

Connecting to %s