দেউলিয়া ব্যবসায়ীকে প্রেসিডেন্ট বানাতে হয় না
গৌতম দাস
১১ জানুয়ারি ২০২১, ০০:০৬, সোমবার

আপনি যখন অন্যকে শারীরিকভাবে কষ্ট দিয়ে সুখ অনুভব করবেন তখন বুঝতে হবে আপনি মানসিক অসুস্থতার পর্যায়ে প্রবেশ করে ফেলেছেন। উপরের চারটা ছবির মধ্যে কম-বেশি সেসবের ছাপ খুঁজে পাওয়া যাবে। বিশেষ করে প্রথমটায়। কারণ এই অসুস্থতার সাথে মুখভঙ্গি বদলের সম্পর্ক আছে। ট্রাম্পের মানসিক অসুস্থতা নিয়ে আমেরিকায় বিশেষত সাইকিয়াট্রিস্ট মহলে ট্রাম্প প্রেসিডেন্ট হবার পর থেকেই বিস্তর আলোচনা হয়ে এসেছে। এমন সাইক্যাট্রিক রিপোর্ট ও এমন আলোচনার অজস্র রিপোর্ট ওয়েব সাইট পাওয়া যাবে।
এদিকে আমেরিকার অর্থনৈতিক অবস্থা প্রবলভাবে ঢলে পড়ছে, প্রভাব হারাচ্ছে আর তা নিয়ে অজস্র রিপোর্ট প্রকাশিত হচ্ছে। বিশেষ করে ট্রাম্পের আমলে সাথে চলতি করোনাকালে এই ভাইরাসের প্রভাব প্রতিক্রিয়া ম্যানেজমেন্ট ও মোকারিলা প্রশ্নে ট্রাম্পের আমেরিকা পরাজিত হয়েছে বলা যায়। জনসংখ্যার ৬.৬% আক্রান্ত হয়েছে যা হয়ত তুলনায় খুব বেশি নয় কিন্তু মৃত্যুর সংখ্যা প্রায় চার লাখ (৩.৭২ লাখ) ছুঁয়ে ফেলার দিকে যেটা ট্রাম্পের পারফরমেন্সের দশা মাপার ক্ষেত্রে এক বড় ইন্ডিকেটর। আর ঠিক এক দিকটাকে স্টাডির মধ্যে নিয়ে একটা স্টাডি রিপোর্ট বলছে অর্থনীতিতে আমেরিকাকে ছাড়িয়ে চীনের এক নম্বরে যাওয়ার কথা যেটা আগে বলা হয়েছিল যে এটা ২০৩৫ সালের দিকে ঘটবে সেটা এখন বলা হচ্ছে কোভিড মোকাবিলায় লড়াইয়ে ট্রাম্প আমেরিকাকে হারিয়ে পিছনে ফেলে দিবার কারণে সেটা এখন ২০২৮ সালের মধ্যে ঘটে যাবে।
এসবেরই প্রভাবে এখন ১২.৮ মিলিয়ন (১.২৮ কোটি) বেকারের ট্রাম্পের আমেরিকায় অর্থনৈতিক সংকটের সাথে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে সাদা শ্রেষ্ঠত্ববাদী বা হোয়াইট সুপ্রিমিস্ট্রদের প্রভাব। অর্থাৎ সাদা মানুষেরাই শ্রেষ্ট, আমেরিকা হল মূলত সাদাদের, এখানে অন্যান্য কালারের মানুষেরা এসে সাদা মানুষদের দুঃখ দুর্দশা সংকট বাড়িয়ে দিয়েছে। তাই সাদাদের শ্রেষ্ঠত্ব ‘রি-ক্লেম’ করে ফেরত নিতে হবে। যার আসল মানে হল সাদা সুপ্রিমিস্টদের চরম উগ্র বর্ণবাদী হতে হবে। চারবছর আগে প্রেসিডেন্ট প্রার্থী ডোনাল্ড ট্রাম্পের উত্থান আসলে ছিল এই সাদাবাদীদেরই রাজনৈতিক উত্থানের প্রথম বড় প্রকাশ। আর এই সাদা রাজনীতির পাবলিক ফিগার স্টিভ ব্যানন (Stephen K. Bannon), তাঁকে ট্রাম্পের ‘হোয়াইট হাউজের চীফ স্ট্রাটেজিস্ট’ হিসাবে নিয়োগ দেয়া ছিল ট্রাম্পের সাদা শ্রেষ্ঠত্ববাদী রাজনীতির সবচেয়ে স্পষ্ট প্রকাশ। কিন্তু এই রাজনীতির একটা লিগাল সমস্যা আছে। আমেরিকার কোন সিটিং প্রেসিডেন্ট সাদা শ্রেষ্ঠত্ববাদের পক্ষে প্রচারক [preach] হলে তাঁর এর বিরুদ্ধে মামলা খাবার বা ইমপিচ হবার সম্ভাবনা আছে। তাই ট্রাম্প একটা দুরত্ব রেখে এদের সমর্থন করে থাকে। ব্যাননকেও এক পর্যায়ে উপদেষ্টা পদ থেকে খারিজ করে দেন তিনি। কিন্তু এবার ০৬ জানুয়ারি ২০২১-তে?
এদিকে অবশেষে জানা গেল প্রেসিডেন্ট-ইলেক্ট বাইডেন ও তার ক্যাম্পের সমর্থকেরা আমাদের জানাচ্ছেন, আমেরিকায় টেরোরিস্ট কারা! কথিত ট্রাম্প সমর্থক যারা ক্যাপিটোল হিলের আমেরিকান কংগ্রেসের ভিতরে প্রবেশ করে ৬ জানুয়ারি তান্ডব ভাঙচুর চালাতে ঢুকেছিল বাইডেন নিজমুখে বলছেন, তারা ‘টেরোরিস্ট’। কিন্তু এতেও পরিস্কার হয়নাই বা লুকিয়ে ফেলা হয়েছে এঁদের সাদা শ্রেষ্ঠত্ববাদী পরিচয়ের দিক। তবে আটই জানুয়ারির পর থেকে মিডিয়ায় প্রকাশিত হওয়া শুরু হয়ে গেছে এদের সাদা শ্রেষ্ঠত্ববাদী পরিচয়। অর্থাৎ বাইডেনের বা অনেক আমেরিকান “বাংলাদেশ এক্সপার্ট” যারা সংসদে হামলাকারিদেরকে “টেররিস্ট” বলে নামকরণ করছেন এরা আসলে হামলাকারিদের সাদা শ্রেষ্ঠত্ববাদ এই মূল পরিচয়, এই মারাত্মক রেসিজম ও ইসলামবিদ্বেষী পরিচয় – এসবই আড়াল করে রেখেছিলেন, গুরুত্ব দেন নাই। সেসবগুলো এখন প্রকাশ্যে সামনে এসে গেছে। এদিকে ফেসবুক ও টুইটার কর্তৃপক্ষ এখন প্রকাশ্যে বিবৃতি দিয়ে এদের সচিত্র ততপরতা, কী কী গ্রুপের সদস্য হয়ে তারা ঐদিন দলবদ্ধ হয়ে ততপর ছিল এর বিবরণ দিয়েছে। আর সেই সাথে ওসব সোশাল মিডিয়া বলছে তারা ট্রাম্পের একাউন্ট চিরদিনের মত মুছে দিয়েছে। যেখানে মূল অভিযোগ তারা জানিয়েছে ট্রাম্প ও তার এই সাদা শ্রেষ্ঠত্ববাদী সমর্থকেরা ফেসবুক ও টুইটার প্লাটফর্ম ব্যবহার করে দাঙ্গা-হাঙ্গামা করে মানুষ হত্যা ও ঘৃণা-হিংসা ছড়ানোর কাজে নেমে গেছিল।
সবশেষে পরিস্থিতি এখন পুরাটাই বাইডেনের পক্ষে, রাজনৈতিক নিয়ন্ত্রণ পুরাটাই আমেরিকার সংসদের (কংগ্রেসের উভয়কক্ষের) হাতে চলে গিয়েছে। এটা ট্রাম্পের জন্য আরও বিপদজনক হয়ে উঠেছে কারণ ট্রাম্পের নিজের দল রিপাবলিকানদের বড় অংশটাই এখন কোন্টাকির সিনেটর ম্যাক-কনেলের [Mitchell McConnell ] নেতৃত্বে ট্রাম্পের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছে। এবং তিনি তার গ্রুপ নিয়ে সম্ভবত আগামি সোমবারে ডেমোক্রাটদের আনা ট্রাম্পকে ইমপিচমেন্টের (অনাস্থা ও অযোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন তোলা) প্রস্তাব যেটা তুলতে যাচ্ছে তা সমর্থন করে বসতে পারেন।
বিপদজনক দেউলিয়া ব্যবসায়ী ডোনাল্ড ট্রাম্পঃ
যেকোনো ব্যবসামাত্রই তাতে উত্থান-পতন আছে, থাকবে। এটা তেমন অস্বাভাবিক কিছু নয়। এমনকি এই সূত্রে কারও ব্যবসা ফেল করাতে দেউলিয়া হয়ে যাওয়া কোন অস্বাভাবিক ব্যাপার নয়। কিন্তু তাই বলে দেউলিয়া হলেই ঐ ব্যবসায়ীর মানসিক রোগ বা অস্থিরতাও দেখা দিবেই তা কিন্তু নয় যদিও কারো বেলায় এটা হতেও পারে। আবার তেমন কিছু নাও হতে পারে। কিন্তু ব্যাপারটা কিছু হয়েছে কিনা চেক করার দরকার আছে। দেউলিয়া [Bankrupt] হলে ঐ ব্যবসায়ী সাথে আবার কোন মানসিক রোগগ্রস্ত হয়েছেন কি না তা নিশ্চিত হওয়া দরকার। নইলে কোন সিটিং প্রেসিডেন্ট নিজেই সংসদে হামলার জন্য দাঙ্গাবাজ রেসিস্টদের এনে উক্সানি দিতে পারে? আমেরিকান কংগ্রেসে তা হামলাভাঙচুর পর্যন্ত ঘটাতে পারে, কিছু লোক বেঘোরে মারা পড়তে পারে! তাই আমেরিকার প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের মানসিক স্বাস্থ্য চেক করার সময় বয়ে যাচ্ছে, যদিও এই আওয়াজ আগেও উঠেছিল।
সেই ২০১৬ সালে প্রার্থী হওয়ার আগেই, ট্রাম্পের মানসিক স্থিতি চেক করে নেয়া দরকার ছিল, সেটা আজ স্পিকারসহ আমেরিকা রাষ্ট্রের নির্বাচিত প্রতিনিধিরা হাড়ে হাড়ে বুঝছেন। ট্রাম্পের ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান নিয়ে কোন কোন অনুসন্ধানী ফ্যাক্টচেক রিপোর্ট মতে, ওয়াশিংটন পোস্ট জানাচ্ছে, ট্রাম্প ১১ বার নিজেকে দেউলিয়া ব্যবসা কোম্পানি হিসেবে রেজিস্টার্ড হয়েছিলেন।
কোনো প্রতিষ্ঠানের ‘দেউলিয়া’ হওয়া মানে কীঃ
কোনো প্রতিষ্ঠানের নিজেকে ‘দেউলিয়া’ ঘোষণা করিয়ে নেয়া মানে কী? আমেরিকান বিজনেস ল’ অনুসারে কোম্পানির মালিকেরা নিজেরাই নিজ কোম্পানিকে দেউলিয়া ঘোষণা করাতে পারেন, তবে আদালতের মাধ্যমে। সাধারণত এটা কোম্পানি মালিক ও ম্যানেজমেন্টের ঘোষিত সিদ্ধান্ত হিসেবে ঘটে থাকে। অনেকের মনে হতে পারে, মালিক নিজেই কেন ঘোষণা করবেন, নিজেকে কি কেউ পাগল বলেন বা বলবেন?
হ্যাঁ বলবেন, ও বলে থাকতে পারেন। কারণ, নিজ কোম্পানিকে দেউলিয়া ঘোষণা করিয়ে নেয়ার জন্য আদালতে ঐ কোম্পানিকেই আবেদন করতে হয় আর তাতে আদালতের অনুমোদন পেতে হয়। কিন্তু কখন ও কেন? যখন সাধারণত দেখা যায় কোনো কোম্পানির আয় ও অর্জিত সম্পদের মোট মূল্যের চেয়ে ওই কোম্পানিকেই পরিশোধ করতে হবে, সম্ভাব্য এমন দায়-দেনার পরিমাণ ছাড়িয়ে অনেক বেশি হয়ে গেছে।
কিন্তু এমন পরিস্থিতি কেন হয় বা হতে পারে? সাধারণত দেখা যায় কোম্পানিটা ধরা যাক সেটা ওষুধের মত পণ্য উৎপাদনকারী এবং বাজারে খুবই সুনাম-ওয়ালা কোম্পানি। কিন্তু ওর যেকোন একটা পপুলার ওষুধ-পণ্যের গুণে ত্রুটি ধরা পড়েছে যা উৎপাদনকালীন বা মুল ফর্মুলাতেই মারাত্মক ত্রুটিজনিত এক ভুল। আর তাতে হয়ত ঐ ওষুধ ব্যবহার করে কয়েক লাখ লোক অসুস্থ হয়ে পড়েছে বা অঙ্গ হারিয়েছে অথবা এদের মধ্যে প্রায় শ’খানেক লোক মারাও গেছেন। এমন হলে ভুক্তভোগীরা আদালতে মামলা করা শুরু করেছে হয়ত। হয়ত দু-একটা মামলার অবস্থা থেকে বোঝাও যাচ্ছে, এসব মামলায় কোম্পানির বিরুদ্ধে আদালতে শাস্তির রায় হয়েই যাবে আর শাস্তির পরিমাণও অনেক বড়, হয়ত মাথাপিছু কয়েক কোটি টাকার উপরে দিতে হবে একেকজন ভুক্তভোগীকে।
এই পরিস্থিতিতে তখন ঐ কোম্পানি নিজ ক্ষতি ও দায় কমাতে বা বেঁচে যেতে আদালতে নিজ উদ্যোগেই আবেদন করে যে, তার কোম্পানিকে দেউলিয়া ঘোষণা করে দেয়া হোক। কারণ ক্ষতিগ্রস্ত সব ভুক্তভোগীর সম্ভাব্য ক্ষতিপূরণ দিতে গেলে এর দায় কোম্পানি অ্যাসেট বা মোট সম্পদের চেয়ে বেশি। এখন এতে আদালত ঠিক কী করবেন? আদালত এই আবেদনে সন্তুষ্টি থাকলে এবার আদালত কোনো এসেট নির্ণয় ও মূল্যায়ন কোম্পানিকে ঐ ওষুধ কোম্পানির খরচে নিয়োগ দিয়ে ঐ দাবির যথার্থতা যাচাই করবেন। যদি ওই নির্ণয় কোম্পানির রিপোর্টও মালিকদের আবেদনের সাথে মিলে যায় তখন সাধারণত আদালত রায় দেন যে, পণ্য প্রস্তুতকারী কোম্পানির যতটুকু সম্পদ বর্তমানে আছে সেই অনুপাতে ক্ষতিগ্রস্তদের ক্ষতিপূরণের অর্থ কম করে দিয়ে যেন সব দায় মিটিয়ে দেইয়া হয়। অর্থাৎ ক্ষতিপূরণ দানের ব্যাপারটা অসীম না থাকতে দিয়ে সম্পদ যা আছে সে অনুসারি সীমিত বা আনুপাতিক করে দেয়া হয় এতে। এরপর আদালত ঐ ক্ষতিপূরণ ভাগ করে দেয়া সাপেক্ষে ঐ ওষুধ কোম্পানিকে দেউলিয়া ও দায় পরিশোধের পরে বিলুপ্ত ঘোষণা করে দিতে পারে। তাই সারকথায় কোন কোম্পানি তার বিভিন্ন ধরনের পাওনাদারদের দাবি যদি মেটাতে ব্যর্থ হয়, সম্পদের চেয়ে দায়ের পরিমাণ যদি বেশি হয় তাহলে সে নিজেকে আদালতের কাছে দেউলিয়া প্রমাণ করিয়ে আদালতের মুখ দিয়ে নিজেকে দেউলিয়া ঘোষণা করিয়ে নেয়, যাতে পাওনাদার থেকে বেঁচে যাওয়া যায়।
ডোনাল্ড ট্রাম্প মূলত হাউজিং ডেভেলপমেন্টের ব্যবসায়ী। ওয়াশিংটন পোস্ট পত্রিকায় ২০১৬ সালের এক ফ্যাক্টচেক রিপোর্ট বলছে, তিনি কমপক্ষে ১১ বার এমন দেউলিয়া ঘোষণা করিয়েছেন নিজেকে।
এটা বলার অপেক্ষা রাখে না, কোনো কোম্পানির মূল মালিকের বহু স্বপ্নের বাস্তবতা হয়ে থাকে তাঁর নিজের ঐ কোম্পানি। ফলে কোম্পানিকে বাজারে দেউলিয়া হয়ে যেতে দেখলে সেটা কারো কারো বেলায় এক মানসিক আঘাত হয়ে হাজির হতেও পারে। একারণে দেখা যায়, মালিক আর নুন্যতম স্বাভাবিক মানুষ নাই, মানসিক বিকারগ্রস্থ ব্যক্তি হয়ে গেছেন। এতে হয়ত দেখা যায় সামাজিক সাধারণ মূল্যবোধ দ্বারা, ভালো-মন্দ, ন্যায়-অন্যায় বা সামাজিক দায়বোধ বা জবাবদিহিতা ইতাদির প্রতি আর তাঁর কোন অনুভূতিই কাজ করে না। আসলে সম্ভাব্য এমনই মানসিক অসুস্থতায় পৌঁছেছেন ট্রাম্প। এদের মনোবিকার হয় এমন যে এখন তো তার কোম্পানিটাই আর নাই। কাজেই তিনি আর এখন সমাজের মুল্যবোধ মেনে কী করবেন? ফলে সবকিছুই মিথ্যা এমন হতাশা ও নৈরাশ্যের জগতে চলে যান তিনি। এর ফলে ঐ অবস্থায় নিজেকে সুস্থভাবে পরিচালিত করার মত অবস্থায় ঐ মালিক আর থাকেন না। এই অস্বাভাবিকতা যেকোনো মাত্রার মানসিক স্থিতিশীলতা, অস্থিরতা হয়ে হাজির হতে পারে।
এখন এমন অবস্থায় আরও বাড়তি দিকটা হল, মানসিক-অসুস্থ মানুষ নিজের সমাজ, পরিবারে থাকলে সেটা এক জিনিস; কিন্তু যদি রাষ্ট্রীয়-সরকারি পদ, তিনি প্রধান নির্বাহী, প্রেসিডেন্ট হয়ে বসেন? সেটা অবশ্যই মারাত্মক। কারণ সেটা তো সারা দেশের মানুষের প্রতিদিনের স্বার্থের ব্যাপার। তাই নির্বাহী পদে নমিনেশন পেপার পেশ করার আগেই শর্ত হিসেবে তার মানসিক স্থিরতা (মেডিক্যাল স্টান্ডার্ড মতে) পরীক্ষা করে নেয়ার ব্যবস্থা রাখা যেতে পারে। কারণ একটি রাষ্ট্রের প্রশাসন পরিচালনা মানে, সম্ভবত শত কোটি নাগরিক ভাগ্য নিয়ে যাকে সিদ্ধান্ত নিতে হয়। একজন দেউলিয়া ব্যবসায়ীর মানসিক অস্থিরতার রিস্ক ঐ দেশের জনগণ নিতে পারে না।
ঠিক এই অবস্থাটা আজ আমেরিকান পাবলিক অনুধাবন করছে বিদায়ী প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পকে নিয়ে। কিন্তু ঠিক কী হয়েছিল গত ৬ জানুয়ারি?

কী ছিল গত ৬ জানুয়ারি?
আমেরিকার কনস্টিটিউশনের বহু কিছু দু’রকম মানে হয়ে যেতে পারে এমন বাক্য যতটা সম্ভব এড়িয়ে গিয়ে রচনা করার উপর জোর দিয়ে রচিত হয়েছে। যেমন নির্বাচন কবে হবে, সেটাও বলা থাকে ওমুক বছরের ওমুক মাসের প্রথম মঙ্গলবারে – এভাবে। অর্থাৎ সব কিছুই আগাম ও ফিক্সড। রাষ্ট্রের কোন নির্বাহির বিবেচনা মতে নির্বাচনের দিন ঠিক করার সুযোগ রাখাই হয় নাই। সবার বিবেচনাবোধ এক বা সমান হয়না; মানুষে মানুষের মধ্যে এনিয়ে ফারাক হতে পারে; তাই কথা এমনভাবে লেখা হয়েছে যাতে তা হওয়ার সুযোগই রাখা হয়নি। এভাবেই গত বছর নভেম্বরের প্রথম সপ্তাহে ৩ নভেম্বর আমেরিকায় প্রেসিডেন্ট নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছিল। এতে আবার নির্বাচনের পরে কত দিনের মধ্যে রাজ্যগুলোর ফলাফল তারা কে কোথায় পৌঁছে দেবেন তাও বলে রাখা আছে। এই পদ্ধতিতে এবং আনুষ্ঠনিকতার দিক থেকে এক গুরুত্বের দিন হল ৬ জানুয়ারি। কারণ, ঐদিন আমেরিকার দ্বিকক্ষবিশিষ্ট কংগ্রেস বা সংসদের উভয়কক্ষ এক যৌথ অধিবেশনে মিলিত হবে। আমেরিকায় আমাদের সংসদের মত আছে ‘প্রতিনিধি পরিষদ’ বা হাউজ অব রিপ্রেজেন্টেটিভ এবং আরেক দ্বিতীয় কক্ষ আছে ‘সিনেট’। ঐদিন এরা উভয়েই ওয়াশিংটন ডিসির ক্যাপিটল হিল জেলায় অবস্থিত প্রতিনিধি পরিষদের নির্ধারিত হলঘরে একসাথে অধিবেশনে বসবেন। আর ঐ যৌথ সভায় সভাপতিত্ব করবেন রাষ্ট্রের ভাইস প্রেসিডেন্ট। তার পাশে বসবেন হাউজ স্পিকার। এই হিসাব মতে, ট্রাম্পের ভাইস প্রেসিডেন্ট মাইক পেন্স ৬ জানুয়ারি সভাপতির আসন নিয়েছিলেন। আর সাথে পাশে বসেছিলেন পরপর চারবারের ও এবারেরও স্পিকার (ডেমোক্র্যাট) ন্যান্সি পেলোসি [Nancy Pelosi ]।
ওদিকে নির্বাচনের ফলাফল কিভাবে চূড়ান্ত হবে কে করবেন, আর তাতে বিতর্ক বা আপত্তি থাকলে তা কী করে নিষ্পত্তি হবে এরও সবই আগাম বলে দেয়া আছে। প্রত্যেক রাজ্যে নির্বাচন কমিশনের কাজ ও পরিচালনা সেখানেই শেষ করা হয়। কারণ কোনো কেন্দ্রীয় নির্বাচন কমিশন বা অফিস আমেরিকায় রাখা হয়নি। তাই ৫০ রাজ্যের আমেরিকার প্রত্যেক রাজ্যে একজন সেক্রেটারি থাকেন যিনি ঐ স্টেটের (সরকারের নয়) ‘সেক্রেটারি অব স্টেট’; আর যার প্রধান কাজ হল তিনি প্রধান নির্বাচন অফিশিয়াল এবং এটা নির্বাচিত একটা পদ; তিনিই ভোটের ফলাফল চূড়ান্ত করেন, কারও আপত্তি থাকলে তাও নিষ্পত্তি করেন। আপত্তিকারী এতে সন্তুষ্ট না হলে তিনি স্থানীয় জেলা জজ থেকে শুরু করে ফেডারেল সুপ্রিম কোর্ট পর্যন্ত যেতে পারেন। আর এরপরে সেই চুড়ান্ত ফলাফল তিনি ঐ যৌথ অধিবেশন কক্ষের সভাপতির (রাষ্ট্রের ভাইস প্রেসিডেন্ট) অফিসে পৌছানোর ব্যবস্থা করেন।
ট্রাম্প নভেম্বরের নির্বাচনের আগে থেকে ‘বড় পাগলামোতেই’ আছেন। একজন প্রেসিডেন্টের জন্য এটা কোন ভাল পরিচায়ক নয় অবশ্যই। তিনি নির্বাচনের ফলাফল নিজের বিপক্ষে হলে মেনে নেবেন না, ক্ষমতা হস্তান্তর করবেন না, ইত্যাদি নানাকথা আউড়ে চলেছিলেন নির্বাচনের কয়েক মাস আগে থেকেই। এদিকে বাস্তবে ৩ নভেম্বরের দু’দিন পর থেকেই পরিষ্কার হতে থাকে নির্বাচনে ট্রাম্প হেরে যাচ্ছেন। আর ততই ট্রাম্পের পালটা পরিকল্পনার কথাগুলো কানাঘুষা প্রচার হতে থাকে। সবখানেই ট্রাম্প বা তার পক্ষের এজেন্টদের কমন অভিযোগ ছিল – তাঁকে হারিয়ে দেয়া হয়েছে, কারচুপি হয়েছে। এরই একপর্যায়ে দেখা যায় এসব ফলাফল বিতর্কগুলো সাথে কোন প্রমাণ না দিয়েই তাঁরা কেবল অভিযোগ মাত্র করে গিয়েছেন। তাই সে মামলাগুলো জেলা জজের আদালতেই শেষ হয়ে যায়, মামলা ডিসমিস। ফলে প্রমাণ অভাবে কোন অভিযোগ কখনোই কোন জেলা জজের আদালতে উপরে যেতে পারেনি। কারণ সবখানেই ট্রাম্পের অভিযোগ ছিল – তাকে হারিয়ে দেয়া হয়েছে, কারচুপি হয়েছে। অথচ মূলকথা, সব আদালতেই যা হাজির ছিল না তা হল, সাথে পেশ করা তথ্য প্রমাণ। অন্তত মামলা শুরু করার মত কিছু ন্যূনতম প্রমাণও ছিল না। ফলে প্রায় সব আদালতই ন্যূনতম প্রমাণ দেখাতে না পারার কারণে মামলা ডিসমিস করে দিয়েছে। শেষে এক পর্যায়ে ট্রাম্প নিজেই মিডিয়াতে নিজেই স্বীকার করে নিতে বাধ্য হন যে, সুপ্রিম কোর্ট পর্যন্ত তার মামলাগুলো দায়ের করা বা পৌঁছানোর মত অবস্থায় তিনি নাই বা মেরিট এগুলোর নেই। কিন্তু এরপরেও সবসময় তিনি শেষ কথা হিসেবে মুখস্তের মত বলে চলেন যে, তাঁকে হারিয়ে দেয়া হয়েছে, কারচুপি হয়েছে।
তাই এসবের বিপরীতে, ট্রাম্পের এক বড় পরিকল্পনার দিন ছিল গত ৬ জানুয়ারি। কিন্তু ৬ জানুয়ারি আমেরিকার নির্বাচনি ফলাফলের দিক থেকে অবশ্যই একটি আনুষ্ঠানিকতার পর্ব কেবল। বিশেষ করে, আমেরিকায় কেন্দ্রীয় নির্বাচন কমিশন রাখা হয়নি বলে এর বিকল্প কিছু বলে যেন রাজ্য পর্যায়ে চূড়ান্ত ফলাফলগুলোর যোগফল চূড়ান্তভাবে কে ঘোষণা করবেন এরই এক আনুষ্ঠানিকতার দিন কংগ্রেসে ঐ যৌথ অধিবেশন এটা। তাই পরিষ্কার করেই কনষ্টিটিউশনে বলা আছে যে, যৌথসভার সভাপতি ভাইস প্রেসিডেন্টের ঐদিনের কাজ কী কী। মূলত তা দুটো। রাজ্যের পাঠানো ফলাফলের বাক্স যা তার অফিসে পাঠানো হয়েছিল তা উন্মোচন করা এবং তা গণনার জন্য নির্ধারিত স্টাফদের নির্দেশ দেয়া; আর তা হবে যৌথসভার (সংসদ ও সিনেটের) সদস্যদের সম্মুখে। সেখানে ভোট গণনার কাজ শেষ হলে উপস্থিত যৌথ সদস্যদের প্রস্তাব-ভোটে চূড়ান্ত ফলাফল যা সেখানে পাওয়া যাবে তা ঘোষণা করা হবে।
ট্রাম্পের কনষ্টিটিউশন পাঠঃ
এখন ট্রাম্পের বা তার প্রকাশ্য-অপ্রকাশ্য উপদেষ্টাদের দেখা যায়, উটকো কিছু ব্যাখ্যা তারা হাজির করে গেছে। আর দেউলিয়া ব্যবসায়ী মনের ট্রাম্প নিজে বুদ্ধি বলে তাঁর উপদেষ্টাদের এসব আজগুবি পাঠ বিশ্বাস করেছিলেন। যেমন ট্রাম্প তাঁর ভাইস প্রেসিডেন্ট মাইক পেন্সকে সুনির্দিষ্ট কিছু করণীয় ও নির্দেশ দিয়েছেন, সেটা তিনি প্রকাশ্যেও বলেছেন।
এখন কথা হল, ট্রাম্প কি যা তার খুশি তা করতে পেন্সকে নির্দেশ দিতে পারেন? নাকি যা যা করার এখতিয়ার পেন্সকে কনস্টিটিউশন দিয়েছে কেবল সেগুলোর মধ্যে থাকা সাপেক্ষে নির্দেশই দিতে পারেন? এখানে ট্রাম্পের ধারণা তিনি যেকোন কিছু নির্দেশ দিতে পারেন। অথচ তা তিনি পারেনই না। তবু তিনি পেন্সকে (নির্দেশ) বলেছিলেন, তিনি যেন যোগফল পাওয়ার পর ঘোষণা করেন, এই ফলাফল তিনি মানছেন না বা অনুমোদন করছেন না। কিন্তু কার্যত সময়ে দেখা গেল মাইক পেন্স ট্রাম্পের নির্দেশ অমান্য করে বসেছেন। অধিবেশন শুরুর আগে তিনি এক বিবৃতি পাঠ করেন।
“It is my considered judgment that my oath to support and defend the Constitution constrains me from claiming unilateral authority to determine which electoral votes should be counted and which should not,” Pence said in a letter to Congress. বাংলা করে বললে, “আমার বিচার বিবেচনায়, আমার শপথের সময় দেয়া কনষ্টিটিউশন রক্ষা ও সমুন্নত রাখার প্রতিশ্রুতি অনুসারে কোন ইলেকটোরাল কাউন্ট হবে কোনটা হবে না এই সিদ্ধান্ত নিবার একক কোন কর্তৃত্ব আমাকে দেয় নাই”।
অর্থাৎ তিনি ট্রাম্পের নির্দেশ মেনে কাজ করতে পারছেন না, এটাই তিনি জানিয়ে দেন। আর এখান থেকে শুরু হয় ট্রাম্প-পেন্স এর ডিপারেচার। অর্থাৎ বোঝা যাচ্ছে, মানসিক অসুস্থতা কেবল ট্রাম্পের, এখনো তার ভাইস প্রেসিডেন্টকে এটা তেমন স্পর্শ করেনি। তাই যৌথ অধিবেশন শুরুর মুহূর্তে পেন্স এক লিখিত ঘোষণায় জানান, তিনি প্রেসিডেন্টের অনুরোধ রাখতে পারছেন না। কেবল কনস্টিটিউশন যা তাকে করার এখতিয়ার দিয়েছে এর ভেতরে সীমাবদ্ধ থাকবেন। এর প্রতিক্রিয়ায় ট্রাম্প এবার হতাশ হয়ে এক টুইট করেছিলেন, “পেন্স সাহসী নন। তার সাহসের অভাব আছে, তাই তিনি পারলেন না” [“didn’t have the courage to do what should have been done.”]। অথচ ফলাফল নিয়ে আপত্তি তুলবার জায়গা তো ঐ অধিবেশনই নয়। সেটার জায়গা যার যার রাজ্য নির্বাচন অফিসে বা আদালতে।
ইতোমধ্যে ঐ অধিবেশকে নিয়ে অনেক নাটকীয়তা করা হয়। সবশেষে ওই যৌথসভা থেকে চূড়ান্ত ফলাফল ঘোষণা করে বলা হয়, বাইডেন বিজয়ী বলে তারা ‘সার্টিফাই’ করছেন [Biden’s election victory certified after chaos at US Capitol leaves four people dead]। তবে এর আগে অনেক নাটকীয়তা হয়েছে। ট্রাম্প তার সমর্থকদের দিয়ে দাঙ্গা হাঙ্গামার ব্যবস্থা করেছিলেন সংসদের ভেতরে মূল হলসহ বিভিন্ন কক্ষে প্রবেশ করে ভাঙচুর করা হয়েছিল। (যদিও পরে পুলিশ জানাচ্ছে যে তারা হামলাকারিদের দখলে থাকা অস্ত্র ও বোমার এক বিরাট মজুদ আটক করেছে। ) অবশ্য এর আগেই পুলিশ ও ন্যাশনাল গার্ডরা সব নির্বাচিত সদস্যকে প্রত্যেকের মুখে একেবারে গ্যাস মাস্ক পরিয়ে সংসদ বিল্ডিংয়ের ভেতরেই গোপন কুঠিতে তাদের নিরাপদ গোপন স্থানে রেখে এসেছিলেন। এদের মধ্যে ভাইস প্রেসিডেন্ট ছিলেন সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। কারণ ট্রাম্প অসুস্থ বা তেমন কিছু হলেই তঁকেই প্রেসিডেন্ট পদে বসতে হতে পারে, তাই প্রেসিডেন্টের মাপের এই নিরাপত্তা অবস্থা। এছাড়া ঐ সংসদকেই কার্যত আমেরিকান রাষ্ট্রের অন্যতম বাস্তব রাষ্ট্ররূপ মনে করা হয়। তাই মূলত পুলিশের আধিপত্যেই ওই দিনটা দাঙ্গাহাঙ্গামাকারিদেরসহ সংসদে সবার কেটেছে। পুলিশ আধিপত্য করে গেছে দাঙ্গাবাজদের পরাস্ত ও নিয়ন্ত্রণ করেছে।
তবে মিডিয়াসহ ট্রাম্পের মধ্যে যে ধারণাটা কাজ করতে দেখা গেছে তা হল, যেন ঐ যৌথ অধিবেশন চাইলেই তাঁদের ভোটাভুটিতেই বা অধিবেশনের সভাপতি পেন্স চাইলেই যাখুশি ফলাফল যেমন ইচ্ছা ঘোষণা করতে পারেন। এরা একটা এমন আশা নিয়ে বসে থেকেছেন, রিপোর্ট করেছেন। কিন্তু বটমঅব দা ফ্যাক্টস হল, একটা প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে পাবলিক সেখানে সরাসরি ভোট দেয়ার পর সেই ফলাফলের বিরুদ্ধে যায় এমন কিছু ঘোষণা করার ক্ষমতা কি পরে ঐ যৌথ অধিবেশনের কারো থাকতে পারে? কনস্টিটিউশন কি এমন এখতিয়ার পেন্স বা ওই হাউজকে চাইলেও দিতে পারে? এর সোজা জবাব হল, দুনিয়ার কোন কনষ্টিটিউশনই এটা পারেই না। এমনকি আমেরিকান কনস্টিটিউশন না পড়েই বলা যায়, এটা তাঁদের কনস্টিটিউশনেও থাকতে পারে না। কারণ সে ক্ষেত্রে এর অর্থ হবে জনগণের ম্যান্ডেটের বিরোধিতা; ওই ম্যান্ডেটকে উল্টে দিতে পারে কোনো ব্যক্তি বা সমষ্টিকে এমন এখতিয়ার কনস্টিটিউশন দিতেই পারে না। পাবলিকের দেয়া ভোট-ম্যান্ডেট এটা সুপ্রীম নাকি ঐ যৌথ অধিবেশন বা ওর সদস্যরা? অবশ্যই পাবলিকের ম্যান্ডেটই চুড়ান্ত। কারণ পাবলিকের ভোটের এই ম্যান্ডেট সুপ্রিম, এর ওপর রাষ্ট্র দাঁড়িয়ে আছে। পাবলিক ম্যান্ডেটকে উলটে দেয়া যায়, কারেক্ট করা যায় এমন বিন্ধুমাত্র ক্ষমতা ঐ যৌথ অধিবেশনকে বা কাউকেই দুনিয়ার কোন কনষ্টিটিউশন দিতেই পারে না। পাবলিক ম্যান্ডেটকে উলটে দিবার ক্ষমতা হিসাবে মাইক পেন্স কেউ না? উনি নাথিং! তিনি কেউ নন, তিনি এমন এক্তিয়ার বিহীনও।
এখন আবার ফিরেএকটা সামআপ হিসাবে বলা যায়, আসলে আমেরিকার এই সমস্যাটা কি ব্যক্তি- ট্রাম্পের মানসিক অসুস্থতা-জাত? না তা অবশ্যই নয়। সমস্যাটা মূলত রাজনৈতিক। অর্থাৎ পলিটিকো-অর্থনৈতিক। আর সেটা জাগিয়ে তুলেছে চীনের অর্থনৈতিক উত্থান, এই অবজেকটিভ ফেনোমেনা। চীন নতুন গ্লোবাল অর্থনৈতিক হবু নেতা হতে চলেছে, আমেরিকাকে সরিয়ে। ফলে এর আঘাতে আমেরিকান সমাজ-রাজনীতি টালমাটাল হয়ে যাচ্ছে। ঠান্ডামাথায় এর প্রতি ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া দেখানোর পরিবর্তে আমেরিকার রাজনৈতিক নেতৃত্ব নিজেরাই এলোমেলো বিভক্ত হয়ে পড়ছে মূলত ভুল অনুমান, ভুল পাঠ এর কারণে। তবে অর্থনৈতিক সঙ্কট সবসময়ই এরকম হাজারো রাজনৈতিক সঙ্কট তৈরিও করে থাকে। একমাত্র পোক্ত নেতৃত্ব এটা মোকাবিলা করতে পারে। কারণ, যা হবেই তাকে যতটা কমক্ষতিতে পারে এভাবে স্বাগত জানিয়ে এই রূপান্তরকে কম অস্থিরতায় পার করে দিতে পারে – এটাই হতে হবে তাঁদের মূলসুত্র।
ট্রাম্পের ইমপিচমেন্টঃ
এখন আগামি সোমবার থেকে নতুন ইস্যু ট্রাম্পের ইমপিচমেন্ট। ডেমোক্রাটেরা এই প্রস্তাব তুলতে যাচ্ছে। অনেকে আশা করছেন এখানে বিভক্ত রিপাবলিকানদের অনেকে তাকে সাপোর্ট করবে। এটা কিছু একটা ফলাফল আসবে হয়ত তা খুব তাতপর্যপুর্ণ কিছু নয় কারণ আর মাত্র নয় দিন ডোনাল্ড ট্রাম্প প্রেসিডেন্ট আছেন। তাহলে এই ইমপিচমেনট কেন? সেটার আসল কারণ ট্রাম্পকে চাপে রাখা যাতে তিনি “ইরানের উপর হামলার নির্দেশ” জাতীয় কিছু মানসিক ভারসাম্যহীন কাজ না করে বসেন তা থেকে বিরত বা চাপে রাখতে। যেমন স্পিকার ন্যান্সি ইতোমধ্যে আমেরিকান আর্মির টপ কয়েকজন জেনারেলের সাথে কথা বলে তার উদ্বেগ জানিয়েছেন, মতবিনিময় করেছেন এসব নিয়ে।
তাহলে দিনশেষে মানে আগামিতে কী হতে যাচ্ছে? এককথায় বললে, চীনের উত্থানের চাপের মুখে আমেরিকার নিজেকে রক্ষার সক্ষমতা গত ৬ জানুয়ারির ঘটনায় বেশ কয়েকধাপ নিচে নামিয়ে দিবে। এর মূল কারণ ইতোমধ্যেই প্রকাশিত হয়ে গেল যে আসন্ন ‘আমেরিকান সঙ্কট” মোকাবলায় রাজনৈতিক নেতৃত্ব সকলের মধ্যে সংকটটা ঠিক কী এনিয়ে নুন্যতম ঐক্যমত নাই। তাঁদের মারাত্মকভাবে বিভক্তিরই প্রকাশ গত কয়েকদিনের ঘটনাবলী। এম্নকি রিপাবলিকান দলই পুরা বিভক্ত। সংকটটা ঠিক কী এনিয়ে নুন্যতম ঐক্যমত থাকত তাহলে ট্রাম্পের জাতিবাদ যার আরেক নাম সাদা সুপ্রিমিস্ট – এই চিন্তা মাইনর কিছু হয়ে থাকত। এটা হল সেই লক্ষণ যে আমেরিকার বিভক্তি সহসাই মিটছে না। অর্থাৎ আমেরিকা অপ্রয়োজনীয়ভাবে আরো দুর্বলই হচ্ছে। তবে তা হয়ত তাতক্ষণিক নয়।, কিন্তু ধীরে ধীরে। যদিও বাইডেনের প্রথম বছরের মধ্যেই আমেরিকানেরা ট্রাম্পের বিরোধী হয়ে যাবে। কারণ তারা বুঝতে শুরু করবে ট্রাম্প তাঁদের কী ক্ষতি করে দিয়ে গেছে। যদিও সাদা সুপ্রিমিস্ট ধারা ভাল রকমই থেকে যাবে! ঠিক যেমন ট্রাম্প তো আগেই জানতেন তিনি ছয় তারিখেই হেরে যাবেন সব শেষ হয়ে যাবে। তবু তিনি এই নষ্টামিটা করলেন কেন? কারণ সাদা সুপ্রিমিস্টরা মনে করে রিপাবলিকান পার্টির উপর তারা পুরা কব্জা কাজ (এখন সব রিপাবলিকান সাদা সুপ্রিমিস্ট ধারার নয়) করতে হলে, তাদেরটাই প্রধান ধারা হিসাবে ছেয়ে বসতে চাইলে সেকাজের পক্ষে বিনিয়োগ এটা। যদিও যৌথ কংগ্রেস অধিবেশনে দাঙ্গা হাঙ্গামাটা একটা নৈরাজ্যমূলক কাজ হিসাবেই দেশে-বিদেশে দেখা শুরু হয়ে গেছে। ফলে তাঁদের উদ্দেশ্য একেবারেই কাজ করবে না। উলটা তারাই সমাজে কোনঠাসা হয়ে পড়ার সম্ভাবনাই বেশি! বিশেষত ইউরোপের প্রায় সব রাষ্ট্র ট্রাম্প ও সাদা সুপ্রিমিস্টদের নিন্দা করেছে, এমনকী ভারতের মোদীও দিনশেষ দেখে এই নিন্দাকারিদের দলে!
ভারতীয় পতাকা দোলানোর গর্বঃ
সাদা সুপ্রিমিস্ট যারা হয় তারা তো নয়ই কিন্তু তাঁদের নেতা-পরিচালকেরা সুস্থ মাথায় চিন্তা করতে পারে এর অভাব সবসময় লক্ষ্য করা যায়। অন্য ভাষায় বললে নুন্যতম যুক্তিবুদ্ধির সামঞ্জস্যপুর্ণ “বয়ান-ভাষ্য” কখনই তাঁদের থাকে না, দাঁড় করাতে পারে না। অথচ বয়ান ছাড়া কেউ রাজনৈতিক শক্তি হিসাবে হাজির হতে পারবে না। যেমন নিউজিল্যান্ডের ৫০ জনের মত মুসলমান হত্যার এক সাদা সুপ্রিমিস্ট ব্রেনটন (Brenton Harrison Tarrant) এর কান্ডটা আমাদের নিশ্চয় মনে আছে। ওর বয়ান হল, নিউজিল্যান্ডে মুসলমানেরা বাইরের লোক, তারা সাদা নয় ইত্যাদি, অতএব হত্যা……। আচ্ছা সে নিজেও কী নিউজিল্যান্ডে “বাইরের লোক” নয়। কোন সাদা চামড়ার কেউ নিউজ্যল্যান্ডের আদি লোক নয়। তাঁদের পুর্বপুরুষেরা সকলেই ইউরোপের আর মূলত বৃটেনের। তাও একেবারেই গরীব, সহায় সম্পদহীন খেটে খাওয়া, জেল খাটা অংশ। কারণ মূল মিডল ও লোয়ার মিডল ক্লাস অংশটা আগেই আমেরিকা চলে গেছিল। তাহলে এই বিদেশি, বাইরের লোক, দখলদার এসব শব্দের ভিত্তি কৈ?
ক্যাপিটোল হিলে ৬ জানুয়ারির আয়োজকই ছিল সাদা সুপ্রিমিস্টরা। অথচ সেখানে গিয়ে হাজির হয়েছে এক ভারতীয় অরিজিন বাসিন্দা।কলকাতার আনন্দবাজারের অনুসন্ধানি দাবি যে তিনি ভিনসেন্ট জেভিয়ার। লিখেছে, “কট্টর ট্রাম্প সমর্থক হিসেবে পরিচিত ভার্জিনিয়ার বাসিন্দা বছর চুয়ান্নর ভিনসেন্ট যে তাঁর কৃতকর্মে অনুতপ্ত নন, সেটাও স্পষ্ট করে দিয়েছেন তিনি”। এছাড়াও লিখেছে, “কাল সেই ভারতীয় বংশোদ্ভূত ভিনসেন্ট জেভিয়ার নিজেই সংবাদমাধ্যমকে বললেন, ‘‘ভারতকে অসম্মান করাটা আমার উদ্দেশ্য ছিল না। আমি আসলে আমেরিকাতেও যে বৈচিত্রের মধ্যে ঐক্য আছে, সেটা বোঝাতে চেয়েছিলাম। দেখাতে চেয়েছিলাম, রিপাবলিকান পার্টি একেবারেই বর্ণবিদ্বেষী নয়।’’
এসব কথা বলে না ঐ কথিত ভিনসেন্ট না আনন্দবাজার নিজেদের মনভাব অভিপ্রায় ঢাকতে পেরেছে। ৬ জানুয়ারি নিয়ে আনন্দবাজার দুটা রিপোর্ট করেছে। কিন্তু দুটাতেই সহানুভুতির জায়গায় দাঁড়িয়ে লেখা। কেন, কীসে এই সহানুভুতি? ভারতের মিডিয়া ও রাজনীতিবিদের এটিচুড হল, ট্রাম্পই তাঁদের ফেবারেট লোক ছিল, বাইডেন নয়। কারণ হিউম্যান রাইট ইস্যুতে বাইডেন ভারতকে ছেড়াবেড়া করে দিবেন। তাঁদের মোদীসহ হিন্দুত্ববাদ দুনিয়াজুড়েই নিন্দার বিষয় হয়ে উঠবে তাতে। কাজেই ট্রাম্পই তাঁদের পছন্দের নেতা যে ভারতের মুসলমানকে পিটিয়ে মারলে বা কাশ্মীরে আগুন ছড়িয়ে দিলেও মোদীকে কিছুই বলবেন না। অতএব ৬ জানুয়ারি যদি লাইগা যায়, চাইকি ট্রাম্প যদি আবার নিজেকে প্রেসিডেন্ট বলে আবার ফিরে আসতে পারেন তাহলে তো লাভই লাভ! এই জায়গায় এসে কথিত ভিনসেন্ট আর আনন্দবাজার দুজনের অবস্থান এক জায়গায়। কিন্তু সেজন্য ভারতীয় পতাকা বইবার দরকার কী?
এইখানে এসে ভিনসেন্ট ধরা খেয়ে গিয়েছেন। তিনি মূলত হিন্দুত্ববাদের লোক এবং জাতিবাদী তাই আমেরিকান ভোটার হয়েও ভারতীয় পতাকা ছাড়া হাটেন না। তিনি বাদামি, হোয়াইট নন। তাই তিনিই কিন্তু সাদা সুপ্রিমিস্টদের একদম আসল টার্গেট। কিন্তু মোদী-ট্রাম্প প্রেম তাঁকে ঐ জমায়েতে নিয়ে গিয়েছে। আবার সাদা সুপ্রিমিস্টদের জমায়েতে গিয়ে তিনি সার্টিফিকেট দিচ্ছেন, সাদা সুপ্রিমিস্টদের ভিতরে বৈচিত্রের মধ্যে ঐক্য খুজেছেন! কি তামসা!তারা বর্ণবাদী নয় বলে সাফাই দিয়েছেন। মানুষের আসলেই বড় অদ্ভুত প্রাণী! আর ওদিকে আনন্দবাজার আরো তামাশার। তাঁদের হেডলাইন হল, “তাণ্ডবে তেরঙ্গা উড়িয়েও অবিচল“। মানে হোক না “তান্ডবে” কিন্তু তেরঙ্গা ভারতীয় পতাকা তো তুলেছে! তাই এটা নাকি গৌরবের!
লেখক : রাজনৈতিক বিশ্লেষক
goutamdas1958@hotmail.com
[এই লেখাটা গত ০৯ জানুয়ারি ২০২১, দৈনিক নয়াদিগন্ত পত্রিকার ওয়েবে ও প্রিন্টেও “আগে প্রেসিডেন্টের মানসিক স্বাস্থ্য চেক করুন” – এই শিরোনামে ছাপা হয়েছিল। পরবর্তিতে ঐ লেখাটাকে এখানে আরও নতুন তথ্যসহ বহু আপডেট করা হয়েছে। ফলে সেটা নতুন করে সংযোজিত ও এডিটেড এক সম্পুর্ণ নতুন ভার্সান হিসাবে ও নতুন শিরোনামে এখানে আজ ছাপা হল। ]