মিয়ানমার কোন রাষ্ট্র নয়, একটা সামরিক ক্লাব


মিয়ানমার কোন রাষ্ট্র নয়, একটা সামরিক ক্লাব

গৌতম দাস

১৫ ফেব্রুয়ারি ২০২১, ০০:০৬ সোমবার

https://wp.me/p1sCvy-3nc

মিয়ানমারের সামরিক বাহিনী / ডিফেন্স ফোর্স নামে ক্লাবের প্রধান মিন অং লাইং

গত ১ ফেব্রুয়ারি থেকে মিয়ানমার মানে, বার্মা-দেশ আবার দেশী-বিদেশী খবরের শিরোনামে উঠেছে। যদিও রয়টার্স বা বিবিসি বলছে ১ ফেব্রুয়ারি ভোরে মিয়ানমারে নাকি একটা ক্যু হয়েছে। আসলেই কী তাই? না, ঠিক তা নয়। আপাত চোখে একটা ক্যু মনে হলেও। কারণ আগে থেকে কোথাও যদি একটা রিপাবলিক বা জন-প্রজাতন্ত্রী রাষ্ট্র গঠন [constitute] হয়ে থাকে একমাত্র এরপরেই না প্রশ্ন উঠে ঐ রাষ্ট্রের সেনাবাহিনী কোন সামরিক ক্ষমতাদখল বা ক্যু করেছে কিনা! যেটা রাষ্ট্রই নয় বরং  একটা সামরিক ক্লাব তার বেলায় এটাকে ক্যু বলা না বলায় কী এসে যায়? তাই নয় কী? তাহলে পশ্চিমারা সবাই একে ‘ক্যু’ বলছে কেন?
এটা বলছে কারণ আমেরিকা-ইউরোপের বা পশ্চিমা রাষ্ট্রগুলোর ভাষ্য এটা।  এককথায়, কারণ এই রাষ্ট্রগুলো গত ত্রিশ বছরেরও বেশি আগে থেকে দাবি করে আসছিল যে বার্মায় নুন্যতম হিউম্যান রাইট নেই, অনবরত এর চরম লঙ্ঘন হচ্ছে। কথা সত্যও বটে। ফলে আমেরিকা তো বটেই সেসময় জাতিসংঘ থেকেও অবরোধ জারি করা ছিল। বার্মাকে অস্ত্রবিক্রির উপর নিষেধাজ্ঞা ছিল।  কিন্তু ২০০৭-১০ এই সময়কালে সব উলটে যায়। টেবিলের নিচে ডিল হয়। হিউম্যান রাইট  বিক্রি হয়ে যায় যা আমেরিকার নেতৃত্ব পশ্চিমারা সব সময় করে আসছে।  কারো হিউম্যান রাইট  রেকর্ড খারাপ থাকলে এর বিনিময়ে পশ্চিমারা সওদা করে  নিজেদের বৈষয়িক স্বার্থ হাসিল করে নিয়ে থাকে। এই ডিলেরই বাইরের প্রকাশ্য চিহ্ন হল নতুন করে লিখিত বার্মার কনষ্টিটিউশন-২০০৮। যেখানে বার্মা সামরিক ক্লাবের ক্ষমতাটা আগের মতই ক্লাবের হাতে থেকে যায় তবে সাথে একটা ভ্যানিটি ব্যাগ বা ‘ফুটানি কা ডিব্বা’ লটকে দেয়া হয়। সেটা হল,  অং সান সুচির [Aung San Suu Kyi] একটা সিভিলিয়ান ফেস। এতেই ভাব ধরা হয়েছিল যে বার্মা যেনবা একটা জন-প্রজাতন্ত্রী রাষ্ট্র। অথচ ক্ষমতাটা ছিল আগের মতই বার্মার “ডিফেন্স সার্ভিস” নামে এক সামরিক ক্লাবের হাতে।
আসলে ব্যাপারটা দাড়িয়েছিল,  হিউম্যান রাইট বিষয়ক অভিযোগ আগে যা ছিল তা পশ্চিমের সবাই দলবেধে বেচে দিয়েছিল, মানে মিটিয়ে নিয়েছিল জেনারেলদের সাথে মিলে দেনা-পাওনায়। আর বিনিময়ে বার্মার জেনারেলদের থেকে বাগিয়ে  ব্যবসা ও সম্পদ লুটের ভাগ নিয়েছিল।  আর এটা শুধু অভিযোগ সব চেপে যাওয়া নয়, উলটা সার্টিফিকেট দিয়েছিল যে এরপর থেকে নাকি কথিত “গণতন্ত্রের পথে সংস্কার” হতে শুরু করেছে!   এই “গণতন্ত্র” শব্দটা অদ্ভুত। বিয়ে করে নাই; অথচ বাচ্চা পয়দা হয়েছে দাবি করার মত।  তাই কনষ্টিটিউশন-২০০৮ এটাই তো প্রমাণ যে  বার্মা একটা সামরিক ক্লাব মাত্র, আর ঐ ক্লাবের গঠনতন্ত্রই হল কনষ্টিটিউশন-২০০৮। মোটকথা ব্যতিক্রমহীনভাবে সারা পশ্চিম বার্মার জেনারেলদের থেকে ব্যবসা ও সম্পদ লুটের ভাগ পেয়ে চেপে গিয়েছিল।  আর এই ডিলটাই ঘটাতে প্রাইমারি দুতায়ালিটা ঘটিয়ে দিয়েছিল ভারত, ফলে সেও কিছু ভাগ পেয়েছিল।  আর চীনের কথা আর কী বলব! সে বরং হিউম্যান রাইটের ঢং না করে বরং সোজা সাপ্টা ঘুষ দেয়া আর কাজ নেয়ার লাইনে ছিল। তাই , যেটা বার্মার উপর আশির দশক থেকে জাতিসংঘের আরোপিত অবরোধ সে আমল থেকে চীন সেটার একাই ফয়দা লুটেছিল। কারণ বার্মার পড়শি বলে একমাত্র চীনের মাধ্যমেই না-দেখার ভান করে বার্মা বাইরের দুনিয়ার সাথে সক্ষম রেখে চলতে পারছিল। তাই এটা ছিল চীনের পড়ে পাওয়া সুবিধা।
তাহলে এখন কী হয়েছে? জেনারেলেরাও কেন ক্যু বলাতে আপত্তি করছে না? মিয়ানমারের জেনারেলরা এই উছিলায় চাইছে তাদের আর ক্লাব নয়, রাষ্ট্রই মনে করা হোক এবং এটাই তাদেরও ভাষ্য। তাহলে সমস্যাটা ঠিক কোথায়? সমস্যা হল, মিয়ানমার একটা দেশ অবশ্যই। কিন্তু এটা জন্ম থেকে কখনোই রাষ্ট্র নয় মানে – মিয়ানমার ১৯৪৮ সালের স্বাধীনতা মানে এর আগের কলোনি দখলদার জাপান অথবা ব্রিটিশদের থেকে মুক্ত হওয়ার পর থেকেই এটাকে খতিয়ে না দেখে  অভ্যাসে রাষ্ট্র মনে করা হয়েছিল। আর পাঁচটা কলোনিমুক্ত হওয়া স্বাধীন রাষ্ট্র ভেবে।  নেহেরুর ভারত বা জিন্নাহ’র পাকিস্তান অর্থেও বার্মা কখনও রাষ্ট্র হতে পারে নাই। যেমন অন্তত একটা ছোট্ট কথা দিয়ে বলা যায়।
খুবই অল্প কথায় বললে, প্রশ্নটা ক্ষমতার, মানে রাষ্ট্রক্ষমতার।  যেমন, শাসন-ক্ষমতাধর যেকোন শাসককে বলতে পারতে হয়, কে তাঁকে ক্ষমতা দিয়েছে। মোটা দাগে এখানে দুধরণের জবাব দেখতে পাওয়া যায়। এক. যারা ক্ষমতার উৎসের জবাব দিতে পারে না, হদিস দিতে পারে না; যাদের বেলায় ক্ষমতার উত্তরাধিকার হিসেবে রাজার সন্তান রাজা এমন হয়। অথবা এদের আদি রাজার ক্ষমতার হদিস না দিতে পেরে দাবি করেন যে ক্ষমতা ‘ঐশ্বরিকভাবে’ পেয়েছে।
আর দুই. যারা হিম্মত রাখে ও ব্যবহারিকভাবে মেনে নেয় যে ‘ক্ষমতা জনগণের’। সে-ই জনগণের সম্মিলিত ইচ্ছার প্রতিনিধি, নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি হিসেবে তারা ক্ষমতায় আসীন হয়েছে। এই দ্বিতীয় ধারার বেলায় কেবল এরাই দাবি করতে পারে, তাদের রাষ্ট্র আছে আর সেই দেশে নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিরা একটা রাষ্ট্রগঠন করেছেন, ফলে এরপর একটা সরকার গঠনও করেছে। এই দ্বিতীয় ধারাকেই বলা যায় এটা এক রিপাবলিক বা জনগণের প্রজাতন্ত্রী রাষ্ট্র। কাজেই রিপাবলিক বাদে আর কোনো দেশেরই ক্ষমতার উতসের হদিস থাকে না, উত্তরাধিকারী রাজা-সম্রাটের সন্তানেরা রাজা-সম্রাট হয়ে থাকে। কোথাও কোথাও বড়জোর সমাজের কিছু এলিট মিলে তাদের পছন্দের কাউকে শাসক বানিয়ে রাখে। ফলে কোথাও শাসক থাকা মানে তা ‘দেশ’ অবশ্যই; কিন্তু শাসক থাকা মানেই তা ‘রাষ্ট্র’ নয়। আবার যদিও  দুনিয়াতে যা দেখা গেছে, এই অর্থে ইতিহাসে ১৬৫০ সালের আগে রিপাবলিক রাষ্ট্র বলে কিছু ছিল না।
তবে নিজ ক্ষমতার উৎস কী, কে দিয়েছে তা পরিষ্কারভাবে বলতে পারা বা না-পারা- এটাকেই আমরা কোনো ‘দেশ’কে ‘রাষ্ট্র’ বলেও মানা না মানার মূল নির্ণায়ক বলতে পারি।

কিছু ব্যতিক্রম, ‘নগর-রাষ্ট্র’
তবে ব্যতিক্রম হিসেবে ক্ষণকালের জন্য আমরা কোথাও নগর-রাষ্ট্র ধারণা লক্ষ করি। যেমন যিশুর জন্মের ৭৫৩ বছর আগে [753 BC] ‘প্রাচীন রোমে’ রাজতন্ত্রের পত্তন হয়েছিল। পরে (প্রায় আড়াইশ’ বছর পরে) সেখানে নগর-রাষ্ট্রের ধারণার বাস্তবায়ন শুরু হয়েছিল, সেটাও যিশুর জন্মের ৫০৯ বছর আগে [509 BC]। এটাই প্রথম দীর্ঘস্থায়ী রিপাবলিক। পরে সেটাও ভেঙে যায় যিশুর জন্মের মাত্র ২৭ বছর আগে [27 BC]। তাতে এবার ফিরে আবার রাজতন্ত্র বা মোনার্কি মানে, রোমান এম্পায়ার প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। আর তা টিকেছিল যিশুর জন্মের ৪৭৬ বছর পরে [476 AD] পর্যন্ত। এ সময়েরই মাঝামাঝি রোমে প্রভাব বেড়ে যাওয়া খ্রিষ্টধর্ম সামলাতে না পেরে শেষে ৩১৩ সালে সম্রাট কনস্টান্টিন নিজেই রোমকে ‘খ্রিষ্টান রোম’ বলে ঘোষণা করেন। তখনই তিনিসহ সংখ্যাগরিষ্ঠ নাগরিক সদলে খ্রিশ্চান ধর্মগ্রহণ করেছিলেন।

কলোনিদখল হয়ে যাওয়ার মধ্যেও ভালোমন্দ আছেঃ
অনেকে বলে থাকেন, দেশ যদি কলোনি দখলে যায়ই তবে জাপানের কলোনি হওয়ার চেয়ে ব্রিটিশ কলোনি হওয়া ভাল। এমন কেন বলেন?
ব্রিটিশেরা ‘পশ্চিমা’ বলে এশিয়ান জাপানের চেয়ে তারা ভাল, ব্যাপারটা একেবারেই তা নয়। আগে দেখেছি, রোম ‘নগর-রাষ্ট্রও’ টিকে নাই। শেষে তা রোম সাম্রাজ্যের ভেতরে হারিয়ে যায়; যে সাম্রাজ্য আবার ৪৭৬ সালের [476 AD] মধ্যে নিজেও বিলীন হয়ে যায়। কিন্তু পরে “হলি রোমান এম্পায়ার” নামে, ৮০০ সাল থেকে রাজা শার্লেমেন [Charlemagne] (ফরাসি উচ্চারণে শাআলে-মেঁ) নতুন করে “হলি রোমান এম্পায়ার” [Frankish king Charlemagne as Roman emperor by Pope Leo III on Christmas Day in the year 800] নামে এক  সাম্রাজ্যের পত্তন ঘটান। তবে আগের রোমান সাম্রাজ্যের সাথে নয়া হলি রোমান এম্পায়ারের কোনো সম্পর্ক নেই, কেবল নামের কিছু মিল ছাড়া। আর এখনকার জার্মানি-ফ্রান্সের মাঝের ফ্রাঙ্ক [Frank] ভূখণ্ডকে কেন্দ্র রেখে এর বিস্তার শুরু হয়েছিল। মোটা দাগে, এই সাম্রাজ্যই (৮০০-১৮০৬) সময়কাল জুড়ে জারি ছিল আর এখনকার ইউরোপের প্রায় সব রাষ্ট্রেরই পূর্বের-শাসক ছিল। যদিও শেষের ৩০০ বছর বিশেষত ১৬৪৮ সাল থেকেই এটা নামকাওয়াস্তে সাম্রাজ্য হয়ে গিয়েছিল। এমনকি তা আলাদা আলাদা ছোট সাম্রাজ্য হয়ে প্রত্যেকে নিজেদের  সীমানাও ভাগ করে নিয়েছিল। আর সেগুলোই একালে রিপাবলিক রাষ্ট্ররূপ [তবে জাতি-রাষ্ট্র] হয়ে নিয়েছিল যা এখনকার ইউরোপীয় রাষ্ট্রগুলোর সীমানা নির্দেশ করে।
এভাবে এক পর্যায়ে ১৬৫০ সালের ব্রিটেনে ক্রমওয়েলের বিপ্লবকেই (Cromwell revolution) ধরা হয়, প্রথম রাজতন্ত্রের বিরুদ্ধে রিপাবলিক রাষ্ট্রচিন্তার বিজয়। তবে এরপরে সাম্রাজ্যগুলোর ভেতরেই এদের শাসন-কাঠামো কী হবে তা নিয়েও রাষ্ট্র-ধারণার ক্রম-রূপান্তর ঘটেছিল; যেখানে মূল প্রশ্ন ছিল রাষ্ট্রক্ষমতা।

রিপাবলিক রাষ্ট্রের অলিগলির ভাবনাঃ
সারকথায় সেটা হল যেমন, নাগরিক হল উপাদান বা কনস্টিটুয়েন্ট। আর এই কনস্টিটুয়েন্টদেরকে নিয়ে রাষ্ট্র কনস্টিটিউট বা গঠন করা – [যেখান থেকে কনষ্টিটিউশন বা Constitution] ধারণাটা। আর এসব ধারণার উপর রিপাবলিক রাষ্ট্র গঠিত। এখানে পাবলিক বা নাগরিকই রাষ্ট্রক্ষমতার উৎস – এই ধারণা আস্তে ধীরে সমাজগুলোতে প্রতিষ্ঠা পেয়েছিল। এর সাথে সাথে তাই রিপ্রেজেন্টেশন বা প্রতিনিধিত্ব ধারণাও প্রতিষ্ঠা পেয়েছে। এটাই জন-প্রতিনিধিত্বের ধারণা; কালক্রমে যা মাঠে ময়দানের ভাষায় ভোট বা নির্বাচন। এখান থেকে রাষ্ট্রের সাথে সম্পর্কিত আরো শব্দ যেমন – জনস্বার্থ, জনস্বাস্থ্য, জনপ্রশাসন, জনপরিবহন অথবা পাবলিক ইন্টারেস্ট লিটিগেশন (জনস্বার্থে মামলা)। আবার এখান থেকেই মাও সেতুংয়ের চীনের ভাষায় তাদের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নাম  – পিপলস ব্যাংক, সেনাবাহিনীর নাম – পিপলস আর্মি ইত্যাদি। সার কথাটা হল, রাষ্ট্রক্ষমতার উৎস জনগণ; রাষ্ট্রপরিচালনায় সব ক্ষমতার উৎস জনগণ – এটাই মূল ভিত্তি। এই ধারণাকে মূল ও কেন্দ্রীয় ধারণা হিসেবে প্রতিষ্ঠা করে রাষ্ট্র ধারণার বিস্তার ঘটেছে। তাই না কোন রাজা, না সম্রাট, না কোন রাজ-উত্তরাধিকারী বা না সমাজের এলিটদের বেছে নেয়া কেউ প্রমুখ – এরা কেউই ক্ষমতার উৎস নন। রাষ্ট্রক্ষমতার উৎস একমাত্র জনগণ। জনগণের সম্মিলিত ইচ্ছার প্রতিনিধি – নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিরাই একমাত্র জনগণের হয়ে রাষ্ট্র পরিচালনা করতে পারেন। এটাই রিপাবলিক (গণপ্রজাতন্ত্রী) রাষ্ট্র ধারণাটার সারকথা।
কিন্তু রাষ্ট্র ধারণার এদিকটা এশিয়ায় এভাবে এত বিকশিত হয়নি। একটা মোনার্কি মানে সেখান থেকে ছোট রাজা থেকে বড় সম্রাটের সাম্রাজ্য আর সেখান থেকে  কলোনি দখলদার মালিকের সাম্রাজ্য হয়ে ওঠার পরে দেখা গেছে, এদের বিকাশের এখানেই সমাপ্তি।  এরা আর রিপাবলিক রাষ্ট্র ধারণা পর্যন্ত বিকশিত হতে পারে নাই।  যেমন এশিয়ান অরিজিন জাপান, এর সম্পর্কে আমরা খুবই কম জানি বা চর্চা করি। সে মূলত পূর্ব এশিয়ার (ততকালে অবিভক্ত) একই কোরিয়া ও চীনের আংশিক কলোনি দখলদার এক সাম্রাজ্য ছিল যা নিজে বৃটিশদের মত কোন রিপাবলিক রাষ্ট্র নয়। কেবলমাত্র এক সম্রাটের সাম্রাজ্য (তবে কলোনিদখলদার) ছিল। এবং সেকালের বার্মার কিছু নেতা অথবা পশ্চিমবাংলার সাবেক কংগ্রেসি নেতা সুভাষ বোস – এদের মাধ্যমে ব্রিটিশ-ভারত এই কলোনিকে জাপান নিজের প্রভাবাধীনে কিছু অংশ বা পারলে পুরাটাই পুণঃদখলি কলোনি করে নেয়ার চেষ্টা করেছিল এমনই আরেক কলোনি মাস্টার ছিল সেই জাপান।

জাপান নিজেকে রিপাবলিক রাষ্ট্র মনে করে কিনা এখনও অস্পষ্টঃ
কিন্তু জাপান সম্পর্কে এর চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ আরেক দিক আছে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পক্ষ-বিপক্ষের ভাগাভাগিতে জাপান হিটলারের জার্মানির পক্ষে আর আমেরিকা-সোভিয়েত-ব্রিটিশ মিত্রশক্তির বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছিল। কিন্তু যুদ্ধে জার্মানির হিটলারের সাথে জাপানও হেরে যায়। কিন্তু আমেরিকা আর সব  ‘হারুপার্টির’ মত জাপানকেও ত্রাণ এবং অবকাঠামো ও শিল্প পুনর্বাসনের অর্থ-বিনিয়োগ দিয়েছিল। এতে জাপান পুণর্গঠিত হয়ে উঠেছিল তবে কেবল সামরিক দিকে আমেরিকার অধীনস্ত থেকে পুনর্গঠিত এক নতুন রাজনৈতিক ব্যবস্থার জাপান গঠন করা হয়েছিল। এই নতুন জাপান নিজেকে এবার আর কোন সম্রাটের সাম্রাজ্য ফিরে দাবি না করলেও নয়া রাষ্ট্র দাবি করেছিল। কিন্তু সেটাও রিপাবলিক কি না তা জানা যায় না। এছাড়া জাপানে রাজনীতি বলে কিছু আছে কি না, চিন্তায় ও চর্চায় রাজনৈতিকতা [Polity] আছে কিনা, তাও জানা যায় না। জাপানের ফরমাল নাম “ইউনিয়ন অব জাপান”। অর্থাৎ কোথাও এটা যে ‘রিপাবলিক’ সে কথা বলা হয়নি।
ওদিকে জাপানে রাজনৈতিক চিন্তা ও চর্চার দিক সবসময়ই খুবই দুর্বল। রাজনৈতিক ধারণা বলতে এখানে বড় জোর একটা জাতিরাষ্ট্র বা দেশপ্রেম – এই পর্যন্তই, যেন এর কোন রাজনৈতিকতা নাই বা সেবুঝে না। বিশেষত জাপানের কলোনি দখলের পক্ষে নিজ কোন সাফাই দেয়ার যেন প্রয়োজন – অনুভব ছিল আমরা দেখি না। যেন তারা বুঝাতে চায় তাদের গায়ের জোর ছিল তাই দখল করেছিল – এধরনের, যেটা বলা বাহুল্য ব্রিটিশদের মত নয়।
কারণ এসবের বিপরীতে ব্রিটিশদের রাজনীতি ও রাষ্ট্র নিয়ে ধারণা ছিল। শুধু তাই না কলোনিদখল করা দেশ বৃটিশ-ইন্ডিয়াতে যেমন- রামমোহন রায়,  (কমিউনিস্টরা যাকে রেনেসাঁর আদিগুরু মনে করে) তাঁর চিন্তার সীমাবদ্ধতা ও কমতির শেষ নেই কথা সত্য। তবু একটা রাজনৈতিক রাষ্ট্র গড়ার স্বপ্ন ব্রিটিশেরা তাঁকে এবং অন্য নেটিভদের দিতে পেরেছিল ও দিয়েছিল। অবশ্য তা মূলত নেশন-স্টেট ধরনের জাতিবাদী, দেশপ্রেম টাইপের আবেগী ধারণা। এটা মূলত জাতিরাষ্ট্র অর্থে রিপাবলিক ধারণা হলেও তা পাবলিকের ক্ষমতার রাষ্ট্র মনে করা হত। এ ক্ষেত্রে রামমোহনে চিন্তার সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও একটা রাজনৈতিকতা সেখানে ছিল আমরা দেখি। এককথায় জনগণই রাষ্ট্রক্ষমতার উৎস ও কেন্দ্র এতটুকু চিন্তার রাজনৈতিকতা ব্রিটিশ কলোনি থেকে পাওয়ার সুযোগ ছিল। কিন্তু জাপানের কলোনি হলে এটুকু কেন কোন রাজনৈতিকতা পাওয়ার সুযোগ ছিল না, নাই। এর একেবারে গোড়ার কারণ জাপান আসলে ছিল এক সম্রাটের সাম্রাজ্য; মানে সেকালে তা ছিল এক রাজতান্ত্রিক জাপান। তবে যদিও তা মার্শাল তেজো ধরণের সামরিক নেতা নির্ভর। এদিকে বলাই বাহুল্য রাজতন্ত্রে “রাজনীতি” বলে কোন ধারণা থাকে না। তাই, শাসনের ক্ষমতা কক্তৃত্ব একমাত্র জনগণের এই ধারণা সমাজে না থাকলে সেখানে রাজনীতি শব্দ ও ধারণার উদ্ভব ঘটে না। থাকতেই পারে না। ফলে কোন ধরণের রাজনৈতিকতাও। তাই নেতা সুভাষ বোস বা বার্মার তরুণদের জাপানি আর্মি যত যাই কিছুই শিখিয়ে থাকুক বা ট্রেনিং দেক তার চিন্তায় রাজনীতি বা রাষ্ট্র ধারণার লেশ মাত্র ছিল না। থাকার কথাও না।

জাপানে কোন ধরণের রাজনৈতিকতার ধারণা না থাকা, এদিকটাই জাপানি ট্রেনিংপ্রাপ্ত মিয়ানমার শাসকদের ভিন্ন করে তুলেছে বলে অনুমান করা যায়। সেকারণেই বার্মা কেন রাষ্ট্রই নয়, কোনো রিপাবলিক নয়, এর কারণ আমরা এখানে খুঁজলে পাবো।

তবে মিয়ানমার কেন ব্রিটিশ শাসনবিরোধিতা করতে জাপানের কাছে গিয়েছিল, এর পেছনে আবার সবচেয়ে বড় কারণ মনে করা হয় দুটা। ব্রিটিশরা বার্মা দখল করেছিল ১৮২৪ সালে, ছেড়ে গিয়েছিল ১৯৪৮ সালে। কিন্তু এই ১২৪ বছরের মাত্র শেষ ১১ বছর (১৯৩৭ সাল থেকে ১৯৪৮) বাদে বাকি সবটা সময় বার্মাকে ব্রিটিশ-ইন্ডিয়ারই একটা প্রদেশ রূপে ঘোষণা করে বৃটিশেরা শাসন করেছিল। আর ভারতীয় ও ব্রিটিশদের উপর এটাই বার্মিজদের প্রধান ক্ষোভের কারণ। সেটাই বা কীভাবে?
বার্মাকে এমন প্রদেশ হিসেবে গণ্য করে শাসন করাতে বার্মার ক্ষমতায় সবার উপরে ব্রিটিশরা থাকলেও মূলত ভারতীয় সিভিল সার্ভিস অফিসারদের অধীনে বার্মা নিজেকে দেখতে পেত। এর ফলে আরো ঘটনা হল বার্মার শহর-গঞ্জে ভারতীয়রা বার্মায় ব্যবসায় ও চাকরিতে প্রধান ভূমিকায় নিজেদের প্রতিষ্ঠিত করে ফেলেছিল। যেমন কথাসাহিত্যিক শরৎচন্দ্রের গল্প উপন্যাসগুলো মনে করা যেতে পারে যেখানে বার্মার নাম এই কারণেই বারবার এসেছে। ফলে ভারতীয়রা হয়ে যায় বার্মার সাধারণ মানুষের চোখে প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী ও লুটেরা; যার উপরে কলোনি মালিক ব্রিটিশের ওপর বার্মিজ ঘৃণা তো আছেই।
ফলে বার্মিজ তরুণদের কাছে জাপানের শাসকেরা হাতছানি তৈরি করতে পেরেছিল। এতে বার্মিজদের পালটা প্রতিক্রিয়া হয় যে, তারা জাপানি সাহায্য নিয়ে হলেও দেশ থেকে ভারতীয় ও ব্রিটিশদের তাড়াবে। এমনকি ভারতীয়দের বিরুদ্ধে এই ঘৃণা ১৯৪৮ থেকে ’৬০ সাল পর্যন্ত আরো তীব্র হয়েছিল তাদের সমূলে ভারত ফেরত পাঠাতে। তবে তরুণদের জাপানি-প্রীতি বাড়ার আরেক বড় কারণ হল, ১৯৪১ সালে বিশ্বযুদ্ধের ভিতর জাপান থাইল্যান্ড দখল করে নিয়েছিল। আর বার্মার প্রতিবেশী হল থাইল্যান্ড। রেঙ্গুন ইউনিভার্সিটির তরুণ, সু চির বাবা অং সান ও তাঁর বন্ধুরা প্রায়ই ব্রিটিশদের নির্যাতন বা খোঁজাখুঁজি এড়াতে পালিয়ে থাইল্যান্ডে আশ্রয় নিতেন। আর সেখানেই জাপানি আর্মির সাথে তাদের প্রথম মোলাকাত ঘটেছিল। সেখানেই সাব্যস্ত হয় যে, জাপানিরা তাদের সামরিক ট্রেনিং দিবে। অং সান গোপনে দেশে ফিরে নিজ বন্ধুদের সংগঠিত করে নিয়ে যান। পরবর্তীকালে ট্রেনিংপ্রাপ্ত এরাই হয় ট্রেনার যা গড়ে তুলেছিল বার্মিজ ইন্ডিপেন্ডেন্ট আর্মি [Burmese Independent Army, BIA] নামের সেনাবাহিনী। পরের বছর ১৯৪২ সালে জাপানিরা বার্মা আক্রমণ করলে এই বাহিনীর তরুণ সেনারা জাপানিদের পক্ষে পদাতিক যুদ্ধে অংশ নিয়েছিল। এতে জাপানিরা ব্রিটিশদের হাত থেকে বার্মাকে স্বাধীন করে ফেলে। আর এতে বার্মায় গড়ে উঠা জাপানি প্রশাসনে অংশ নিয়েছিলেন অং সান ও তার বন্ধুরা।

আমাদের মোগল আমলে ‘রাজনীতি’ বলে কোন শব্দই ছিল না, কেন?
কিন্তু নির্ধারক ভূমিকাটা ঘটেছিল আরেকটু অন্যখানে। জাপানিরা অং সানের ৩০ জন বিশেষ বন্ধুদের একটা দলকে বিশেষ ট্রেনিং দিয়েছিল বিআইএ গঠনের সময়। এদের গল্প-বীরত্বই আজও বার্মার আর্মির পুঁজি। সাথে আবার একই সাথে বার্মা কোন রাষ্ট্র নয়, একটা সামরিক ক্লাব হিসাবে গড়ে উঠবার পিছনের কাহিনী। মনে রাখতে হবে জাপান তাঁদের যতকিছুরই ট্রেনিং দেক তাতে রাজনৈতিক ট্রেনিং বা রাষ্ট্র-বিষয়ক কোন ট্রেনিং বা ধারণা তাদেরকে দেয় নাই। কারণ খোদ জাপানেই তো রাজনীতি বলে কিছু ছিল না। স্মরণ করেন, আমাদের মোগল আমলে ‘রাজনীতি’ বলে কোন শব্দই ছিল না। কারণ রাজতন্ত্রে এসব ধারণা বা শব্দ থাকে না। যে কারণে এখনকার সৌদি আরবেও রাজনীতি শব্দটা নাই। রাজনীতি শব্দ বা ধারণা থাকার পুর্বশর্ত হল যখন রাজতন্ত্রের বিপরীতে “জনগণই রাষ্ট্রক্ষমতার উৎস” – এধারণা প্রতিষ্ঠিত থাকে।

পরবর্তিতে মাত্র তিন বছরের মধ্যে জাপানিদের ব্রিটিশদের কাছে হার স্বীকার করতে হয়েছিল। মূল কারণ ১৯৪৫ সালের আগস্টে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের জাপান-জার্মান অক্ষশক্তির হার হয়েছিল। ফলে বার্মার ক্ষমতা আবার সেই ব্রিটিশদের হাতে ফিরে চলে যায়। আর তা থেকেই পরে ১৯৪৮ সালে অং সানের (তিনি ১৯৪৭ সালে আততায়ীর হাতে নিহত হয়েছিলেন)বন্ধুরা ক্ষমতা নেন, বিশেষত ঐ ‘প্রমিন্যান্ট’ ৩০ জন।

বিশেষ ত্রিশজনের পরিণতিঃ
কিন্তু বার্মার শাসনে দুর্যোগের দিন শুরু হয় এখান থেকেই। মূলত এই ৩০ জন ভাগ হয়ে গেছিলেন মূলত কারা মূল সিভিলিয়ান রাজনীতিবিদ বা প্রশাসক হবেন আর কারা মূল আর্মি অফিসার হবেন – এভাবে। কিন্তু এটাই কাল হয়ে দাঁড়ায়- এ দুই দলের কারা শ্রেষ্ঠ অথবা কাদের ভূমিকা নির্ধারক, এসব নিয়ে। আসলে পেছনের ঘটনাটা আরেকটু ভিন্ন। জাপানি ট্রেনিংয়ে কখনোই রাজনৈতিকতাকে গুরুত্ব দেয়া হয়নি। একই কারণে রাষ্ট্রক্ষমতার ও রাষ্ট্রগঠন সংক্রান্ত ধারণা দেয়া হয়নি। কারণ এসব বিষয়ে জাপানিরা নিজেদেরই ধারণা ছিল না। বরং উলটা, তাঁদের ধারণা বলতে সবই ছিল ক্ষমতার ধারণা; তাও আবার যেখানে ক্ষমতা মানে কেবল সামরিকতা। কিন্তু ক্ষমতার অর্থ তো দুইটা; সামরিক ক্ষমতা ও সাফাই বয়ান এর(নেরেটিভের) ক্ষমতা। রাষ্ট্রধারণা, জনগণ ক্ষমতার উৎস কেন বা জনপ্রতিনিধির ধারণা ইত্যাদি ব্যাপারে কোনো ধারণাই এদের ছিল না। এর উপর আবার বার্মা [রেস ও এথনিক অর্থে] প্রধান ৯টি জাতে বিভক্ত যাদের অন্তত তিনটি গোষ্ঠী ব্রিটিশ আমলেই স্বায়ত্তশাসন উপভোগ করত। কিন্তু স্বাধীন বার্মার জেনারেলরা প্রথমেই তা কেড়ে নিয়েছিলেন। এখন এসব জাতিগোষ্ঠীকে কিভাবে মোকাবেলা করা হবে এ নিয়েও লাগে নিজেদের মধ্যে দ্বন্দ্ব। এসব জটিলতার সমাধান হবে একমাত্র বল প্রয়োগে তা মনে করে, অং সানের আরেক বন্ধু নেউইন যিনি সামরিক জেনারেল ছিলেন, ১৯৬২ সালে সামরিক বলে ক্ষমতা দখল করার ঘোষণা দেন। অর্থাৎ সিভিল রাজনীতিক বনাম আর্মির ভাগ হয়ে থাকায় একে অপরকে অযোগ্য ব্যাপারটা বুঝে না মনে করা – এরই ভাব ও পরিণতিতে। সেই থেকে দেশের ক্ষমতা আর কখনোই সিভিল রাজনীতিকের হাতে আসেনি। আবার রাষ্ট্র রাজনীতি এই শব্দগুলোই বা কী, রাষ্ট্রগঠন কী জিনিষ তা জীবনেও আর জেনারেলেরা সহ বার্মিজ সমাজের জানা হয় নাই। ঐ “ত্রিশজন বীরের” গর্ব ও আবেগের নিচে সব চাপা পড়ে আটকে যায়। অথচ ঐ ত্রিশজনই ট্রেনিংয়ে রাষ্ট্র রাজনীতি ধারণাগুলোই কখনও শুনে নাই।

তাহলে ২০০৮ সালে কনষ্টিটিউশন লেখার অর্থ তাতপর্য কী?
কথা শুরু করেছিলাম ‘মিয়ানমার কোনো রাষ্ট্র’ নয় বলে। কেন? মিয়ানমার অবশ্যই একটা ‘দেশ’। কিন্তু এই দেশের মালিক যেন একটা ‘ক্লাব’ এবং এটা একটা সামরিক ক্লাব।
একটু বড় সেসব পিছনের গল্প। বার্মা একটা দেশ ওর শাসক আছে কিন্তু তা রাষ্ট্র নয়, মানে জনগণের রাষ্ট্র নয়।  অনবরত যে মূলত বার্মিজ বা বুদ্ধিষ্টদের বাদে অন্যান্য সব জাতিগোষ্ঠির উপর হত্যা নিপীড়ন চালিয়ে যাচ্ছে। এজন্য বার্মার উপর পশ্চিমা দেশের তো বটেই জাতিসংঘেরও অবরোপ করা ছিল সেই আশির দশক থেকে। অর্থাৎ বার্মা ছিল একঘরে। বার্মাকে অস্ত্রবিক্রিও নিষেধ ছিল। কিন্তু চীনের সাথে সীমান্ত আছে বলে অনেকটা চোরাচালানের ছলে বা বেনামে ব্যাপক পণ্যবিনিময় চলত। এটাই তার একমাত্র সীমান্তের বাইরে যাবার উপায় ছিল। চীনের সাথে এই সম্পর্ক আবার চীনের যখন ডাবল ডিজিট উত্থান সে যুগে বার্মার সাথেও বেড়ে উঠেছিল।

সে সময়টা ছিল গ্লোবাল অর্থনীতিতে ২০০৮ সালের মন্দা আসার আগের বছর পর্যন্ত সময়কাল। তাই অর্থনীতি ভাল চলাতে কোন দেশের মাটির নিচের গ্যাস-তেল কে আগে কিনে নিতে বুকিং দিয়ে রাখতে পারে  এর প্রতিযোগিতা ছিল। আমাদের এদিকে চীন ও ভারতের মধ্যে। সেই সুত্রে বার্মার একটা খনির গ্যাস ভারত বুকিং দিতে কথা শুরু করেছিল। কিন্তু শর্ত ছিল  হুইলচার্জ দিয়ে বাংলাদেশের উপর দিয়ে পাইপলাইন বসিয়ে এই গ্যাস নেয়া হবে। কিন্তু বাংলাদেশ এই অনুমতি দিতে সিদ্ধান্ত নিতে দেরি করাতে ইতিমধ্যে প্রতিযোগিতায় চীন ঐ গ্যাস কিনে ফেলার ডিল করে ফেলে। মূলত এরপর থেকে ভারত নতুন এক আইডিয়া নিয়ে একদিকে বার্মা অন্যদিকে মূলত আমেরিকাসহ পশ্চিমাদের সাথে মধ্যস্থতার ভুমিকায় হাজির হয়েছিল। ভারতের মূল পয়েন্ট ছিল অবরোধের সুফল অন্য সবাই বাদ যাচ্ছে, আর একচেটিয়া তা কেবল চীন খাচ্ছে। সুচি তখনও হাউজ এরেস্টে ছিল। তাই নামকা ওয়াস্তে হলেও যদি দেখানো যায় যে বার্মা একটা রাজনৈতিক সংস্কার শুরু করেছে আর তাতে যে মূল ক্ষমতা তা আগের মতই বাহিনীর হাতে রেখে দিয়েও তাঁদেরই অধীনে কেবল সুচিকে কিছু ক্ষমতা দিয়ে তারা “গণতন্ত্র কায়েম” করেছে বলে যদি পশ্চিম সার্টিফিকেট দেয় তবে এই উসিলায় বার্মার সব অবরোধই পশ্চিম ও জাতিসংঘ তুলে নিতে পারে। এবার তখন আর একা চীন না, ভারত ও পশ্চিমারাও বিনিয়োগ পণ্য-পুজি বার্মার বাজারে রপ্তানির ব্যাপক সুযোগ নিতে পারে। তবে এমন এই রফাতেও জেনারেলদের কথিত লোকদেখানো সংস্কার (যেটা রাষ্ট্র সংস্কার নয় মোটেও) করে নির্বাচন দিতেই ২০১০ সাল লেগে গিয়েছিল। আর তখনই কি কি ক্ষমতা জেনারেলেরা সুচিকে দিতে চায় এর হিসাব লিখে রাখতেই কথিত ‘কনষ্টিটিউশন সংস্কার’ করা হয়েছিল। ফলে এই সংস্কারে যে আজকের দশায় পড়বে তা সবাই জানলেও সবাই তা এড়িয়ে বার্মার বাজারে ঢুকতে ঝাপিয়ে পরেছিল। যেমন, বার্মায় মোবাইল ব্যবহারকারি ছিল মাত্র কয়েক পার্সেন্ট, সেটা এখন ৯২% । এভাবে যে যা পেরেছে খাবলে নিয়েছে এতদিন। ওদিকে ২০১০ সালের নির্বাচন এই কনষ্টিটিউশন ২০০৮ এর অধীনেই হয়েছিল। সুচি তখন মুক্ত কিন্তু বুঝাবুঝি অনুসারে নির্বাচনে অংশ নেয় নাই। আর আর্মি একাই অংশ নিয়েছে বেনামে, নিজেরাই একটা দল (ইউনিয়ন সলিডারিটি এন্ড ডেভেলবমেন্ট পার্টি, USDP) খুলে নিয়েছিল। এভাবেই ক্ষমতায় ছিল। আর পরের ২০১৫ সালের নির্বাচনে সু চির দল এনএলডি অংশ নিয়ে প্রধান নির্বাচিত দল হয়। কিন্তু তবু বাহিনী সরকারের উপর নিয়ন্ত্রণ হারায় নাই। কারণ কনষ্টিটিউশনে লেখা আছে সংসদের নিম্ন কক্ষে চার ভাগের এক ভাগ আসন ৪৪০/১১০, আর উচ্চকক্ষের ৩৩% আসন “ডিফেন্স সার্ভিস”কে দিতে হবে।  যেটা আবার সার্ভিস প্রধান ঠিক করে দিবেন কোন অফিসার সংসদ সদস্য হবে। এতেও শেষ হয় নাই। স্বরাষ্ট্র,প্রতিরক্ষা, সীমান্তরক্ষীসহ পাঁচ মন্ত্রীত্ব সেনাবাহিনীকে দিতে হবে আর সার্ভিস প্রধান এই নিয়োগ দিবে। আর সবার উপরে “ডিফেন্স সার্ভিস” প্রধানের থাকবে সবকিছুর উপর এক ভেটো ক্ষমতা।

অর্থাৎ “ডিফেন্স সার্ভিস” এরাই আসলে বার্মা দেশের (সরি, রাষ্ট্র বলতে পারছি না) মূল মালিক, এটা এখানে বুঝা গেল। নাহলে ডিফেন্স চীফ কি করে প্রতিরক্ষামন্ত্রী নিয়োগ দিবেন!

বার্মার কনস্টিটিউশনে ‘ডিফেন্স সার্ভিস’ কারা ও কীভাবেঃ
মিয়ানমারে এখন তৃতীয় কনস্টিটিউশন চলছে। এর সর্বশেষটা রচিত হয়েছিল ২০০৮ সালে।
কনস্টিটিউশন ২০০৮ [এখানে পিডিএফ কপি পাবেন] এর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অংশ হল, এই কনস্টিটিউশনের শুরুতে তৃতীয় পাতায় দ্বিতীয় প্যারাতে যে অনুচ্ছেদ, এর শিরোনাম ‘বেসিক প্রিন্সিপল’ [Basic Principles of the Union, p.3]। এর অনুচ্ছেদে রাষ্ট্রগঠনের উদ্দেশ্য হিসেবে (এ থেকে এফ) এভাবে সাতটি উদ্দেশ্যের কথা বলা হয়েছে। আর এর সর্বশেষ এফ বা সপ্তম উদ্দেশ্যই হলো, হাজার কথার এককথা। সপ্তম উদ্দেশ্য হল, ‘দেশের ডিফেন্স সার্ভিসকে রাষ্ট্রের জাতীয় রাজনৈতিক নেতৃত্বের ভূমিকায় অংশগ্রহণে সক্ষম করা” [Enabling Defence Services to be able to participate in the National Political leadership role of the State]।

বলেছিলাম বার্মা রাষ্ট্র্র নয় একটা দেশ মাত্র। বলেছিলাম, রাজতন্ত্রিক দেশ দেশের ক্ষমতার উৎস জানাতে ব্যর্থ হবেই। অপরদিকে, রিপাবলিক রাষ্ট্র গড়লে বলা সম্ভব, রাষ্ট্রক্ষমতার উৎস জনগণ। সেটা যাই হোক, নির্বাচিতের বেলায় জনপ্রতিনিধি হিসেবে নির্বাচিত রাজনৈতিক নেতা হবেন নির্বাহী প্রধানমন্ত্রী বা প্রেসিডেন্ট। আর তার অধীনে রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলো থাকবে। নির্বাহী প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতার অধীনে থাকবে সামরিক বাহিনীসহ সব প্রতিষ্ঠান। এই হলো রিপাবলিক ক্ষমতার কাঠামোগত বিন্যাস। অথচ কনস্টিটিউশনের সপ্তম উদ্দেশ্য বলছে, ‘দেশের ডিফেন্স সার্ভিসকে রাষ্ট্রের “জাতীয় রাজনৈতিক নেতৃত্বের ভূমিকায় অংশগ্রহণে সক্ষম করা”। অর্থাৎ এই বাক্য অর্থহীন ও স্ববিরোধী। “ডিফেন্স সার্ভিসের সদস্যরা” দেশের ‘রাজনৈতিক নেতা’ হয় কী করে?  আর এটাই নাকি ২০০৮ সালের কনষ্টিটিউশনের উদ্দেশ্য?  কিভাবে?

আবার এই ‘ডিফেন্স সার্ভিস’ বলতে আমাদের মতো রাষ্ট্রকাঠামোর সেনাবাহিনী বলে বুঝা ভুল হবে। কারণ মিয়ানমারের বর্তমান কনস্টিটিউশনের ‘ডিফেন্স সার্ভিস’ বলতে একে সবার উপরের ক্ষমতার এক প্রতিষ্ঠান বলে যদি ধরে নেন তাহলে এরপর এর পুরোটার অর্থ স্পষ্ট হবে। এ জন্যই বলেছি, মিয়ানমারের ‘ডিফেন্স সার্ভিস’ একটা ক্লাবের মত; তবে সামরিক ক্লাব, যে আবার দেশের মালিক। আর ঠিক এ কারণেই মিয়ানমার কোনো রাষ্ট্রের নাম নয়, রাষ্ট্র নয়।

শেষকথাঃ
বার্মায় পশ্চিমাদের ব্যবসা বাগানোর লোভে লোকদেখানো কারবারের নাম ‘গণতন্ত্র’। মানে কথিত যে বার্মার গণতান্ত্রিক সংস্কার’ এতদিন চলতে তা ফেল করল। এটাই ১ ফেব্রুয়ারির তাতপর্য। এর মানে হল ২০১৫ সালের নির্বাচন ছিল “ডিফেন্স সার্ভিস” ক্ষমতায় নিজের নিয়ন্ত্রণ না হারিয়ে সিভিলিয়ানদেরকে কতদুর ক্ষমতার ভাগ দিতে পারে, এরই পরীক্ষা। “ডিফেন্স সার্ভিস” এখন বলল যে সেই পরীক্ষা অচল, অসম্ভব। কারণ এবার ২০২০ সালের নভেম্বর নির্বাচনে সুচির দল আরও বেশি আসন দখল করেছে, প্রায় ৮৩% ভোট। এতে স্বভাবতই সুচি আরও বেশি ক্ষমতার হকদার হয়ে উঠত। তাই এবারের নতুন সংসদ বসার আগেই সিভিল রাজনীতিকদের ক্ষমতা কেড়ে নিয়ে বাড়ি পাঠিয়ে দিল। সুচি গ্রেফতার তো বটেই, দেশের প্রেসিডেন্টও ক্ষমতাচ্যুত ও বন্দি। আর্মি চীফ আরেক সাবেক আর্মি সদস্যকে প্রেসিডেন্ট নিয়োগ দিয়েছেন।

কিন্তু তবু অনেক গণতন্ত্রী বার্মায় সেনাবিরোধী মিছিল সমাবেশ দেখে খুব উতসাহিত হচ্ছেন, আশার আলো দেখছেন। তাদেরকে বার্মার ইতিহাস পড়তে বলব। ঠিক এরকম নির্বাচন অনুষ্ঠান এর আগে ১৯৬০ সালের পর থেকে দুবার ঘটেছিল। দুবারই সিভিলিয়ানেরা প্রবল্ভাবে জিতেছিল। এবং ক্ষমতা পেতে প্রবল সভা সমাবেশ করেছিল। কিন্তু নির্বিচার গুলিতে সবাইকে দমিয়ে ফেলা হয়েছিল আর জীবিতদের বাড়ি পাঠিয়ে দেয়া হয়েছিল। এখনও রাষ্ট্র-রাজনীতি-ক্ষমতা সম্পর্কে না-বুঝ লোকেদের বেলায় ভিন্ন কিছু হবে না। “গণতন্ত্র” দিয়ে রাষ্ট্রগঠন করা যায় না। বিশেষত যেখানে “ডিফেন্স সার্ভিস” নামে সামরিক ক্লাব থাকে।

লেখক : রাজনৈতিক বিশ্লেষক
goutamdas1958@hotmail.com

[এই লেখাটা  গত ১৩ ফেব্রুয়ারি ২০২১, দৈনিক নয়াদিগন্ত পত্রিকার ওয়েবে ও  পরদিন প্রিন্টেও  “মিয়ানমার একটা সামরিক ক্লাব” – এই শিরোনামে  ছাপা হয়েছিল।  এছাড়া  সাপ্তাহিক  “সাম্প্রতিক দেশকাল”  পত্রিকায় ১৬ ফেব্রুয়ারিতে  মিয়ানমারে কোন সামরিক ক্যু হয়নি” এই শিরোনামে আমারই আরেকটা লেখা ছাপা হয়েছিল।    পরবর্তিতে ঐ দুই লেখাকে একসাথে করে এখানে আরও নতুন তথ্যসহ বহু আপডেট করা হয়েছে। ফলে সেটা নতুন করে সংযোজিত ও এডিটেড এক সম্পুর্ণ নতুন ভার্সান হিসাবে ও নতুন শিরোনামে এখানে আজ ছাপা হল। ]

Leave a Reply

Fill in your details below or click an icon to log in:

WordPress.com Logo

You are commenting using your WordPress.com account. Log Out /  Change )

Twitter picture

You are commenting using your Twitter account. Log Out /  Change )

Facebook photo

You are commenting using your Facebook account. Log Out /  Change )

Connecting to %s