আফগানিস্তান নিয়ে ভারত ও পাকিস্তানের আলাদা উদ্যোগ
গৌতম দাস
১৫ নভেম্বর ২০২১, ০০:০৬ সোমবার

Afghans attempting to withdraw money from a bank in Kabul, Afghanistan, where lost income and cash shortages are worsening severe food insecurity, September 21, 2021. © 2021 Haroon Sabawoon/Anadolu Agency via Getty Images
সবার আগের প্রসঙ্গঃ
আফগানিস্তানে এক দুর্ভিক্ষ আসন্ন আর সেইসাথে সেখানকার পাহাড়ি-শীত জেঁকে বসল বলে। এর চেয়েও বড় কথা আফগান অর্থনৈতিক অবস্থা ডুবন্ত। এমনিতেই আফগানিস্তানে ২০ বছরের দখলি শাসন অবসানের পরে একটা নিজ রাজনৈতিক শাসন প্রতিষ্ঠা করা সহজ কাজ নয়। এর উপর তাতে কার্যকর একটা অর্থনৈতিক সিস্টেম আবার খাড়া ও চালু রাখা খুবই কঠিন কাজ। বিশেষত যখন ঐ দেশের অর্থনীতিতে বৈদেশিক মুদ্রাব্যবস্থাটাই অকার্যকর হয়ে আছে। বলা যায় আফগানিস্তান এখনো ‘গ্লোবাল রাজনৈতিক ব্যবস্থার’ সাথে একই বোঝাবুঝিতে নেই, ন্যূনতম কার্যকর রাজনৈতিক সহমত তৈরি নাই বা হচ্ছে না। ফলে বাস্তবত আফগানিস্তান বাইরের গ্লোবাল অর্থনৈতিক সিস্টেম ও গ্লোবাল মুদ্রাব্যবস্থার সাথে সংযুক্ত নয়, বিচ্ছিন্ন। ফলে আফগান অর্থনৈতিক কাঠামোটাই নড়বড়ে, নিজে নিজে কোনো মতে টিকে থাকার চেষ্টা করছে। দুর্ভিক্ষাবস্থার মূল সঙ্কট এখানেই।
এদিকে পাকিস্তানের ‘ডন’ একটি খুবই খারাপ খবর ছেপেছে। জাতিসঙ্ঘের সেক্রেটারি জেনারেলের ডেপুটি মুখপাত্র ফারহান হকের বরাতে পত্রিকাটি লিখেছে, তা অনুবাদ করে লিখছি : ফারহান বলছেন, “মানবিক সাহায্য বিতরণ নিয়ে কাজ করা আমাদের সহকর্মীরা সতর্ক করে জানাচ্ছে যে, আফগানিস্তানের প্রায় দুই কোটি ৩০ লাখ লোক যারা মোট জনসংখ্যার অর্ধেকেরও বেশি (৫৫ শতাংশ), তারা অতি জরুরি পর্যায়ের খাদ্যসঙ্কট ও অনিশ্চয়তার মুখে পড়তে যাচ্ছে। বিশেষ করে চলতি নভেম্বর ২০২১ থেকে মার্চ ২০২২ এই সময়কালটায়” [“Our humanitarian colleagues warn that nearly 23 million people — or 55 per cent of the Afghan population — are estimated to be in crisis or experiencing emergency levels of food insecurity between November 2021 and March 2022,” Mr. Haq said.]।
বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধের পরে, ১৯৭৪ সালের দিকে যাদের বয়স তখনই ১০ বছর বা এর বেশি ছিল তাদের স্মৃতিতে আবছা বা স্পষ্ট থাকার কথা যে, দেশ রাজনৈতিক স্বাধীনতা লাভের পরে খাদ্যসঙ্কট, দুর্ভিক্ষ আর অর্থনৈতিক ব্যবস্থার অকার্যকর হয়ে পড়া বা থাকা ওদেশের মানুষের জন্য কেমন অসহায় অবস্থায় এক চরম সঙ্কট-বিপর্যয় তৈরি করেছে! আজ বাংলাদেশে নিজেরা জীবনমানের দিক থেকে যে উঁচু জায়গাতেই থাকি পুরনো সেই স্মৃতি আমাদের জানান দেয় আফগানিস্তানের সাধারণ মানুষ এখন কী অমানবিক দুর্দশায়! চার দিকে খাদ্যের জন্য লাইন ধরে দাঁড়িয়ে থাকা – মিডিয়ায় শুধু পুরুষ লাইন না, নারীদের লাইনও বলে দেয় তাদের অসহায় অবস্থার কথা!
এদিকে আমেরিকান হিউম্যান রাইটস ওয়াচ মূলত মানবাধিকার ইস্যুতে কাজ করে। গত ১১ নভেম্বর তার রিপোর্টের শিরোনাম ‘আফগানিস্তান দুর্ভিক্ষের মুখোমুখি’ [Afghanistan Facing Famine]। মানুষকে দুর্ভিক্ষের মুখে ফেলা ও রাখা চেয়ে বড় মানবাধিকার ও মর্যাদার সঙ্কট আর কি-ই-বা হতে পারে? তাদের রিপোর্টের সারাংশ করে লিখেছে, ‘জাতিসঙ্ঘ, বিশ্বব্যাংক, আমেরিকার উচিত যা কিছু বাধানিষেধ বা অর্থনীতিক অবরোধ বা পলিসি তারা আফগানিস্তানে আরোপ করতে চায়, তা অবশ্যই যেন বাস্তবতার দিকে তাকিয়ে শিথিল করে নেয়” [UN, World Bank, US Should Adjust Sanctions, Economic Policies]।’
পরের প্রথম বাক্যেই লিখছে, ‘দাতা দেশ, জাতিসঙ্ঘ ও আন্তর্জাতিক ফাইন্যান্সিয়াল প্রতিষ্ঠানগুলোকে আফগানিস্তানের ভেঙে পড়া অর্থনীতি ও ব্যাংকিং ব্যবস্থা ঠেকাতে জরুরিভিত্তিতে দ্রুত পদক্ষেপ নিতে হবে, যাতে তা গড়িয়ে সর্বব্যাপী দুর্ভিক্ষ অবস্থা না তৈরি করে – আজ (১১ নভেম্বর) হিউম্যান রাইট ওয়াচ এ কথা বলেছে।”।
Donor countries, the United Nations, and international financial institutions should urgently address Afghanistan’s collapsed economy and broken banking system to prevent widespread famine, Human Rights Watch said today.
Pakistan hosts US, China, Russia to discuss Afghanistan
আফগানিস্তান নিয়ে দুটা গ্লোবাল উদ্যোগঃ
এ’সপ্তাহে আফগানিস্তান নিয়ে দুটো উদ্যোগ থেকে মিটিং ডাকা হয়েছে। একটার আয়োজক ভারত, অন্যটার পাকিস্তান। এর মধ্যে ভারতেরটাকে বলা যায় ভারত কিভাবে আফগানিস্তানের সাথে যুক্ত হয়ে কাজ সম্পর্ক তৈরি করতে পারে আর পাকিস্তানেরটা হল, আফগানিস্তান কিভাবে গ্লোবাল পলিটিক্যাল সিস্টেমের সাথে খাপ খাইয়ে স্বীকৃতি যোগাড় করে এক সাথে লেনদেন বিনিময় সম্পর্কে যুক্ত হতে পারে তা নিয়ে। এটাই প্রকাশ পেয়েছে কে কোথায় আমন্ত্রিত হয়েছে সেই তালিকায়। যেমন ভারত আফগানিস্তানকে আমন্ত্রণই জানায় নাই, কিন্তু পাকিস্তানের আয়োজনে আফগানিস্তান আমন্ত্রিত।
এছাড়াও ভারতের তালেবানদের আফগানিস্তান নিয়ে সভা ডাকাতে এনিয়ে অনেক পাঠক কৌতুহলি হতে পারেন ঠিক প্রথমত যে আমি ঠিক ভারতই বুঝাতে চেয়েছি কি না। কারণ আমরা জানতাম আমেরিকার বসানো পুতুল – গনি সরকারকে ফিরিয়ে আনা ছাড়া ভারত অন্য কোনো কিছুতে আস্থা রাখে না, এমন ভারতকেই আমরা চিনতাম। হ্যাঁ, তা বটে। কিন্তু ইদানীং তাতে ছোট্ট কিছু মোচড় দেখছি আমরা। তা হলো ভারত হঠাৎ করে জানাল তারা (নাকি আফগানিস্তানকেই দাওয়াত না করে তবে) আফগানিস্তান ইস্যুতে বিভিন্ন দেশের নিরাপত্তা উপদেষ্টাদের নিয়ে এক সভা করতে চায়। এমন ইচ্ছা করাটাই অবশ্য ভারতের ‘গনি সরকার’ ছেড়ে অন্য কিছুর তালাশ করার স্পষ্ট লক্ষণ।। তাই ভারতের দিক থেকে এটা বাস্তবতা স্বীকার করে নেয়া যে, ‘গনি সরকারকে’ ফিরিয়ে আনতে আবদার এটি বাস্তবের মাটিতে পা রেখে দাঁড়ানো কোনো পক্ষের জন্য কোনো অপশনই নয়। তাই বলা যায়, ভারত যে আফগান ইস্যুতে এক দিকভ্রান্ত মুসাফির হয়ে গেছে; যে আবার দিশা খুঁজতে এবার পথে নেমে পড়েছে তা আর লুকানো থাকল না।

আবার আফগানিস্তান ইস্যুতে কিছু করতে বা পেতে চাইলে চীন ও পাকিস্তান যে গুরুত্বপুর্ণ অংশীদার সে কথা আর ভারত অস্বীকার না করে স্বীকার করে নেওয়ার প্রমাণও হাজির রাখল। ভারত পাকিস্তান ও চীনকে তাদের সভায় যোগ দেওয়ার জন্য আমন্ত্রণ জানিয়েছিল। এই আমন্ত্রণে সব চেয়ে বেমানান ঘটনাটা হল, কোন জিনিষ হঠাত করে শুরু হয় না। প্রথমত গত আগষ্টে তালেবানেরা ক্ষমতা দখলের পর থেকেই এটা যে ভারত মানে না সেটা ভারত সবসময় প্রকাশ করে গেছে। যদিও ব্যাপারটা এমন না যে সারা দুনিয়াতেই তালেবানদের ব্যাপারে সব রাষ্ট্রশক্তি একে গ্রহণ করে নিয়েছে। তবে কোন আপত্তি তোলার চেয়ে কি করে খাপ খাইয়ে নেয়া যায় সকলেই এই এপ্রোচ নিয়েই আগিয়ে এসেছে। তালেবানেরা কিভাবে সবার স্বীকৃত আফগান শাসক হয়ে উঠতে পারে এটাই ছিল মুখ্য দিক। তাই ভারতের জন্য এই সভা ডাকা নিয়ে সবচেয়ে যা বেমানান তা হল কেউ উজানে বাইতে বাইতে হঠাত যদি ভাটিতে নেমে যায় তেমন অবস্থা। ভারত প্রতিটা ক্ষেত্রে আফগানিস্তানের জন্য পাকিস্তানকে উঠতে বসতে দায়ী ও খারাপ ভাষা প্রয়োগ করে এসেছে। কথা একটাই বলে এসেছে “পাকিস্তান সব সন্ত্রাসবাদ ঘটাচ্ছে”। এ’অবস্থায় হঠাত করে সেই তালেবানের আফগানিস্তান নিয়ে সম্মেলন ডাকা আর তাতে পাকিস্তানকেই দাওয়াত দেয়া – এটা কেন? সবচেয়ে বড় কথা এটা কেন ভারত কী মূল্যায়ন বদলিয়েছে? তাই ভিন্নভাবে বাস্তবতা দেখছে? এর জবাব হল, না ভারত তা মুখে স্বীকার করে কিছু বলছেনা। তাহলে পাকিস্তান আসবে কেন? এর জবাব ভারতের আছে নাই। ফলে তাই হয়েছে। পাকিস্তানের নিরাপত্তা উপদেষ্টার দাওয়াত প্রত্যাখান নিয়ে ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া দেখা গেছে। পাকিস্তানের নিরাপত্তা উপদেষ্টা মঈদ ইউসুফ-এর ভারতের আহুত সভায় না যাওয়া এবং সাথে ক্ষুবশ প্রতিক্রিয়া দেখান। তিনি বলেন, কোন শান্তি ভন্ডুলকারি আবার নিজেই শান্তিসভার আহবায়ক হতে পারে না ‘A spoiler can’t be a peacemaker’। শুধু তাই না তিনি ভারতের আহুত সভাকে খামোখা [moot] সভা বলে বলেন তিনি কোন খামোখা সভায় যাচ্ছেন না [not attend an upcoming moot]। অন্যদিকে চীনেরও ভারতের সভার যোগদান প্রত্যাখানটা তুলনামূলক নরম বা ঠান্ডা ভাষায়। চীনের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র ব্রিফিংয়ে জানান তারা ঐ সময়ের ব্যস্ততার মধ্যে সময় মিলাতে না পারায় [“scheduling reasons”……”inconvenient” ] যেতে পারছে না তা ভারতকে জানিয়েছে। তবে পাকিস্তানের প্রতিক্রিয়া এত খারাপ হত না হয়ত যদি ভারত আমেরিকা অথবা খোদ রাশিয়াকে দিয়েই পাকিস্তানকে লবি করাতো। অর্থাৎ বলা যায় ভারত ঐ পর্যায়ের সিরিয়াস ছিল না। আবার এমন সিরিয়াস না থাকার পিছনের বড় কারণ খোদ মোদি ও তার হিন্দুত্ববাদ। কারণ ,মোদি তার শাসনের গত প্রায় আট বছর ধরে নিয়মিত পাকিস্তানকে ব্যবহার করে এসেছে তার নির্বাচনে তার বাক্সে হিন্দুভোট যোগাড়ের অপব্যবহারে। সেই পুরাণ ফর্মুলা যে, পাকিস্তান মানে মুসলমান । তাই পাকিস্তান বা মুসলমানের বিরুদ্ধে লড়াকু হিন্দু-বীর হলেন মোদি অতএব সমস্ত হিন্দুভোট মোদির দলের প্রাপ্য। কিন্তু এতে ভারত তো একটা রাষ্ট্র যার অনেক স্বার্থ আছে পাকিস্তানের সাথে একসাথে একমতে কাজ করার। কিন্তু না, সেটা সেকেন্ডারি। হিন্দুত্ববাদের ভোট যোগাড়ই মোদীর প্রধান স্বার্থ হয়ে থেকে গেছে। এবং আগামি অন্তত ২০২৪ মে নির্বাচন পর্যন্ত এটাই থাকবে।
শুধু কি তাই? ভারত কি মনে করে আফগান ইস্যুতে এই সভা-সম্মেলন করে এবার পথে পেয়ে যাবে? এক কথায় উত্তর, একেবারেই না। কিভাবে তা জানা গেল? ভারতের মিডিয়ারই ভারতের এই আফগান ইস্যুতে উদ্যোগ থেকে কোনো ফলাফল আসা নিয়ে আস্থায় নেই। যেমন ধরা যাক, দৈনিক প্রথম আলোর নয়াদিল্লি প্রতিনিধি লিখছেন এভাবেঃ “পাকিস্তান বেঁকে বসেছে। মুখ ফিরিয়েছে চীনও। এখন আফগানিস্তান পরিস্থিতি স্বাভাবিক করতে ভারতের উদ্যোগ কতটা ফলপ্রসূ হবে, তা নিয়ে সন্দেহ জেগেছে। তবু ভারত চেষ্টা ছাড়তে রাজি নয়”। [দেখেন চীন-পাকিস্তানকে ছাড়াই উদ্যোগী ভারত] অর্থাৎ স্পষ্ট করেই নয়াদিল্লি প্রতিনিধি আমাদের বুঝিয়ে দিচ্ছেন, ভারতীয় উদ্যোগের উপর তার কোনো আস্থাই নেই।
কেন ভারতও এমন সম্মেলন করতে গেলঃ
ভারতের এ উদ্যোগে রয়টার্স বলছে দাওয়াত পেয়েছিল ইরান, কাজাখস্তান, রাশিয়া, তাজিকিস্তান, তুর্কমেনিস্তান ও উজবেকিস্তান [India, Iran, Russia, Kazakhstan, Kyrgyzstan, Tajikistan, Turkmenistan and Uzbekistan]। তবে আসলে এখানে ভারতসহ আট রাষ্ট্রকে দেখা গেলেও এতে মূল গুরুত্ব ইরান ও রাশিয়ার। এ দুটোর মধ্যে আবারও মূল ওজনটা একমাত্র রাশিয়ার; যদিও ভারত এই সম্মেলনের শিরোনাম দিয়েছে এভাবে : ‘দ্যা দিল্লি রিজিওনাল সিকিউরিটি ডায়লগ অন আফগানিস্তান…’ [Delhi Regional Security Dialogue on Afghanistan…… ]।
কিছু কথা এখানে খুলে বলাই ভাল, বুঝতে সুবিধা হবে তাতে। যেমন গত আগস্ট থেকে আফগানিস্তান ইস্যু ভারতের কেন ‘ঘুম হারাম’ হয়েছে সে কথা কাউকে সে খুলে বলতে পারছে না। প্রধানত ঘুম হারাম ঘটনাটা হল কাশ্মিরকে নিয়ে; অর্থাৎ কাশ্মিরের ভবিষ্যৎ বা তা হাত ছাড়া হয়ে যায় কি না! কেন?
কারণ মোদি-অমিত খুবই ভীত এ জন্য যে, ২০১৯ সালের ৫ আগস্ট তারা একেবারেই গায়ের জোরে কাশ্মির (পুরোটাই মানে, শুধু ভারতের দখলে থাকা অংশ না – পাকিস্তান ও চীনের দখলে থাকা অংশসহ) ভারতের স্বাভাবিক অঙ্গ-ভূখণ্ড বলে সংসদে ঘোষণা করেছিলেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ। এখানে “গায়ের জোরে” বললাম অনেক কারণে। প্রথমত, নেহরু জানতেন কাশ্মির ভারতের নয়; তাই তো জাতিসঙ্ঘের কাছে তিনি চিঠি লিখে মতামত চাইলে জাতিসঙ্ঘ গণভোট আয়োজন করে সিদ্ধান্ত নিতে ফয়সালা দিয়েছিল। এটাই “নেহরু জানতেন” একথার সবচেয়ে বড় প্রমাণ। কিন্তু ভারত জাতিসংঘের রায় কখনোই অনুসরণ করেনি। তবে একেবারেই কোনো পদক্ষেপ না নেয়াটা সরাসরি জাতিসংঘ অমান্য করা হয় – সম্ভবত এমন অনুমানে তিনি কিছু “বিশেষ শর্তে” (যেমন ভারতের মূল ভূখণ্ডের কেউ কাশ্মিরে জমি কিনতে পারবে না ইত্যাদি) কাশ্মিরকে ভারতভুক্ত করে নেন। আর সেসব “বিশেষ শর্ত” সেটাই হল – ভারতের কনস্টিটিউশনের ৩৭০ ও ৩৫এ ধারা। আর গত ২০১৮ সালেও ভারতের সুপ্রিম কোর্টে বিজেপি সমর্থক এক ব্যক্তি মামলা করেছিলেন ৩৭০ ধারা বাতিল করে রায় দিতে; তা এই যুক্তিতে যে সেসময় “ভারতের মূল কনস্টিটিউশন প্রণয়ন কমিটি” ৩৭০ ধারা যুক্ত করেছিলেন একে ‘অস্থায়ী’ বলে উল্লেখ করে। কিন্তু পরবর্তিতে এ নিয়ে আর কোনো কাজ না করেই ওই প্রণয়ন কমিটি তার আয়ু শেষ, তাই ‘বিলীন’ (ডিসল্ভ) বলে ঘোষণা করে দেয়া হয়। অতএব কোর্ট এখন ৩৭০ ধারাকে বাতিল ঘোষণা করুক – এই ছিল আর্জি। কিন্তু কোর্ট রায় দেন, এমন করা যাবে না। কারণ এমনটা করা হলে আইনিভাবে কাশ্মির আর ভারতের অংশ থাকবে না। তাই আদালত ওই রিট আবেদন বাতিল করে রায় দিয়েছিলেন।
এর অর্থ ২০১৯ সালের ৫ আগস্ট অমিত শাহের ৩৭০ ধারা বাতিল ঘোষণা এক অবৈধ কাজ। কিন্তু যেহেতু কেউ এখনো এ ব্যাপারটা আদালতের দৃষ্টিতে আনেনি, তাই এটা অটুট থেকে যাচ্ছে।
আবার সুপ্রিম কোর্টের ওই রিট মামলার রায়ে দেখা যাচ্ছে সেখানেও আসলে পরোক্ষে ধরে নিয়ে রায় দেয়া হয়েছে যে, কাশ্মির ভারতের নিজ মূল ভূখণ্ড নয়। তা হলে অমিত শাহের ৩৭০ ধারা বাতিল ঘোষণা এবং কাশ্মিরকে সরাসরি ভারতের নিজভূমি বলে দখল করে নেয়া – এটাও তো অবৈধ। কিন্তু এটাও আদালতের দৃষ্টিতে কেউ আনেনি, তাই এটাও কোন চ্যালেঞ্জ এড়িয়ে টিকে আছে। এ ছাড়া মোদির জমানায় আদালতের ট্রেন্ড হল, সরাসরি প্রধানমন্ত্রীর বিরোধিতা করতে হয় এমন ইস্যু হলে আদালতের ঐ মামলা এড়িয়ে চলা বা বছরের পর বছর ফেলে রাখা অথবা কোনো একবারের প্রধান বিচারপতি আন্ডারহ্যান্ড ডিলের অভিযোগ মাথায় নিয়েও সরকারের পক্ষে রায় দিয়ে দেয়ার ঘটনা অনেক। এসবই মামলা না হওয়া অথবা আদালতের দ্বারস্ত না হওয়া বা জনস্বার্থের মামলাগুলো করার মত লোক গরহাজিরা পিছনের কারণ মনে করা হয়।
এভাবেই মোদি-অমিত তাদের রামরাজত্বের হিন্দুত্বের শাসন চালিয়ে যেতে পারবেন মনে করা হয়েছি। কিন্তু না! উপরে উল্লেখিত এসব ‘গায়ের জোরের’ মতো হঠকারি কাজ – আফগানিস্তানে তালেবান ক্ষমতায় আসার পরে থমকে যায় আর মোদি-অমিতও চমকে ওঠেন। কারণ এর সরাসরি প্রভাব কাশ্মিরে জমানো রামরাজত্বের উপর পড়বেই। এর প্রভাবে আজকের কাশ্মিরে (যেখানে মানুষের কোনো প্রতিনিধিত্ব নেই, প্এরতিনিধিত্টিবশীল শাসন নাই, এখন রাজ্যের মর্যাদায় নেই, রাজনৈতিক মতামত প্রকাশের কোনোই আইনি ব্যবস্থা বা কাঠামোই, [ রাজ্য সরকার] নাই)। একারণে এবার যদি আবার সশস্ত্র আন্দোলন চাঙ্গা হয়, কি তুঙ্গে ওঠে আর যদি ভারত থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়ার মত পরিস্থিতি এসে যায়; তবে সারা ভারতের হিন্দুত্ববাদীরাই ফিরে মোদি-অমিতের চরম বিরুদ্ধে চলে যাবে এই বলে যে, “গায়ের জোরে কাশ্মির ভারতের বলে দখল, ৩৭০ ধারা বাতিল’ করতে যাওয়াতেই এই বিপর্যয়! অর্থাৎ হিন্দুত্ববাদ ব্যাকফায়ার শুরু করবে!
মূলত একারণেই মোদি-অমিত এখন চান যেই আফগানিস্তানে ক্ষমতায় আসুক সে যেন প্রতিশ্রুতি দেয় যে কাশ্মিরে স্বাধীনতাকামী কাউকে আফগান-সহযোগিতা দেওয়া হবে না। মজার কথা হল, মোদি-অমিতের কাছে এই ঘোরতর মাথাব্যথার ইস্যু কাশ্মির অথচ, এনিয়ে বাইডেন প্রশাসন অন্তত কোনো সমর্থনের অবস্থানে নেই; বরং উল্টো ভারতের বিরুদ্ধে কাশ্মিরে মানবাধিকার লঙ্ঘনের ইস্যু আমেরিকার অভিযোগের তালিকায় আছে। কিছু কংগ্রেস সদস্যও এ নিয়ে সোচ্চার।
রাশিয়া কেনঃ
তাহলে দেখা যাচ্ছে এখন সব মিলিয়ে ভারতের কাছে একমাত্র ভরসা মুরুব্বি রাশিয়া! কিন্তু সে কেন ভারতকে এই কোল দিতে গেল যাতে ভারত একটি সম্মেলন ডাকতে পারে?
তালেবানরা এবার গত আগষ্টে ক্ষমতায় আসার পর থেকেই রাশিয়া মূলত খুবই খুশি। তার অনুমান, এবার দিন তার পক্ষে এসেছে ও যাবে; আর আমেরিকার বিপক্ষে। কিন্তু একই রাশিয়ারই আবার এক প্রবল শঙ্কা; কারণ সে আবার সেন্ট্রাল এশিয়ার ছয় রাষ্ট্রের কাছে (এরই চার রাষ্ট্র ভারতের সম্মেলনে যোগ দিয়েছে) প্রতিশ্রুতিবদ্ধ যে রেডিক্যাল ইসলাম বা আইএস টাইপের সশস্ত্র আন্দোলন বা তাদের হবু আক্রমণ থেকে এই রাষ্ট্রদেরকে সুরক্ষিত রাখবে। আর একাজে আবার রাশিয়া তালেবানদের ওপর নির্ভর করতে হবে, বিকল্প নাই। ফলে টেনশন আছে।
এসব কিছু অবশ্যই রাশিয়ার বড় স্বার্থ। কিন্তু এসব ছাড়াও রাশিয়ার আরেক বড় স্বার্থ আছে। যেমন সেটি হল, রাশিয়ান এস-৪০০ মিসাইলের হবু ক্রেতা ভারত; যার একটার দামই আধা বিলিয়ন ডলার। এছাড়া আরও কাহিনী হল – ভারত এটা কিনলে আমেরিকা ক্ষেপে গিয়ে ভারতের ওপর অর্থনৈতিক অবরোধসহ বহু ধরনের বাধা আরোপ করবে, তা আনুষ্ঠানিকভাবে আগেই জানানো হয়ে আছে, বাইডেন ক্ষমতা নিবার পরের মাসেও বাইডেনের প্রতিরক্ষামন্ত্রীর সফরে তা ভারতকে জানানো হয়ে আছে। তাই ভারত চেষ্টা-তালাশ করছে কোনো ছাড় পাওয়া যায় কি না। কিন্তু ইতোমধ্যেই উদাহরণ হল, একই পথে তুরস্কের বেলায় সে ব্যর্থ হয়ে আছে। এসব কারণে, রাশিয়ার আগ্রহ হল, ভারতকে কিনাতে পারলে তা আমেরিকার উপর একটা বড় চাপ তৈরি হবে।
তাই এসব মিলিয়ে অনুমান করা যায় রাশিয়ার হবু ক্রেতা ও আগে অন্য অনেক সমরাস্ত্রের এরই মধ্যে ভালো ক্রেতা এই ভারতের ‘মন রক্ষা’ করতে রাশিয়া সেন্ট্রাল এশিয়ার চার রাষ্ট্র সাথে নিয়ে ভারতের সম্মেলনে যোগ দিতে সম্মত হয়েছে। তবে সেন্ট্রাল এশিয়ার চার রাষ্ট্র – এদের দিক থেকে দেখলে তাদের নিজস্ব বড় স্বার্থও এটা যে, তারা তালেবানদের ভরসা করেই যেকোনো রেডিক্যাল ইসলাম থেকে সুরক্ষিত থাকতে চায়। এটি তাদের ভাইটাল স্বার্থ!
তা হলে ইরান কেন?
ইরান ভারতের সম্মেলনে কেন – এটাও এক মজার প্রশ্ন। তবে জবাবটা সহজেই এভাবে বলা যায় যে, সম্প্রতি আফগানিস্তানে শিয়া মসজিদে হামলা পরপর সম্ভবত তিনবার বোমা হামলার ঘটনা ঘটেছে। আর প্রতিবারই দেড় শতাধিকের উপর লোক মারা গেছে। এটা শুধু শিয়া মসজিদে হামলা – এতটুকুতে সীমাবদ্ধ থেকে দেখাভুল হবে, এটা তা না; এরা ছিল মূলত আফগানি হাজারা শিয়া এথনিক গোষ্ঠি – তাদের উপর হামলা।
ওরা শিয়া এই সেন্টিমেন্টের ওপর ভর করে এ হামলা করা ও তাতানো হয়েছে। কিন্তু এরা মূলত আফগানিস্তানের তৃতীয় বৃহত্তম এথনিক জনগোষ্ঠী। আমাদের মত দেশগুলোর ভূখণ্ডের সীমানা টেনেছে কলোনিয়াল শক্তিগুলো তাদের নিজের একান্ত স্বার্থে। আর এতে একই এথনিক জনগোষ্ঠী কাটা পড়ে সীমানা দুই দেশে বিভক্ত করা হয়ে গেছে। যেমন আমাদের বেলায় একই বাঙালি অথবা পাঞ্জাবি এথনিক জনগোষ্ঠী যেমন ভারতে থেকে গেছে; যাদের আরেক অংশ বাংলাদেশে বা পাকিস্তানে আলাদা কাটা পরে আছে। তেমনি আফগান হাজারা জনগোষ্ঠী আরেক বড় অংশ আছে ইরানে। ফলে আফগানিস্তানের অংশ হামলায় বিপদগ্রস্ত হলে ইরানের বড় দুটো সমস্যা। স্বাভাবিকভাবে ইরানে সেন্টিমেন্ট তৈরি হয় হাজেরা আফগানদেরকে উদ্ধার ও রক্ষার। আবার আরেক বিপদ হলো, ইরান না চাইলেও তারা রিফুজি হিসেবে ইরানে ভিড় করে, করবেই – এটাই স্বাভাবিক। আর ইরান সেই দায় ঠেলে ফেলেও দিতে পারে না।
কাজেই তালেবানরা যদি হাজারা, এরা শিয়া (ওরা কম মুসলমান বা সহি মুসলমান না ইত্যাদি ধরনের যেসব এথনিক ঘৃণা আফগান পশতুন ডমিনেটেড সমাজে প্রচলিত আছে) এই ধর্মীয়-সামাজিক মনোভাবের আলোকে উপেক্ষায় আইএসের হাতে হামলায় মারা যেতে দেয়, নাগরিক নিরাপত্তা না দিতে পারে তা হলে গত আগস্টে তালেবানরা ক্ষমতায় আসার পর থেকে ইরান সরকারের যে সমর্থন ও ইতিবাচক মনোভাব তালেবানদের প্রতি বজায় আছে তা ইরান চাইলেও আর বজায় রাখতে পারবে না। যেমন আফগানিস্তানের প্রয়োজনীয় তেল সরবরাহ এখনো ইরান করছে; যেখানে এর অর্থ পরিশোধের কী ব্যবস্থা হবে, সেটা এখনো অনিশ্চিত, তা সত্বেও। কারণ, তালেবানদের হাতে কোন বৈদেশিক মুদ্রার মজুদ নাই, ব্যবস্থা নাই।
অতএব ইরানের ভারতের সম্মেলনে যোগ দেয়া বলতে গেলে তালেবানদের ওপর অপ্রকাশ্য অসন্তুষ্টির পরোক্ষ প্রকাশ বা বলা যায় তা প্রকাশ করার সুযোগ নেয়াঃ যেন তালেবানদেরকে বলা যে, তুমি আফগান হাজেরাদের উপর আইএস ধরনের রেডিক্যাল ইসলামিস্টদের যদি আফগানিস্তান থেকে দূরে রাখতে না পারো, তবে ইরানের তোমার বিপরীতে যাওয়া ছাড়া পথ নেই।’
তাহলে এখন উলটা করে বলা যাকঃ এর মানে কি যারা আইএস ধরনের রেডিক্যাল ইসলামীদের থেকে মুক্ত এক আফগানিস্তান দেখতে চায়; তাদের সম্মেলন ছিল ভারতেরটা? ভাবটার একটা আবছা শেড থাকলেও সেটা কখনও নয়, সত্যিকারভাবে নয়। যেমন আইএস ধরনের রেডিক্যাল ইসলামী সশস্ত্র গ্রুপ – এই হলো অ্যালার্জি বা অগ্রহণযোগ্যতার মাপকাঠি যদি ধরি, তা হলে কি বলা যাবে এমন গ্রুপের বিরোধীদের সম্মেলন ছিল ভারতেরটা? এটি বলা যাবে না। কেন?
কারণ বাইরে থেকে মনে হতে পারে, হিন্দুত্ববাদী ভারত নিশ্চয় এমন রেডিক্যাল ইসলামী সশস্ত্র গ্রুপদের বিরোধিতা পছন্দ করবে। কিন্তু না, করবে না। কেন? আর প্রমাণ কী?
ইদানীং পাকিস্তানের ইমরান খান কী নিয়ে পেরেশান সেটা লক্ষ্য করতে হবে। দুটা ইসলামী গ্রুপ নিয়ে তিনি পেরেশান – TTP (তেহরিক-ই-তালেবান পাকিস্তান) আর TLP (তেহরিক-ই-লাব্বায়েক পাকিস্তান)। আধা সশস্ত্র এরা আবার রাজধানীতে প্রকাশ্যে রেডিক্যাল মিছিল সমাবেশ করে থাকে। টিএলপির প্রধান আবার এখন গ্রেফতার হয়ে আছেন। এমনকি সুপ্রিম কোর্টও প্রধানমন্ত্রী ইমরানকে সমন জারি করে ডেকে অসন্তুষ্ট জানিয়েছেন। কারণ, ২০১৪ সালে পেশোয়ারের এক আর্মি স্কুলে টিটিপির অস্ত্রধারী জঙ্গিরা হামলা চালালে ১৩২ শিশুসহ মোট ১৪৭ জনের প্রাণহানি ঘটেছিল। এরই বিচার এখনও চলছে। তাই আদালত প্রধানমন্ত্রী ইমরানকে সরাসরি আদালতে দেকে নিয়ে এসে ভর্ৎসনা করেছেন। তাই এবারের ইস্যুতে এদের বিরুদ্ধে সামরিক পদক্ষেপ নিতে প্রধানমন্ত্রী আভ্যন্তরীণভাবে অবস্থান জানিয়েছিলেন। কিন্তু সেনাবাহিনীর ভিন্নমত হল তারা মনে করে এতে জীবন ও সম্পদ ক্ষয় হবে মাত্রাতিরিক্ত। তাই কৌশল হিসেবে এখনই সামরিক পদক্ষেপ বাতিল করা হয়েছে, আর সুযোগের অপেক্ষায়।
মজার কথা, এ খবর আরো বিস্তারিত ছাপা হয়েছে পাকিস্তানের ‘ডন’ পত্রিকা। আর যা খুবই কম ঘটে থাকে – আমাদের অবাক করে প্রথম আলো এসব খবর ছেপে দিয়েছে ডন-এর রেফারেন্সে, বিনা দ্বিধায়।
কিন্তু কেন ‘মজার খবর’ বলছি? ডন-এর খবরে লেখা হয়েছে, সশস্ত্র গ্রুপগুলো ভারতের সাথে সম্পর্কিত। প্রথম আলোর এই রিপোর্টের শিরোনাম টিএলপির সঙ্গে চুক্তি প্রকাশ হচ্ছে, শক্তি প্রয়োগ চেয়েছিলেন ইমরান, নারাজ সেনাবাহিনী। প্রথম আলো ডন-এর রিপোর্ট থেকে অনুবাদ করে লিখেছে, ”
প্রথম আলো লিখেছে “পাকিস্তানের মতে আফগানিস্তানভিত্তিক টিটিপির অন্যতম প্রধান সমর্থক ও অর্থদাতা ভারত। পাকিস্তানে সন্ত্রাসী হামলা চালাতে নিষিদ্ধ গোষ্ঠীটিকে অর্থ ও অস্ত্র দিয়ে সহায়তা করে আসছে দেশটি”।
“পাকিস্তানের মতে আফগানিস্তানভিত্তিক টিটিপির অন্যতম প্রধান সমর্থক ও অর্থদাতা ভারত। পাকিস্তানে সন্ত্রাসী হামলা চালাতে নিষিদ্ধ গোষ্ঠীটিকে অর্থ ও অস্ত্র দিয়ে সহায়তা করে আসছে দেশটি।’ এ ধরনের পাকিস্তান সরকারের পুরো মনোভাব ও পরিকল্পনাই ওই রিপোর্টে আছে। কিন্তু আমাদের এখানকার জন্য এটুকুই যথেষ্ট যে, মোদি-অমিতের কাশ্মির বাঁচাতে তারা পাকিস্তানের অভ্যন্তর অস্থিতিশীল করতে সশস্ত্র ইসলামী গ্রুপের ওপর নির্ভর করতেও রাজি; অর্থাৎ যে অভিযোগ আগে কেবল বেলুচ বিচ্ছিন্নতাবাদী গোষ্ঠীর মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকত অথবা একালে উইঘুর সশস্ত্র গোষ্ঠী (ETIM)-এর কথা উঠছে; এখন তা অনেক দূরে বিস্তৃত। এখানে উল্লেখ্য যে, হাজারাদের ওপর আইএসের যে তিন হামলা, তাতে সর্বশেষটাতে হামলাকারী হিসেবে ধৃত ব্যক্তি উইঘুর জনগোষ্ঠীর লোক। কেন এমন হচ্ছে? কারণ তালেবানরা এই ETIM গ্রুপকে আফগানিস্তানে আশ্রয় দেবে না বলে চীনের পররাষ্ট্রমন্ত্রীকে প্রতিশ্রুতি দেয়ার পর থেকে এই উইঘুর গ্রুপ আইএস এর সাথে হাত মিলিয়ে যোগ দিয়েছে, তাই এ ঘটনা।
বিপরীতে পাকিস্তানের আয়োজিত সম্মেলন কী ও কাদের নিয়েঃ
এক কথায় জবাব, যদিও এ সম্মেলনের হোস্ট বা আয়োজক হল পাকিস্তান কিন্তু এটা আসলে ‘ট্রয়কা প্লাস’ [TROIKA+] -এর বৈঠক। [এনিয়ে আমার পুরান লেখা রাশিয়ান ট্রয়কা ভারত নয়, পাকিস্তানকে নিয়েছে] কোন ‘ট্রয়কা প্লাস’? গত ১৫ আগস্ট তালেবানরা ক্ষমতা নেয়ার আগে রাশিয়ার উদ্যোগে রাশিয়া, আমেরিকা ও চীনকে এই শক্তিধর তিন দেশীয় গঠন করা হয়েছিল তালেবান-আফগান ইস্যুতে তাদের কমন অবস্থান প্রকাশের জোট, সেটাই ট্রয়কা বা ত্রিদেশীয় জোট। এর প্রধান উদ্দেশ্য ছিল তালেবানদেরকে প্রচলিত আন্তর্জাতিক আইন ও নিয়মের অধীনে আসতে সাহায্য করা যাতে তারা নয়া আফগানিস্তানকে নিয়ে গ্লোবাল রাজনৈতিক সিস্টেমে সহজেই প্রবেশ করতে পারে।
আসলে নিরাপত্তা পরিষদের আফগান ইস্যুতে পাস হওয়া এক সর্বসম্মত প্রস্তাবকে তাদের গঠনভিত্তি হিসেবে নিয়ে গঠিত হয়েছিল। পরে পাকিস্তানকে ওই ট্রয়কাতে কোঅপ্ট করে নেয়া হয়; কারণ আফগানিস্তানে কোনো কিছু বাস্তবায়ন করতে গেলে পাকিস্তানের মাধ্যমে তা করা অর্থপূর্ণ ও সহজ। অন্তত দুটো কারণে – এক. পাকিস্তান এই প্রথম ২০ বছরের আমেরিকার স্বার্থের যুদ্ধের দায় থেকে মুক্ত হয়েছে। তারপরও এখনো আফগানিস্তানে যেকোন অস্থিতিশীলতা ঘটলে তাতে সবচেয়ে বেশি পুরনো দায় ফিরে আসবে পাকিস্তানের উপর, নিজে সেই অস্থিতিশীলতায় আক্রান্ত হবে ও সামরিক-অর্থনৈতিকভাবে ক্ষতি হবে পাকিস্তানের। তাই পাকিস্তান না চাইলেও ‘স্থিতিশীল এক আফগান দেখার পক্ষে অবস্থান’ সে নিতে বাধ্য। দুই. আফগানিস্তান কিন্তু এক ল্যান্ডলকড ভূখণ্ড। ফলে পাকিস্তানের সাথে ন্যূনতম একটি তাল মিলিয়ে চলতে আফগানিস্তানও বাধ্য। এবং বাইরের কোন রাষ্ট্রও আফগানিস্তানে কিছু করতে চাইলে পাকিস্তানকে সাথে নিয়ে করলে তা বাস্তবায়ন সহজ ও সম্ভবত সম্ভব।
অতএব পাকিস্তানকে গ্রুপে নেয়ায় এর নাম হয়ে যায় ‘ট্রয়কা প্লাস’। আর এতে ভারতের জন্য তা এটা ততোধিক বিব্রতকর হয়ে যায়; কারণ এতে ভারতের অভ্যন্তরীণ পাবলিকের কাছে হিন্দুত্ববাদীরা যে প্রপাগান্ডা চালাত এই বলে যে পাকিস্তান সন্ত্রাসবাদ লালনকারী, তা এখানে উল্টে যায়। কারণ, এখানে পাকিস্তান হইয়ে যায় বাস্তবত – জাতিসঙ্ঘের প্রস্তাব বাস্তবায়নে সন্ত্রাসবিরোধী সবচেয়ে নির্ভরশীল মিত্র, বিশেষ করে এখনকার সময়ের সবচেয়ে শক্তিধর তিন দেশ ও তাদের জোটের নির্ভরশীল মিত্র।
এবার সবচেয়ে কঠিন সত্যটা আগে বলে রাখি। তা হলো আফগানিস্তানে তালেবানরা ফেল করলে এর বিকল্প বা অন্য শক্তিটা হল এককথায় আইএস। মূলত আইএস আর সাথে ওর সমমনা আরো ছোট ছোট নানা, মূলত ‘পড়শিদেশীয়’ গ্রুপ। সবচেয়ে বড় অস্বস্তিকর বাস্তবতা হল, যেকোনো পশ্চিমা রাষ্ট্রশক্তি তো বটেই, এমনকি এশিয়া অমুসলিম রাষ্ট্রগুলো তো বটেই, এদের কেউই বা অন্য ইসলামী ধারা কেউই আইএসের সাথে পাশাপাশি পরস্পরকে স্বীকার করে টিকতে বা চলতে পারবে না, তা আইএস তো বটেই কেউই মনে করে না। অর্থাৎ একা আইএস-এর রাজত্ব কায়েম হব। ফলে তালেবানরা ফেল করার মানে সবার কাছেই পরিষ্কার।
তাই তালেবানকেন্দ্রিক এখনকার বাস্তবতা হল, সংশ্লিষ্ট অন্য দেশের এক কমন আকাঙ্ক্ষা যে, তালেবানরা ফেল করা নয় বা আইএস আসা একেবারেই নয়। তাই তালেবানদের ফেল করতে দেয়া যাবে না। এতে সবার ক্ষতি। কিন্তু জাতিসঙ্ঘকেন্দ্রিক যে গ্লোবাল রাজনৈতিক ব্যবস্থা আছে, তার ভিত্তিতে তালেবানরা আফগানিস্তান শাসক হিসেবে নিজেদের গড়ে নিক। আর সেই আফগানিস্তান যেন পড়শি যেকোনো দেশে সশস্ত্র হামলাকারী কোনো গোষ্ঠীকে আশ্রয়দানকারী ভূখণ্ড না হয়, এটি নিশ্চিত করতে হবে।
এটি বাস্তবায়নে তাহলে সমস্যাটা কোথায়?
অনেকে মনে করেন, তালেবানরা ভাবছে যেহেতু আফগানিস্তান যেন রেডিক্যাল ইসলাম বা আইএস টাইপের সশস্ত্র আন্দোলন বা আক্রমণকারীদের আশ্রয়ভূমি না হয় এটা নিশ্চিত করা প্রায় সারা দুনিয়ার সকল রাষ্ট্রস্বার্থ। কাজেই তালেবানরা রাজনৈতিকভাবে কেমন শক্তি (আরেকটি আইএস কি না বা রাজতন্ত্র যেমন এক সালতানাত বা আমিরের দেশ কি না) তা দেখাদেখি ট্রয়কাকে বিবেচনা বন্ধ করতে হবে বা ছাড় দিতে হবে।
অথবা আফগানিস্তানেও দুর্ভিক্ষ লেগে যেতে পারে এই ভয়ে ট্রয়কাসহ সবাই তালেবানরা যেমন আছে এভাবেই মেনে নিতে বাধ্য হতে হবে।
তালেবানদের নিজের সম্পর্কে এই অতি-অনুমান যে তারাই হলো দুনিয়াকে স্থিতিশীল রাখার একমাত্র শক্তি – এটিই তালেবানদের সব কিছুকে স্থবির করে রেখেছে।
ট্রয়কা উদ্যোগ ফেল করলে এর প্রথম শিকার হয়ে যাবে আফগানিস্তানের খাদ্যসঙ্কটে থাকা ৫৫ শতাংশ জনগণ।
দ্বিতীয় সত্য হল, ট্রয়কার তালেবানের সাথে কোনো ছাড় দেয়া যদি ঘটেও সেই তালেবান শক্তির শাসনও ফেল করবেই। ফলাফল হবে আইএস ও সমমনাদের উত্থান। সেই আফগানিস্তান হবে আফ্রিকার সোমালিয়ার চেয়ে ভয়ঙ্কর কোনো ভূখণ্ড। সারা দুনিয়ার জন্য এক নো গো [no go] এরিয়া!
লেখক : রাজনৈতিক বিশ্লেষক
goutamdas1958@hotmail.com
[এই লেখাটা গত ১৩ নভেম্বর ২০২১, দৈনিক নয়াদিগন্ত পত্রিকার ওয়েবে ও পরদিন প্রিন্টে “আফগানিস্তান : ভারত ও পাকিস্তানের উদ্যোগ “– এই শিরোনামে ছাপা হয়েছিল।
নয়াদিগন্তে ছাপা হওয়া লেখাগুলোকে আমার লেখার ‘ফার্স্ট ড্রাফট’ বলা যায়। আর আমার এই নিজস্ব সাইটের লেখাটাকে সেকেন্ড ভার্সান হিসাবে এবং থিতু ভাষ্য বলে পাঠক গণ্য করতে পারেন। পরবর্তিতে ‘ফার্স্ট ড্রাফট’ লেখাটাকেই এখানে আরও অনেক নতুন তথ্যসহ বহু আপডেট করা হয়েছে। ফলে সেটা নতুন করে সংযোজিত ও এডিটেড এক সম্পুর্ণ নতুন ভার্সান হিসাবে ও নতুন শিরোনামে এখানে আজ ছাপা হল। ]