ভারত কী কোন নয়া সিদ্ধান্ত নিয়েছে?
গৌতম দাস
০৪ জুন ২০২৩ ০০ঃ ০৪
https://wp.me/p1sCvy-4yT
দেড় দশকে দেশ আরও সাম্প্রদায়িক হয়েছে – প্রথম আলো
অবস্থা দেখে মনে হচ্ছে ভারত হাসিনা-বিরুদ্ধ-ততপরতায় নেমে পড়েছে, অবস্থান নিয়েছে। কিছু জায়গায় তো একেবারে প্রকাশ্যে, দেখিয়েই তা করতে শুরু করেছে।
ভারতের মোদি সরকার বিশেষত তার গোয়েন্দা বিভাগ বাংলাদেশে হাসিনা সরকার আর টিকছে না যেন তা ধরে নিয়ে কাজকাম শুরু করে দিয়েছে। তাদের সকল ততপরতা এখন এমন হাসিনাবিরোধীতাকে টার্গেট করে যে বাংলাদেশে হিন্দু নির্যাতনের জন্য তারা এখন ঝেঁড়ে কেশে হাসিনাকেই দায়ী করে বাইডেনের কাছে নালিশ দিয়েছে ও একশন দাবি করেছে। সেই চিঠির ইংরাজি পিডিএফ কপি এখানে। আর এর এক উল্লেখযোগ্য প্যারাগ্রাফ অংশ বাংলা করে দিচ্ছি নিচে।
” যখন থেকে শেখ হাসিনা ক্ষমতায় তখন থেকে আজ অবদি বাংলাদেশের হিন্দু জনসংখ্যা অর্ধেক হয়ে গেছে। বাড়িঘর পুড়ানো, লুট করা, মন্দির ধবংস করা ও প্রতিমা ভাঙচুর, খুন রেপ আর বাধ্য করে ধর্মান্তরকরণ ইত্যাদিতে সবকিছুরই পরিণতি হয়েছে যে হিন্দুরা ভারতে পালায়ে গেছে। শেখ হাসিনা সরকার বাংলাদেশের খৃশ্চান জনগোষ্ঠিকেই নিপীড়ন-নির্যাতন করেছে; তাদের তাদের উপাসনালয় জ্বালিয়ে দেয়া লুট করা, পাস্টার-পাদ্রীকে জেলে নেওয়া আর ধর্মান্তকরণ এর সময় পরিবার তছনছ করে দেয়া ইত্যাদি সবই ঘটেছে”।
চিঠির যে অংশটার বাংলা অনুবাদ এটা নিচে সেটারই ইংরাজিটা,
“Since Sheikh Hasina’s rise to power, the Hindu population has been halved. Looting and burning of households, destruction of temples and religious idols, murder, rape, and forced religious conversion are causing Hindus to flee Bangladesh. Sheikh Hasina’s government also has persecuted Bangladesh’s minority Christian population — burning and looting places of worship, jailing pastors, and breaking up families when religious conversion occurs”.
আসলে ভারতীয় প্ররোচনায় ড্রাফট করা আর কংগ্রেসম্যানদের দিয়ে সে অভিযোগ তোলার সময়ে হাসিনার বিরুদ্ধে বিরোধীদলের কর্মীদেরকে যতগুলো গুম, খুন, অপহরণ, বিনাবিচারে হত্যা বা বেআইনি আটকে রাখার অভিযোগ দায়ের কাছে ভারতের কৌশল সেসব অভিযোগই আসলে যেন কেবল হিন্দুদের কিছু খৃশ্চানের উপর করা হয়েছে – এইভাবে তুলে এনে সাজানো হয়েছে ঐ চিঠিতে। আরেক দিক থেকে দেখলে মোদি যেভাবে সবকিছুতে ভারতের মুসলমানেরা হিন্দুদের ধর্মান্তকরণ [কেরালা স্টোরি সিনেমা] করছে বলে ভুত দেখে থাকে সব জায়গায় সেভাবেই হাসিনাকেও ঐ একই ধর্মান্তকরণের কর্তা-নায়িকা বলে তুলে ধরা হয়েছে। ব্যাপারটায় বেশ আমোদ হয়েছে আমাদের! এই আর কী!
আর আমাদের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী চাইলে নিশ্চয় এখন আপসোস করতে পারেন যে গত ২০২১ সালের কুমিল্লায় দুর্গাপুজার হামলার ঘটনায় জড়িত সকলের খবর ম্যাপ এঁকে বের করলেও কেন তিনি এদের পিছনের ভারতীয় হাত ও লিঙ্ক উন্মোচন বা-প্রকাশ করেন নাই কেন একথা ভেবে!!! স্বামীর সুখের কথা ভেবে স্ত্রীরা এভাবে আর কতদিন……।
অর্থাৎ হাসিনা সরকার আর টিকবে না মনে হচ্ছে ভারত যেন এমন সিদ্ধান্ত-অবস্থান পৌছে গিয়েছে। এনিয়ে সুবীর ভৌমিক গেল একসপ্তাহে দুবার লেখা দিয়েছে। প্রথমটাই হাসিনাকে বিরোধিতা দেখালেও আবার দ্বিতীয়টাতে ভান করেছে যে যেন ভারত সরকার ও গোয়েন্দা বিভাগ হাসিনা সরকারের টিকানোর জন্য কাজ করেছে। নিচে দেখেন সুবীরের লেখা থেকে সেই দাবির অংশটুকুছিল এরকমঃ
“Indian diplomats and national security officials have flown back
and forth in a week of intense parleys
(foreign secretary Vinay Kwatra to Washington DC, R&AW chief Samant Goel to Dhaka, to cite a few)”
মানে হল, বাস্তবে ভারত হাসিনাকে ত্যাগ করার সিদ্ধান্ত নিয়ে নিলেও সুবীর এখনও একটু নাটক করতে চাইছেন। অথচ এনিয়ে ভারত সরকার ভারতের মিডিয়াকেও হাসিনা (বাংলাদেশ)বিরোধি সরকারি গাইড লাইন দেয়া হয়েছে। যেমন দেখুন “ভিসা নিষেধাজ্ঞা নিয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে পালটা কূটনৈতিক বার্তা? চিনের সঙ্গে বৈঠকে ঢাকা” । অথবা দ্যাহিন্দু পত্রিকার বিরাট আঁতলামো রিপোর্ট যার শিরোনাম – Explained | How has Dhaka reacted to the U.S. threat on visas? – অথচ ভিতরে শিরোনামে দাবির কথা নিয়ে কিছুই নাই কেবল খামোখা চীনকে দোষারোপ ছাড়া। মানে হল হাসিনা যেন চীনের পক্ষে নতুন করে যাচ্ছে অথচ এর কোনটাই সত্যি না। আর ভারত এই উসিলা তুলছে যেন বাইডেনের কোলে উঠে হাসিনাবিরোধি সাজতে পারে সে। ফ্যাক্টস হল, হাসিনা নতুন করে কোন চীন-ঘনিষ্ঠতা করে নাই। কারণ সেই সুযোগই নাই। এই ভোলাটাইল [volatile] বা অস্পষ্ট মুহুর্তে চীন নিজেই কোনদিকে ঝুঁকতে আগ্রহি নয়, কেবল রুটিন ততপরতা ছাড়া।
কিন্তু কেন এখন ভারত হাসিনার হাত ছেড়ে দিতে সময় হয়েছে মনে করলোঃ
ভারতীয় র-এর প্রধান সামন্ত গোয়েল বাংলাদেশ সফরে এসেছিলেন – একথা সুবীর ভৌমিক তার নিজের লেখাতেই “ভারতের বীরত্ব হিশাবে দেখাতে গিয়ে” স্বীকার করেছেন। যদিও গোয়েল সাব এসেছিলেন এনিয়ে হাসিনাবিরোধী শক্তির সাথে একসাথে কাজ করতে চাওয়ার অফার দিতে। কিন্তু বাংলাদেশের তেমন বা অমন কোন শক্তিই সামন্ত গোয়েলের সাথে কাজ করতে আগ্রহ দেখায় নাই। গোয়েল সাব ভেবেছিলেন হাসিনাবিরোধি কোন একশনে যৌথকাজ কারবারের অফার দিলে বাংলাদেশের যে কেউ ঝাপায় পড়ে গোয়েল সাব রে কোলে তুলে নিবে। আর এর ভিতর দিয়ে আগামি হাসিনা-উত্তর নয়া সরকারের মধ্যেও হাসিনা আমলের মতই গোয়েল সাবেরা ঢুকে বসে থাকার সুযোগ নিবেন, ধারাবাহিকতা বা কন্টিনিউটি বহাল থাকবে! কিন্তু হায়! গোয়েল সাব হতাশ হয়েছেন!
এই খবর নিয়ে যদিও আরেকটা সুত্র একটু কারেকশন দিয়েছে। তাদের মতে সামন্ত গোয়েলের সাথে বাংলাদেশের হাসিনাবিরোধী শক্তির দেখা হয়েছে সেকথা সত্য তবে সেটা বাংলাদেশে নয়, বিদেশে দেখা হয়েছে। মানে গোয়েল সাহেব বাংলাদেশে আসেই নাই। সে যাই হোক, এখানকার মূল কথাটা হল, ভারত হাসিনার হাত ছাড়ার সময় হয়েছে মনে করেছে।
আসলে সারকথাটা হল, সামন্ত গোয়েল বা ভারত সরকার প্রচন্ড অধৈর্য ও অস্থির হয়ে উঠেছে। মূল কারণ, হাসিনা সরকারের টিকে যাওয়া-না যাওয়া নিয়ে অবস্থা তেমন ভাল না এমন ভয় অনেকের মধ্যেই ঢুকেছে; অন্তত ভারতের মত বিদেশিস্বার্থের মধ্যে “এক অনিশ্চয়তা” শুরু হয়েছে। সেখান থেকেই এমন অনুমান যে হাসিনা যদি টিকতে নাই পারেন সেক্ষেত্রে হাসিনার সরকারের ক্ষমতা-উত্তর বাংলাদেশে কোন অন্তর্বর্তি সরকার বা পরের নির্বাচিত সরকার ইত্যাদিতে সম্ভব্য যারাই ক্ষমতায় আসবেন অনুমিত সেসবের কারোর সাথেই এখনও ভারতের কোন ঘনিষ্ঠতা দূরে থাক কোন নুন্যতম সম্পর্কের কিছুই তৈরি হয় নাই। কাজেই এই সম্পর্ক, ঘনিষ্ঠতা তৈরি করতেই এখন থেকেই ভারত বেপরোয়া অস্থির হয়ে উঠেছে। কিন্তু কী থেকে শুরু করবে তার কিছুই খুজে পাচ্ছে না। যেখানে বিএনপি সেই প্রণয় ভার্মার বাসায় কথিত ডিনারের দাওয়াতের পরে যেন হ্যালো বলা থেকেও আরো দূরে চলে গেছে। মূল কারণ, ভারতের নিজ সম্পর্কে হুদাই খুবই উচ্চ ধারণা! ভারত ধরে নিয়ে আছে যে সেই-ই এতই ক্ষমতাবান যে বিএনপির নেতা কে হবে অথবা কী রাজনীতি করবে তা ভারত ঠিক করে দিতে পারে! যেখানে বাইডেনের হাত থেকে মোদি বাঁচে কিনা, কিভাবে তাই এখন নিলামে উঠেছে বড় বাজি হয়ে! অথচ এটা তো বুঝাই যাচ্ছে, সরকার বদল না হলে বিএনপি কারোও সাথেই কথা বলবে না। এমনকি ভারতের বেলায় সরকার বদলের পরও কী হবে বিএনপি ভারতকে নিয়ে কী করবে এর পুরাটাই এখনও অনিশ্চিত। সম্ভবত সঠিক শব্দ হবে যে – সেটা এখনও বিএনপির কাছে “এজেন্ডাই হতে পারে নাই”। যেকারণে, সবমিলিয়ে ভারত ইতোমধ্যেই বিএনপিবিরোধী প্রপাগান্ডা শুরু করে দিয়েছে। অনেকের ভারত-ইসরায়েলি কালেকশনের সোয়েব চৌধুরীর কথা মনে আছে হয়ত। সেই সোয়েব একাজ শুরু করে দিয়েছে। যদিও এসব কাজ এখন মানুষ আর খায় না। কারণ সব গুমোর উদাম হয়ে গেছে তাই এসব ছেচড়ামির আর কোন দাম নাই!
কিন্তু ভারত কেন এত মরিয়া হয়ে আগেই হাসিনার হাত ছাড়তে চায়?
এর পিছনের সবচেয়ে বড় কারণ, গত ১৫ বছর ধরে বাংলাদেশকে চুষে চুষে খেতে, একপক্ষীয় সুবিধা নিতে যত দীর্ঘ তার অফুরন্ত স্বার্থের লিস্ট ভারত তৈরি করেছে, হাসিনা-উত্তরকালে সেসবের কী হবে? সেই একই ধারাবাহিকতা-সুবিধা তখনও থাকার তো কোন কারণ নাই। এছাড়া চুষে-লুটে যেসব একতরফা কর্মকান্ডে বাংলাদেশের সম্পদ নিয়ে যাচ্ছে আর এসবের উপর নির্ভরশীল হয়ে যে নিজস্বার্থ ব্যবস্থা-বাণিজ্য গড়ে তুলেছে তা তো আর বজায় থাকবে না – সব অনিশ্চিত হয়ে পড়বে। এটাই স্বাভাবিক। সুবীর ভৌমিক সরাসরি এসব ইস্যুতে ভারতের স্বার্থ নিয়ে উদ্বিগ্নতা প্রকাশ করে বিএনপির নাম ধরেই লিখেছে যে আগামি বিএনপি সরকার ক্ষমতায় এসে কখনও যদি ভারতকে হাসিনার দেয়া বিভিন্ন একপক্ষীর চুক্তির সুবিধা সব কেড়ে নিয়ে বাতিল করে দেয় তাহলে কী হবে [what with khateda Zia’s threart to review all agreements Hasina has signed with India]!! সকলেই জানে এবিষয়ে ভারতের স্বার্থের স্টেক বা স্বার্থ-বহর অনেক লম্বা। তাই এখান থেকেই ভারতের সব দুঃশ্চিন্তার শুরু। তাই বাংলাদেশে এমন যেকোন একটা রাজনৈতিক গ্রুপ বা শক্তিকে পেতে মরিয়া যারা আগামিতে সম্ভাব্য ক্ষমতাসীন হবেন – ফলে ভারতের বাংলাদেশ লুটার স্বার্থের ধারাবাহিকতা ঠিক থাকে! ভারতের দুর্ভাগ্য যে এখনও এমন কোন বাংলাদেশি শক্তির হদিস তারা পায় নাই। আর বিএনপি সে তো আরো দূরে। আর ততই গোয়েল সাহেবেরা ডেসপারেট হয়ে বলতে চাচ্ছেন হাসিনার বিরুদ্ধে কাজ করা বা তাঁকে বেচে দিয়ে হলেও ভারতকে বাংলাদেশের একটা আগামি রাজনৈতিক শক্তির নাগাল পেতেই হবে।
ভারতের হাসিনার হাত ছাড়ার প্রথম উদ্যোগের হদিস আমরা কিছু এখান থেকেই পাচ্ছি। তবে এটার প্রকাশ্য রূপ-ততপরতা নাগাল পাওয়া বা জানা যথেষ্ট কম-ই বলতে হবে। কারণ সেনা বা গোয়েন্দা বিষয়ক তথ্য যথেষ্ট পাওয়া যায় না আর পেলেও সেনসেটিভ বলে অত খুলে আলোচনা করা যায় না। সেটা সঠিকও না, হিতে বিপরীত হতে পারে। তাই ভারতের দ্বিতীয় উদ্যোগটার দিকে তাকানো যাক। এটা তুলনায় অনেক স্পষ্ট আর উন্মুক্ত।
ভারতের দ্বিতীয় উদ্যোগঃ
ভারতের এই উদ্যোগ অনেক প্রকাশ্য এবং অনেক দূর ইতোমধ্যে আগিয়ে গেছে। আর সুবীর যেমন ক্রেডিট নিতে বলেছিল যে, ভারতের foreign secretary Vinay Kwatra to Washington DC, R&AW chief Samant Goel to Dhaka ) যারা হাসিনারর পক্ষে কাজ করতে ভীষণ দৌড়াদৌড়ি করছে – সেটা দৌড়াদৌড়ি ছিল অবশ্যই কিন্তু তা ছিল হাসিনার বিপক্ষে, তাঁকে বেচে হলেও হাসিনার হাত ছেড়ে দিয়ে হলেও ভারতের আগামি স্বার্থ উদ্ধার বা যা ছিল বাংলাদেশের আগামি রাজনৈতিক শক্তি যারা হবে তাদেরকে তালাশ বা অন্তত তাদের একটা লিঙ্ক যোগাড় -এই ছিল ভারতের ওসব দৌড়াদৌড়ির উদ্দেশ্য।
কংগ্রেসম্যান বা কংগ্রেস প্রতিনিধি সম্পর্কে কিছু কথাঃ
সরাসরি হিন্দুইজমের সমর্থক এক অ্যামেরিকান কংগ্রেস প্রতিনিধি ছিলেন তুলসী গাব্বার্ড। [Tulsi Gabbard] এই নামে দেখুন এখানে যিনি সর্বশেষ ২০২০ সালেও কংগ্রেস সদস্য ছিলেন। তাকেঁ ঘিরে এছাড়া হিন্দু অ্যামেরিকান ফাউন্ডেশন [Hindu American Foundation (HAF)], ইসকন এমন আরো অনেক কিছু মিলে ভারত কিছু কংগ্রেসম্যান যোগাড় করেছিলেন যাদেরকে ভারত প্রত্যক্ষ-পরোক্ষভাবে ব্যবসা দিয়ে নিজরাষ্ট্র স্বার্থে ভারত ওসব কংগ্রেসম্যানদের দিয়ে লবি করাত। আমেরিকার মোট কংগ্রেসম্যান হল ৪৩৫ জন। এদের মধ্যে নুন্যতম দশজনকে ভারত তার স্বার্থের পক্ষে লবি-কারি বানাতে পারবে সেটা নিশ্চয় অসম্ভব কিছু নয়। সেসবের একালের ততপরতা হিশাবে মনে করা যায় যখন একালে ছয় রিপাবলিকান কংগ্রেস সদস্য প্রেসিডেন্ট বাইডেনের কাছে পাঠান এক চিঠি।
তাই একালে হাসিনা-উত্তরকালে ভারতের কী হবে এর সন্ধানে থাকা ভারতের দ্বিতীয় উদ্যোগটা হল এই ছয় অ্যামেরিকান রিপাবলিকান কংগ্রেসম্যান (আমাদের ভাষায় যারা অ্যামেরিকান সংসদ সদস্য) প্রেসিডেন্ট বাইডেনের কাছে চিঠি পাঠানো থেকে। গত ১৭ মে এমন ছয় জন কংগ্রেসম্যান একটা চিঠিতে যৌথভাবে স্বাক্ষর করে প্রেসিডেন্ট বাইডেনের কাছে পাঠিয়েছিল। এই চিঠির বিষয়বস্তুই হল, বাংলাদেশে হাসিনার মানবাধিকার লঙ্ঘণ ও এর প্রতিকার! এই চিঠির কপি সোশাল মিডিয়ায় ঘুরছে অনেকে দেখে থাকবেন, আর এর একটা কপি ঢাকার নিউ এজ পত্রিকায় ছাপা হয়েছে। আবার অনেকের কাছে আমেরিকান ইউনুস সেন্টারের কপিটাও আছে দেখেছি। শুরুতে বা উপরে আমি দিয়েছে অরিজিনাল কপির লিঙ্ক।
সবচেয়ে বড় কথা এতে শেখ হাসিনাকে চরমতম ভিলেন – হিউম্যান রাইট ভায়োলেটর, র্যাবের নামে ডেথ স্ক্যায়াড [death squard] বা ভাড়াতে খুনি বাহিনী চালানো, বিরোধীদেরকে নির্যাতন, ঘুম, খুন, অপহরণ ইত্যাদি সব ধরণের অভিযোগে অভিযুক্ত বলে দাবি করা হয়েছে। সবচেয়ে বড়কথা এটা হাসিনা ক্ষমতাসীন হবার সেই ২০০৯ সাল থেকেই হাসিনার অপততপরতা বলে দাবি করা হয়েছে।
এমনকি এর মধ্যে তাই হাসিনার সহযোগী বাহিনী হিশাবে বাংলাদেশের সেনাসহ এসব বাহিনী থেকে (স্বল্প কিছু যা) জাতিসংঘ বাহিনীতে যুক্ত হয় এদের সকল বাহিনীকেই জাতিসংঘ শান্তিবাহিনীর কাজে নিষিদ্ধের করার জন্য বাইডেনের কাছে এবার সুপারিশ করা হয়েছে।
সেনাবাহিনী বা জাতিসংঘ সম্পর্কিত চিঠিতে এই বাড়তি অনুচ্ছেদ – এটা বেশ নতুন তা মানতেই হবে। কারণ, এর ভিতর অন্তর্নিহিত বক্তব্য-অর্থ বা ইমল্পিকেশন [implication] অনেক গভীর ও মারাত্মক। এটা সৈনিকদেরকে অফিসারদের বিরুদ্ধে খেপানোর শয়তানি কাজ, অবশ্যই। অনুমান করা হচ্ছে যে এর ভিতরের যে অন্তর্নিহিত বক্তব্য তা নিয়েই কাজ করতে এটা সুবীর ভৌমিক কথিত সামন্ত গোয়েলের ঢাকা আগমন ঘটিয়েছিল। অর্থাৎ ভারতীয় পক্ষ থেকে তাদের এই ততপরতা ফলাও করে হাসিনার পক্ষের কাজ বলে প্রচার করা হচ্ছে। অথচ ভারত করেছে উলটা কারণে, ভারতের হাসিনার হাত ছাড়তে বলা – এটাই সে ফেরি শুরু করেছে।
কিন্তু এর চেয়েও গুরুত্বপুর্ণ এবং চমক লাগানো দিক হল এই চিঠির আরেকটা অংশ, সেদিকটা। আর সেখান থেকে এটা পরিস্কার যে – এই ছয় কংগ্রেসম্যানের স্বাক্ষরে চিঠি পাঠানো – এটা ভারতেরই কাজ। তারাই কংগ্রেসম্যান জুটিয়ে এই চিঠি লেখার ঘটনাটা ঘটিয়েছে। কিন্তু কেন?
কংগ্রেসম্যানদের চিঠিতে কী আছে সে সম্পর্কে আগে বলেছি। যেমন হাসিনাকে সেখানে হিউম্যান রাইট দলনকারী হিশাবে দেখানো হয়েছে তা নিয়ে উপরে বর্ণনা দিয়েছি। কিন্তু কীভাবে সেই বর্ণনা থেকে পরের প্রসঙ্গ যাওয়া হয়েছে তাপাঠককে সরাসরি জানানো দরকার।
প্রথমত এই চিঠিতে এক দীর্ঘ অভিযোগে দাবি করা হয়েছে হাসিনা হিন্দু-খৃশ্চানদের দলনকারী, জুলুমকারী [……persecuted ethnic and religious minorities in Bangladesh.] !!!!! মানে হাসিনা তাদের ভাষায় সংখ্যালঘুদের নির্যাতনকারী – যেকথা রানা দাসগুপ্ত বা সুলতানা কামালও বলতে চাইবেন কিনা সন্দেহ! কিন্তু সরি। এটা এখন সত্য যে একথা এখন রানা দাসগুপ্ত বা সুলতানা কামালও বলতে চাইছেন; আসছি সেখানে। এটাই ভারতের ম্যাসেজ বা ভারতের এখন দানের পাশা ঊল্টানো আচরণ!
কংগ্রেসম্যানদের চিঠি হাসিনার অপরাধ সম্পর্কে লিখেছে …...The well-documented abuses by the Hasina government are not confined to her political opponents; the government also has persecuted ethnic and religious minorities in Bangladesh. মানে হাসিনার মানবাধিকার দলন এটা আর কেবল বিরোধীদলের উপরেই নাকি সীমাবদ্ধ নাই। এটা ধর্ম ও জাতিগতভাবে যারা সংখ্যালঘু [ মানে হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদ, ভারত স্বঘোষিতভাবে যাদের কাস্টডিয়ান] দের উপরেও নির্যাতন জুলুমবাজি করছে হাসিনা!
Since Sheikh Hasina’s rise to power, the Hindu population has been halved. Looting and burning of households, destruction of temples and religious idols, murder, rape, and forced religious conversion are causing Hindus to flee Bangladesh. Sheikh Hasina’s government also has persecuted Bangladesh’s minority Christian population — burning and looting places of worship, jailing pastors, and breaking up families when religious conversion occurs.
কী তামসা দেখেন! দাবি করে বলা হচ্ছে হাসিনার এবারের ক্ষমতা নিবার পর থেকে বাংলাদেশে হিন্দু জনসংখ্যা নাকি অর্ধেক হয়ে গেছে [Hindu population has been halved]। আর যে অভিযোগ এই সেদিনও সেতুমন্ত্রী বিরোধীদলের উপর আবার একালে গত কয়েক সপ্তাহ আগে আরোপ করতে চাচ্ছিলেন যে বিএনপি নাকি সাম্প্রদায়িকতা ছড়ানোর কাজ করছে! আর আজ সে অভিযোগ ভারতের মুখ দিয়ে উঠে আসছে খোদ হাসিনার বিরুদ্ধেই। তাই এটা এক কঠিন তামাসাই বটে! তবে এখনও আমরা আসল জায়গায় যাই নাই, এখন যাব।
‘দেড় দশকে দেশ আরও সাম্প্রদায়িক’ হয়েছেঃ
এই প্রসঙ্গটা হল বাংলাদেশে ঘটা একটা ঘটনা যেটা ভারতীয় উদ্যোগে ঐ ছয় কংগ্রেসম্যানের চিঠিতে হাজির করা আর হাসিনাকে হিন্দু নির্যাতনকারি হিশাবে তুলে ধরার-ই বাংলাদেশ ভার্সান ও সংশ্লিষ্ট ততপরতা। এনিয়ে প্রথম আলো লিখছে, “দেশের বিশিষ্টজনেরা বাংলাদেশ হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদ আয়োজিত এক মতবিনিময় সভায় উপস্থিত হয়েছিলেন। সেটা ছিল ‘জাতীয় নির্বাচন ২০২৪: ধর্মীয়–জাতিগত সংখ্যালঘু জনগণের অধিকার’ শীর্ষক এক সভা যা বুধবার বিকেলে রাজধানীর রমনার ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশনে অনুষ্ঠিত হয়। মজার কথা হল সেখানে প্রথম আলো প্রতিষ্ঠান হিশাবে নিজেও এক অংশগ্রহণকারী দাওয়াত গ্রহিতা হিশাবে উপস্থিত ছিল। তাদের যুগ্ম সম্পাদক সোহরাব হাসান এতে প্রতিনিধি হিশাবে বক্তৃতা করেন।
আসলে এখানে অংশগ্রহণ করেছেন যারা তারা হলেন – যারাই প্রত্যক্ষ-পরোক্ষভাবে ভারতীয় অর্থে বা অর্থের প্রতিপত্তিতে তৈরি হওয়া ক্ষমতাকে ব্যবহার করে তাদের আয়-জীবিকা নির্বাহ করেন। তাই, ভারত এই সভায় তাদের সকলকে যোগ দিতে সহজেই বাধ্য করতে পেরেছে। কথিত এই মতবিনিময় সভায় প্রথম আলতে ছাপা হওয়া রিপোর্টটাকে খুটিয়ে দেখলে এমন অনেক কিছুই পরিস্কার হওয়া সম্ভব। এককথায় এটা হল, ভারত এতদিন বাংলাদেশের যাদেরকেই (কথিত হিন্দু সংগঠন ও এর নেতারা সহ) পেলেপুষে নিজের প্রভাবে রেখেছে তাদের সর্বোচ্চ সমাবেশ ছিল এটা। এর প্রথম উদ্দেশ্য ছিল হাসিনাকে ত্যাগ করা [disown] বা হাত ছেড়ে অস্বীকার করা যে তিনি আর তাদের কেউ নন। শুধু তাই নয় গত পনেরো বছর ধরে হাসিনা ‘সংখ্যালঘু’ নিপীড়ন-জুলুমবাজি করেছেন বলে হাসিনাকে অভিযুক্ত করে দেওয়া। এটাই সবচেয়ে কঠিন কঠোর পদক্ষেপ ছিল ভারতের। এর মানে ঐ কথিত সভায় যারা উপস্থিত ছিলেন তারা যে ভারতের পাপেট বা হাতের পুতুল ছিলেন সেটা যেন তারাই হাজির করেছেন। কেন?
কারণ, বাংলাদেশের ভারতের কোরস্বার্থ সহ সবকিছুই এখন কঠিন বিপদের মুখে। তাই এসকল মুখ এক্ত্রে ঐ সভায় উপস্থিত হয়ে হাসিনার মুন্ডু-নিপাত করছেন অবলীলায়!!! সত্যি তামাশা চলছেই!!! কারণ বাংলাদেশে হাসিনা তার সকল রাজনৈতিকবিরোধীদের উপর যে নিপীড়ন জুলুম করেছে সেসব কিছুকে এক ঘটকার এই শয়তানেরা একে হিন্দু নিপীড়ন বলে নামিয়ে ছোট করে নিজের পক্ষে নিয়ে গেল!
ঐ সভায় উপস্থিত এক মুখ্য চরিত্র দেবপ্রিয় ভট্টাচার্যঃ
দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য সিপিডির মূল উদ্যোক্তা-মালিক রেহমান সোবহান এর পরের ব্যক্তি তিনি। সেই ওয়ান-ইলেভেনের সময় থেকে ভারতের নর্থ-ইস্ট কে করিডোর দিতেই হবে; দিলে সেই আয়ে আমরা নাকি সিঙ্গাপুর হয়ে যাব – এরপক্ষে ভারতীয় দালালি দিয়েই প্রতিষ্ঠানটার বড় ততপরতা শুরু। তাই ভারতীয় স্বার্থরক্ষার কনসালটেন্সির অর্থ তাদের এক বড় আয়ের উৎস আমরা বুঝতে পারি। কিন্তু তাই বলে দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য – তিনি বাংলাদেশের কথিত হিন্দুস্বার্থের নেতা হয়ে যাবেন?? দেবপ্রিয়ের এই ভুমিকার এত চিপ …… একথা আমাদের জানা ছিল না। খুব সম্ভবত সিপিডি “ঠিকঠাক” চালাতে গেলে এখন দেবপ্রিয়কে কথিত সংখ্যালঘু হিন্দু নেতার ভুমিকায় নামতেই হবে, হয়েছে দেখা যাচ্ছে। তাহলে মানুষের আত্মমর্যাদা বলতে কী আসলে কিছু নাই?
প্রথম আলো সুনির্দিষ্ট করে বলছে, ” মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তি ক্ষমতায় থাকলেও গত দেড় দশকে দেশ আরও সাম্প্রদায়িক হয়েছে” – এই কথাটা বলেছেন দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য! আর তা পুনরায় সমর্থন ও উচ্চারণ করেছেন রামেন্দ্র মজুমদার, শাহরিয়ার কবির প্রমুখ। সত্যিই দেবপ্রিয়-র বিল এইবার ম্যাচিউরড আর সবাইকে ছাড়িয়ে তা বড় পরিমানের হবে।
সাম্প্রদায়িক জিনিষটা কী তা একটু পরে আসছি। তার আগে এখন ওবায়দুল কাদের – সেতুমন্ত্রী ওকার মুখটা মনে পড়ে করুণা লাগছে। বেচারা কত না এতদিন প্রমাণ করলেন যে “বিএনপি মানে সাম্প্রদায়িক” একথা বলে; এভাবে মনে সুখ নিচ্ছিলেন তিনি। আর এখন বাংলাদেশের হিন্দু-সব বড় বড়কর্তাদের সভায় যেটা আবার ভারতের আশীর্বাদে সমবেত এক সভা; সেখান থেকে তার মানে ওকা ও তাঁর জননেত্রী হাসিনা কাউকেই ছাড়লো না ভারতীয় স্বার্থ? তারা ওকা ও তাঁর জননেত্রী হাসিনা কেই সাম্প্রদায়িক বলে রায় দিল????
বাংলাদেশে যেখানে গত পনেরো বছর ধরে লাগাতর সেপাই, এসআই ওসি থেকে শুরু করে সচিব পর্যন্ত বাংলাদেশের ইতিহাসে হিন্দুদের সর্বোচ্চ পদায়ন ঘটে চলেছে, যেটা কারও কারও হিশাবে এটা ২৫% বা এরই বেশি। হাসিনার কথা শুনেছি অনেকের মাধ্যমে তিনি নাকি ধারণা করেন যে হিন্দুরাই নাকি তাঁর সবচেয়ে বিশ্বশ্ত, মুসলমান কর্মচারিরা যেটা নাও হতে পারেন! তাহলে? এ কোন বাংলাদেশি হিন্দু ? ভারতের এক ইশারায় যারা তামাম-ই হাসিনা ছেড়ে শুধু না; সমস্ত দায়-অভিশাপ হাসিনার উপর চাপিয়ে দিয়ে ভারত-রাষ্ট্রস্বার্থ এর পক্ষে এলাইন হয়ে গেল? হাসিনাকে ছেড়েই চলে গেল? এরপরেও কী বাংলাদেশের সব হিন্দুরা না হোক ঐ কথিত মত বিনিময় সভায় যারা উপস্থিত ছিলেন তারা বাংলাদেশকে প্রতিনিধিত্ব করেন? বলা যাবে, তাদের রাষ্ট্র ও নাগরিকত্ব পরিচয় বাংলাদেশী?
ব্যক্তির রাষ্ট্র পরিচয় কেন একালে লাগে আর তা গুরুত্বপুর্ণ কেন সেটা আগে বুঝার চেষ্টা করতে পারি আমরা। রাষ্ট্র-পরিচয় না থাকায় বেওয়ারিশ লাশের মত কোন এয়ারপোর্টের মেঝেতে মাসের পর মাস শুয়ে রাত কাটিয়ে দেয়া মানুষের জীবনের দিকে একবার কিছুক্ষণ তাকান!! রাষ্ট্র স্পষ্ট না থাকা প্যালেসটাইনিদেরকে বুঝার চেষ্টা করেন অন্তত! মানুষের রাষ্ট্রীয় পরিচয় যেমন গুরুত্বপুর্ণ তেমন রাষ্ট্রটাকে টিকিয়ে রাখা আর ওর দায় নেয়া বা রাষ্ট্রস্বার্থ রক্ষাও নাগরিক হিশাবে আপনার দায় – এদিকটাও বুঝতে হবে। কাজেই বাংলাদেশে আপনার যত দুঃখই থাক অভাব থাক তা মিটাতে সেই বাংলাদেশ রাষ্ট্রকেই নতুন করে পুনঃগঠনের লক্ষ্যে রাজনৈতিক লড়াই করেন, এটাই আপনার একমাত্র করণীয়। কিন্তু কোনভাবেই আপনার সুখ নিরাপত্তার জন্য মোদিকে আপনাকে সুরক্ষার ব্যবস্থা করতে আহবান করতে পারেন না। কারণ, এতে আপনিও আর কার্যত বাংলাদেশের নাগরিক থাকেন না, রাষ্ট্রও আপনার থাকে না, নাই হয়ে যায়। মোদিও কী ভারতের কোন মুসলমান নাগরিককে পাকিস্তানকে ডেকে আনার পক্ষে থাকতে এলাও করবেন? সেটা একবার ভাবেন? সেটা মোদি হিন্দুত্ববাদি বলে নয় এটা কোন রাষ্ট্রই পারে না। তবে কিছুই করতে না পারলে একালে মাইগ্রেট করে জন্মরাষ্ট্র ফেলে মাইগ্রেটেড রাষ্ট্রের নাগরিক হওয়া যায় সেটা ট্রাই করতে পারেন। কিন্তু বাংলাদেশে বসে নিজ সুখ বা পেটিস্বার্থের জন্য ভারতের ব্যাগ-বোঝা বইতে পারেন না।
এটা খুবই অদ্ভুত একজন পিএইচডি হোলডার দেবপ্রিয়-কে নিয়ে এসব কথা বলতে হচ্ছে!! কথা আরও কত কী হয়ে গেছে দেখেন। দেবপ্রিয় এখন কোনটা নিজের সামাজিক পরিচয় বলে দাবি করবেন? তিনি কী বাংলাদেশের হিন্দুস্বার্থের নেতা? যেটা আসলে ভারতরাষ্ট্রের বাংলাদেশে যেসব স্বার্থ আছে এর কোন তল্পিবাহক সংগঠন বা এর নেতা ছাড়া আর কিছুই নয়! নাকি দেবপ্রিয় সিপিডির এক বড়কর্তা প্রতিনিধি? দেখেন গতকাল সিপিডি বাংলাদেশের বাজেট নিয়ে আবার সরকার সমালোচনার মুডে চলে গেছে। গতকাল কড়া সমালোচনা করেছে সিপিডির প্রতিনিধিরা। যদিও গতকাল দেবপ্রিয় সেখানে ছিলেন না, সিপিডির অন্যেরা ছিল। এখন সপ্তাহ খানেক আগেও দেবপ্রিয় সরকারের পক্ষে দাঁড়ায়ে আইএমএফ রে দায়ী করে (বোকা বোকা দালালি) বক্তব্য দিয়েছেন। তাহলে আজকে হাসিনা ছেড়ে যাচ্ছেন কে?
সোজা কথাটা হল, কাল যদি তিনি সিপিডির বাজেট সমালোচনায় উপস্থিত থাকতেন তাহলে তার মুখে বাজেট সমালোচনা কে বাংলাদেশের মানুষ কীভাবে নিত – আপনি বাংলাদেশের আম-মানুষের পক্ষে দাঁড়িয়ে বাজেট সমালোচনা করছেন নাকি হিন্দু নেতা হয়ে ভারতের স্বার্থের পক্ষে এটা কোন সমালোচনা? আমাদেরকে এদুটার ফারাক বুঝবার তো কোন উপায় রাখেন নাই! যে কথিত হিন্দুস্বার্থের নেতা হতে চায় (যা আসলে ভারতরাষ্ট্রের স্বার্থ) তিনি তো একই সাথে বাংলাদেশের আম-মানুষেরো প্রতিনিধি বা বক্তা হতে পারবেন না!
দেখেন হাসিনা ফ্যাসিস্ট – গুম, খুন ‘ডেথ স্ক্যায়াডের’ রানী হওয়াই তার পরিণতি। কিন্তু আপনি দেবপ্রিয় এতদিন হাসিনার মাখন খেয়ে চলেছিলেন আর এখন এই বিপদে পড়া হাসিনাকে ছেড়ে চলে যাচ্ছেন, কেবল ভারতের স্বার্থে? আপনি তো হাসিনার চেয়েও খারাপ! পনেরো বছর ধরে হাসিনার ‘ডেথ স্কয়াড’ চলেছে মুখ খুলেন নাই, আকার ইঙ্গিতেও না, কেন? এমনকি এখনও হাসিনার সমালোচনা যেটা করছেন সেটাও ভারতের ইচ্ছায়! ঐ সভায় যারা উপস্থিত তারা সকলে এই অপরাধে অভিযুক্ত, নয় কি?
সাম্প্রদায়িকতা কী?
খুবই সংক্ষেপে বলব। আর আমার আগে বলা লেখা পড়ে নিতে লিঙ্ক দিব।
সেটা ১৮০০ সালের দিকের কথা যখন হিন্দু জমিদারের বৃটিশ শাসনের অধীনে নিচে নতুন শাসক শ্রেণী হিশাবে বাংলায় আসর জমিয়ে বসতেছেন। তারা দুটা সিদ্ধান্তের উপর তাদের নয়া বাংলার মসনদ সাজিয়েছিলেন। সারকথায় এর এক হল, মুসলমানেরা বাঙালিই না। জমিদারদের এই চাপিয়ে দেয়া সিদ্ধান্ত। কেউ বাঙালি কিনা এই এথনিক পরিচয়াবলী ভা এথনিসিটি নির্ধারণ যেন কোন শাসকের ইচ্ছা দিয়ে নির্ধারণ সম্ভব! দুইঃ বাংলা ভাষা সংস্কৃত থেকে এসেছে। যেটার বিপরীতে ডঃ মুহম্মদ শহীদুল্লার উচ্চারণ বাংলা সংস্কৃতের দুহিতা (কন্যা) নহে।
এদুটা মূল সারকথার উচ্চারণে কী এমন ফারাক হয়ে গেল তা প্রগতিশীলেরা হয়ত বুঝবে না। বলবেন হয়ত এটা হুদাই ভারতবিরোধিতা। এবিষয়ে প্রগতিশীলতা=হিন্দুত্ববাদ এই সমীকরণটা মনে রাখলেই আপাতত চলবে! এদিকে জমিদার হিন্দুর নেয়া সবচেয়ে আত্মঘাতি সিদ্ধান্তটা হল যে নয়া তাদের নে্তৃত্বে সমাজে মুসলমানদের উপর আধিপত্য (সম্পর্ক) কায়েম তাদের করতেই হবে। যেকোন জাতিবাদি চিন্তা মাত্রই তা অন্য সকল জাতির উপরে নিজ শ্রেষ্ঠত্ব কায়েম করতে চায় – এটাই তার লক্ষ্য মনে করে থাকে। জাতিবাদ মানে তাই “জাত শ্রেষ্ঠত্ববাদ”। তাই জমিদারদের আধিপত্যের খায়েস মূলত হিন্দু শ্রেষ্ঠত্ববাদ কায়েমের খায়েস। এছাড়া, জমিদারির অর্থনৈতিক জবরদস্তি সে তো আছেই।
সাম্প্রদায়িকতা শব্দটার রূট শব্দ হল ‘সম্প্রদায়’, যেটা ইংরাজি ‘কমিউনিটি’ [community] শব্দের অনুবাদ। যদিও সাবধান। ‘কমিউনিটি’ শব্দটা খুবই ইতিবাচক শব্দ, কোনোভাবেই এটা [derogated] বা নিচু-অর্থ হয়, নেতি ধারণা হয় এমন শব্দ নয়। অথচ জমিদার হিন্দুর আবিস্কৃত বা কয়েন করা শব্দ ‘সাম্প্রদায়িকতা’ একটা নেতিবাচক শব্দ।
এটা ১৮০০-১৯৪৭ এই সময়কালজুড়ে হিন্দু জমিদারি স্বার্থ ও এর রাজনীতির বয়ান তৈরি করতে শুরুর দিকেই বানিয়ে নেয়া শব্দ। বাঙালি ‘জাতি’ কী, কোনটা থাকলে বাঙালি জাতি নাহলে নয়, কী এর বৈশিষ্ট্য আর এছাড়া, কোনটা ও তা কেমন বাংলা ‘ভাষা’ ইত্যাদি এথনিক পরিচয়গুলো ঐ জমিদারি ক্ষমতার হাতে তৈরি এবং আকার, বৈশিষ্ট্য দেয়া ইত্যাদি সবই সম্পন্ন হয়েছিল তখনকার ঐ সময়কালের শুরুতেই। আর এখানেই সাব্যস্ত করা ছিল- হিন্দু জমিদারি স্বার্থ ও এর রাজনীতির এক কঠিন রায় বা সিদ্ধান্ত যে, ‘মুসলমানেরা বাঙালি নয়’।
মুসলমানেরা বাঙালি নয় এই ফতোয়া দিলে তা মুসলমান মাত্রই তারা অধস্তন, আর তা হিন্দু জাতভেদের হিশাবে হিন্দু-জাতের সবচেয়ে নিচা মুচি বা চন্ডালদের চেয়েও নিচে – এখানে মুসলমানদের কোন অবস্থান হবে। এছাড়া পুর্ববঙ্গে আবার মুসলমানেরা সংখ্যাগরিষ্ট। তাই এই নিচা অবস্থান দেখিয়ে দিলে জমিদারদের পক্ষে অখন্ড বাংলায় আধিপত্য করতে এটা সহায়ক হবে। কিন্তু আধিপত্য করতে হবে কেন এই প্রশ্ন কেউ করতে নিজেকে করতে চায় নাই!
এরপরেও জমিদারদের দুঃখ ঘুচে নাই। মোটাদাগে যদি পশ্চিমবঙ্গে মুসলমান জনসংখ্যা ২৫% ধরে নেই তবে সেটাও যথেষ্ট বড় সংখ্যা বলে এদেরকে চাইলেও শুধু দাবিয়ে রাখা মুসকিল। বৃটিশ ভারতে ১৮৩০ সালের দিকে আধুনিক শিক্ষা মানে স্কুল কলেজে শিক্ষা শুরু হয়েছিল। অর্থাৎ সরকারি চাকরির জন্য জনসম্পদ [Human resource HR] তৈরি তা বৃটিশ-ইন্ডিয়া সিদ্ধান্ত নিয়েছিল নিজ স্বার্থে। এই সিদ্ধান্তটাকে যদি একজামিন করি তাহলে দেখব শাসক জমিদার শ্রেণীর হাতে মুসলমানদেরকে এই সুবিধা নিতে ঠেকিয়ে দিবার মত তেমন অস্ত্র ছিল না। তাই তাদের সমাজ মানে তাদের হিন্দু আধিপত্যের সমাজে মুসলমানদের জন্যই অন্তত কিছু জায়গা ছেড়ে রাখাটাই সঠিক হবে বলে মনে করা হয়েছিল। আর সেখান থেকেই স্কুলে মুস্লমান ছেলেটাকে পাশ বসতে দিবে কিভাবে, কিংবা চাকরিস্থলে বা এমনকি এই সুত্রে সমাজে পাশাপাশি চলতে দিবে কিনা ইত্যাদি মেলা প্রশ্ন ভর করে এসেছিল। তখন জমিদার শাসনের হিন্দু সমাজ যেসব শর্ত আরোপ করেছিল যে শর্ত পুরণ সাপেক্ষে এই “সর্ব অন্তজ-জাত” মুসলমানেরা তাদের সামনের হিন্দু ডমিনেটেড সমাজে একটি প্রবেশ ও কোনায় বসার অনুমতি পেয়েছিল সেটাই “অসাম্প্রদায়িক” হওয়া। মুসলমান আদব কায়দা দেখানো যাবে না, ইসলামি চিহ্ন প্রকাশ্যে প্রদর্শন করা যাবে না মানে হিন্দু সমাজের কমন প্লেসে দেখানো যাবে না। ব্যাপারটা দাড়ায় স্কুলে ব্যাকবেঞ্চে জায়গা হয় একটু কিন্তু কেউ পাশে বসে না। নিজেরা টিকি আর চন্দনে মুখে বা কপালে ড্রয়িং এঁকে হিন্দুরা সাত জায়গা ঘুরে বেরাচ্ছে অথচ মাথার টুপি ভুলে মাথা থেকে না খুলে প্রকাশ্য রাস্তায় বের হওয়া যাবে না। মানে সবসময় মনে করিয়ে দেয়া You are not equal to us – এই লক্ষ্যেই এটা পরিচালিত হত, শাসন সহজ করার জন্য। তাহলে সাম্প্রদায়িকতা কী? এর মানে হল যে হিন্দু সমাজ যে অধীনতা শর্ত চাপিয়েছিল মুসলমানদের উপর সেটা ভঙ্গকারিকে সাম্প্রদায়িক বলা হত। হিন্দু সমাজ আধিপত্যের শর্ত মানতে না চাইলে আপনি সাম্প্রদায়িক। অর্থাৎ সেটা মেনে চললেই কেবল আপনি “অসাম্প্রদায়িক সার্টিফিকেট প্রাপ্ত” হয়ে শর্ত পূরণ করেছেন বলে কেবল ঐ সমাজে প্রবেশাধিকার লাভ করতে পারেন।
কালক্রমে আবার একদল হিন্দু একাদেমিক হিন্দুত্বের অসাম্প্রদায়িক হবার শর্ত যেটা সেটাই যেন আধুনিকতা, এই বলে প্রলেপ দেয়া এক নয়া সাফাই চালানোর চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু এরা জানেই না যে ‘অসাম্প্রদায়িকতার শর্ত’ যারা চাপাতে চায় তারা আধুনিকই নয়। তাদের আধুনিক হবার সুযোগ নাই। কারণ আধুনিকতা প্রথম শর্ত হচ্ছে সাম্য। অথচ আপনাদের চাওয়ার ভিত্তি তো আধিপত্য, জাত শ্রেষ্ঠত্ব। কাজেই মানুষকে সমান চোখে দেখতে শিখেন আগে। নাগরিক মাত্রই সকলেই সমান অধিকারের নাগরিক সেটা শিখতে হবে আগে। এছাড়াও প্রত্যেকের মর্যাদা, স্বাধীন নাগরিকের মর্যাদা আছে সে কথা খেয়াল রাখতে হবে। অথচ ওদিকে সাম্প্রদায়িক শর্ত দিবার উদ্দেশ্যই তো হিন্দু সমাজ আধিপত্যের শর্ত মানতে অপর যেকাউকে বাধ্য করা। যেটা সাম্য ধারণার উলটা। বরং জাতভেদে বিভক্ত ও ছেড়াবেড়া হিন্দুত্বের ধারণাটাই এজন্য আধুনিক হবার অযোগ্য, এটা এক মৌলিক অযোগ্যতা। আর তাদের কথিত রেনেসাঁর আদিপুরুষ রাম মোহন রায় এজন্যই তো সবার আগে ১৮১৫ সালেই একটা নয়া ব্রাহ্মধর্ম বা ব্রাহ্মসমাজ গড়ে নিতে চেয়েছিলেন। এসব কেন হয়েছে সেসবের ব্যাখ্যা করতে শিখেন আগে। না বুঝে কথা বলা এসব অন্নদাশঙ্কর মার্কা রেনেসাঁ-বুঝার ভাবসাব আর কতদিন দেখাবেন! বরং যেসব ধর্ম বা থিওলজিক্যাল ব্যাখ্যায় বাই ডিফল্ট সাম্য অনুসরণ যোগ্য হয়েই থাকে সেসব থিওলজি থেকে আধুনিকতায় যাওয়া আসা সহজ। মর্ডানিটি বুঝবার আগেই কমিউনিস্ট- প্রগতিশীল হয়ে যাবার সমস্যা এগুলাই! মূল কথাটা হল, সবার আগে সবাইকে সমানজ্ঞান করা ও মর্যাদা দিতে শিখতে হবে। আর এই হল কথিত অসাম্প্রদায়িকতার গুমোড় ফাঁক!
“মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তি ক্ষমতায় থাকলেও
বাংলাদেশ আরও সাম্প্রদায়িক হয়ে যাওয়ার কথাটি
বলেন বেসরকারি সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) বিশেষ ফেলো দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য।”
এখন আসেন, দেবপ্রিয়ের ঐ কথিত মত বিনিময় সভার কথায়। তিনি হাসিনাকে দায়ী করে বলেছেন, মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তি ক্ষমতায় থাকলেও গত দেড় দশকে দেশ আরও সাম্প্রদায়িক হয়েছে”। তাহলে তিনি আসলে কী বলেছেন যা শুনে ঐ আসরের আরও অনেক কর্তা-হিন্দুনেতা হাততালি দিয়েছেন? এর মানে তারা পনেরো বছরের হাসিনার শাসনে একেবারেই সন্তুষ্ট নন। আমরা দেখছি তারা চাচ্ছেন অসাম্প্রদায়িকতা – একটা খুব সুন্দর অসাম্প্রদায়িকতার সমাজ! যা মুসলমান হাসিনা দিতে পারেন নাই, এই হলো অভিযোগ। কিন্তু সেটা কী জিনিষ! আচ্ছা থাক সেকথা বাদ দিলাম। বরং আসেন জিজ্ঞাসা করে জেনে নেওয়া যাক কখন হিন্দুরা অসাম্প্রদায়িকতার সমাজ উপভোগ করেছিল? তাহলে একটা ধারণা পেয়ে যেতে পারি।
আমি নিশ্চিত দেবপ্রিয় বা রামেন্দ্র মজুমদার তো বটেই এমনকি খুশি কবির আর সাথে শামসুল হুদাও বলে উঠবেন – কেন, ১৯৪৭ সালেরও আগের জমিদার-হিন্দু আধিপত্যের সমাজে!
এবার কী বুঝা গেছে তাদের খাঁটি অসাম্প্রদায়িকতার মাপকাঠি কী? মানে আমাদেরকে শুরু করতে হবে জমিদারদেরকে জমিদারি ফেরত দিয়ে। কারণ জমিদারি ফেরত না দিলে জমিদার-হিন্দু আধিপত্য আর তাদের রুস্তমির সমাজ ফিরে আসবে কোথা থেকে? আর সেটা না হলে জমিদারি-অসাম্প্রদায়িক সমাজ আসবে কোথা থেকে? আহ রে অসাম্প্রদায়িকতা, কোথায় রাখি তোরে!!!! My Foot!
আচ্ছা তাহলে কলকাতায় কী অসাম্প্রদায়িকতার সমাজ আছে? আছে তয় মমতা মাঝে মাঝে মুসলমানদের ভোট নিতে গিয়ে সব নষ্ট করে দেয়! অবশ্য ইদানিং আরএসএস উঠে আসছে। তারা হিন্দু জনবসতির মধ্যে হোটেলে মুসলমান স্কুল শিক্ষকদের ভাড়া দিয়ে থাকতে এলে তাদেরকে থাকতে দেওয়ার বিরুদ্ধে বিজেপি ফতোয়া দিয়েছে । ভালই হয়েছে, সব পরিস্কার হয়েছে। এটা খুবই অসাম্প্রদায়িক কাজ হয়েছিল একটা! অতএব শেখ হাসিনা যতই শেখের মেয়ে হোক, তিনি তো আসলে মুসলমান! মানেই বিল্ট-ইন সাম্প্রদায়িক! তাই না!
তাহলে ভারত কেন এই মত বিনিময় সভা করে নিজের স্বার্থ জড়ো ও হাজির করছে?
কারণ, হাসিনার অবস্থা ভাল না। যদি তিনি ক্ষমতা হারায়েই ফেলেন কোন কারণে তবে আগামির রাজনৈতিক শক্তির সাথে ভারত যদি কোন সখ্যতাই না গড়তে পারে তবে এই হিন্দুস্বার্থে প্রতিনিধিত্বের নামে ভারত নিয়মিত ডিস্টার্বেন্স হিন্দু জন-অসন্তোষ সৃষ্টি করা ছাড়া আর তো কোন লিভার [lever বা চারাকাঠি] ভারতের হাতে থাকবে না!
+++
আপডেটেডঃ ০৫ জুন ২০২৩ দুপুর ০২ঃ ৩৫
গৌতম দাস,
রাজনৈতিক বিশ্লেষক
goutamdas1958@hotmail.com

