চীনের ‘গায়েব’ কালচার ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী চিন গ্যাং
গৌতম দাস
২৯ জুলাই ২০২৩
https://wp.me/p1sCvy-4LB
Where is China’s foreign minister?
চীনা পররাষ্ট্রমন্ত্রী একমাস গায়েব ছিলেন; মানে তিনি পররাষ্ট্রমন্ত্রী হয়ে গেলেও মাফ পান নাই। তিনিও ডিসাপিয়ার্ড [dissappeared] হতে পারেন এবং হয়েছেনও। ‘পার্টি’ যে কাউকে এমন শিকার হতে বাধ্য করতে পারে!!! কী ‘সুন্দর’ একটা প্রাকটিস তাই না!!! এটা চরম ভীতিকর, অগ্রহণযোগ্য! এটা রাজনীতি হতে পারে না! সেই পররাষ্ট্রমন্ত্রী সম্পর্কে সরকার থেকে গত ২৫ জুলাই এরপর জানালো হল যে তিনি সদ্য অপসারিত হয়েছেন। আর সেই পররাষ্ট্রমন্ত্রীর নাম চিন গ্যাং [QIN GANG]। উনার সরকারী বায়োডাটা উনার নামের সাথে দেয়া লিঙ্কে বা এখানে পাওয়া যাবে। চীনা শব্দের সঠিক উচ্চারণ নিয়ে বিতর্ক সবসময় হয়। তারা নিজেরাই দুবার উচ্চারণের স্টাইল বদলিয়েছে এটাও এর এক কারণ। যেমন মাও সে তুং [ইংরেজি: Mao Zedong ] আর হবে না, মাও জে দং বলতে হবে, এ’হলো এমনই এক বদল। তবে এখানে এখন যে তত্ব ফলো করেছি সেটা হল চীনা শব্দ যেটা ইংরাজি ‘Q’ শব্দ দিয়ে করা হয় এর (ফোনেটিক্যাল) উচ্চারণ করতে হবে চ [ch]। আর এই সুত্রে নামটা চিন গ্যাং [QIN GANG] লিখেছি। যদিও অনেকে ইংলিশ ফোনেটিক বা আক্ষরিক উচ্চারণের নীতি অনুসরণ করলে বলবেন এটা কুইন [QIN]। নাম বা উচ্ছারণের প্রসঙ্গের এখানেই ইতি টানছি।
এই অপসারণের মাধ্যমে চীনা কমিউনিস্টদের কালচার-চর্চার বিরুদ্ধে যে কঠোর সমালোচনা দুনিয়া জুড়ে চালু বা অগ্রহণযোগ্যতা আছে তাতে এখন আরেকটা বাজে উদাহরণ বা কলঙ্কের মুকুট যোগ হলো। বুঝা গেল এমন কলঙ্কের ঘটনা সহসা বা সহজেই চীনা কমিউনিস্ট পার্টিকে ছেড়ে যাচ্ছে না। চীনা কমিউনিস্টদেরও এথেকে মুক্তি নাই। বদনাম যা হয়েছে ও দাগ যা লেগেছে তা আরো বয়ে বেড়াতে হবে।
কেন এটা কলঙ্কঃ
চিন গ্যাং চীনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী হয়েছিলেন মাত্র সাত মাস আগে। রয়টার্সের এক বিস্তারিত রিপোর্ট চিন গ্যাং এর ঠিকুজি মানে জন্ম ও কর্ম-বৃত্তান্ত সব ছাপিয়ে দিয়েছে। রয়টার্সের সেই রিপোর্টের শিরোনাম – “চীনা চিন গ্যাং এর উল্কাগতিতে উত্থান ও মুহুর্তেই পতন” [China’s Qin Gang had meteoric rise and swift removal]। সেখানে দেখা যাচ্ছে চীনের রাজধানী বেইজিংয়ে এক বিশেষায়িত বিশ্ববিদ্যালয় আছে University of International Relations [UIR] এই নামে। বুঝাই যাচ্ছে এটা ‘আই আর’ মানে ‘ইন্টারন্যশনাল রিলেশনস’ বা আন্তর্জাতিক সম্পর্ক; মানে যা কেবল বা মূখ্যত বৈদেশিক বা পররাষ্ট্র সম্পর্ক বিষয়ক স্টাডির এক বিশেষ বিশ্ববিদ্যালয়। রয়টার্সের ভাষায়, এটা খুবই প্রেস্টিজিয়াস [prestigious] বা উচ্চমানের বিশ্ববিদ্যালয়। চিন গ্যাং সেখান থেকে গ্রাজুয়েশন করেই সরকারের কুটনীতিক সার্ভিসে যোগ দিয়েছিলেন। সেই থেকে টানা দীর্ঘদিন পররাষ্ট্র বিভাগেই দেশে-বিদেশে বিভিন্ন পোস্টিং পেয়ে চলেছেন। এতে তিনি দুইদুবার চীনের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র হয়েছিলেন, দুবার ওর প্রটোকল অফিসারও। শেষে বৃটেনে চীনা রাষ্ট্রদুত ছিলেন। আর একেবারে শেষে গত ডিসেম্বর ২০২২ সালে মানে এখন থেকে সাতমাস আগে, খোদ চীনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিশাবে নিয়োগ পেয়েছিলেন। আর এর ঠিক আগে পর্যন্ত ছিলেন আমেরিকায় চীনা রাষ্ট্রদুত।
বলা হয়েছে ৫৭ বছর বয়স্ক তিনি এপর্যন্ত চীনের সর্বকনিষ্ট পররাষ্ট্রমন্ত্রী ছিলেন। আবার কমিউনিস্ট পার্টি রেওয়াজের কারণে, পররাষ্ট্রমন্ত্রী হয়ে যাওয়াতে পরে আরেক গুরুত্বপুর্ণ পদ চীনা কমিউনিস্ট পার্টির পলিটবুরোর মেম্বার হয়ে যান চিন গ্যাং। যা পার্টির সর্বোচ্চ ক্ষমতাধর সক্রিয় কমিটি। তাঁর নিয়োগের পর থেকেই মিডিয়ায় বলা শুরু হয়, তিনি বর্তমান চীনা প্রেসিডেন্ট শি এর নেকনজরে আছেন; তাই চিন গ্যাং এর এই খাঁড়া উত্থান। প্রেসিডেন্ট শি তুলনায় কমবয়সীদের সুযোগ দিতে চান – এর সুবিধাগুলো কাজে লাগাতে চান তাই নাকি ‘এই উত্থান’। এমনকি অনেক বিশ্লেষক বা বিশেষজ্ঞরাও অনুমান করে বলা শুরু করেছিল যে , চীন-আমেরিকার সম্পর্ককে শক্ত ও গঠনমূলক স্থিতিশীলতা [to help stabilise relations with the U.S] দেওয়ার জন্যই নাকি প্রেসিডেন্ট শি এর এই পরিকল্পনা। বিশেষ করে অ্যামেরিকান পররাষ্ট্রমন্ত্রী ব্লিঙ্কেনের সাথে তাঁর প্রথম লম্বা বৈঠকের পরেই এই জল্পনাকল্পনা শুরু হয়েছিল।
কিন্তু হায়! সব ভুল প্রমাণিত হয়ে গেল। সব মিথ্যা আর সবকিছুই ‘না’ করে দিয়ে, মাত্র সাতমাসের মাথায় সব ভেঙ্গেচুড়ে ছাড়খার হয়ে গেল। গত ২৫ জুনের পর থেকেই চিন গ্যাং “জনসমক্ষে অনুপস্থিত” হতে থাকলেন। চীনা গায়েব হয়ে যাওয়ার সেই ট্রাডিশন আবার চালু হয়ে গেল। কেউ তাঁকে আর জনসমক্ষে দেখতে পেল না। তবে একবার গায়েব ঘটনার কেবল দুসপ্তাহ পরে (১১ জুলাই) তাঁর মন্ত্রণালয় জানালো যে অজানা স্বাস্থ্যগত কারণে তিনি নাকি তার পুর্ব নির্ধারিত ইন্দোনেশিয়া সফরে যাচ্ছেন না। এতটুকুই। এরপর?
এরপর আকাশ থেকে ফেলে দেওয়া। মানে তিনি মোট প্রায় এক মাস গায়েব থাকার পরে, গত ২৫ জুলাই এর সরকারী ঘোষণায় জানানো হল যে চিন গ্যাং-কে অপসারণ করা হয়েছে। আর এর সাথে জানানো হয়েছিল যে আগের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ওয়াং ই [Wang Yi ] কে আগের জায়গায় মানে নয়া পররাষ্ট্রমন্ত্রী পদে স্থলাভিসিক্ত করা হয়েছে। এভাবে চীনের মানে, কমিউনিস্টদের এই কলঙ্ক বাড়ছে তো বাড়ছেই।
কমিউনিজম আর ইনসাফ কী পরস্পরবিরোধীঃ
কমিউনিজম আর ন্যায় (বা ইনসাফ) এর ধারণা এদুটো যেন একসাথে চলতেই পারবে না, এরা পরস্পর বিরোধী। সম্ভবত কমিউনিস্ট পার্টির কাছে তাই। সেই যে লেনিনের [Vladimir Lenin] হাতে দুনিয়াতে প্রথম (১৯১৭) কমিউনিস্ট বিপ্লব ঘটেছিল কিন্তু তা সত্বেও ন্যায়ের ধারণা কমিউনিস্টদের হতে পারল না। সেসময়ই বিপ্লবী লেনিন প্রথম যে হোচট খান তা হল, তারা বলশেভিক বিপ্লবীরা বা তাদের বলশেভিক পার্টি বিপ্লবের প্রথম গণভোটেই ফেল করেছিলেন। আর সেই থেকে পাবলিক ধারণাটার উপরেই কমিউনিস্টদের বিতৃষ্ণা এসে যায়। বলা যায় “পাবলিক” এই কনসেপ্ট এটা সেই থেকে পার্টি ও সারা দুনিয়ার কমিউনিস্টদের জন্য আর আপন হয় নাই ও ক্রমশ পাবলিক বা জনস্বার্থ ধারণাটা অপ্রয়োজনীয় হয়ে থেকে যায়। অবস্থা হয় এমন যেন – “হারামজাদা জনগণ তোরা থাক, আমরা চললাম সুন্দরবন”। এমনিতে এই সোভিয়েত বিপ্লবের আগে থেকেই, তাত্বিকভাবে বললে কমিউনিস্ট থিওরিতে কার্যত ‘পাবলিক’ বা জনগণ ধারণাটাই নাই। কথাটা শুনে অনেকের অদ্ভুত লাগতে পারে, অবিশ্বাস্য লাগতে পারে। মনে হতে পারে আমি মিথ্যা বলছি বা প্রপাগান্ডা করছি। কিন্তু আপনারা কমিউনিস্টেরা নিজেই নিজেকে জিজ্ঞাসা করে দেখতে পারেন। কেবল আগেই ধরে নিবেন না যে পাবলিক বা জনগণ ধারণাটা আছে; বিশেষত বিপ্লব বা ক্ষমতাদখলের পরে। কিন্তু কেন নাই?
কী জিজ্ঞাসা করবেনঃ
ছোট্ট উত্তর – জনগণ ধারণাকে কমিউনিস্টেরা ‘শ্রেণী’ বলে এক ধারণা দিয়ে বদলে নিয়েছে কেন, তা জিজ্ঞাসা করবেন।
‘সমাজটা শ্রেণীতে বিভক্ত’ – এটা কমিউনিস্টদের খুবই কমন কথা। আর খুবই ডিপ রুটেট – মনের গভীরে ঢুকে থাকা তাদের এক ধারণা এটা। এমনকি এটা তাদের গর্ব করার এক ধারণা। “তাই সবকিছুকে শ্রেণী দিয়ে, শ্রেণীর ভিত্তিতে বিচার করে দেখতে হবে”; এই হল কমিউনিস্টদের দাবি ও অনুমান। অর্থাৎ কমিউনিস্টেরা বলছে – শ্রেণী নির্বিশেষে – সাধারণভাবে জনগণ বলে কিছু নাই। বরং আছে কেবল শ্রেণী। কথা বলতে গেলে মানুষকে কোন না কোন শ্রেণীর পক্ষেই কথা বলা হয় বা হয়ে যায়, যাবেই – বলে কমিউনিস্টেরা বিশ্বাস করে। এটাই কমিউনিস্টদের আদি ও মৌলিক বক্তব্য অবস্থান। তা নিশ্চয় কমিউনিস্টেরা অস্বীকার করবেন না। যেমন পাবলিক ইন্টারেস্ট বা গণমানুষের স্বার্থ, গণস্বার্থ বলে তাই শ্রেণী-বুঝের কমিউনিস্টদের কাছে কিছুই নাই। গণস্বার্থ নয় তাদের আছে শ্রেণী স্বার্থ ধারণা। ঠিক কিনা নিজেকে জিজ্ঞাসা করে নেন, একান্তে। যারা সতর্ক কমিউনিস্ট তারা পাবলিক আর শ্রেণী ধারণার ফারাকটা স্বযত্নে মনে রাখেন।
কিন্তু এই শ্রেণী ধারণার কারণেই এরপরে আর পাবলিক বলে কোন ধারণা কমিউনিস্ট সাহিত্য বা ভোকাবুলারি থেকে বাদ হয়ে যায়। ( এখানে পাবলিক, মাস পাবলিক (mass public), জনগণ বা আম-জনতা ইত্যাদি এসব ধারণাগুলোকে এককথায় পাবলিক বলা হয়েছে)। কেন বলছি? কারণ পাবলিক কথাটার অর্থ শ্রেণী নির্বিশেষে আম-জনতা। আবার আরো আগিয়ে জনগণ বলতে যদি সিটিজেন বা নাগরিক ধারণাটার দিকে যদি আগাই তাহলে নাগরিক কথাটাও আর কমিউনিস্টদের থাকে না; আসলে নাইও। কমিউনিস্টরাই উলটে নাগরিক ধারণাটাও তাদের বলে দাবি ছেড়ে দিয়েছে; তাদের কঠোর শ্রেণীবোধ এর কারণে। এককথায় কমিউনিস্ট চিন্তায় শ্রেণী ধারণাটা সব ধারণার আগে বা সেন্ট্রাল করে রাখাতে এই পাবলিক বা নাগরিক ধারণা কমিউনিজমে নাই; তারা আর থাকতে পারে নাই এমন হয়ে গেছে। মূলত সোভিয়েত বা রাশিয়ান বিপ্লবের পরেই এমনটা স্পষ্ট করেই হয়ে গিয়েছে।
যদিও পরে ১৯৪৯ সালের মাওয়ের চীন বিপ্লবের বেলায়ও শ্রেণী ধারণাটা সেন্ট্রাল শুধু না, সম্ভবত আরও কড়াভাবে সেন্ট্রাল বা মুখ্য করা হয়। যেমন মাওবাদীদের ক্ষেত্রে সবধারণার শুরু শ্রেণীদ্বন্দ্ব ধারণা থেকে আর শ্রেণীদ্বন্দ্ব ধারণা দিয়ে। তাই এখানেও বাস্তবত পাবলিক বা নাগরিক ধারণা চীনা কমিউনিজমেও নাই। কিন্তু তবু একটা কিন্তু করে রাখা হয়েছে। ডেকোরেটিভ (decorative) বা অর্নামেন্টাল (ornamental) অর্থে মানে বাংলায় বললে, কেবল অলংকারে সাজানো অর্থে পিপলস [peoples] শব্দটার ছড়াছড়ি আছে চীনে। যদিও এটা ঠিক পাবলিক বা জনস্বার্থ বলতে যা বুঝাই পিপলস এর অর্থ এখানে ঠিক তা নয়। খুব সম্ভবত দুনিয়ায় দ্বিতীয় কমিউনিস্ট বিপ্লব হিশাবে চীনা বিপ্লব; ফলে রাশিয়ান বিপ্লবের অনেক কিছুর দায় বা সাথে মিলিয়ে চীনের নিজের বিপ্লবকে ব্যাখ্যা করতে হয়েছিল। তাতে সোভিয়েত শব্দ ও ধারণাটা যেটা রাশিয়ান বিপ্লবের মুখ্য বৈশিষ্ট – যার একচুয়াল অর্থ পাড়া মহল্লা বা এলাকার প্রতিরোধ কমিটি। বাংলাদেশের সাথে তুলনায় আমাদের যেকোন আন্দোলনে যেটা আমরা বলি “সংগ্রাম পরিষদ” – এটাই সেই সোভিয়েত ধারণার বাংলাদেশীকরণ। [এটাই দাদা সিরাজুল আলম খানের এক সুচিন্তিত অবদান]।
রাশিয়ান বিপ্লবে লেনিন ও সহযোগীদের সমস্যা ছিল এটা কেমন বিপ্লব বলে তারা পরিচয় করাবে? তাদের বহুকাঙ্খিত রাশিয়ান কমিউনিস্ট বিপ্লবকে [তাঁরা ইউরোপে যেমন হয়েছিল রিপাবলিক বিপ্লব মানে রাজা-বাদশার শাসনের বিপরীতে প্রথম জনগণের শাসন বা পিপলস রিপাবলিক রাষ্ট্রগঠন বলে থাকে] – যেটাকে আবার কমিউনিস্টেরা তাদের চোখে বুর্জোয়া বিপ্লব বলে চিনিয়ে এসেছে – তাই তারা কোনভাবেই রাশিয়ান কমিউনিস্ট বিপ্লবকে এসব পুরানা শব্দের কোনটাই ব্যবহার করে চিনাতে চায় নাই। আর সত্যি সত্যি রাজধানী ক্রেমলিনের এলাকা এলাকায় প্রতিরোধ কমিটি বা সোভিয়েত গড়ে তুলেই এই বিপ্লব সংগঠিত হয়েছিল বলে এই সোভিয়েত বা প্রতিরোধ কমিটি গড়া ও নাম দেয়ার রেওয়াজ শুরু হয়েছিল যেটা থেকে কমিউনিস্ট সাহিত্যে একে সোভিয়েত বিপ্লব বলে চিনানোর।
কিন্তু এটাই আবার সমস্যা হয়ে যায় চীনের বিপ্লবের বেলায়। কারণ, চীনের ক্ষমতাদখলের ক্ষেত্রে তাদের স্টাইলে কোন প্রতিরোধ কমিটি বা সোভিয়েত গড়ে তা আগিয়ে নিয়ে এটা সম্পন্ন করা হয় নাই। তাই চীনে ‘সোভিয়েত’ শব্দের বিকল্প হিশাবে ‘পিপলস’ শব্দটা চালু করা হয়েছিল। আর মনে রাখতে হবে – এই পিপলস এর অর্থ ঠিক পাবলিক বা নাগরিক ধারণা একেবারেই নয়। কেন নয়? কারণ, শ্রেণী নির্বিশেষে কোন পাবলিক বা নাগরিক ধারণা কমিনিজমে নাই, শ্রেণী আছে। আর কমিউনিস্ট পার্টি তো কেবল শ্রমিক শ্রেণীর স্বার্থ রক্ষার্তে রাষ্ট্র কায়েম করেছে বলে পার্টি মনে করে।
আর এসব কারণেই, যেকোন কমিউনিস্ট ক্ষমতা দখলের পরে সবকিছুর মূলকর্তা হয়ে যায় পার্টি – মানে কেবল শ্রমিক শ্রেণীর স্বার্থ (আম-জনতার স্বার্থ নয়) রক্ষার জন্য ক্ষমতাদখল করেছে যে পার্টি। । তাও আবার এই মূলকর্তা বলতে কতদুর বুঝিয়েছি ? আসছি সেখানে, তবে এর আগে কিছু কথা। কমিউনিস্ট রাষ্ট্রে একারণেই নাগরিক সবারই কিছু মৌলিক ও কমন স্বার্থ রক্ষার জন্য বা সবারই মৌলিক অধিকারগুলো রক্ষার জন্য (রিপাবলিক) রাষ্ট্র গঠন করা হয় – এধারণাটাই কমিউনিজমে নাই, তাদের রাষ্ট্রে নাই। আছে কেবলমাত্র শ্রমিক শ্রেণীর স্বার্থ রক্ষার কথা। সবকিছু তাই সেখানে শ্রমিক শ্রেণীর স্বার্থের জন্য। এখন এতে আরেক সমস্যা তাহলে হাজির হয় যে তাহলে কেবল শ্রমিক শ্রেণীর স্বার্থের রাষ্ট্রে কোনটা শ্রমিক শ্রেণীর স্বার্থ তা বুঝা যাবে কী করে? এর জবাব থেকেই পার্টি ধারণাই মুখ্য কেন্দ্রীয় ক্ষমতার ধারণা হয়ে যায়। কেন? যেটা শ্রমিক শ্রেণীর পার্টি বলবে, সাব্যস্ত করবে সেটাই কেবল শ্রমিক শ্রেণীর স্বার্থ বলে বুঝতে হবে।
আর এভাবে সাব্যস্ত করাতেই কমিউনিস্ট সমাজে এরপর থেকে বিচার, ন্যায়বিচার, স্বাধীন বিচার ব্যবস্থা, বিচার প্রক্রিয়া ইত্যাদি যত সম্পর্কিত শব্দ আছে এর সবকিছু নাই ও বাতিল হয়ে যায় অথবা পার্টির হুকুমের অধীনে হয়ে যায়। কিন্তু ইনসাফ বা ন্যায় জিনিষটাই এমন যাকে স্বাধীন থাকতেই হয় নইলে তা ইনসাফ নয়। বিশেষ করে শাসক-ক্ষমতার অধীনে যে যেতেই পারে না। কারণ সেক্ষেত্রে এটা শাসকের ইচ্ছাই হয়ে যাবে। ইনসাফ-বিচার কখনই শুধু শাসক কেন, কারো অধীনের যেতে পারে না। তাহলে সেটা আর ইনসাফ-বিচার একেবারেই নয়। এটাই প্রিযুডিস। একারণেই, সেপারেশন অব পাওয়ার না থাকা, প্রিযুডিস (prejudice) হয়ে থাকে বা কোন আগাম অনুমান মাথায় নিয়ে বিচারক বিচার এজলাসে বসলে সেটা আর বিচার-ইনসাফই নয়, হবে না। অথচ কমিউনিস্ট দেশে খোদ পার্টি মানে শাসন ক্ষমতাও যার হাতে সেই-ই হয়ে আছে কার্যত বিচারকের ভুমিকায়। এজন্যই পার্টিই বিচারক বা রায় দাতা যে কে শ্রমিক শ্রেণী আর কে বুর্জোয়া তা কেবল পার্টিই বলে দিতে পারে! তাই চীনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এর অপরাধ কী? কে তার বিচার করেছে আর কিসের ভিত্তিতে এসবে বিচার সাব্যস্ত হয়েছে এনিয়ে চীনা পার্টি নিরুত্তর। কোন জবাব তারা দিবে না এটাই কমিউনিস্ট কালচার। ক্ষমতা চর্চার কালচার!। সবচেয়ে লোমহর্ষক কালচার!!! দুঃখের কথা, এটা রিপাবলিক বা মর্ডাণ যুগের রাজনৈতিক মুল্যবোধ চিন্তা ও চর্চা তো নয়ই এটা এরও পিছনের দিনের কোন মনার্কি [ monarchy] রাজতন্ত্র বা কোন রাজা-বাদশার কালেও যেটুকু বিচার ব্যবস্থা ছিল কমিউনিজম সেটুকুওও নয়। বরং এরও পিছনের পর্যায়ের কোন সমাজের চিন্তা ও চর্চার কাহিনী!!!
যেকোন মানব সমাজ জন্মানো শুরু হয় ন্যায় বা ইনসাফের ভিত্তি থেকেঃ
এটা বহু আগেকার প্রতিষ্ঠিত ও ব্যবহারিক সত্য যে যেকোন সমাজ জন্মানো শুরু হয় ন্যায় বা ইনসাফের ভিত্তিমূলক ধারণা থেকে। কথাটা আরও ভালভাবে বুঝবেন যেমন ধরেন কেউ কোন কাজ বা সেই কাজটা করে ঠিক করেছে কিনা এটা সেই সমাজ কী দিয়ে সাব্যস্ত হবে? সমাজ কী দিয়ে কিসের ভিত্তিতে তা সাব্যস্ত করবে? গায়ের জোর নাকি ন্যায় ইনসাফের ধারণায়? – এটা যেকোন সমাজের জন্য খুবই ফান্ডামেন্টাল প্রশ্ন!! অর্থাৎ – ন্যায়বিচার সংক্রান্ত মুল্যবোধ দিয়ে নাকি যার গায়ের জোর যার বেশি সেই সঠিক বলছে ধরে নিতে হবে? মনে রাখতে হবে ন্যায়বিচার সংক্রান্ত মুল্যবোধ বা ইনসাফের ধারণা এখানেই ধর্মতত্বেরও এক বিরাট প্রভাবক ভুমিকা আছে এবং থাকবেই। কাজেই এসব দিকগুলোকে একটা সংজ্ঞায়িত করা নাই এমন ক্ষমতা দিয়ে – পার্টিক্ষমতা দিয়ে সব রিপ্লেস করে ফেলবেন – এটা কখনও ঘটবে না,চলবে না! এটাই কমিউনিস্ট ক্ষমতার ফান্ডামেন্টাল ত্রুটি ও অযোগ্যতাই হয়ে আছে ও থাকবে; এই ত্রুটি প্রকাশ করতেই থাকবে।
তাই আমরা জোর দিয়ে বলতে পারি যে একটা নুন্যতম বিচার-ইনসাফ ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করতে পারলে – এই ইনসাফের ভিত্তিতে দাড়িয়েই কেবল সমাজ শুরু হয় হয়েছে এবং আছে। না হলে মানুষ এতদিন সকলকেই কেবল সারাদিন ডন-বৈঠক করে জিমে কাটিয়ে গায়ের জোরের চর্চা করত! কারণ অর্থ-সম্পত্তি ও ঘরের মেয়েদের রক্ষা করতে হবে তো!
এখন ইনসাফ প্রতিষ্ঠা মানে কী ধরণের বিচার ব্যবস্থা ও পদ্ধতি প্রতিষ্ঠা করা – সেটা কী কাজী ব্যবস্থা বা রোমের বিচার ব্যবস্থারই আধুনিকায়ন করে নেয়া কোন ব্যবস্থা – এমন যেকোন কিছুই হতে পারে। মানে বলতে চাচ্ছি মানুষের সমাজ আর এর সাথে একটা না একটা বিচার ব্যবস্থা একেবারে হাতে হাত ধরে হেঁটেচে তবেই কেবল আমাদের সমাজ সভ্যতাগুলো একালে পৌছিয়েছে।
আবার এর ভিতর একটা বড় তর্ক ছিল যে কেউ অপরাধ করেছে কীনা এটা কে সাব্যস্ত করবে? যে কেউ আঙুল তুললেই হবে? নাকি সবচেয়ে গুরুত্বপুর্ণ কথা, শাসক যদি আঙুল তুলে তাহলেই তা কী কেউ অপরাধী সাব্স্ত হওয়ার জন্য যথেষ্ট হবে? এরাই সদুত্তর ছিল না, বরং একটা বিচার ব্যবস্থা দাড় করাতে হবে। শুধু তাই না, সেই বিচারব্যবস্থার উপর শাসকের খবরদারি রোধ করে রাখা হয়েছিল। এটাই ইউরোপের অর্থে সেপারেশন অফ জুডিশিয়ারি তর্ক।
কিন্তু সরি! কমিউনিস্ট সমাজ বা কমিউনিস্ট আন্ডারস্টান্ডিং ঠিক এরকম এর ধারেকাছেই নয়। যেটা এতক্ষণ বললাম, এর মূলে আছে একদিকে এর কথিত শ্রেণী ধারণা আর অন্যদিকে পার্টিই সর্বময় ধারণা। আর এতে কোন বিচারবিভাগ নয়, পার্টিই সাব্যস্ত করে দিবে কেউ অপরাধী কিনা!
এমনিতেই কে কোন শ্রেণীর লোক তা সে নিজে বললে হবে না। পাটি যদি বলে কেউ বুর্জোয়া তো সে বুর্জোয়া। দ্বিতীয়ত, কমিউনিস্ট চিন্তা বলে কয়েই শুরু করে থাকে যে সে নিজে এক একনায়কতান্ত্রিক ক্ষমতা। আর এই একনায়কতান্ত্রিক ক্ষমতা বলতে তা এমনই যে যাকে সে বুর্জোয়া মনে করবে তার সাথে সে বলে কয়ে বৈষম্য করবে – সমান আইনি সুযোগ বা ন্যায়বিচার তাকে দিবে না। এটাই তার একনায়কতান্ত্রিক ক্ষমতা। প্রথমত কমিউনিস্ট রাষ্ট্র ধারণায় নাগরিক মাত্রই সবাই সমান অধিকারের নাগরিক – এই ধারণা সেখানে কাজ করে না, নাই। কারণ, কমিউনিজমে নাগরিক বলে কোন ধারণাই নাই। আছে কেবল শ্রেণী ধারণা; তাও সেটাও একমাত্র পার্টি ঠিক করে দিবে যে কে কোন শ্রেণীর লোক। তাই নাগরিক অধিকার বলেও কোন ধারণাই নাই। যদিও পাবলিক শব্দের ব্যবহারে যথেচ্ছচার আছে। যেমন আমাদের বাংলাদেশ ব্যাংক যা সাধারণ ভাবে আমাদের সেন্ট্রাল কন্ট্রোলিং ব্যাংক- এর ধারণা। চীনে এর সমতুল্য ব্যাংকের নাম PBOC। মানে হল পিপলস ব্যাংক অব চায়না। এমনকি দেশের নাম পিপলস রিপাবলিক অব চায়না [PRC]। সেনাবাহিনীর নাম পিপলস আর্মি ইত্যাদি।
আসল সমস্যাটা হল, পার্টি সবক্ষমতার অধিকারী এটা যতটা কনসেপ্টের সমস্যার এর চেয়েও বেশি সমস্যা তা হল, পার্টি কিসের ভিত্তিতে এই সিদ্ধান্ত নিয়েছে তা সে পাবলিককে বলবে না; জনসমক্ষে বলবে না। বিচারক যেমন রায় লেখার সময় তাকে রায়ের পিছনের সাফাইটা কী বা কোন আইনে দেয়া ক্ষমতা অনুসারে সে ঐ এই রায় দিচ্ছে সেই সাফাই, সেই ব্যাখ্যা লিখিত রায়ের সাথে জুড়ে দিতেই হবে। আর ঐ রায় তো ওপেন। তাই যে কেউ রায় যাচাই করতে পারে। কিন্তু কমিউনিস্টদের বেলায় তা এটা মানে না। অথচ এমনিতেই পার্টি হল শাসক তাই শাসক নিজেই আবার একই সাথে বিচারক হতেই পারে না। কোন প্রধানমন্ত্রী যদি প্রকাশ্যে ও সরাসরি বিচারকের ভুমিকা নেয় – এটা তেমনই এক ঘটনা হবে তাহলে। অথচ এটা তো কোন এথনিক-কালচারাল সমাজের সাধারণ ন্যায়বোধও অনুমোদন করে না। কিন্তু কমিউনিস্টদের বেলায় তারা এই “সেপারেশনের” ধারণা দূরে থাক তারা কোনকিছুই মেনে চলে না। তাদের শ্রেণী ধারণা এমই ঘামন্ডি, গোয়াড় একচোখা ও উদ্ধত!! আসলে এটা শুনতে খারাপ লাগলেও এটা মূলত এক বেইনসাফ বা অবিচারের ধারণা। এর উপর আবার পার্টি কোন আইনে বা কিসের ভিত্তিতে রায় দিচ্ছে সেটাও ত বলবেই না।
আর জনসমক্ষে পার্টির এই বলতে না পারার যে প্রাকটিস এরই বাইরের প্রকাশটা হল হঠাত করে লোকটার জনসমক্ষ থেকে গায়েব ডিসাপিয়ার্ড [dissappeared] হয়ে যাওয়া বা গায়েব করে দেওয়া। এজন্য হাসিনা আর কমিউনিস্টদের সখ্যতার ভিত্তি এটাই। কিন্তু একালে আসলে এটা কী চলে? চীনের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর বেলায়, এই গায়েব রাখার এসময়ে পার্টি তাকে বলপ্রয়োগ করে বাধ্য করেছে একটা স্বীকারোক্তি দিতে যে সেই দোষী বলে পদত্যাগ করছে বা সব মেনে নিচ্ছে। আর এই স্বীকারোক্তি পেলে এবার আবার তার জনসমক্ষে হাজির হওয়া তবে সব ক্ষমতা পদ নাই হয়ে থাকা অথবা পার্টি যা শর্ত দিয়েছে সে অনুযায়ী কিছু একটা তার নাই হয়ে যাওয়া বা থাকা।
এককথায় জনসমক্ষে কোন ন্যায়ের ধারনা পার্টি চর্চা করে না বা করতে পারে না বলেই এই গায়েবী কালচার!!!
এখন লেনিনের আমলে মানে, আজ থেকে একশ বছর আগে যা পার হয়ে গেছে যখন এই পার্টি ধারণা ও এর চর্চা শুরু হয়েছিল। এখন জনসমক্ষে এবং কোন ন্যায়ের ধারণার চর্চা ছাড়া কোন রাষ্ট্র প্রসঙ্গে ধারনা অচল ও অগ্রহণযোগ্যই হবে অবশ্যই। এর উপর আবার চীন যদি আগামিতে আমেরিকার মত না হলেও অন্তত কেবল অর্থনৈতিক অর্থে গ্লোবাল নেতা হতে চায় তাহলে এটা হবে নেতার গ্লোবাল পাবলিক বা সারা দুনিয়ার চোখে সবচেয়ে অগ্রহণযোগ্য স্বভাব-বৈশিষ্ট! এককথায় বললে, পার্টি-ক্ষমতা এই বিষয়টাকে এর – ন্যায্যতা প্রতিষ্ঠা করা এক ক্ষমতা – এভাবে হাজির করতেই চায় না। যা আসলে একটা কোটারি-ক্ষমতা মানে এক অলিগর্কি ক্ষমতা [oligarchy] করে রেখে দিতে চায়। একারণে, এটা বারবার কমিউনিস্ট ক্ষমতার ধারনা “এক অন্যায্য ক্ষমতা” – আনজাস্টিফায়েড ক্ষমতা হিসাবেই হাজির হতে থাকবে। আর এভাবে ক্রমশ চরম ভাঙনের দিকেই যেতে থাকবে; সোভিয়েত ক্ষমতা যেভাবে গিয়েছে।
জ্যাক মা সমস্যাঃ
জ্যাক মা রাজনীতিবিদ বা রাষ্ট্র অথবা ক্ষমতা সংফশ্লিষ্ট কেউ না; তিনি ব্যবসায়ী। নয়া আইডিয়ায় গ্লোবাল মার্কেটিং ব্যবসা এটা। এখন হতেই পারে তিনি অসৎ সুযোগ নিয়ে দেশের নয়ম ভেঙ্গে কোন ব্যবসায়িক ততপরতা করেছেন। কিন্তু তাকেও মাসের পর মাস গায়েব ডিসাপিয়ার্ড [disappeared] করে রেখে দেয়া হয়েছিল। এর অর্থ আইনিভাবে জ্যাক মা কে নিয়ন্ত্রণ করার কোন মেকানিজম চীনা কমিউনিস্ট রাষ্ট্র ব্যবস্থায় নাই। তাই নয় কী? চীনা রাষ্ট্রে এমন প্রকাশ্য আইনি বিচার ব্যবস্থা তাহলে নাই! তাই কী? তার মানে এই ডিসাপিয়ার্ড [disappeared] করে রাখার ব্যবস্থা – এটা তো কোন রাজা-বাদশার সমাজ-শাসন ব্যবস্থাতেও অচল। হয়ত কোন এক গোত্র-সমাজের ব্যবস্থায় তা ছিল!! এভাবে কিছুদিন পরপর ডিসাপিয়ার্ড [disappeared] করে রাখার ব্যবস্থা করে হবু গ্লোবাল নেতা চীনের কী ইমেজ বাড়তেছে? এর অর্থ চীনের রাষ্ট্র একটা নুন্যতম “স্বাধীন বিচার সিস্টেম” দাড় করাতে সবসময়ই অপারগ থেকে যাবে। এতে পার্টি মানে তাদের শ্রেণী-চিন্তায় এটা পারমিশেবল নয়, অ-অনুমোদিত থেকেই যাবে! চীন অন্তত তার চীনের ‘গায়েব’ কালচার দিয়ে কোন গ্লোবাল নেতা হতে পারবে না! তা এখনই বলে দেয়া যায়!
কোন রাষ্ট্রের আভ্যন্তরীণ রাজনীতি পর্যন্ত যুক্ত হতে চায় না চীনঃ
অনেকের মত আমারও ধারণা ছিল এই যে, গ্লোবাল নেতা হতে চায় চীন তাতে কোন অসুবিধা কী! কিন্তু এর মানে এই না যে আমেরিকার মত চীনকেও কোন রাষ্ট্রের আভ্যন্তরীণ রাজনীতি পর্যন্ত ঢুকে পড়তে হবে, হতেই হবে; এই অনুমান তো অবশ্যই ভুল। চীন তেমন হতে চায় না। অন্তত এখনই। কিন্তু টের পাচ্ছি আমাদের এই ধারণায় ক্রমশ চির ধরাচ্ছে চীন নিজেই। প্রথমত, কম্বোডিয়া। এটা খুবই এক বাজে উদাহরণ হয়ে উঠে এসেছে।
টানা গত ৩৮ বছর ধরে হুনসেন ক্ষমতায় আছেন। মানে খেমার রুজদের তান্ডব শ্রেণী শত্রুর নামে নির্বিচারে (পাঁচশ টাকার টংয়ের দোকানিকেও মালিক) বুর্জোয়া বলে হত্যার কমিউনিজমের শেষ পর্বে ১৯৮৫ সাল থেকে তিনি ক্ষমতা নিয়েছিলেন। এরপর [1991 Paris Peace Agreements] জাতিসংঘের অধীনে শান্তি চুক্তি এর সুবিধার সব মাখনটাও তিনি খেয়ে প্রধানমন্ত্রী থেকে গেছিলেন। কিন্তু ২০১২ সালের পর থেকে তিনি আরেক ত্রাস হয়ে উঠলেন।
গত ২০১৩ সালের সাধারণ নির্বাচনের সময় থেকে অনেক প্রত্যক্ষভাবে লক্ষ্য করছি কম্বোডিয়ার সব বিরোধীদলীয় নেতাদেরকে জেলে রাখা হয়েছে বা বিদেশে আশ্রয়প্রার্থী হতে বাধ্য করা হয়েছে। অথবা নানা উসিলায় দল নিষিদ্ধ বা নানা শর্ত আরোপ করে রাখা হয়েছে। সেসময়ের হংকংয়ের এক মানবাধিকার সম্মেলনে তাদের কয়েকজন প্রতিনিধি সাথে সাক্ষাতের সুযোগ হয়েছিল। জেনেছিলাম তাদের একদলীয় রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে বিরোধীদল শুন্য হয়ে থাকার ইতিকথা। এরপরে ২০১৮ সালের আর একবার একদলীয় নির্বাচন; পরে এবার ২০২৩ সালের একইভাবে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে। কিন্তু পরিস্থতির কোন উন্নতি বা পরিবর্তন নাই। বরং এবার আরো নিম্নমুখি অবস্থাটা হল, এতদিন হুনসেন তার ছেলেকে সেনাপ্রধান করে রেখেছিলেন। আর এবার এখন তিনি নিজে পদত্যাগ করে ঐ সেনাপ্রধান ছেলেকে প্রধানমন্ত্রী পদে বসাবেন; এর পরিকল্পনাতেই এবারের কথিত নির্বাচনটা হয়েছে। যা আমাদের পরিস্থিতির সাথে বহুলাংশে মিলে! যেটা বুঝে আসে না – কেন চীনকে আরেকটা দেশের একটা খেলনা নির্বাচনে জড়িত হতেই হবে। এত নিচে নেমে চীনের স্বার্থ উদ্ধার করতে হবে? চীনের এত কী ঠেকা? চীন কোন দেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে মাথা ঘামায় না – এটা কী এর উদাহরণ আর থাকলো? আর এভাবেই কম্বোডিয়া যেন চীনের যেন লাগাতর নিজ প্রভাবাধীন করে রাখতেই হবে সেও ব্রত পূরণ করবে সিদ্ধান্ত নিয়েছে – এই বেপরোয়া চীন এটা কেন???
মূল কথাটা হল, এতে কোন একটা দেশের আভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক ক্ষমতা সুস্থভাবে গড়ে না উঠে একে বরং মারাত্মক ব্যহত করে দেয়া হচ্ছে। এজায়গায় কম্বোডিয়ার সাথে বাংলাদেশের মিল আছে। এটা খুবই ভয়ংকর টেনডেন্সি। কম্বোডিয়া বা বাংলাদেশের মত দেশগুলো তাদের আভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক ব্যবস্থা ভেঙ্গে পড়ুক, এসব দেশগুলোর আভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক ক্ষমতার হাতবদলের ব্যবস্থা অসুস্থ হয়ে পড়ুক – সেটা কী চীনের কাজ এক্তিয়ার হতে পারে – এটা তো একেবারেই গ্রহণযোগ্য নয় বা কাম্যও নয়। তাতে সেটার জন্য দায়ী চীন অথবা আমেরিকা অথবা উভয়ের অসুস্থ প্রতিযোগিতা যাই হোক না এটা গ্সরহণ হ্য করা যায় না। নুন্যতম গ্রহণযোগ্যতা থাকতে পারে না। অন্তত এটা চীনের জন্য এক বিরাট আত্মঘাতি কাজ হচ্বেছে ও হবেই; যার অনেকটাই সম্ভবত ঘটা শুরু হয়ে গেছে। মাত্রার দিক থেকে বাংলাদেশের তুলনায় আগানো কম হলেও কম্বোডিয়া ইতমধ্যেই মারাত্মক বিপদজনক জায়গায় চলে গেছে। খুব সম্ভবত চীন অতিরিক্ত রিস্ক নেয়ার পথে হাটা শুরু করে দিয়েছে।
এটা হবু গ্লোবাল নেতা চীনের জন্য কোন পথ বা পদ্ধতি হতে পারে না। এটা চীনের জন্যই আত্মঘাতি ও নিজেকেই ক্ষতিগ্রস্ত করার পদক্ষেপ হয়ে দাঁড়াবে, দাঁড়াতে বাধ্য। একটা গ্লোবাল অর্ডার – রাষ্ট্রব্যবস্থায় উন্নতির বদলে একে আরও নিম্নগামি করা হবু নেতা চীনের আচরণ হতে পারে না; কাম্যও নয়। আমরা আমাদের দেশকে গুম-খুন আর অপহরণের দেশ করে গড়তে পারি না! কাউকে এলাও করতে পারি না। সেটা যেই বহিঃশক্তিই – চীন বা আমেরিকা – একাজে দানব সরকারকে সহায়তা করুক!
জঙ্গীদমনের নামে আমেরিকার বাংলাদেশকে ভারতের হাতে তুলে দেওয়া যেমন গ্রহণযোগ্য নয় ঠিক তেমনই, শ্রেণী শাসনের নামে চীন এর বাংলাদেশকে গুম-খুন আর অপহরণের দেশ বা সম্পদপাচার লন্ডারিংয়ের দেশ হওয়ার দিকে ঠেলে দেওয়া এটাও গ্রহণযোগ্য নয়। এসব থেকে তাদের অবশ্যই দূরে থাকতেই হবে। এটা কোন উদাহরণ হতে পারে না। আগে যেকোন বহিঃশক্তিকে এসব থেকে দূরে যেতে হবে। এরপরেই আমরা অর্থনীতি, বাণিজ্য, উন্নয়ন, অবকাঠামো ঋণ সহায়তা ইত্যাদি দিকে সবার সাথেই একমাত্র সম্পর্কিত হতে চাইবে।
এছাড়া নয়া কোন গ্লোবাল নেতা মানেই আমাদের বুঝতে হবে এর শুরুতেই খোদ জাতিসংঘের একটা সংস্কার হতে হবেই। আর তাতে কী এমন হস্তক্ষেপ এটাই নয়া জাতিসংঘের রেওয়াজ হবে???? আমাদের মত দেশগুলো চীনা সমর্থনে গুম-খুন আর অপহরণের দেশ হয়ে উঠবে??? বুঝাই যাচ্ছে চীন এসব বিষয়ে এখনও নাদান!
যারা বাংলাদেশকে ইতোমধ্যেই গুম-খুন আর অপহরণের দেশ বা সম্পদপাচার লন্ডারিংয়ের দেশ বানিয়েছে অথবা যারা এতে সমর্থন দিয়ে নিজের ভাগ্য গড়েছে সেসব দলগুলোর সাথে চীনের ঘনিষ্ঠতা বাড়ানো আমরা খেয়াল করেছি। দেশে রাতের ভোটে ক্ষমতাসীন হবে আর চীন তাদের এই কথিত ভোটের খরচ যোগানো দেশ হয়ে উঠবে এটা চলতে পারে না, এটা কাম্য নয়। তার মানে – আভ্যন্তরীণ রাজনীতি পর্যন্ত চীন যুক্ত হতে চায় না – এটা আর সেই চীন নয়। এটাই হতে যাচ্ছে। তাই যথেষ্ট ভেবেচিন্তে এবিষয়ে চীনকে সিদ্ধান্ত পদক্ষেপ নিতে হবে। বলাই বাহুল্য এমন পদক্ষেপ এগুলো একেবারেই কাম্য নয়! আর এতে চীনের কোন গ্লোবাল সম্ভাবনা কিছু ঘটবার আগেই সব ভেঙ্গেচুড়ে মুখ থুবড়ে পড়তে বাধ্য!!!
এককথায় চীন নিয়েও একালে এখন আমাদের পশ্চিমাদেশের মত উদ্বিগ্নতা বাড়ছেই! যা চীনের জন্য ভাল লক্ষণ নয়!!!
আপডেটেডঃ ০৬ আগষ্ট ২০২৩; দুপুর ১১ঃ০২
আপডেটেডঃ ২০২৩;
>>>
গৌতম দাস
রাজনৈতিক বিশ্লেষক
goutamdas1958@hotmail.com

