জেনারেল আজিজের উপর আমেরিকান নয়া ‘পদক্ষেপ’ কেন?
গৌতম দাস
২১ মে ২০২৪
https://wp.me/p1sCvy-5DG

গতকাল দুপুর থেকেই খবরটা ঢাকায় ক্রমশঃ ছড়িয়ে পড়ছিল যে সাবেক এক ‘বাংলাদেশ আর্মি চীফ’ জেনারেল আজিজ আহমেদের বিরুদ্ধে আমেরিকান অসন্তোষ বা এনিয়ে তাদের “নয়া পদক্ষেপ” এর খবর। আজ ডেইলিস্টার লিখেছে, “আমেরিকা আজিজ আহমেদ ও তাঁর নিকটাত্মীয়দের উপর [“United States has imposed sanctions on former chief of Bangladesh Army Aziz Ahmed and his immediate family…”] স্যাংশন দিয়েছে। এলেখায় বেশির ভাগ সময় জেনারেল আজিজকে নিয়ে আমেরিকান বিবৃতিকে আমি “আমেরিকান পদক্ষেপ” বা শুধু “পদক্ষেপ” বলে চিহ্নিত করব। যদিও ডেইলি স্টার সহ অনেক মিডিয়াই এটাকে স্যাংশন আরোপ করা বলেছে। আর এর বিপরীতে আমেরিকান বিবৃতিতে স্যাংশন শব্দটা দেখিনি। তাই, এই বতর্ক থেকে দূরে থাকতে একে “আমেরিকান পদক্ষেপ” বলব এখানে।
“আমেরিকান পদক্ষেপ” বলতে শব্দে যাই থাক, বাংলাদেশে সামাজিকভাবে এক বড় খুশির প্রতিক্রিয়া হয়েছে দেখার মত। এতে লক্ষ্যণীয় যে, বিগত দুবছরের সরকারবিরোধী আন্দোলনকালে যারা আমেরিকান সাপোর্ট ও সহায়তার ব্যাপারে গভীরভাবে বাইডেন-লু এর আমেরিকার উপর “রাজনৈতিক আস্থা” রেখেছিল; গভীর নির্ভরশীলতায় আপন বোধ করত প্রবল খুশির প্রতিক্রিয়া এসেছে মূলত তাদের থেকে। কিন্তু এসব সত্বেও , সেসময়ে এরাই আবার বাধ্য হয়েছিল নির্বাচনের আগে যখন আমেরিকা নিজেই নিজ কমিটমেন্টের উলটা ঘুরে গিয়ে বাংলাদেশকে ফেলে পালিয়ে গিয়েছিল শুধু না, একেবারে “বিজয়ী” হাসিনার কোলে গিয়ে উঠেছিল; আর তা দেখে লজ্জায় মারা গিয়েছিল যারা মূলত তারাই এবার জেনারেল আজিজের বিরুদ্ধে আমেরিকান পদক্ষেপ দেখে আর নিজেদের চাপা কষ্ট বা প্রতারিতবোধের কষ্ট আর লুকিয়ে রাখতে পারে নাই। বাংলাদেশের এই “আমেরিকা সমর্থক গোষ্ঠি” লজ্জায় মরমে মরে গিয়েছিল, নির্বাচন ঘটে যাবার পর থেকে এতদিন পর্যন্ত। বিশেষ করে এখন বাইডেন-হাসিনা নাকি “কেমন জানি বন্ধু” যা নিয়ে আবার মন্ত্রী ওবায়দুল কাদের উচ্ছ্বাস জানিয়ে বিএনপিকে টিটকিরি দিয়ে কথা বলে চলেছে। এদিকে আমেরিকার ধারণা তারা একসাথে বাইডেন-হাসিনা ‘কী জানি’ [ইন্দো-প্যাসেফিক স্ট্রাটেজি] উতযাপনও শুরু করে দিয়েছিল ইত্যাদি! তাই গত চার-পাঁচ মাস “আমেরিকা সমর্থক গোষ্ঠি”দের কেটেছে এসব নখড়া দেখতে দেখতে! অতএব পালটা এবার এদের উচ্ছ্বাসের প্রতিক্রিয়াই ছিল আজ দেখার মত। যেন তারা বলতে চাচ্ছে – তাদের প্রিয় আমেরিকা অনেক সুইট – এরা বিট্রে করে না, ফেলে পালায় না ইত্যাদি। মানে যেন সিনেমার ডায়লগের ভাষায়, উদ্ধার করতে ‘মেরা অর্জুন [এখানে আমেরিকা] জরুর আয়েগা”। কিন্তু আসলেই কী তাই? এটার মানে কী আমেরিকার ফিরে এসেছে? আমেরিকা কী ফিরে এসে গেছে? বা আসবে?
বলা বাহুল্য উচ্ছ্বসিত এই আমেরিকা সমর্থকেরা কঠোর সরকারবিরোধী; তারা সরকারের পতন দেখার জন্য উন্মুখ বহুদিন থেকেই জেনুইনলি। কিন্তু তারা সকলে কী তা এবার দেখতে পাবে?
এনিয়ে আমার মন্তব্য ও পরামর্শ হবে – এখনও উচ্ছ্বসিত না হয়ে “ধীরে চলেন”। প্রচুর [if, not, but’] এসবের যদি, কিন্তু আছে সামনে; সেসব ব্যাপারে – আমেরিকা কী অবস্থান নেয় সুযোগ থাকে; পরিস্থিতি কতটা আমেরিকার ফেবারে থাকে বা আমেরিকা চায় তা এখনও অনিশ্চিত। আর সবচেয়ে বড় কথা আমেরিকা যাদের ভরসায় বা যাদের সমর্থন পেতে বা খুশি করতে চেয়ে বা লক্ষ্য করে এই “পদক্ষেপ ঘোষণা” নিয়ে থাকুক না কেন বাংলাদেশের সেই রাজনৈতিক অংশ কী আমেরিকাকে আগের মতই গ্রহণ করবে? এটাই এখন একেবারেই অনিশ্চিত। যেমন, মির্জা আলমগীর প্রতিক্রিয়া দেখা যাক!
আজ বিএনপি সাধারণ সম্পাদক মির্জা আলমগীর প্রতিক্রিয়াঃ
আজকে বিএনপি সাধারণ সম্পাদক মির্জা আলমগীর প্রতিক্রিয়া জানিয়ে বলেছেন, “আজিজ আহমেদের নিষেধাজ্ঞা আরেকটা বিভ্রান্ত করাঃ মির্জা ফখরুল”। এর সোজা মানে হল, আমেরিকা আগেও বিভ্রান্ত করেছে তাই আবার আরেকটা বিভ্রান্তি আনা বলেই দেখতে চাচ্ছে বিএনপি – আমেরিকান এই পদক্ষেপকে! কেন তিনি এমনটা বললেন সেটা বুঝার চেষ্টা করতে পারেন আমেরিকা সমর্থকেরা। উচ্ছ্বসিত আমেরিকা সমর্থকদের মত করে, আলমগীর সাহেবেরও তো অন্তত ইতিবাচক মন্তব্য করার কথা! কিন্তু এই মন্তব্য অন্তত নেতিবাচক! কিন্তু সেটাই বা কেন? এছাড়া আরেকটা কথাও তিনি ওখানে বলেছেন। আলমগীর সাহেব বলছেন – “নিজের ঘরকে যদি নিজে সামলাতে না পারি, অন্য কেউ সামাল দেবে না। নিজের শক্তি নিয়ে দাঁড়াতে হবে, নিজের শক্তি দিয়ে তাদের (আওয়ামী লীগ) পরাজিত করতে হবে”। এই বাক্যের মূল শব্দ নিজের শক্তিতে দাঁড়ানো, আমেরিকার না। এদিকটা মনোযোগ দিয়ে বুঝতে হবে।
কাজেই আমার মন্তব্য ও পরামর্শ হবে – বাংলাদেশের “উচ্ছ্বসিত আমেরিকা সমর্থক”, আপনারা একেবারেই ধীরে চলেন; স্থির হয়ে নেন আগে! আর সমস্ত স্ব-সক্ষমতা দিয়ে পরিস্থিতি বুঝতে ও ব্যাখ্যা পেতে চেষ্টা করেন সবার আগে। এর আগে কোন মুভ করলে ভুল হবে।
এখন কেন এই আমেরিকান পদক্ষেপঃ
জবাবটা এবার এখানে খাড়া বলে ফেলি। ভারতের নির্বাচনে মোদি নাকি এবার হেরে যাবেন। আমেরিকান এই পদক্ষেপ এমন এই অনুমানের উপর নির্ভর করে নেয়া হয়েছে; যেটা এখনও ঘটে নাই। আগামি ৪ জুনে প্রকাশিতব্য ভারতের নির্বাচনী ফলাফলে মোদি হেরে গেছে – এটা আমেরিকাসহ আমরা সকলেই শুনতে পাব হয়ত। এই হল সেই অনুমান। সোজা কথা এটা এখনও ঘটে নাই; ঘটতেও পারে!
তাই বলাই বাহুল্য যদি উলটা হয়। মানে মোদি যদি নিজেকে বিজয়ী বলে ঘোষণা দেখাতে পারেন তবে সেক্ষেত্রে বলাই বাহুল্য – “আমেরিকার পদক্ষেপের” এখানেই আপাতত ইতি হয়ে যাবে।
তবে মির্জা ফকরুলের নেতি-প্রতিক্রিয়ার কারণ ভিন্ন। এর সাথে আমরা যেন আবার আমেরিকার ভাবনা বা অনুমানের সাথে সম্পর্কিত করে না দেখি; এটা সম্পর্কিত নয় তাই। সেটা বিএনপির নিজস্ব আলাদা কারণ।
এখন আমার অনুমান হাসিনা বা মোদি সরকারও খুব নিশ্চিত নন যে আমেরিকা বা বাইডেন-লু ঠিক কী বুঝে এমন বেমাক্কা এক পদক্ষেপ হাঁকালেন? বিবৃতির কাগজে আমেরিকা “ডেজিগনেশন” [designation] এই শব্দটা ব্যবহার করেছে। মানে নামকরণে সাবেক জেনারেল আজিজকে অপরাধী বলে চিহ্নিত করে ফেললো।
তবে আমি মন্ত্রী হাসান মাহমুদ যে কথা বলেছেন যে আমাদের সরকার জানত দুদিন আগে বাংলাদেশের আমেরিকার এমবেসিকে বাইডেন প্রশাসন জানিয়েছিল, এনিয়ে কিছু বলছি না।
আরেকটা কথা, হাসান মাহমুদ যে কথা বলেছেন যে – এটা “ভিসা স্যাংশন নয়” – একথা কিন্তু সত্য [US sanction on Aziz not under visa policy: foreign minister]। বরং অরিজিনাল স্টেট ডিপার্টমেন্টের বিবৃতিতেও স্যাংশন বলে কোন শব্দই নাই। এছাড়া আমেরিকার ঐ বিবৃতিতে আজিজ ও তাঁর নিকটাত্মীয়দের – আমেরিকায় প্রবেশ নিষেধ বা সম্পত্তি বায়োজাপ্ত ইত্যাদি কোন শব্দাবলীও নাই।
কেবল একটাই শব্দ আছে “ডেজিগনেশন”। মানে, বাংলায় বললে “চিহ্নিত করা” ধরণের বা নামকরণ করা যেন। তাই বলছে, আমেরিকান প্রশাসন সাবেক জেনারেল আজিজকে দুর্নীতিবাজ যা বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠান ধবংস বা বিশ্বাসযোগ্যতা নষ্ট করেছে। এই হলো অভিযোগ ও নামকরণ। একথা অবশ্যই বেশ ওজনদার! কিন্তু সেজন্য আমেরিকার দিক থেকে শাস্তি কী বা শাস্তিমূলক পদক্ষেপ কী আরোপ করা হবে – এধরণের কোন বাক্য আর সেখানে নাই। তবে কোন আইনে এই ডেজিগনেশন এর একটা ধারা নম্বরউল্লেখ করা আছে; তা হল [7031(c)] । হতে পারে ঐ ধারার বিস্তারে কোন শাস্তির কথা লেখা আছে। তবে আপাতত আমরা তা জানি না।
তাই, উপরে আমি লিখেছে, জেনারেল আজিজের উপর স্যাংশন আরোপ করা হয়েছে। হা বলেছি তবে নিজ বরাতে না। বলেছি ডেইলিস্টারের বরাতে। বিবৃতিতে স্যাংশন শব্দটাই নাই আগেই বলেছি; আমি গত রাতে পড়েছি। তাই ঢাকার মিডিয়ায় কীভাবে আসছে এমনকি হাসান মাহমুদ তিনিওও স্যাংশন আরোপ হয়েছে বলেছেন।
তাহলে মূলকথাটা হল, আগামী ৪ জুন ভারতের নির্বাচনী ফলাফল প্রকাশের দিন। এদিন যদি মোদিই হেরে গেছেন বলে প্রকাশিত হয় তবেই আমেরিকান বিবৃতি আরো পাতা খুলে ফুলে-ফলে বিকশিত হয়ে উঠতে চাইবে। এবং সেক্ষেত্রে খুব দ্রুতই বহু বহু সব ঘটনা ঘটবে। ইতোমধ্যেই অবশ্য ভারতে রাষ্ট্রক্ষমতার করিডোরে প্রবল আলোড়ন বয়ে যাচ্ছে যে মোদি এবার হারছেন। ভারতের যত জুয়ার আড্ডা আছে বড় বড় সব বিখ্যাত ডেরা সেখানে মোদি হেরে যাওয়ার পক্ষে বাজি ধরা জুয়ারি লোকের সংখ্যাই বেশী, রেটও হাই। এটা একটা খুবই তাতপর্যময় তথ্য! ইতোমধ্যে ভারতীয় শেয়ার বাজারও সব বিক্রি করে দাম ফেলে মানে আগে নিজ বিনিয়োগ বাচাও – এমন জোয়ার তুলেছিল আমরা দেখেছি। আার অন্যদিকে, ভারতে ভোটপ্রদানের % যদি ৬০ এর নিচে যায় তবে মনে করা হয় এটা মোদির হারার লক্ষণ! সেটাও চারপর্বের পর থেকে দেখা যাচ্ছে!
তবুও আমার শেষ কথা, এমন যত আলামতই দেখা যাক না কেন – মোদির হাতে থাকা “ভোট বাক্সকে সফটওয়ার ম্যানিপুলেশনের সক্ষমতা” যদি অকার্যকর হয়ে থাকে তবেই একমাত্র তবেই, উপরে যা বলেছি তা সত্য হতেও পারে, নইলে মোদি নিজেকে বিজয়ী ঘোষণা করবেনই আগেরবারের মতই!!
এবার এক বাক্যে বলি, যদি মোদি হেরে যায় তবে সবচেয়ে কঠিন সঙ্কটে পড়বে হাসিনা সরকার! আর হবু সেটাই আমেরিকার পদক্ষেপের মূল লক্ষ্য!
নিচে আমেরিকান বিবৃতিটা সেঁটে দেয়া হলঃ
Designation of Former Bangladesh Official for SIGNIFICANT Corruption:
Designation of Former Bangladeshi Official for Significant Corruption
The U.S. Department of State announced today the public designation of former General Aziz Ahmed, previously Chief of the Bangladesh Army Staff, due to his involvement in significant corruption. His actions have contributed to the undermining of Bangladesh’s democratic institutions and the public’s faith in public institutions and processes.
Aziz Ahmed engaged in significant corruption by interfering in public processes while helping his brother evade accountability for criminal activity in Bangladesh. Aziz also worked closely with his brother to ensure the improper awarding of military contracts and accepted bribes in exchange for government appointments for his personal benefit.
This designation reaffirms the U.S. commitment to strengthening democratic institutions and rule of law in Bangladesh. The United States supports anticorruption efforts in Bangladesh through assistance to make government services more transparent and affordable, improve the business and regulatory environment, and build capacity in investigating and prosecuting money laundering and other financial crimes.
These public designations are made under Section 7031(c) of the annual Department of State, Foreign Operations, and Related Programs Appropriations Act. This action renders Aziz and his immediate family members generally ineligible for entry into the United States.
লেখকঃ
গৌতম দাস, রাজনৈতিক বিশ্লেষক
goutamdas1958@hotmail.com
[এই লেখা কোন নিউজ নয়, ব্যক্তির নিজস্ব রাজনৈতিক বিশ্লেষণ মাত্র। ফলে পাঠকের এ’লেখা পড়ে কিছুই বহন করা বা মান্য করার বাধ্যবাধকতা নাই। কেবল জানলেন যে এমন একটা মতামত আছে!]
আপডেটঃ ২১ মে ২০২৪ রাত ১১ঃ ২৬
শেষ আপডেটঃ ২৩ মে ২০২৪, ভোর ০৫ঃ ৪৬

