আফগানিস্তানের সম্ভাব্য আগামী


আফগানিস্তানের সম্ভাব্য  আগামী

গৌতম দাস

২৫ অক্টোবর ২০২১, ০০:০৬

 

চলতি অক্টোবরের প্রথম সপ্তাহে আমেরিকান উপপররাষ্ট্রমন্ত্রী ওয়েন্ডি শেরমান [Wendy Ruth Sherman ] ভারত সফরে এসেছিলেন। দুই দিনের সফরে তিনি প্রকাশ করেননি, তিনি ফেরার সময় আর কোথায় যাবেন; যদিও ধরে নেয়া হয়েছিল তিনি কেবল ভারতে এসেছেন, আর আফগান-তালেবান ইস্যুতে বেদিশা হয়ে থাকা ভারতকে দিশা ও রাস্তা দেখাতে আসছেন। দিশা কতটা দেখাতে পারছেন, সেটা নিয়ে আমরা আজ কিছু কথা বলব। কিন্তু এর চেয়েও, দিশা দিতে এসে শেরমানও বুঝে গেছেন যে, ভারত একটা দেখানো ঘামবড়া আর ফুটানিতে চলতে চায় এমন দেশ। ফলে শেরমান তার ভারত ছাড়ার আগে যখন প্রকাশ পেল তিনি পাকিস্তান হয়ে ফিরবেন (শুধু তা-ই নয়, তিনি আসলে পাকিস্তান সফর শেষে  এরপরে আবার তালেবানদের আফগানিস্তান হয়েও ফিরেছিলেন) তখন সেটা শুনে ভারত তার ভান-ভণিতা আর ভারত যেন খুবই উচ্চবংশীয় – এই মিথ্যা ফুটানি প্রদর্শন তুঙ্গে উঠেছিল। তারা তখন শেরমানকে অভিযুক্ত করেছিল এই বলে যে  তিনি ভারত-পাকিস্তানকে সমান পাল্লায় মাপছেন। মানে বলতে চেয়েছেন, পাকিস্তান ভারতের সমতুল্য নয়, বরং ভারত অনেক শুদ্ধ বা পবিত্র। কাজেই এতে ‘ভারত-পাকিস্তান’ এভাবে মাঝখানে হাইফেন দিয়ে লেখা (হাইফেনেটেড, hyphenated) শুরু হয়ে যাবে। সেটা নাকি ভারতের জন্য ‘অপমানজনক’! এতে শেরমান বুঝে যান তিনি কোনো ভয়ঙ্কর পেটি কালচারাল খপ্পরে পড়েছেন। উপায়ন্ত না পেয়ে তাই তখন তিনিও তেল ঢালা শুধু করেছিলেন। আর যে কথার আড়ালে যেটা বলে পার পেতে চেয়েছিলেন তা হলো – পাকিস্তানের সাথে আমি কোনো গভীর ভালোবাসায় জড়াতে যাচ্ছি না। আমার ‘খুবই সুনির্দিষ্ট আর ছোট্ট একটি কাজ’ [very specific and narrow purpose]আছে; তাই যেতে হচ্ছে। অর্থাৎ কোনো পুরুষ যখন তার এক প্রেমিকার কাছে ধরা পড়ে যায় তার অপর প্রেমিকার খবরসহ – সেই দশায় তিনি। শেরমান নাকি তখন বলেছিলেন, “ভারতের সাথে আমেরিকার যে সম্পর্ক সেই লেভেলের কোনো দিন পাকিস্তানের সাথে হবে না। কিন্তু সেটা কেউ ভালো করে না ছাপানোয় ভারত আবার সেটা নিজেই লন্ডন গার্ডিয়ান পত্রিকায় ছাপানোর ‘বন্দোবস্ত’ করেছিল। এ ঘটনা জেনে আমাদের মনে হতে পারে ভারত আসলেই খুবই উচ্চবংশীয় কালচারের দেশ!

কিন্তু শেরমান পাকিস্তান থেকেও আমেরিকা ফেরেননি। এরপরে গিয়েছিলেন আফগানিস্তানে এবং সরাসরি তালেবানের সাথে একই টেবিলে মুখোমুখি বসে মিটিং করে গেছেন। কিন্তু কেন আফগানিস্তানে আর তালেবানদের সাথে মিটিং? যখন শুধু আমেরিকা কেন, বলতে গেলে কোনো রাষ্ট্রই এখনো যে তালেবান সরকারকে আনুষ্ঠনিক স্বীকৃতি দেয়নি। তবে এ কারণে  ভারতের অসুবিধা হয়নি; কারণ ভারতের হিন্দুত্বপ্রেমী ভোটারদের দৃষ্টি-আগ্রহের ততদিনে এসবের বাইরে চলে গিয়েছিলেন শেরমান। আসলে মোদির নিজের তৈরি যে খাঁচা সেখানে তিনি নিজেকে বন্দী দেখাতে বাধ্য হন যে, তিনি বিদেশী কূটনৈতিক দেখা সাক্ষাৎ সম্পর্কগুলোর মধ্যেও ক্রমেই মুসলমান বা পাকিস্তান কোপানোর একমাত্র নেতা এবং সফল হিন্দুবাদী নেতা তিনি। আর এটা দেখিয়েই তিনি ভোটের বাক্স ভরিয়ে ক্ষমতাসীন আছেন। যদিও কাহিনী হল, নয়নীমা বসু প্রমুখের মত কূটনৈতিক সংবাদদাতাদেরও তবু মোদির হিন্দুত্বপ্রেমি ভোটারকে দেখানোর এসব মিথ্যা ভাব-ভনিতার সেনসিটিভিটির দিকে খেয়াল রেখে তেমন শব্দ বেছে রিপোর্ট লিখতে হয়।

শেরমানের দেশ আমেরিকা আফগানিস্তানকে স্বীকৃতি না দেয়া সত্ত্বেও তার আফগান সফর এবং ফ্লাইট-এয়ারপোর্ট ঠিকমতো ন্যূনতম থিতু হয়ে চালু শুরু না হওয়া সত্বেও এক আমেরিকান মন্ত্রী হিসেবে তার আফগানিস্তান গিয়ে সরাসরি তালেবানের সাথে মিটিং – সেটা এক বেশ উল্লেখযোগ্য ঘটনা বৈকি। যখন  এ’ঘটনাটাকে তালেবানদের অনেকে আমেরিকার ওপর তাদের ‘বিজয়’ বলে দেখার আগ্রহ আছে। যা এমনকি আমাদের দেশেও অনেকের।

এমন আরো কথা হল – তালেবান, ২০ বছর ধরে আমেরিকার হাতে মার্জিনালাইজড বা চাপা পড়ে থাকা জনগোষ্ঠী বলে তাদের মনেও ক্ষোভ কম নয়; বরং এমন হওয়ারই কথা। আর হতেই পারে তারা সেটা প্রকাশ করেছিল পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ইমরান খানের সংস্পর্শে কখনো আসার কালে, যা মোটেও অসম্ভব নয়; কারণ আমরা দেখেছি ইমরান খান তাদের মুখপাত্র হয়ে যেন আমেরিকাকে একটু বকা দিতে গেয়েছিলেন। সিএনএনের সাথে ইন্টারভিউয়ে বলেছেন, এবারের তালেবান উত্থানের কারণে গত ২০ বছরের আমেরিকান চাপ-নির্যাতন থেকে আফগানরা মুক্তি পেয়েছে। আবার ইমরান একইভাবে ক্ষোভ প্রকাশ করেছিলেন এই বলে যে, গত ২০ বছর আমেরিকা পাকিস্তানকে ‘ভাড়া করা অস্ত্রের মতো ব্যবহার’ করেছে [US treated Pakistan like a ‘hired gun’ in its fight against Taliban, says Imran Khan]। গত ১৫ আগস্টের পর ইমরানের এধরনের কড়া কথাগুলো আমেরিকার ভালো হজম হয়নি। আবার কথাগুলোতে অনেক খানিকটা সত্যতা তো আছেই। ইমরান নিজের দেশের অভিজ্ঞতা হিসেবে দ্বিতীয় কথাটা বলতে পারতেন হয়ত, কিন্তু তালেবানদের জন্যও তাদের মুখপাত্র ও নেতা হতে চেয়ে আমেরিকাকে দায়ী করে কিছু বলা্র কারণে হয়ত আমেরিকানরা এটাকে “একটু বেশি কথা” হিসেবে দেখেছে। ফলে শেরমান ঐ সফরে ইমরানের সাথে সাক্ষাৎ করেননি; যদিও করবেনই এমন  নির্ধারিত কোন শিডিউল ছিল না।

এদিকে আরো অন্য কিছু মূল কথা, আমেরিকান সেনা প্রত্যাহারের পর আমেরিকাসহ পশ্চিমা দেশের আর পাকিস্তানকে প্রয়োজন নেই বা ফুরিয়েছে –  এখনকার বাস্তবতা কিন্তু এর একেবারেই ধারেকাছেও নয়। বরং উল্টো; আমেরিকাসহ পশ্চিমা দেশের পাকিস্তানকে এখন আরো বেশি দরকার তবে ভিন্ন কারণে। লন্ডন ইকোনমিস্ট সে কথা স্মরণ করিয়ে দিয়ে সম্প্রতি এক আর্টিকেল ছেপেছে।  আবার আরও ধারালো আরেক মন্তব্য করেছে [It is too important—and dangerous—to ignore] আবার পাকিস্তানেরও আমেরিকাকে আর তেমন দরকার নেই, পরিস্থিতি সেটাও নয়। আজকের পাকিস্তান অর্থনৈতিকভাবে আমেরিকা ছেড়ে অনেক বেশি চীন নির্ভরশীল হলেও এটা কোনো ‘আমেরিকা অপ্রয়োজনীয়’ ধরনের অবস্থা নয়। তাই মাঠের সাধারণ নাগরিকের ভাষায়, কোনো প্রধানমন্ত্রীর আমেরিকার সাথে বা নিয়ে কথা বলতে যাওয়ার কিছু দিকটা ধরলে এই আমলনামাতে একটা ভুল তো এখানে আছেই। ব্যাপারটাকে সেভাবে দেখতে পারি আমরা।

এটাকে ভুল বলার অন্য আরো যে বিশেষ কারণ, তা এখন বলব। প্রথমত, এবারের সেনা প্রত্যাহার করার পর বাইডেন প্রশাসনের কারো, মানে শেরমানের এই পাকিস্তান সফর একেবারের ভিন্ন ও নয়া তাৎপর্যের। এটা অবশ্যই আমল করতে হবে। এটা এক নয়া যুগের। কারণ আগের ২০ বছর আমেরিকা-পাকিস্তান সম্পর্ক ছিল এমন যে, আমেরিকার বুশ প্রশাসন আফগানিস্তানে হামলা চালাতে চায় তাই হামলার লঞ্চিং প্যাড হিসেবে আমেরিকার পাকিস্তানকে দরকার ও তাকে আমেরিকা বাধ্য করবে – এই যে “সম্পর্ক” – সেটা এতদিন বজায় থাকলেও সময় এসেছে এবারই প্রথম সেই শর্ত আর নেই। পাকিস্তানও এসব বাধ্যবাধকতা থেকে এখন একেবারে বাইরে ও মুক্ত। আর এই নয়া মুক্ত পরিস্থিতিতে শেরমান পাকিস্তান সফরে এসেছেন। অতএব এই নয়া পরিস্থিতির উপলব্দি – তা থেকেই সব পক্ষের দেখা উচিত। ফলে কথাবার্তা বা নতুন প্রস্তাব নিয়ে আলোচনার সময় এ নিয়ে সব পুরনো রেফারেন্স বাদ দিয়ে বরং নয়া এই পরিস্থিতির মধ্যে নয়া সম্পর্কের কাল হিসেবে কথা বলতে পারতে হয়েছে বা হবে এখন থেকে উভয়পক্ষকে।

কিন্তু সাবধান, উপরের এসব ঘটনার সাথে আরো কমন কিছু ইস্যু সামনে। সেগুলো  হলঃ
১. তালেবান এখনো কোনো সরকার গঠন করতে পারেনি।
২. তারা এখনো এক আমিরের আফগানিস্তান নিয়ে আঁকড়ে পড়ে আছে। রাজা আর জনপ্রতিনিধির ফারাক বুঝতে চাইছে না।  ফলে অবলীলায় রাজা বা আমিরের পক্ষে দাঁড়িয়ে যেতে পারছে। এযুগেও জনপ্রতিনিধি হবার যুগ ফেলে রাজা হতে চাইছে তা স্পষ্ট না। আমিরের দেশে আমিরই দেশের মালিক এখানে কোনো নাগরিক থাকে না, সব হুকুমের বান্দা থাকে। এখানে দেশ গড়ার কিছু থাকে না। আমিরের খেয়াল থাকে। অথচ এক আমিরাতই তাদের লক্ষ্য।

৩. সবচেয়ে ভয়াবহ ও বিপদের কথা হল, আমেরিকান ভোয়া [VOA] লিখছে,  জাতিসঙ্ঘসহ সারা পশ্চিম যেটা নিয়ে উদ্বিগ্ন, তা হলো- প্রায় ১০ লাখ শিশু না খেয়ে মরার মুখোমুখি, প্রায় ১৮ লাখ দুস্থ মানুষ যারা জাতিসঙ্ঘের মানবিক নানান ধরনের সাহায্যের ওপর নির্ভরশীল প্রভৃতি। এসব মানবিক সাহায্য তালেবান সরকার স্বীকৃত নয় বলে আগের মতো সরবরাহ বজায় রাখতে তা বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। মানুষের ক্ষুধা এসব কী সমস্যা তা জানার যোগ্য থাকে না।

Sherman recounted a recent U.N. warning that about 1 million Afghan children were at risk of starvation, that more than 18 million Afghans needed urgent humanitarian assistance, and that deepening drought and the approaching harsh winter were only going to make matters worse.

পশ্চিম তাই আগেই স্বীকৃতির ইস্যু বাইরে রেখে এড়িয়ে সরাসরি কথা বলতে এসেছে। আমেরিকা, ইইউ এরই মধ্যে স্বীকৃতির প্রশ্ন পাশে ফেলে রেখে  কাবুল সফরে এসে কথা বলেছে। এমনকি সেখানে আবার একটা স্বীকৃত সরকার হতে করণীয় কী সে সম্পর্কে আলোচনা, পরামর্শ তুলেছেন। কিন্তু এটাকে তাদের ঠেকা, তারাই বিপদে পড়েছে – এমন অনুমান নিয়ে ব্যাপারটাকে তালেবানদের দেখা এক বিরাট ভুল ও আত্মঘাতী সিদ্ধান্তের দিকে যাওয়া হবে।  তার ইঙ্গিত উঠে আসছে।  ফলে আমেরিকা, ইইউ যেটা আগবাড়িয়ে করছে, সেটা হলো নিজেদের দিক থেকে যা করণীয় কর্তব্য ছিল, তা যতদুর পারে আগেই পূরণ করে রাখছে; যাতে শেষ পর্যন্ত কোনো সিদ্ধান্তহীনতায় যদি কিছু শিশু অভুক্ত মারা যায়; যাতে সে আগেই পরিষ্কার রাখতে পারে তাদের দায়ের অংশ ও উদ্যোগ তারা যথেষ্টই নিয়েছিল। তাতে তখন কিন্তু পরিস্কার দেখা যাবে তালেবানদের কারণে পুরোটাই ব্যর্থ হয়ে গেছে। তাই এমনটা কখনই যেন না হয় যে, দানগ্রহীতার আগ্রহ নেই ফলে দাতা চেষ্টা করেও কিছু করতে পারে নাই। ফলে তখন মানুষ দাতাকে নয় গ্রহিতাকেই প্রধান দায়ী করবে।

৪. অতএব দাতারাই ঠেকায় পড়েছে আর তাদের সেই ঠেকে যাওয়া দশাকেই ব্যবহার করে চাপ দিয়ে তালেবানদেরকে তাদের স্বীকৃতি আদায় করে নিতে হবে এমন অনুমান- এটি খুবই আত্মঘাতী ও বিপজ্জনক এবং দায়দায়িত্বহীন  সিদ্ধান্ত হবে।

৫. এরপর যা লিখব সেগুলোই তালেবান ইস্যুর মূল প্রসঙ্গ। নয়া তালেবান এরা কোন স্বীকৃত সরকার নয়। একারণেই এটা কোন থিতু সরকার নয়, এ অনুমান ভুল, ভিত্তিহীন। কারণ আসলে এটা এখনো অস্থিতিশীল মূলত এর অভ্যন্তরীণ (গ্রুপিং-গুলোর) সংহতি খুবই দুর্বল, তাই। কথাটাকে যদি রেডিক্যাল [হাক্কানি] আর তুলনায় লিবারেল [তালেবান]  ধারা হিসেবে বলি, তবে এ দুই ধারার বিরোধ – এটাই প্রধান অ-সংহতি [un-consolidated] চিহ্ন। এখানেই শেষ নয়। তালেবানের ভেতরের এই বিরোধের বাইরেও আবার আরো চরম রেডিক্যাল (আইসিস-কে) ধারা আছে, যার ছাতার নিচে আবার এর সমমনা আরো ছোট ছোট গ্রুপ আছে। এই চরম রেডিক্যাল (আইসিস-কে) [ISIS-K] –  এরা তালেবানদের ‘চরম অসহ্য শত্রু’ জ্ঞান করে।

৬. এরই মধ্যে আইসিস-কে গত আগস্টের দুইবার এয়ারপোর্ট হামলার পরে আর শান্ত বসে নাই। তাদের এখনকার টার্গেট মূলত হাজারা ট্রাইব বা এথনিক গোষ্ঠী, যারা শিয়া জনগোষ্ঠী। [The Hazaras are a Persian-speaking ethnic group; bigger other parts are in Iran. They primarily residing in the Hazarajat region in central Afghanistan.] আর মোট আফগান জনসংখ্যার ৯ শতাংশ। আফগানিস্তানের বড় প্রথম তিন জনগোষ্ঠী হল – পশতুন (৪০-৫০ শতাংশ ), তাজিক (২৫ শতাংশ) আর হাজারা (৯ শতাংশ)। ISIS-K এর এই হামলা মূলত নির্মূল করা [Ethnic Cleansing] ধরনের। আপাতত এনিয়ে তাদের ততপরতা “মসজিদে হামলা” টাইপের। অনেকে হাজারা-রা মুসলমান কি না তর্ক সে দিকে নিতে পারেন। এটি ভুল পথ। কারণ, এমন তর্ক ইসলামের ভেতরের। এটা বাইরের গ্লোবাল পলিটিক্যাল সিস্টেমের জায়গায় বসে দেখলে  বাইরের এই পুরো দুনিয়ার চোখে তারা ব্যাপারটাকে দেখবে কোনো এথনিক জনগোষ্ঠীকে নির্মূল করা হিসেবে, বসনিয়ায় যা হয়েছে। দুনিয়াতে ১৯৪৫ সালের আগে এমন বহু এথনিক জনগোষ্ঠীকে নির্মূল করে দেয়া গেছে। কিন্তু ১৯৪৫ সালের পরে দুনিয়া বদলে গেছে; কারণ এক ‘গ্লোবাল রাজনৈতিক ব্যবস্থা’ তৈরি হয়ে আছে। বিশেষত ২০০০ সালের পরে যে গ্লোবাল আইনি-কাঠামো, আদালত ব্যবস্থা তৈরি হয়ে গেছে; তাতে যারাই কোনো এথনিক জনগোষ্ঠীকে নির্মূল করতে যাবে, তো সে যে অজুহাতেই হোক তারা সহি মুসলমান ছিল না বলে অথবা অন্য কিছু, এরা প্রত্যেকেই এখন বিচারের সম্মুখীন হবেই, সর্বোচ্চ সাজা পাবে। যেমন ইতোমধ্যেই বার্মার শাসকেরা রোহিঙ্গা নির্মূল প্রচেষ্টার অভিযোগে।

এসব হলো আফগানিস্তানের আরেক জগৎ। সেই জটিলতার একটু ইঙ্গিত দিলাম। আর এখানে এবার ভারতের অবস্থা নিয়ে একটি কথা বলে শেষ করব।

অবশেষে ভারতের মিডিয়া জানাচ্ছে, আগামী মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহে আফগানিস্তানে যেসব দেশের স্বার্থসংশ্লিষ্টতা আছে এমন দেশগুলোর ‘জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টার’ [NSA, National Security Advisor] দায়িত্বে আছেন এমন মর্যাদার মন্ত্রী-উপদেষ্টাদের নিয়ে এক সম্মেলন আহ্বান করতে যাচ্ছে ভারত। কিন্তু মজার কথা হল, তাতে ভারতের প্রধান দুই মেহমান হল পাকিস্তান ও চীন [Pakistan & China among invitees as India looks……… ]।

তাহলে এত দিন মোদির হিন্দুত্ববাদ আর ভোটের স্বার্থে যে এ দুই দেশকে ভারতের চরম শত্রু বলে প্রপাগান্ডা চালানো হয়েছিল, এর কী হবে? যে চরমশত্রু দেশ সেই আবার দাওয়াতি-অতিথি হয় কী করে? এই ভারত সরকারের এই স্ববিরোধিতার কোন উত্তর নাই।আলাদা রাষ্ট্র বলে  ভারতের স্বার্থ অবশ্যই চীন বা পাকিস্তানের স্বার্থের বিরোধী এবং এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু তাই বলে ‘চরমশত্রু দেশ’ বলে চীন বা পাকিস্তানকে চিনানো আর প্রতি মুহূর্তে তাদের বিরুদ্ধে প্রপাগান্ডা চালানো – এই হিন্দুত্ববাদ অগ্রহণযোগ্য ও আত্মঘাতি, তা ভারতের পক্ষেও যায় না – এটাই ভারত প্রমাণ করল!

লেখক : রাজনৈতিক বিশ্লেষক
goutamdas1958@hotmail.com

 

[এই লেখাটা  গত  ২৩ অক্টোবর ২০২১, দৈনিক নয়াদিগন্ত পত্রিকার ওয়েবে ও পরদিন প্রিন্টে   “আফগানিস্তানের আগামী– এই শিরোনামে  ছাপা হয়েছিল।
নয়াদিগন্তে ছাপা হওয়া লেখাগুলোকে আমার লেখার ‘ফার্স্ট ড্রাফট’ বলা যায়।  আর আমার এই নিজস্ব সাইটের লেখাটাকে সেকেন্ড ভার্সান হিসাবে এবং  থিতু ভাষ্য বলে পাঠক গণ্য করতে পারেন। পরবর্তিতে ‘ফার্স্ট ড্রাফট’ লেখাটাকেই এখানে আরও অনেক নতুন তথ্যসহ বহু আপডেট করা হয়েছে। ফলে সেটা নতুন করে সংযোজিত ও এডিটেড এক সম্পুর্ণ নতুন ভার্সান হিসাবে ও নতুন শিরোনামে এখানে আজ ছাপা হল। ]

Leave a comment