একালেও কিসিঞ্জার আমেরিকা-চীনের জন্য দরকারি সফরে
গৌতম দাস
২৩ জুলাই ২০২৩ মধ্যরাত ০০ঃ ০৩
https://wp.me/p1sCvy-4Jj
Henry Kissinger with President Xi Jinping
হেনরি কিসিঞ্জার এর কথা বাংলাদেশের মনে থাকার কথা। তাঁর বয়স এখন একেবারেই শত বছর। ফলে ব্যক্তিগত সবকাজেই এইড[aid] বা সাহায্যকারীর সহায়তায় চলে তার জীবন। কিন্তু তবু তাঁর এই জীবন খুবই সচল ও সক্রিয় এক জীবন। মানে বেড-রিডেন [bed-ridden] বা বিছানায় বেশিরভাগ সময় কেবল শুয়েই কাটায় বলতে সিনিয়র-বয়স্ক সিটিজেনদের যেমন কাটে তাঁর বেলায় এটা ঠিক তেমন নয়। যেমন কম করে গত বিশবছর যদি ধরি তো তিনি নিজ লিখা লিখেন না টাইপও করে লিখেন না। বরং মুখে বলে ডিকটেশন [dictation] দিয়ে লেখান – এইডদের সহায়তায়।
হেনরি কিসিঞ্জার এখন রীতিমত বিমানে উড়ে চীন সফরে এসে গেছেন। তবে যতগুলো পশ্চিমা মিডিয়া রিপোর্ট পড়েছি – CNN, REUTERS, BBC, BLOOMBERG ইত্যাদি এমনকি চীনা জিনহুয়া কোথাও উল্লেখ করা নাই যে কিসিঞ্জার কারও আমন্ত্রণে চীন গিয়েছেন কিনা! বরং সব জায়গায় লেখা আছে যে কিসিঞ্জার চীন সফরে গেছেন; অর্থাৎ নিজেই গিয়েছেন এবং গত শনিবার তিনি প্রেসিদেন্ট শি এর সাথে মিটিং করেছেন। হোয়াইট হাউজের মুখপাত্ররা জানাতে ভুলেন নাই যে এই সফর ব্যক্তিগত; মানে তিনি বাইডেনের কোন দুত হিশাবে যান নাই। অথবা কেউ জানিয়েছেন, “কিসিঞ্জার অবশ্যই কোন সরকারি পদ বা প্রশাসনকে প্রতিনিধিত্বকারি কেউ নন”। হোয়াইট হাউজের বাইডেন প্রশাসনের স্টাফদের ভাষায়, তিনি ‘এখন এক প্রাইভেট সিটিজেন এবং সে হিসাবেই তিনি চীন সফরে’ আছেন।
তবে বেশিরভাগ মিডিয়া রিপোর্ট শুরু হয়েছে প্রেসিডেন্ট শি অথবা হেনরি কিসিঞ্জার এদুইয়ের কেউ না কেউ অথবা উভয়েই কী উচ্ছ্বাস প্রকাশ করেছেন তা দিয়ে। যেমন রয়টার্স লিখেছে, প্রেসিডেন্ট শি কিসিঞ্জারকে শুধু পুরানা বন্ধু-ই [old friends] বলেন নাই সাথে বলেছেন, তাঁর মত পুরাতন বন্ধুকে কখনও ভোলা যাবে না। […Chinese President Xi Jinping told Henry Kissinger that “old friends” like him will never be forgotten,…।] একইভাবে বিবিসি লিখেছে, আমাদের পুরানা বন্ধুকে আমরা কখনো ভুলতে পারি না এবং চীন-আমেরিকার (প্রথম কাছে আসা) বন্ধুত্ব ও সম্পর্ক স্থাপনের ক্ষেত্রে কিসিঞ্জারের ঐতিহাসিক অবদান আমরা ভুলব না –[ “We will never forget our old friends, and will not forget your historical contributions to develop US-China relations and friendship]। এছাড়া বিবিসি অবশ্য কিসিঞ্জারের এই সফরকে সাপ্রাইজ সফর বলেছে আর শিরোনামে বলেছে, আমেরিকা চাচ্ছে, চীনের সাথে সম্পর্কের বরফ ভাঙতেই কিসিঞ্জার আসুক তাই তিনি এসেছেন […US seeks to defrost China ties]।
কেন কিসিঞ্জার বিখ্যাত – ব্যাকগ্রাউন্ড অবদানঃ
কিসিঞ্জার নিয়ে কোন কিছু পড়ার সময় সংক্ষেপে আমাদের দুটা জিনিষ অবশ্যই মনে রাখতে হবে যা আমাদেরকে তাঁকে বুঝতে সহায়তা করবে। প্রথমত. আমজনতা হিশাবে আমরা ১৯৭১ সালের কিসিঞ্জারকে চিনব যিনি সেসময় আমাদের স্বাধীনতা যুদ্ধের বিরোধী মানে আমাদের স্বাধীনতার পক্ষে ভুমিকা রাখেন নাই। যদিও হবু বাংলাদেশকে রিলিফ অর্থে সাহায্য-সহায়তা চালু রেখেছিলেন। এসব কথা সত্য হলেও খেয়াল রাখতে হবে এসবই এখনকার প্রাসঙ্গিক আলাপের বিষয়ের দিক থেকে এক লোকাল বা স্থানীয় ঘটনা। আর এই লোকাল দিকটার বাইরে আরেক গ্লোবাল দিক আছে – যেটা আমাদের এখনকার আলোচ্য মূল বিষয়। তাই গ্লোবাল ভুমিকার দিক নিয়ে আমরা এখন কথা তুলব। যখন ঐ একই ১৯৭১ সালের তো বটেই সাথে সেই সত্তর দশক জুড়েই কিসিঞ্জারের ভুমিকা ছিল গ্লোবাল রাজনীতিতে তাতপর্যপুর্ণ।
তিনি প্রেসিডেন্ট নিক্সন আর পরের প্রেসিডেন্ট ফোর্ড এই দুজনের আমলেই (১৯৬৯-১৯৭৭) এই পুরা সময়কাল জুড়ে জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা (মন্ত্রী) ও পররাষ্ট্র উপদেষ্টা (মন্ত্রী) [ সেক্রেটারি স্টেট ডিপার্টমেন্ট] ছিলেন এবং এই আট বছর ধরে তিনি সবকিছু কাঁপিয়ে বেরিয়েছেন তাঁর সারা জীবনের গুরুত্বপুর্ণ সময়কাল হিশাবে। মূলত এসময়কালে তিনি দক্ষ নিগোশিয়েটর বা মধ্যস্ততাকারী পরিচয়ে মুখ্য অবদান রেখেছেন। যেমন দাবি করা হয় তিনি আমেরিকার সেনা প্রত্যাহার করিয়ে ভিয়েতনাম যুদ্ধকে সমাপ্তির দিকে নিতে বিবদমান সবপক্ষের জন্য কাজ করেছেন। যেটা অন্যভাবে বললে সেকালের অ্যামেরিকান প্রেসিডেন্টকেও মানাতে পেরেছিলেন যুদ্ধ আর আগালে সেটা আমেরিকার পক্ষে যাবে না। তবে মূলকথা এসবই আসলে অ্যামেরিকান দৃষ্টিভঙ্গিতে দেখে কথা বলা এক কিসিঞ্জারের অবস্থান। ভিয়েতনাম ইস্যুটা ছাড়াও আমেরিকার জন্য আরেক বড় অর্জন হল – সেটা ছিল কিসিঞ্জারের আরেক ধাক্কা তৈরি করা ঘটনা যা সাধারণ্যে চীন-আমেরিকার পারস্পরকে কূটনৈতিক স্বীকৃতি দান ও ঘনিষ্ট সম্পর্ক ঘটানো।
যার ভিতরের মূল ঘটনাটা হল, ১। চীনের মাও তার বিপ্লবের দশবছরের মধ্যে বা পরে টের পান যেভাবে ভাবা হয়েছিল কথিত সমবায়ে কৃষি উতপাদন সেভাবে বাড়ছে না। ২। কৃষিসহ সবখানেই মালিকানা যেমনই হোক বিনিয়োগ পুঁজির স্বল্পতা এক বড় ফ্যাক্টর জ্ঞান করেন। তাই তিনি নয়াপথ কমিউনিস্ট পার্টির নেতৃত্বে এক ক্যাপিটালিজম করাকে সঠিক জ্ঞান করে সিদ্ধান্ত নেন। যদিও এই নয়াপথে যেতে নিজে পার্টি সংগঠন কে ঢেলে সাজাতে গিয়ে মাও-কে কমপক্ষ ২০ বছর সময় ব্যায় করতে হয়েছিল। ৩। এর শেষ দশ বছর মাও আমেরিকার সাথে সম্পর্ক পুনর্গঠন করতে ব্যয় করেছিলেন। হবু বাংলাদেশের স্বার্থকে তাই নিজ চীনের এই নয়াস্বার্থে বলি দিয়ে দিছিলেন। খুবই সংক্ষেপে শিরোনামে বললে, এই প্রথম ১৯৭১ সালে চীন জাতিসংঘের সদস্যপদ লাভ করেছিল এবং সেটা ভেটোক্ষমতা-সহ সদস্যপদ। যা জাতিসংঘ জন্মের সময়ে চীনকে দেয়া হলেও ১৯৭১ সালের আগে পর্যন্ত তা (১৯৪৯ সালের চীনাবিপ্লবের পর থেকে ১৯৭১ পর্যন্ত) ব্যবহার করত শুধু তাইওয়ান। সেটাই তখন তাইওয়ানকে বাদ দিয়ে -সমগ্র চীন বলতে – সেটা মাওয়ের চীনই জাতিসংঘ স্বীকৃতি করে আর বিচ্ছইন্ন হয়ে যায় অফিসিয়ালি ও জাতিসংঘের চোখেও ঐ মাওয়ের মূল চীনের অংশ। এই বিষয়টাকে সংক্ষেপে মাওয়ের চীনের একচীন নীতি বলে আখ্যায়িত করা শুরু হয়েছিল; আর আমেরিকা তখন এটাই এটাই তার নীতি-অবস্থান বলে ঘোষণা করেছিল। েসব কিছু শেষ করতে মাওয়ের ১৯৭৭ সাল পর্যন্ত সময় লেগে যায়। পরে ১৯৭৮ সালের ১ জানুয়ারি থেকে পুর্ব-ঘোষণা দিয়ে দিয়ে উভয় দেশ আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি দান করে অর্থনৈতিক-সহ বাকি সব পারস্পরিক ততপরতা শুরু করেছিল।
কিন্তু এতে আমেরিকার কী লাভ হয়েছিল?
গত ১৯৭৮ সাল থেকে পরের অন্তত ৩২ বছর মানে ২০১০ সাল পর্যন্ত ডাবল ডিজিট জিডিপির চীনা অর্থনীতি গড়তে যত বিনিয়োগ পুঁজি লেগেছিল এর মাখন অংশ সবই আমেরিকার ওয়াল স্ট্রিট [wall street] এই গ্লোবাল পুঁজিবাজারের বিনিয়োগ-পুঁজি। এসবের মধ্যে কাজের সবচেয়ে জটিল অংশটা ছিল চীন-আমেরিকার প্রতিটা পদে পদে পারস্পরিক স্বার্থ-ঝগড়ার ইস্যুগুলোকে আপোষ মীমাংসায় পৌছানোর নিগোশিয়েশন – এরই প্রধান নায়ক উদ্যোক্তা ছিলেন হেনরি কিসিঙ্গার। মানে একদিকে অ্যামেরিকান রাজনীতির পক্ষগুলো ও সরকার-প্রশাসনকেই শুধু আস্থায় নেয়াই নয় আবার সাথে অন্যদিকে ওয়াল স্ট্রিট ব্যবসায়ীদেরকেও তাদের স্বার্থের দিকটা-সহ আস্থায় নেয়া – এসবই ঘটাতে পেরেই এর পুরা নিগোশিয়েশনটা সম্পন্ন করতে হয়েছিল কিসিঙ্গার-কে। ক্যাপিটালিজমের আদি-সংকট হল দুদিন পরপর পুঁজি বিনিয়োগের বাজার সঙ্কুচিত হয়ে যায় আর তা থেকে তৈরি হয় ব্যাপক সংকট হাহাকার। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সফলভাবে নিজের পক্ষে পরিসমাপ্তি দেয়া যা ছিল প্রেসিডেন্ট রুজভেল্ট- ট্রুম্যানের এক ব্যাপক অর্জন। কারণ, তা এই প্রথম (অন্যান্যদিকে আর যাই হোক) ১৯৪৫ সালের পর থেকে অন্তত আমেরিকাকান ওয়াল স্ট্রিট এর গ্লোবাল পুঁজিবাজারের জন্য এক ব্যাপক গ্লোবাল বিনিয়োগ বাজার যোগাড় করে এনে দিয়েছিল। সেবার চীন স্বীকৃতিতে ১৯৭৮ সালে আরেকবার প্রায় একইভাবে আরেকবার ওয়াল স্ট্রিটকে ব্যাপক গ্লোবাল বিনিয়োগ বাজার যোগাড় করে দিয়েছিল – মানে আবার নয়া বাজার খুলেছিল কিসিঞ্জারের হাত দিয়ে অ্যামেরিকান প্রশাসন।
আমেরিকা কী জানত না যে এতে এই চীন এককালে [৩০-৫০ বছরের মধ্যে] আমেরিকারই প্রতিদ্বন্দ্বি হয়ে উঠবে? জবাবটা ধরে নেয়া যাক তারা জানত! কিন্তু তাতে কী? কারণ গ্লোবাল পুঁজি বিনিয়োগের বাজার তার নিয়মিত বাজার ফুরিয়ে আসার সংকট বাসঙ্কুচিত হওয়া এভাবেই – ‘নগদ যা পাও হাত পেতে নাও’ আর ‘বাকিটা বা পরেরটা আবার পরে দেখা যাবে’ – এভাবেই পথ মারিয়ে চলে থাকে। তাই অনুমান করা হচ্ছে ২০৩০ সালের আশেপাশে চীনা অর্থনীতি আমেরিকাকেই ছাড়িয়ে যাবে – যা হলেও কিছুই করার নাই!!! এটা তখনও কিছুই করার ছিল না, এখনও নাই। এরই এক ভাল উদাহরণ হল, ২০০৯ সালে চীনকে ব্রিকস [BRICS] উদ্যোগে নতুন করে চীনা নেতৃত্বে রাইজিং অর্থনীতিগুলোকে নিয়ে নয়া আইএমএফ-বিশ্বব্যাংক ধরণের প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা শুরু করার পরামর্শটা দিয়েছিল এই ওয়াল স্ট্রিট থেকেই।
আমরা এখানে সীমাবদ্ধ থাকব কিসিঙ্গার প্রসঙ্গের মধ্যে। তাহলে কিসিঙ্গারের ঐ সময়টা গুরুত্বপুর্ণ ছিল কারণ, নিগোশিয়েশন দক্ষতা – এটা অ্যামেরিকান অর্থনীতিকে আরেক প্রাণ দিয়েছিল। আবার সেটাই পুরানা চীনকে আজকের চীন বানানোর সুযোগ এনে দিয়েছিল। এই অর্জন এটাই এক খ্যাতিমান কিসিঞ্জার এর জন্ম দিয়েছিল। এছারা দ্বিতীয়ত, কিসিঞ্জার খ্যাত হয়েছেন আরেক কারণে। তা হল, তাঁর এই নিগোশিয়েশন দক্ষতা ও কর্ম আমেরিকায় তো বটেই সারা একাদেমিক জগতে সাড়া ফেলে ও তত্বায়িত করা হয়ে গেছে, নিবিড় পাঠের জন্য। বিশেষ করে অ্যামেরিকান প্রফেশনাল ডিপ্লোম্যাট, আমলা, স্ট্রাটেজিস্ট, নীতি-নির্ধারক, কনসালটেন্ট ইত্যাদি সকল পেশাদারদের কাছে তিনি কিসিঞ্জার নিজেই হয়ে উঠে আছেন এক পাঠযোগ্য সাবজেক্ট [reading material] হিশাবে। এটাই কিসিঞ্জার খ্যাতিমান হয়ে উঠার দ্বিতীয় কারণ।
পাঠকদের প্রতি অনুরোধ – খুঁটিয়ে কিসিঞ্জার পাঠ করতে মনোযোগী হতে। এটা একেবারেই ভুল পথ যে তাই ভুলে যান যে আপনি আমেরিকা নাকি চীনের সমর্থক। আপনি কার সমর্থক তা জাহির করে এরপর কিছু বুঝতে-পড়তে শিখা এটা সবচেয়ে কমকথায় বললেও এক পন্ডশ্রম – গাধামি! বরং আপনার লক্ষ্য হতে হবে ঘটনা-ফেনোমেনা চীন নাকি আমেরিকার তাতে কিছুই এসে যায় না, আপনাকে তা যতটা সম্ভব স্পষ্ট বুঝতে ও ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ করে দেখানোর ক্ষমতা অর্জন করতে হবে। এই সক্ষমতাই আপনার নীট অর্জন যা আপনাকে সম্মান ও গুরুত্ব এনে দিবে। কেবল বোকারাই সমর্থক হবার জন্য লাফালাফি করে সময় নষ্ট করে।
একালের কিসিঞ্জারও গুরুত্বপুর্ণ হয়ে উঠছেন কেনঃ
এই সময়কালে বিশেষত, বাইডেনের বর্তমান আমলে চীন-আমেরিকান সম্পর্ক সম্ভবত শীতলতম বলা যায়! এদিকে ব্যক্তিটা কিসিঞ্জার বলেই হয়ত অনেক বেশি (প্রায় দশটা মিডিয়ায়) পশ্চিমা ও চীনা ভাষ্য পড়তে হয়েছিল। আর তাতেই লক্ষ্যণীয় যে চীন-আমেরিকান সম্পর্ক সম্ভবত শীতলতম হওয়া সত্বেও এসময়ে সব মিডিয়া গুরুত্ব দিয়েছে প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং সহ সকলেই কিভাবে কিসিঞ্জারের প্রশংসায় পঞ্চমুখ হয়েছেন। এখন চীনের দিক থেকে দেখলে কিসিঞ্জারকে নিয়ে প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং এর উচ্ছসিত বা কিছু আবেগী মন্তব্য প্রকাশ – এটা বাস্তবতই তাই কারণ সেসময়ে কিসিঞ্জারের “ঐতিহাসিক অবদান ভুলা যায় না” কথাটা চীনের দিক থেকে আজও বাড়িয়ে বলা নয়। কিন্তু তাই বলে সবটাই কী চীন বা শি জিনপিংয়ের আবেগ আর উচ্ছাস????
সম্ভবত একেবারেই না। বরং চীন আর আমেরিকা এই উভয় পক্ষই – ইনফরমালি ফরমাল – এই ভঙ্গিতে সব জানে এবং সবটাই পরোক্ষে। তবে সেটা যাই হোক বিবিসি ইতোমধ্যে চীন-আমেরিকার সম্পর্কের ঢলে পরা সম্পর্ককে উন্নতি ঘটাতে কিসিঞ্জারের ভুমিকা রাখার সম্ভাবনা দেখে এক ম অন্তব্য করেছে। বিবিসি বলেছে কিসিঞ্জার যত বড় ব্যক্তিত্ব তাতে তিনি পিছনের ঘরের মাধ্যমে আমেরিকা-চীনের এর আলাপ-আলোচনা রফায় পৌছানোর পক্ষে ভুমিকা রাখতে পারেন […But given his outsized stature in China, he could act as a backchannel for US-China negotiations.]।
কিন্তু কী সেটা, বা এর সাবজেক্ট বা লক্ষ্য কী? লক্ষ্য হল, বাইডেন তিন বছরের প্রান্তে এসে তাঁর আর সময় আর অনেক কমই বাকি। এই অর্থে যে আর ১৬ মাসের মধ্যে (নভেম্বর ২০২৪) তাঁকেও পরবর্তি নির্বাচন ফেস করতে হবে। তাই নির্বাচনের আগের করণীয়ের জন্য যে এক বছর সময় লাগে বা পাওয়া যায় মানে [নভেম্বর ২০২৩ – নভেম্বর ২০২৪] – এই সময়কাল এর জন্য কিছু প্রস্তুতিতে তিনি ঘাটতিতে আছেন।
২০২৪ নির্বাচনে বাইডেনের অন্তত দুইটা ইস্যুতে চীনকে তাঁর দরকারঃ
প্রথম শিরোনাম হল, বাইডেন ইউক্রেন ইস্যুতে সময় আর অর্থ দুটাই যথেষ্ট বেশি ব্যবহার করে ফেলেছেন; কথাটা নির্বাচনী প্রেক্ষিতে বুঝতে হবে যা বাইডেনের জন্য যথেষ্ট নেতিবাচক। এমনিতেই প্রতি দশবছরের আগেই অ্যামেরিকান রাষ্ট্র যে অন্তত েকবার করে থেকে ঋণ করে খোদ রাষ্ট্রের ঋণগ্রহণের সীমা বাড়িয়ে তবেই [৩১.৪ ট্রিলিয়ন ডলার পার হয়ে গেছে] তার ব্যয়নির্বাহ করে চলছে – এই আমেরিকা রাষ্ট্রকে ঋণ করার অনুমতি বা সিনেট-সংসদের দেয়া সিলিং তাকে বার বার বাড়িয়ে নিতে হচ্ছে। তাই আমেরিকা নিজে ধার করে সেই অর্থে ইউক্রেনের মানুষ ও অথনীতি বাঁচিয়ে রাখা আবার এই যুদ্ধের ব্যয় মিটানো – এটা একটা তিতা সীমায় পৌছে গেছে। আগামি সেপ্টেম্বরের আগে ইউক্রেনকে আবার দেওয়ার মত কোন ঋণের বিলে সেনেটে আসছে না। এরপরে কী হবে সেটাও এখন অনিশ্চিত। অথচ এই যুদ্ধ চালানো অবস্থায় অ্যামেরিকান নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে এটা বাইডেনের প্রার্থীতার বিরুদ্ধে যাবে বলেই অনুমান। তাই নির্বাচনের আগেই যুদ্ধের শেষ হওয়া দরকার!
কিন্তু ইতোমধ্যেই তাইওয়ান ইস্যুতে স্পিকার, সংসদ নেতা বা সদস্য পাঠানোকে কেন্দ্র করে চীনের সাথে সম্পর্ককে তিতা করে ফেলা হয়ে গেছে। বাইডেনের একালে স্যাংশন শুধু রাশিয়া বা বাংলাদেশ না, খোদ চীনের উপরেও কোন কম হয় নাই! আগের ট্রাম্পের আমল থেকেই মধ্যবিত্ত ভোক্তা যেসব চীনা হাউজহোল্ড আইটেম কিনতে আস্থা পায় এর উপর ৯০% পর্যন্ত বাড়তি শুল্ক আরোপ করে রেখে গেছিলেন; তা বাইডেন হাত দেন নাই। ইউক্রেন যুদ্ধ নিয়এ পরোক্ষে হলেও চীনের সাথে টেনশন কম নাই। এককথায় গত তিনবছরে চীনের সাথে নুন্যতম ওয়ার্কিং রিলেশন থাকছে বা থাকবে কিনা এটা চিন্তা না করে বেপরোয়া হয়ে বাইডেন সব পদক্ষেপ নিয়ে গেছেন। এসবই এখন থামাতে বা কমাতে চাইছেন!! আর সেটা অন্তত নিজ নির্বাচনী কাজে লাগবে এমন কৌশল ও কাজের খাতিরে।
এবারের ঋণ সিলিংয়ের ব্বিল পাশ হয়েছিল গত ৩ জুন আর এরপর থেকেই বাইডেন চীনের সাথে কিভাবে দরজা খুলে নেয়া যায় তা ভাবতে থাকেন। আর প্রায় একই সময়ে [২-৪ জুন ২০২৩] এবারের সিঙ্গাপুরের সাংগ্রিলা নিরাপত্তা সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। এটা হল, চীন-আমেরিকা সহ প্রায় সকল মুখ্য প্রভাবের রাষ্টড়্গুলোর সিকিউরিটি ইস্যুতে পরস্পরের অবস্থানকে বুঝাবুঝি বাড়ানোর এক ব্যতিক্রম সম্মেলন। বাইডেন চীনের সাথে এতদিনের বেপরোয়া দুরত্ব তৈরির প্রয়াস এবার ক্ষান্ত দিতে চাচ্ছিলেন এই সাংগ্রিলা সম্মেলন থেকেই। অ্যামেরিকান প্রতিরক্ষামন্ত্রী লয়েড অস্টিন চেয়েছিলেন উপস্থিত চীনের প্রতিরক্ষামন্ত্রীর সাথে সাইডলাইনে বৈঠকে বসেন। কিন্তু চীনামন্ত্রী এই আগ্রহে ঠান্ডা পানি ঢেলে দেন। পিছনের কারণ যা জানা গেছিল তা হল বর্তমান চীনামন্ত্রীর বিরুদ্ধে অ্যামেরিকান স্যাংশন আরোপ করা আছে – চীন কিছু রাশিয়ান অস্ত্র আমদানি করেছিল বলে।
তবে আমেরিকা ঐ ব্যর্থতা সত্বেও প্রচেষ্টা অব্যহত রেখেছিল। তাই কিছুদিনের মধ্যেই ব্লিকেনের চীন সফর ঘটেছিল। কিন্তু এত শীতল সফর কেউ আগে দেখেনি যেন; কোন মিডিয়াতেই এই সফর থেকে নুন্যতম আশাবাদ রাখার কিছু নাই এটাই বর্ণনা করেছিল; হয়েছিলই তাই। কিন্তু ব্লিঙ্কেনের সফরের পরে আসেন আমেরিকার অর্থমন্ত্রী জেনেট ইয়েলেন। এবার এতে দেখা যায় চীনারা কিছু মুখ খুলেছে – অন্তত কিছু ইস্যুতে সবটা না হলেও অনেক অগ্রগতির দেখা মিলেছিল। যদিও সফর প্রথম দিনেই জেনেট ঝাড়ি দিয়ে কথা বলে শুরু করেছিলেন। এজন্য যে চীন কেন অ্যামেরিকান কিছু
ইয়েলেন এর সফর নিয়ে আলাদা বিস্তারে লিখতে হবে। তবে এখনকার প্রাসঙ্গিকতা হল, কিসিঞ্জার ইয়েলেনের এই এপ্রোচ এর সমালোচনা করেছেন। তবে ইয়েলেনের কথায় পরিস্কার যে বাইডেনের আগামি নির্বাচন তিনি লড়বেন অন্তত দুটা এজেন্ডাকে সামনে নিয়ে – জলবায়ু-পরিবেশ আর গ্লোবাল অর্থনৈতিক পুনর্গঠন । এই ধারণাওটা পাওয়ায় আযায় ইয়েলেনের সফরের বক্তব্য থেকে। তিনি গত ৯ জুন থেকে শুধু চীন সফরে গেছিলেন তাই না। তিনি এরপরে ভারতের গুজরাতে -জি২০- অগ্রসর অর্থনৈতিক দেশের জোট এর সভায় যোগ দিতে গেছিলেন। সেখানেই তিনি জানান বাইডেন সরকারের এদুই পরিকল্পনার কথা [দেখেন ……Yellen ‘eager’ to work with China on debt, other global challenges।]।
আর জলবায়ু প্রসঙ্গে আলাপ করার জন্য এরপরে বাইডেন প্রশাসনের জলবায়ু বিষয়ে বিশেষ দুত জন কেরি চীন গেছিলেন। খুব সম্ভবত রিপাব্লিকান প্রার্থী হিশাবে ট্রাম্প বা অন্য যেই আসেন তাদের জলবায়ু প্রোগাম নিয়ে নির্বাচনী ইস্যু নাই থাকতে পারে, ট্রাম্পের মতন। আর এই সুযোগটাই সম্ভবত নিতে চান বাইডেন।
আর ঋণ পরিশোধিত না হওয়া গরীব দেশের ঋণকে রি-শিডিউল বা ঢেলে সাজাতে গেলে এরজন্য অর্থের চাপ নিবার ক্ষমতা চীনের বেশি বলে আমেরিকা এই ইস্যুতে চীনের সাথে গাটছাড়া বাধতে চায়। যার মানে চীনা ঋণের ফাঁদ এই বক্তব্য এখন হজম করে লুকিয়ে ইয়েলেন এখন চীনা এলায়েন্স গড়ে তুলতে চাইছে।
তাই এসব কাজে হেনরি কিসিঞ্জার ভুমিকা রাখেন যেন এটা বাইডেনের পরোক্ষে চাওয়া।
এটা ঠিক ততটা পরোক্ষে থাকবে না। কারণ কিসিঞ্জার আগেই ঘোষণা দিয়েছেন যে আমেরিকা ফিরে গিয়ে তিনি নিজেই বাইডেন প্রশাসনকে এনিয়ে ব্রিফ করবেন। আর ওদিকে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব চীনা প্রেসিডেন্টের সাথে বাইডেন মটিঙ্গোয়ে বসে সম্পর্ক আবার ঘনিষ্ট করতে চান স্টা বাইডেন জানিয়ে দিয়েছেন। খুব সম্ভবত বাইডেন ইউক্রেন যুদ্ধের শেষ চান আর যেকাজে চীন মধ্যস্থকারির ভুমিকা নেক – এটাই হবে সম্ভবত বাইডেনের চাওয়া।মটা দাগে এসবই হোল আগামি দিনের চীন-আমেরিকার সম্পর্কের রূট বা অভিমুখ। এখন প্রশ্ন হল যত সহজে এটাকে গত প্রায় তিনবছর ধরে ডিকাপলিং [decoupling] বা বিচ্ছিন্নতার লাইনে বাইডেন ঠেলেছেন তাতে এখন চাইলেই কী স্বাভাবিক সম্পর্কে ফেরা যাবে – এটাই বিলিয়ন ডলারের প্রশ্ন। আস্থা ভাঙ্গা যত সহজ তত সহজে তা আবার গড়ে নেয়া যায় না!!!
আপডেটেডঃ ২৩ জুলাই ২০২৩; রাত ০২ঃ ০৮
আপডেটেডঃ জুলাই ২০২৩;
>>>>
গৌতম দাস
রাজনৈতিক বিশ্লেষক
goutamdas1958@hotmail.com

