তেল রফতানি বাজারে আমেরিকার প্রবেশ ঠেকানো


তেল রফতানি বাজারে আমেরিকার প্রবেশ ঠেকানো
গৌতম দাস
২২ জানুয়ারি ২০১৬
http://wp.me/p1sCvy-zG

ব্যাপারটা শেষ বিচারে দাঁড়িয়েছে জ্বালানি তেলের দাম কমিয়ে বিক্রির প্রতিযোগিতা। চলতি মাসের ১৪ তারিখে রয়টার্সের বরাতে দৈনিক ‘বণিকবার্তা’ বলছে, ১৫০ ডলার ব্যারেলের তেল এখন দাম কমতে কমতে প্রায় ৩০ ডলারেরও নিচে নেমে গেছে। বিগত শেষ ২ বছর থেকে এ কমতি দশা। বিশেষ করে বিগত প্রায় ১৩ বছর ধরে ক্রমে একটানা বাড়তিতে ২০০৮ সাল থেকে যে তেলের দাম ১৫০ ডলার উঠেছিল প্রথমে পরে সেই দাম নামতে নামতে ৭০ ডলারে থিতু হয়েছিল। কিন্তু গত ৬ মাস থেকে এটাই আবার নামতে নামতে এখন এ ২৭ ডলারে নেমে যাওয়ার দশা। প্রায় ১ বছরের কিছু আগে ২০১৪ সালের ৩০ ডিসেম্বর রয়টার্সের এক নিউজ রিপোর্ট শঙ্কা ব্যক্ত করেছিল যে, তেলের দাম ২০ ডলারে পৌছাতে পারে। মনে হচ্ছে, ঘটনা সেই দিকে যাচ্ছে। আল-জাজিরার টক শো “ইনসাইড স্টোরি”তে তেলের দাম ১০ ডলারে নেমে যেতে পারে কিনা তা নিয়ে আলোচনা তুলেছিল গত সপ্তাহে।

তেলের দাম এত উঠাপড়ার সাধারণ কারণ কি আছে
মোটা দাগে বললে, একেক পর্যায়ে তেলের দাম ওঠা বা পড়ার কারণ একেক ধরনের। তাই সাধারণীকরণ না করে প্রতি ক্ষেত্রে সুনির্দিষ্ট কারণের দিক থেকে তা বুঝতে হবে। যেমন, যে ১৩ বছর ধরে বিশেষত ২০০৩ সাল থেকে দাম উঠতির কথা বলছিলাম এর প্রধান কারণ ছিল রাইজিং ইকোনমি। ব্যাপারটা মূলত চীনকে ঘিরে। চীনের মাও মারা যান ১৯৭৬ সালে। তাঁর মৃত্যুর আগের শেষ ৬ বছরের সময়কালে পশ্চিমের সঙ্গে (মূলত আমেরিকার সঙ্গে) চীনের অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক সম্পর্কের বড় ধরনের রদবদল ঘটায় নতুন করে তা সাজানো হয়েছিল। যার সারকথা হলো, চীন আমেরিকার নেতৃত্বের পশ্চিম থেকে বিপুল পরিমাণ পুঁজি নেবে, চীনে ব্যাপকভাবে বিদেশি পুঁজি আসতে দেবে। অবকাঠামো নির্মাণ খাতে এবং বাণিজ্যিক বিনিয়োগ খাতেও। এককথায় গ্লোবাল পুঁজিতান্ত্রিক অর্ডারের দুনিয়ার ভেতর কমিউনিস্ট চীন পুরোপুরি প্রবেশ করবে। অন্যভাষায় বললে, কমিউনিস্ট চীন নিজে এক ব্যাপক পুঁজিতান্ত্রিক রূপান্তরে যাবে এবং এ কাজে প্রয়োজনীয় পুঁজি চীন আমেরিকার নেতৃত্বের পশ্চিম থেকে আসতে দেবে। এরই মৌলিক নীতিগত রফাদফা সম্পন্ন হওয়ার কাল ছিল ঐ শেষ ছয় বছর। বিস্তারিত রফাদফার খুঁটিনাটি শেষ করে চীনের নিজের অভ্যন্তরীণ আইনকানুন নতুন পরিস্থিতি অনুযায়ী নতুন নিয়্মে সাজাতে সাজাতে সময় লেগে যায় প্রায় ১৫ বছর, ১৯৯০ সাল পর্যন্ত। এটাকে প্রস্তুতিমূলক বা পিকআপ নেয়ার আগের সময় বলা যেতে পারে। পরের ১৯৯০-২০১০ এই ২০ বছরকে বলা হয় রাইজিং ইকোনমির বা উদীয়মান অর্থনীতির চীন। এই এক নতুন টার্ম, যেটা উন্নত পশ্চিম আর আন্ডার ডেভেলপড (অনুন্নত) তৃতীয় বিশ্ব এই দুই শব্দের বাইরে; নতুন এক শব্দ। মূলত চীনের একেবারে গা-ঝাড়া দিয়ে উঠে দাঁড়ানোর প্রভাবে আর যে চার অর্থনীতি – ভারত, ব্রাজিল, রাশিয়া ও সাউথ আফ্রিকা উঠে দাঁড়িয়েছিল মোট এ পাঁচ অর্থনীতিকে বোঝাতেই এই নতুন টার্ম রাইজিং ইকোনমি।

তাহলে কথা দাঁড়াল, তেলের দাম দিয়ে গ্লোবাল অর্থনীতির মতিগতি বুঝতে সেকালে তেলের দাম বৃদ্ধির এক অন্যতম কারণ ছিল রাইজিং ইকোনমি – এটা বুঝতে হবে। এমনটা ঘটার বড় কারণ ছিল ১৯৯০-২০১০ এ ২০ বছরে চীনের অর্থনীতির প্রবৃদ্ধি হয়েছিল ডাবল ডিজিটের জিডিপিতে, যেটা খুবই মূল্যবান লক্ষণ মানা হয় এবং কোন রাষ্ট্রের অর্থনীতিতে সচরাচর তা দেখা যায় না এমন। বলার অপেক্ষা রাখে না, চীনা অর্থনীতির এ প্রবৃদ্ধির সে সময়ের আর এক লক্ষণ ছিল, ক্রমবর্ধমানভাবে চীনের জ্বালানি তেলের চাহিদা লাফিয়ে লাফিয়ে বেড়ে চলা। এ বেড়ে চলা চীনের চলতি যে জ্বালানি প্রয়োজন হচ্ছিল শুধু সেজন্য নয়, বরং পরের কমপক্ষে ২০ বছরের পরিকল্পনায় চীনের জ্বালানি তেলের চাহিদা মেটাতে সরবরাহের প্রবাহ যেন একই ধরনের থাকে, এজন্য বিভিন্ন দেশের প্রমাণিত রিজার্ভের তেল খনিতে আগাম বুকিং বা ক্রয়চুক্তি করেছিল চীন। অর্থাৎ সার কথা হলো, চীনের অর্থনীতিতে তেলের চাহিদা – এ ক্ষুধার খবর বাজারে রটে থাকাতে তেলের বাজারে বিপুল বিনিয়োগকারীর আনাগোনায় দাম ১৫০ ডলারে উঠেছিল। অতএব ওই সময়ের তেলের উচ্চমূল্য রাইজিং ইকোনমিগুলোর উচ্চ চাহিদার নির্দেশক ছিল।

এখানে মনে রাখা ভাল চীনের অর্থনীতির ওই ক্রমবর্ধমান উচ্চ চাহিদার প্রভাবে গ্লোবাল অর্থনীতিও বৃদ্ধি দেখা দিয়েছিল ও নাড়াচাড়া পড়েছিল। বিশেষ করে তেল বিক্রির দেশ এবং বাকি রাইজিং ইকোনমির দেশের অর্থনীতিও চাঙা হয়েছিল। তেল বিক্রির দেশ, যেমন রাশিয়া, ভেনিজুয়েলা, ব্রাজিল, আলজিরিয়া, অ্যাঙ্গোলা, ইকুয়েডর, ইন্দোনেশিয়া, ইরান, ইরাক, কুয়েত, লিবিয়া, নাইজেরিয়া, কাতার, সৌদি আরব, দুবাই এদের সবারই বাজেটের বড় বা মূল আয়ের উৎস হল তেল বিক্রি থেকে আয়। কোনো কোনো এমন দেশের ৯০ থেকে ১০০ ভাগ বিদেশি মুদ্রা আয় বা রাজস্ব আয় হল তেল বিক্রি থেকে আসা অর্থ। ফলে চীনের তেলের চাহিদা বৃদ্ধি মানে এসব তেল বিক্রি করা দেশের অর্থনীতি চাঙা করে রাখা। অর্থাৎ একটা চেইন ইফেক্ট বা পরস্পর পরস্পরের ওপর নির্ভরশীলতার এক লম্বা শিকলের মতো অর্থনীতি ওখানে ওই পরিস্থিতিতে তৈরি হয়েছিল। তবে একেক দেশের তেল উতপাদন বা তোলার বিনিয়োগ ইত্যাদির খরচে ব্যতিক্রম আছে। কিন্তু এর চেয়েও বড় হলো এ হিসাবে দেখা গেছে, তেল রাজস্বের ওপর নিজের বাজেট নির্ভরশীল বলে মোটামুটি ৯০ থেকে ১০৫ ডলার – তেলের দাম ঐ জোনের মধ্যে বা উপরে থাকলে তা প্রায় সব তেল বিক্রি করে চলা দেশের অর্থনীতি চাঙাভাবে থাকে। রাষ্ট্র হাত খুলে বাজেট তৈরি ও খরচ করতে পারে। আবার মধ্যপ্রাচ্য রাষ্ট্রগুলোর সবার বেলায় তেল-রাজস্ব ঠিক মত না এলে ঠিক বাজেট ছাঁটতে হবে এমনটা নয়। বিশেষ করে সৌদি আরব। যদিও এবারই প্রথম এবারের ঘোষিত সৌদি বাজেট ঘাটতি বাজেট বলে দেখানো হয়েছে। বলা হচ্ছে, সৌদি অর্থনীতি প্রতিদিন প্রায় ৫০০ মিলিয়ন বা হাফ বিলিয়ন ডলার আয় কম হচ্ছে এই অর্থে সে ঘাটতিতে আছে। আইএমএফের এক অনুমিত হিসাব মতে, গালফ রাষ্ট্রগুলো এ বছর ৩০০ বিলিয়ন ডলারের মতো আয় হারাবে। একা সৌদি আরব ইতোমধ্যে গত একবছরে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ৭৪২ বিলিয়ন ডলার থেকে কমে ৬৪৮ বিলিয়ন ডলার হয়েছে বলে সৌদি মনিটারি এজেন্সীর বরাতে আলজাজিরা জানাচ্ছে। 

অন্যদিকে আর একটা খবর আমাদের এ দিকের মিডিয়ায় নজরেই আসে নি। সেই খবরটা হলো, আমেরিকা এখন তেল রফতানিকারক দেশ। অনেকে অবশ্য হতে পারে আগে খেয়াল করেননি অথবা নিশ্চিত ছিলেন না যে আমেরিকা কি তেল রফতানিকারক দেশ ছিল নাকি! জবাব হচ্ছে হ্যাঁ, আগে ছিল না। তবে কথাটা ভেঙে বলতে হবে- ছিল না মানে কী? রফতানি করার মতো তেল ছিল না নাকি, তেল ছিল কিন্তু আইন করে রোধ বা নিষেধাজ্ঞা দেয়া ছিল? হ্যাঁ, দ্বিতীয়টা। অর্থাৎ আমেরিকার রফতানি করার মতো তেল থাকা সত্ত্বেও আইন করে নিষেধাজ্ঞা দেয়া ছিল, যাতে রফতানি করা না যায়। এমনকি আমেরিকার যেসব স্টেট বা রাজ্য তেল তুলে বেচার ব্যবসায় জড়িত ও তেল বেচা আয়ের উপর রাজ্য বাজেট বড়ভাবে নির্ভরশীল এমন রাজ্যগুলোর রাজস্ব আয় মারাত্মক ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে আছে, যেমন আলাস্কা, নর্থ ডাকোটা, টেক্সাস, ওকলাহামা, লুসিয়ানা ইত্যাদি রাজ্যগুলো।

কবে থেকে এবং কেন?
কারণের বিস্তারে যাওয়া যাবে না এখন, সে অন্য প্রসঙ্গ হয়ে যাবে তাই। তবে সংক্ষেপে বললে, তৃতীয় আরব-ইসরাইলের যুদ্ধ, আরব জাতীয়তাবাদী হয়ে ১৯৭৩ সালে তৃতীয় ও শেষবার ইসরাইলের বিরুদ্ধে আরব-ইসরাইলের যুদ্ধ হয়েছিল।ঐ যুদ্ধে আরবেরা খুব খারাপভাবে হেরে গিয়েছিল। কিন্তু এতে এর চেয়ে বড় ব্যাপার হয়ে ওঠে এরপর সবাই আরব জাতীয়তাবাদের ঝাণ্ডা ফেলে নিজ নিজ রাষ্ট্রবাদী-জাতীয়তাবাদ আঁকড়ে ধরেছিল; সেই থেকে আরব জাতীয়তাবাদের ঝাণ্ডা আর কেউ বইতে রাজি হয় নাই। যেমন আরব জাতীয়তাবাদী জামাল নাসেরের মিসর এর পর থেকে হয়ে যায় মিসরীয় জাতীয়তাবাদে। এখানে বলে রাখা ভালো, বাক্যগুলোকে এভাবে লেখা হচ্ছে ঠিকই কিন্তু  এটা “আরব জাতীয়তাবাদ” হারানোর কোন শোক থেকে একেবারেই নয়। বরং কথাগুলোকে আরব জোটবদ্ধতা হারানোর শোক হিসেবে দেখা যেতে পারে। সেভাবেই লেখা। আরব জোটবদ্ধ যেটা ইসরাইলের বিরুদ্ধে দাঁড়ানোর জন্য এখনও খুবই জরুরি পূর্বশর্ত। কিন্তু সেসময়ে যুদ্ধে হেরে আরবদের দিক থেকে রাগের মাথায় একটা খুব বাজে সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছিল। সেই সিদ্ধান্ত “তেল অবরোধ” নামে পরিচিত। শুনতেও খুব ভাল, জাতীয়তাবাদী জোশে উঠে দাড়ানোর মত। ব্যাপারটা হল জ্বালানি তেলে সমৃদ্ধ আরবেরা সে সময়ের সিদ্ধান্ত নিয়ে ছিল পশ্চিমকে আর তেল বেচবে না। এই ছিল সিদ্ধান্তের সারকথা। মনে করা হয়েছিল এই সিদ্ধান্ত নিয়ে পশ্চিমকে খুব বড় বিপদে ফেলা যাবে। কারণ পশ্চিমা সভ্যতা ও এর অর্থনীতি দাঁড়িয়ে আছে ফসিল ফুয়েল বা মাটির নিচের জ্বালানির ওপরে। দুনিয়াতে যে জ্বালানির বিরাট এক অংশ মধ্যপ্রাচ্যে আরবদের দেশে ও দখলে । ফলে পশ্চিমারা বিরাট অসুবিধায় পড়বে। কথা সত্য কোনো সন্দেহ নেই। কিন্তু অন্য এক সত্যও আছে। রিলেশনাল, মানে পশ্চিমের সাথে সম্পর্কিত হয়ে থাকার দিকটা কেউ ভালো করে দেখেনি। তেল না বেচলে ক্রেতার কী দশা হবে, কী অসুবিধায় পড়বে এটা যত বেশি নজর করা হয়েছিল, এর কণামাত্র নজর দেয়া হয়নি এতে বিক্রেতার কী দশা হবে। এতে ধরে নেয়া হয়ে গিয়েছিল যেন তেল বিক্রি করা বিক্রেতার একটা ঐচ্ছিক ব্যাপার খেয়াল বা শখ। তেল বিক্রি যেন বিক্রেতার দিক থেকেও গভীর প্রয়োজনের বিষয় নয়। অথচ ব্যাপারটা ছিল ঠিক এর উল্টো।  প্রতিটি আরব রাষ্ট্রের অর্থনীতি বিশেষ করে বাজেটের রাজস্ব আয়ের (৯০-১০০%) একমাত্র উৎস ছিল ফসিল ফুয়েল বিক্রি। ফলে তেল বিক্রি না করলে পশ্চিমা শক্তি বিশাল বিপদে পড়বে সন্দেহ নেই; কিন্তু তেল বিক্রেতা আরব দেশগুলোর অর্থনীতি চলবে কীভাবে? এ দিকটাতে কোন গুরুত্বই দেয়া হয়নি। অতএব বলা বাহুল্য, এই সিদ্ধান্তের ফলাফল শেষ বিচারে আত্মঘাতী হিসেবে হাজির হয়েছিল। আরব জাতীয়তাবাদ থেকে মিসরীয় জাতীয়তাবাদ অথবা সিরীয় জাতীয়তাবাদ হয়ে যাওয়ার পেছনে এই ফ্যাক্টরগুলোও কাজ করেছিল। শেষ বিচারে তেল অবরোধ হয়ে ওঠে আরবদের জন্যই বুমেরাং, কাউন্টার প্রোডাকটিভ। এ ছাড়া যুদ্ধ কোন ব্যয়-বিনিয়োগ প্রকল্প নয়, বরং আয়বিহীন বা রিটার্ণ না আসা এক বিনিয়োগ। ফলে  একদিক থেকে দেখলে যুদ্ধ মানে একটি রাষ্ট্রের আয়বিহীন এক ব্যয়ে জড়িয়ে পড়া। আরব-ইসরায়েলের যুদ্ধে সব আরব রাষ্ট্রের দশা ছিল তাই। ফলে যখন তেল বিক্রির আরব রাষ্ট্রগুলোর দরকার আরও আয় যাতে যুদ্ধ মানে ওই আয়বিহীন একটি ব্যয়ে ভারসাম্য ফেরে। অথচ তাঁরা পদক্ষেপ নিয়েছিল প্রয়োজনের উলটা – তেল অবরোধ। ফলে তেল অবরোধ সিদ্ধান্ত না টেকার পেছনে এটাও বড় একটা কারণ।
তবু “তেল অবরোধ” নামে তৎপরতাটাই, তা সে যত কম দিন কার্যকর থাকুক তা পশ্চিমকে ভয় পাইয়ে দেয়ার জন্য যথেষ্ট হয়েছিল। এরই প্রমাণ হলো আমেরিকার থেকে তেল রপ্তানি নিষিদ্ধ আইন। পরবর্তিতে ১৯৭৫ সালে আমেরিকা তেলে উদ্বৃত্ত হোক আর না হোক, আমেরিকান তেল কোনো ব্যবসায়ী রফতানি করতে পারবে না বলে আইন পাস হয়েছিল। আইনটা পাসের উদ্দেশ্য হিসেবে বলা হয়েছিল, “আমেরিকার নিজের মজুদ তেল সংরক্ষণের (মানে আমেরিকান নিজের তেল একমাত্র শেষ হতে হবে কেবল নিজেরা ভোগ করে, বিক্রি করে নয়) জন্য রফতানিকে নিরুৎসাহিত করতে এই বিল আনা দরকার”, তাই। ‘সংরক্ষণের’ এ কথা থেকে বোঝা যায় তাদের ভয়ের মাত্রা সম্পর্কে।

চল্লিশ বছর এতদিনে পরে এখন সেই আইন সংশোধন করে নেয়া হলো। অর্থাৎ এখন থেকে আমেরিকান তেল রফতানি করা যাবে। লন্ডন ইকোনমিস্ট ১৮ ডিসেম্বর বলছে, মূলত রিপাবলিকানদের উৎসাহ ও তাদেরই আনা বিল এবং তেল ব্যবসায়ী লবি যারা গত দু’বছর ধরে চেষ্টা করছিল এদেরই মিলিত আগ্রহে বিলটা আসে। আর ডেমোক্র্যাটরা যারা সংখ্যালঘু, এখন তারা অন্য একটি কিছু পাওয়ার আসায় সেই বিনিময়ে আনা এই আইনকে পাস হতে সম্মতি দিয়েছে। সব মিলিয়ে আইনটি পাস হয়েছে ১৮ ডিসেম্বর ২০১৫। প্রায় এক মাস আগে। এই অর্থে এটা কোনো একটা দলের একক প্রচেষ্টা আর অন্যটার বাধা দেয়া নয়, বরং বাই-পার্টিজান বা আমেরিকান দুই পার্টি মিলে নেয়া যৌথ সিদ্ধান্ত। আমেরিকান পুঁজিবাজারবিষয়ক মুখ্য পত্রিকা ১৬ ডিসেম্বর ২০১৫ ‘ওয়াল স্ট্রিট জার্নাল’ মন্তব্য করে লিখেছে, চল্লিশ বছর নিষিদ্ধ থাকার পরে ‘এই সিদ্ধান্ত ঐতিহাসিক’ এবং ‘এতে আমেরিকান তেল উৎপাদনকারীদের বাজারে চাপে ও তোড়ের মুখে পড়ে আমেরিকার রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক পটবদল’ প্রতিফলিত। এসব বক্তব্য থেকে বোঝা গেল চল্লিশ বছর নিষিদ্ধ থাকার ঘটনাটা। কিন্তু ‘তেল উৎপাদনকারীদের বাজারে চাপে ও তোড়ে’ ঘটা ঘটনাটা কী? মানে ঠিক এখনই কেন তেল রফতানির অবরোধ তুলে নেয়া?

নতুন ধরনের এক তেলের উৎস একালে চালু হয়েছে- শেল অয়েল। চালু হয়েছে কথাটা টেকনোলজির দিক থেকে বলা- নতুন এক টেকনোলজি চালু হওয়াতে শক্ত শ্লেট থেকে তেল উৎপাদন করা যাচ্ছে। শ্লেট-পেন্সিলে লেখার শ্লেটের মতো দেখতে, স্তরের ওপর স্তর পড়া শক্ত মাটির শ্লেট  – মাটির নিচে এর ওপর উচ্চ চাপ ও তাপের পানি পাঠিয়ে তা থেকে উত্থিত তেল ও গ্যাস সংগ্রহ করার টেকনোলজি ব্যবহার করে এই তেল উৎপাদন করা হয়। সম্ভবত এটাও আরেক ধরনের জীবাশ্ম, তবে এটা থেকে তেল বের করার কার্যকর টেকনোলজি ছিল না বলে এর ব্যবহার আগে ছিল না। এখন এই টেকনোলজির পর্যাপ্ত উপস্থিতি ও খরচ পোষায় মনে করাতে শেল অয়েলের ব্যবসায় একটা উচ্ছ্বাস উদ্দীপনা চলছে। এভাবে তেল বের করার এই টেকনোলজিটাকে বলা হয় ফ্রেকিং। তাই অনেকে এটাকে ফ্রেকিং অয়েলও বলে। অথবা শ্লেট জাতীয় উপাদান বা কাঁচামাল থেকে এই তেল বের করা হয় বলে একে শেল অয়েলও বলা হয়। এ ছাড়া এই টেকনোলজিতে প্রচুর পানি ব্যবহার করতে হয় বলে এবং এর প্রক্রিয়ায় প্রচুর অব্যবহৃত তাপ উদ্ভব হয়, যেখানে দুনিয়ার তাপমাত্রা কমানোটাই এখন ইস্যু সেখানে পরিবেশগত দিক থেকে এটা পরিবেশ বিনষ্ট আরো বাড়িয়ে তোলে এমন এই টেকনোলজি। ফলে অনেকে একে নোংরা তেল বা ডার্টি অয়েল নামেও ডাকে। মাটির নিচে  মজুদ শ্লেটের এর দিক থেকে বড় বা শীর্ষে থাকা দেশ হল আমেরিকা, জর্ডান, কানাডা ইত্যাদি। বলা হচ্ছে, আমেরিকান মজুদের পরিমাণ এত বেশি যে, তা দিয়ে আমেরিকান জ্বালানি চাহিদা মেটানো তো বটেই এমনকি তা মিটিয়েও আমেরিকা শেল অয়েল রফতানি করতে পারে। তাই, গত কয়েক বছর ধরে আমেরিকায় এই শেল অয়েল উৎপাদনের জোয়ার উঠেছে। ফলে গত তিন বছর ধরে এই জোয়ার ওঠাতে আমেরিকান মিডিয়ায় শেল অয়েলের বিরুদ্ধে নেগেটিভ দিক যেগুলো আছে তা খুব কমই ছাপা হচ্ছে। এই টেকনোলজির আরেক বড় নেগেটিভ দিক হল এই টেকনোলজি ব্যবহারের তুলনামূলক খরচ মানে তেল বের করা বা তেল তুলার খরচ অনেক বেশি। বলা হয়েছিল বাজারে তেলের দাম প্রতি ব্যারেল ৭০ ডলারের বেশি হলে বেশ আয়েশে এই ব্যবসা করা যায়। সারকথায় তরল জীবাশ্ম তেল উৎপাদনের চেয়ে এর খরচ বেশি। সেটা যাই হোক, আমেরিকার এই শেল অয়েল বা ফ্রেকিং অয়েল উৎপাদন দ্বিগুণ হয়েছে বলেই এই তেল উৎপাদনকারীদের লবি চাপ ইত্যাদিতে পরে এখন চল্লিশ বছর পরে আমেরিকা থেকে তেল রফতানি নিষেধাজ্ঞা তুলে নেয়া হল।

আর ঠিক এখানেই মূল প্রতিদ্বন্দ্বিতা। জীবাশ্ম তরল তেল উৎপাদকদের (মূলত মধ্যপ্রাচ্যের) এক কার্টেল-জোট হল ওপেক (OPEC)। ওপেকের সাথে পশ্চিমের স্বার্থবিরোধ অনেক পুরনো। আমেরিকান রফতানি নিষেধাজ্ঞা তুলে নেয়া উপলক্ষে লন্ডনের সাপ্তাহিক ইকোনমিস্ট গত মাসে ১৮ ডিসেম্বর এক রিপোর্ট বের করেছে। ওই রিপোর্টের প্রথম বাক্যটা অনুবাদ করলে হয় এরকম : “যুগ যুগ ধরে ‘বাজার’ শব্দটা বিশ্বব্যাপী তেলবাণিজ্যে এক আনফিট শব্দ হয়ে আছে। তেল উৎপাদনকারীদের আন্তর্জাতিক কার্টেল ওপেক শুধু তেলের বাজারে ইচ্ছামতো হস্তক্ষেপ করেছেই শুধু নয়, নিজের জন্য নানা মাত্রার সফলতাও বের করে নিয়ে গেছে।” এই বাক্য থেকে ওপেকের সাথে আমেরিকার স্বার্থবিরোধের তীব্রতা টের পাওয়া যায়। সারা দুনিয়ায় যে তেল উৎপাদন হয় এর এক-তৃতীয়াংশ করে ওপেক সদস্যরা সবাই মিলে। আর ওপেকে উৎপাদনেরও এক তৃতীয়াংশের কিছু বেশি একাই উৎপাদন করে সৌদি আরব- এটা প্রতিদিন মোটামুটি ১০ মিলিয়ন ব্যারেল, যেখানে এখন দুনিয়ায় দৈনিক মোট উৎপাদন ৮০ মিলিয়ন ব্যারেলের বেশি। ফলে ওপেকের কোনো সিদ্ধান্তে সৌদি আরবের প্রভাব প্রায় একচেটিয়া। ফলে তেলের বাজারে আমেরিকার শেল অয়েল নিয়ে প্রবেশ ঠেকাতে সৌদি আরব লড়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এ কাজে সে সহজেই ওপেককে নিজের পেছনে দাঁড় করিয়ে নিতে পেরেছে। এখানে শেল অয়েলকে ঠেকানোর সৌদি কৌশল হল- শেল অয়েলের উৎপাদন খরচ তুলনামূলক বেশি, সেটাকে কাজে লাগানো। এ কারণে এক দিকে সৌদি আরব ক্রমান্বয়ে তেলের দাম ফেলে দিচ্ছে। আবার একই সাথে ওপেকে জোটবদ্ধ হয়ে উৎপাদন না কমিয়ে (তেলের দাম বেড়ে যাবে বলে) বরং বাড়িয়ে চলেছে। এভাবে তেলের দাম ফেলে দিয়ে ২০০৩ সালের সমান ২৭ ডলারে নামিয়েছে। প্রতিদ্বন্দ্বীদের বাজার থেকে হটানোর মতো ফল এতে পেয়েছে। যেমন ব্রিটিশ বিপিসহ বহু তেল কোম্পানি ইতোমধ্যে প্রায় আড়াই লাখ কর্মী ছাঁটাই করেছে, নতুন বিনিয়োগ বন্ধ করে রেখেছে, নতুন করে রিগ বসানোর যত পরিকল্পনা তেল তোলা কোম্পানিগুলোর ছিল, সব স্থগিত হয়ে গেছে। এতে ক্ষতি সৌদি আরবের কম হয়নি। বলা হয়, প্রতিদিন নাকি সৌদি আয় ৫০০ মিলিয়ন ডলার মানে হাফ বিলিয়ন ডলার কম হচ্ছে। আইএমএফ হিসাব করে বলছে, এ বছরে মধ্যপ্রাচ্য মোট ৩০০ বিলিয়ন ডলারের বেশি আয় হারাবে। আইএমএফ সৌদি আরবকে সাবধান করেছে এভাবে সীমাহীন তেল উৎপাদন বাড়ানোর বিপদ স্মরণ করিয়ে দিয়ে।

সৌদিদের এই লড়াইয়ে জেতার কৌশল সহজ। তারা মনে করে, দীর্ঘ দিন ২০ ডলার বা কম দামে তেল বিক্রি করে লোকসান সহ্য করার ক্ষমতা একমাত্র তারই আছে। সুতরাং প্রতিদ্বন্দ্বীদের আগে দেউলিয়া বানানোর পরেই সে বাজারের লাগাম টেনে ধরবে, উৎপাদন কমিয়ে তেলের দাম বাড়াবে। এ ব্যাপারে সৌদিদের অনুমিত সময়কাল এক বছর। অর্থাৎ আগামী বছর থেকে বাজার ঘুরে দাঁড়াবে বা সৌদিরা দাঁড় করানোর সুযোগ পাবে। এ বছরের জুন মাসের পর থেকে এসব ব্যাপারে আলামত ফুটতে শুরু করবে সৌদি আরবের বিশ্বাস। এ কাজে তার প্রধান টার্গেট প্রতিদ্বন্দ্বী প্রথমত আমেরিকান শেল অয়েল। আর এর পরের টার্গেট আবার বাজারে ফিরে আসা ইরান। দেখা যাক কার নার্ভ কত শক্ত, কে কতক্ষণ টেকে!

goutamdas1958@hotmail.com

[এই লেখাটা এর আগে দৈনিক নয়া দিগন্ত পত্রিকায় ১৭ জানুয়ারি.২০১৬ সংখ্যায়  এবং ১৬ জানুয়ারি দৈনিক আলোকিত বাংলাদেশ পত্রিকায় ছাপা হয়েছিল। এখানে তা আরও সংযোজন ও এডিট করে ফাইনাল ভার্সান হিসাবে আবার এখানে ছাপা হল।]

Leave a comment